প্রশ্নোত্তর:
শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?
নভেরা হোসেন: ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে দার্শনিক পিতার সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা । মানুষ যে কতটা ইচ্ছা স্বাধীন হতে পারে তা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। মনটা স্বচ্ছ জলের মতো টলটলে ছিল। বাবা মা দুজনেই বই পড়তেন সারাদিন, তবে দু ধরণের বই। বাবা দর্শন , রাজনীতি , ধর্ম , মিস্টিক সাহিত্য , নৃবিজ্ঞান আরো হাজারটা বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতেন। মা বিশুদ্ধ গল্প , উপন্যাস , কবিতা।বইয়ের সেলফ ভর্তি বই আর বই। সে সব নিজেও পড়তে শুরু করলাম। আমাদের ছোটবেলাটা মানে ৮০ ‘র দশকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বয়স্কজন থেকে কিশোর সবাই কম বেশি বই পড়তো। অল্প বয়স থেকেই থেকেই মনে একটা অস্থিরতা দম বন্ধ অবস্থা , বন্ধুদের সব কথা বলতে পারি না। হয়তো রাজনৈতিক কারণে , দেশের নানা পট পরিবর্তন, সামাজিক রক্ষনশীলতা এসব বিষয়তরুণ মনে গভীর ছাপ ফেলতো। ধীরে ধীরে ডায়েরির আশ্রয় নিলাম , কলম বন্ধু। নানাভাবে নিজের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইতাম, স্পষ্ট করতে চাইতাম। নব্বইয়ের দিকে এক ঝাঁক তরুণ কবির সংস্পর্শ। হয়তো মনের ভেতর চাপা অনুভূতি , চাপা কবিতা অন্য কবিদের সংস্পর্শে যেতে আগ্রহী করতো। সেই সময়ে মনে হতো কেউ যেন আমাকে বুঝতে পারছে না, কোথাও যোগাযোগ তৈরী হচ্ছে না। কবিতা ধীরে ধীরে মনের ভিতর জমাট বাঁধতে লাগলো। প্রথম দিকে লিখেছি খুবই এলোমেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ একটা সময় চরম মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর এক সময় মন কিছুটা শান্ত হলো। গল্প লিখতে শুরু করলাম , সেইসব কিছুই প্রকাশিত হয়নি। হঠাৎ কবিতা প্রেম। বিনয় মজুমদারের চাকা কেমন করে যেন হাতে এলো আর দুনিয়াটা বদলে যেতে শুরু করলো। তরুণ বয়সের মানসিক অস্থিরতা, বিধ্বস্ত মন ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে একটা আকৃতি দিতে চাইলো। আর তা কবিতা হয়ে প্রকাশিত হতে লাগলো। পুরোপুরি মনের ইচ্ছেতেই কবিতা লিখি , কোন পূর্ব পরিকল্পনা থাকে না। এই পরিণত বয়সে এসে সামাজিক, বৈশ্বিক, রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত আবেগ- অনুভূতি থেকে কবিতা তৈরী হয়, কখনো কলম নিয়ে বসলে মাথার ভেতর ঘুরতে থাকা বিষয় , অনুভূতিগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। অন্যের কবিতা পড়ার পর অনেক সময় নতুন লেখা তৈরী হয় কিছুটা আক্রান্ত হওয়ার মতো।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষা শৈলির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী ।
