কার্টুনিস্ট কিশোরের সাথে কারাগারে আজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা

Share this:

কিশোরদার সর্বশেষ যুদ্ধটা ছিল করোনার বিরুদ্ধে। করোনা নিয়ে সরকারের খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে। অসংখ্য কার্টুন এঁকেছেন প্যান্ডেমিকের শুরুর দিকে। আর সেই আঁকাই তাঁর জন্য কাল হল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হল। আজ ৮ মাস ধরে অন্ধকার কারাগারে আছেন কিশোর। জনতার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর।

 কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ২০২০ সালের একুশে বইমেলার শেষের দিকে। এরপরেই করোনা শুরু হয়ে গেলো। ফলে কয়েকবার কথা হলেও আর দেখা হবার সুযোগ ছিল না। এবছর কিশোরদার একটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছিল। বইয়ের নাম ‘ভালোবাসার চারা গল্প’। বইটার মোড়ক উন্মোচন করার জন্য খুব উদগ্রীব ছিলেন কিশোরদা। আমি বারবার ওনাকে নিরুৎসাহিত করছিলাম। আমার কাছে বইমেলার মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে বইয়ের মোড়ক খোলাকে একটা বাতুলতা মনে হয়। এই উন্মোচন দেখে একটা লোকও বই কিনতে আসে বলে আমার মনে হয় না। আমি আমার কোন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে খুলিনি। এখানে ঘন্টার পড় ঘন্টা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, এরমাঝে আবার বড়বড় মহারথি অতিথিরা আসলে সিরিয়াল ভেঙে ওনাদের আগে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

আমি কিশোরদাকে বললাম যে দাদা মোড়ক উন্মোচন করে কি লাভ? আমরা প্রকাশনীর সামনে বই হাতে কিছু ছবি তুললেই তো হয়ে গেলো। কিন্তু কিশোরদাকে কোনভাবেই বোঝানো গেলো না। এই ত্যাড়া মানুষটি তিন ঘন্টার মত অপেক্ষা করে, কয়েকবার মোড়ক উন্মোচন মঞ্চের লোকজনের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করে ঠেলেঠুলে স্টাইজে উঠলেন। স্টেইজে উঠে মাইক হাতে কিশোরদা বললেন,

‘আমি স্টেইজে উঠেছি একটা কারণে। আমার এই বইটি আমি উৎসর্গ করেছি প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ভাইকে। প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে তাঁর অফিসে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছিল মৌলবাদীরা। সেই হত্যার বিচার হয়নি। বইমেলায় কেউ তাঁকে স্মরণ করে না। না লেখকেরা, না প্রকাশকেরা। আমি আজকে এই স্টেইজে উঠেছি শুধু একটা কথা বলতে যে আমরা কিছু তরুণ কিন্তু দীপনদাকে ভুলি নাই। আমরা এই হত্যার বিচার চাই।’

মনে পড়ে আবরার ফাহাদকে যখন হত্যা করা হল তখন একলাই নেমে গিয়েছিলেন প্রতিবাদ করতে। বাংলাদেশের সবকটি প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে লড়াই করেছেন কার্টুনিস্ট কিশোর।

 

সাংবাদিক কাজল যখন নিখোঁজ হলেন তখনো সোচ্চার ছিলেন কিশোর। যখন তাঁকে বর্ডার থেকে ধরে আনা হল তখনো তিনি তাঁকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন সোচ্চার ভাবে। দশ বছর আগে কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে যখন মৌলবাদীদের হুমকির মধ্যে পড়তে হয়েছিল তখন বাংলাদেশের যেই গুটি কয়েক মানুষ সোচ্চার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কিশোর। শুধু জাতীয় নয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও আরিফুর রহমানের মুক্তির দাবীতে সোচ্চার ছিলেন কিশোরদা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা রকস্টার আজম খানের যুদ্ধের গল্প নিয়ে একটা কার্টুন সিরিজ করার চেষ্টা করেছিলেন।

 

শাহবাগ আন্দোলনে সবচেয়ে সোচ্চার মানুষদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন করতে গিয়ে যখন ল্যাজেগোবরে অবস্থা করে ফেলল সরকার তখনো তাঁকে সোচ্চার হতে দেখেছি। লিখেছিলেন-

“বিয়াই ভাইরাস!

স্বাধীনতার এতো বছর পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী রাজাকারের বিতর্কিত তালিকা প্রনয়ন করলেন, একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্মের কাছে দোষ চাপালেন পেন ড্রাইভের, হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয়, তিনি, পেন ড্রাইভে ডেটা ট্রান্সফারের সময় ভুলভালের জন্য ‌‌’বেয়াই ভাইরাস’ এর উপরেও দোষ চাপাবেন। রাজাকারের মধ্যে যে কতোশতো ‘আপনজন’ মিশে আছে!

ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানের সাথে চুদুরবুদুর করতে পারলে, একটা পরিবারের সাথে তা করতে কতোক্ষণ?”

