যৌন সন্ত্রাস: সমাজ ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হাতিয়ার

Share this:

ধর্মীয় গুরু ও আলেমদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতার দায় আড়াল করা যায়। যেখানে সেই আলেম ও ধর্মীয় শিক্ষকরা ধর্ষণকে কেবলই ধর্মীয় বিধান না মানার ফলাফল হিসেবে অভিহিত করেন। ধর্ষণ সেখানে কেবলই সামাজিক ক্ষতি, মালিকানাহীন যৌনতা। সহিংসতার স্বীকৃতি সেখানে নেই, শারিরীক-মানসিক ক্ষতির স্বীকৃতি নেই। আছে কেবল নারীর অপমান আর অসম্মান।

 

ধর্ষণ বুঝতে হলে প্রথম দায় ধর্ষণকে যৌনতা থেকে আলাদা করে ফেলা। ধর্ষণ শুধুমাত্র লৈঙ্গিক রাজনীতি এবং নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য এই ডিসকোর্স থেকে বেরিয়ে আসা। ধর্ষণ এমনকি ‘যৌন সম্ভোগ’ও নয়। বা সম্ভোগ হলেও ভোগের চেয়ে বেশি শক্তিমত্তা ও ক্ষমতার প্রমাণ দেয়াটাই সেখানে মুখ্য।

জমিজিরাত নিয়ে ঝামেলা, আধিপত্য বিস্তার বা যুদ্ধ-বিগ্রহের মতো ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট ও পুঁজিবাদী লড়াইয়ের মতো অযৌন লড়াইয়েও যখন নারী-শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে তখন এটা পরিস্কার যে সৈনিকরা মূলত যুদ্ধ করতে আসে। কিন্তু যুদ্ধ করতে এসে ধর্ষণের মতো নৃশংসতা কেন চালায়! চালায় কারণ যুদ্ধটা তারা দু’ভাবেই করে। এক, বস্তুগত ক্ষতিসাধন এবং দুই, অবস্তুগত ক্ষতিসাধন।

জন্মদানসহ অন্যান্য প্রকৃতিগত কারণে যে কোন সমাজের অত্যন্ত সংবেদনশীল ও সুরক্ষিত জনগোষ্ঠী নারী। সেই নারীদের অধিকৃত করা সেই সমাজের ডিফেন্স মেকানিজমকে চ্যালেঞ্জ (ইজ্জত দখল) করে ফেলার নামান্তর সেই বার্তা পৌঁছে দেয়া। উপর্যুপরি যুদ্ধের ফলে ভূখণ্ডের মালিকানা বদল হতে পারে, নতুন করে সীমানা নির্ধারণ করা যেতে পারে, প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক বনে যাওয়া যেতে পারে কিন্তু যে নারীর যোনী একবার ব্যবহৃত হয় তার আর কিছু থাকে না। সেই সমাজ-রাষ্ট্রের ইজ্জতও ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়। অমোচনীয় এই কলঙ্গের দাগ ইতিহাস হয়ে কালান্তরে রয়ে যায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় বেইজ্জতির গ্লানি। এই বার্তা এতই শক্তিশালী যে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা ধর্ষণের শিকার ৪ লাখ (মতান্তরে ২ লাখ) নারীর ওপর ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও ধর্ষণকে অ্যাড্রেস করার জন্য ‘শ্লীলতাহানি’ ও ‘সম্ভ্রমহানি’ ধরণের অত্যন্ত আপত্তিকর ও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করা হয়। ঠিক যে পরাশক্তির চিহ্ন রেখে যেতে এ দেশের লাখ লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল সেই শক্তি, সেই ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে খোদ যুদ্ধজয়ী রাষ্ট্র। পরবর্তী কোন ধর্ষণের ঘটনাকেই তাই ক্ষমতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়নি। সর্বোচ্চ যৌন সহিংসতার মতো অরাজনৈতিক সহিংসতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

