আল-জাজিরার একটি প্রতিবেদন, কিছু প্রতিক্রিয়া এবং ‘মাফিয়া-রাষ্ট্রের’ কদর্য রূপ

Share this:

আমি কোনোভাবেই বলার চেষ্টা করছি না যে, আল জাজিরার প্রতিবেদন একদম নিখুঁত, শতভাগ সত্য। এর শক্তি ও সম্ভাবনা জায়গাটা চিহ্নিত করা দরকার, আবার এর দুর্বলতাগুলোকে জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। এতে উত্থাপিত ‘শক্তি ও সম্ভাবনাময়’ বিষয়গুলো নিয়ে সরাসরি ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, আবার ‘দুর্বল’ বিষয়গুলোর পর্যালোচনা করা- অন্তত সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই হওয়া উচিৎ ছিল স্বাভাবিক কর্ম। অন্তত নাগরিক হিসাবে এটা বোধহয় আমাদের চাওয়া।   

 

আল জাজিরা ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন [ডকুমেন্টারি আকারে] প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাতন্ত্রের একটি অন্ধকার দিককে ফুটিয়ে তোলা, তাও আবার দুর্দান্ত কারিগরির সহিত টানটান উত্তেজনাকর গল্পের মাধ্যমে, প্রায় যে কোনো দর্শক [বা, পাঠক]-কে মুগ্ধ করেছে। যারা পরবর্তীতে এই সংবাদ নিয়ে সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিলেন তারাও শুরুতে নির্মাণশৈলীর প্রশংসাকে কবুল করে আলাপ বাড়িয়েছেন। তবে অনেকেই বলেছেন বা বলার চেষ্টা করেছেন যে, আল জাজিরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে যে মাফিয়াদের কীর্তিকলাপ পর্দায় হাজির করেছে, সেটা তো বাংলাদেশের প্রায় সকলেই জানেন, হয়তোবা এতোটা তরতাজা অবস্থায় না হলেও এমন মাফিয়াতন্ত্রের আন্দাজ তারা আগ থেকেই জানতেন। আগ থেকেই জানি- এই বলার মধ্যে খানিকটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা নিজেদেরকে আরেকটু ‘পাকা’ হিসাবে হাজির করার খায়েশ থাকতেই পারে, কিন্তু এটা তো সত্য যে, বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই বহুজন বলেছেন এই রাষ্ট্রে মাফিয়াতন্ত্র বা লুটেরাতন্ত্র কায়েম হয়েছে। হয়তোবা সেই বলার ‘স্বর’ এতোটা উঁচু ছিল না, বরঞ্চ খানিকটা নিচু স্বরেই বলতে হতো। আল- জাজিরা সেই ‘স্বর’কে আরো একটু জোর এনে দিয়েছে। চরম ফ্যাসিবাদী এই সময়ে এটাই বা কম কিসে!

আল-জাজিরার ডকুমেন্টারিতে কি দেখানো হয়েছে সেটা দর্শক পাঠক দেখেছেন, যে যে যার যার মত করে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। আমার আগ্রহ আপাতত এদিকে না, বরঞ্চ এটা আমাদের চেহারার আরো কিছু অংশ উন্মোচন করেছে, [যা অবশ্য সংবাদের বিষয়বস্তু ছিল না]। মানে, এই সংবাদের প্রতিক্রিয়াগুলো সংবাদের বিষয়বস্তুর বাইরে আরেক বাস্তবতা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।

 

সরকারি বিবৃতিসমূহ ও ‘রাজনৈতিক নকশা’

