১. কথামুখ : ‘ক্যারিক ফেরগাস’ ও ‘আইলারে নয়া দামান’
অ্যালিসন মোরের কণ্ঠে ‘ক্যারিক ফেরগাস’ নামে প্রচলিত সুবিখ্যাত লোকগানটি শোনেননি বিশ্বসংগীতের এমন সমজদার লোক দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া ভারি। জোয়ান বায়েজ, ব্রায়ান ফেরি, ডমিনিক বিহান, দ্য ডাবলিনার্স, ভ্যান মরিসন, ব্রেইন কেনেডি, জিম ক্যানন প্রমুখের কণ্ঠেও গানটির জাদুমাখা সুর ও কথা মানুষকে অন্য এক জগতের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু এই ‘ক্যারিক ফেরগাস’ গানের উৎসও অস্পষ্ট; যদিও সুরের ব্যঞ্জনার সঙ্গে আইরিশ কবি গইলা ঘুনার ‘দেয়ার দেয়াজ এন নোবেল উইম্যান’ গানের সঙ্গে সম্পৃক্তি স্বীকৃত। (ট্র্যাডিশনাল, ওরিজইন্যাল ভার্সন অব ক্যারিক ফেরগাস, সেকন্ডহ্যান্ডডটকম)গানটির দুই রূপ যখন দুই পৃথক স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয় তখন গানের প্রকৃতি ও ভাবধারাও দুইভাবে আবিষ্কৃত হয়। সংগীত-বিশ্লেষকদের মতানুযায়ী গানদুটি ভিন্ন; এবং পৃথক দুটি ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে উদ্ভুত, যদিও গানগুলো প্রকৃতিগতভাবে এক। এর একটি রূপে আয়ারল্যান্ডের বিশেষ স্থানের একটি লোকগাঁথার সঙ্গে সম্পর্ক দেখা যায়, যেখানে বিরহী একজন পুরুষের মনোভাব রসাত্মকভাবে ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে বিশ্ববিশ্রুত ‘ক্যারিক ফেরগাস’ একটি নস্টালজিকভাবের নারীর গান। অর্থাৎ অনুসন্ধানের পর দেখা গেল যে-গানটি আদিতে রচিত হয়েছিল এবং যে-গানটি বিপুল জনপ্রিয় আদপে দুই গান। প্রথমটি পুরুষের জবানিতে, এবং দ্বিতীয়টি নারীর জবানিতে। স্বাভাবিকভাবেই গানে যখন লিঙ্গের পরিবর্তন হলো, অনুষঙ্গও পালটে গেল। যখন স্থানচ্যুতি হলো ভাষা ও পরিবেশও গেল পালটে। আর আদিগানের সঙ্গে বর্তমানে গীত ক্যারিক ফেরগাসের অনেক অনুভূতিও মেলে না; সুরেও এসেছে ভিন্নতা, উপস্থাপনাও ভিন্ন। এদিকে বিশ্লেষকরা ‘ক্যারিক ফেরগাসে’র কথার সঙ্গে বিশেষ ধারার লোকগানের যেমন সাদৃশ্য পান, তেমনি স্কটল্যান্ডের বিশেষধারার লোকগীতিরও ঘনিষ্ট মিল খুঁজে পান। আধুনিককালে গানটি মুদ্রিত রূপে প্রকাশ পেলে; বিশেষ করে বিশিষ্ট অভিনেতা পিটার অত্তলের অভিনয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে ‘ক্যারিক ফেরগাস’ বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করে। এখানে উল্লেখ্য যে জনপ্রিয় এই গানটির তিনটি অন্তরার মধ্যে প্রথম ও শেষ অন্তরা জনপ্রিয় অভিনেতার গীত সংগীত থেকে নেওয়া এবং মাঝখানের অন্তরাটি গীতি-সংকলক ও শিল্পী ডমিনিক বিহানের নিজের জুড়ে দেওয়া; ডমিনিক বিহান নিজে গানটি গাইতেন।(ম্যাকচেকার, ওরিজিন্স, উইকিপিডিয়া) ‘ক্যারিক ফেরগাস’ যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে এবং লোক-অনুষঙ্গের বাইরে এসে ব্যান্ডের সঙ্গেও গীত হতে থাকে তখন প্রশ্ন উঠেছিল গানটি কার রচনা? এমন নয় রচয়িতার কোনও আত্মীয় হঠাৎ করে এর দাবি তোলেন। দাবিটা উঠেছিল বিভিন্ন পাঠ ও সুরের বিশিষ্টতার কারণে; ঐতিহ্যের সন্ধানে। লোকগান ‘আইলারে নয়া দামান’ গানের রূপ-রূপান্তর ও রচয়িতাসূত্রে ‘ক্যারিক ফেরগাস’ গানের কথা সঙ্গতভাবেই প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। মুখে মুখে রচিত হয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় হয়ে-উঠা লোকগানের প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যসূত্রেই ক্যারিক ফেরগাসের রূপ-রূপান্তর ঘটেছে; রূপেও সুরে এসেছে বৈচিত্র্য। যেমন যন্ত্রানুষঙ্গে ও পরিবেশনায়, তেমনি ভাবে ও সুরে। যে-গানটি নিছক লোকগীতি থেকে শুরু; পরবর্তীকালে দেখা গেল নাট্যাভিনয়ে, ব্যান্ডসহ পপগানেও এমনকি বিবিসি ড্রামাতেও নানারূপে নানাভাবে প্রচলিত ও সমাদৃত হয়ে ওঠে। সভ্যতার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লোকগান ও লোকসংস্কৃতির এমন বিবর্তন ও প্রচলন খুবই স্বাভাবিক প্রবণতা।‘আইলারে নয়া দামান’ লোকগানটির রচয়িতা কিংবা এর রূপ-রূপান্তর প্রশ্নে আমাদেরকে ‘ক্যারিক ফেরগাসে’র বিষয়টিই মাথায় রেখেই সামনের দিকে এগোতে হবে।
‘আইলারে নয়া দামান’ সিলেটি উপভাষায় রচিত বিখ্যাত বিয়ের গীত। গানটি নানা কথায় ও নানাভাবে দীর্ঘদিন ধরে সিলেটসহ বাংলাভাষী অঞ্চলসমূহে গীত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ বেতার সিলেট থেকে সত্তর দশকের শুরু থেকেও এটি প্রচার পেয়ে আসছে বলে স্বীকৃত। সিলেটের মুসলমান সমাজে ‘আইলারে নয়া দামান’ দিয়ে শুরুর গীতটি অবধারিত বিয়ের গীত হিসেবে এর জনপ্রিয়তাও তুঙ্গে। বিয়ের আসর থেকে মঞ্চ, মঞ্চ থেকে বেতার-টেলিভিশন মাধ্যম, তা থেকে চলচ্চিত্রে পর্যন্ত গানটি নানাভাবে গাওয়া হয়েছে এবং হয়ে আসছে। অজপাড়া গাঁয়ের গায়নরীতি ও সুর পেরিয়ে বর্তমানে এই গীত আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গেও গাওয়া হয়; গ্রাম্য লোকগীতির বৈশিষ্ট্য হারিয়ে র্যাপ/ফিউশান, এমনকি এনিমেশন আকারেও ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন আগে প্রবাসে বসবাসরত কম্পোজার মুজাহিদুর আব্দুল্লাহের (মুজা) সংগীত আয়োজনে তোশিবা বেগমের গাওয়া নতুন সংস্করণ ‘নয়া দামান’ অনেকের নজর কাড়ে এবং ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর মূলগানটিও আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। বিশেষ করে সম্প্রতি কোভিড চিকিকৎসারত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনজন তরুণ ডাক্তারের স্বল্পদৈর্ঘ্য নাচে গানটি ব্যবহারের পর। মুজার তৈরি গান কিংবা ডাক্তারদের নাচে গাওয়া গানটির কোথাও গীতিকার ও সুরকারের নাম ব্যবহৃত না-হওয়ায় গানটির রচয়িতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কেউ বলেন এটি নাম-ভণিতাহীন লোকগান যা বিভিন্নজনের সম্মিলিত সৃষ্টির ফল; কেউ বলেন এটি হাসন রাজার গান, কেউ বলেন গিয়াস উদ্দিন আহমদের, কেউ বলেন সিদ্দিকুর রহমানের, কেউ-বা বলেন দিব্যময়ী দাশের। সর্বত্র শুরু হয় নয়া বিতর্ক গানের জন্ম-পরিচয় নিয়ে। শুধু তাই নয় আলোচনা ও জিজ্ঞাসার কেন্দ্রবিন্দু পরে আর জন্ম-পরিচয়ে স্থির থাকেনি, গানটির আদি রূপ ও রচয়িতার সঙ্গে এর বিভিন্ন রূপ-রূপান্তর, এমনকি উদ্ভবস্থল নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তৈরি হয় নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, ধর্মনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জিজ্ঞাসাও।
২. ‘আইলারে নয়া দামানে’র রচয়িতা নিয়ে দাবি
সংগীতজ্ঞ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী রামকানাই দাশ (১৯৩৫-২০১৪) প্রথম ‘আইলো রে নোয়া জামাই’ কথামুখ দিয়ে আরম্ভ বিয়ের গীতকে দিব্যময়ী দাশে রচনা বলে উল্লেখ করেন। নিজের রচিত ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’ এবং সুমনকুমার দাশ-কৃত ‘রামকানাই দাশের নন্দনভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ’ গ্রন্থ ছাড়াও বিবিসি-ভোয়াসহ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে দেওয়া তথ্য-অনুযায়ী ভাটি অঞ্চল মেয়ে তাঁর মা দিব্যময়ী দাশ(১৯১০-১৯৭৯/৮০) লোককবি ছিলেন। তথ্যমতে তাঁর বাবা রসিকলাল দাশও লোককবি ছিলেন। ভাটি অঞ্চলের গ্রামীণ পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁর বাবা-মা দুজনেই গান করতেন; ধামাইল গান, জামাই বান্ধার গান ইত্যাদি। বাবা রসিকলালের মতো মা দিব্যময়ীও ‘পাঠশালা’ পাশ ছিলেন। বাবা ‘মায়নর’ ক্লাশেও পড়েন; গায়ক-গীতিকার হলেও নাম-ধাম ছিল কবিগানে। কিন্তু দিব্যময়ীর লেখা সব গান ছিল ধামাইল। বিয়ের আগেও রসিকলালকে নিয়ে তিনি ধামাইল রচনা করেছিলেন। দিব্যময়ী বেশ মজার মানুষ ছিলেন; মজা করে মুখে মুখে গান বাঁধতেন। রামকানাই দাশ মায়ের বিশটি গান পরে সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। (সুমনকুমার দাশ, রামকানাই দাশের নন্দনভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ, ২০১৪)২০০৪ সালের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত লোকগানের একক অ্যালবাম ‘অসময়ে ধরলাম পাড়ি’তে মায়ের ভণিতার দুটো গান রেকর্ডও করেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘আইলো রে নোয়া জামাই’। ভোয়াতে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি মায়ের নাম উল্লেখ করে গানটি গেয়েছেন। আবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে গানের গীতিকার হিসেবে মায়ের নাম বলে এলেও নিজের অ্যালবামে তা উল্লেখ করেননি। কিন্তু এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় যে বাংলা একাডেমি থেকে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশের ধামাইল গান’ নামক বইটি। বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে সংগ্রাহ্ক ও সংকলক ধামাইল গানের কবিদের পরিচয় ও নামের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে দিব্যময়ী দাশের নাম পাওয়া যায় না। এমনকি তাঁর ভণিতার কোনও গানও গ্রন্থে সংকলিত হয়নি।
সম্প্রতি ‘আইলারে নয়া দামান’ গানটি ভাইরাল হওয়ার পরেই রামকানাই দাশের যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী কন্যা কাবেরী দাশ একে তাঁর ঠাম্মার বলে দাবি তোলেন। পিতার দাবির সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি জানান গানটির আদিরূপ ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ কথামুখ দিয়ে রচিত এবং তা দিব্যময়ী দাশের রচনা। কাবেরীর দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী তাঁদের বাড়িতে গানের চর্চা ছিল। তাঁর ঠাকুর মা কীর্তন লিখতেন-গাইতেন, লোকগানও লিখতেন-গাইতেন। বিয়ের গান লিখতেন, অর্থাৎ মুখে মুখে গাইতেন; গাইতে গাইতে আবার সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেন। দলবেঁধে যখন গাইতেন তখন সবাই শিখে ফেলত, এভাবেই গানগুলো ছড়িয়েছে। (কাবেরী দাশ, ভিডিও-বার্তা, মে, ২০২১) কাবেরী দাশের অন্যত্র বলেছেন,
১৯৭২-৭৩ সালে আমরা টিলাগড়ে প্রধান শিক্ষক প্রয়াত শ্রী চন্দ্রপালের বাড়িতে থাকতাম। তখন ইয়ারুন্নেসা খানম আমাদের বাড়িতে আসতেন। […] একদিন তিনি আমার ঠাকুরমার (দিব্যময়ী দাশ)-এর কাছ থেকে দুটি গান শিখে নিয়েছিলেন, তার একটি হলো-‘আইলোরে নোয়া জামাই’, অন্যটি হলো ‘তোরা শুনগো নীরব হইয়া দেখগো বাহির হইয়া/ কি সুন্দর বাঁশিটি যায় বাজাইয়া’। বলা বাহুল্য তখন তিনি গানটি সিলেট বেতারে গাইবার সময় তাঁকে বাধ্যতামুলক কিছু শব্দ পরিবর্তন করতে হয়। যেমন, ‘রাধা‘ শব্দ ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি আর ভণিতাতে যেখানে গীতিকারের নাম ছিল তা গাইতে দেয়া হয়নি।
[…] আর ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ গানের বেশ কিছু শব্দ ভালো করে লক্ষ করলে বুঝা যাবে যে এই শব্দগুলো আমাদের এলাকার। যেমন, ‘ফেদা‘ অর্থ ময়লা, ‘উরা‘ মানে বাঁশের বেত দিয়ে বানানো এক প্রকার টুকরি, ‘বটের গাইল‘ হলো বটগাছের গুড়ি দিয়ে বানানো যার মাঝে মহিলারা ধান কুটত।(কাবেরী দাশ, শাকুর মজিদের ফেসবুক ওয়াল থেকে, ৩০শে এপ্রিল ২০২১)
কাবেরী দাশ রামকানাই দাশের বরাত দিয়ে বলেছেন যে, গানটি রেকর্ড করার পর শব্দ বা ভণিতা পরিবর্তনের বিষয়টি ইয়ারুন্নেসা খানম তাঁর বাবাকে জানিয়েছিলেন। তিনি অন্যত্রও বলেছেন যে, ‘[…] রেডিওতে তখন এ-গানে ঠাকুরমার নাম বলা হয়নি, কারণ তিনি অ্যানলিস্টেড (নিবন্ধিত) গীতিকার ছিলেন না। তাই তখন গীতিকারের নাম ‘অজ্ঞাত‘ বলা হয়েছিল। কিন্তু গানটি তো ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকেই আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত’। (কাবেরী দাশ, সমকালডটকম, ৮ই মে, ২০২১)। রামকানাই দাশের ছেলে পিনুসেন দাশেরও যুক্তি হচ্ছে ‘[…] গানের মধ্যেই পদকর্তা দিব্যময়ী দাশের নাম রয়েছে (ভণিতা)। এই গানে একটি লাইন আছে ‘পাড়ার লোকে দেখত আইছে দিব্যময়ীর বিয়া’।(পিনুসেন দাশ, সমকালডটকম, ৮ই মে, ২০২১)
সব মিলিয়ে কাবেরী দাশ ও পিনুসেন দাশের কথা হচ্ছে দিব্যময়ী দাশের গানটিই জনপ্রিয়তার কারণে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ ও সুর ধারণ করেছে। এব্যাপারে তাঁরা নিঃসন্দেহ এবং তাঁদের পরিবারই গানটির একমাত্র দাবিদার। লেখক ও চিত্রনির্মাতা শাকুর মজিদও নিজের ফেসবুক ওয়ালে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এটাকেই সত্য বলে বিবৃতি ও যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু পরিবারের পক্ষে কাবেরীর বক্তব্য এবং শাকুর মজিদের সহমত নানা কারণে অনেকেই মেনে নিতে চাননি। বরং পালটা অনেক যুক্তি দিয়ে তাঁরা এ-দাবিতে প্রশ্ন তুলেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন সংগীতবোদ্ধা, শিল্পী, সাংস্কৃতিক জন, লোকসংগীত গবেষক এবং বয়োবৃদ্ধ সিলেটি ব্যক্তিবর্গও।
৩. রচয়িতা নিয়ে বিতর্ক ও বিভিন্ন মতামত
‘আইলারে নয়া দামান’ গানটি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত, তাতে গীতিকারের কোনও নাম-ভণিতা নেই। এটা নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্নও তুলেননি। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে জফির সেতুর সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনায় ‘সিলেটি বিয়ের গীত’ নামে যে-গ্রন্থটি শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হয় তাতে গানটির রচয়িতা অন্যসব বিয়ের গীতের মতো নাম-ভণিতাহীনভাবে ছাপা হয়েছে। এমনকি ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘সিলেটের বিয়ের গীত’ নামে আরেকটি সংকলন সম্পাদনা করে বের করেন জাহান আরা খাতুন। তাতেও গানটি নাম-ভণিতাহীনভাবেই মুদ্রিত হয়। এছাড়া শরদিন্দু ভট্টাচার্য তাঁর পিএইচডি থিসিসে (২০০৯) সিলেটের মুসলমান সমাজের বিয়ের গীত হিসেবে অাইলারে নয়া দামান গানের একটি ভার্সন তুলে ধরেন, সেটিও ছিল নাম-ভণিতাহীন। এদিকে গানের রচয়িতার প্রসঙ্গে দিব্যময়ী-তনয়া একুশে পদকপ্রাপ্ত সুবিখ্যাত শিল্পী সুষমা দাশ ৩০শে এপ্রিল নিউজবাংলা অনলাইন পোর্টালকে বলেছেন ‘এই গানটি কার লেখা তা তিনি জানেন না। মায়ের লেখা বলে তিনি কখনও শোনেননি’। (নিউজবাংলা২৪ডটকম, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২১, ৮:৩৫)
