বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় আটক শিশু পূজার জীবন

Share this:

চারবছর পর পূজার বয়স এখন নয়। সে স্থানীয় স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বাচ্চাটির যৌনাঙ্গ চিরে দেয়ায় তার এই প্রাইভেট পার্টস আর কখনও ঠিক হবে কি না সেটি অনিশ্চিত। সে পেশাব ধরে রাখতে পারে না।  প্যান্টের ভেতর কাপড় গুঁজে তাকে স্কুলে পাঠান তার মা। একটা বড় ধরনের অপারেশন তার লাগবে যেটির খরচ অনেক এবং একটা নির্দিষ্ট বয়স না হলে সেই সার্জারিও করা যাবে না বলে চিকিৎসক জানিয়েছে। মানসিকভাবে পূজা ট্রমাটাইজড। তার কথা বলা, তাকানো কোনও কিছুই স্বাভাবিক নয়। হাঁটতে পারে না ভালোমতো। আমাদের কয়েকজন সাংবাদিককে সংবাদ সংগ্রহের কাজে বেশ কিছুক্ষন ওদের বাড়িতে অবস্থান করতে হলে খানিক পরে পূজা ভয় পেতে থাকে। অর্থাৎ তার মানসিক স্থিতি সম্পূর্ণরূপেই নষ্ট হয়ে গেছে।

 

সাধারনত কোনও শিশু ধর্ষণের শিকার হলেই পত্রিকায় একটা শব্দ ব্যবহার করা হয় না? ফুলের মতো ফুটফুটে শিশু? যেন শিশুটি ফুলের মতো ফুটফুটে না হয়ে দেখতে খারাপ হলে (?) তার সাথে এই অন্যায়টা জায়েজ ছিল-আমি সচেতনভাবে এই ধরনের শব্দবন্ধ এড়িয়ে চলি। কিন্তু পূজার বাড়ি ঢুকে প্রথম যখন পূজাকে দেখতে পেলাম তখন আমারও ঠিক এই শব্দবন্ধই মাথায় এলো। “ফুলের মতো ফুটফুটে শিশু” । এই শিশুটির বয়স এখন নয় বছর। সে যখন ধর্ষণের শিকার হয় তখন তার বয়স ছিল পাঁচ বছর। এই শিশুটিকে দেখে কারো মাথায় যৌনচিন্তা আসতে পারে তা আমার অবিশ্বাস্য লাগতে থাকে।

ঘটনাটি আপনাদের একটু মনে করিয়ে দেই। ২০১৬ সালের ১৮ই অক্টোবর। দিনাজপুরের পার্বতীপুরের পাঁচবছরের পূজা খেলছিল তার সাথীদের সাথে বাড়ির পাশে রাস্তায়। প্রতিবেশী ৩৮ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম তাকে ভুলিয়ে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। এই সাইফুল ইসলাম পূজার খেলার সাথী রেশমার বাবা। পূজাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে সারাদিন এবং সারারাত ধর্ষণ করে সাইফুল। শিশুটির হাত পা বাধা হয়, মুখে লাগানো হয় টেপ, ধর্ষণের সুবিধার্থে ধারালো ব্লেড দিয়ে চিরে দেয় পূজার যৌনাঙ্গ। তারপর পুরো একদিন পর তাকে মৃত ভেবে ফেলে দেয় পাশের একটি ঝোঁপযুক্ত মাঠে। পরের দিন ভোরে প্রতিবেশীরা তাকে খুঁজে পায়। বেঁচে যায় ছোট্ট মেয়েটি। ২০ অক্টোবর ২০১৬ পূজার বাবা সুবল চন্দ্র দাস বাদী হয়ে মামলা করে।

সারাদেশে ঘটনাটি সাড়া ফেলেছিল। আসামী সাইফুল গ্রেফতার হয়। তারপর পার হয়ে গেছে চার বছরের বেশি সময়। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার এক অন্যতম উদাহরণ হয়ে এখনও এই মামলা চলমান।

 

পূজার শরীরের বর্তমান অবস্থা:

চারবছর পর পূজার বয়স এখন নয়। সে স্থানীয় স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বাচ্চাটির যৌনাঙ্গ চিরে দেয়ায় তার এই প্রাইভেট পার্টস আর কখনও ঠিক হবে কি না সেটি অনিশ্চিত। সে পেশাব ধরে রাখতে পারে না।  প্যান্টের ভেতর কাপড় গুঁজে তাকে স্কুলে পাঠান তার মা। একটা বড় ধরনের অপারেশন তার লাগবে যেটির খরচ অনেক এবং একটা নির্দিষ্ট বয়স না হলে সেই সার্জারিও করা যাবে না বলে চিকিৎসক জানিয়েছে। মানসিকভাবে পূজা ট্রমাটাইজড। তার কথা বলা, তাকানো কোনও কিছুই স্বাভাবিক নয়। হাঁটতে পারে না ভালোমতো। আমাদের কয়েকজন সাংবাদিককে সংবাদ সংগ্রহের কাজে বেশ কিছুক্ষন ওদের বাড়িতে অবস্থান করতে হলে খানিক পরে পূজা ভয় পেতে থাকে। অর্থাৎ তার মানসিক স্থিতি সম্পূর্ণরূপেই নষ্ট হয়ে গেছে। সমাজের স্টেরিওটাইপ যে ধারণাটি প্রোথিত যে ধর্ষণের শিকার হলে মেয়েদের জীবন ধ্বংস বা শেষ হয়ে যায়, সেই স্টেরিওটাইপটি এইখানে সত্য। পূজা আর কখনই এই দরিদ্র পরিবারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে কি না তার কোনও নিশ্চয়তা কারো কাছেই নেই।

 

মামলার বর্তমান অবস্থা: 

২০১৬ সালে ২০ শে অক্টোবর দিনাজপুরের পার্বতীপুর মডেল থানায় পূজার বাবা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭/৯(৪) ক/৩০ ধারায় মামলা করে। ২৪ তারিখ আসামী গ্রেফতার হয়। পুলিশ চার্জশীট দেয় ২০১৭ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি। মামলার সাক্ষী গ্রহন শুরু হয় ওই বছরেই ১৮ ই নভেম্বর। তারপর মামলাটি চার বছর ধরে সাক্ষী গ্রহন পর্যায়েই আছে।

কেন এই দীর্ঘসূত্রিতা তার কোনও জবাব কারো কাছে নেই। ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার কার্যক্রম শেষ করার আইন আমরা চিরকালই বলি, কাজীর গরু কিতাবে আছে আসলে নেই-এখানেও তাই ঘটেছে। সবশেষ এ মাসের ২ তারিখে পূজাসহ আরো দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য নেবার কথা ছিল, পূজাসহ অন্য সাক্ষীরা উপস্থিত থাকলেও পাবলিক প্রসিকিউটর না আসায় সাক্ষী গ্রহন হয়নি। একই দিন ডিএনএ রিপোর্ট দেবার দিন ধার্য্য থাকলেও পুলিশও ডিএনএ রিপোর্ট দেয়নি।

 

পূজার পরিবার:

পূজার বাবা সুবলের বয়স ২৮ বছর। মূলত মাছ ধরার কাজ করেন। মায়ের বয়স ২৫। পূজার আরো একটি ভাই রয়েছে যার বয়স চার বছর। পূজার বাবা এই মামলা নিয়ে হতাশ। তিনি আর লড়াইটা চালাতে পারছেন না। তবে পূজার মা বেশ শক্ত। তিনি আমাকে জানালেন, বিচার পাবার জন্য যতদূর যেতে হয় তিনি যাবেন। তবে তার ভয়, সাইফুল যদি কঠিন সাজা না পায় তবে বের হয়ে এসে আরো বড় ক্ষতি সে এই পরিবারের করতে পারে। পূজার ভবিষ্যত কি হবে, সে কি এই পৃথিবীতে আদৌ সার্ভাইভ করতে পারবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত পূজার মা। তিনি জানালেন, তার সংসারটা চিরদিনের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। অথচ এই ঘটনা না ঘটলে যেটুকু আয় ছিল পূজার বাবার তা দিয়ে গুছিয়ে সংসারটা তিনি করতে পারতেন।