সংবাদের প্রকাশের পরপরই বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হয়, সেখানে আল-জাজিরার প্রকাশিত সংবাদকে প্রত্যাখান করা হয় এবং ‘নিন্দা’ জ্ঞাপন করা হয়। কিন্তু এখানে সে প্রত্যাখ্যানের ভাষাটা গুরুত্বপূর্ণ: ‘১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ যে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যাচ্ছে, এই প্রতিবেদনে তার সম্পূর্ণ বিপরীত বলা হয়েছে।’ প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সাথে মাফিয়াচক্রের পারিবারিক ও রাজনৈতিক যোগসাজশ। কিন্তু সরকারি বিবৃতি উক্ত সংবাদকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য বা উক্ত মাফিয়া আখ্যানকে বৈধতা দেয়ার জন্য একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামকে টেনে নিয়ে আসা হলো। বাংলাদেশের বিদ্যমান ফ্যাসিবাদের মতাদর্শিক যোগানে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার ধ্রুপদী উদাহরণ হতে পারে এই বাক্য।

সরকারি বিবৃতি উপরোক্ত সংবাদের বিষয়বস্তুর বিপরীতে কোনো তথ্য তুলে না ধরে বরং প্রকাশিত সংবাদের ‘নিয়ত’ নিয়েই বেশি টানাহেঁচড়া করতে আগ্রহী। উদাহরণস্বরূপ এই বাক্যটা: ‘আল-জাজিরা এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে নিজেকে হিংসাত্মক রাজনৈতিক নকশার হাতিয়ার হওয়ার সুযোগ দিয়েছে, যা বাংলাদেশকে দুঃখিত করেছে।’

একইভাবে সেনা সদরের বিবৃতির ভাষ্যমতে, তিনটা কালেক্টিভ কারণে এই সংবাদ নিন্দনীয়। এক, ডেভিড বার্গম্যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিত একজন অপরাধী; দুই, সামি মাদকাসক্তির অপরাধে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে বহিষ্কৃত একজন ক্যাডেট; তিন তাসনিম খলিলের নেত্রনিউজ ‘অখ্যাত’। অর্থাৎ সংবাদের সাথে জড়িত কুশীলবের আখলাক-আচার-আচরণ সংবাদের ‘সত্যতা’র নির্ধারক।

আল-জাজিরা বা যে কোনো মাধ্যমের প্রতিবেদনই শতভাগ ‘সত্যতা’ হাজির করে না, দুর্বলতার উপস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। এর কোন কোন জায়গা ‘অসত্য’, কোন জায়গা ‘দুর্বল’ সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য তুলে ধরা যাদের বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে তাদের কর্তব্য। কিন্তু এমন কোনো কিছু না করে, স্রেফ প্রতিবেদনের ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে প্রশ্ন তুললে কেবল ‘প্রপাগান্ডা’ ব্যতীত আর কিছুই হয় না।

সরকার সমর্থকদের বয়ান আসলে এই চক্রের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কারো কারো মতে, ‘সমস্যাটা’ আসলে আল জাজিরার পূর্বতন ইতিহাস। আল জাজিরা বিভিন্ন সময়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে’ কথাবার্তা না বলে উল্টো চোখ রাঙাইছে, ফলে আল জাজিরার সংবাদ বিশ্বাসযোগ্য নয়। অর্থাৎ, প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু এখানে সত্যমিথ্যার নির্ধারক নয়, খোদ আল জাজিরার অতীত এখানে নির্ধারক। উল্লেখ্য, আল জাজিরা সম্পর্কেও খোদ আওয়ামী বয়ানেই বিরোধাত্মক কথাবার্তা শোনা গেলো। কেউ কেউ বললেন, আল জাজিরা জামাত ফান্ডেড, ইসলামি মৌলবাদীদের সহিত তাদের গভীর যোগসাজশ। আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, আল-জাজিরার কাজ হলো মুসলমান দেশগুলোর দোষ বের করা। একইভাবে তাসনীম খলিল, সামি, বার্গম্যানের ‘আচরণ’ অনেকের কাছে ‘নিন্দনীয়’ মনে হওয়ায় আল-জাজিরার সংবাদকে বিশ্বাস করতে আগ্রহী নয়। কারো কারো মূল আগ্রহ আল-জাজিরার উদ্দেশ্য বা নিয়তের দিকে। আল জাজিরার নিয়ত যেহেতু ‘সহি’ না সেহেতু এই সংবাদও বিশ্বাসযোগ্য নয়। সরকারপক্ষীয় বুদ্ধিজীবীদের বয়ান এখন পর্যন্ত মোটাদাগে সরকারি বিবৃতি দুটোকে কেন্দ্র করেই ঘুরছেন। ফলে এক অর্থে বলা যায়, কেউই আল-জাজিরায় প্রকাশিত ‘সত্যে’র বিপরীতে অন্য কোনো ‘সত্য’ হাজির না করে বরঞ্চ ভিডিও নির্মাণের বা সংবাদ পরিবেশনের ‘দুর্বলতা’ বা ‘দেখে মন ভরেনি’, ‘নিয়ত সহি না’ ধরণের মতামত বা বিবৃতি প্রদানেই ব্যস্ত।

