এতো সংগ্রাম, এতো লড়াই, এতো বিদ্রোহ, এতো রক্তের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র কায়েম হলো, সেই রাষ্ট্র কেন এমন কাঠামো ধারণ করলো, কেন এমন নৃশংস হয়ে গেলো যে, স্রেফ কথা বলার জন্য দিনের পর দিন জেলে আটকে রেখে নাগরিককে প্রাণে মেরে ফেলছে? এই প্রশ্নগুলো আগে যারা করছিলেন, তাদেরকে আরো জোরেশোরে করতে হবে। যারা করেননি, তাদেরকে শুরু করতে হবে। আমাদের লড়াইকে আরো বেগবান করতে হবে। বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে। যতদিন যাবে মুশতাকদের সংখ্যা কেবল বাড়বেই। মুশতাক শহিদি মরণ আমাদেরকে এমন প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড়াতে বাধ্য করছে। আমাদের দাঁড়াতেই হবে।
মুশতাকের চিরমুক্তি আমাদেরকে এই জমিনের উপর যে জুলুম বিরাজ করছে তাকে আরো স্পষ্ট করে দিয়ে গেলো। মুশতাক শহিদ হয়েছেন। মুশতাক গ্রেফতার হয়েছিলেন অন্যায্যভাবে, একটি অন্যায্য আইনে। অন্যায্যভাবেই তিনি বারেবারে জামিন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছিলেন। মুশতাক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন। এবার রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। মুশতাকের শহিদি মৃত্যু এই রাষ্ট্রে মৃত্যুর সম্মুখে সদা উন্মোচিত নাগরিকদের জীবনেরই মৃত্যু। রাষ্ট্রে নাগরিক হিসাবে মৌলিক অধিকারের অনুপস্থিতিকেই হাজির করে এই মৃত্যু। স্রেফ কথা বলা ও লেখার জন্যই মুশতাক জেলের ভেতর পচে মরে গেলেন। আমি আবারো বলছি মুশতাক শহিদ হয়েছেন, বাকস্বাধীনতার জন্য শহিদ হয়েছেন।
২০২০ সালের ৫ মে করোনা মহামারির কালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মুশতাক গ্রেফতার হোন। মুশতাকের সাথে কিশোর, দিদারসহ আরো অনেকেই গ্রেফতার হন। দিদারের জামিন হলেও কিশোর ও মুশতাক জেলে বন্দী ছিলেন। মুশতাক প্রায় ২৯৭ দিন জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বাস করার পর আজ মারা গেলেন। কিশোর এখনো বন্দী। উনিও অসুস্থ। তাদের অপরাধ কী ছিল? কেউ লিখেছেন, কেউবা কার্টুন এঁকেছেন। কলমের খোঁচায়, তুলির আঁচড়ে রাষ্ট্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন, একের পর এক আত্মঘাতী সরকারি সিদ্ধান্তসমূহের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলেন একটা কথা; ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যে রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল সেই রাষ্ট্রে এখন কথা বলা যায় না, সেই রাষ্ট্রে সরকারের সমালোচনা করা যায় না। সরকার এই রাষ্ট্রে হয়ে উঠেছে জীবন-মৃত্যুর চূড়ান্ত মালিক, সরকার হয়ে উঠেছে ‘খোদা’। সুতরাং, সরকারের সমালোচনা এখানে ‘কবিরা গুনাহ’। পাপ। অপরাধ। এখানে মাফিয়াগিরি অপরাধ নয়, এখানে খুন অপরাধ নয়, এখানে জনগণের টাকা হাপিশ করা অপরাধ নয়, ব্যাংক লুট করা অপরাধ নয়, এখানে ধর্ষণ অপরাধ নয়, এখানে জনগণের ওপর দমন-পীড়ন অপরাধ নয়, থানায় পিটিয়ে মেরে ফেলাও অপরাধ নয়। এখানে অপরাধ কেবল কথা বলা, ছবি আঁকা। এখানে অপরাধ কেবল মাফিয়াগিরি, টাকা লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলা, আওয়াজ তোলা। মুশতাক-কিশোর ভুলে গিয়েছিলেন এই রেজিম ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’র মহাপবিত্র রেজিম। এই ‘মহাপবিত্র’ রেজিমের পবিত্রতাকে তারা প্রশ্নমুখর করে তুলেছিলেন। তারা ভুলে গিয়েছিলেন, এই ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’ কীভাবে নাগরিকের স্বাধীনতাকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে তুলতে পারে, কীভাবে আইনি খাঁচায় স্বাধীনতাকে পুরে রাখতে পারে, কীভাবে লাল দালানের ভেতর স্বাধীনতাকে আটকে রাখতে পারে। তারা ভুলে গিয়েছিলেন ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’র স্বাধীনতা দাঁড়িয়ে আছে নাগরিক পরাধীনতার সৌধের ওপরে। আজ দুই হাজার একুশ সনে, যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পঞ্চাশ বছরে পদার্পন করতে যাচ্ছে, তখন মুশতাক নিজের প্রাণ দিয়ে এই রাষ্ট্রের চেহারা সুরত আমাদের সামনে উন্মোচন করে গেলেন।