ভারত এক বৃহৎ কারাগারে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকারসহ মানুষের সামগ্রিক কর্তাসত্তা নির্মম লিঞ্চিং এর শিকার ভারতে। এই পরিস্থিতি থেকে সহসা কোন উত্তরণ আছে কিনা জানিনা, তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রচলিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, নির্জীবতার মধ্যেই ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্টদের সমন্বয়ে নতুন এক নাগরিক শক্তি বিজেপি-আরএসএস এর নৃশংস রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে।
And it’s what makes writing the most perilous of activities, whose consequences are not literary prizes or good or bad reviews. For some of us, every sentence, spoken or written, real or fake, every word, every punctuation mark can be torn from the body of a text, magled and turned into a court notice, police case, a mob attack, a television lynching by crazed anchors-or, as in the case of the journalist Gauri Lankesh and so many less well-known others, an assassination. -Arundhati Roy (রায়, ১৭৫)
বাংলাদেশে করোনা মহামারির কালেও আমরা যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ক্রসফায়ারসহ নানাবিধ রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মহামারি প্রত্যক্ষ করেছি ; ঠিক একইভাবে আরো বিশদ আকারে, আরো নির্মমভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে সম্পূর্ণ সরকারি পরিকল্পনা মোতাবেক। ভারতরাষ্ট্র এক ভয়াবহ রাজনৈতিক মহামারিতে আক্রান্ত। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট, গবেষক, শিক্ষক, নারীবাদী, শিল্পীসহ যাবতীয় প্রকারের ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় ক্র্যাকডাউন চালানো হচ্ছে।
বিশেষত মুসলমান ও দলিত সম্প্রদায়ের জন্য ভারত ক্রমেই এক নরকে পরিণত হতে চলেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এবং তাদের মূল পৃষ্ঠপোষক আরএসএস এর যৌথ প্রযোজনায় ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানানোর সকল আয়োজন সম্পন্ন। যদিও ভারত তার জন্মলগ্ন থেকেই সেক্যুলারিজম এর মোড়কে উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরই রাষ্ট্র (রায়, ১১০)। তারপরেও এতকাল পর্যন্ত ভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষার অন্তত একটা আপাত স্বীকৃতি ছিল। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে একেবারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সাংবিধানিকভাবে ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানানোর পাঁয়তারা চলছে।হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ এর নামে বহু ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি-জাতির এক মহাজনপদকে একটি সমরূপ প্রদেশে পরিণত করার আত্মঘাতী যজ্ঞে লিপ্ত ‘সংঘ-পরিবার’।
‘হিন্দুরাষ্ট্র’-প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ
অরুন্ধতী রায় যথার্থই চিহ্নিত করেছেন যে, বর্তমান বিজেপি-আরএসএস আদর্শিক ও রণকৌশলগত ভাবে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ এবং হিটলারের নাৎসিবাদের অনুরক্ত ও অনুসারী হলেও, ফ্যাসিবাদ কিংবা নাৎসিবাদের সাথে আরএসএস-বিজেপির তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। নাজি জার্মানি যেখানে একটি দেশের মতাদর্শকে গোটা ইউরোপে, এমনকি ইউরোপের বাইরেও বিস্তৃত করতে উদ্যত হয়েছিল; অন্যদিকে, আরএসএস একটি মহাজনপদকে একটি একক ভাষিক-ধর্মীয় প্রদেশের মধ্যে ঠেসে দিতে বদ্ধপরিকর। (রায়, ১১২)