 

বাংলাদেশের গণমাধ্যম: কবরের নিস্তব্ধতা বনাম গোয়েবলসীয় প্রচারণা

এই সরকারি বয়ানকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার কথা ছিল গণমাধ্যমের। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে [একেবারে সবগুলোতে] আল-জাজিরার অনুসন্ধানীমূলক এই তথ্যচিত্রের ব্যাপারে দেখা গেলো কবরের নিস্তব্ধতা ও সুনসান নীরবতা। সরব হলো সরকারি বিবৃতি আসার পর, সেই বিবৃতি প্রচার করার মাধ্যমে। গণমাধ্যম যে ‘সরকারি বিবৃতির প্রচারমাধ্যম’ হয়ে গিয়েছে তার এমন নগ্নরূপ পূর্বে দেখা গিয়েছে বলে মনে হয় না। তবে নামীদামী দুয়েকটা পত্রিকা আল-জাজিরার প্রতিবেদন নিয়ে সংবাদ করার পরিবর্তে ‘কেনো সংবাদ করতে পারছে না’ এই প্রশ্নের মিনমিনে উত্তর দিতে সচেষ্ট হয়েছে। যারাই উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন তাদের কণ্ঠে অসহায় সুর ফুটে উঠেছে।

আমি কোনোভাবেই বলার চেষ্টা করছি না যে, আল জাজিরার প্রতিবেদন একদম নিখুঁত, শতভাগ সত্য। এর শক্তি ও সম্ভাবনা জায়গাটা চিহ্নিত করা দরকার, আবার এর দুর্বলতাগুলোকে জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। এতে উত্থাপিত ‘শক্তি ও সম্ভাবনাময়’ বিষয়গুলো নিয়ে সরাসরি ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, আবার ‘দুর্বল’ বিষয়গুলোর পর্যালোচনা করা- অন্তত সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই হওয়া উচিৎ ছিল স্বাভাবিক কর্ম। অন্তত নাগরিক হিসাবে এটা বোধহয় আমাদের চাওয়া।