মুস্তাক, আপনি উন্মোচন করেছিলেন লেখনী দিয়ে, আজ যখন লেখনীকে স্তধ্ব করা হলো আপনি উন্মোচন করলেন আপনার প্রাণ দিয়ে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি উপনিবেশিক আইন। এইটা কেবল আজ বলছি না, যেদিন কিশোর-মুশতাক-দিদারদের গ্রেফতার করা হয়েছিল সেদিনও বলেছিলাম। যেদিন এই আইন প্রণীত হয়েছিল সেদিনও আমরা বলেছিলাম। বোধ-বুদ্ধি সরকারের কাছে বর্গা দেননি এমন মানুষ ছাড়া বাকি সবাই এই আইনের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। একটা রাষ্ট্রে একটি আইন জারি আছে যে আইনে ‘সত্য-মিথ্যা’ নির্ধারণের কোনো বালাই নাই, আছে কেবল অনুভূতির জরুরত। আছে কেবল অনুভূতির খেলা। এই অনুভূতি ব্যক্তি-অনুভূতি, এই অনুভূতি ধর্মানুভূতি, এই অনুভূতি রাষ্ট্রানুভূতি, এই অনুভূতি পিতানুভূতি, এই অনুভূতি চেতনানুভূতি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কদর্য সার্বভৌম সহিংসতা আজকে অনুভূতির চাদরে ঢাকা পড়েছে। আর হাঁসফাঁস করছে এই রাষ্ট্রের নাগরিক বলে কথিত মানুষেরা। সেই অস্ফুট আর্তনাদ যেন চিৎকার আকারে শোনা গেলো মুশতাকের শাহাদতে।
এতো সংগ্রাম, এতো লড়াই, এতো বিদ্রোহ, এতো রক্তের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র কায়েম হলো, সেই রাষ্ট্র কেন এমন কাঠামো ধারণ করলো, কেন এমন নৃশংস হয়ে গেলো যে, স্রেফ কথা বলার জন্য দিনের পর দিন জেলে আটকে রেখে নাগরিককে প্রাণে মেরে ফেলছে? এই প্রশ্নগুলো আগে যারা করছিলেন, তাদেরকে আরো জোরেশোরে করতে হবে। যারা করেননি, তাদেরকে শুরু করতে হবে। আমাদের লড়াইকে আরো বেগবান করতে হবে। বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে। যতদিন যাবে মুশতাকদের সংখ্যা কেবল বাড়বেই। মুশতাক শহিদি মরণ আমাদেরকে এমন প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড়াতে বাধ্য করছে। আমাদের দাঁড়াতেই হবে।
এই সরকার জুলুমবাজ। এই সরকার, এই রাষ্ট্র জালিম। এই সরকার, এই ক্ষমতাসীন দল নিপীড়ক। এই সরকার ফ্যাসিবাদী। এই সরকার মাফিয়াতান্ত্রিক। এই সরকার স্বৈরতান্ত্রিক। জনগণকে চোখে চোখে হিসাব রাখতে হবে, কারা কারা এই সরকারে, এই রেজিমের দালালি করছে। কারা এই রেজিমকে পদলেহন করে এই রেজিমের স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত করছে। মুশতাক-কিশোররা জেলে যাওয়ার পরও কারা কারা নানান ছুতোয় এই রেজিমের পক্ষে দালালি করে বেড়িয়েছে, মুশতাকদের যে আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই উপনিবেশিক জঘন্য আইনের বিরুদ্ধে কথা না বলে উল্টো সেই আইনের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করেছে, কারা দিস্তার পর দিস্তা পৃষ্ঠা খরচ করছে, তাদেরকে চিনে রাখতে হবে। অন্যথায়, মুশতাকের আত্মার অভিশাপ লাগবে।
এই সরকার মুখে ফেনা তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে। মাফিয়াতন্ত্রকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে। তারা নিজেদেরকে ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাহক দাবি করে আসছে। তাদের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরাও দিনের পর দিন আমাদেরকে তাই বুঝিয়েছেন। তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা ভাষা আন্দোলনের চেতনার সাথে বাংলার জনগণের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের চেতনা ফ্যাসিবাদের মতাদর্শিক হাতিয়ার। জনগণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের, ভাষা আন্দোলনের চেতনা আসলে বিদ্রোহের চেতনা। শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর চেতনা। জুলুমের বিরুদ্ধে ক্রমাগত আওয়াজ জারি রাখার চেতনা। নিরবতার বিরুদ্ধে ক্রমাগত সক্রিয়তার চেতনা। বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির চেতনা। অজ্ঞতার বিরুদ্ধে প্রশ্নমুখরতার চেতনা। জনগণের এই চেতনার সাথে ক্ষমতাসীনদের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যারা এইটা বুঝেন না, বা বুঝতে চান না, বা ‘চোখ থাকিতেও অন্ধ’ তারা মুশতাকের মৃত্যুর দিকে তাকান।