মোদী-অমিত শাহ’র মতো ঘোষিত হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে বিজেপি-আরএসএস ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের ক্ষমতায় আসার প্রথম ছয়মাসে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলোতে একবার চোখ বুলালেই পরিস্কার হবে মোদি-শাহ গং বহু ভাষা-বহু জাতি-বহু ধর্মের ভারতকে কোনদিকে নিয়ে যেতে চায়।
দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ভয়ংকর পদক্ষেপটি ছিল কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা কেড়ে নেয়া। রাষ্ট্রপতির নির্দেশ জারির মধ্য দিয়ে মোদি সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিয়েছিল, যা জম্মু-কাশ্মীরকে এতকাল ধরে অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে দুই টুকরোও করে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। রাজ্য থেকে লাদাখকে বের করে দিয়ে নতুন এক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিশেবে তৈরি করা হয়েছে, যার কোনো বিধানসভা থাকবে না।

যদিও সংবিধানের ৩৭০ ধারার তেমন কোন কার্যকারিতা ছিল না, কাশ্মীরকে পৃথিবীর সবচাইতে ঘন সামরিক অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার মাধ্যমেই দমন করে রাখা হয়ছে; তারপরেও এই স্বায়ত্তশাসন, আলাদা পতাকা, নিজেদের প্রধানমন্ত্রী, স্বতন্ত্র সংবিধান, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি ছিল কাশ্মীরের সাথে কেন্দ্রীয় ভারতের সর্বশেষ সংযোগ।
এই ধারা বাতিলের মাধ্যমে কাশ্মীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় ভারতের উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছে। করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি জনপ্রিয় হওয়া লক-ডাউন, স্টে হোম, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং ইত্যাদির শব্দবন্ধনীর আলাদা কোন তাৎপর্য কাশ্মীরিদের কাছে নেই। কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেয়ার আগে থেকেই কাশ্মীরীদের সমগ্র পৃথিবী, এমনকি নিজেদের কাছ থেকে নিজেদেরকেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
ভারতের প্রায় সমস্ত নিয়মিত ও বিশেষ বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, ঊর্দি পরিহিত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা অপরূপ নৈসর্গের কাশ্মীরকে এক বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা হয়েছে। আধুনিক দুনিয়ায় এর প্রতিতুলনা কেবল চলে ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্টাইন নামক ভয়ংকর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সাথে। (এমবেম্বে, ৭৮-৮২)

কাশ্মীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রের উপনিবেশে পরিণত করার চারমাসের মধ্যে আরো তিনটি প্রলয়ংকারী পদক্ষেপ নেয়া হয়। বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের রায়, আসামে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি অফ সিটিজেন্স (এনআরসি) এর আওতায় প্রায় বিশ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া এবং গোটা ভারতব্যাপী এনআরসি প্রণয়নের ঘোষণা দেয়া ; সর্বশেষ মুসলিমবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) প্রণয়ন করা। এই তিনটি পদক্ষেপ সম্মিলিতভাবে ভারতজুড়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অপরায়নের শর্ত তৈরি করেছে।
