‘আমি’টার (বহুবিধ) প্রদর্শনী আর মেনিফেস্টো

Share this:

পোশাক প্রতীক – বৈভবের, খান্দানের, ব্রান্ডের, আনুগত্যের, পক্ষপাতের, দলবদ্ধতার, প্রতিবাদের, সংক্ষুব্ধতার, প্রতীতীর, প্রজ্ঞার। এটা একটা সংমিশ্রিত র‍্যান্ডাম তালিকা মাত্র। ভেঙে ভেঙে বলা সম্ভব। এমনকি ভেঙে বলিনি বলে পাঠকের বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে বলেও আমার মনে হয় না। এর একেকটা শব্দে কয়েক সেকেন্ড থামলেই তার সম্পর্কিত দৃশ্যকল্প, অভিজ্ঞতা তিনি মনে করতে পারবেন। যাঁরা এই তালিকার মধ্যে ‘বিশ্বাস’ও যোগ করতে চাইবেন, তাঁদের বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেব যে বিশ্বাসও নির্দিষ্ট কিছু বিধি ও বিধানের প্রতি আনুগত্য মাত্র। তার থেকে বৃহত্তর অংশে যাকে তাঁরা বিশ্বাস নাম দিয়ে ডাকেন সেটাকেই আমি প্রতীতী বললাম।

 

এক।। ‘পোশাক যখন পতাকা’

ঢাকা শহরে লুঙ্গি এখনো সুলভ। কিনতে তো বটেই, পরিহিত অবস্থায় মানুষের কোমরের নিচ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় অজস্র লুঙ্গি ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়ায়। জানা মতে, এবং বাহ্যদৃশ্য মোতাবেক এগুলো পুরুষদের কোমর থেকেই ঝুলতে থাকে। তদুপরি ঢাকায় এটা মধ্যবিত্তীয় আলোচ্য বিষয় হিসাবে এটা তেমন গুরুতর কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। তবে ফরহাদ মজহার লুঙ্গি-পরিহিত অবস্থায় ঢাকা ক্লাবে ঢুকতে গেলে, এবং ক্লাব-কর্তৃপক্ষ তাতে বাধা দিলে, এটা কয়েকদিন গুরুতর ঝৈঝগড়ার বিষয়ে পরিণত হয়। সাইবারস্পেসে যেমনটা ঘটে থাকে, অন্তত দুইটা শক্তিশালী পক্ষ লুঙ্গির পক্ষে ও বিপক্ষে, ঢাকা ক্লাব কর্তৃপক্ষের পক্ষে ও বিপক্ষে, ফরহাদ মজহারের লুঙ্গি পরিধান-বিষয়ক মানবাধিকারের পক্ষে ও বিপক্ষে, উপনিবেশের সুফল ও কুফলের পক্ষে-বিপক্ষে তর্কাতর্কি তো চললই; ঠাট্টাতামাশাও (যাকে ট্রল বলা হয়ে থাকে এই পরিমণ্ডলে) খুব চলল। ঢাকার (মধ্যবিত্ত) রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জনাব মজহারের লুঙ্গি এর আগেও নজরে ছিল, এই দফায় দীর্ঘ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে পড়েছিল। তিনি ছাড়া গায়ক-চিন্তক, নবীন প্রজন্মের যদিও, অরূপ রাহীও লুঙ্গির লাগাতার প্রকাশ্য ব্যবহার করে থাকেন। এরকম একটা সময়ে সাইবার তর্কালোচনায় কবি ব্রাত্য রাইসু আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘পোশাককে পতাকা বানাবেন না’।