এরই মধ্যে বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল/পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদক গীতিকারের সন্ধান চেয়ে বরেণ্য সংগীতজ্ঞ, বোদ্ধা ও গবেষকের সঙ্গে কথা বলে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন রচনা করে প্রকাশ করেন। প্রতিবেদকদের ভাষ্যমতে গানটি দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসলেও গীতিকার বা সুরকারের হদিস কেউ দিতে পারেননি। গানটি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ-নাগাদ সিলেট বেতারে প্রথম প্রচারিত হয়। শিল্পী ছিলেন ইয়ারুন্নেসা খানম। একটি প্রতিবেদনে হিমাংশু বিশ্বাস তথ্য দেন যে ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম এই গানটি সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন সিলেটের কয়েকজন শিল্পী। দলে ছিলেন সিলেটের প্রবীণ এই সঙ্গীত শিল্পী। প্রতিবেদনের ভাষ্যে হিমাংশু বিশ্বাস বলেন,
১৯৭৩ কি ৭৪ সালে নওয়াজেশ আলী খানের পরিচালনায় ‘বর্ণালী’ অনুষ্ঠানে আমরা বিটিভিতে এই গানটি পরিবেশন করি। এর আগে সিলেট অঞ্চলের বাইরে এই গানটি পরিবেশন করা হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। […] স্বাধীনতার পরে সিলেট নগরের মিরের ময়দানে বাংলাদেশ বেতারের সিলেট কেন্দ্র স্থাপন হয়। এর পরই বেতারে গানটি প্রথমবারের মতো রেকর্ড করা হয়। এর আগে এর কোনো রেকর্ড ছিল না। তখন সিলেট বেতার কেন্দ্রে এই অঞ্চলের অনেক বিয়ের গান প্রচারিত হতো। […] বেতারের জন্য এই গানটির সুর করেছিলেন সিলেট বেতারের সঙ্গীত প্রযোজক আলী আকবর খান। এখন তাঁর সুরেই গানটি গাওয়া হয়’। (হিমাংশু বিশ্বাস, নিউজবাংলা২৪ডটকম, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২১, ৮:৩৫)
হিমাংশু বিশ্বাস গীতিকারে নাম তখন গানে সংযুক্ত ছিল না বলেও জানান। এমনকি রচয়িতার কথাও কখনও শুনেননি। হিমাংশু বিশ্বাসের কথামতো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভসূত্রে প্রতিবেদক পয়ত্রিশ বছর পূর্বেকার নারীশিল্পীদের সমবেত কণ্ঠের গানেরও হদিস পান। বাংলাদেশ বেতারের সিলেট কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক প্রদীপচন্দ্র দাস প্রতিবেদককে জানান যে, ‘আমাদের আর্কাইভে থাকা সবচেয়ে পুরোনো রেকর্ডে এই গানের সুরকার হিসেবে আলী আকবর খানের নাম রয়েছে। আর গীতিকারের জায়গায় লেখা রয়েছে অজ্ঞাত’। (প্রদীপচন্দ্র দাস, নিউজবাংলা ২৪ডটকম, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২১, ৮:৩৫) প্রতিবেদন-অনুযায়ী জফির সেতুর বক্তব্য হচ্ছে ‘গানটি সিলেট অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়ের বিয়ের গান। অনেক তথ্য-তালাশ করেও এই গানের গীতিকার কে তা জানতে পারিনি। তবে সময়ের পরিক্রমায় গানের কথায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। আবার সিলেটেরই বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে গানের কথা কিছু বদলে গেছে’। (জফির সেতু, নিউজবাংলা২৪ডটকম, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২১, ৮:৩৫) অন্য এক প্রতিবেদনে সুমনকুমার দাশের বক্তব্য হচ্ছে,
সিলেট অঞ্চলে মুসলিম বিয়েতে ‘আইলো রে নয়া দামান’ ও হিন্দু বিয়েতে ‘আইলো রে নোয়া জামাই’ শিরোনামে দুটি উৎসমুখ দিব্যময়ীর গানটি প্রকাশের আগে থেকেই বিয়ের গীত হিসেবে প্রচলিত ছিল। […] পরে সেখান থেকে ষোলো [আসলে আট] ধরনের অন্তরা পাওয়া যাচ্ছে। লোকগীতি লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়। প্রচারিত হওয়ার সময় কথার পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে গানটা যে দিব্যময়ী দাশ লিখেন নাই, সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না; আবার গানটা যে উনারই লেখা, সেটাও বলা যাচ্ছে না। […] গানটি আগে থেকেই কিছু কিছু এলাকায় যেমন শোনা গেছে তেমনি এমন সংগীত-পরিবারের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফলে বিষয়টি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। (সুমনকুমার দাশ, বিডিনিউজ২৪ডটকম, ৫ই মে, ২০২১, ২২:৩৬)
‘দিব্যময়ী দাশের পরিবার বলছেন, গানটি রচনার পর গ্রামের আসরে তিনি পরিবেশন করেছেন। ফলে রেডিওতে প্রচারের আগেই সেটি মুখে মুখে ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে কি না?’ প্রতিবেদকের এই প্রশ্নের মুখে সুমনকুমার দাশের জবাব হচ্ছে, ‘উনি (দিব্যময়ী দাশ) যেই এলাকায় থাকতেন, সেই সময়ে গানটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া খুব কঠিন। রেডিওতে প্রচারের পরও মুখে মুখে ছড়ানোটা কঠিন। তখন তো প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে রেডিও ছিল না’।
বিয়ার গানে গীতিকারের নাম থাকে না, বরং পাত্র/পাত্রীর নাম যোগ করা হয়। অন্যান্য অঞ্চলের বিয়ার গানেও পাত্র/পাত্রীর নাম যোগ করে গান গাইতে দেখা যায়। এই রীতি বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই প্রচলিত। দিব্যময়ীর ভণিতা-ব্যবহার নিয়ে আরেকজন প্রতিবেদক কথা বলেছেন সিলেট অঞ্চলের লোকগানের বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে। ধামাইল গানে ভণিতা (পদকর্তার নাম থাকা) থাকলেও বিয়ের গানগুলোতে সাধারণত ভনিতার ব্যবহার দেখা যায় না। কিন্তু বিয়ের গান হওয়ার পরও ‘আইলো রে নোয়া জামাই’ গানে ভণিতা যুক্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদকদের কেউ স্পষ্ট কোনও ধারণা দিতে পারেনি। ওই প্রতিবেদনে শাকুর মজিদ, হিমাংশু বিশ্বাস ও সুমনকুমার দাশের মতও যুক্ত করা হয়েছে। নিচে তাঁদের দেওয়া দরকারি মত যথাক্রমে উদ্ধৃত করছি।
১. […] রাধারমণের গানের প্রভাব ওই অঞ্চলে আছে। রাধারমণের ধামাইল গানের সুর ও স্ট্র্যাকচারের (গঠন) মতো করেই গানটি করা হয়েছিল। পরে এর কথা ও সুর পরিবর্তন করে অনেকে গেয়েছেন। আমি একটি গান পেয়েছি, যেখানে মূল সূরে গানটি না-গেয়ে ধামাইলের সুরে গাওয়া হয়েছে। তবে মূলগানে তাঁর (দিব্যময়ী) ভনিতাসহ বহু জায়গায় অনেক আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে।
[…] যতক্ষণ দিব্যময়ী এই গান লেখার আগে গানটি প্রচলিত ছিল বা গাওয়া হতো বলে প্রমাণিত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বলতে পারি এটি উনার লেখা। শাহ আবদুল করিমের এমন অনেক গান সংগ্রহ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দিব্যময়ীর অনেক গানও এখন রাধারমণের বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। (শাকুর মজিদ, সমকালডটকম, ৮ই মে, ২০২১)
২.আমি নিজে রামকানাই‘দার (রামকানাই দাশ) সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। আমরা একসঙ্গে কিছুদিন সংগীতজ্ঞ ও লোকগানের গুরু বিদিতলাল দাসের দলেও ছিলাম। কিন্তু তখন তিনি একবারের জন্যও এই গানটির রচয়িতা হিসেবে নিজের মায়ের কথাটি আমাকে বলেননি। সাক্ষাৎকারে উনি কী বলেছেন তা আমি জানি না, শুনিওনি।
[…] ১৯৭৩ বা ১৯৭৫ সালে লোকগানের আন্তর্জাতিক একটা সম্মেলন হয়েছিল। জসিমউদ্দীন সাহেবও (পল্লিকবি জসিম উদ্দীন) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে সিলেটের লোকসংগীতের ৫০ মিনিটের একটি সেশন ছিল। সেই সেশনে ‘নয়া দামান‘ গানটি আমরা গেয়েছি। সেখানে কথা ও সুর ‘সংগৃহীত‘ বলা হয়েছে। বর-কনে সাজিয়ে গানটিকে চিত্রায়িত করা হয়েছিল, টেলিভিশনেও দেখানো হয়েছে, তখনও উনি কোনো প্রতিবাদ করেননি। (হিমাংশু বিশ্বাস, সমকালডটকম, ৮ই মে, ২০২১)
৩. ‘আমি অন্তত এ-গানের ছয়টি পাঠ (ভার্সন) সিলেট অঞ্চলে পেয়েছি। প্রতিটি গানের অন্তরায় ভিন্ন শব্দ বা পঙ্ক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ৯৫ শতাংশ গানগুলোতে ‘জামাই‘ শব্দটির বদলে ‘দামান‘ ব্যবহার করা হয়েছে।‘
[…] ‘এই গানটির স্থায়ী অংশটি অন্তত ৫৫ থেকে ৬০ বছর ধরে এ-অঞ্চলে প্রচলিত। এই স্থায়ীকে কেন্দ্র করেই অনেক লোককবি বা গীতিকারেরা গানটি পুনর্নির্মাণ করেছেন। প্রচলিত গানে সিলেট আর মৌলভীবাজারের অনেক শব্দ রয়েছে। অন্যদিকে দিব্যময়ী দাশের গানে কিছু কিছু শব্দ আছে, যা সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের। আবার কিছু পাঠে হবিগঞ্জ অঞ্চলের মৌখিক উপভাষার ব্যবহারও দেখা গেছে। মূলত যে অঞ্চলে গানটি গাওয়া হয়েছে, সে অঞ্চলের শব্দ এতে ঢুকে গেছে। লোকগানের সব বৈশিষ্ট্যই এই গানটিতে আছে। দিব্যময়ী দাশ হয়তো প্রচলিত গানটিকে তার মতো করে পুনর্নির্মাণ করেছেন, অন্যরাও করেছেন। এ-কারণেই একাধিক পাঠ পাওয়া যাচ্ছে গানটির। এরপরও বিস্তর গবেষণা ও যাচাই-বাছাই ছাড়া গানটির বিষয়ে প্রকৃত সিদ্ধান্তে আসা কঠিন।‘ (সুমনকুমার দাশ, সমকালডটকম, ৮ই মে, ২০২১)
সেজুল হোসেন ‘আইলারে নয়া দামান : গীতিকার প্রসঙ্গ’ শিরোনামে ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে জফির সেতুর ২০১৩ সালে প্রকাশিত সিলেটি বিয়ের গীতের প্রসঙ্গ তুলে লিখেন যে, ‘তখনো জীবিত ছিলেন পন্ডিত রামকানাই দাশ। দিব্যময়ী দাশের বংশধররা তখনো-এখনো গান বাজনায় সচল থাকার পরও জফির সেতুর কাছে কেন পৌছল না দিব্যময়ীর নাম? এমনকি এই গানের বইটি ছাপা হওয়ার পরও?’ আর ‘গানটি ভাইরাল হওয়ার আগ পর্যন্ত এই গানটির সঙ্গে গীতিকারের নাম যুক্ত করার কোনও উদ্যোগ কেন ছিল না শ্রী দিব্যময়ীর স্বজনদের?’ অথবা, যেখানে
সুষমা দাশ ১৯৭৪ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশ বেতারে পল্লিগীতির একজন শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করে আসছেন। […] এই বৃদ্ধ বয়সেও কোনো ধরনের পাণ্ডুলিপির সাহায্য ছাড়া তিনি অন্তত দেড়শ গান গেয়ে যেতে পারেন। এর বাইরে হাওরাঞ্চলের নানা ধারা-উপধারার অন্তত পাঁচ শতাধিক প্রাচীন গান তাঁর ঠোঁটস্থ। প্রাচীন লোককবিদের প্রায় ২ হাজারের অধিক গান তাঁর সংগ্রহে আছে। তাঁর গাওয়া প্রাচীন ২২৯ টি গান, জীবনী, সাক্ষাৎকার নিয়ে আজিমুল রাজা চৌধুরী ‘সুষমা দাশ ও প্রাচীন লোকগীতি’ নামে একটি বই ২০২০ সালের মার্চে প্রকাশ করেন। এটিই তাঁকে এবং তাঁর গান নিয়ে রচিত প্রথম বই। আমার কৌতুহল হলো ‘নয়া দামান’তাঁর মায়ের রচনা হলে তিনি সেটা অতি নিশ্চিতভাবে গাইতেন এবং সেটা এই বইয়ে স্থান পেত। [..। প্রশ্ন হলো-এত সজীব ও প্রাণবন্ত এই লোকশিল্পী যার কাজই লোকগানের চর্চা করা, রপ্ত করা, পরিবেশন করা ‘নয়া দামান’ গান কেন তাঁর জানার সীমানার বাইরে থাকবে, যদি সেটা তাঁর মায়ের রচনা হয়? (সেজুল হোসেন, ফেসবুক আইডিতে দেওয়া স্ট্যাটাস, ৩রা মে, ২০২১)
এদিকে রামকানাই দাশ ও তাঁর পরিবার এবং শাকুর মজিদের বক্তব্যে দিব্যময়ীকে শক্তিশালী কবি হিসেবেই পাওয়া যায়। এমনকি রামকানাই দাশ ও শাকুর মজিদের মতে, দিব্যময়ীর ওপরে রাধারমণের ব্যাপক প্রভাব ছিল। তাঁর নামে প্রচলিত গানও সেকথা বলে। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য আলোচ্য গানের বাইরেও ভিতরে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রথমত রামকানাই দাশের বক্তব্য প্রসঙ্গে বলি। তিনি বলেছেন তাঁর মা পঞ্চম শ্রেণি পাশ ছিলেন, আমাদের জানামতে সেসময়ে এইবিদ্যা লেখাপড়ার জন্য পর্যাপ্তই বলতে পারি। দিব্যময়ীর গানের ভাব ও ভাষায় এরও প্রমাণ মেলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো দিব্যময়ী তাঁর রচিত গান খাতায় লিখলেন না কেন? খাতায় না-লিখে মুখে মুখে প্রচার করবেন এটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। কাবেরী দাশও নিজ বক্তব্যে বলেছেন নানাধরনের গান দিব্যময়ী লিখতেন ও গাইতেন। সমান বক্তব্যে এও বলেছেন যে, ‘লিখতেন মানে কী, মুখে মুখে গাইতেন’। (কাবেরী দাশ, ভিডিও-বার্তা, এপ্রিল, ২০২১) এতে তাঁর বক্তব্য অস্পষ্ট হয়ে যায়। তাহলেও, যদি তিনি লিখেও থাকেন তবে তাঁর গানের খাতাগুলো এখন কোথায়? তা পেলে এই সমস্যা-সমাধানের হয়তো একটা পথ খুঁজে পাওয়া যেত। একইভাবে রামকানাই দাশের কথানুযায়ী পিতা রসিকলাল দাশ মাইনর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন; কিন্তু তাঁরও কোনও পাণ্ডুলিপির খবর আমরা পাই না। বরং তাঁর মতো শিক্ষিত লোককবির পক্ষে এটাই সম্ভব ও স্বাভাবিক ছিল। যে রাধারমণ এবং হাসন রাজার কথা বলা হচ্ছে তাঁরাও অনেক গান টুকে রাখতেন। যদিও অনেক গানের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি।
ঠাকুরদার বাপ থেকে বর্তমান প্রজন্ম মিলে রামকানাই দাশের পরিবারকে সংগীতপরিবার বলেই জানা যায়। সংগীত তাঁদের জীবনে এসেছে উত্তরাধিকার হিসেবে। রামকানাই দাশের নিজের জীবনের মতো বাবা-মায়ের জীবনের ব্রত ও সাধনা ছিল গানরচনা ও গাওয়া। কিন্তু তাঁরা কেন রচিত গান লিপিবদ্ধ করলেন না এটা একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন হতেই পারে। রামকানাই জানাচ্ছেন যে পিতা রসিকলাল তাঁর মাতুলালয় পুটকা গ্রামেই বসবাস করে আসছিলেন। ওইগ্রামেই তাঁর যত সংগীতসাধনা ছিল। নিজগ্রামে ফিরে আসার কারণে তাঁর সকল গান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন রামকানাই দাশ। তিনি বলছেন,
একসময় বাবা পটকা গ্রাম ছেড়ে আমাদের নিয়ে পিতৃপুরুষের ভিটে পেরুয়া গ্রামে ফিরে আসেন। তখন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় গান-বাজনা ছেড়ে দেন। তাই পটকা গ্রামেই ছিল বাবার সব গানরচনা এবং গায়েনের সময়। সে সময় তো এতকিছু বুঝিনা, তাই বাবার গানগুলোও আর সংগ্রহ করা হয়নি। পরে আমি যখন বুঝতে পারলাম যে, বাবার রচনাগুলো রক্ষা করার দরকার। সেটা সম্ভববত ১৯৯৫/৯৬ সাল হবে। তখন থেকেই বাবার গান সংগ্রহ করা শুরু করি। (রামকানাই দাশ, উদ্ধৃত, রামকানাই দাশের নন্দনভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ, ২০১৪)