বিশেষত মুসলমান, দলিত, খ্রিস্টান এবং দরিদ্র শ্রেণীর নারীদের জন্য এনআরসি-সিএএ এক জলজ্যান্ত দানব হিশেবে হাজির হয়েছে। সিএএ প্রণয়নের পর থেকেই এক অভূতপূর্ব প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে ভারত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রবিক্ষোভ এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। দিল্লীর শাহিনবাগেসম্পূর্ণ গেরস্থ বয়োবৃদ্ধ নারীরা সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো অহিংস আন্দোলন গড়ে তুলেছে। সেই আন্দোলনের অন্যতম ফ্রন্টলাইনার বিলকিস দাদী টাইম ম্যাগাজিনের ২০২০ সালের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় স্থান পেয়েছেন। ভারতের আরও একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে টাইম ম্যাগাজিনের শীর্ষ প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি ইণ্ডিয়ার ‘Divider in Chief’ নরেন্দ্র মোদি।

ভিন্নমতাবলম্বী দমন
অন্যদিকে গেরুয়া বলয়ও আইন-বেআইন দুইভাবেই নজিরবিহীন ত্রাসের রাজত্ব জারি রেখেছে। ভিন্নমত মাত্রই অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর-পূর্ব দিল্লীতে পরিকল্পিতভাবে মুসলিমবিরোধী সহিংসতা উস্কে দেয়া হয় প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় আয়োজনে।

সেই সহিংসতাকে কেন্দ্র করে এখন গোটা ভারতজুড়ে ‘উইচ হাণ্ট’ এর মতো ‘ডিসিডেণ্ট হান্ট’ (dissident hunt) শুরু করেছে মোদি সরকার।স্বৈরাচারী আইন ইউএপিএ’র (UAPA-Unlawful Activities Prevention Act) আওতায় উমর খালিদ, শারজিল ইমাম, শাফুরা জাগুর, নাতাশা কারওয়াল, দেভাঙ্গানা কালিতাদের মতো তরুণ সাহসী গবেষক, অ্যাক্টিভিস্টদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
হাজার হাজার পাতার চার্জশীট তৈরি করেছে দিল্লী পুলিশ এবং রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ উস্কে দেয়া, জনমনে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা উস্কে দেয়ার মতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দমনমূলক সব অভিযোগ আর ধারায় বুদ্ধিজীবী, গবেষক, আইনজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট, মুসলিম ও দলিত সংগঠক, রাজনীতিবিদ সহ যাবতীয় ভিন্নমতাবলম্বীদের চার্জশীটে অন্তর্ভূক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান।
বিজেপি সরকার ভারতে দৃশ্যত ক্ষমতায়। কিন্তু আদতে ভারত ‘ডিপ স্টেট’ হলো আরএসএস। যদিও অরুন্ধতী রায় মনে করেন, আরএসএসকে ‘ছায়ারাষ্ট্র’ বলার দিন শেষ, আরএসএসই বর্তমানে রাষ্ট্র। (রায়, ১০৩, ১১৭)
রাষ্ট্রীয় সমস্ত প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মিডিয়া, বিচারবিভাগ এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহেও বর্তমানে আরএসএস এর ভয়াবহ আধিপত্য। গোটা ভারতজুড়ে আছে তাদের ৫৭,০০০ শাখা এবং ৬,০০০০০ সক্রিয় র্যাডিকাল কর্মী। সম্প্রতি বিভিন্ন লেখাপত্রে দক্ষিণ এশিয়া এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও আরএসএস দৃশ্যমান উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শ্রীলংকা-মায়ানমারে আরএসএস এর পৃষ্ঠপোশকতায় উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের মধ্যেও মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদ ইঞ্জেক্ট করার মতো ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ভারতে একদিকে বাড়ছে আরএসএস-বিজেপির প্রভাব, অন্যদিকে ‘পাকিস্তানি জিহাদী’, কাশ্মীরী ‘সন্ত্রাসবাদী’, বাংলাদেশী ‘অনুপ্রবেশকারী’, শহুরে’নক্সাল’, ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ ইত্যাদি বর্গ তৈরির মাধ্যমে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের গ্রাহক নন এমন ব্যক্তি-সংগঠনসমূহকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাদের চরিত্র হনন ও দানবায়ন প্রক্রিয়া চলছে জোরেশোরে।
মব ও মতাদর্শিক লিঞ্চিং
