ইনক্লুসিভ করে ভাবতে শেখা আয়েশা খানম বলতেন, “নারীবাদ একটা নকশীকাঁথা, সবাইকে এখানে বুনে যেতে হবে কিছু না কিছু। দাগ রাখতে হবে সবাইকে। আমি একা পারবো না, তুমিও একা পারবে না।” সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির হয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক সহযোদ্ধার সাথেই মতদ্বৈততা হয়েছে শুনেছি কিন্তু তাই বলে সিস্টারহুড নষ্ট হয়নি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়নি-এই বিষয়টা আমাদের আজকের নারীবাদী আন্দোলনের নেতাদের শেখাটা মাস্ট।
আয়েশা খানম মারা যাবার পর আজ আমি যখন ইউটিউব থেকে অতিথি হয়ে আসা আয়েশা আপার দুটো এপিসোড নামাচ্ছিলাম তখন একটা বিষয় দেখে একটু চমকে গেলাম। তবে ঘটনাটি খুব স্বাভাবিকই। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে রোকেয়া দিবস এবং ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রীতিলতা দিবস উপলক্ষে অন্যপক্ষতে এসেছিলেন তিনি। দুইবারেই একই শাড়ি পরা। প্রসাধনহীন, দীপ্ত একটা মুখ্। খুব বেশি কোথাও যেতেন না শেষের দিকে। কথার খেই হারাননি কখনও। বিলাসব্যাসনহীন, নিলোর্ভ, দৃঢ়, বাহুল্যবর্জিত নারী অধিকারকর্মীর যে চিত্র আমার চোখে ভাসে সেখানে আয়েশা আপারই মুখ।
রাজপথে নারী অধিকার আন্দোলন আর আয়েশা খানম প্রায় সমার্থক আমার কাছে। স্কুল পাশ করিনি এমনসময় প্রথম এসেছিলাম বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সম্মেলনে। ১৯৯৬ সালের কথা। তখন হেনা দাস ছিলেন সভাপ্রধান। আমি মায়ের সাথে এসেছিলাম। বাসভর্তি করে সারাদেশ থেকে এসেছিলেন নারীরা। কোনওরকমে গাদাগাদি করে রাতে সেগুনবাগিচায় ভাড়া করা বাড়িতে ছিলাম আমরা।পরদিন সম্মেলন। উদ্বোধন করেছিলেন সদ্য ক্ষমতা নেওয়া তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখনও কত স্বপ্ন। ইয়াসমিন হত্যা মামলার রায় হয়েছে তার কিছু আগেই। টগবগে এক সময় ছিল সেটা।
আয়েশা খানম প্রথমে সাধারন সম্পাদক এবং পরে সভাপ্রধান হন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের।সারাদেশে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের শাখা। কর্মবীর আয়েশা আপা ছুটে বেড়িয়েছেন সারাদেশেই। ঈর্ষনীয় তার ক্যালিভার।
কিশোরীকাল থেকে চেনা আয়েশা আপাকে আরও ভালোমতো চিনলাম ঢাকায় সাংবাদিকতা করতে এসে। “বাংলাদেশের নারী আন্দোলন ঠেকে আছে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে”-এই কথা বলে অনেকবার ইয়ার্কি মারলেও এখন বুঝতে পারি ওই মানববন্ধনগুলির শক্তি। বছরের পর বছর ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড, জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, সিডও সনদে সাক্ষর এবং সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার-এরকম সব দরকারী কিন্তু তেতো বিষয়গুলো নিয়ে আয়েশা খানম ও তাঁর সংগঠন কাজ করে গেছেন। আজকের নারীদের চলার পথ যদি সামান্যতমও মসৃণ হয়ে থাকে তবে এইসব রিফর্মেশনের গুরত্ব রয়েছে। আয়েশা আপার সঙ্গে অনেকবার মতদ্বৈততা হয়েছে। আম্মুকেও হেসে বলতাম, “তোমাদের মহিলা পরিষদের কাজ কী? কাজ হলো, স্বামী যদি স্ত্রীকে পেটায় তবে সেই স্বামীকে ধমকধামক দিয়ে যেভাবেই হোক নারীটিকে সংসার করানো।এই হলো তোমাদের নারী অধিকারের সংগ্রাম।”
আয়েশা আপাকেও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছিলাম একথা। তিনি বলতেন, তুমি কথা বলছো সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবে, যে নারীটির কোথাও যাবার নেই তার তো অধিকার ওই স্বামীর শাস্তি নিশ্চিত করে তার সাথে থাকা, সবকিছু ইনক্লুসিভ ওয়েতে কেন ভাবতে শেখো না তোমরা?