রামকানাই দাশের ভাষ্য-মোতাবেক রসিকলালের কাছ থেকে যারা গান শিখেছিলেন এমন দুজন শিল্পী মঙ্গলচন্দ্র দাশ ও নবলাল দাশকে সিলেটে এসে নিজ বাসায় রেখে তাঁদের মুখ থেকে পিতার গান উদ্ধার করেন। এভাবে দেবেন্দ্র সূত্রধরের কাছ থেকেও দুটি ঘাটুগান সংগ্রহ করেন। গান সংগ্রহের সঙ্গে গানের সুরও তিনি শিখে নিয়েছিলেন। রামকানাই দাশ রসিকলালের মোট পঞ্চাশটি গান লিখেছিলেন বলে ধারণা করেন। কিন্তু সকল গান উদ্ধার করতে পারেননি। মা দিব্যময়ীর বিশটি গান সংগ্রহের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এও জানা যায় দিব্যময়ী দাশ পুত্র রামকানাইয়ের সঙ্গেই শেষবয়েসে সিলেটে বসবাস করতেন। তিনি তখন সিলেটে সংগীতশিক্ষাও দিতেন।এখানে আমাদের প্রশ্ন জাগে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে দিব্যময়ী যখন সুখে-শান্তিতে বসবাস করে সংগীতশিক্ষা দিতেন তিনি কেন বহুবছর ধরে রচিত ও গীত নিজের গানগুলো লিপিবদ্ধ করলেন না? কেন তিনি স্মৃতি ও শ্রুতিতে রেখে গানগুলোকে হারিয়ে যাওয়ার বা বিকৃত করার সুযোগ দিলেন? এমনকি ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ বিকৃত হয়ে ‘আইলারে নয়া দামান’ হওয়ার পরও? এটা আমাদের বোধগম্য হয় না।
আবার ভণিতাবিহীন ও ভণিতাসহ রাধারমণ ও হাসন রাজার অনেক গান দিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গবেষকদের। এঁদের ভণিতাযুক্ত অনেক গানই আছে যা আদপে তাঁদের নয়; স্রেফ জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য অনেকে গান রচনা করে নিজনামের ভণিতা যুক্ত করে গেয়ে আসছেন। আবার অনেকে এই দুই সাধকের অনেক গান ভণিতা ফেলে দিয়ে কিংবা নিজের নামে ভণিতা যুক্ত করে নিজের বলেই চালিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন। লোকগানের রচনা মুখে মুখে বলে কিংবা মুখে মুখে প্রচারিত বলে এসব গানের কপালে তা-ই ঘটে আসছে, সিলেটে কেন দুইবঙ্গের সবখানে। সুতরাং কেউ কোনও ভণিতাহীন জনপ্রিয় লোকগানে নিজের নাম যুক্ত করে দিলেই সেটা তার হয়ে যায় না। আবার রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার গান কিংবা নামপরিচয়হীন ধামাইলমাত্রই রাধারমণ হবেন এমন ভাবাও যায় না। প্রচলিত প্রত্যেক গানেই রচয়িতারা নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষরই রেখে গিয়েছেন তা হয়তো আমাদের সকলের বোধগম্য হয় না। এর মানে এই নয় যে এখানে রামকানাই দাশ কর্তৃক সংগৃহীত ও গীত দিব্যময়ীর গানের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হচ্ছে। এসব গান, প্রাপ্ত বক্তব্য ও ভণিতা থেকে দিব্যময়ীর দাশের গানকে দিব্যময়ীর গান হিসেবেই ধরে নিতে চাই। প্রয়োজনে রাধারমণের গানের ভাব ও ভাষার সঙ্গে দিব্যময়ীর নামে প্রচলিত গানের ভাব-ভাষা যাচাইও করা যেতে পারে।
৪. গানের সংগ্রহ, পাঠ-পাঠান্তর, স্বরূপ ও কিছু প্রশ্ন
এতসব প্রশ্ন দেখা দিত না যদি ‘আইলো রে নোয়া জামাই’য়ের মতো ‘আইলারে নয়া দামান’ গানেরও গীতিকারের ভণিতা থাকত। যদি এমন হতো নয়া দামানেরও শেষে দিব্যময়ীর ভণিতা আছে এবং অন্তরাতে অদলবদল হয়েছে তাতেও কোনও সমস্যা হতো না। সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এখানে যে ‘আইলারে নয়া দামান’টিই বহুল পরিচিত এবং বহুল জনপ্রিয় গান বৃহত্তর সিলেটের সকল অঞ্চলে। ‘নোয়া জামাই’ও প্রচলিত আছে, তবে সেটা যেমন কম, তেমনি তা শুধু হিন্দুসমাজেই সীমাবদ্ধ। গবেষকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী দিব্যময়ীর গানটি প্রকাশের আগেও ‘আইলো রে নোয়া জামাই’ গানটি প্রচলিত ছিল। সুতরাং দুইটি গানের মধ্যে কোনটি আদি তা নিয়েও প্রশ্ন আসে। আশুতোষ ভট্টাচার্যের ‘বাংলার লোকসাহিত্য’(১৯৬১-১৯৬৫) গ্রন্থে সিলেট অঞ্চলের যেসব লোকসংগীতের উল্লেখ রয়েছে তাতে কিন্তু গানদুটির একটিও পাওয়া যায় না। প্রায় একই সময়ে বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে চৌধুরী গোলাম আকবর সিলেট অঞ্চলের যে-সমস্ত লোকসংগীত সংগ্রহ করেছিলেন এবং বাংলা একাডেমি থেকে যা প্রকাশিত হয়েছিল তাতেও গানটি পাওয়া যায় না। এমনকি গুরুসদয় দত্ত ও নির্মলেন্দু ভৌমিক সম্পাদিত এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘শ্রীহট্টের লোকসংগীত’ গ্রন্থে যে-পয়ত্রিশটি বিয়ের গীত সংগৃহীত হয়েছে তার মধ্যেও গানগুলো পাওয়া যায় না। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘সিলেটি বিয়ের গীত’ গ্রন্থে একটি মুদ্রিত রূপ হয়েছে। তাহলে ধরা যেতে পারে দীর্ঘদিন ধরে গীত হয়ে আসলেও গানটির প্রথম মুদ্রিত রূপ প্রকাশিত হয় ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দেই।এখানে সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন দাঁড়ায় বিপুল জনপ্রিয় গানটি কিংবা বর-বরণের গানদুটির একটাও কেন সংগ্রহকদের চোখে পড়ল না। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী ‘আইলারে নয়া দামান’ গানের যে-বিপুল জনপ্রিয়তা এবং প্রচার-প্রচলন সিলেটের বিয়ের গীতের সংগ্রহ-সংকলনের বেলায় এটিই তো সর্বাগ্রে আসা উচিৎ ছিল। গত শতকের ষাটের দশকের উল্লিখিত যে-তিনটি বিখ্যাত সংগ্রহ ও লোকসংগীতের ওপর কাজ হয়েছিল; আশুতোষ ভট্টাচার্য, গুরুসদয় দত্ত-নির্মলেন্দু ভৌমিক ও চৌধুরী গোলাম আকবরের মতো মানুষ যেখানে জড়িতে ছিলেন সেখানে গানগুলো সকলের দৃষ্টি এড়ালো কীভাবে? তাহলে কি গানদুটির একটিও তখন রচিত হয়নি কিংবা রচিত হলেও তা ব্যক্তিপর্যায়ে কিংবা গ্রামপর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল? আর সংগ্রাহকদের পক্ষেও সেখানে পৌছা সম্ভব হয়নি। তাঁরা তখনকার সময়ের জনপ্রিয় গানগুলোই কিংবা যেটুকু পেয়েছেন তা-ই সংগ্রহ করেছেন? কিন্তু ‘শ্রীহট্টের লোকসংগীতে’র সংগ্রহ (গুরুসদয় দত্ত ও নির্মলেন্দু ভৌমিক, শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত, ১৯৬৬) কিংবা বাংলা একাডেমির সংগ্রহ থেকে জানা যায় সংগ্রাহকরা গ্রামের ভিতর থেকেও প্রচুর গান সংগ্রহ করেছেন।(আবদুল হাফিজ, ফোকলোর আরকাইভস,১৯৯৩-৯৪,) তাহলে সেসময়ে গানটি যদি রচিত কিংবা গীত হয়ে মুখে মুখে প্রচলিত থাকত তাহলে নিশ্চয়ই সংগ্রাহকদের দৃষ্টি এড়াতো না।
এপ্রসঙ্গে একটি কথা বলার যে কাবেরী দাশের বক্তব্য অনুযায়ী দিব্যময়ী দাশ ‘আইলো রে নোয়া জামাই’ গানটি ষাটের দশকের শেষের দিকে গানটি ঠাম্মার মুখে শুনেছেনও। এবং সেটা যদি ব্যক্তি বা পারিবারিক পর্যায়ে থেকে যায় তাহলে আলোচনার এ পর্যায়ে এটা দাঁড়ায় যে গানটির রচয়িতা দিব্যময়ী দাশই। কিন্তু তখন পর্যন্ত গানটি অপ্রকাশ্যই ছিল, তাই সংগ্রাহকদের কাছে গানটি পৌঁছায়নি। পরে যখন রেডিওতে প্রচারিত হয়, তখন তা বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু কথা এখানেও থেকে যায় যে সেই সত্তরের দশক থেকে হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজে বিপুল জনপ্রিয় এই গানটি/গানদুটো কেন মুদ্রিত হলো না একুশশতকের প্রথমদশক পর্যন্তও। এর জবাব হচ্ছে লোকগান বলেই তা হয়নি। লোকগান ব্যক্তিবিশেষের রচনা নয় বলে তা অবহেলিত যেমন থাকে, সংগ্রহেও সকলের মনোযোগ থাকে না। এব্যাপারে আমাদের আরও বক্তব্য হচ্ছে যে, তাহলে ষাটের শেষের দিকে রচনা এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে গীত হওয়ার কারণে উল্লিখিত সংকলনগুলোতে ভুক্তি না-হওয়া যেমন সম্ভব, তেমনি গানটি বহু আগেও রচিত হয়ে প্রচারিত ও জনপ্রিয় হয়ে আসলেও তার সংকলনভুক্তি না-হওয়াও অসম্ভব নয়।
আবার, প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যানুযায়ী জফির সেতু সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কমপক্ষে গানের চারটি রূপ সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেগুলো থেকে যাচাই বাছাই করে একটি মান্য রূপ সংকলনভুক্ত করেন [পরিশিষ্ট-১-এর পাঠ-১-সংখ্যক গীত]। আবার জাহান আরা খাতুন তাঁর সংকলনে যে-রূপটি স্থান দিয়েছেন তার সঙ্গেও জফির সেতুর সংকলিত গানের শব্দে-বাক্যে তারতম্য রয়েছে [পরিশিষ্ট-১-এর পাঠ-৫-সংখ্যক গীত]। সুমনকুমার দাশ বলেছেন গানের ছয়টি রূপ তাঁর চোখে পড়েছে এবং সব মিলিয়ে আটটির মতো অন্তরা রয়েছে। আমাদের পর্যবেক্ষণে এই বৈচিত্র্য ‘আইলো রে নয়া জামাই’য়ের ক্ষেত্রে নয়; এটি প্রযোজ্য শুধু ‘আইলা রে নয়া দামানে’র ক্ষেত্রে। এর অর্থ এই যে ‘আইলা রে নয়া দামান’ গানটি সিলেটের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ জনপ্রিয়তার দিক থেকে ‘আইলারে নয়া দামান’ই সর্বাধিক প্রচার পায়। ফলে এই গানের অন্তরা বেশি পরিমাণে রচিত হয় এবং বিচিত্রতা পায়। এ-বিষয়ে হাসনাত আনোয়ারের ভাষ্য এরকম :
লোকমুখে প্রচারিত বলেই একেক এলাকায় একেক রকম করে গাওয়া হয়ে থাকে এ গান। তাই কোথাও এ গান তিন অন্তরা বা তিন প্যারাগ্রাফ, আবার কোথাও এর বেশি। এ নির্ভর করে কতটুকু সময় পাওয়া যাবে গানটি গাইতে, তার উপর। বিয়ের গান, সারি গান ইত্যাদি লোকগানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, এ গানগুলো যাতে সাধারণ মানুষ সহজে মনে রাখতে পারেন, সেজন্যই গানগুলির কথা বিশেষ ভাবে সাজানো হয়। গানের মূল কথা অবিকল রেখে অল্পকিছু কথা দিয়ে বাকি অন্তরাগুলো সাজানো হয় । মূল কথাগুলো ঠিক রেখে মাত্র দুই তিনটি শব্দের হেরফেরে বাকি পদগুলো সাজানো হয়। ফলে মনে রাখা সহজ হয়। কেননা দু তিনটি শব্দ বাদে বাকি পদটুকু একই থাকে। এই গানটির কথাই ধরা যাক। এখানে গানের এক পদে দামান্দের ভাই এর কথা বলা হয়েছে, এর পরের অন্তরা বা পদে দামান্দের বোন, এর ও পরের পদে দামান্দের ভাবীর কথা এসেছে । এভাবে দাদী, নানি, সহ অনেকের কথা বলা যায় বা বলা হয়। আমাদের সারিগান ও বিয়ের গানে এ রচনাশৈলীর ব্যবহার খেয়াল করার মতো । এ গানের বিষয় হলো, শ্বশুরবাড়িতে নতুন জামাইয়ের আগমনে তাকে বরণ করে নেয়া। […]
অন্যান্য বেশকিছু লোকগানের মতো, এই গানেরও বেশকিছু ভিন্নপাঠ রয়েছে। একই গান দুই তিন রকমভাবে গাওয়াকে বলে ভিন্নপাঠ বা কথান্তর । আইলারে নয়াদামান আসমানেরও তেরা-এই গানে দু রকমের ভিন্নপাঠ দেখা যায়। প্রথম যে ধরনের ভিন্নপাঠের কথা বলবো, তা হলো : গানের বর্ণনা বিষয়ে ভিন্নতা। কোনটিতে গানের বর্ণনার সময় প্রথমে ‘দামান্দের’ভাই এর কথা উল্লেখ করা হয়, এর পরে উল্লেখ করা হয় ‘দামান্দের বইন’ এবং এর পরে ‘দামান্দের ভাইর বউ’ । মোট কথা এই যে ‘দামান’ এর আত্মীয় স্বজনের উল্লেখ করা হয়, তার ধারাবাহিকতা সব সময় সমান থাকে না। আগেপিছে হয়ে থাকে। কোনও গানে দামান্দের ভাই এর বদলে দামান্দের বাপ উল্লেখ করা হয়। এই হলো গানটির বিষয়গত ভিন্নপাঠ। (হাসনাত আনোয়ার, কাকনফকিরডটকম, ২৯ শে জুলাই, ২০১৭, ৬:৩০)
জনপ্রিয় লোকগানে এটা সম্ভব ও স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় গানদুটি কি এক? একই রচয়িতার রচনা? একরচনা বহু মুখে বহু স্থানে ছড়িয়ে পড়ে বহু রূপ ধারণ করেছে? নাকি পৃথকদুটো রচনা পৃথকভাবে রূপান্তরিত হয়ে বহু অন্তরাবিশিষ্ট নানা রূপান্তর হয়েছে? বিষয়টি ভাবনা উদ্রেককারী। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভণিতা না-থাকার কারণে এবং যথাসময়ে যথাস্থানে সংগৃহীত না-হওয়ার কারণে গানটির আসল রূপ ও সত্যিকার রচয়িতার পরিচয় কালান্তরে অস্পষ্ট কিংবা ঢাকা পড়ে গেছে।
আবার, এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে যে-গানটি ভাইরাল হয়েছে এবং যা বহুরূপে বহুল প্রচলিত তা দিব্যময়ীর গান নয়; এটি সম্পূর্ণ অন্য গান এবং তা ভণিতাহীন। আবার ভণিতাযুক্ত দিব্যময়ীর ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ গানটি ভাইরালকৃত কিংবা প্রচলিত উপর্যুক্ত ‘আইলারে নয়া দামান’ থেকে অনেকাংশে মিল থাকা সত্ত্বেও সূচনা-সমাপ্তি-ভণিতাসহ আরেক পাঠ [পরিশিষ্ট-১-এর পাঠ-৪-সংখ্যক গীত]। সুতরাং আমরা গানের দুটি পাঠ ধরেই আলোচনায় যেতে পারি। এ-ব্যাপারে প্রথম কথা হচ্ছে পাঠানুযায়ী দুটি কি আসলেই পৃথক গান? নাকি একই মূল উৎস থেকে দুটি পৃথক রূপের প্রচলন? কিংবা ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ পাঠ অনুকরণে ‘আইলারে নয়া দামান’ লিখিত অথবা ‘আইলারে নয়া দামান’ পাঠের অনুকরণে ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ লিখিত? আবার গান দুটোর গায়কীও ভিন্ন। ‘আইলারে নয়া দামানে’র গায়কী ও সুরে সাধারণ বিয়ের গানের সুর থাকলেও ‘আইলোরে নোয়া জামাই’গানটিতে ধামাইল সুর বিদ্যমান।
লোকগান মুখে মুখে রচিত ও গীত হয়ে চলমান থাকে বলে কোনও শিল্পী গাওয়ার সময় নিজের নামের ভণিতাও লোকগানে যুক্ত করে দিতে পারেন। বাংলাদেশ কেন সিলেটের অনেক লোকগানেও তার নজির আছে। সুতরাং ভণিতাই গানের মালিকানার একমাত্র প্রমাণ নয়। তাই প্রচলিত ভণিতাহীন গানের ভিন্ন পাঠে দিব্যময়ীর ভণিতা থাকলেই সেটা দিব্যময়ীর হয়ে যাবে এমন কোনও যুক্তি নেই। অন্যদিকে কোনও একটি প্রচলিত গানকে উত্তরসূরী কেউ দাবি করলেই সেটা তার হয়ে যেতে পারে না। এর জন্য দরকার শক্ত প্রমাণস্বরূপ অন্যসব দলিল-দস্তাবেজ। পিতার বরাত দিয়ে কাবেরী দাশের বক্তব্য হচ্ছে ইয়ারুন্নেসা গানটি সুরসহ শেখেন দিব্যময়ীর কাছ থেকে এবং তিনি বেতারে যখন রেকর্ড করেন তখন গানের কয়েকটি শব্দ ও ভণিতা বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু উল্লেখ করার বিষয় যে, সময়টা পাকিস্তান আমল ছিল না। পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক পরিবেশ বিশেষ করে বেতার-টেলিভিশনে যে ছিল সেটা সকলেই অবগত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর, এমনকি সময়টা সদ্যস্বাধীন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে এমনটা উগ্রসাম্প্রদায়িকতা বলবৎ ছিল এমনটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। লোকগানের আসল সমজদার এদেশের সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের মতো এমন দেশ পৃথিবীতে বিরল যে, লোকসংস্কৃতিচর্চায় এতটা উদার। অন্তত মুসলমান-অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এমনকি মসজিদে যাওয়ার আগে, মসজিদ থেকে বেরিয়ে রাধাকৃষ্ণ নামের ‘লোকগান শুনে অভ্যস্ত। সিলেট অঞ্চলে ‘ভ্রমর কইও গিয়া/শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া’ কিংবা কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে/ ফুলে পাইলা ভ্রমরা ইত্যাদি গান সিলেটের সর্বসাধারণের নিত্যসঙ্গী। সকলেই জানেন বাউল-বৈষ্ণব-সুফি ভাবনার এত সমন্বয় বাংলার আর কোথাও ঘটেনি। সেটা লোকসংগীত, লোকসংস্কৃতিতে কেবল নয়; লোকমানজ ও লোকজীবনেও। তাই এই বক্তব্যের সত্যতা অনুসন্ধানের দাবি রাখে বলেই মনে হয়।