আলোচ্য দুইজন ছাড়া রাইসুর আহ্বানের আরেকজন উদ্দীষ্ট ছিলেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি অবশ্য লুঙ্গিমুক্তভাবে আলোচিত। জনাব মকসুদের বিবরণী অনুযায়ী তিনি যেটা পরেন সেটা কাফনের কাপড়; দর্শকদের কাছে তা বহুল-সেফটিপিন-মণ্ডিত পপলিনের দীর্ঘ কাপড়। উভয়পক্ষের অনুভব খুব ভিন্ন নয় তাও সত্য, সেফটিপিনগুলো ছাড়া। জনাব মকসুদের দাবি-ঘোষণানুযায়ী ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিবাদে তিনি তা ধারণ করেছেন। রাইসু যে দুর্ভাবনাটা করেছিলেন তা হলো যেহেতু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আশু কোনো সমাপনী দিবস আন্দাজ করা যাচ্ছে না, তাহলে তো জনাব মকসুদের পোশাকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেল! কোনো চিন্তাশীল দরদী মানুষের পক্ষে এই বিষয়ে দুর্ভাবনা না-দেবার উপায় নেই। এই সঙ্কটের পর আমার মহাত্মা গান্ধীর কথাও মনে এসেছে; স্বল্পবসনে তাঁর জীবন কাটিয়ে দেয়া নিয়ে মমতাবোধ না-করে আমি পারিনি। তবে পরিশেষে আমি সান্ত্বনাও পেয়েছি ওইসব অঞ্চল থেকেই। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের দিকপালদের সাংস্কৃতিক পোশাক পরিধান বিষয়ে একটু গাঢ়ভাবে ভাবলে ত্যাগস্বীকারের সুদীর্ঘ ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়। শখ-আল্লাদ সব শেষ করে একটা ঢোলাঢালা আলিগড়ি পাজামা, তাও আমৃত্যু এক রঙের, পরেই কাটিয়েছেন বহু (পুরুষ) নেতা। একটা হাতাকাটা জ্যাকেটে গৈরিক রঙ চাপিয়ে তাঁকে নেহরু-মুক্ত করতে পারলেও, মোদীর পক্ষে কোটটা থেকে মুক্তি ঘটছে কই? আর তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্তদেরও একই দশা! অধুনা ডিজাইনারদের কল্যাণে ‘মোদী কোট’-এর নানাবিধ রঙের উদ্ভাস ঘটেছে; আপনারাও গুগলসার্চ করে তা দেখে নিতে পারেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি অতটাও উদ্ভাসিত হয়নি। দুয়েকজন তরুণ মন্ত্রী অনেক উদ্ভাবনী সামর্থ্য খাটিয়ে অতি সম্প্রতি কালো থেকে নেভি-ব্লু পর্যন্ত নিতে পেরেছেন। নিদিষ্ট পোশাকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকরণে দর্শকের অশান্তিকে খাটো করে দেখার পক্ষপাতী আমি নই।

 

দুই।। প্রতীক নির্মাণ প্রক্রিয়া

আমার নিজের পোশাকের সাথে সম্বন্ধের ইতিহাসও উল্লেখযোগ্য। আমি সতর্ক আছি যাতে পোশাকের একটা আত্মজৈবনিক নিবন্ধ হয়ে না পড়ে এটা। কিন্তু আজকের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে তা সম্পর্কিত। শৈশবে যে অজস্র ভুলভাল শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে, পরিবারে এবং স্কুলটিস্কুলে, তার মধ্যে একটা হলো পোশাকের সংজ্ঞা সংক্রান্ত। মানুষ নাকি লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাক পরে থাকে! তাইলে ছালবাকলা বা পাটের সাবেক দেশে ছালা বহুল প্রচলিত না থাকার কোনোই কারণ নেই। পোশাক যে চিহ্ন বা প্রতীক সেটা বোঝানোর জন্য মোটামুটি ৪-৫ বছরের শিশুদেরকেই ছাত্রছাত্রী বানানো সম্ভব। যাঁদের সন্দেহ আছে, তাঁরা যেন গুটিকয় ৪-৫ বছরের শিশুকে আমার কাছে কয়েক দিনের জন্য এনে দেন।

পোশাক প্রতীক – বৈভবের, খান্দানের, ব্রান্ডের, আনুগত্যের, পক্ষপাতের, দলবদ্ধতার, প্রতিবাদের, সংক্ষুব্ধতার, প্রতীতীর, প্রজ্ঞার। এটা একটা সংমিশ্রিত র‍্যান্ডাম তালিকা মাত্র। ভেঙে ভেঙে বলা সম্ভব। এমনকি ভেঙে বলিনি বলে পাঠকের বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে বলেও আমার মনে হয় না। এর একেকটা শব্দে কয়েক সেকেন্ড থামলেই তার সম্পর্কিত দৃশ্যকল্প, অভিজ্ঞতা তিনি মনে করতে পারবেন। যাঁরা এই তালিকার মধ্যে ‘বিশ্বাস’ও যোগ করতে চাইবেন, তাঁদের বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেব যে বিশ্বাসও নির্দিষ্ট কিছু বিধি ও বিধানের প্রতি আনুগত্য মাত্র। তার থেকে বৃহত্তর অংশে যাকে তাঁরা বিশ্বাস নাম দিয়ে ডাকেন সেটাকেই আমি প্রতীতী বললাম।

