নব্বুই এবং এর পরের দশকেও আমরা বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার ব্যানারে প্রচুর আন্দোলন সংগ্রাম দেখেছি, “এনজিওবাদী” “পয়সা খেয়ে আন্দোলন করা” ইত্যাদি বলা হলেও অনেক বড় বড় আন্দোলন বা ধাক্কা কিন্তু এসেছিল এইসব আন্দোলন থেকে। সংসদে নারী আসন, নারী নির্যাতনের জামিন অযোগ্য মামলার আইন, নারীনীতি বাস্তবায়নের দাবীর মতো বড় বড় কাজ তখন হয়েছে। এখন কি আমরা আর দেখতে পাই “সম্মিলিত নারী সমাজ” নামে কোনও সংগঠনকে। এখন অধিকাংশই ড্রয়িংরুম আর সোশালমিডিয়া অ্যাক্টিভিজম। এর কারণ বোঝাও কঠিন নয়। রাজনৈতিক অবরুদ্ধ অবস্থা। এমন না যে এই সরকার বদলে বিএনপি বা অন্য কেউ ক্ষমতায় এলেই সব বদলে যাবে।
শাহবাগের যেই অংশটিতে কোনও গাড়ি এমনকি রিকশাও চলে না, স্বাভাবিক সময়ে চটপটি বা ফুচকার দোকান বসে, ফুটপাতে লোকজন বসে বসে অলস সময় কাটায় সেই জায়গাটিতে ছেলেমেয়েগুলি গগনবিদারী শ্লোগানে ভরিয়ে তুলছিল। “ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই” – শ্লোগান, এটা ছাড়া আর কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। কয়েকটি টিভি চ্যানেল এর সংবাদকর্মী, পত্রিকার ফটো সাংবাদিক এবং ওই শ দুয়েক বা দেড়েক ছেলেমেয়ে ছাড়া ওইখানে কেউ ছিল না।পাশের রাস্তা দিয়ে প্রবহমান জীবন। মানুষ নিজ নিজ কাজে যাচ্ছে। এই শ্লোগানমুখর আন্দোলনে তাদের কোনও আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না।
আমি গিয়েছিলাম সংবাদকর্মী হিসেবে। বুঝার চেষ্টা করছিলাম যে এই আন্দোলনকারীদের দাবী আসলে কী। একজন নারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, “ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চান তারা।”
এইখান থেকে আমার ভাবনার সূতোটা খুললো। প্রকৃতপক্ষে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির চাওয়ার আগের স্টেপগুলো কি আমরা পার হতে পেরেছি?
আইন ও শালিস কেন্দ্রের সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিনটির বেশি ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। এবং একটি ঘটনারও বিচারকাজ শেষ হয়নি।আদালত পর্যন্ত যেতে একজন রেপ ভিকটিমকে কি কি পোহাতে হয়, আদালতে যাওয়ার পর কি কি ঘটে, পুলিশ কতদিনে চার্জশীট দেয়, সাক্ষী না আসায় মামলার ডেট কিভাবে একের পর এক পড়তে থাকে এবং নব্বুই দিনে নিস্পত্তি হবার কথা যেসব মামলার সেসব কত নব্বুই দিনে গিয়ে ঠ্যাকে-সেইসব্ সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা কতটুকু? এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে “ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি” এই আইন হলে কি লাভ হবে?এই আইন ইতিমধ্যেই করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এসেছে। এখন কি আন্দোলনকারীরা আনন্দিত এবং রিলাক্সড হয়ে ঘরে ফিরে যাবেন?
যারা ফেসবুকে আন্দোলন করছেন তাদের একটা বড় অংশ ধর্ষণকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে এটাকে শুধুই নারীর প্রতি পুরুষের যৌন সহিংসতা হিসেবে দেখছেন। তারা কি এটা না বুঝে করছেন? আমার তা মনে হয়নি। সম্ভবত তারা কমফোর্ট জোন ভাঙতে চান না। ধর্ষন যে ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে যুক্ত একটা ব্যাপার -এই সত্য স্বীকার করলে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়। এই ঝুঁকি তারা নিতে নারাজ।ক্ষমতার রাজনীতির সাথে যুক্ত অথবা ক্ষমতায়িত হতে রাজনীতি করা ধর্ষকদের তারা প্রকারান্তরে অস্বীকার করছেন। নোয়াখালীর এই ঘটনা, অনেকগুলো দিক তো আমাদের সামনে উন্মোচিত করলো। প্রথমত: এই পেটোয়া বাহিনী অনেক আগে থেকেই নারীটিকে উত্যক্ত করতো, নারীটি সেই অভিযোগ স্থানীয় মেম্বারকে করেছিলেন। লাভ হয়নি। দ্বিতীয়ত, এই ক্ষেত্রে পেনিট্রেশন হয় নাই ফলে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এটা তো রেইপ কেসই না! তো এই যে ধর্ষকের ফাঁসির দাবীতে আন্দোলন সেইখানে এই নারী আন্দোলনের ফসল কি করে পাবে? ন্যায়বিচার কি করে পাবে?