কাবেরী দাশের কথার সূত্র ধরে অনেকে (শাকুর মজিদ প্রমুখ)বলছেন সে-সময়ে রেডিও-টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত গীতিকার না-হলে গীতিকারের নামসহ ভণিতা ব্যবহারের রীতি ছিল না। আমাদের মনে হয় না এটি কোনও সর্বাংশে সঠিক তথ্য। তাহলে যেসব লোককবি বেতার টেলিভিশনের জন্মের আগেই পৃথিবী থেকে লোকান্তরিত হয়েছেন তাদের গান কি বেতার-টেলিভিশনে গাওয়া হয় না? ভণিতা ছাড়াই কি গাওয়া হয়? তা তো মনে হয় না? এসব শিল্পীরা কি তালিকাভুক্ত? যেমন হাসন রাজা কিংবা রাধারমণ কিংবা দীন ভবানন্দ প্রমুখ। যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে দিব্যময়ীর ক্ষেত্রে এমনটা হবে কেন? এছাড়া দিব্যময়ী তখন জীবিত ছিলেন, গান গাইতেন, সংগীত শিক্ষা দিতেন বলে বলা হচ্ছে। শুধু তাই নয় সিলেট রেডিও স্টেশন চালু হবার পর থেকে অর্থাৎ ১৯৬৭ সাল থেকে স্টেশনে চাকরি করেছেন কিছুদিন রামকানাই দাশ। সর্বত্র তাঁর পরিচিতি ছিল তখন। চাইলেই, মায়ের পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে রেডিওতে তালিকাভুক্তি করিয়ে নিতে পারতেন। নারী লোককবির তখন ছিল না বললেই চলে; আর যাঁর গান এতটাই ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ ও শিল্পোত্তীর্ণ তিনি তো কখনওই বাদ পড়তেন না।
আবার শব্দ পরিবর্তন করে, সুর বদলে দিয়ে ও ভণিতা ফেলে দিয়ে যে-গান গাওয়ানো হলো বা রেডিওতে তো চালু হলো এই অন্যায় তিনি কেন মেনে নেবেন? আমরা তো এর পেছনে কোনও স্বার্থও দেখি না। আর্থিক ও খ্যাতির দিক থেকে যতটা লাভবান হতেন সে ইয়ারুন্নেসাই। এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দিব্যময়ী কেন নিজের সৃষ্টিকে মাতৃহীন করবেন কিংবা রামকানাই দাশের মতো বিজ্ঞ মানুষ কেনই-বা সেটা ছেড়ে দেবেন এ প্রশ্নের উত্তরও মেলে না। তবে, তর্কের খাতিরে এটা বলা যেতে পারে যে, স্রষ্টা সৃষ্টিতেই আনন্দ পান; তাঁর সৃষ্টি অন্য উপভোগ করুন, এতেই তিনি খুশি ও পরিতৃপ্ত ছিলেন। এমনটাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে শব্দ পরিবর্তন করেই হোক, অন্তত নিজ নামে গানটি প্রচার করার সুযোগ অনায়াসেই করা যেত।
আরও একটা কথা; রামকানাইয়ের দেওয়া দিব্যময়ী দাশের ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ গানের স্তবকগুলোর ধারাবাহিকতার সঙ্গে ইয়ারুন্নেসার গাওয়া গানের ধারাবাহিকতার মিলও কোথাও লক্ষিত হয় না। অন্তরাগুলোর অদলবদল আছে, পঙ্ক্তির পরিবর্তন হয়েছে, হয়েছে উপমা রূপকের পরিবর্তনও। টিলাগড়ের বাসা থেকে সংগীত শিক্ষা নিয়ে রেডিও স্টেশন পৌঁছোতে পৌঁছোতে এই অলট-পালট, পরিবর্তন বা পরিবর্ধনই-বা করল কে? আমরা বলব তাহলে গানটিতে কাঁচি চালানো হয়েছে, সেটা কী ইয়ারুন্নেসা করলেন? নাকি যিনি সুরকার ছিলেন, তিনিই করলেন। বিশেষ করে অন্তরার ধারাবাহিকতার। সেখানে গানের থিমও নষ্ট হয়ে গেছে। আমূল পরিবর্তিত গানটি গাইতে কি ইয়ারুননেসার বুক কাঁপল না? বিবেকে বাধল না? এটা একটি প্রশ্ন। আরেকটি প্রশ্ন, তাহলে তো গীত গানটি আর দিব্যময়ীর গানটিও থাকল না। সেটা কেন পরে আবার ইয়ারুন্নেসাকে দিয়ে দিব্যময়ী গাইতে দিলেন? নিজে কেন প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়ালেন না রামকানাই দাশ? (এমন কি ইয়ারুন্নেসা যেখানে রামকানাই দাশেরও ছাত্রী ছিলেন।) এমনকি যতদিন জীবিত ছিলেন, তাঁদের কোনও প্রতিবাদের কথা কোথাও জানা যায় না। অথবা, অনেকেই যে প্রশ্ন তুলেছেন; রামকানাই দাশ একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় লোক হয়েও, বিশিষ্ট ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও ‘আইলারে নোয়া জামাই’ গানটিকে ‘আইলারে নয়া দামান’ হিসেবে বিকৃতরূপে (!) বিকৃতপাঠে (!) সরকারিভাবে যে গাওয়া হচ্ছে, প্রচারিত হচ্ছে তিনি কেন কোনও উদ্যোগ নিলেন না। এমনকি সহশিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস বা অন্য কাউকেও মার লেখা গান বলে কিংবা বিকৃত করে গাওয়া হচ্ছে বলে জানালেন না! সঙ্গতভাবে সে প্রশ্নও আমাদের আলোড়িত করে।
তাই সঙ্গতকারণেই সঙ্গীতবোদ্ধা, বিশিষ্টজন, বয়োবৃদ্ধ লোক ও সাধারণ শ্রোতার অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে এ-ব্যাপারে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখছেন বা বলছেন যে সিলেট অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এই গানটি ভণিতাহীন এবং আইলারে নয়া দামান হিসাবেই শুনে আসছেন; কানও ওইভাবে তৈরি হয়ে আসছে; এখন হঠাৎ করে কাবেরী দাশ ও তার পরিবারের এই দাবিতে অনেকেই তা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিলেও কেউ কেউ বা কোনও কোনও গবেষক বলছেন অন্য কথা। যেমন শাকুর মজিদ প্রমুখ অনেকেই গানটির আদিরূপ দিব্যময়ীর বলে নিঃসন্দেহ; কেউ-বা বলছেন দিব্যময়ী দাশের পাঠ পুনর্নির্মাণ; যেমন সুমনকুমার দাশ; কেউ-বা অন্য মত। তবে এসকল মত ধারণা বা অনুমানভিত্তিক। এ-ক্ষেত্রে গানটির বিভিন্ন পাঠ, উপস্থাপনা, গায়কী প্রভৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করে গবেষক সাইমন জাকারিয়ার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, প্রচলিতভাবে গানটির মোট পাঁচ স্তবক আছে। রামকানাই দাশের গাওয়া গানেও স্তবক-সংখ্যা সমান। আর, ভণিতা হিসেবে যে-অংশটা রামকানাই দাশ গেয়েছেন ‘কুঞ্জেরো ভিতরে জামাই বইছে গো সাজিয়া/পাড়ার লোকে দেখত আইছে দিব্যময়ীর বিয়া’ এই অংশটি অন্য কোনও পাঠে নেই। তাই তাঁর কথা হচ্ছে,
তাহলে আমরা একবাক্যে বলতে পারি না যে যতগুলো লৌকিক ভার্সন আছে সবগুলোরই রচয়িতা দিব্যময়ী দাশ। এটা আমরা বলতে পারি না। কারণ লোকগানের একটি বৈশিষ্ট্য আছে সেই গান বিভিন্ন মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তিত হয় এবং পরিবর্তিত হতে হতেই তার প্রবাহমানতাকে অক্ষুণ্ণ রাখে। সিলেটের সমগ্র মানুষের সৃষ্টিশীলতাকেও স্বীকার করে নিতে হবে। সিলেট অঞ্চলের গ্রামীণ মেয়েরা বা ছেলেরাও মুখে মুখে অনেক গান বাঁধেন এবং সেগুলো তাদের ব্যক্তি পরিচয়ের উর্ধ্বে সমষ্টিক পরিচয়ের জায়গা থেকে পরিচিত করে তোলেন। আমার মনে হয় ‘আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা’ এরকমই একটি গান। (সাইমন জাকারিয়া, আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা : সামগ্রিক পরিচয় ও বিতর্কের অবসান-শীর্ষক ভিডিও-ক্লিপ, ভাবনগর ফেসবুক পেজ, ৯ই মে, ২০২১)
লোকসাহিত্যের তত্ত্ব ও নিজের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে ‘আইলারে নয়া দামান’ নিয়ে সাইমন জাকারিয়া তাঁর তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণে যে-কটি ভার্সন নিয়ে কথা বলেছেন তার মধ্যে একটি ব্যতীত সবগুলোই ‘আইলারে নয়া দামানে’র রূপ; ‘আইলো রে নোয়া জামাই’ শুধুমাত্র রামকানাই দাশ পরিবেশিত গানে দেখা যায়। এথেকে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অন্তত সাইমন জাকারিয়ার ভিডিওচিত্রের গানের রূপান্তর-পরিবেশনার উদাহরণ থেকে, ‘আইলো রে নোয়া জামাই’র প্রচলন একেবারে কম বা সীমিত আকারেই গাওয়া গীত হয়। অবশ্য শাকুর মজিদ তাঁর বক্তব্যে ওই গানের একটি পরিবেশনা দেখিয়েছেন। এর বাইরে বাদবাকি সবগুলো গানই ‘আইলারে নয়া দামানে’র গান, অর্থাৎ সেসব গানে কোনও ভণিতা নেই। এপ্রসঙ্গে আমরা ‘নোয়া জামাইয়ে’র আরেকটি পাঠের কথা উল্লেখ করতে পারি যার কথামুখ ‘আইলারে নোয়া জামাই আছমানেরো তেরা’ দিয়ে শুরু এবং গানটিতে কারও ভণিতা নেই [পরিশিষ্ট-১-এর পাঠ-৩-সংখ্যক গীত]। উল্লিখিত গানের সঙ্গে দিব্যময়ীর ‘নোয়া জামাই’য়ের চেয়ে প্রচলিত ‘নয়া দামানে’র সাদৃশ্যই বেশি। প্রায় একই রকম। এ-বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ ও মতামত যথাস্থানে উল্লেখ করব। এখন সাইমন জাকারিয়ার মত যদি স্পষ্ট করে বলি, তাহলে তা হচ্ছে এই যে, বহুল প্রচলিত এই গানটি মুখে মুখে রচিত এবং সিলেটের বহু মানুষের সম্মিলিত সৃষ্টি হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান রূপে বিদ্যমান; যদিও একেক অঞ্চলে একক রূপ পরিদৃষ্ট হয়। আর দিব্যময়ী দাশের ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে যে তিনিও একজন লোককবি, আর এই গানেও অংশবিশেষের ভাগীদার; চলমান স্রোতধারায় এক কিংবা একাধিক পদের রচয়িতাও। সারাগানের/মূলগানের রচয়িতা তিনি নন; হতে পারেন না।
৫. ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক, সমাজসাংস্কৃতিক ও ভাষাতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কোনও গানের উৎসসন্ধানের ক্ষেত্রে নানাবিধ পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান অপরিহার্য হয়ে ওঠে। সিলেটে প্রচলিত এই গানদুটির ক্ষেত্রেও নানাবিধ অনুষঙ্গ যেমন ভূপ্রকৃতি ও ভৌত-কাঠামো, নৃতাত্ত্বিক-সূত্র, ধর্মনৈতিক পরিস্থিতি, সমাজসংস্কৃতি, লোকাচার, ভাষিক পরিস্থিতি প্রভৃতি বিবেচনা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। ভৌগোলিক কিংবা জীবন-জীবিকার তাগিদে হোক আর ধর্মীয়-রাজনৈতিক কারণেই হোক সুপ্রাচীনকাল থেকে সিলেটে নানা জাতের, নানা বর্ণের, নানা ধর্মের মানুষের আগমন ঘটে। জনতাত্ত্বিক বিচারে নিগ্রোবটু, নিষাদ, দ্রাবিড়, কিরাত, আর্য প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এখানে মোঙ্গলয়েড, আরব, ইরান, আফগানিস্তান সহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলো থেকে আগত জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে যেমন এক রক্তসংকর জনতা তৈরিতে সহায়তা করেছে, তেমনি এদের প্রত্যেকেরই সমাজ-সংস্কৃতি এ-অঞ্চলে লক্ষণীয়ভাবে রয়ে গেছে। ধর্মের দিক থেকে অনার্য শত শত ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ, হিন্দু ও ইসলাম প্রধান তিন ধর্ম। এর ফলে বাংলার অন্য অঞ্চলের মতোই সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যেমন আন্তঃসংঘর্ষ ঘটে, তেমনি একধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়াও ঘটে। তবে সিলেটের বিশিষ্টতা অন্য কারণে যে শাহজালাল (র.), অদ্বৈতাচার্য এবং শ্রীচৈতন্যের মতো মহাপুরুষদের সংস্পর্শে এখানে মানবীয় প্রেমের ধর্মাদর্শ হিন্দু, মুসলমান ও অন্য সকলকে প্রভাবিত করে। শ্রীচৈতন্যদেবের বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব সিলেটের জনমানসকে কতটা আলোড়িত করেছিল তার প্রমাণ সিলেটের লোকসংগীতের ধারা। লোকসংগীতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, লোককবিদের রচিত এসব সৃষ্টিশীল সাহিত্য হিন্দুয়ানি ভাব ও উপমায় সমৃদ্ধ। গানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে রাধাকৃষ্ণ প্রতীক নিরন্তর ব্যবহৃত হয়েছে। বৈষ্ণবতত্ত্বের জীবাত্ম-পরমাত্মা এখানে সুফিতত্ত্বের আশিক-মাশুকে একাকার হয়ে যায় এবং হিন্দু-মুসলমান কবি সমানভাবে লোকসংগীতে তার ব্যবহৃত করতে থাকেন। তাই গানের ভিতর দিয়ে সিলেটের কোনও লোককবির ধর্মপরিচয় খুঁজে বের করা একঅর্থে শক্তও। তবু লোকাচার, ভাষা, সংস্কৃতি প্রভৃতির সূক্ষ্মবিচারে তা চিহ্নিত করা অসম্ভবও নয়।
সমাজ-সংস্কৃতি ও লোকাচার বিচারে ‘আইলারে নয়া দামান’ গানটি মুসলমান সমাজ-রীতি এবং দিব্যময়ীর ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ হিন্দুরীতির বলেই স্পষ্ট। মুসলমান সমাজে বর-বরণের গীত একধরনের স্ত্রী আচার বা নারী-সংস্কৃতি। সাধারণত অন্দরমহলে এধরনের গীত সমস্বরে গীত হয়ে থাকে, বাদ্যযন্ত্রহীন। হিন্দুসমাজেও তা আছে নানাপর্বে। বর-বরণ উপলক্ষে পশ্চিবঙ্গের বর্ধমান জেলার মুসলমান বিবাহরীতিতেও ‘আইলারে নয়া দামান’ টাইপের একটি গান পাওয়া গেছে। গানটির উৎসমুখ প্রায় একইকম যে,
আইলেন গো নয়া দামাদ আশমানের তারা
বর-বরেতের আসন পাতো আমুন ধানের ন্যাড়া \
এইটা কেডা? দামাদের বোনহাই।
মাথায় উমরি-ঝুমরি
মাথায় ঝুবরি-ঝাবরি
আমাদের মজলিশে মানাবে না অরে তাড়া তাড়া \ [আংশিক]
(উদ্ধৃত, মনোয়ারা বেগম, মুসলিম গানে বাঙ্গালি মুসলিম সমাজ, কলকাতা, ২০০৪)
উদ্ধৃত গানটির কথামুখ লক্ষ্য করার মতো, ‘আইলারে নয়া দামানে’র সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণও। এখানেও ভাবার মতো বিষয় যে গানদুটির সাদৃশ্যতার তাৎপর্য কোথায়? যাই হোক, ‘আইলারে নয়া দামান’ ও ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ গানদুটির পৃথক অনুষঙ্গ শুনলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন দিব্যময়ীতে ‘জামাই’ ছাড়াও ‘কুঞ্জ’ কথাটা বলা হয়েছে। এটা হিন্দুসংস্কৃতিরই প্রতীক। আমাদের মনে হয় না এখানে বড়ো ব্যাখ্যার দরকার পড়ে। বিভিন্ন জনের মতামতেও আমরা তা দেখেছি। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ গানগুলোর ভাষা। অনেকের যুক্তি সেখানেও। ভাষাব্যবহারের কেউ বলছেন গানটি দিব্যময়ীর, কেউ বলছেন তা হতে পারে না। আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ীই মতামত দেবো।
ভাষাপ্রসঙ্গে আমাদের পর্যবেক্ষণের আগে সিলেটি ভাষার প্রেক্ষাপট নিয়েও দু-একটি কথা বলা আবশ্যক। প্রথম কথা হচ্ছে বাংলাভাষার একটি উপভাষা হিসেবে সিলেটের উপভাষা বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে তা নানা রূপ ধারণ করে এবং এটা শতবর্ষ আগে থেকেই। সিলেটে বিদ্যমান ভাষারূপের বৈচিত্র্য নিয়ে প্রথম কথা তুলেন জর্জ গ্রিয়ারসন তাঁর ‘লিঙ্গুইস্টিকস সার্ভে ইন ইনডিয়া’ (১৯০৩-১৯২৭) গ্রন্থে। গ্রন্থটি বিশশতকের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে গ্রিয়ারসন সিলেটকে Assam District of Sylhetধরে ভাষারূপ নিয়ে বলেন যে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভাষা পূর্ববঙ্গ ঘেঁষা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল বঙ্গীয় প্রভাব মুক্ত এবং অধিক বিকৃত। এমনকি সিলেটি উপভাষাকে পূর্ববঙ্গীয় উপশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে Western Sylhet এবং Eastern Sylhet বা Ujania এই দু-ভাগে বিভক্তও করেন। পরে সুনীতিকুমার, গোপাল হালদার, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, আবদুল হাই, মনিরুজ্জামান সকলেই মোটাদাগে এই বৈচিত্র্যের কথা বলেন। আমার নিজের গবেষণায়ও (২০০৫-২০০৮) বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছি। অর্থাৎ সিলেটি ভাষার এই বৈচিত্র্য শুধু বাগর্থিক নয়, বরং ধ্বনিতাত্তি¡ক, রূপমূলতাত্তি¡ক, বাক্যতাত্তি¡ক এমনকি সমাজভাষাতাত্তি¡কও। সুতরাং ভাষাবৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে এই দুই গানের মধ্যের নানারূপ পার্থক্য বিদ্যমান। সার্বিক বিবেচনায় প্রচলিত পাঠকে ‘উজানি’ এবং বিদ্যময়ীর পাঠকে ‘ভাটি’ অঞ্চলের বলে চিহ্নিত করা সম্ভব। যেমন,