একদিকে রাস্তায় গো-রক্ষার নামে গরুর মাংস খাওয়া কিংবা বহন করার ‘অপরাধে’ রাস্তায় পিটিয়ে মারা হচ্ছে মুসলমান ও দলিতদের। অথচ প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা (DN Jha) অকাট্য প্রমাণাদিসহ দেখিয়েছেন, প্রাচীন ভারতে গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ ছিল ব্রাহ্মণ-সেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীনকাল থেকে ভারতে গোহত্যা ও গোমাংস আহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল উচ্চ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুর বাড়িতে, সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ব্রাহ্মণ-তুষ্টিতে এবং বিভিন্ন রাজকীয় আয়োজনে। (ঝা, ২০০৯)
২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১১৩ টি পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। অরুন্ধতী যথার্থই বলেছেন, ইণ্ডিয়া আজকে ‘Lynching nation’ এ পরিণত হয়েছে (রায়, ৮০)। যেখানে মুসলমান ও দলিতদের প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মেরে, বেত্রাঘাত করে সেগুলোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব ও হোয়াটসঅ্যাপে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।
তবে এই মব সন্ত্রাস কেবলমাত্র রাস্তায় সীমাবদ্ধ নেই আর। এই মব সন্ত্রাস কেবল শারীরিকভাবে পিটানোতে সীমাবদ্ধ নেই। সমালোচক-বিরোধীতাকারী-ভিন্নমতাবলম্বী মাত্রই বর্তমান ভারতে কোন না কোনভাবে মতাদর্শিক মিডিয়া/ফেসবুক লিঞ্চিং এর শিকার। তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রোপাগাণ্ডা, চরিত্র হনন, ফেইক নিউজের মাধ্যমে তাদের জীবন ও অস্তিত্বকে বিষিয়ে তোলার এক ভয়াবহ কাঠামো বিদ্যমান। সর্ববৃহৎ কথিত গণতন্ত্রের দেশ সর্ববৃহৎ দমনমূলক ও মতাদর্শিক লিঞ্চিং রিপাবলিকে (Lynching Republic) এ পরিণত হয়েছে।
ভারতে এতকাল ধরে মুসলমানরা ধারণাগতভাবে ‘নয়া দলিত’ হিশেবে অস্তিত্বশীল ছিল। কিন্তু বিজেপি-আরএসএস ভারতের মুসলমানদের রীতিমতো আইনগত ‘নয়া দলিত’ এ পরিণত করতে যাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর সবচাইতে হতবুদ্ধিকর ও নির্মম বর্ণপ্রথা বলবৎ হতে যাচ্ছে :
“The real purpose of an all-India NRC, coupled with the CAA, is to threaten, destabilize, and stigmatize the Indian Muslim community, particularly the poorest among them. It is meant to tiered citizenship, in which one set of citizens has no rights and lives at the mercy, or on the good will, of another-a modern caste system, which will exist alongside the ancient one, in which Muslims are the new Dalits. Not notionally, but actually. Legally.” (রায়, ১৪৬-৪৭)
নয়া এলিটদের উত্থান
বিজেপি-আরএসএস এর এই ভয়াবহ উত্থানকে ‘anti-intellectual’, ‘new elite’ উত্থানও বলছেন অনেকে। যেমন জওহরলাল নেহরু (জেএনইউ) বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক শারজিল ইমামকে গ্রেফতার করা হয়েছে সহিংসতা ‘উস্কে’ দেয়ার ‘অপরাধে’। শারজিলের গবেষণার বিষয় ১৯৪৭ এর পার্টিশান এর সময়কার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তিনি দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জগৎবিখ্যাত গবেষক, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস Paul R. Brass এর বই “Forms of Collective Violence: Riots, Pogroms, and Genocide in Modern India” নামক একটা বইকে তিনি রেফারেন্স হিশেবে ব্যবহার করেছেন। গত জানুয়ারিতে গ্রেফতারের পাঁচ মাস পর গত জুলাই এ ছয়শ পাতার চার্জশীট দাখিল করে দিল্লী পুলিশ শারজিলের বিরুদ্ধে। চার্জশীটে উল্লেখ করা হয়েছে: “only such literature and not researching alternative sources.” অর্থাৎ একজন গবেষক কোন উৎস থেকে গবেষণার কাঁচামাল ব্যবহার করবেন সেই ব্যাপারেও ভারত রাষ্ট্র নজরদারি-খবরদারি করবে!