হ্যাঁ আয়েশা আপা ইনক্লুসিভলি ভাবতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলা গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আর রোকেয়া হলেরনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ঢাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত করার দায়িত্ব ছিল মূলত আয়েশাএবং তাঁর সহকর্মী ছাত্র নেতাদের উপর৷ এছাড়া ছাত্র নেতা হিসেবে দেশের বিভিন্নঅঞ্চলে স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা ও সচেতনতার কাজেওসক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন তিনি৷ সেসময় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি যেটা গঠিত হয়েছিলসেটার উপর দায়িত্ব ছিল সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পক্ষে জনমত সৃষ্টিকরা৷ সেই কাজ করেছেন আয়েশা খানম। সাতই মার্চের পর থেকে ঢাকা শহর সংগঠিতকরা এবং যোগাযোগ রক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করেছিলেন৷ সেসময়ের বন্দুককাঁধে করা নারীদের যে ছবিটি এখন সবাই দেখতে পান সেখানে আয়েশা খানম, রোকেয়া কবীর রয়েছেন।এপ্রিল মাসের শেষদিকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় যানআয়েশা খানম৷ সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত শরণার্থী শিবির ওমুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ক্রাফটস হোস্টেলে উঠেন তিনি৷ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যাঁরাভারতে আসতেন, তাঁদের এক অংশের সাময়িক আবাসস্থল ছিল ক্রাফটস হোস্টেল৷সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী শিবিরগুলোতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদেরমনোবল অটুট রাখা, প্রণোদনা দান এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাজাগাতে কাজ করেন আয়েশা খানম এবং তাঁর সহকর্মীরা৷ ইনক্লুসিভ করে ভাবতে শেখা আয়েশা খানম বলতেন, “নারীবাদ একটা নকশীকাঁথা, সবাইকে এখানে বুনে যেতে হবে কিছু না কিছু। দাগ রাখতে হবে সবাইকে। আমি একা পারবো না, তুমিও একা পারবে না।” সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির হয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক সহযোদ্ধার সাথেই মতদ্বৈততা হয়েছে শুনেছি কিন্তু তা বলে সিস্টারহুড নষ্ট হয়নি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়নি-এই বিষয়টা আমাদের আজকের নারীবাদী আন্দোলনের নেতাদের শেখাটা মাস্ট।
আর শুধুই সহিংস স্বামীকে ধমকধামক নয়, প্রবল পুরুষাধিপত্যের এই দেশের আনাচে কানাচে ক্ষমতাবানদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার, নির্যাতনের শিকার নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে মহিলা পরিষদ। আজ এই প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে কোনও কোনও ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতেই পারে কিন্তু এর সহায়তা পেয়েছেন অনামা অনেক নারী আর পরিবার।
আয়েশা খানম চলে গেছেন।কিন্তু এখনও সিডও সনদে রিজার্ভেশন রেখে দিয়েছি আমরা, এখনও সম্পত্তিতে সমান অধিকার পায়নি নারী, এখনও নারীনীতি প্রনয়ন হয়নি। আয়েশা খানমেরা রিলে রেসের মশালটা কিন্তু তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে, আমরা কি পারবো কি পারবো তাঁর মতো নির্লোভ আর বাহুল্যবর্জিত হয়ে আমাদের পরবর্তী সংগ্রামটুকু জারি রাখতে?
Israt Jahan Urmi is a journalist and activist.