নিশ্চিন্তপুরের অনিশ্চয়তার গল্প

Share this:

আর এজন্যই হয়তো প্রেসক্লাবের সামনে প্রায় দুইটা মাস টানা খেয়ে না খেয়ে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শেষরাতের শীতে নিজেদের বাহুরউষ্ণতাকেই অবলম্বন করে দিনরাত লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী করেও পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দাবীতে বসে থাকা তাজরিনে ফ্যাশনেরআহত শ্রমিকেরা নজরে আসছে না এইদেশের জনমানুষের, গণমাধ্যমের, ঠিক প্রেসক্লাবের সামনে যেই জায়গাটায় তাঁরা অবস্থান নিয়েছে তারথেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ আমাদের বিজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের, নজরে আসছে না তাঁরা এবং তাঁদের দাবীদাওয়া আমাদের প্রশাসনের ও রাষ্ট্রের।

 

গেল বছর রুপালী মরেছিল, তার আগের বছর আসমা, আর এ বছর শারমিন।

কখনো কখনো পূর্বসূরির ইতিহাসের থেকেও বর্তমান’ই আমাদের কাছে আরো বেশি অতীত হয়ে ওঠে।

আমি নিশ্চিন্তপুরের কথা বলছি। কথাগুলো তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে আহত কর্মক্ষমতাহীন শ্রমিকেদের, যারা নিজেদের চোখের সামনেজীবন্ত জ্বলতে দেখেছে দেহ শতাধিক সহকর্মীর, যারা স্মৃতিতে গত আট বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে সেইসব সহকর্মীর জীবনের আকুতি, বীভৎসতার সংলাপ। গত আট বছরে তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত যাঁদের বাস্তবতায় বুনে দিয়েছে বিষাক্ত বীজ অনন্ত যন্ত্রণাময় একজীবনের। যারা চোখে মুখে একটা প্রশ্ন নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে আট’টা বছর- ‘আগুনের দহন থেকে বাঁচতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাঁচতলা ছয়তলা থেকে ঝাঁপিয়ে নিচে পড়ে সারাজীবনের জন্য নিজের কাছেই অসহনীয়বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার চাইতে অগুনে পুড়ে মরে যাওয়াই বরং ভালো ছিল কীনা, মরে গেলে সব যন্ত্রণা একবারে শেষ হয়ে যেত কীনা?’ যেহেতুতাঁদের জীবনের যেই দায়-দায়িত্ব নেবার কথা ছিল আমাদের রাষ্ট্রের, মালিকপক্ষ আর বিজিএমইএ’র তাঁরা কেউই সাড়া দেয়নি আজ পর্যন্তএই আহত শ্রমিকদের বেঁচে থাকার পক্ষে। কথাগুলো সাভারের শিমুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের কয়েক হাজার মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তার।

আপনারা যারা লেখাটা পড়ছেন, আপনাদের যদি ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ডের ভয়াবহবীভৎসতার কথা মনে না থাকে, তবে সে দায় নিতান্তই আপনার স্মৃতির নয়।

আমরা গণ-বীভৎসতাতান্ত্রিক বাংলাদেশে বাস করি, যেখানে একটা বীভৎসতার কথা আমাদের স্মৃতিতে স্থায়ী হবার আগেই আরো কোনোভয়াবহ বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করতে হয় আমাদের, যার নজির তাজরীন ফ্যাশনের ঘটনার ৫ মাস না পেড়োতে সাভারেই আরেক পোশাককারখানা রানা প্লাজার ভবনধ্বসে ইতিহাসের সর্বাধিক মানুষের প্রাণহানি, ২০১৬ সালে টঙ্গীর ট্যাম্পকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায়অগ্ণিকাণ্ড এবং এইসব বীভৎসতার সর্বশেষ সংযজন সম্ভবত লালমনিরহাটে প্রক্যাশে জলজ্যান্ত একজন মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা।এজন্যই শুরুর দিকে বলছিলাম ‘কখনো কখনো পূর্বসূরির ইতিহাসের থেকেও বর্তমান’ই আমাদের কাছে আরো বেশি অতীত হয়ে ওঠে।’ কারণ এই বীভৎস বর্তমানের কোনো ঘটোনাই বর্তমান হিসেবে আমাদের স্মৃতিতে জায়গা ধরে রাখতে পারে না বেশিক্ষন।