নভেরা হোসেন: যখন লিখতে শুরু করলাম ভেতর থেকেই তাগিদ এলো নতুন চিন্তা এবং অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করার জন্য। বরাবরই সাম্যবাদী চিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন। লেখার জন্য যে আলাদা একটা চোখ দরকার তা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলাম, অনেক সময় নির্মোহতা এমন গেড়ে বসতো, বাস্তবতাকে এড়িয়ে নিজস্ব এক জগতে প্রবেশ করতাম। বিষয়ের বাইরে থেকে দেখার একটা প্রবণতা তৈরী হলো। প্রত্যেকের কবিতায় একটা নিজস্ব স্বর থাকে। আর তা ধীরে ধীরে তৈরী হয়। আমার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে ভাষা বিমূর্ত / অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। বর্তমান জটিল বৈশ্বিক রাজনৈতিক বিশ্বকে যেমন দূরবীনের ভেতর দিয়ে দেখতে হয় তেমনি গভীরভাবে পৃথিবীকে দেখা এবং অনুভব করার ফলে তৈরী হতে থাকে কবিতা। নানা বৈচিত্র্যতায় পূর্ণ হতে থাকে কবিতার শরীর -মজ্জা। মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম , প্রেম – অপ্রেম ,মর্গের ভেতরের কাটা – ছেঁড়া , ছাতক চাতকীর নিবিড়তা।
নাগরিক জীবনে নিস্পৃহতা সবকিছু একটু একটু করে কবিতায় প্রবেশ করেছে । এটা কোনো পরিকল্পিত বিষয় নয় | সমসাময়িক পৃথিবী থেকে পাওয়া প্রেম ও ঘৃণা , নিজস্ব চলার প্রকৃতি , চিন্তার প্রকৃতি একেকজন কবির লেখার ভাষাকে তৈরী করে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয় । অতিরিক্ত সংবেদনশীলতার জন্য ভাষা কখনো কখনো নির্মোহতা হারায় আর তখনই বেশি মাত্রায় যোগাযোগ তৈরী হয় পাঠকের সাথে ।
শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
নভেরা হোসেন: সাহিত্যে তথাকথিত শ্লীল – অশ্লীলতা সম্পর্কে আমার তেমন কোনো অনুভূতি নেই । এটা নির্ভর করে কবি বা লেখকের মানসিক গঠনের উপর। যে কবি একটা বদ্ধ পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন তার মধ্যে দু ধরণের প্রকাশ ঘটতে দেখি। এক দল বদ্ধ জলে সাঁতার কাটে অন্য দল কাচের ত্রিশিরা ভেঙে বেরিয়ে আসে সর্পিল পৃথিবীতে। স্তন বা যোনি শব্দটা কবিতায় ব্যবহৃত হলে সাধারণ পাঠক মন অনেক সময়ই হোঁচট খায় কিন্তু কবিকে প্রয়োজনে সকল শব্দ ওঅনুভূতিকে প্রকাশ করতে হবে। না হলে সত্যের অপলাপ হবে। রক্ষণশীল সমাজে কবি লেখকরা অনেক বর্ণনা , অনুভূতি , শব্দকে এড়িয়ে চলেন। তাতে সাহিত্য বাঁধাগ্রস্ত হয়। তবে যে বিষয়েই হোক না কেন তা যদি শিল্পত্তীর্ণ না হয় তা হলে সে লেখাকে অশ্লীল মনে হতেই পারে। সাহিত্যের কাজ বাস্তবতার অনুবাদ তৈরী করা। সে ক্ষেত্রে কোথাও একটু দুর্বলতা বা অদক্ষতা থাকলে একই শব্দ বাতিল হয়ে যেতে পারে কবিতায় বা গদ্যে। বিষয় বস্তু এবং উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও একই বিষয় ঘটে। প্রকৃত পক্ষে কবিতা হয়ে ওঠার জন্য যে দক্ষতা আর সংবেদনশীলতা প্রয়োজন তার অভাব ঘটলে সব লেখাই বাতিল হয়ে যেতে থাকে।
শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আাপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/ বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে কোনো সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।
