উন্নয়নের যাঁতাকলে চিম্বুক পাহাড়

Share this:

সেনাকল্যাণ ট্রাস্ট ও সিকদার গ্রুপের দাবি অনুযায়ী ২০০৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১৬ একর জমি বান্দরবান সেনাজোনের নামে আবেদন করা হয়েছে। সেই ১৬ একরের অবস্থান প্রথমে জীবননগর দেখানো হলেও পরে ৩৫৫ নং সেপ্রু মৌজার কাপ্রু পাড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিস্ময়কর বিষয় হল- ১৬ একর জমির আবেদন করা হলেও ৮০০ একর জায়গার ওপর চৌহদ্দি দেওয়া হয়েছে!

 

বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ! তাই মানুষের মাথাপিছু আয়ের সাথে সাথে চিন্তা ও মনের দিক থেকেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে এ চিন্তা ও মননে কতটুকু উদারতা-বিশালতা এসেছে সেই প্রশ্নে নাই-বা গেলাম! কিন্তু এটা সত্যি যে, টাকা তো মানুষের হাতে আসছে- সেটা কাঁচা টাকা হোক বা হকের হোক! বর্তমানে বিনোদন, ভ্রমণ, লং ড্রাইভ, শহর থেকে দূরে কোথাও নিরিবিলিতে ঘুরতে যাওয়াটা হল মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক ধরনের স্ট্যাটাস! এই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম হল সবচেয়ে সহজলভ্য ও কাছের নিশানা। তাই চিম্বুক পাহাড়, বগালেক, সাজেক, কংলাক, নীলগিরি যেন তাদের কাছে সস্তার দার্জিলিং!

দেশের মানুষ দেশকে দেখতে চাইবে, জানতে চাইবে এতে দোষের কিছুই নাই। পাহাড়বাসীদেরও এতে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু আপনি যখন একটা নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে যাবেন তখন সেখানকার পরিবেশ, সংস্কৃতি, মানুষদের প্রতি সম্মান বজায় রাখাটাও যে ভদ্রতা সেই ভব্যতা ক’জনের থাকে! হৈ হৈ রৈ রৈ করতে করতে পাহাড়ে গিয়ে সেখানকার শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশকে নষ্ট করা নিশ্চয় কোন সভ্য মানুষের কাম্য হতে পারেনা। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় বলে- পাহাড়ে দিনের পর দিন এই অভব্যতা-ই ঘটে চলেছে। অবাধে পরিবেশ দূষণ করা হচ্ছে, স্থানীয়দের সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানা হচ্ছে। এটা মনে রাখা দরকার- পার্বত্য চট্টগ্রাম কোন বিনোদন পার্ক নয়। সাজেক, কংলাক কিংবা চিম্বুকের সৌন্দর্য দেখতে যাওয়ার আগে এটা কি কারোর মনে কখনো উদয় হয়- সেসব পাহাড়ের সৌন্দর্যের আড়ালে কত মানুষের হাসি-কান্না, দুঃখগাথা আছে? এসবের হিসাব কি কেউ কখনো তলিয়ে দেখেছেন?

সম্প্রতি বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে স্থানীয় আদিবাসীদের বিশেষত ম্রো সম্প্রদায়ের ভোগদখল করা প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ একর জমি দখল করে ‘ম্যারিয়ট’ নামে একটি পাঁচ তারকা হোটেল ও অ্যামিউজমেন্ট পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। এটি যৌথভাবে নির্মাণ করছে সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ও বিতর্কিত সিকদার গ্রুপ (আর এ্যান্ড আর হোল্ডিংস)। এই পাঁচ তারকা হোটেলের সাথে থাকবে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাতায়তের জন্য আধুনিক ক্যাবল কার, রাইড, বিলাসবহুল ভিলা। এসব নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে ওই এলাকা জরিপ করে সেখানে সাইনবোর্ডসহ খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। এ জরিপকৃত বিশাল এলাকায় রয়েছে ম্রো পাড়াবাসীদের শত বছর ধরে সংরক্ষিত পাড়া বন, শশ্মানভূমি, জুম পাহাড়, বনজ-ফলদ বাগান। এখানে জনবসতি এলাকার মধ্যে কাপ্রুপাড়া, দোলাপাড়া ও এরাপাড়া সরাসরি উচ্ছেদের শিকার হবে। একইভাবে মার্কিনপাড়া, লংবাইতংপাড়া, মেনসিংপাড়া, রিয়ামানাইপাড়া ও মেনরিংপাড়া উচ্ছেদ হুমকির মুখে থাকবে।