এ বছরের মে মাসে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নৃবিজ্ঞানী অর্জুন আপ্পাদুরাই এর একটা লেখার অনুবাদ করেছিলাম। শিরোনাম ছিল : নয়া এলিটদের অভ্যুত্থানের সাক্ষী হচ্ছি আমরা। অন্যান্য বেশ কয়েকটা রাষ্ট্রের উদাহরণ টানলেও আপ্পাদুরাই মূলত ভারতের কথা মাথায় রেখেই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন।আপ্পাদুরাই বলার চেষ্টা করছিলেন, সারা দুনিয়াতেই এলিট কমপ্লেক্সে একটা ক্যু ঘটে গেছে। চিরাচরিত লিবারেল এলিটরা অন্তত নিজেদের বিচার বিবেচনা, শ্রেণী ও গোষ্ঠীস্বার্থ মোতাবেক বাক-স্বাধীনতা, প্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোর প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে পুঁজি-মন্দির-মিডিয়া-হিন্দুত্ববাদের সমন্বয়ে যে এলিট কমপ্লেক্স ভারতে ক্ষমতায়, তারা সর্বোতভাবে যেকোন প্রকারের ক্রিটিকাল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, গবেষণা, ইতিহাসচর্চার ঘোরতর বিরোধী। মোদি-শাহ নেতৃত্বাধীন একদিকে হিন্দুত্ববাদ ইতিহাসকে মিথে পরিণত করেছে, অন্যদিকে মিথকে ইতিহাস বানিয়েছে।(রায়, ১৬২)
আপ্পাদুরাই এর প্রবন্ধ অনুবাদ করতে গিয়ে একটা দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছিলাম। ভারতে বিরাজমান কঠোর বর্ণপ্রথাকে এই ভূমিকার সাথে মিলিয়ে পড়লে পরিস্থিতির ভয়াবহতা টের পাওয়া যাবে আশা করি :
‘অর্জুন আপ্পাদুরাই বিশ্বজুড়ে বিরাজমান ফ্যাসিবাদী, ডানপন্থী রাষ্ট্রপ্রণালী সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। আমরা মনে করছি অপেক্ষাকৃত ন্যায্য, গণমুখী, গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা যারা বলেন, সমাজ-সম্পর্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে যারা চিন্তা করেন, সক্রিয় থাকেন; অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের এই পর্যবেক্ষণ তাঁদের আমলে নিতে হবে। কারণ বর্তমানে আমরা এমন এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমাজ বিন্যাসে আছি,যা প্রতি মুহুর্তে নিজেকে হালনাগাদ করছে, কৌশল বদলাচ্ছে। অত্যন্ত ক্ষীপ্র এই ব্যবস্থাকে যারা মোকাবেলা করছেন, তাঁরা তদ্রুপ ক্ষীপ্রতা অর্জন করতে না পারলে, আধিপত্যশীল ব্যবস্থা সম্পর্কে শত শত বছরের স্থবির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকলে, কখনোই সমাজ-সম্পর্কের পরিবর্তন আশা করা সম্ভব না।
আপ্পাদুরাই বলছেন, বর্তমান দুনিয়ার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে তার একটা অন্যতম প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিটদের মধ্যেই এক নতুন এলিট সম্প্রদায় এর উত্থান ঘটেছে। যারা বদলে দিয়েছে পুরোনো হিশাব নিকাশ। একে আমরা বলতে পারি, এলিটদের বিরুদ্ধে নব্য এলিটদের পাল্টা-অভ্যুত্থান।
দেখা যাচ্ছে যে, এই নব্য এলিট সম্প্রদায় কোন কোন ক্ষেত্রে, যারা জনগণ কেন্দ্রীক রাজনীতির কথা বলে তাঁদের চেয়ে বেশি জনসংশ্লিষ্ট। নব্য এলিটদের এই রাজনীতি-ধর্ম ব্যবসা-সংস্কৃতি কারখানার পেছনে আছে ব্যাপক জনসমর্থন। অন্তত আপাতদৃষ্টে তাই মনে হবে। প্রথাগত এলিটরা যেসব উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী মূল্যবোধকে স্বীকার করত অন্তত নিজেদের শ্রেণীর মধ্যে, এরা এমনকি সেইসব মূল্যবোধের প্রতিও বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাশীল না। এদের কোন ছদ্মবেশ নেই। মহৎ মহৎ কথার কোন ফুলঝুরি নেই, তারা যা করতে চায়, তা অত্যন্ত খুল্লামখুল্লাই করে।