আর এজন্যই হয়তো প্রেসক্লাবের সামনে প্রায় দুইটা মাস টানা খেয়ে না খেয়ে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শেষরাতের শীতে নিজেদের বাহুরউষ্ণতাকেই অবলম্বন করে দিনরাত লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী করেও পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দাবীতে বসে থাকা তাজরিনে ফ্যাশনেরআহত শ্রমিকেরা নজরে আসছে না এইদেশের জনমানুষের, গণমাধ্যমের, ঠিক প্রেসক্লাবের সামনে যেই জায়গাটায় তাঁরা অবস্থান নিয়েছে তারথেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ আমাদের বিজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের, নজরে আসছে না তাঁরা এবং তাঁদের দাবীদাওয়া আমাদের প্রশাসনের ও রাষ্ট্রের।

দুইমাস অনেক সময়। দুইমাস আগে যে শিশু পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল- আজ সে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে মা ও মাসীর ঘ্রাণ। আরআট বছর তারচেয়েও অনেক বেশি সময়, আট বছর আগে তাজজিনের যে আহত শ্রমিকেরা আশায় বুক বেঁধেছিল সুচিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ওপুনর্বাসন পেয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার- তাঁদের অনেকেই আজ মৃত। তবু এই ৮ বছরে পূরণ হয়নি তাঁদের অধিকারের কোনো প্রাপ্যকিছুই। গত আট বছরে তাজরিনের আহত শ্রমিকেরা শরীরের ভাঙা হাড়, ভাঙা মেরুদণ্ড, ও ক্ষত থেকে তৈরি হওয়া ক্যান্সার নিয়ে নানানমহলে ঘুরেফিরে এক কথায় পায়নি প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই। এবং বাস্তবায়ন হয়নি সেইসব প্রতিশ্রুতির একেবারে কিছুই। অন্যদিকে এইআট বছরে কর্মক্ষমতা হারানো এই শ্রমিকেরা নিজেদের চিকিৎসা খরচ, খাদ্য-বাসস্থান, ও পরিবারের খরচ চালাতে গিয়ে একের পর বিক্রিকরেছে নিজেদের ভিটেমাটি, ঘরের আসবাবপত্র, ব্যাংক সহ নানান প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়েছে একের পর এক ঋণ এবং সেই ঋণ শোধ করতেগিয়ে পড়েছে আরো ভয়াবহ ঋণের চক্রে। এর মাঝে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের, অনেকের সন্তানেরপড়ালেখা হয়ে গেছে বন্ধ, আর কোনো উপায় না পেয়ে পথে বসতে বাধ্য হয়েছে তাঁদের অনেকে। অথচ এই মানুষ গুলোর উপর নির্ভর করে টিকে আছে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা, এই মানুষ গুলোর শ্রমে ভিত্তি করেই চলেছে দেশেরঅন্যতম প্রধান রপ্তানিশিল্প।

অগ্নিকান্ডের তিন বছর পর আই এল ও এর তত্ত্বাবধানে ট্রাস্ট গঠন করা হয়। তাজরিন ক্লেইম এডমিনেস্ট্রেশন ট্রাস্ট। ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন ও ইন্ডাস্ট্রিঅলের উদ্যোগে ক্ষতিপূরণের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেল জার্মানভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডএ। সেই হিসেবে বিলসের সৈয়দ সুলতান ২o১৫ সালের নভেম্বরে প্রথম আলোতে সাক্ষাৎকার দেন যে প্রতিটি পরিবার ১o লক্ষ টাকা পাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে দেড় থেকে তিন করে লক্ষ টাকা মিলেছে। ওই টাকায় এই আট বছরের চিকিৎসার খরচই তো উঠে না ঠিকমতো! পরিহাসের সত্য হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ৫o হাজার টাকা করে অনুদান পাবে ১৭৩ জন আহত শ্রমিক।প্রথম দফায় অনুদান পেয়েছে ১৩ জন শ্রমিক আর চারজন খুব কষ্ট করে অনেক দৌড়ে ৫ বছর পর টাকা উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। বাকি ১৫৫ জন প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে পায়নি একটাকাও। সমস্ত চিকিৎসা সেবার প্রতিশ্রুতি দিলেও বিজিএমইএ থেকে চিকিৎসার খরচ মেলেনি আজ’ও।লোক দেখানো কিছু নামকাওস্তে চিকিৎসা দেখিয়ে প্রহসন করা হয়েছে শ্রমিকদের সাথে এবং তাতে আরো বেড়েছে তাঁদের উপর হয়রানী।