‘আইলা’ উজানি অঞ্চলের সম্মানসূচক/বহুবচনজ্ঞাপক ক্রিয়াপদ; কিন্তু ‘আইলো’ ভাটি অঞ্চলের সম্মানসূচক/বহুবচনজ্ঞাপক ক্রিয়াপদ। উজানি অঞ্চলে সম্মানসূচক/বহুবচনজ্ঞাপক অর্থে ‘আইলো’ ব্যবহার হয় না। এটা বরং তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হয়। অথবা সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। বড়ো ছোটোকে বলতে পারে, ছোটো বড়োকে নয়। চর্যাপদেও আইলা ক্রিয়াপদের ব্যবহার আছে। ‘যে যে আইলা’ ইত্যাদি।
‘গেলা’ও উজানি অঞ্চলের রূপমুল। সম্মানসূচক/বহুবচনজ্ঞাপকতায় তার ব্যবহার সর্বত্রই। প্রভাবে ভাটিতেও প্রচলন দেখা যায়। উদাহরণ, ‘তাইন গেলা যে’; তারা গেলা তো। চর্যাপদেও এই রূপমূল বহুবচনবাচকতায় ব্যবহার হতে দেখি। ‘তে তে গেলা’ ইত্যাদি।
‘নয়া’ উজানি অঞ্চলের রূপমূল, যা নতুন অর্থে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে মুসলমান সমাজে ‘নয়া’ শব্দের ব্যবহার বেশি। ‘নোয়া’ ভাটি রূপমূল, বিশেষত হিন্দুসমাজে প্রচলন বেশি।
একইভাবে ‘দামান/দামান্দ’ শব্দটি ফারসিজাত মুসলমান-সমাজের শব্দ। এর হিন্দুসমাজের প্রতিশব্দ জামাই। ভাটি অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ‘জামাই’ ব্যবহার হয়। তবে মুসলমান সমাজে ‘দামান’/’দামান্দ’ ব্যবহারও আছে। কিন্তু উজানি অঞ্চলে মুসলমান সমাজে জামাই ব্যবহার হয় না বললেই চলে।
‘আসমান’ ফারসিজাত শব্দ। সিলেটি উপভাষায় মুসলমান সমাজে ‘আসমান’ হিন্দু সমাজে ‘আকাশ’ ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। উজানিতে মুসলমান সমাজে ‘আকাশ’ বলাই হয় না। ভাটিতে মুসলমানরা ‘আকাশ’ও বলেন। ভাষাপ্রভাবের কারণেই এটা হয়েছে। আসমানের সাধারণ উচ্চারণ ‘আশমান’ না হয়ে ‘আসমান’।
‘তারা’ শব্দটা উজানিতে ‘তেরা’ই। মুসলমান সমাজেও ‘তেরা’। ভাটি অঞ্চলে বিশেষ করে হিন্দু সমাজে তারা, তবে সর্বত্র নয়। ‘তেরা’কে যারা ‘বাঁকা’ অর্থে বলছেন সেটা সঠিক নয়। ‘তেরাফুল’ বলে সিলেটে বেতজাতীয় একপ্রকার ফুলকেও বুঝায়; সেটা তারার সাদৃশ্যেই। ‘বাঁকা’ অর্থে ‘ত্যাড়া’।
‘শাইল ধান’ বিশেষ করে উজানি অঞ্চলের ফসল। ভাটি অঞ্চলে আমন ও বোরো; শাইলও হয় তবে প্রধান ফসল নয়। আবার দু-অঞ্চলে উপ-অঞ্চল বিশেষে ব্যতিক্রমও আছে। সুতরাং ‘শাইল’ শব্দটি ভাষাসৃষ্টির ভৌত-উপাদানজনিত সৃষ্ট শব্দ, যা উজানি; ভাটির নয়।
‘বাটার পান’ উজানি অঞ্চলের শব্দ-বন্ধ এবং মুসলমানি অনুষঙ্গ। বাটা সংস্কৃতজাত শব্দ নয়; দেশি। পানবাটা-গুয়াবাটা ছাড়া মুসলমান সমাজে বিবাহরীতি অসম্ভব ছিল। আজও সেটা প্রচলিত।
‘কাটিয়া’ উজানি ক্রিয়াপদ; ভাটিতে কাইট্যা রূপমূল।
‘ভাই’ সম্বোধন মুসলমান সমাজেই প্রচলিত; হিন্দুসমাজে দাদার প্রচলন। মুসলমান সমাজে দাদাভাইয়েরও প্রচলন আছে।
‘হিজলের মোড়া’; হিজল বিশেষ করে ভাটি অঞ্চলের গাছ হলেও সারা সিলেটে হিজল গাছের ছড়াছড়ি রয়েছে এখনও। সুতরাং এর ভাষানুষঙ্গের দাবিদার উজান সিলেটের যে হতে পারে তাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
‘ফেদা’ কাদা অর্থে ভাটিতে ব্যবহৃত শব্দ। উজানিতে ‘ফেখ’; ভাটিতেও এর ব্যবহার আছে; তবে ‘ফেদইল’ শব্দের ব্যবহার উজানিতে দুর্লক্ষ নয়।
‘ফেদা’ উজানিতে ফারসিজাত আরেকটি শব্দ। ফে’র এর পরে লংভাওয়েল উচ্চারিতহয়। পেয়াদা/লাঠিয়াল অর্থে ব্যবহৃত আছে। উজানিতে ‘ফেঁদার গাও’ বলে একটি গ্রামও আছে; যা পূর্বে গোয়াইন ঘাট বর্তমানের কোম্পানিগঞ্জের সংগে সংযুক্ত।
উড়া বাঁশনির্মিত টুকরি অর্থে সিলেটি শব্দ; মূলত যা উজানি। উপ-আঞ্চলিক রূপ বা ভাটিরূপ উরা।
‘বইন’; কইন্যার ভাই এ-দুটো সম্বন্ধবাচক শব্দ মুসলমান সমাজে বেশি ব্যবহৃত হয়। হিন্দুসমাজের ভাষায় দিদি ও কইন্যার দাদাই ব্যবহার হওয়া সঙ্গত।
‘কইবা’ উজানি সম্মানসূচক/বহুবচনবাচক রূপমূল/ক্রিয়া। অইগেলাও একই ধরনের রূপমূল।
‘চেরা’ অবয়ব/মুখ অর্থে উজানি রূপমূল। ফারসিজাত ‘চেহরা’ থেকে আগত।
‘বটর গাইল’। বট উজানি অঞ্চলের বৃক্ষ। ভাটিতে কচিৎ মেলে। এছাড়া বটর গাইল ভারী অর্থে উজানি অঞ্চলের বাগধারা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বটের গাইল সিলেটিতে কখনও হয় না। সিলেটিতে ঘরের নয়, ঘরর; তলের নয়, তলর। সুতরাং বটের নয়, বটরই হবে।
‘কাটিয়া’ উজানি রূপমূল; অন্যদিকে কাইট্যা ভাটি অঞ্চলের।
‘চান’ সিলেটিতে উজান-ভাটি উভয় অঞ্চলে ব্যবহৃত হলেও প্রয়োগ বিশেষত্বও আছে। হিন্দুসমাজের বড়ো একটা অংশ চন্দ্র বলেন; মুসলমান সমাজে শুধু চানই। শিক্ষিত জনেরা আকাশ বলেন।
‘কুঞ্জ’ হিন্দুবিবাহরীতির অনুষঙ্গ; মুসলমান সমাজের রিচ্যুয়ালে তার প্রয়োগ নেই। একইভাবে ‘সাজানি’ এবং ‘হাজানি’ ব্যবহারে ধর্মভিত্তিক বৈচিত্র্য দুর্লক্ষ নয়। ‘সাজিয়া’ সাধারণত হিন্দুসমাজের ব্যবহৃত রূপমূল। মুসলমান সমাজে হাজিয়া লক্ষণীয়; ‘সাজিয়া’ও চলে।
‘বইছে’ ক্রিয়াপদ উজানি-ভাটি উভয় অঞ্চলে ব্যবহৃত হলেও অঞ্চলবিশেষে এর প্রয়োগ-বিশেষত্ব আছে। উজানি অঞ্চলে বইছে ক্রিয়াপদ সাধারণ বা তুচ্ছর্থে ব্যবহৃত হলেও ভাটি অঞ্চলে সম্মানার্থে ব্যবহৃত হয়। জামাই আইছে কিন্তু উজানিতে হচ্ছে জামাই ‘বইছইন’/ ‘দামান বইছইন’। একইভাবে ভাটি অঞ্চলে আইছে বহুবচনে সম্মানসূচক ক্রিয়া হলেও উজানিকে ‘পাড়ার লোকে দেখতে আইছে’ এর পরিবর্তে হবে ‘পাড়ার লোকে দেখতে ‘আইছইন’/ ‘আইছন’।
অর্থাৎ উজানি সিলেটের উপভাষায় বহুবচন-বাচক রূপমূল ‘এ’, ‘অ’ নয়। একইভাবে ‘ছে’ নয়, ‘ছইন’/ ‘ছন’।
ধ্বনিতাত্ত্বিক দিক থেকে উজানি ‘ড়’, ভাটিতে ‘র’ হিসেবে প্রায়শ উচ্চারিত।
সুতরাং ভাষাসৃষ্টির উপাদান অর্থাৎ ভূপ্রকৃতি বা ভৌত-পরিবেশ, আর্থসামাজিক পরিবেশ, সমাজসংস্কৃতি, ধর্মীয় রীতিনীতি, সমাজশ্রেণি ও অপরাপর ভাষাবৈজ্ঞানিক বিবেচনায় প্রচলিত ‘আইলারে নয়া দামান’ গানটিকে উজানি অঞ্চলের এবং ‘আইলোরে নোয়া জামাই গান’টিকে ভাটি অঞ্চলের ভাষাবৈশিষ্ট্য রচিত বলে ধরে নিতে পারি।
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় কোনটি গানের আদিরূপ?
দিব্যময়ী দাশের ভণিতায় গানটি যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে প্রথমে সেটাই বিচার-বিবেচনা করে দেখতে হয়; দাবিদার সহ অনেকের যুক্তিও সেখানে। শাকুর মজিদ লিখেছেন দিব্যময়ীর পক্ষেই এমন গান রচনা করা সম্ভব। সাইমন জাকারিয়াও আশিংক দাবির স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাহলে বলতে হয় গানটির আদি রচয়িতা দিব্যময়ীর ‘আইলোরে নোয়া জামাই’র বিবর্তিত রূপ ‘আইলোরে নয়া দামান’। আর সেটা মেনে নিতে হলে দিব্যময়ী দাশকে লোককবি স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর ভণিতায় প্রাপ্ত গানের ভাব ও ভাষার সঙ্গে এই গানের ভাব ও ভাষার সাদৃশ্য বিচার করে দেখতে হয়। দিব্যময়ীর ব্যাপারে যতটা জানা গেছে তিনি ধামাইলভাব ও রসিকতাপূর্ণ বিষয় নিয়ে প্রেমগান রচনা করতে পারতেন। আমরা যদি দিব্যময়ীর সেসব গানের ভাষা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব তাঁর প্রত্যেকটি গানের ভাষা আঞ্চলিক হয়েও মান্যভাষামুখী। বিভিন্ন উৎস থেকে অন্তত আমরা যেসব গান হাতের কাছে পেয়েছি [পরিশিষ্ট-২-এ উদ্ধৃত] । শুধুমাত্র ‘আইলোরে নোয়া জামাই’র ভাষা সামান্য ব্যতিক্রম।
প্রথমেই দিব্যময়ী দাশের অপরাপর গানের [পরিশিষ্ট-২-এর (১-৫) সংখ্যক গান] ভাষাতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যাক। নিচে গানগুলোতে ভাষিক উপাদান হিসেবে রূপমূল, ক্রিয়ারূপ, সর্বনাম/বিশেষণ, অব্যয় ও শব্দভাণ্ডার উদ্ধৃত হলো :
রূপমূল : ওরে, তে, রে, গো, টি, র, য়, এ, গণ, নি, এর, মু, ও,ত, র, ওগো, এরও, খানি, ই, লাগি, নারে।
ক্রিয়াপদ : রাখলে, আইও, পাইবায়, করে, করি, আইও, আইসা, দিও, করে, শুন, হইয়া, যায়, বাজাইয়া, বাজায়, মারে, চলো, যাই, মিলিয়া, শুনছ, আইছে, আইছে, চিরো, চিরাইমু, দিয়া, নাচাইমু, অইও, ধরে, আইলো, হইলো, গাথিয়া, ছিল, সাজাইতাম, সাজাইয়া, পইরাছি, দিতাম, কইরা, মাইলে, জানিয়ে, দিলাম, হইলাম, ফিরি, কান্দে, হরিয়া, নিরায়, গেলায়, লইও, হয়, শুনি, যায়, উঠে, বলিয়া।
সর্বনাম/বিশেষণ প্রভৃতি : তুই, আমার, আমি, তোমার, তুমি, তোরা, নাই, তার, আরেক, নইলে, তারা, নাকি, কী, যে, ওই, আজ, এই, তোর, সব, ওই।
অব্যয় প্রভৃতি : আর, না, নাহি, আর, যেন ।
শব্দভাণ্ডার : বন্ধু, রসিকচান, মান, সাবধান, অপমান, ফুলতারা, চিন্তামণি, কানাকানি, দিনরজনী, প্রেম, আগুয়ান, নিষেধ, বারেবার, ভরদুপুর, নিশাকাল, বাঁশি, অবলা, নারী, মন, টান, সদা, উচাটন, জীবন, মরণ, প্রাণ, বাণ, নীরব, সুন্দর বাঁশি, হেচকা, কলসি, জল, যমুনা, সখি, রাই, এক, ভাই, নোয়া, জামাই, বলদ, গাই, সঙ্গে, লোহা, জিঞ্জিল, গলা, বান্দর, ত্যক্ত, ঠাট্টা, কথা, বাহির, সজনী, কোকিলা, ধ্বনি, প্রাণ, ধৈর্য, প্রাণবন্ধু, কুঞ্জ, সই, প্রভাত, রজনী, ফুল, মালা, দ্বিগুণ, জ্বালা, মন, রসিকমণি, বাসরশয্যা, বড়ো, লজ্জা, প্রাণবন্ধু, যৌবন, মনচোরা, কালিয়া, পিরিতি, রীতি, আপন, মান, কুলমান, চরণ, দোষী, লোক, মন, বনে বনে, দিনরাতি, জীবন, সর্বস্ব, ধন, করিয়া, ডাকাতি, দরশন, অন্তিমকাল,বইন,কোল, মিনতি, আশা, গুণমণি, রুনুঝুনু, শব্দ, চমকিয়া, হিয়া, বাজায়, জয়রাধা,কাইল।
দেখা যাচ্ছে এসব গানের ভাষার রূপমূলে সিলেটি হাতেগোনা; ক্রিয়াপদের কিছু গঠন সিলেটি রূপমূলসাধিত হলেও বেশিরভাগই মান্যবাংলার। সর্বনাম, বিশেষণ ও অব্যয় পদের ক্ষেত্রেও তাই। আর শব্দভাণ্ডারের লক্ষণীয় হচ্ছে ‘নোয়া’ ও ‘জিঞ্জিল’ ছাড়া সব শব্দই মানবাংলার।
এবার দিব্যময়ী দাশ রচিত ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ [পরিশিষ্ট-১-এর পাঠ-৪-সংখ্যক গীত] গানের ভাষাতাত্তি¡ক উপাদান নিচে উদ্ধৃত করছি :
রূপমূল : ও, এর, অইন, রে, বার, এরও, এর, লাগি, গো, র, এ, মু, ইয়া, ইছে,।
ক্রিয়াপদ : আইলো, বিছাইয়া, দেও, বও, দেখতে, উঠতে-বইতে, লাগে, করইন, দিলে, পরে (পড়ে), যাইবার, কইন, কাইট্টা, রাখমু, বইছে, দেখতে, আইছে।
শব্দভাণ্ডার : নোয়া, জামাই, আসমান, তারা, বিছানা, শাইল, ধান, নেরা, ভাই-বৌ, বট (বটের), গাইল, ছ‘মাস, আইন চাইন, হিজল (হিজলেরো), বইন, মোড়া, টুনকি, ফেদা, ষাইট, সত্তইর, উরা, ভাই, চান, কান, কুঞ্জ, ভিতর, সাজিয়া, পাড়ার, লোক, বিয়া, যদি।
উপর্যুক্ত ভাষাতাত্ত্বিক উপাদানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এইগানের রূপমূল, ক্রিয়াপদ ও শব্দভাণ্ডারের বেশিরভাগই সিলেটি ঔপভাষী উপাদান-বিশিষ্ট। শুধু তাই নয় গানের পাঁচটি স্তবকের মধ্যে মাঝখানের তিনস্তবকের সবটাই সিলেটি; আর প্রথম ও শেষ স্তবকদুটোতে সিলেটি উপাদান কম এবং তা মান্যমুখী। সুতরাং প্রশ্ন দাঁড়ায় দিব্যময়ী দাশের এই রচনায় ভাষাগত ব্যতিক্রম ঘটল কেন? আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষযোগ্য যে, মাঝখানের যে-তিন-স্তবক সিলেটি উপাদানে ভরপুর সে-তিন স্তবক ‘আইলারে নয়া দামান’গানের ধারাবাহিকতা ও কিছু শব্দ বাদে প্রায় একই।
প্রমাণস্বরূপ এবারে ‘আইলারে নয়া দামান’ [পরিশিষ্ট-১-এর পাঠ-১-সংখ্যক গীত] গানের ভাষা-উপাদান নিচে দেওয়া হলো :
রূপমূল : আ, রে, বার, ইয়া, এরও, এর, লাগি, গো, র, এ, লাগি, ত, র, গেলা, খান।
ক্রিয়ারূপ : আইলা, বিছাইয়া, দেও, বও, কওরে, খাওরে, চাওরে, যাইবার, কাটিয়া, রাখমু, দিলে, দেখতে, উঠতে-বইতে, লাগে, করইন, দিলে, পড়ে, যাইবার, কইন, রাখমু, বইছে, দেখতে, আইছে, লাগে, দেইখ্যা, অইগেলা।
শব্দভাণ্ডার : নয়া, দামান, আসমান, তেরা, বিছানা, শাইল, ধান, নেরা, কথা, বাটা, পান, কান, ভাই-বৌ, বইন, বট, গাইল, মাটি, আইন-চাইন, হিজল(হিজলেরো), মুড়া, টুকনি, ষাইট, সত্তইর, উড়া, ভাই, সময়, চেরা, বোবা, এক, যদি।
এখানে আমরা যেসব ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান দেখছি যেমন রূপমূল, ক্রিয়ারূপ, শব্দভাণ্ডার ও বাক্যকাত্ত্বিক দিক; এমনকি সমাজভাষাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া-পদ্ধতিও সবই উজানি সিলেটি ভাষার। অর্থাৎ, আমরা যদি ধরে নিই দিব্যময়ী দাশ গানটির আদি রচয়িতা তাহলে মেনে নিতে হবে যে, মাঝখানের স্তবক-তিনটি ওলটপালট করে দিয়ে এবং প্রথম ও শেষ স্তবক পরিবর্তন করে গানটি বর্তমান বহুল প্রচলিত ‘আইলারে নয়া দামান’ রূপটি পেয়েছে। অথবা ভাষাতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণে দিব্যময়ীর রচনা প্রথম ও শেষ স্তবক, আর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবক অন্য কারও; এগুলো কিছুতেই দিব্যময়ীর নয়, হতে পারে না, কারণ এটা দিব্যময়ীর অপরাপর গানের ভাষাবৈশিষ্ট্য নয়।এদিকে শরদিন্দ ভট্টাচার্য্যও তার থিসিসে আরও কয়েকটি মুসলিম বিয়ের গীত উদ্ধৃত করে এগুলোর ভাষা-সুরের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে বলেছেন গানগুলো হিন্দু বিয়ের গানের চেয়ে স্বতন্ত্র। (শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য, সিলেটের লোকনাট্য ও লোকগীত, ২০০৯)
আবার, ভাষাতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ অন্যকথাও বলে যে, ‘আইলো রে নোয়া জামাই’ গানটির দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবকের ভাষাবৈজ্ঞানিক প্রবণতা প্রথম স্তবকের ‘নোয়া জামাই’ ও ‘তারা’ শব্দগুলো বাদে সবটুকুতেই প্রবাহিত। এমনকি কাব্যসৌন্দর্য বিচারেও ‘তারা’র সঙ্গে ‘নেরা’র অন্তমিল অস্বাভাবিক। বরং ‘তেরা’টাই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। আবার উপরের চার স্তবকের ভাষাসঙ্গতির সঙ্গে শেষস্তবক বেমানান ঠেকে। ভাবগত দিক থেকেও তাই।
সমাজসংস্কৃতি ও লোকাচারের বিষয় যদি বিবেচনা করি তাতেও কিছু প্রশ্ন দেখা দেয় ‘আইলো রে নোয়া জামাই’য়ের ক্ষেত্রে। রামকানাই দাশ একজায়গায় বলেছেন তাঁর মা দিব্যময়ীর লেখা সব গানই ধামাইল। আবার অন্য এক জায়গায় বলেছেন জামাইবান্ধা ও বিয়ার গানও তিনি লিখেছেন। এ-দুকথার মধ্যে বৈপরীত্য আছে। তবু তাঁর কথাকে সত্য ধরে নিয়ে এ-প্রশ্নও তোলা সম্ভব যে ‘আইলো নোয়া জামাই’ যে-পর্বের গান তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতখানি? আর দিব্যময়ী গানটাই-বা কখন রচনা করেছিলেন?