নভেরা হোসেন: বাংলাদেশ একটি সদ্য স্বাধীন দেশ। ভারতবর্ষের অংশ হয়েই দীর্ঘকাল তার চলাচল। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা একই সুতায় গাঁথা ছিল। কলকাতা ছিল তখন শহর আর বাংলাদেশ বিরাট গ্রাম। তখন কবিতা লেখা হতো শহর কলকাতার রুচি অনুযায়ী। পূর্ব বাংলার কৃষি ভিত্তিক সমাজ কাঠামোতে বেড়ে ওঠা কবিরা বিশাল কোনো নগরের গর্ভে হারিয়ে যেতেন , লিখতেন তাদের ভাষায়। সাহিত্য অনেকটাই রাজনীতি নির্ভর| কেন না রাজনৈতিক পটভূমির উপর দাঁড়িয়ে গঠন হয় মানুষের মনস্তত্ব। বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের কবিতা প্রথম দিকে অনেকটা কলকাতা ঘরানার ছিল। পশ্চিমবঙ্গ মুখিনতা কবিদের আচ্ছন্ন করে রাখতো। ভাষা, শৈলী, বিষয়বস্তু সবকিছুই পশ্চিমবঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তার মধ্যে ব্যতিক্রম কেউ ছিল না তা নয়। আল মাহমুদ , শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক প্রমূখ এদেশের মাটি ও বহু প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে নিজস্ব ধারায় প্রকাশ করেছেন প্রথম থেকে। এরকম অনেকেই রয়েছেন। তবে বর্তমান কালে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কবিতার ভাষা বেশ পৃথক হয়ে পড়েছে। একই ভাষার মানুষ হয়েও দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কবিতা তার নিজস্বতা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। স্থানিক ভাষা , শব্দ , মানুষের জীবনযাপন , দর্শন কবিতায় প্রকাশিত হচ্ছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা। বর্তমান কালের পশ্চিমবঙ্গের কবিতা সেই আঠারো শতকের ধারাবাহিকতায় লিখিত হচ্ছে তবে সেখানেও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের কবিরা ভাষা আন্দোলন ও একাত্তর এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে মনে ধারণ করছে। না চাইলেও এই অভিজ্ঞতা কবিতায় প্রভাব ফেলছে। যে ভূমিতে একটি ভয়ংকর জেনোসাইড বা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেখানকার মানুষের মন মগজে তার ছাপ থাকবেই। কয়েক শতক পর্যন্ত এর প্রভাব থাকবে। বাংলাদেশের কবিতায় এই বৈশিষ্ট্য প্রকট | কলকাতার কবিরা একটি বহুজাতিক দেশে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভাবে টিকে থাকার জন্য লড়াই করে চলেছে। কলকাতার ভাষাতে ঔপনিবেশিকতার প্রভাব রয়েছে যেমন , কলকাতার শিক্ষিত সমাজ তাদের দৈনন্দিন জীবনে, কাজে ইংরেজি ভাষা বেশি ব্যবহার করেন । বাংলা এখন তাদের কাছে সেকেন্ডারি ভাষায় পরিণত হয়েছে। হিন্দি ভাষা বাংলার স্থান দখল করে নিয়েছে। সাহিত্যেও এই বিষয়টি প্রভাব রাখে। কলকতার সাহিত্য নানা ধরণের। প্রাতিষ্ঠানিক ধারায় বা মূলধারায় যারা সাহিত্য চর্চা করেন তারা এক ধরণের সাহিত্য লেখেন যার মধ্যে আপামর জনমানুষের কথা তাদের মুখের ভাষা, চিন্তার ধরণ, জীবন সংগ্রামের কথা এমনভাবে থাকে যা অসম্পূর্ণ। কিন্তু যারা প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখক কবি তারা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ও জীবন সংগ্রামকে সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় করেন। আমাদের এখানেও নানা ধরণের সাহিত্য রচিত হয়। কবিতায় গ্রামীণ আবহ , মনস্তত্ব , জীবন সংগ্রাম কিছুটা আসে । বর্তমানে উত্তরাধুনিক ভাবধারায় আন্তর্জাতিক বিষয় ও চিন্তা কবিতায় প্রচুর ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন ।