এই অসহায়ত্ব, বা একদিকে নীরবতা অন্যদিকে সক্রিয়তার কারণ বহুবিধ। ডেইলি স্টারে মাহফুজ আনাম যখন আল-জাজিরার প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান নীরবতা নিয়ে লিখেন তখন অধিকাংশ সময় তিনি ব্যয় করেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং দেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বিরাট হুমকি সে বিষয়ে প্রায় সবাই একমত। কথা বলা, ছবি আঁকা, কার্টুন আঁকা ইত্যাদির জন্য হরেদরে নাগরিকগণ হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। এই আইন যে একটি অলিখিত সেন্সরশিপ চালু করেছে তার একটা নমুনাও বর্তমান পরিস্থিতি সাক্ষ্য দিচ্ছে। ডয়েচ ভেলের একটি টকশোতে একজন সাংবাদিক [তিনি সরকার সমর্থক কি না তা আপাতত উহ্যই রাখলাম], যিনি কিনা জাজিরার প্রতিবেদনকে বারেবারে নাকচ করে দিচ্ছিলেন, তিনিও যখন বারেবারে দেশীয় পরিস্থিতি দোহাই পাড়ছিলেন তখন তার আর্তনাদও শোনা যাচ্ছিলেন। মানে তিনি তার তর্কে যে ‘বিষয়’টা অস্বীকার করছিলেন, তা করতে গিয়ে প্রকারান্তরে তিনি আরো বড়ো বিষয় স্বীকার করে নিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের নাগরিকদের মাথার ওপর যতদিন এমন আইন বিরাজ করবে ততদিন আসলে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম ক্ষমতার কাছে প্রশ্ন না করে, ক্ষমতা ও কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায্য প্রশ্ন না তুলে, জবাবদিহি না চেয়ে উল্টো জনগণকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে- গত কয়েকবছরের বিভিন্ন আন্দোলন থেকে এই অভিজ্ঞতা আমরা পেয়েছি। এবারও দেখা গেলো যে, আল জাজিরার প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষমতা ও কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন না তুলে যে বা যারা প্রশ্ন তুলেছেন [অনুসন্ধানের মাধ্যমে] উল্টো তাদেরকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে। ভারতের সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনে সেখানকার গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে একজন কৃষক বলেছিলেন, গণমাধ্যমের যেখানে উচিৎ ছিল সরকারকে প্রশ্ন করা, সেখানে তারা উল্টো জনগণকেই প্রশ্ন করছে। গণমাধ্যম আসলে সরকারি মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কেবল নিরবই থাকে নি, উল্টো যা করে যাচ্ছে তাকে গোয়েবসলীয় প্রচারণা ব্যতিরেক আর কিছুই বলা যায় না। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি কোম্পানির সার্ভেলেইন্স যন্ত্রপাতি কেনার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। সেনাবাহিনী তাদের বিবৃতিতে দাবি করেন যে, যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য’। কিন্তু জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে দেয়া তথ্যটি প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু বাংলাদেশের অনেকগুলো সংবাদমাধ্যম জানায়, জাতিসংঘ নাকি জাজিরার প্রতিবেদনই প্রত্যাখ্যান করেছেন। সম্প্রতি আবার বাংলাদেশ থেকে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। তার মানে যা দাঁড়ালো, নিজ দেশের গণমাধ্যমকে দলীয় ফুট-সোলজার হিসাবে ব্যবহৃত হবে, আবার যাদেরকে ফুট-সোলজার হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না, যারা আমার ‘না-পছন্দ’ সংবাদ প্রকাশ করবে তাদের আওয়াজ যেন জনগণ পর্যন্ত না পৌঁছায় সে ব্যবস্থা করা হবে।

 

ফ্রিডম অফ প্রেস: ব্যবসা ও রাজনীতির বেড়াজালে   

তবে এই গণমাধ্যম কেবল ‘সরকারি’ নয়, ‘বেসরকারি’ গণমাধ্যমও এতে অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে বেসরকারি গণমাধ্যমের সংখ্যা উর্ধ্বমুখী হওয়া সত্ত্বেও এখানে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বা ফ্রিডম অফ প্রেস বা ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন নিম্নমুখী। কারণ হিসাবে যেমন আইনি বিষয় রয়েছে [ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা মনে করুন], তেমনি এর সাথে জড়িত মিডিয়া-মালিকানার ইস্যু। বাংলাদেশের মিডিয়া কে চালাচ্ছে? মিডিয়ার সাথে এখানকার রাজনীতির সম্পর্ক কি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে আলী রীয়াজ ও মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমানের ‘Who Owns the Media in Bangladesh’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে। সেখানে বিভিন্ন মিডিয়া আউটলেটের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, মালিকদের প্রোফাইল, পারিবারিক অবস্থান, রাজনৈতিক অবস্থান ইত্যাদি নাড়াচাড়া করে তিনটা বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এক, বহু মিডিয়া আউটলেট পারিবারিক সদস্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। দুই, মিডিয়া আউটলেটগুলোর অধিকাংশ মালিকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জড়িত। তিন, প্রায় সকল মিডিয়া আউটলেটের মালিকানা হচ্ছে বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যাদের বিবিধ অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়া রয়েছে।

রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কটা আবার চার তরিকায় হয়। এক নাম্বার তরিকা হচ্ছে, মিডিয়া আউটলেটের জন্য কে লাইসেন্স পাবে আর পাবে না সেটা নির্ভর করে সরকারের সাথে বাঁ ক্ষমতাসীন দলের সাথে তার দহরম-মহরমের ওপর। দুই নাম্বার তরিকা হচ্ছে, খোজ রাজনীতিবিদরাই মিডিয়া মালিকানার লগে যুক্ত। তিন নাম্বার হচ্ছে, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাকে লবি হিসাব ব্যবহারে করে। চার নাম্বার হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তনের সাথে সাথে মিডিয়ার মালিকানা পরিবর্তন হয়।

প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, প্রধানত চারটা ব্যবসায়ী সেক্টরে মিডিয়া মালিকদের সরব উপস্থিতি রয়েছে: ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইনস্যুরেন্স, এনার্জি এবং রিয়েল এস্টেট। ‘Each of these sectors has attracted attention in the past years for shoddy deals and political connections with the incumbent.’

মিডিয়া আউটলেটের মালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলো, মানে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর ব্যক্তিবর্গ আবার বিভিন্ন ব্যাংকের উচ্চাসনে বসে আছেন। এবং ঋণখেলাপীদের মধ্যে বহু মিডিয়া মালিকও রয়েছেন। এটা কেবল একটা সেক্টরের কথা উল্লেখ করলাম, বাকি সেক্টরগুলোতেও একধরণের হাল। আবার এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে আছে এমন সংবাদ যে প্রচণ্ড সেন্সরের মুখোমুখি হয় তার একেবারে রিসেন্ট উদাহরণ হচ্ছে ইউল্যাবের ঘটনা। ফলে সাংবাদিকদের যেমন নির্যাতন-জেল-জুলুমের ভয় রয়েছে, তেমনি ভয় রয়েছে চাকরি হারানোর।

কোন রাজনৈতিক বিষয়ে জনমত গড়ে উঠবে, কোনটাতে আলো পড়বে না, কোনটা নীরবে এড়িয়ে যাওয়া হবে, কোনটার স্বপক্ষে সম্মতি উৎপাদন করা হবে, আবার কোনটাতে অসম্মতি উৎপাদন করা হবে – এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আসলে মিডিয়া মালিকানা, মালিকপক্ষের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ফায়দা এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় আইনের ওপর শর্তাধীন। এমনিতেই বাংলাদেশের সংবিধান বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে কথা বলার স্বাধীনতাকে বন্দী করে রাখলেও ‘বাক স্বাধীনতা রয়েছে’ এমন একটা মিথ চালু এখানে করা সম্ভব হয়েছে। ফলে, আমাদের ‘স্বাধীনতা’ বন্দী অজস্র বেড়াজালে। আমাদের ‘স্বাধীনতা’ শ্বাস নেয়ার জন্য হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু পারছে না।

 

মাফিয়া রাষ্ট্র: অস্বাভাবিকতার স্বাভাবিকরণ

তবে সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিও তাদের ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে তারা ‘সুষ্ঠু’ বলে রায় দিয়েছিলেন, এবারও তারা বিবৃতি প্রদান করে আল-জাজিরার নিন্দা করেছেন। আল জাজিরায় প্রকাশিত সংবাদের বিষয়বস্তুকে তারা ‘বাংলাদেশ বিরোধী’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ মাফিয়াচক্রের সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের পারিবারিক যোগসাজশের যে ইশারা এই প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে, সেটা তাদের চোখে ‘বাংলাদেশ বিরোধী’। বিবৃতিতে যে ‘বাংলাদেশে’র কথা বলা হয়েছে সেটা যে ‘মাফিয়াস্টেট’ তা প্রকারান্তরে শিক্ষক সমিতি মেনে নিচ্ছেন। মাফিয়া রাষ্ট্রে মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সংবাদ তো সে রাষ্ট্র বিরোধী-হ হবে!