বিদ্যময়ী দাশ বিয়ের আগেই গানটা রচনা করলেন? উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে তিনি রসিকতা করতেন বলেও জানি। সে যুগে বিয়ের পূর্বেও যিনি হবু স্বামীকে নিয়ে গান বেঁধেছেন তাঁর পক্ষে নিজের বিয়ে নিয়েও গানরচনা সম্ভব। কিন্তু গানে যে লোকাচার দেখা যায় শেষস্তববক ছাড়া সবটাতেই সিলেটি মুসলমান সমাজের বিয়ের আচারটা প্রতিফলিত। ‘বাটার পান’ দিয়ে অতিথিকে বরণ থেকে শেষ রসিকতাপর্যন্ত। মূলত মুসলমান বিয়ের রীতির এ-পর্বে নবাগত দামানকে আক্রমণাত্মক রঙ্গরসিকতায় চূড়ান্ত রফাদফা করেই বরণ করে নেওয়া হয়। কিন্তু দিব্যময়ীর গানে বসতে দেওয়ার পরে বাটার পান দিয়ে অভ্যর্থনার বিষয়টিই অনুপস্থিত। সুতরাং ‘আইলারা নেয়া দামান’ গানে লোকাচারের পূর্ণতা যেখানে আছে; ‘আইলো রে নোয়া জামাই’য়ে তা খণ্ডিত। ‘বও দামান কওরে কথা খাওরে বাটার পান/যাইবার লাগি চাওরে যদি কাটিয়া রাখমু কান’ এই কথন দামানের জন্যই, দামানের ভাইয়ের জন্য হতে পারে না। কিন্তু দিব্যময়ীতে আছে ‘আইলোরে জামাইয়ের ভাই আসমানেরো চান/যাইবার লাগি কইন যদি কাইট্টা রাখমু কান’। তাও কথাগুলো বলা হচ্ছে ভণিতাংশের ঠিক আগেই অর্থাৎ শেষলগ্নে। আর প্রচলিত ‘আইলারো নেয়া দামান’ গানে কথাটা দামানকে বলা হচ্ছে বরণ-মুহূর্তেই।
এখানে এবার ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ গানের ভিন্ন পাঠটি নিয়েও কথা বলা দরকার। দেখা যায় গানটির শুরু হয়েছে ‘আইলারে নোয়া জামাই আছমানের তেরা দিয়ে’ [পরিশিষ্ট-১-এর পাঠ-৩-সংখ্যক গান] । গানটি হিন্দুসমাজে প্রচলিত বলে ভাবা যায় এবং ভাষা ব্যবহারে তা সিলেটের অদূরবর্তী সুনামগঞ্জ অঞ্চলের বলেই মনে হয়। কারণ গানের শব্দে-রূপমূলে-ধ্বনিতে উজানি সিলেটের উপস্থিতি সর্বত্র। এই গানের উপস্থাপনা পরম্পরা এবং বিন্যাস ‘আইলারে নয়া দামানে’র মতোই। ‘আইলো’ এর পরিবর্তে শুরু হয়েছে ‘আইলা’ দিয়ে, ‘আসমানে’র উচ্চারণ ‘আশমান’-এর বদলে ‘আসমান’, ‘নয়া’র পরিবর্তে ‘নোয়া’, এবং ‘দামানে’র পরিবর্তে ‘জামাই’। অভ্যর্থনায় ‘বও’ শব্দ একবার এবং গানটি ভণিতাহীন। এক্ষেত্রে ভাবা সম্ভব দিব্যময়ীর ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ এবং উদ্ধৃত ‘আইলারে নোয়া জামাই’ যে-কোনও একটি থেকে আরেকটি অনুকারী গান। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় এদুটে গানের মধ্যে কোনটি আদি? দিব্যময়ীর গান নাকি অন্য ‘আইলারে নোয়া জামাই’ গান?
৬. সিদ্ধান্ত ও ফলাফল
সুতরাং লোকগানের বৈশিষ্ট্য, বিশেষত সিলেটি বিয়ের গীতের বৈশিষ্ট্য এবং উপরে আলোচিত নানা তথ্য-উপাত্ত, জিজ্ঞাসা ও বিভিন্ন জনের মতামতের ভিত্তিতে আমরা ‘আইলারে নয়া দামানে’র রচয়িতা ও উৎস নিয়ে কিছু ধারণামাত্র পোষণ করতে পারি। উপরে আমরা আলোচনা প্রসঙ্গে কিছু মতামতও দিয়েছি যা এখানে আর পুনরোক্ত করছি না। কিন্তু এটা ঠিক যে বড়োপ্রমাণ ছাড়া আসলে কেউ এব্যাপারে নিশ্চিত ও স্থির সিদ্ধান্ত দিতে পারেন বলেও আমরা মনে করি না। সেই হিসেবে আমাদের ধারণা ও মতামত এই যে,
গানটির রচনাকাল
‘নেরা’ দিয়ে দামান বা জামাইকে বিছানা করে দেওয়ার বিষয়টি দ্বারা মনে হতে পারে অনেক আগের ব্যাপার। বিষয়টি হতে পারে নাও হতে পারে। কারণ দামান/জামাইয়ের চেয়ার-টেবিল-সোফা ইত্যাদির ব্যবহার খুব বেশিদিন আগের নয়।অন্যদিকে শাইল হেমন্তকালীন ফসল। হেমন্তের ধান ওঠার পরেই সিলেট অঞ্চলে বিয়ে শাদি হতো। গ্রামে লোকজনকে বসতে দিতে খড়ের ওপর শক্তকিছু দিয়ে তারও ওপরে কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হতো; বরের আসনসহ। হেমন্তে বিয়ের জন্য শাইল ধানের টাটকা খড় দিয়েই গদি/বিছানা করা হতো। খড় দীর্ঘ বা নরম এই কারণে নয় বরং হেমন্তের টাটকা খড় হিসাবেই শাইল ধানের খড়া দেওয়া হতো। পুরনো খড়ে পোকা থাকে; বাজে গন্ধ থাকে। এটা বরং আয়োজনের বিবরণ। জামাই/দামানকে বসাতে কী আয়োজন হয়েছে তার বর্ণনা। এটা আবার কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনকেই ইঙ্গিত করে। সুতরাং এধরনের আয়োজন গানের প্রাচীনতা দাবি করে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এখনও উঠানে খড় বিছিয়ে বাঁশ কিংবা বেতজাতীয় চাটাই দিয়ে বসবার ব্যবস্থা করা হয়। তাই গানটি অর্বাচীনকালের রচনা হতেও বাধা নেই। অন্যদিকে পুরোগানটি রঙ্গতামাশা বা ঠাট্টামূলক। বিয়ের এই পর্বে কনেপক্ষ নানাভাবে বরপক্ষকে নাজেহাল করতে চায়। পরাজিত করে তবে কন্যাকে বরের হাতে সঁপে দিতে চায়। এই রীতিতে স্তুতিস্থলে নিন্দা এবং নিন্দাস্থলে স্তুতি করা হয়। বরপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করে কনেপক্ষ নিজেদের শ্রেষ্ঠ করে তোলাই এধরনের রীতির মূল উদ্দেশ্য। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম বিয়ে রীতিতে এমন প্রচলন লক্ষণীয়। তাই গানের কথাগুলো বাস্তবতার রঙ্গব্যঙ্গমূলকভাবেই স্ফূরিত। এই রঙ্গব্যঙ্গ অনেক আগে যেমন ছিল এখনও তা বহমান আছে অন্তত গ্রামসিলেটের সমাজে। তবু, গানের প্রত্নভাষা বিচার করে বিশশতকের ষাটের দশকে রচিত গান বলেই অনুমিত হয়। আবার এটা স্বাধীনতার সূচনাকালে; এমনকি বেতারে প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিতও হতে পারে। অনেক বয়োবৃদ্ধের সঙ্গেও কথা বলে জানা গেছে তাঁরা গানটি প্রথম শুনেছেন বেতারের কল্যাণে। তারপর মুখে মুখে গানের কথা শুনেছেন; বিয়েবাড়িতে শুনেছেন। গ্রাম-গ্রামান্তরে। কিন্তু দিব্যময়ীর গান বিবেচনা করলে ধরে নিতে হবে তা আরও তিরিশ বছর আগেকার গান। রামকানাই দাশ (১৯৩৫) ও সুষমা দাশের (১৯৩০) জন্ম তিরিশের দশকে। তাঁদের মা দিব্যময়ীর বিয়ে হয়েছে আরও আগে। কেননা গানে নিজের বিয়ের প্রসঙ্গ আছে। যদিও কাবেরী দাশ বলছেন গানটি ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে লেখা।
গানটির আদিরূপ
গান-দুটির ভাষাতাত্ত্বিক রূপ ও সমাজসংস্কৃতি এবং নৃতত্ত্ব ও লোকাচার প্রভৃতি বিবেচনা করে এ-ধারণা পোষণ করা সম্ভব যে মূলগানটি উজান সিলেটের রচনা। ‘আইলা রে নয়া দামান’ উৎসমুখের গানটিই সিলেট শহরের চারদিক; এমনকি জৈন্তা থেকে গোবিন্দগঞ্জ; জকিগঞ্জ থেকে বিশ্বনাথ; গোয়াইন ঘাট থেকে বিয়ানিবাজার-মৌলভীবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার কোনও অঞ্চলের কবির রচনা। তবে ভাষার দিক থেকে সিলেট শহরের আশপাশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ‘শাইল ধানের নেরা’ এক্ষেত্রে গভীর অর্থবহ। আগেও এব্যাপারে কিছু কথা বলা হয়েছে যে হেমন্তের ধানকাটার পর ছিল বিয়ের মৌসুম। শাইলধানের নেরা সংরক্ষণও করা হতো সারাবছরের জন্য গরুর খাবার হিসেবে। বিয়ের বিছানায়ও ব্যবহার করা হতো নানা কারণে। আর ভাটি অঞ্চলের প্রধান ফসল বোরো; তাহলে সেখানকার গান হলে শাইল ধানের পরিবর্তে আমন ধানের নেরার কথা বলা হতো। একইভাবে ‘পেয়াদা’ অর্থে ‘ফেদা’ শব্দের ব্যবহারও একদিকে যেমন প্রাচীনত্ব, অন্যদিকে উজানি শাসনব্যবস্থাকেও ইঙ্গিত করে। ধারণা করা যায় প্রথমে একটি ছিল ব্যক্তিগত রচনা, পরে এটি লোকমুখে প্রচলিত-প্রসারিত-বিস্তারিত হয়ে অথবা অবিকৃতভাবেই রেডিও পর্যন্ত পৌঁছায়।
গানটিতে লোকাচারের পূর্ণাঙ্গতাও এর বড়ো প্রমাণ। আদিগানের মূল অংশ কখনওই পরিত্যক্ত হয় না। যেভাবে ‘আইলোরে নোয়া জামাই আছমানেরো তেরা’তে পরিত্যক্ত হয়নি। অর্থাৎ আমাদের বক্তব্য যে ‘আইলোরে নোয়া জামাই আসমানের তারা’ তৃতীয় ধাপে রচিত একটি গান। প্রথম সৃষ্টি ‘আইলা রে নয়া দামান আসমানেরো তেরা’; দ্বিতীয়বারে পরিবর্তিত ‘আইলারে নোয়া জামাই আছমানেরো তেরা’ এবং তৃতীয় ধাপে ‘আইলোরে নোয়া জামাইআসমানের তারা’ রূপ। তাই প্রথম ও দ্বিতীয় পাঠের অভ্যর্থনা ও লোকাচারে পূর্ণরূপ থাকলেও তৃতীয়টির (অর্থাৎ দিব্যময়ীতে) উৎসমুখের পরের অন্তরায়ই অতিথি আপ্যায়নের কথা যেখানে আছে পরিত্যক্ত আকারেই গীত হয়েছে। আবার, প্রথম ধাপের আসমানেরো তেরা, দ্বিতীয় ধাপে আছমানেরো তেরা’ এবং তৃতীয় ধাপে তা আসমানের তারা’তে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। অন্যদিকে তৃতীয় পাঠটি অস্বাভাবিকও। শাকুর মজিদ এক জায়গায় লিখেছেন যে, ‘এ নিয়ে ঘুম হারাম না করে, বরং এই গানের মধ্যে সিলেটের প্রাচীন কালের নতুন অতিথি আপ্যায়নের যে সংস্কৃতির কথা উঠে এসেছে তা নিয়ে আলোচনা করুন’। তাঁর কথাটা সত্যি; কিন্তু যে-গানটিকে তিনি আদিরূপ বলছেন তাতে তো অতিথি আপ্যায়নের বিষয়টিই নেই। এছাড়া দিব্যময়ীর ভণিতার গান বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন এবং অসংলগ্নও। গানে লোকাচারের পরম্পরা রক্ষিত হয়নি। ‘এ গো’ ধামাইল টাইপ কথা ও সুর বিয়ের গীতের আবহেরও পরিপন্থী। সুতরাং রেডিওতে প্রচার হওয়ার পরে সিলেটের বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং অঞ্চলবিশেষে লোকমুখে নানা পরিবর্তন-পরিবর্ধন হতে থাকে। সুনামগঞ্জের ভাটিপাড়ায় ‘শাইল ধানের নেরা’র পরিবর্তে ‘আমন ধানের নেরা’র পাঠও পাওয়া যায়। তাই বেতারে ইয়ারুন্নেসা খানম কিংবা হিমাংশু বিশ্বাসরা যে-সমবেত গানটি গান সেই প্রত্নরূপ জনপ্রিয় হয়ে নানা আকার ও সুর ধারণ করে।
গানটির আদি রচয়িতা
হাসন রাজা, সিদ্দিকুর রহমান, সহিফা বানু, গিয়াসউদ্দিন আহমেদকেও এই গানের রচয়িতা বলে অনেকে মত প্রকাশ করলেও এঁরা কেউই এর রচয়িতা বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। হাসন রাজা ও সহিফা বানু এধরনের গান রচনা করেননি। সিদ্দিকুর রহমান, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ কিংবা আজিজুর রহমান তাঁদের গান লিখে রাখতেন। নিজেদের গানের ব্যাপারে তাঁরা খুবই সজাগ ছিলেন। জীবিত অবস্থায় তাঁদের গানের সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। গানটির ভাব ও ভাষার সঙ্গে গিয়াসউদ্দিনের বিয়ের গানের একটা মিল থাকলেও এ গানটি তাঁর নয়। গানটি গিয়াসউদ্দিন আহমদের জীবদ্দশায় জনপ্রিয় গান হিসেবে প্রচলিত ছিল; তিনিও খুব জনপ্রিয় ছিলেন। সুতরাং বেতারে প্রচলিত নিজ গান ভণিতাহীন গাইতে দিতে পারেন না তিনি। তাঁর কোনও সংকলন বা পাণ্ডুলিপিতেও এই গানের চিহ্ন নেই। গানটির মূল রচয়িতা অজ্ঞাতনামা কেউ হবেন। আদি বিয়ের গান অনামা/অজ্ঞাতনামা থাকাই নিয়ম। জফির সেতু কিংবা জাহান আরা খাতুনের দুটি সংগ্রহে সিলেটের যে শত শত গানের সংগ্রহ তাতে কোনও রচয়িতার নাম নেই। রচয়িতার নাম নেই আশুতোষ ভট্টাচার্য, গুরুসদয় দত্ত, চৌধুরী গোলাম আকবর কিংবা বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত এধরনের মেয়েলি গীতে, বিশেষ করে বিয়ের গীতে। এগুলো সত্যিকার লোকসাহিত্যের উদাহরণ।
দিব্যময়ী দাশের রচনা বলে দাবি
অন্য গবেষক যেমন, সুমনকুমার দাশ গানের ছয়টি পাঠ এবং সর্বমোট আটটি অন্তরার সন্ধান দিয়েছেন। বর্তমান গবেষকও প্রায় সমানসংখ্যক অন্তরা গানসংগ্রহকালে লক্ষ করেছিলেন। এব্যাপারে সুমনকুমার দাশ মন্তব্য হচ্ছে এটি অন্যদের রচনার মতো দিব্যময়ী দাশও লিখে থাকতে পারেন। আমাদেরও এই ধারণা। এক্ষেত্রে যেটা হয় নতুন রচয়িতা প্রচলিত গানের শব্দ বদলে দেন; এমনটাও তিনি ও অন্যরা করেছেন। দিব্যময়ী যেহেতু সকল গানে নিজের ভণিতা ব্যবহার করতেন, এক্ষেত্রেও নিজনামের ভণিতা যুক্ত করে দিয়েছেন। নিজে গাইতেন বলে সুরেরও পরিবর্তন করেন। এক্ষেত্রে ধামাইল-সুরকে তিনি বেছে নেন; এরকম সুরের গানের উদাহরণ হাজিরও করেছেন পুত্র রামকানাই দাশ।
শব্দের অদলবদল করে অন্তরার রূপান্তর প্রসঙ্গে মাঝখানের একটি অন্তরার ‘ফেদা’ শব্দটির কথাই ধরা যাক। দিব্যময়ী দাশের ‘ফেদা’ কিংবা কাবেরি-ব্যাখ্যাত ‘ফেদা’ মানে ‘ময়লা’ বা ‘ফেদইল’ নয়। উজানি সিলেটের ‘ফেদা’ মূলগানের ‘পেয়াদা’/ ‘লাঠিয়াল’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্তরার লাইনের এক ভার্সন হচ্ছে ‘ঠুনকি/টুনকি দিলে মাটি পড়ে ষাইট সত্তইর উড়া’; অন্যভার্সনে আছে, ‘ঠুনকি/টুকনি দিলে ফেদা পড়ে ষাইট সত্তইর জোড়া’। অর্থাৎ হিজলের মোড়া অতিশক্ত পোক্ত জিনিস অর্থে এখানে ব্যবহৃত। দামান্দের ভাই এত শক্তিশালী মানুষ যে টোকা দিলে ষাট-সত্তর জোড়া পেয়াদা/লাঠিয়াল শুইয়া পড়ে। যে-ভার্সনে ‘মাটি’ পড়ার কথা বলা হয়, সেখানে বাক্যের শেষে ‘উড়া’/‘উরা’ ব্যবহার হয়। পূর্ব উল্লেখ করা হয়ে যে ‘উড়া’ উজান সিলেটি শব্দ আর ‘উরা’ ভাটির শব্দ। মাটি কামলারা মাটি ফেলে ‘উড়া’ দিয়ে। দামানের ভাই এতশক্তিশালী যে ষাট-সত্তর উড়া মাটি টোকা দিয়ে ফেলে দিতে পারে। লক্ষণীয় বিষয় যে, আমরা যেটাকে দ্বিতীয় ধাপের রচনা বলছি তার সঙ্গেই দিব্যময়ীর আশ্চর্য মিল যে, তাতে যেখানে ‘ঠুনকি দিলে মাটি পড়ে ষাইট-সত্তইর উড়া’ আছে, দিব্যময়ী লিখেছেন ‘টুকনি দিলে ফেদা পরে ষাইট সত্তইর উরা’। ‘মাটি’র পরিবর্তে ‘ফেদা’টা ‘ময়লা’ অর্থে ব্যবহার করেছেন। ‘উড়া’র ভাটি রূপ ‘উরা’ হয়ে গেছে। কাবেরীও ‘ফেদা’কে ‘উড়া’র সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন। যে-বাক্যে ‘ফেদা’ আছে সেইবাক্যে ‘উরা’/‘উড়া’ নাই। বসালে অর্থ বিকট হয়। ‘ফেদা’র সঙ্গে থাকে ‘ষাইট-সত্তইর জোড়া’ কথাটি। একইভাবে সিলেটি ‘তেরা’আর ‘তেড়া’ শব্দ দুইটা গুলিয়ে ফেলছেন কাবেরী দাশ। উজান সিলেটি শব্দ আর ধ্বনি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না-থাকায় এমনটা হতে পারে। দিব্যময়ী ভণিতার গানেও সেই ভাষাতাত্তি¡ক সমস্যা আছে; যেমন আছে হবিগঞ্জ বা সুনামগঞ্জ অঞ্চলের এই গানে।