ফেব্রুয়ারি মাস ভাষা আন্দোলনের মাস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাস। আমরাই একমাত্র ভাষা আন্দোলন করেছি, এমন থরথর আবেগে বক্তৃতা সরকারি ব্যক্তিবর্গরাই করছেন। অথচ সেই ভাষার মাসে স্বাধীনভাবে কথা বলার অপরাধে কিশোর-মুশতাকরা জেলে বন্দী থাকেন। মুশতাক মারা যান। মুশতাকের মৃত্যু তাই আওয়ামী চেতনার যাবতীয় মুখোশ একটানে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এরপরও যারা ইনিয়ে বিনিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পক্ষে ওকালতি করবেন, এরপরও যারা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন না এই রাষ্ট্র একটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্র একটা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র, তাদের অন্তরে খোদা মোহর মেরে দিয়েছেন। তারা মুশতাকের মরণকে আরো দশটা মরণ হিসাবেই নিবেন। তারা বলবেন, দিনে কত মানুষই মারা যায়, এ আর এমন কি!
লেখক মুশতাক প্রাণ দিয়ে জানিয়ে গেলেন, বাকস্বাধীনতাকে শর্তের শৃঙ্খলে গ্রেফতার করা যায় না। বাক স্বাধীনতা মানেই অফুরন্ত স্বাধীনতা। বাকস্বাধীনতা মানেই এক বাক্যের বিরুদ্ধে আরেক বাক্য, হয়তোবা হাজারটা বাক্যও। কিন্তু বাক্যের বিরুদ্ধে বাক্য, শব্দের বিরুদ্ধে শব্দ ব্যতিরেকে অন্য যে কোনো পদক্ষেপই ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ। স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ। মুশতাক আমাদের জানিয়ে গেলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সরাসরি বাকস্বাধীনতা পরিপন্থী। কোনো রাষ্ট্র যদি নিজেকে স্বাধীন বলে দাবি করে, সেই রাষ্ট্রে এমন আইন থাকতে পারে না। এই আইন খোদ নিজ রাষ্ট্রের জনগণকেই উপনিবেশিত করে ফেলেছে। এই আইন বাতিল করতেই হবে। মুশতাক আমাদের জানিয়ে গেলেন এই রাষ্ট্রের সংবিধান বাকস্বাধীনতাকে নানাবিধ শর্তের জালে বন্দী করে রেখেছে। আমাদের আর কোনো পথ নেই। আমাদের আর কোনো মুক্তি নেই। আমাদের মুক্তি আছে কেবল লড়াইয়ে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে। মাফিয়াতন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ে। এই রাষ্ট্রকে নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্র বানানোর লড়াইয়ে। এই রাষ্ট্রের যাবতীয় নিপীড়নমূলক কাঠামোকে ধুলিস্যাৎ করার লড়াইয়ে। একই সাথে এই লড়াই আমাদের অতীতকে মুক্ত করার লড়াইও। আমাদের বর্তমানের পাশাপাশি আমাদের অতীতও বন্দী হয়ে আছে জালিমের কারাগারে।
শহিদ মুশতাক আহমেদ, আপনাকে সালাম।
*শিরোনামের ‘মুক্তি অথবা মৃত্যু’ লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ ভাইর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া হয়েছে। মুশতাকের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তিনি লিখেন, ‘মুক্তি অথবা মৃত্যু! ইতিহাস ওভাবেই ছক কেটে রেখেছে! বাকিটা ভবিষ্যত।’
ইমেজ: ফেসবুক Jibon Ahmed(ছবির কবি)
Sohul Ahmed, activist, and author. Topics of interest are politics, history, liberation war, and genocide. Published Books: Muktijuddhe Dhormer Opobabohar (2017), Somoyer Bebyocched (2019), and Zahir Raihan: Muktijuddho O Rajnoitik Vabna (2020)