আমার শৈশবে অজস্র জামাকাপড় ছিল না। অনেকেরই ছিল না। পূজাতে একটা নতুন জামা অন্তত নির্দিষ্ট ছিল। তখন বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত ন্যায্যমূল্যের দোকানে টেট্রন কাপড় বলে যে বস্তুটা পাওয়া যেত তাতে মাত্র কয়েকটা রঙ। আমার বাবা আশা করতেন আমি সেসব রঙের মধ্যে উজ্জ্বল রঙের (ওখানে উজ্জ্বল রঙ বলতে সেই কালে কিছুই তেমন ছিল না) একটা বাছাই করব। কিন্তু ঘটত যা তা মোটামুটি খুবই আলাদা। কোনো কোনো বছর বাবা নিজেকেও একটা জামা উপহার দিতে চাইতেন, এবং যে রঙের কাপড় নিজের জন্য কিনবেন বলে ভেবে ফেলেছেন সেটাই আমি বাছাই করে বসতাম আমার জন্য। একবারের কথা মনে আছে যে বাবা আমার ‘বুইড়া’ রঙ বাছাইয়ে এতই বিরক্ত হয়েছিলেন যে তিনি ওই কাপড়ই দুজনের জন্য কিনলেন। ওখানেই থামলেন না কেবল, উপরন্তু রহমান কাকার দোকানে প্রায় একই ডিজাইনের দুইটা শার্ট বানানোর বন্দোবস্ত করলেন। আমার সঙ্গে বাবার এই দলবদ্ধতাতে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম, প্রথমে। বাবা বিরক্তিতে নিরুচ্চার ধরনের মানুষ ছিলেন। ফলে যতক্ষণ না তিনি তাঁর বন্ধুদের সামনে ছেলেসমেত একই জামা পরে গিয়ে প্রশ্নের মধ্যে পড়েছেন, ততক্ষণ তাঁর বিরক্তি অতটা আমি বুঝিনি। তিনি ক্রুদ্ধস্বরে জানান দিলেন ‘কী করব বলেন! ছেলে সব বুড়াদের রঙ পছন্দ করে।’ এই এত বছর পরেও আমার কাছে স্পষ্ট হবার কথা নয় ৪২/৪৩-এর বাবার নিজেকে বুড়া দাবি করার হেতু কী থাকতে পারে। কিন্তু সূক্ষ্মবিচারে এটা তাঁর জৈবিক বয়সের প্রসঙ্গ নয়, বরং তার থেকেও ওই রঙটার (বিস্কুট কালার বলতেন ওঁরা) বয়স। কিংবা ওই রঙটাকে প্রতীক হিসাবে যে বয়সবর্গের বলে তাঁরা সাব্যস্ত করেছিলেন। শান্তভাবে ভাবতে বসলে, আমি এটার কারণও জানি যে কেন আমার ওই রঙগুলোই পছন্দ ছিল। নিশ্চয়ই ওইসব অগ্রজেরদের আলাপ-আলোচনায় কান পেতে থাকতে-থাকতে আমি ওই বয়সেই শিখে গেছিলাম ওইসব রঙ ‘রুচিশীল’ রঙ। রুচির লোভে, কিংবা বার্ধক্যের প্রাজ্ঞতার লোভে, আমারও ওসব রঙের প্রতি পক্ষপাত তৈরি হয়ে গেছিল। আমার এই অনুভবকে প্রতারণামূলক ভাবা ঠিক হবে না। কিংবা আমি মনভার করে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওইসব বিস্কুট বা ধূসর রঙ গায়ে চাপাতে চাইতাম তাও অসত্য, বরং খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো ওই বয়সে আসলেই আমার ওই রঙগুলোই ‘পছন্দ’ ছিল। প্রতীকের অর্থ মাথায় ধারণ করতে থাকলে, পছন্দকারিতা কোনো জবরদস্তির বিষয় নয়। হোক তা জামার রঙ, কিংবা ‘জননেতা’র ভঙ!