অন্যটাও হতে পারে যে; দিব্যময়ী শুধু লোককবিই ছিলেন না। নিজে গান গাইতেন, গান ছড়িয়ে দিতেও ভালোবাসতেন। এই গানটিরও শিল্পী তিনি ছিলেন, গাইতেন। এমনকি সৃষ্টিশীল ছিলেন বলে; রসিকতা জানতেন বলে ঈষৎ পরিবর্তনসহ নিজনামের ভণিতা দিয়েও আনন্দের সঙ্গে গাইতেন। তাঁর সঙ্গীরাও পরে ভণিতাযুক্ত রূপান্তরিত গানটিকে গাইতেন কিংবা তাঁর নিজের লেখা গান বলে মনে করতেন। রামকানাই দাশও তা-ই মনে থাকবেন। এমনটাও অসম্ভব নয়।
আবার; অন্য বিয়ের গান গাওয়ার সময় নিজের নাম জুড়িয়ে দেওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকি দিব্যময়ী লেখাপড়া জানতেন; যদি গানের খাতায় টুকেও গানটি নিজনামে রাখেন তাও যে তাঁর হয়ে যাবে এমন নয়। গানে নাম থাকলেই কিন্তু সেটা ভণিতা/গীতিকার বুঝায় না। গানের খাতায় শিল্পীরা গান টুকে রাখেন; সুতরাং গাওয়ার জন্য টুকে রাখা আর গানরচনা করা এক জিনিস নয়। অন্যদিকে দিব্যমণির অন্য গানের ভাব, ভাষা ও রীতির সঙ্গে এ গান মেলে না।
আরেক কথা; ‘আইলোরে নোয়া জামাই’ দিব্যময়ী কি নিজের বিয়ের পূর্বে রম্যগানের রচনাকালে নিজের বিয়ের কথা নিজেই লিখলেন? এটা নাহয় ধরে নেওয়া হলো। কিন্তু এক্ষেত্রেও ভণিতা কি এখানে আবশ্যক ছিল? অনেকের মতো এটাও আমাদের প্রশ্ন। এমনকি জলবান্ধার গানে এমনভাবের গান কতটা সঙ্গত এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। যেমন গীতিকার শামসুল আলম সেলিম লিখেছেন, ‘বলা হচ্ছে এটি হিন্দু বিয়ের ‘জামাইবান্ধার গান‘। বান্ধা গানে বর-আগমনের সময় গান বান্ধার সুযোগ আছে কি না, কিংবা হিন্দু বিবাহরীতিতে বর আগমনে এরকম হেয়ালি-রসাত্মক গান করার সুযোগ আছে কি না-এরকম বহু প্রশ্ন আমাদের সামনে রয়েছে, বিজ্ঞজনেরা নিশ্চয়ই এর উত্তর খুঁজবেন’। (শামসুল আলম সেলিম, ফেসবুক ওয়ালে মন্তব্য, ৩ মে, ২০২১) সে প্রশ্ন অযৌক্তিকও নয়। আমাদের মনে হয় না গানটি প্রাসঙ্গিক।
আবার; এটাও হওয়া অসম্ভব নয় যে, দিব্যময়ীর বিয়ের সূত্র ধরে বলতে পারি : মূলগানের অনুকরণে বা অনুসরণে রচিত ও বিন্যাসকৃত গানটি দিব্যময়ীর বিয়ের পূর্বে প্রচলিত ছিল এবং দিব্যময়ীর বিয়েতে কেউ এরূপ গেয়েছে! সেটা হওয়ার যুক্তিও কম নয়; কারণ প্রচুর বিয়ের গানে মূল পাত্রপাত্রীর/সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজনের নাম যোগ করে গাওয়া হয়। সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে প্রচলিত বিয়ে তো বটেই, নাটকের মঞ্চেও ‘নোয়া/নয়া জামাই/দামান’ গানেও অনেকস্থলে পাত্রীর নাম যোগ করে গীত হয়েছে; যেমন ‘পাড়ার লোকে দেখতে আইছে শিবানির/সখিনার বিয়া’। এই গানেও পাত্রীর নাম যোগ করে গীত হয়েছে ‘পাড়ার লোকে দেখতে আইছে দিব্যময়ীর বিয়া’। হতে পারে দিব্যময়ীর বিয়ার সময় যারা গেয়েছিল তারা তাঁর নাম যোগ করে গানটা গেয়েছিল যেটা পরে তিনি নিজেও গাইতেন। অথবা নিজে গাওয়ার সময় নিজের নাম যোগ করে গাইতেন। এই গানটাতে বরযাত্রীদের নিয়ে টিটকারি মারা হয়। বরযাত্রীতে ভাই/ভাবী না-থেকে অন্য কেউ থাকলেও তাদের যোগ করা হয়। যেমন আইলা রে দামান্দর মামা/দাদা/নানা/নানি/দুলাভাই প্রভৃতি। কিন্তু দিব্যময়ী ভণিতার গানটি আগাগোড়া ডায়নামিক। সুতরাং এই গানে নাম থাকা আর লোকগানে ভণিতায় নাম থাকা এক নয়। ‘নোয়া জামাই’/ ‘নয়া দামান’ গানে কারও নাম থাকা মানে সে বিয়ার পাত্রী; গানের গীতিকার না। হতে পারে দিব্যগানটির দিব্যময়ীর লেখা। তিনি একটা কাস্টমাইজ ভার্সন গাইতেন।
গানটি যদি দিব্যময়ীর বিয়েরসূত্রে রচিত বা গীত হয় তাহলে এর রচনাকাল/ প্রচলনকাল/উদ্ভবকাল আমাদের পূর্বের ধারণার সঙ্গে মিলে গিয়ে বিশশতকের তিরিশের দশকের আগের গান বলে চিহ্নিত করা সম্ভব। কিন্তু সে সম্ভবনা নেহাত কম বা নেই।
দিব্যময়ী দাশের প্রসঙ্গে শেষ কথা যে; সুষমা দাশের স্মৃতি-শ্রুতি ও অভিজ্ঞানের কথা সেজুল হোসেনের বরাতে বলাও হয়েছে; কিন্তু তিনি মায়ের গান হলেই জানতে পারবেন এমনটা নাও হতে পারে। তবে কথা হলো বহু বিখ্যাত গানটি মা দিব্যময়ী দাশের হলে তাঁর পক্ষে জানাটা অসম্ভব ছিল না। রামকানাই দাশ ও পরিবারের অন্যরা জানতেন তিনি জানতেন না এটা অবিশ্বাস্য ঠেকে।
আলী আকবর খান কার কাছ থেকে লোকগান সংগ্রহ করতেন?
সিলেট বেতারে যে-দুবার বা তারও অধিক আলী আকবার খানের সুরারোপে ‘আইলারে নয়া দামান’ রেকর্ড হয়; স্বাধীনতার পর একবার এবং আশির দশকের শুরুতে আবার, তা নিয়ে দুটি প্রশ্ন আছে এবং গানের উৎসনির্ণয়ে তারও মুসাবিদা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আলী আকবর খান কুমিল্লার লোক ছিলেন, সিলেটি উপভাষা তিনি বলতে পারতেন না, কিন্তু উপভাষায় রচিত অসাধারণ সুর সংযোজন করতে পারতেন। সিলেট বেতারের নিয়মিত আর্টিস্ট ছিলেন তিনি, জমনু মিয়া নামক আরেকজন তবলাবাদকের কথাও জানা যায়। জীবিকার প্রয়োজনেই পল্লিগীতিতে সুরারোপ করতেন আলী আকবর এবং সুর তুলতে নিজ বাসায় সহযোগিতা করতেন জমনু মিয়া। আলী আকবরের কাজ ছিল সিলেটি গান সংগ্রহ করে তাতে সুরারোপ দেওয়া। তখন সিলেট বেতারে নিয়মিত বিয়ের গানের আসর বসত। আসরে বাজানো হতো নিত্যনতুন বিয়ের গান। এসব গানের সংগ্রাহকও ছিলেন আলী আকবর। তিনি শহরের সুবিদবাজারস্থ কলাপাড়ায় সপরিবার থাকতেন। তাঁর শিষ্যরা বর্তমান গবেষণায় এমন সব তথ্য দিয়েছেন যে, আলী আকবর গান সংগ্রহের কথা শিষ্যদের সঙ্গে অকপট আলাপ করতেন এবং জমনু মিয়ার সঙ্গে মিলে যন্ত্রসহ সুর তুলে শিষ্যদের নতুন সুরারোপিত গানের ব্যাপারে মন্তব্য শুনতেন। শিষ্যদের সন্তুষ্ট করতে পারলেই বেতারে জমা দিতেন। তিনি সিলেট শহরে বসবাসরত সংগীতপাগল ও পল্লিগান লিখেন এমন একজনের কাছ থেকেই গানগুলো সংগ্রহ করতেন। সেই লোক নিজের লেখা গান বা অন্যের লেখা গান আলী আকবরকে দিতেন, সেজন্য আলী আকবর গানপ্রতি পাঁচশত টাকা পরিশোধ করতেন। আলী আকবর খানের সঙ্গে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত গান শিখেছেন এমন একজন শিষ্য জানান যে, তিনি একবার তাঁকে এ প্রশ্নও করেছিলেন যে, লোকটি কেন নিজের গান বিক্রি করে দেন বিনাশর্তে? তখন আলী আকবর জবাব দিয়েছিলেন যে, যেখানে পেট চলে না সেখানে নামের দরকার কী? আক্ষেপ করে বলতেন ‘আমাদের নামের দরকার নেই’! এ তথ্য একাধিক জনের কাছ থেকেও পাওয়া যায়। সুতরাং তথ্যটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ যে আলী আকবর খান যার কাছ থেকে গান সংগ্রহ করতেন বা কিনতেন তিনি কে? কী তাঁর পরিচয়? অনেক তথ্য অনুসন্ধান করেও নামটি আবিষ্কার করা যায় না। আলী আকবর খান জীবিত নেই। তাঁর পরিজনদেরও সন্ধান চলছে; যদি তাঁর ডায়েরি পাওয়া যায় তাহলে হয়তো কোনও নতুন তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। অথবা যে-ব্যক্তির কাছ থেকে গান সংগ্রহ করা হতো তাঁর কোনও নোট বা পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেলে বিয়ের গানগুলোর উৎস বেরিয়ে আসার সম্ভবনা। বর্তমান গবেষণার অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে-সময়ে সিলেট বেতার ‘আইলারে নয়া দামান’ সুরারোপ করা হয়েছে প্রায় সমান সময়ে একই সুরকারের অজ্ঞাত আরও কয়েকটি বিয়ের গানের সন্ধান মেলে যার ভাব, ভাষা, লোকাচার, সংস্কৃতি ও উপস্থাপনা সমধর্মী।

লোকগান হিসেবে ‘আইলারে নয়া দামান’
লোকসাহিত্য অর্থাৎ লোকগানের প্রধান ধর্ম হচ্ছে তা মুখে মুখে রচিত এবং তা একক কারও তো নয়ই বরং এধরনের গান সম্মিলিত সৃষ্টি। ভারতীয় তাত্ত্বিকদের মতো পৃথিবীর সকল বরেণ্য ফোকলোরবিদও এমন কথা বলেন। ‘বিয়ের গান’ পরিভাষা অধুনা; এগুলো মূলত গীতই। সিলেট অঞ্চলে বিশেষ করে মুসলমান সমাজে তা মুখেই গাওয়া হতো। এই গীতগুলো নারীদের রচনা; এবং তা মুখে মুখে। সিলেটি বিয়ের গীত সংগ্রহ করা কালেও দেখা গেছে সকল গানই নারীদের মুখে মুখে প্রচলিত এবং গীত। সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই সিলেটের বিয়ের গীতে কারও নামপরিচয় পাওয়া যেমন যায় না; তেমনি তা গোটা অঞ্চলের নারীদের সামগ্রিক সৃষ্টিশীল প্রয়াসও। সাইমন জাকারিয়া যেমনটা বলেছেন। শাকুর মজিদ কিংবা রামকানাই দাশেরও একই কথা লোকগান বিষয়ে। শাকুর মজিদ লিখেছেন যে, ‘[…] লোকগান মুখে মুখে ছড়াতো, তার লিখিত রূপ থাকত না। সে কারণে গায়ক থেকে গায়কে যাওয়ার পর কথা বদল হত, নতুন অন্তরা যুক্ত হত। এটা লোকগানেই হয়ে থাকে’। (শাকুর মজিদ, ফেসবুক আইডিতে দেওয়া স্ট্যাটাস থেকে, ৮ই মে, ২০২১) কিন্তু ‘আইলারে নয়া দামানের ব্যাপারে তিনি আবার এ-তত্ত¡ মানতে নারাজ। রামকানাই দাশ আলাপচারিতায় লোকগানের ধর্ম নিয়ে বলেছেন, […] লোকগীতিটা হচ্ছে যুগ যুগে বহে আসা গান, এ মুখ থেকে সে মুখে। লোকের মুখে মুখে বয়ে আসা গান, যেসব গানের গীতিকারের সন্ধান পাওয়া যায় না […]’। (রামকানাই দাশ, উদ্ধৃত, রামকানাই দাশের নন্দনভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ, ২০১৪) তা যদি সত্য হয় তাহলে বিশেষজ্ঞ হয়েও, মায়ের মুখে গীত এমন মেয়েলি বিয়ের গীতকে(বহুল জনপ্রিয় একই গান প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও), কেন মায়ের রচনা বলে দৃঢ়ভাব পোষণ করলেন তা আমরা বুঝে উঠতে পারি না।
লোকসাহিত্য গবেষক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ্ আলোচিত গান-প্রসঙ্গে লোকগানের চরিত্র, পরিবর্তন ও মৌলিকত্ব বিষয়ে বলছেন যে ‘লোকগান যুগে যুগে শব্দ-পঙ্ক্তির পরিবর্তনের উদাহরণ যথেষ্ট রয়েছে। এক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নাও হতে পারে। তবে লোকগান বা বিয়ের গান যা-ই বলি না কেন কাল-কালান্তরে এর সংযোজন-বিয়োজন ঘটতে পারে এমন সম্ভাবনা আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। সবচেয়ে বড়ো কথা গানের মূলপাঠে বিধৃত ভাষা ধ্বনি, লোকাচার ও লোক পরম্পরা কতটা লক্ষিত হয় এর ওপর সংশ্লিষ্ট গানের মৌলিকত্ব নির্ভরশীল’। (আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, ১৬ মে, ২০২১) ‘আইলারে নয়া দামান’ নিয়ে ইমতিয়ার শামীমের তাত্ত্বিক মতামতটি আমাদের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য মনে হয়। তিনি লিখেছেন যে, ‘যে কোনও কালজয়ী আবেদনময়ী সৃষ্টিই শেষপর্যন্ত ‘প্রচলিত’ বা ‘সংগৃহীত’র কাতারভুক্ত হয়। তার অসংখ্য সংস্করণ তৈরি হয়। স্রষ্টার নাম খুঁজে পাওয়া যাক বা না যাক, সেখানেই স্রষ্টার সার্থকতা’। (ইমতিয়ার শামীম, তন্ময় মোদকের ফেসবুক ওয়াল থেকে মন্তব্য, ৮ই মে, ২০২১) ‘আইলারে নয়া দামানে’র মাঝখানের তিন অন্তরাই গানের মূল চাবিকাঠি এবং কালজয়ীসৃষ্টি। সুতরাং এটিই গানের আদি উৎস ও রচনা এমন ভাবনা অসমীচীন হবে না। ইমতিয়ার শামীমের ইঙ্গিতও এখানে স্পষ্ট যে গানটি ব্যক্তিবিশেষের রচনা হতে পারে না। এটি সত্যিকার অর্থেই একাট লোকগান বা লোকসাহিত্যের বস্তু। নাগরীলিপি ও সাহিত্যের গবেষক মোহাম্মদ সাদিকও লোকসাহিত্যের অনন্য দলিল হিসেবে গানটির উৎস প্রসঙ্গে স্পষ্ট মতামত দিয়েছেন যে,
সত্যিকার লোকগানের রচয়িতা খুঁজতে যাওয়া খড়ের গাদার মধ্যে সুই খুঁজতে যাওয়ার মতোই কঠিন। আমাদের লোকসংগীতে সমষ্টিগত এক মহাসংগীতের চরিত্র আছে যা মহাকাব্যিক। এর রচয়িতা মহান এক জনগোষ্ঠী। কখনও কখনও কে কোন পংক্তি রচনা করেছেন, কে তাতে কোনও পংক্তি সংযোজন বিয়োজন করেছেন, তার সূত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন! লোকসংগীতের সৌন্দর্যও সেখানেই!!!(মোহাম্মদ সাদিক, সেজুল হোসেনের ফেসবুক ওয়াল থেকে মন্তব্য, ৩রা মে, ২০২১)
সুতরাং আমাদের মনে হয় ‘আইলারে নয়া দামান’ গীতটিকে বাংলা লোকসাহিত্যের অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচনা করে লোকগীতি হিসেবেই একে মূল্যায়ন করা উচিৎ। অন্যভাবে দেখতে গেলেই লোকগানের চারিত্র্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে।
সবশেষে একটি প্রশ্ন : রামকানাই দাশের দাবি কতটা গ্রহণযোগ্য?