এতো কিছুর পরেও জীবনশক্তির জোর যতটুকু বাঁচিয়ে রেখেছিল তাঁদের, সেইটুকুও কেড়ে নিয়েছে তাঁদের কাছে থেকে করোনার মহামারী।লকডাউনের ভেতর না খেয়ে পাড় করতে হয়েছে তাঁদের পাড় করতে হয়েছে দিনের পর দিন। তাঁদের বেশিরভাগের কাছেই পৌঁছায়নি সরকারিবা বেসরকারি তেমন কোনো ত্রাণ সাহায্য। তাঁরা নিজেরা যেহেতু কর্মক্ষম নেই তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে, আর যাদের সংসারে ছিলকাজের করতে সক্ষম মানুষ তাঁরাও হারিয়েছে কাজ এই লকডাউনের ভেতর। বাসার ভাড়া বকেয়া থাকায় বাড়িওয়ালা তালা বন্ধ করে রাস্তায় তাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁদের কাউকে। কারো কারো দোকানে জমেছে ৩৬ হাজার টাকা বাকি। দোকানদার আর চাল ডালটা দিবে না।

অপরদিকে তাজরিন ফ্যাশনের মালিক দেলোয়ারের নামে যে মামলা হয়েছিল আট বছরেও হয়নি সেটার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

লেখার এই পর্যন্ত যারা পড়ে ফেলেছেন, এবার একটু আপনাদের কাছে ফিরে আসি, এ লেখার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র আপনাদের কাছে কিছু তথ্য পৌঁছে দেওয়া নয়। আপনি, আপনি এবং আপনারা যখন এ বছর পুরো ঠাণ্ডার মৌসুমে শীতের বিরুদ্ধে মোটা পোশাক দিয়ে উষ্ণতার ব্যারিকেডে জড়াবেন নিজেদের, একবার ভাবুন, সেইসকল পোষাক বানিয়েছে যারা, তখন এমন শত নরনারী খোলা রাস্তার উপর খালি পেটে উদোম শুয়ে থাকবে অধিকারহীন নিরুপায় হয়ে। সভ্যতার ইতিহাসে এর চেয়ে অশ্লীল ঘটনা আর কীইবা হবে পারে?

অথচ মানুষগুলো ঘরবাড়িহীন হয়ে পথে নেমেছিল নিজেদের অধিকার চাইতে। এরচেয়ে বেশি কিছুই তাঁরা চায়নি।

তাঁদের দাবী মাত্র তিনটি। শ্রম আইনের ক্ষতিপূরণের ধারা অবিলম্বে বদল সাপেক্ষে সকল শ্রমিকের জন্য একজীবন আয়ের সমপরিমাণ আয়ের ব্যবস্থা; সকল আহত শ্রমিকের সম্মানজনক ও বাস্তবসম্মত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং সকল শ্রমিকের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

অনেক কথাই এ পর্যন্ত বলে ফেলেছি,

“এখানে বক্তৃতা আমার উদ্দেশ্য নয়,
আমি এক নগণ্য মানুষ,
আমি শুধু বলি: জলে পড়ে যাওয়া ঐ পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন।” (শহীদ কাদরী)

 

Shoikot Amin is an anti-authoritarian poet and activist from Bangladesh. He believes in equal rights for all human beings on this planet and the right of every other living being to live free.

 

More Posts From this Author:

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!