নভেরা হোসেন: সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু কবিতা ও গদ্যের বই পড়া হয়েছে। পঠিত বইগুলোর মধ্যে আন্দালীবের কবিতার বই ” বিদূষিকার লণ্ঠন ” – আমাকে বেশ আলোড়িত করেছে। তরুণ কবি আন্দালীব কবিতার ভিন্ন এক স্বর তৈরী করেছেন যা সমকালীন বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেক কবি নিজের মতো লেখেন তবে তার মধ্যে স্বতন্ত্র স্বর সবাই তৈরী করতে পারেন না। হয়তো পুরানো ধাঁচে , চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে থাকেন কবিতায়। আন্দালীব সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বিশেষ করে “বিদূষিকার লণ্ঠন” – বইটির ভাষা শৈলী এবং বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যতা ভিন্ন এক অনুভূতির কাছাকাছি নিয়ে যায় আমাদের। “পিপুল” – কবিতাটিতে চাঁদকে পিপুল গাছের ডালে অর্থাৎ গাছের উপরে উঠতে দেখা যায়, যেখানে মেঘ নেই , হরিণ যত্র -তত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেঘ, পিপুল এবং চাঁদের এক অপূর্ব কোলাজ কবিতাটিকে পাঠকের মনে বহুদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবে।
“আখরোট ভাঙার শব্দ “-কবিতায় প্রকৃতিজাত কাঠবিড়ালির খাদ্য আখরোট কাঠবিড়ালির হাত ফস্কে সমতলে চলে যেতে দেখি , সেই আখরোটকে শস্যাগারে তুলে রাখা হয়। মানুষের খাদ্য হয়ে যায় কাঠবিড়ালির আখরোট। এখানে প্রকৃতি ও মানুষের মিথষ্ক্রিয়া অতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এবং বর্তমানে প্রকৃতির বেশিরভাগ অংশ মানুষই ভোগ করছে। এ বিষয়গুলোর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের ভোগের শিকার হচ্ছে আখরোট ও বিড়ালীরা।
“ইলোরা গওহরের কথা ভাবতে ভাবতে” কবিতাটি সমকালীন মানুষ ও পৃথিবীর একটি বাস্তবিক প্রকাশ। ইলোরা গওহর এখানে একজন সিম্বল যার কথা ভাবা যায় এবং কোয়ারিন্টিনের দুর্ভিক্ষের মধ্যে রিলিফের মালের জন্য অনেকেই অপেক্ষমাণ, যারা এক সময় রিলিফের মালকে পাশ কাটিয়ে চলে যেত তাদেরও রিলিফের লম্বা কাতারে এসে দাঁড়াতে হয়। এই যে বাস্তবতা এবং অর্থনীতির কঠিন কথাটি তাকেঅতি সহজভাবে কবিতায় এনেছেন আন্দালীব।
এই বইয়ের বান্দিশগুলো একটা সুরের মতো কানে এসে বাজে , মনকে সারগামের উঁচু থেকে নিচু স্কেল পর্যন্ত পরিভ্রমণ করায়। কবিতার কাছে মানুষ কি চায় ? অথবা বলা যায় কবিতা পড়ে মানুষের কি অনুভূতি , উপলব্ধি হয়। জাগতিক জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে একটা ভিন্নচোখ, ভিন্ন স্বাদ -এইতো কবিতার গূঢ়তত্ত্ব । কবিতা কখনো শুধুই প্রতিবাদী , কখনো বন্দনা , নতুন করে দেখবার চোখ তৈরী করে দেয় কবিতা। আন্দালীবের কবিতা এই সমস্ত রসদে পূর্ণ।
কবিতা:
ক্রোকোডাইল
আমরা দুজন হারিয়ে যাচ্ছি
আজ নস্টালজিক ক্যাফে
কাল সন্তুর
আরেকদিন সাভার
দুজন দুজনকে নখ দিয়ে আঁচড়াই
জিভ দিয়ে লেহন করি
যখন ইচ্ছে হয় চাবি দিয়ে বন্ধ করে রাখি
যখন ইচ্ছে হয় ধুয়ে ইস্ত্রী করে
আলমারিতে তুলে রাখি
আবার ইচ্ছেমতো পরিধান করি
দুজন দুজনকে অনেক পেতে চাই
আবার এড়িয়ে এড়িয়ে চলি
বৃষ্টিতে ছাতার নিচে
গরমে এসিতে
একজনের রক্তের ভেতর অন্যজন ঢুকে পড়ি
সাঁতার কাটা শেষ হলে
নিজেদেরকে শুকাতে দেই বেলাভূমিতে
কুমিরের ছানারা সব আমাদেরকে
দেখতে থাকে
আমরাও চোখে সানগ্লাস দিয়ে
তাদেরকে দেখি ..