দু:খজনক হলেও সত্য যে স্বাধীন সার্বভৌম একটা রাষ্ট্রে নারীকে এখনো পাওয়ার পলিটিক্সের টুল হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। এমনকি ক্ষমতার আনন্দ-বেদনা উদযাপনের অংশ হিসেবেও নারীই প্রধান উপজীব্য। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে ভোটে জেতার আনন্দে ধর্ষণ করা হয়, ভোটে হেরে যাওয়ার বেদনায় ধর্ষণ করা হয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর প্রতিশোধের অংশ হিসেবে ধর্ষণ করা হয়, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলেও ধর্ষণ করা হয়। হেরে গেলে মানসিক শক্তি-বলের পরিচয় দিতে শরীরকে ব্যবহার করে নারীর স্বরাজ ধ্বংস করে নিজের ক্ষমতার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়। জিতে গেলে নিজের রাজ্যের সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অর্থলাভের পাশাপাশি ‘নারীর মালিকানা’ পাওয়ার আনন্দে ধর্ষণ করা হয়। কোন পরিবারের নারীকে ধর্ষণ করা হলে সারাজীবন ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে সেই আনুগত্য লাভের আশায় ধর্ষণ করা হয়। আবার, নারী মানেই সম্পত্তি। নারীর কোন এজেন্সি নাই। নারী অন্যের দ্বারা গৃহীত হবে, বর্জিত হবে। কিন্তু গ্রহণের সিদ্ধান্ত তার থাকতে পারে না। সেই নারী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তার ক্ষমতার সীমারেখা বোঝানোর জন্য ধর্ষণ অবিকল্প। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, গ্রহণ-বর্জনের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত পুরুষের। সমাজ-রাষ্ট্রই পুরুষের দণ্ডায়মান সেই অবস্থানে জ্বালানি সরবরাহ করে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই নারীর চলন-বলনের অসামঞ্জস্যতার আলোচনা এই যুক্তিকে আরো স্পষ্টই করে।

রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ধর্ষণ নৈতিক স্খলনের প্রতিফলন। মানুষের নৈতিকতা নেই বলেই সমাজে উত্তরোত্তর ধর্ষণ বাড়ছে। এমনকি বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও ‘পরিবারগুলো সন্তানদের নীতিশিক্ষা দিতে ব্যর্থ’ ধরণের বক্তব্য দেখা যায়। এবং এর সমাধান তারা পাওয়ার পলিটিক্সের আরেক হাতিয়ার ‘ধর্ম’ ব্যবহার করে করতে চান। যেন ক্ষমতার প্রসঙ্গ এড়ানো যায়। ধর্মীয় গুরু ও আলেমদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতার দায় আড়াল করা যায়। যেখানে সেই আলেম ও ধর্মীয় শিক্ষকরা ধর্ষণকে কেবলই ধর্মীয় বিধান না মানার ফলাফল হিসেবে অভিহিত করেন। ধর্ষণ সেখানে কেবলই সামাজিক ক্ষতি, মালিকানাহীন যৌনতা। সহিংসতার স্বীকৃতি সেখানে নেই, শারিরীক-মানসিক ক্ষতির স্বীকৃতি নেই। আছে কেবল নারীর অপমান আর অসম্মান।