বুর্জোয়া মানবতাবাদ, গণতন্ত্র, উদারনীতির সমন্বয়ে যে রাষ্ট্রপ্রণালী প্রচলিত ছিল, যেগুলো অন্তত কিছুটা হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় কাজ করত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন ছিল, ক্ষমতার অন্তত লোকদেখানো বিভাজন ছিল; তার কিছুই আজকে আর অবশিষ্ট নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, এমনকি বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলোতে। যেন এক সর্বত্র এক সর্বব্যাপ্ত মাফিয়াতন্ত্র কায়েম হয়েছে।
যারা প্রচলিত এলিট সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, উদারনৈতিকতার বিরুদ্ধে এক অনন্ত ‘ক্যু’ সংঘটিত করে চলেছে। অর্জুন আপ্পাদুরাই বলছেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্মম পরিহাস হলো, আগেকার যে কোন স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদের সাথে আজকের দুনিয়ার এই নব্য এলিট সম্প্রদায়ের নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদের পার্থক্য হলো, বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে, তার সবকিছুর পেছনেই এক আপাত বিপুল জনসমর্থন আছে।
কী করে সম্ভব হলো এই পরিস্থিতি? বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট-শিল্পী-নারীবাদী-সমাজতন্ত্রী-পরিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে এত বিপুল ক্ষোভ ও ঘৃণা উৎপাদনের কারণ কী? কী করে জনগণকে তাদের আসল বাস্তব প্রাত্যহিক সমস্যা-সংকট থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে নানা রকম ফাঁপা প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শিক চর্চায়? কী করে জনগণকে পরিণত করা যাচ্ছে ‘উন্মত্ত মব’-এ?
এই প্রবন্ধের প্রাথমিক পাঠে মনে হতে পারে যেন, অর্জুন আপ্পাদুরাই জনগণের উপরেই সমস্ত দায় চাপাচ্ছেন। কিন্তু আরেকটু গভীরভাবে পাঠ করলেই এটা পরিস্কার হবে যে, তিনি মূলত বলছেন, বর্তমান কালের নব্য এলিটরা ‘জনতা’র ধারণাতেও ক্যু সংঘটিত করে চলেছে। ‘জনতা’র নামে তারা মূলত এমন এক কাল্ট[গোষ্ঠীতন্ত্র] , এমন এক ক্রোধান্মত্ত মব তৈরিতে সক্ষম হয়েছে, যারা যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হতে হতে, নানা ধরনের আদর্শিক প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে, শেষমেষ নিজেদের বাস্তব পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন না দেখতে পেয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, কোন এক‘অতি-মানব’ সুপারলিডারে আস্থা রাখা ছাড়া, জিহাদি জোশ সম্বলিত কোন মতাদর্শের খরিদ্দার হওয়া ছাড়া তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবেনা।
ফলে এইসব ‘অতি-মানব’ স্বৈর-শাসকদের নির্মিত ‘কল্পিত শত্রু’র বিরুদ্ধেই তাঁরা তাঁদের সমস্ত ক্ষোভ ঢেলে দিতে উদ্যত। স্বৈর-শাসকদের সৃষ্ট বাস্তব সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে ঘৃণা, বিভাজন উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে যখন আমরা করোনাভাইরাস মহামারীতে সরকার-রাষ্ট্রপ্রণালীর নিদারুণ ব্যর্থতা, উন্নয়নের রোলমডেল রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাতের অকল্পনীয় অব্যবস্থাপনা (যার শিকার হচ্ছে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণ মানুষ), মাসখানেকের লকডাউনে সমস্ত কিছুতে ধস, তীব্র খাদ্যাভাব প্রত্যক্ষ করছি; ঠিক তখন ‘ধর্ম বনাম বিজ্ঞান’ এর মত অন্তঃসারশূন্য বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার মত চরম অসংবেদনশীলতাও দেখতে পাচ্ছি।
অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের লেখার সার কথাটুকু যদি আমরা বুঝতে পারি, তাহলে আমরা হয়তো উপলব্ধি করব যে, জনগণকে নানা মতাদর্শে, চিন্তার বৈচিত্র্যকে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষে পরিণত করা, স্বীয় নলেজ সিস্টেমকে অন্য নলেজ সিস্টেমের উপর চাপিয়ে দেয়ার এই প্রবণতা বর্তমান কালের নব্য এলিটদের প্রধানতম সার্থকতা।
আরেকটা ব্যাপারও খেয়াল রাখা দরকার, এমনকি শতাব্দী পুরোনো ‘শ্রেণী’ বিশ্লেষণ দিয়েও আজকের পরিস্থিতি পুরোটা বোঝা অসম্ভব। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিট কমপ্লেক্সে পূর্ব অনুমিত অবধারিত কোন শ্রেণীগত ঐক্য নেই। একই শ্রেণীতে অবস্থিত সমস্ত পক্ষই একই মূল্যবোধে দীক্ষিত নয়।
যদি তাই হতো, তাহলে লিবারেল গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের বিরুদ্ধে একই শ্রেণীগত অ্যান্টি-লিবারেল, অ্যান্টি-হিউম্যানিস্ট, অ্যান্টি-ডেমোক্রেটিক ফ্যাসিস্ট এলিটদের উত্থান দেখতে হতোনা আজকের পৃথিবীকে। শ্রেণীবাদী রাজনীতি-অর্থনীতির বিরুদ্ধে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে, কিন্তু চিরাচরিত যুক্তি-বিশ্লেষণ দিয়ে নয়। সেক্ষেত্রে আমরা পরিস্থিতির গুণগত নেতিবাচক পরিবর্তন বুঝতে ব্যর্থ হব। এলিটদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান রত নব্য এলিটদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হবো।’
গোটা ভারতের কাশ্মীরায়ন (Kashmirization) : বৃহৎ এক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প
ভারত এক বৃহৎ কারাগারে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকারসহ মানুষের সামগ্রিক কর্তাসত্তা নির্মম লিঞ্চিং এর শিকার ভারতে। এই পরিস্থিতি থেকে সহসা কোন উত্তরণ আছে কিনা জানিনা, তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রচলিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, নির্জীবতার মধ্যেই ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্টদের সমন্বয়ে নতুন এক নাগরিক শক্তি বিজেপি-আরএসএস এর নৃশংস রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে।
তবে এই প্রতিরোধ কেবল বিজেপি-আরএসএস এর ক্ষমতাচ্যুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আরোপনমূলক-একরৈখিক-ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদের যে সাংস্কৃতিক মিউটেশন (mutation) ঘটেছে সমগ্র ভারতের সমাজদেহে, গণতান্ত্রিক লড়াই-প্রতিরোধের বিস্তৃতি এই মিউটেশনের বিরুদ্ধেও হতে হবে।
প্রাকৃতিক ভূস্বর্গ কাশ্মীরকে আক্ষরিক অর্থে এক কবরস্থানে পরিণত করার পর (রায়, ১৫৩) বিজেপি-আরএসএস এবার সমগ্র ভারতকে কাশ্মীরসম এক ভয়াল নিক্রপলিসে পরিণত করেছে। ভারতের প্রতিরোধী শক্তি সেই নিক্রপলিসকে মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস (Ministry of Utmost Happiness) এর আঞ্জুম এর মতো (রায়, ১৫৩) বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রের ‘জান্নাত’ তথা স্বর্গে পরিণত করবে ; বাংলাদেশ নামক নিক্রপলিস থেকে আমরা সেই প্রত্যাশাই করি।
তথ্যসূত্র:
[রায়] Roy, Arundhati. Azadi: Freedom. Fascism. Fiction, Penguine Random House India, 2020 [এমবেম্বে] Mbembe, Achille. Necro-Politics. 1st edition, Duke University Press [ঝা] Jha, D.N. The Myth Of The Holy Cow. Navayana Publishing, 2009
Sarwar Tusher is an author and activist; interested in studying the state, power, authority, sovereignty, violence, and social relations.