নিস্তব্ধতা
” আমারে কবর দিও হাটু ভাঙার বাঁকে “
শান্ত নদী বহে যায়
ধূসর পাহাড়ের দেশে
ছিপে টোনা মাছ গেঁথে অপেক্ষায় নিস্তরঙ্গ জীবন
একটা গুলির শব্দে সব কিছু বদলে গেলো
শত শত সৈনিক প্যারেড করে যাচ্ছে
গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিলো
উত্তরের এই মহাদেশে
ভয়ানক যুদ্ধ হলো
সবাইকে ছুড়ে ছুড়ে ফেলা হলো
হাঁটু ভাঙার বাঁকে
সভ্যতার মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ
তাদের নিঃশ্বাসের শব্দে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস
আজ আর কেউ মনে রাখেনি তাদের কথা
নদীর উপর দিয়ে উঁচু ওভার ব্রিজ
নিচে তাকালে শান্ত নদী
যেন এক পৃথিবী মানুষ ঘুমিয়ে আছে
পপিক্ষেত আর স্কারলেট ফুল
উপরের তলায় একটা দোকান
নিচে ক্যাফেটেরিয়া
কিছু বিন নেবো ভাবছিলাম আমরা
রেশম পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছিল ভেতরে
কাচ দিয়ে ঘেরা ঘর
বাঁকা চাঁদ আকাশে
আমরা সময়কে ছুতে পারিনা
সময় আমাদের –
নৈঃশব্দ্যের ধ্বনিকে ছুঁতে পারে একমাত্র
নিস্তব্ধতা
নস্টালজিক ক্যাফে
নস্টালজিক ক্যাফেতে ভেটকি মাছের
ফিশ ফিঙ্গার পাওয়া যায়
আরো আছে চিকেন উইংস
কফি আমেরিকানো আর ক্যাপাচিনো
এখানে ধূমপান কক্ষ আছে
অনেকেই আসে-যায়
ওই ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে
তার মধ্যে তুমি চিন্তা করছো
ভৈরব ব্রিজ কি মেঘনা নদীর উপরে ?
ওদিক দিয়েই সিলেট যায়?
সিলেট যাওয়ার সময় তুমিও কি
এই ব্রিজ অতিক্রম করেছিলে ?
বহুদিন আগের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে
মেঘনা নদীর পাশেই কি যমুনা নদী ?
দুজনে দেখা হলো কেন কথা কহিলনা
নদীতে প্রবল ঢেউ তোমার কান্নার সাথে ভেসে যাচ্ছে অস্তগামী সূর্য
ট্রাক ভর্তি ফেরিতে একটাই বাস
বসে আছো ফিরে যাবার অপেক্ষায়
একটা বিস্তৃত জীবন ছেড়ে ফিরে যাওয়া
যেখানে সব আছে শুধু
তুমি আর নাই
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ
ছাদের টবে সাজানো সারি সারি গন্ধহীন ফুল
জবার উচ্চকিত কণ্ঠে পরাগ রেনু চেয়ে আছে
মানুষেরা ভীত পা ফেলছে হিসাব কষে
মুখোশে ঢাকা পড়া ঠোঁট
তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে শ্রাবনের বর্ষণে
তবু একজন অন্য জনের চেয়ে তিন হাত দূরে থাকে
তারের ভেতর দিয়ে ভেসে আসা কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসে
ওপারে কেউ নেই
তুমি তবু কান পেতে থাকো
একটা শঙ্খের নিনাদ
দূরে কোথাও লোনা জল আছড়ে পড়ছে
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ আকাশে
ছেঁড়া ছেঁড়া প্রেম ভাসছে ইথারে
ছুঁতে গেলে দূরে সরে যায়
পাখির পলক সব পড়ে আছে আঙিনায়
নরকের গান
জল সরে সরে যায়
হৃদয় সেও ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ে