যে ম্রো পাহাড়ে একটা প্রাইমারি স্কুল নেই! একটা জুনিয়র হাইস্কুল পর্যন্ত নেই সেখানে ‘পাঁচ তারকা হোটেল’ কী জিনিস সেটা স্থানীয়দের পক্ষে বিশেষত যারা শহুরে পরিবেশ থেকে দূরে থাকেন তাদের বোঝার কথাও নয়। তবে তারা যতই অক্ষরজ্ঞান শূন্য হোন না কেন তাদের কাছে এটা পরিষ্কার যে, এ তারকাখচিত ‘হোটেল’ তাদের রুটিরুজি, পায়ের তলার মাটি আর বাপ-দাদা’দের রেখে যাওয়া বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন জুম পাহাড় কেড়ে নেবে! হ্যাঁ, অন্তরের এই ডাকটাই ‘পাঁচ তারকা’র মতন ক্ষমতাধরদের সাথে তাদের অসম লড়াইয়ের মূল শক্তি!

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসেও ম্রো সম্প্রদায়কে যদি এখনও একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি জুনিয়র হাইস্কুলের দাবি জানাতে হয়, চিৎকার করে সে কথা বলতে হয় তাহলে এ লজ্জা ওই সম্প্রদায়ের নয়! এ লজ্জা সরকারের, এ ব্যর্থতা রাষ্ট্রের।

ম্রো’দের পিঠ আজ পাহাড়ে ঠেকে গেছে। তাই নিজেদের অস্তিত্বের জন্য তারা, যাকে বলে আবালবৃদ্ধবণিতা পথে নেমে এসেছেন। অস্তিত্ব সংকটের গিরিখাদে দাঁড়িয়েও শান্তিপ্রিয় ম্রো’রা সহিংসতার পথ নয়, বেছে নিয়েছেন কালাচারাল শোডাউনের মতন অহিংস প্রতিবাদের পথ। যে বাঁশির সুর আর ঢোলের আওয়াজ এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে আনন্দের মুর্ছনা তুলত, আজ সেই বাঁশির সুর কেন বিষাদে ছেয়ে গেল? কতটা গভীর বেদনা আর কষ্ট হলে সুরেলা বাঁশিও নীল হয়ে যায়? নীল কষ্টে ভরা বাঁশির এ কান্নার আওয়াজ কি আপনারা শুনতে পান?

১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে জলে ডুবা মানুষগুলো ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে একটুখানি শুকনো জমির খোঁজে যে যার মত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। ফলে তারা পরিবার থেকে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বংশানুক্রম ধরে চলে আসা পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে। তেমনিভাবে এ তারকা খচিত ‘ম্যারিয়ট হোটেল’ ম্রো’দের শুধু ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের শত বছরের সামাজিক বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে তা নয়, এর নীলাভ আলোর নীল বিষ ম্রো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ ছড়িয়ে দেবে।

বড়সড় সমাবেশ হয়েছে বলে আজ সকলেই জানলেন ম্রো’দের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়ে সেখানে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কখনো সদম্ভে, কখনো নীরবে পাহাড়িদের, এই ম্রো’দের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়ে রিসোর্ট, রাবার বাগান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে সে খবর কজনই বা রাখেন। আরেকদিকে রাতের আঁধারে অজানা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত জেনেও কেউ কেউ হচ্ছেন দেশান্তরী।

সেনাকল্যাণ ট্রাস্ট ও সিকদার গ্রুপের দাবি অনুযায়ী ২০০৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১৬ একর জমি বান্দরবান সেনাজোনের নামে আবেদন করা হয়েছে। সেই ১৬ একরের অবস্থান প্রথমে জীবননগর দেখানো হলেও পরে ৩৫৫ নং সেপ্রু মৌজার কাপ্রু পাড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিস্ময়কর বিষয় হল- ১৬ একর জমির আবেদন করা হলেও ৮০০ একর জায়গার ওপর চৌহদ্দি দেওয়া হয়েছে!