এই মাফিয়ারাষ্ট্র বিষয়টা কি? কেনইবা বলছি আল-জাজিরার প্রতিবেদন বাংলাদেশের এই চেহারাই হাজির করেছে? এর উত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দীন খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসে পাওয়া যাবে। ‘মাফিয়া রাষ্ট্রের সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য হলো – রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের কোনো পর্যায়ে আইনের শাসন বলতে কিছু থাকেনা। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা অপরাধীদের অভয়ারন্য হয়ে উঠে। এই শাসন ব্যবস্থায় শক্তিমানের সাথে ব্যক্তিগত আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে। তাই এরকম রাষ্ট্রে যে কোন পর্যায়ে শক্তিমানের সাথে বন্ধন খুব গুরুত্বপূর্ণ নিজের নিরাপত্তা ও স্বার্থ সুরক্ষার জন্য। এই বন্ধন ক্রমধারাবাহিক। উদাহরণ হিসেবে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি ধরা যাক। নিজের ব্যক্তি স্বার্থ সহজে হাসিল করার জন্য একজন শিক্ষক বলতে পারেন, ‘আমি উপাচার্যের লোক’; আবার ‘উপাচার্য বলতে পারেন আমি প্রধানমন্ত্রীর লোক’! সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে একজন সংবাদ কর্মী বলতে পারেন ‘আমি সম্পাদকের লোক’; সম্পাদক বলতে পারেন, ‘আমি মালিকের লোক’; আবার মালিক বলতে পারেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর লোক’! এরকম অবস্থায় নাগরিকেরা প্রতি পর্যায়ে নিজেদের সব সময় প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকে আমি অমুকের লোক! আবার রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীও নিজেদের রক্ষা করার জন্যে সহিংসতা-আশ্রয়ী হয়ে উঠে। এতে সংগঠিত অপরাধ বা Orgnised crime – কে রাষ্ট্রের সহিংসতা থেকে অনেক সময় আলাদা করা যায়না।’ [ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১] তানজীমউদ্দীন সারের ছোট লেখাটাতে আল-জাজিরার প্রতিবেদনের একেবারে গোড়ার বিষয়টা উঠে এসেছে।

বিদ্যমান মাফিয়াতন্ত্রকে একেবারে ‘সাধারণ’ হিসাবেই মেনে নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। এমনকি যে বা যারা এই সরকারের শুভানুধ্যায়ী [যেমন ডয়েচভেলের টকশোতে নাইমুল ইসলাম খান] তারাও একের অধিক বার বলছেন, তারা সবই আগে থেকে জানতেন। আল জাজিরার প্রতিবেদন এমন কিছুই দেখাতে পারেনি যা তারা জানতেন না। তার মানে, বিদ্যমান এই পরিস্থিতিকে তারা স্বাভাবিক হিসাবেই মেনে নিয়েছেন, এবং এটা নিয়ে যে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না সেটাও তারা মেনে নিয়েছেন। উক্ত টকশোতে যখন তাসনীম খলিল সেনাপ্রধানের রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহারের নজির [স্বজনকে ওয়ার্ড কমিশনার বানানো] দিয়েছিলেন, তখন সেই ‘নজির’কে উপস্থাপক ও নাইমুল ইসলাম খান স্রেফ উড়িয়ে দিলেন এই বলে যে, এইটা তো খুব ‘ছোট’ ঘটনা। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির এই স্বাভাবিকরণটাই হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সবচেয়ে ভয়ের জায়গা, সবচেয়ে আশঙ্কার জায়গা। ক্ষমতাসীনরা এগুলোকে স্বাভাবিক হিসাবেই হাজির করার আপ্রাণ চেষ্টা-চরিত করবেন, যেমন এখন করে যাচ্ছেন।