এই মুহূর্তে তীব্র আকাঙ্খা
পর মুহূর্তেই নিস্তরঙ্গ জলাশয়
জল কেটে কেটে পানা সরিয়ে
স্বচ্ছ মুখচ্ছবি
আয়নায় শত শত সাদা কফিন
গোলাপে ঢাকা মৃত্যুর শীতলতা
মারি হয়ে এসেছিলে তুমি
বুকে ছুরি বসিয়ে কেটে নিলে
আস্ত একটা হৃদপিন্ড
তারপর থেকে জল ঝরছে
লাল জলে ভেসে গেলো বিছানা
এইসব গোপন কথা
কোনোদিন কেউ জানতে পারে না
স্নিগ্ধ হাসির আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে
নরকের গান
বারান্দার কোণে ঘুমিয়ে আছে
রিলকের একেকটা স্তবক
সেই কাল ঘুম আর ভাঙে নাই তার
কতদিন সে সূর্য দেখে না
রক্তে কমে এসেছে লোহিত কণিকা
তবু যখন তোমার হাত স্পর্শ করে
সেও হয়ে পড়ে একজন মায়াবাসী
খাড়ি কেটে সমুদ্রের জল সব ভর করে চোখে
একেকটা অস্তগামী পুকুর ভরে ওঠে
কুসুমিত আলোয়
হে পাষণ্ড হৃদয়হরণকারী
কি নামে ডাকবে আজ তাকে
সেতো এপিটাফে লেখা হয়ে আছে
নির্জন প্রান্তরে
আয়নায় দেখা চোখ
আয়নায় দেখা চোখ
বলে যায় বিগত দিনের কথা
গোলাপি ফ্রকে দৌড়ে যাওয়া সরু রাস্তা ধরে
তখন সাপের মতো ছিপছিপে পথকে
বিরাট দুনিয়া মনে হতো
দুহাতে কাশফুল জড়িয়ে
অনন্ত আকাশে ভেসে চলা
আড়িয়াল খাঁর পশ্চিম তীরে
ধু ধু একটা পথ
তুমি একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো
আটকে ছিলে নক্ষত্র হয়ে
আয়নায় সেই চোখ দুর্বিনীত চেয়ে থাকে
খুঁজেফেরে হারানো দোকান এল দরাদো
পৌষের রাতে কুয়াশায় ঢাকা সকাল
আস্ত একটা দুনিয়াকে খুলে দেয় চোখের সামনে
বায়োস্কোপে দেখা যায়
আবাবিল পাখি, কারবালার রক্তাক্ত ময়দান
হায় হাসান ! হায় হোসেন !
রব তুলে বুকে ছুরি নিয়ে মহররমের দল
এই চোখ খুঁজে নেয় লক্ষ্মীর পেঁচা
দুর্গার ধারালো অস্ত্র
কেটে চলে শত শত কচি ঘাস
রোবটের দুনিয়া
তুমি চেয়ে দেখো আয়নায় সেই চোখ
আজ আর চেনা যায় না
ফোলা ফোলা, ভেজা চোখ
শুন্যদৃষ্টি
যেন শাপগ্রস্ত মনসা
এই চোখ তুমি আর চেনো না
টুপটাপ ঝরে পরে শীতের রোদে
আয়নার পারদ গলে ঢাকা পরে গেছে বিস্তৃত জীবন
কিরিচের মতো তবু সেই চোখ ঝলসে ওঠে অমাবশ্যার রাতে
অপেক্ষা
বর্ষার ধারাপাতের মতো ঝরছে
একটা রিনরিনে শব্দ ছুঁয়ে আছে
সারা শরীর মনকে
বাইরে ঝকঝকে রোদ
ভাবছো বিগত দিনগুলোর কথা
আরো কত শত দিন পরে আছে সামনে
এসব পার হয়ে পৌঁছে যাবে
কোনো এক অনিদৃষ্টের কালে
প্রতিটা দিন প্রতিটা ক্ষণ
যার জন্য অপেক্ষা সেই
বোধি বৃক্ষের দেখা মেলে না
তুমি তবু সাঁতরে পার হও নিঃসীমকাল
মধ্য থেকে অন্ত
আদি থেকে অনন্ত
একবার মনে হয় পেয়ে গেছো সব
যা কিছু খুঁজছো এতকাল
বারবার শূন্যতায় ভেসে বেড়ানো
সব তছনছ ওই ভাবনার মধ্যেই
সব কিছু ভাসিয়ে দিয়ে
উড়ে চলো দিগন্ত ব্যাপী
এখানে কিছু পাওয়ার নেই
নেই হারাবার
সব কিছু আছে তোমার
সব কিছুই হারিয়েছো
More Posts From this Author:
- None Found