চিম্বুকে পাঁচ তারকা ম্যারিয়ট হোটেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সেনাকল্যাণ ট্রাস্ট ও সিকদার গ্রুপের সাথে বান্দরবান জেলা পরিষদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের খবরও কোন কোন পত্রিকায় এসেছে। পার্বত্যচুক্তি লঙ্ঘন করে বান্দরবান জেলা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে এ নির্মাণকারী গ্রুপের পক্ষে এতবড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা নিশ্চয় সম্ভব নয়। তবে বান্দরবান জেলা পরিষদ যদি এ বিষয়ে একেবারেই ওয়াকিবহাল না হয়ে থাকে, বা সিকদার গ্রুপের দাবি অনুযায়ী বান্দরবান জেলা পরিষদের ৮ শতাংশ শেয়ার থাকার বিষয়টি যদি ডাহা মিথ্যা হয়ে থাকে, তাহলে জেলা পরিষদ কেন এখনও এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না বা হোটেল নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে না? আমাদের সকলের প্রশ্ন এখানেই।

পাহাড় কেটে বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ, হোটেলের শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাসস্থান নির্মাণ, পাহাড়ের ঝিরি বা ঝরণায় বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম লেক বানিয়ে পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা করা হলে প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য সেটা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ২০১৭ সালের চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলার ভয়াবহ ভু’মিধসের ঘটনার পরও কি আমাদের পরিবেশ রক্ষা নিয়ে শিক্ষা হবে না?

 

এ মুহূর্তে সিরাজ সিকদারের ‘চিম্বুক পাহাড়’ কবিতার কয়েকটি লাইন বারবার মনে ভাসছে-

“ঝর্ণা-পাহাড়-জঙ্গল

কত পথ ভেঙ্গে দেখা ভ্রাতৃপ্রতিম পাহাড়িদের সাথে

আত্মীয়তা- নিবিড় আতিথেয়তা সহজ সরল।

এখনও তারা শোষকের কপটতা-প্রতারণা শেখে নাই।

এখনও রয়ে গেছে তারা আদি সাম্যবাদের কাছে সমাজতান্ত্রিক সমাজের যেন ছবি। …….

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যায় মুরং মেয়ে

অঙ্গে তার ছোট্ট আবরণী, কী নিটোল স্বাস্থ্যবতী

কবে তার কাঁধে শোভা পাবে রাইফেল একখানি।”

 

সাড়ে চার দশক আগে এ বিপ্লবী যে চিম্বুক পাহাড়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজ কি তবে সেই অচেনা চিম্বুকই সত্যি হতে চলেছে! তরুণ প্রজন্মের চোখে আজ আমরা প্রতিবাদের আগুন দেখছি। আগামীকাল সেই আগুন সারা ম্রো পাহাড়ে স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়লে এর দায় কে নেবে?

উত্তরে সাজেক, দক্ষিণে চিম্বুক- পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামটাই যেন ভূমিখেকো, মুনাফা লোভী ও ক্ষমতাসীনদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। স্থানীয় অধিবাসীদের একের পর এক গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে পর্যটনের বিকাশ ঘটিয়ে কার টেকসই উন্নয়ন করা হচ্ছে?

দেশের উন্নয়ন হোক সেটা নাগরিক হিসেবে আমরা সকলেই চাই। কিন্তু উন্নয়নের নামে- অন্যের অনিষ্ট করে, কাউকে নিজ বাস্তুভিটে থেকে উচ্ছেদ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে কোনভাবেই উন্নয়ন বলা যায়না। কোন এলাকার উন্নয়ন করতে গেলে অবশ্যই সেখানকার স্থানীয়দের মতামত ও সম্মতির ভিত্তিতে উন্নয়ন করতে হবে, তবেই সে উন্নয়ন টেকসই হবে।

সবশেষে আমাদের দাবি- শান্তিপ্রিয় ম্রো’রা যেন বাপ-দাদাদের রেখে যাওয়া পাহাড়ের গায়ে প্রকৃতির সাথে মিশে তাদের বংশপরম্পরায় যাপিত নিরিবিলি জীবন কাটাতে পারে। তাই অচিরেই পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করা হোক। ম্রো পাহাড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হোক।

 

Ilira Dewan is a human rights activist, columnist, and former General Secretary of Hill Women’s Federation.

 

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!