 

পাকা ধান কেটে দিয়েছিল আওয়ামীলীগের নেতা। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে সেই ছবি ভাইরাল হয়ে যায়। কার্টুনিস্ট কিশোরের আঁকা কার্টুন তখনো আমাদের আন্দোলনের ভাষা হয়েছিল।

 

মৌলবাদের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। রাজাকার নিয়ে, হানাদার বাহিনিকে নিয়ে অসংখ্য কার্টুন তো এঁকেছেনই। শফি হুজুরের তেঁতুলতত্ত্বের প্রতিবাদে তারচেয়ে সোচ্চার আর কে হয়েছিলেন?

 

আমাজান জঙ্গলে যখন আগুন লাগলো আমাদের দেশের সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবীরা খুব সোচ্চার হয়েছিলেন অথচ সুন্দরবন ধ্বংস করে যখন বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হচ্ছিল তখন কাউকে দেখা যায়নি একটি শব্দ উচ্চারণ করতে। কিশোর সেটাকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নিজের শিল্প দিয়ে।

 

কিশোরদার সর্বশেষ যুদ্ধটা ছিল করোনার বিরুদ্ধে। করোনা নিয়ে সরকারের খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে। অসংখ্য কার্টুন এঁকেছেন প্যান্ডেমিকের শুরুর দিকে। আর সেই আঁকাই তাঁর জন্য কাল হল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হল। আজ ৮ মাস ধরে অন্ধকার কারাগারে আছেন কিশোর। জনতার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর।

অক্সিজেন সিলিন্ডারে পাওয়া যাচ্ছিল না। সরকার তবুও নির্লজ্জভাবে নিজেদের সফল দাবী করে যাচ্ছিল। কিশোর লিখলেন-

“যারা দেশের সম্পদ নিজের বাপদাদাদের মনে করেন এমনকি এই করোনা দূর্যোগে হাসপাতালের অক্সিজেন সিলিন্ডার কুক্ষিগত করতে নিজেদের ভিভিআইপি,ভিআইপি এবং আইপি পরিচয় দিয়ে সিস্টেম করছেন, তাদের জন্যে চাই আনলিমিটেড কেজি’র নাসিমোভিডিলিন্ডা”

 

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আবিষ্কৃত কিট নিয়ে অসংখ্য নাটক হল। সেটা নিয়ে আঁকলেন কিশোর! মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোষহীন কিশোর!

 

করোনা চিকিৎসায় ভিভিআইপিদের বিশেষ হাসপাতালে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। এই নিয়ে অনেক কার্টুন আঁকলেন কিশোর। তাঁর কার্টুনে সাধারণ মানুষের কথা আসলো। বারবার যেমনটা আসতো।

 

প্রচন্ড জীবনমুখি একজন মানুষ আহমেদ কবির কিশোর। কখনো অন্যায়ের সাথে নূন্যতম আপোষ করেননি। যেখানে আদর্শের সাথে আপোষ করতে হয়েছে সেখানে কাজ ছেড়ে চলে এসেছেন। অসংখ্য চাকরি ধরেছেন ছেড়েছেন। গণমানুষের হয়ে এঁকেছেন একেরপরএক কার্টুন।

লোকটার সবচেয়ে বড় দুর্বল জায়গা ছিল বাংলাদেশ। এতো এতো শহীদের রক্তে অর্জিত একটা বাংলাদেশ এই বাংলাদেশ দিন দিন শাসকদের হাতে ধ্বংসের মুখে পড়ছে সেটা কখনো মানতে পারতেন না। খেয়ে না খেয়ে এর বিরুদ্ধে লড়তেন।

আজ আট মাস ধরে কার্টুনিস্ট কিশোর কারাগারে। অসম্ভব মেধাবী এই মানুষটির দেশকে অনেক কিছু দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক অনেক কাজ করতে চেয়েছিলেন। জানি না অন্ধকারে থাকতে থাকতে তিনি আর এই দেশ নিয়ে ভাবেন কি না।

বাংলাদেশে এখন একটা অন্ধকার সময় চলছে। লেখার জন্য, কথা বলার জন্য, মত প্রকাশের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অহরহ গ্রেফতার হচ্ছেন লেখক, কার্টুনিস্ট, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতি কর্মী আর সাধারণ ছাত্ররা। এই অন্ধকার সময়টা কখন কাটবে জানি না। কিন্তু এটুকু জানি কখনো যদি কাটেও সেটা কাটবে আমাদের সম্মিলিত আওয়াজ ওঠানোর পরেই।

আসুন আমরা অন্যায়ভাবে গ্রেফতার হওয়া প্রতিটি মানুষের মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হই। মুক্ত থাকার সময় ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হওয়া প্রতিটি মানুষের জন্য লড়েছেন কার্টুনিস্ট কিশোর। আজ তাঁর বিপদের দিনে তেমন কাউকেই কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না। আজ যদি আমরা আওয়াজ না ওঠাই কাল আপনার আমার পক্ষে কেউ দাঁড়াবে না।

কার্টুনিস্ট কিশোরের মুক্তি চাই

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল কর

 

Arif Rahman is a researcher and author focusing on genocide, Bangladesh, and political science.

 

 

 

 

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!