বলাই বাহুল্য, নিজেরই চেষ্টায়, বা যাত্রাপথে, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আমার পোশাক ও রঙপ্রিয়তার যাবতীয় ব্যাকরণ বদলে গেল; বদলে ফেললাম। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো, যা কিছু ‘রুচি’র ঘোষণাকারী তা কিছু থেকে কয়েক হাত দূরের কাজকর্ম আর পোশাকরাজি করতে ও পরতে থাকলাম। রুচির সঙ্গে আমার ওই যুদ্ধপ্রস্তুতিটা সরল গল্প নয়, বহুমিশ্রিত; আর আজকের প্রসঙ্গ নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে শিক্ষার্থী হিসাবে, এবং পরে, কয়েক বছরের শাস্তিমূলক বিরতির পর, শিক্ষক হিসাবে আমার পোশাক-আশাক (চালচলনসমেত বুঝতে হবে, নাহলে ভ্রান্তপাঠ হবে – ওই যে প্রতীক) এতটাই ‘আপত্তি’র জন্ম দিল যে আমি অনায়াসে উল্লেখযোগ্য ‘ব্যাড কস্ট্যুমড’ কর্মচারী হিসাবে সাব্যস্ত। অবশ্যই কর্তাব্যক্তিদের কাছে মুখ্যত। প্রথমত আমার অজস্র পোশাক ছিল না; কিন্তু স্বল্পসংখ্যক পোশাকেও ‘সহিহ্ কোড’ মানা সম্ভব ছিল। পোশাকের সহিত্বের এই নির্ধারণ সুনির্দিষ্টভাবে কর্তৃত্বপরায়ণতা দিয়ে বুঝতে হবে। এর আর কোনো ফাঁকফোঁকড় নাই। এখন আমার পোশাকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি, আর আমি প্রায় সব রকমের ঘোষণাপত্র আমার পোশাকে বহন করি। এমনকি শেষের দিকে অফিসমার্কা ক্রিজওয়ালা শার্ট-প্যান্টও আচমকা পরে বসি। আমি পাঞ্জাব-পেশোয়ার অঞ্চলে সুপরিচিত ‘কাবলি’ (সালওয়ার ও কুর্তা) একদিন পরেছিলাম।  সময়াভাবে নতুন রঙের নতুন সেট বানানো হয়নি। আমার পছন্দ কালো। বানানো হলে, বা জোগাড় হলে তা পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার বাসনা রাখি।

কিন্তু ধুতি আমি পরেছিলাম মাত্র দুইদিন। অন্তত প্রকাশ্য জনপরিসরে দুদিনের কথাই মনে করতে পারি। একদিন কোলকাতা শহরে সম্ভবত ১৯৯৫ সালে। আমার বোনের বিয়ে যেরকম অনাড়ম্বর ও আইনীভাবে হয়, সেখানে যেকোনো পোশাকই, অন্তত একটা গায়ে থাকলে, গৃহীত হতো। বোনের বড় ভাই হিসাবে আমার যে ‘ইমেজ’ (প্রতীকময়তা) হবু-আত্মীয়দের কাছেও পরিচিত ছিল, নিজপক্ষের কাছে তো বটেই, তাতে অন্য যে কোনো দিনেরই একটা পোশাক পরে গেলেই চলত। বরং ধুতি পরেই কোনো জৈব-তরুণ আসেননি। আমি গেছিলাম। ওটা আমার মজারু উপভোগ ছিল। বোনও তার ভ্রাতার পোশাকবিষয়ক নানাবিধ নিরীক্ষার একটা দিন হিসাবে খুব খুশি ছিলেন। আরেকদিন সম্ভবত ১৯৮৮ বা ১৯৮৯ সালের সরস্বতী পূজার দিন, জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে। শৈশবে সরস্বতী দেবীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ছিল। তিনি আমাকে গাদা গাদা নম্বর দিতেন, যা দিতে তিনি এনটাইটেলড; আর আমি দিতাম অর্ঘ্য, নৈবেদ্য, ভক্তি – সবই, উজাড় করে। পরের দিকে ওটা ওয়ান-ওয়ে ফিক্সড ডিপোজিট হয়ে গেছিল। আমি তাঁকে এসব না দিলেও তিনি যোগান দিতে থাকতেন। আর যতটুকু সামান্য টানাটানি পড়ত, বা পড়েছিল, তাতে দেবী কিছু করতে পারতেন বলে মনে হয় না। বরং প্রশাসকদের কাছে আমার তরফে আরো নম্রতা, আরো আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হতো। তো, এরকম একটা মহতীহৃদয় সরস্বতী পেয়ে যাবার পর তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক একপেশেই ছিল। আমি আর কখনো তাঁকে ঘাঁটাইনি। তিনিও আমাকে নন। কিন্তু সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানটাকে ক্যাম্পাসের সংস্কৃতিমনস্করা একটা ‘সেক্যুলার’ মিলনমেলা হিসাবে দেখতেন। আমার গানের ‘ভক্তদের’ চমক দেবার জন্যই আমি ধুতিটা আগের দফা বাবার সংগ্রহ থেকে নিয়ে এসেছিলাম, ওই অনুষ্ঠানটিতেই পরব বলে।