এখানে কিন্তু মাফিয়াতন্ত্রের দায়ভার গণমাধ্যমের কান্ধে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে না। বরঞ্চ এমন ফ্যাসিবাদী ও মাফিয়াতন্ত্রের কবলে আমাদের গণমাধ্যমও তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। যে একব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় ব্যক্তির ‘রেফারেন্সে’ বা নামে বিভিন্ন কার্য হাসিল করা যায় [বৈধ ও অবৈধভাবে], এবং সেই ‘সু-সম্পর্কের’ বদৌলতে ‘আমার তো গুণ্ডা লাগে না, র‍্যাব-পুলিশই আমার গুণ্ডা’, ‘আমি মন্ত্রী হবো কেন, আমিও তো ওদের নাচাই’ ডায়লগ ছুড়ে দেয়া যায়, সেই ব্যবস্থাকে উপচে না ফেলা পর্যন্ত আসলে আমাদের আর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের ‘নাগরিকরা’ যে ‘প্রজা’র জীবন যাপন করছেন তা থেকে উত্তরণ পাওয়ার জন্য ‘দাবি থেকে প্রতিবাদ, প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধে’র দিকেই যাত্রা শুরু করতে হবে।

সিস্টেম কীভাবে ফাংশন করে তা মানুষের সামনে খোলাসা করাটাই বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, এক্টিভিস্ট, রাজনৈতিক-কর্মীদের অন্যতম কাজ বলে মনে করি। বিশেষ করে এই সর্বাত্মক ক্ষমতাতন্ত্রের আমলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দিকে যাত্রা শুরু করার জন্য এটা জরুরি। আমি একজন এক্টিভিস্ট, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক কর্মী কী চাই, কোনটাকে জরুরি বলে মনে করি, কোন রাজনীতিকে আপাত জরুরি বলে মনে করি, সেটা উপস্থাপন করা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি প্রয়োজনীয় জনগণের সামনে সিস্টেম ও ক্ষমতাতন্ত্রকে ন্যাংটো করা, ক্রমাগত বিব্রত করা, ষড়যন্ত্র করা। অর্থাৎ, এই তন্ত্র কীভাবে টিকে আছে, কীভাবে কাজ করছে সেগুলো তুলে ধরা। আমজনতা ‘আম’ এর মতো নিষ্ক্রিয় সত্তা নয়, নাট-বল্টু যত বেশি খুলবেন, ক্ষমতার নাট-বল্টু যত বেশি মানুষের সামনে উন্মোচন করবেন ‘আমজনতা’ নিজেই তখন নিজের পথটাকে বেছে নিতে পারবে। কখন কীভাবে কোন পথ জনতা বেছে নিবে, সেটা কোনো নীলনকশা অনুযায়ী হবে না। অবশ্য ভিশন থাকতেই হবে। এরপর থেকে যখনই কেউ বলবেন এই রাষ্ট্র একটা মাফিয়ারাষ্ট্র, তিনি কিন্তু বুকে জোর নিয়া বলবেন। এইটাই শক্তির জায়গা। এমন উন্মোচন প্রক্রিয়া ফ্যাসিবাদ বিরোধী [তা নিজেকে এই নামে চিহ্নিত করুক আর না-ই করুক] প্রত্যেককে শক্তি যোগান দিবে। না চাইলেও দিবে। আল-জাজিরার প্রতিবেদনের প্রধান জরুরত আসলে এখানেই। আমাদের প্রয়োজন এমন অনেক হুইসেল ব্লোয়ার।

 

Sohul Ahmed, activist, and author. Topics of interest are politics, history, liberation war, and genocide. Published Books: Muktijuddhe Dhormer Opobabohar (2017), Somoyer Bebyocched (2019), and Zahir Raihan: Muktijuddho O Rajnoitik Vabna (2020)

 

 

More Posts From this Author:

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!