বাংলাদেশের অজ পাড়া গাঁ এর একটি পরিবারের কন্যাশিশু থাকার যন্ত্রণা কি তা তারা ভালো টের পাচ্ছেন।

 

পাবলিক প্রসিকিউটর সংক্রান্ত: 

ভদ্রমহিলার নাম তৈয়বা বেগম। আমাকে ইন্টারভিউ দেয়ার সময় তিনি খুব ক্যাজুয়ালি বললেন, কারা কারা নাকি ছড়িয়েছে আমি পূজার বাবার কাছে টাকা চেয়েছি ( বাংলাদেশের আদালত গুলোতে পিপির দুপক্ষ থেকেই টাকা বা ঘুষ চাওয়া অনেকটা ওপেন সিক্রেট) বলেন তো, পূজার বাবার মুখের দিকে তাকালে আর টাকা চাওয়া যায়? দেখলেই তো মায়া লাগে, এতো গরীব…”

এই কথার অর্থ দাঁড়ায় যে, যেসব ধর্ষণের শিকার নারীর বাবার দিকে তাকালে “মায়া” লাগে না বা যারা গরীব নন তাদের কাছ থেকে টাকা চাওয়া যায়। কেন এতো দেরি হচ্ছে এই মামলার রায় পেতে তার কোনও কংক্রিট কারণ তৈয়বা বেগম বলতে পারেননি। উল্লেখ্য যে শেষ সাক্ষ্য গ্রহণের দিন তার সুগার ফল করায় পূজার বাবা অসুস্থ ছোট মেয়ে এবং আরও দুইজন সাক্ষীসহ ফেরত যান। ১৮ জন সাক্ষির মধ্যে মাত্র ছয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহন শেষ করতে পেরেছেন তিনি।

 

পূজার পাশে: 

পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ জোট আমরাই পারি ঘটনার পর থেকেই পূজার খোঁজখবর রাখতো। দিনাজপুরের স্থানীয় সংগঠন পল্লীশ্রির মাধ্যমে মামলাটি পর্যবেক্ষনে রাখে তারা। সবশেষ পূজার বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতায় যুক্ত হয় আরো দুটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা নেটজ এবং রিইব। আমরাই পারির প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, জীবদ্দশায় অন্তত এই শিশুটির সাথে ঘটা নৃশংসতম ঘটনাটির বিচার দেখে যেতে চান তিনি। দীর্ঘদিন এই আদালতে স্থায়ী বিচারক ছিল না, আমরাই পারির বিভিন্ন কর্মকান্ডে একসময় বিচারক আসেন। শেষপর্যন্ত আগামী বছর মার্চের মধ্যে এই মামলার বিচার করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দিতে বলেছে।

 

উপসংহার: 

পুরো এই কেসে বেশ কতগুলো বিষয় চোখে পড়েছে। নারী নির্যাতন রোধে আইন যতই কঠিন হোক দুএকটি ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও বিচার ঝুলে আছে। সাইফুল কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি নয় বিচার তবু হয়নি। কেন এতো দেরি হচ্ছে-এই প্রশ্নের উত্তর যা দেয়া হয় তাতে খুব সহজেই বুঝা যায়, ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার বা নির্যাতকদের সাহস পাওয়ার কারণ যথেষ্টই আছে চারদিকে। এই বিচারব্যবস্থা নিয়ে এই সমাজে এই নারীমুক্তির যে ঝান্ডা আমরা ওড়াই তাতে আমার কেবলই হাসি পায়। এবং কান্নাও।

 

 

প্রচ্ছদ ছবি: ইন্টারনেট

পূজার ছবি: ইশরাত জাহান ঊর্মি

 

Israt Jahan Urmi is a journalist and activist.

 

 

More Posts From this Author:

Share this:

About The Author

1 thought on “বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় আটক শিশু পূজার জীবন”

  1. Pingback: বাংলাদেশের নারী অধিকার আন্দোলন - শুদ্ধস্বর

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!