এই এত বছরে কখনো আমি আর ধুতি পরার কোনোরকম বাসনা করিনি। কেন? এর মুখ্য, এমনকি একমাত্র কারণ এই যে, অন্য যে পোশাক নিয়েই ‘তামাশা’ (বা নিদেনপক্ষে দর্শকের অস্বস্তি) আমি সামলাই না কেন, ধুতির অবধারিত হিন্দুত্বকেন্দ্রিক ‘প্রতীককে’ তামাশার মধ্যে পড়তে দিতে আমি নারাজ ছিলাম। এর থেকে কী সিদ্ধান্তে আসা যাবে? আমি নিষ্ঠাবান হিন্দু? নাকি আমি ধুতি পরলেই বরং হিন্দুত্বের প্রতি আনুগত্য দেখানো হতো? নাকি তামাশা সত্ত্বেও ধুতির আঁচল বাতাসে উড়িয়ে চলাফেরা করাই আমার হিন্দু হিসাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড হতো? নাকি, ধুতিকে হিন্দুত্বে পর্যবসনে আমার সংক্ষোভ জন্মেছে? নাকি এই পর্যবসনের সমাজতত্ত্বকে আমি পাশ কাটিয়ে যেতে চাই? নাকি পোশাকটির তামাশা খোদ একটি সম্প্রদায়ের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রতিই তামাশা হিসাবে দেখার কারণ খুঁজে পাই? নাকি কী?! এর উত্তর বিসিএস-এর মাল্টিপল চয়েসে দেয়া সম্ভব নয়। হয়তো প্রতিটি জিজ্ঞাসাই আন্তরিক মনোযোগী বিশদ ভাবনা দাবি করে। হয়তো আরো জিজ্ঞাসা এর ধারাবাহিকতায় হাজির করতে পারা দরকার।

 

তিন।। প্রতীক-চিহ্নের বিরুদ্ধে শত্রুতা, ঘৃণা আর বিদ্বেষ

প্রথম অংশে আপনাদের আবার নিয়ে চলি, চলুন। বলছিলাম যে, নির্দিষ্ট পোশাকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দর্শকনয়নে অস্বস্তি উৎপাদন হতে পারে। কিন্তু অস্বস্তি মানেই তো ঘৃণা নয়। অস্বস্তিবোধ আর ঘৃণাবোধের সম্পর্ককে চুলচেরা কীভাবে বিচার করতে পারি তা নিয়ে আমি ভাবিত ছিলাম, ও আছি। যদি অস্বস্তির লাগাতার (ভাষাগত) প্রকাশ করতে থাকি তাহলে তা পুনঃ পুনঃ সংঘটিতই হয় না কেবল, বরং সেই পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া শামিল করতে থাকতে পারে পারে আরো আরো জগৎবাসীকে। একটা অশান্তি বা অস্বস্তি পৌনঃপুনিকতার মধ্য দিয়ে একটা গোষ্ঠী সৃষ্টি করতে পারে, আর তা দলগতভাবে এমনসব আচরণ সংগঠিত করতে থাকতে পারে যাকে ঘৃণা বা বিদ্বেষ না বলবার কারণ থাকবে না। চিহ্ন বা প্রতীকের বিরুদ্ধে দর্শকের বা গ্রহীতার ঘৃণা, বিদ্বেষ, শত্রুভাবাপন্নতাকে খুঁটিয়ে-খতিয়ে দেখা আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে। যদি কেউ সেই দায় অস্বীকার করতে চান, করুন; কিন্তু রাজনৈতিকভাবে চেতনার দাবিদার হলে আপনার আর ছাড় নেই। বসুন, রসুন, ভাবুন এবং সাব্যস্ত করুন কোন কোন ঘৃণা-বিদ্বেষ-শত্রুতার আপনি সংগঠক-বাহক-সঞ্চালক-সহমর্মক হবেন না। যদি অনবধানবশত, জোশের চোটে, হয়ে থাকেন তাহলে তা মেরামতি করুন। যদি ভেবেচিন্তেও আপনি নির্দিষ্ট কোনো প্রতীকের বিরুদ্ধে আপনার লাগাতার/সিস্টেমেটিক ঘৃণাকে অপলোপ ঘটাতে না পারেন, তাহলে তো স্পষ্ট যে আপনার ওই প্রতীকের বিরুদ্ধাচরণ করার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। এমন প্রতিপক্ষতা তো ইতিহাসে আছেই, তা নিয়ে আলাদা করে বিচলিত হবার কারণ নেই। তবে দুর্ভাবনার আছে যখন আপনি কিছু প্রতীকের বিরুদ্ধে আপনার বিদ্বেষকে ‘রুচি’, ‘স্বাধীনতা’, ‘অগ্রসরতা’ এইসব হেভিওয়েট ভুজুং দিয়ে সাফাই গাইতে চেষ্টা করছেন। যখন আপনি আপনার বিদ্বেষকে (বা অন্তত প্রতিপক্ষতাকে) জাস্টিফাই করছেন প্রতীকধারীর বা চিহ্নবাহীর ‘পশ্চাৎপদতা’, ‘পরাধীনতা’ আর ‘কুরুচি’র রায় দিয়ে। প্রতীকধারীর স্বভাবচরিত্রের থেকে আপনার অসহিষ্ণুতাই তখন আমার অধিক মনোযোগে থাকে। বিচারকার্য পরিচালনের ও রায়প্রদানের আপনার এই পরাক্রমকেই বিপজ্জনক হিসাবে দেখতে পাই আমি।