আমার মনে হচ্ছে, আমরা মূল সমস্যা থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করি। কিছু শ্লোগানমুখর অবস্থান কর্মসূচী এবং ম্যাড়ম্যাড়ে মানববন্ধন আমাদের ইগোকে তাৎক্ষনিক তৃপ্ত করে তারপর যা যা ঘটার তাই তাইই ঘটে। যথারীতি।
ধর্ষণ প্রতিরোধে যে প্রশ্নগুলো তোলা দরকার সেগুলো আমরা উল্লেখ করতে পারি।
১. ধর্ষণ যে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় ঘটে তা কি রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের কর্ণধররা স্বীকার করে?
২, ধর্ষণ যে যৌন সুখের বিষয় কেবল নয়, নারীকে দুর্বল ভেবে তার উপর আধিপত্য বিস্তারের এই প্রক্রিয়া তা কি আমরা স্বীকার করি?
৩. যেসব আইন আছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তার প্রয়োগ নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট?
৪. আমাদের আদালতের পরিবেশ যে নারীবান্ধব নয় এবং নারীবান্ধব করতে কোনও পদক্ষেপ এপর্যন্ত নেয়া হয়নি সেটা কি রাষ্ট্র স্বীকার করে?
৫. পাঠ্যক্রমে যৌন শিক্ষা অর্ন্তভূক্ত করা যে দরকার সেটা কি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট কেউ ভেবেছে?
আরও অনেক প্রশ্ন করা যায় তবে শুধু ধর্ষন প্রতিরোধের জন্য এই প্রশ্নগুলো জরুরী। আন্দোলন তীব্র প্রতিক্রিয়া থেকে হয়, আন্দোলন তরুণরা করছেন কিন্তু মাথা ঠান্ডা হলে শুধু তরুণরা নয় সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দেন, দীর্ঘদিন নারী অধিকার আন্দোলন নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের ভাবা উচিত। পরিষ্কার একটা পথরেখা করা উচিত। এবং সেই অনুযায়ী রাস্তায় নামা উচিত। এবং রাস্তায় নামার আগে মনে রাখা দরকার যে রাজনৈতিকভাবে অবরুদ্ধ একটা সময়ে আমাদের বসবাস। অতএব যেকোন দাবী নিয়ে রাস্তায় নামলে রাজনৈতিক হামলা, প্রতিরোধ ইত্যাদি আসবে। নব্বুই এবং এর পরের দশকেও আমরা বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার ব্যানারে প্রচুর আন্দোলন সংগ্রাম দেখেছি, “এনজিওবাদী” “পয়সা খেয়ে আন্দোলন করা” ইত্যাদি বলা হলেও অনেক বড় বড় আন্দোলন বা ধাক্কা কিন্তু এসেছিল এইসব আন্দোলন থেকে। সংসদে নারী আসন, নারী নির্যাতনের জামিন অযোগ্য মামলার আইন, নারীনীতি বাস্তবায়নের দাবীর মতো বড় বড় কাজ তখন হয়েছে। এখন কি আমরা আর দেখতে পাই “সম্মিলিত নারী সমাজ” নামে কোনও সংগঠনকে। এখন অধিকাংশই ড্রয়িংরুম আর সোশালমিডিয়া অ্যাক্টিভিজম। এর কারণ বোঝাও কঠিন নয়। রাজনৈতিক অবরুদ্ধ অবস্থা। এমন না যে এই সরকার বদলে বিএনপি বা অন্য কেউ ক্ষমতায় এলেই সব বদলে যাবে।
আমি শুধু বলতে চাইছি, নারী নির্যাতন এবং ধর্ষনের মতো ঘটনা রাজনৈতিক এবং পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার সাথে যুক্ত সেইটা ভালোমতো বুঝে আন্দোলনের রুপরেখা তৈরি করতে হবে। এবং মনে রাখতে হবেই যে এটা একটা নিরন্তর যুদ্ধ, সমতা এবং মানবিক মর্যাদা অর্জনের যুদ্ধ।
Israt Jahan Urmi is a journalist and activist.
.