রাষ্ট্র ও ধর্ম পারস্পরিক স্বার্থোদ্ধার ও লক্ষ্যে পৌঁছুতে বৃহত্তর অর্থে নারীর প্রতি সহিংসতার নেপথ্যের রাজনীতিটা কেটে দিয়ে শুধুমাত্র সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবকেই দায়ী করে। অথচ কোন রাষ্ট্রেই নারী তার প্রাপ্য মানবিক মর্যাদা পায় না। এমনকি চূড়ান্ত সভ্য; ন্যায়বিচার, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক ও ধর্মীয় ভিত্তির ওপর পরিচালিত রাষ্ট্রেও নারী ধর্ষণের ঘটনা বিরল নয়। এটিই কি প্রমাণ করে না ধর্ষণের মৌলিকত্ব পুরোপুরি ক্ষমতা সম্পর্কিত? ধর্ম যেহেতু অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও অনুভূতি নির্ভর ফলে জনমানুষের সচরাচর কোনরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই ধর্মকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র নিজের কাঠামো ও যন্ত্রাংশ বাঁচাতে মোটামুটি প্রকাশ্যেই নারীবিদ্বেষ টিকিয়ে রাখে। এবং সরকারি আলো-জলে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠা প্রগতিশীল-বুদ্ধিজীবীরা তার সম্মতি উৎপাদনের কাজ করে যায়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৮ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ সংখ্যা ছিল ৪৩৯ জন। ২০০৯তে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩৯ জন। ২০১০ সালে আরো বৃদ্ধি পেয়ে ৭০০ জন, ২০১১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৮০০তে। ২০১২ সালে কিছুটা কমে হয় ৬৬৫ জন। কিন্তু ২০১৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ৮৮১ জনে উন্নীত হয়েছে।  ২০১৪ সালে ৮৪০ জন, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৭ জন, ২০১৬ সালে ১ হাজার ৬ জন এবং ২০১৭ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৯৩ জনে। গত বছর সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার ১ হাজার ৪১৩ নারী ও শিশু। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৩২।

প্রায় ৫০টির মতো জেলা ও প্রায় ১১০টি সহযোগী সংগঠনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ জানিয়েছে, ২০২০ সালের এপ্রিল-জুলাই চারমাসে দেখা যায় ৪১ হাজার ৯৫৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। বস্তুত, গণমাধ্যমের খবরগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনাই ক্ষমতাসীন দলের সংগাঠনিক কর্মী দ্বারা সংঘটিত। যারা সরাসরি ক্ষমতাব্যূহের বাইরে অবস্থান করেন তাদেরও কোন না কোনভাবে ‘প্রভাবশালী’ ব্যাকাপ থাকে। আর কিছু সংখ্যক ক্ষেত্রে কোন ধরণের প্রভাব ও ক্ষমতা ছাড়াই ধর্ষক ধর্ষণ করে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথী বা এমন হেভিওয়েট মামলার ক্ষেত্রে তারা ধরা পড়ে এবং শাস্তি হয়। উল্লেখ্য, এমনকি সেই ধর্ষণের ঘটনায়ও যতখানি না যৌনতা থাকে তারচেয়ে অনেকাংশে থাকে পুরুষের সামাজিক অবস্থানগত দাপট। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, এই দাপট পুরুষকে কে যোগাচ্ছে? পরিবার? পরিবার কীসের অন্তর্গত? সমাজ? সমাজকে পরিচালিত করছে কে? সমাজের আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রচনা করছে কে? শেষাবধি, প্রশ্নের উত্তর যদি হয় রাষ্ট্র তবে পুরুষের আধিপত্যের বিপরীতে নারীকে রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক মর্যাদা দিতে ঠিক কী কী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে?

পরিকল্পনা দূরে থাক, উল্টা- বিবাহ আইন, উত্তরাধিকার আইন, ভরণপোষণ আইনসহ একের পর এক আইনের ছত্রছায়ায় নারীকে কেবল দখলকৃত পুতুলরূপে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সর্বৈব যৌনতাসর্বস্ব ঊনমানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নারীকে। এই প্রতিষ্ঠার মূলে আঘাতটাও তাই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র ভাংচুর করে সংস্কার ছাড়া উপায়ান্তর নেই।

 

প্রচ্ছদ ছবি: The Independent Uganda

 

Bithy Soptorshi is a journalist by profession. Her interests are in history, contemporary politics, feminism, and archeology. She also worked on women’s rights and has published two books: The X-Chromosome, an essay on women’s rights and feminism, and a book of poetry Three and a half years.

 

 

 

More Posts From this Author:

Share this:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!