মোদীজির (তিনি জীবিত, ও উদাহরণ হিসাবে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ) কোট পরিহিতবৃন্দকে তামাশা করা আর হিজাবীদের তামাশা করার সাংস্কৃতিক মূল্য যে এক নয় এটা বোঝার জন্য টপর‍্যাংকড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিম্যান্টিক্সে ডিগ্রি করে আসার দরকার পড়ে না। প্রতীক স্থান, কাল ও ঐতিহাসিকতা নির্দিষ্ট। আজকে হিজাবের যে গুরুত্ব নির্দিষ্ট হয়েছে তার কারিগরি লুক্কায়িত আছে গত কয়েক দশকের পাশ্চাত্যীয় কাঠামোগত মুসলিমবিদ্বেষের গহ্বরে। তাই ইরানের যে নারী রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা (অবশ্যই চলছে ঈশ্বরের নামে) উপেক্ষা করবার জন্য হিজাব-বর্জনের ডাক দিচ্ছেন তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলানোর পাশাপাশি, ডেট্রয়েটে বা ঢাকায়, মিলানে বা ময়মনসিংহে, বস্টনে বা বরিশালে, যেসব নারী হিজাব ধারণ করেন, তাঁর প্রতীকবহনের স্বাধীনতাকে কবুল করতে পারেন। এই দুই কর্মকাণ্ডের কারণে আপনাকে বৈপরীত্যময়-দ্বিচারী-স্ববিরোধী সাব্যস্ত করার কারণ নেই। বরং আপনার অবস্থান খুবই বোধগম্যভাবে স্থান-কাল-পরিপ্রেক্ষিত ধারণ করে। এতে আপনার বিপ্লবী চেতনা ভূলুণ্ঠিত হবারও সম্ভাবনা দেখি না। কবুল না করলেই বরং নিশ্চিত হওয়া যাবে, ওই যে শৈশবে রুচি আর মুক্তির গালগল্প শুনে শুনে লিবেরেল একদলা ঘিলু বানিয়েছেন, সেই ঘিলু এখন শক্ত শাসনে রেখেছে আপনাকে। এত শাসনে রেখেছে যে নিজের চৈতন্যের লিগ্যাসি থেকেই আর লিবার্টি নিতে পারছেন না।

আপনার লিবেরেল মস্তিষ্কভূতটি আপনাকে ছেড়ে দিক! আপনি সার্বভৌমভাবে জাগরুক সচল কিলবিল-করতে-থাকা অজস্র প্রতীকের দিকে তাকাতে পারুন! মানুষ মরে যায়, প্রতীকও মরে যায়! প্রতীকের জানবাজি বিরোধিতা করতে-করতে আপনার চিত্ত যাতে মরে না যায়!

 

Manosh Chowdhury teaches social anthropology at Jahangirnagar University, lectures in some other areas, writes across genres, mostly in Bangla.

 

 

 

 

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!