এটা সত্যি ভাববার মতো বিষয় যে, সংগীতজ্ঞ রামকানাই দাশের এই দাবি কতটা গ্রহণযোগ্য? প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে তাঁর প্রতি যথার্থ সম্মান রেখেইে। প্রশ্ন উত্থিত হবার মূল কারণ হচ্ছে, দিব্যময়ী দাশের লেখা এই গান সম্পর্কে আমরা সকল তথ্য পাই রামকানাই দাশের কাছ থেকে। বাকি সবাই (রামকানাই দাশের পুত্র ও কন্যা) চুম্বক তথ্য নিয়েছেন তাঁরই কাছ থেকে ধার করে। দিব্যময়ী দাশের গুণী সংজ্ঞীতজ্ঞ কন্যা সুষমা দাশও মায়ের রচনা হিসেবে এই গানের খবর জানেন না। গানটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন যাঁরা ইয়ারুন্নেসা খানম, বিদিতলাল দাশ, হিমাংশু বিশ্বাস, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, আকরামুল ইসলাম, দুলাল ভৌমিক, স্বপ্না দে, শুক্লা দে প্রমুখ কিংবা রামকানাই দাশের সমকালীন সকল শিল্পী; তাঁরা কেউই বিষয়টি জানতেন না এটা হতে পারে না। আবার রামকানাই দাশ বেঙ্গল থেকে যে-সিডি বের করেছিলেন তাতে কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘সংগীত ও আমার জীবন’ নামক গ্রন্থে এই গানের রচয়িতা হিসেবে দিব্যময়ীর নাম অনুক্তও রেখেছেন। সুতরাং মুখের কথা থেকেই, তথ্যপ্রমাণ ছাড়া একজনের দেওয়া তথ্য সাপেক্ষে এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সঠিক বলে গ্রহণ করা যৌক্তিক মনে হয় না। এছাড়াও সিলেটের বিভিন্ন লোকগানের কথা ও সুর নিয়ে রামকানাইদাশের নানা বিভ্রান্তিকর তথ্যপ্রদানের বিষয় বর্তমান গবেষণার তথ্য-উপাত্ত হিসেবেও গোচরীভূত হয়। ২০১১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘সংগীত ও আমার জীবন’ গ্রন্থে তিনি এমন কিছু তথ্য দিয়েছিলেন যাতে আহত হয়েছিলেন অনেকেই। বিশেষ করে সাধের লাউ বানাইলে মোরে বৈরাগী ও বিনোদিনী গো তোর বৃন্দাবন কারে দিয়া যাবি এই দুটি গানের সুরকার হিসেবে তিনি নিজেকে উপস্থাপিত করায়। এ-ঘটনায় উপমহাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী ও সুরকার প্রণম্য বিদিতলাল দাশ তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও দায়ের করেন। পরে আদালতের রায়ে বইটি বাজেয়াপ্তও হয়। ২০১৩ সালের ৫ই নভেম্বর সিলেটে আদালতের সিনিয়র জজ নাজিয়া নাহিদ আদালতের পক্ষে রায়টি প্রদান করেছিলেন। (ফকির ইলিয়াসের ফেসবুক ওয়ালে দেওয়া স্ট্যাটাস, ৬ই মে, ২০২১)
শেষকথা
আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম সুবিখ্যাত ‘ক্যারিক ফেরগাস’ গান দিয়ে; সেটিতেও আমরা দেখেছি যে বহুকাল আগে রচিত গানটি লোকমুখে প্রচলিত হতে হতে বর্তমান রূপে বিশ্বদরবারে পৌঁছেছে। মাঝখানের অন্তরাটি শিল্পী ও সংগ্রাহক ডমিনিক বিহানের রচনা হলেও তিনি গানটিকে নিজের বলে দাবি করেননি কখনও। তাহলে সেটি আর লোকগান থাকে না; এমন দাবিতে অন্যান্য রচয়িতাও অসম্মানিত হন এবং সমষ্টিক সৃষ্টি ব্যক্তিমানুষের নামের আড়ালেও ঢাকা পড়ে যায়।
পরিশিষ্ট ১: ‘আইলারে নয়া দামান’ গানের কয়েকটি পাঠ
পাঠ-১
আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা।
বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা \
দামান বও, দামান বও।
বও দামান কওরে কথা খাওরে বাটার পান।
যাইবার লাগি চাওরে যদি কাটিয়া রাখমু কান \
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের ভাই হিজলের মুড়া।
ঠুনকি দিলে মাটি পড়ে ষাইট-সত্তইর উড়া \
(টুনকি দিলে মাটিত পড়ইন ষাইট বছরের বুড়া)
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের বইন কইবা একখান কথা।
কইন্যার ভাইর চেরা দেইখ্যা অইগেলা বোবা \
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের ভাইবৌ মোটা বটর গাইল।
উঠতে বইতে সময় লাগে করইন আইল চাইল \
দামান বও দামান বও।
[সিলেটি বিয়ের গীত, জফির সেতু, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১৩]
পাঠ-২
আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা।
বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা \
দামান বও, দামান বও।
বও দামান কওরে কথা খাওরে বাটার পান।
যাইবার লাগি চাওরে যদি কাটিয়া রাখমু কান \
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের ভাই হিজলের মোড়া।
টুকনি দিলে ফেদা পড়ে ষাইট সত্তইর জোড়া\
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের বইন কইবা একখান কথা।
কইন্যার ভাইর চেরা দেখিয়া অইগেলা বোবা \
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের ভাইবৌ মোটা বটর গাইল।
উঠতে বইতে সময় লাগে করইন আইল চাইল \
দামান বও দামান বও।
(সংগৃহীত)
পাঠ-৩
আইলারে নোয়া জামাই আছমানের তেরা।
বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা \
জামাই বও।
বও জামাই কও কথা খাওরে বাটার পান।
যাইবার লাগি চাওরে যদি কাইট্টা রাখমু কান \
আইলারে জামাইর ভাই হিজলের মুড়া
ঠুনকি দিলে মাটি পড়ে ষাইট-সত্তইর উড়া \
আইলারে জামাইর বইন কইবা একটু কথা।
কইন্যার ভাই চেরা দেইখ্যা হইয়া গেলা বোবা \
আইলারে জামাইর ভাই-বউ দেখতে বটর গাইল।
উঠতে-বইতে সময় লাগে করইন আইন-ছাইন \
(সংগৃহীত)
পাঠ-৪ (দিব্যময়ী দাশ প্রণীত)
আইলো রে নোয়া জামাই আসমানেরো তারা।
বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা\
জামাই বও জামাই বও।
আইলো রে জামাইয়ের ভাই-বৌ দেখতে বটের গাইল।
উঠতে বইতে ছয়মাস লাগে করইন আইন চাইন\
জামাই বও জামাই বও।
আইলোরে জামাইয়ের বইন হিজলেরো মোড়া।
টুকনি দিলে ফেদা পরে ষাইট সত্তইর উরা\
জামাই বও জামাই বও।
আইলোরে জামাইয়ের ভাই আসমানেরো চান।
যাইবার লাগি কওরে যদি কাইট্টা রাখমু কান\
জামাই বও জামাই বও।
কুঞ্জেরো ভিতরে জামাই বইছে গো সাজিয়া
পাড়ার লোকে দেখত আইছে দিব্যময়ীর বিয়া\
জামাই বও জামাই বও।
(দিব্যময়ী দাশ, রামকানাই দাশের ‘অসময়ে দিলাম পাড়ি’ অডিও সিডি, বেঙ্গল)
পাঠ-৫
আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা।
বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেড়া \
দামান বও, দামান বও।
বও দামান কওরে কথা খাওরে বাটার পান।
যাইবার কথা কওরে যদি কাইট্যা রাখমু কান \
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের ভাই হিজলের মুড়া।
ঠুনকি দিলে মাটিত পড়ে গতরের গুঁড়া \
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের বইন কইবা একখান কথা।
কইন্যার ভাইর চেরা দেইখ্যা হইয়া গেলা বোবা \
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের ভাইবউ দেখতে গতর খান।
উঠতে বইতে সময় লাগে পড়ইন আইন-টাইন \
দামান বও দামান বও।
(সিলেটের বিয়ের গীত, জাহান আরা খাতুন, ২০১৭)
পরিশিষ্ট ২: দিব্যময়ী দাশ প্রণীত গান
১.
ওরে বন্ধু রসিকচান রাখলে না
রাখলে না তুই আমার মান
সাবধানে সাবধানে আইও
নইলে পাইবায় অপমান \
ফুলতারা আর চিন্তামণি
তারা করে কানাকানি
আমি নাকি দিনরজনী
তোমার প্রেমে আগুয়ান \
নিষেধ করি বারেবারে
আইও না রে ভরদুপুরে
নিশাকালে আইসা বন্ধু
বাঁশিতে দিও রে টান \
আবলা নারীর মন
গদায় করে উচাটন
তুমি আমার জীবন মরণ
দিব্যময়ীর প্রাণের বাণ \
(দিব্যময়ী দাশ, উদ্ধৃত, রামকানাই দাশের নন্দন ভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ, ২০১৪)
২.
তোরা শুন গো নীরব হইয়া
কী সুন্দর বাঁশিটি যায় বাজাইয়া \
কলসিতে নাই রে জল
চলো যাই যমুনার জল
চলো যাই সখিগণে মিলিয়া \
রুনুঝুনু শব্দ শুনি
ওই যায় গুণমণি
চমকিয়া উঠে রাধার হিয়া \
বাঁশি বাজায় রসিক চান
হেচকা হেচকা মারে টান
বাজায় বাঁশি জয়রাধা বলিয়া \
(দিব্যময়ী দাশ, উদ্ধৃত, রামকানাই দাশের নন্দন ভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ ২০১৪ ও রামকানাই দাশের অডিও সিডি )
৩.
তোমরা শুনছনি গো রাই
কাইল যে আইছে নোয়া জামাই
বলদ নাকি গাই \
এখব বলদ নোয়া জামাই
এক বলদ তার তার ভাই
আরেক বলদ সঙ্গে আইছে
তার বইনের জামাই \
চিরো যদি নোয়া জামাই
আমিও চিরাইমু
লোহার জিঞ্জিল গলাত দিয়া
বান্দর নাচাইমু \
ত্যক্ত অইও না গো জামাই
বেজার অইও না
দিব্যময়ীর ঠাট্টার কথা
বাড়িত কইও না \
(দিব্যময়ী দাশ, উদ্ধৃত, রামকানাই দাশের নন্দন ভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ, ২০১৪)
৪.
তোরা বাহির হইয়া শুন সজনী
ওই করে কোকিলা ধ্বনি।
কোকিলারও কুহু স্বরে
প্রাণ ধৈর্য নাহি ধরে, ওগো সজনী \
আমার প্রাণবন্ধু আইলো না কুঞ্জে
সই গো প্রভাত হইলো রজনী।
গাথিয়া ফুলেরও মালা
এালা হইল দ্বিগুণ জ্বালা, ওগো সজনী \
আমার মনে ছিল ফুলে ফুলে
সাজাইতাম রসিকমণি
সাজাইয়া বাসরশয্যা
আজ পইরাছি বড়ো লজ্জা, ওগো সজনী \
আমার মনে ছিল প্রাণবন্ধুরে
দিতাম দিব্যময়ীর যৌবনখানি, ওগো সজনী \
(দিব্যময়ী দাশ, উদ্ধৃত, রামকানাই দাশের নন্দন ভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ, ২০১৪)
৫.
মনচোরা কালিয়ারে এই কী রে তোমার পীরিতি
ওরে পীরিত কইরা প্রাণে মাইলে এই কী গো তোর রীতি \
বন্ধু তোমার আপন জানিয়ে
মান-কুলমান সবই দিলাম তোমার চরণে
আমি দোষী হইলাম লোকের মনে ফিরি বনে বনে দিনরাতি \
বন্ধু তোমার লাগি কান্দে আমার মন
আমি তোমার তুমি আমার জীবনের জীবন
ওরে হরিয়া নিরায় সর্বস্ব ধন করিয়া গেলায় ডাকাতি \
আমি চাইনারে আর তোমার দরশন
আশায় আশায় দিব্যময়ীর হয় যেন মরণ
আমার অন্তিমকালে লইও কোলে তোমার চরণে এই মিনতি \
(দিব্যময়ী দাশ, উদ্ধৃত, রামকানাই দাশের ‘অসময়ে দিলাম পাড়ি’ অডিও সিডি)
পরিশিষ্ট ৩ : বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলাপ
প্রফেসর আবদুল আজিজ, অ্যামেরিটাম অধ্যাপক; লেখক ও গবেষক;
প্রফেসর নন্দলাল শর্ম্মা, লেখক ও গবেষক;
প্রফেসর নৃপেন্দ্রলাল দাশ, লেখক ও গবেষক;
ডক্টর মোহাম্মদ সাদিক, কবি ও গবেষক;
প্রফেসর ডক্টর আবুল ফতেহ্ ফাত্তাহ, লেখক ও গবেষক;
মিহিরকান্তি চৌধুরী, লেখক ও গবেষক;
আবদুল হামিদ মানিক, লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক;
আল আজাদ, লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সাংবাদিক;
ডক্টর সাইমন জাকারিয়া, নাট্যকার ও লোকসাহিত্য গবেষক;
মিসেস রওশন আজিজ, সংগীতবোদ্ধা;
মিসেস গুলবাহার বেগম, একসময় বিয়ের গীত গাইতেন;
আবিদ ফায়সাল, কবি ও লেখক;
মাহবুব লীলেন, কবি, গল্পকার ও গবেষক;
এবং অন্যান্য।
পরিশিষ্ট ৪ : তথ্যসূত্র
উইকিপিডিয়া;
নিউজবাংলা২৪ডটকম, ৩ শে এপ্রিল, ২০২১, ৮:৩৫;
বিডিনিউজ২৪ডটকম, ৫ই মে, ২০২১, ২২:৩৬;
সমকালডটকম, ৮ই মে, ২০২১;
কাকনফকিরডটকম, ২৯ শে জুলাই, ২০১৭, ৬:৩০;
সেকন্ডহ্যান্ডডটকম
ভাবনগর ফেসবুক পেজ, ৯ই মে, ২০২১;
ম্যাপ টিভি ফেসবুক পেজ, ৭ই মে, ২০২১;
শাকুর মজিদের ভিডিও ফুটেজ;
কাবেরী দাশের ভিডিও ফুটেজ;
বিভিন্ন অডিও সিডি;
রামকানাই দাশের বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের ভিডিও ফুটেজ; প্রভৃতি
পরিশিষ্ট ৫ : ‘আইলারে নয়া দামান’ গানের রচয়িতা-বিতর্ক নিয়ে বিভিন্ন ফেসবুক আইডির পাবলিক পোস্ট এবং পোস্টের ওয়ালে যে-সব অভিমত বা মন্তব্য এসেছে ক্ষেত্রকের্মের তথ্য-উপাত্তের বরাত যাদের:
আল আজাদ; শামসুল আলম সেলিম; মুহিত চৌধুরী; মোহাম্মদ হোসাইন; নাসনির চৌধুরী ডায়না; ফজলুল হক; পুলিন রায়; নিশীত সূর্য; ফকির ইলিয়াস; সুফি সুফিয়ান; মিদহাত আহমেদ; দীপঙ্কর মোহান্ত; কাকন ফকির; মাহবুবুর রহমান লায়েক; মিসফাক আহমেদ মিশু, মোহাম্মদ সাদিক, মাধব কর্মকার; আবদুল জলিল; একুশ তাপাদার; রামানুজ রায়; মো. লুলন; আবিদ ফায়সাল; আমি জন; সাকি চৌধুরী; তন্ময় মোদক; রাজীব নূর; ইমতিয়ার শামীম; সাকিব আহমেদ রণি; ফারুক আহমেদ; আতিক রহমান; মীর লিয়াকত মামুন পারভেজ; জামাল আহমেদ; নাদিফ ফারহান নাজ; আজিমুর রেজা চৌধুরী; গুলজার আহমেদ; বিমল দে ; দীপঙ্কর দাশগুপ্ত; নাজিকুল রানা; আরিফ জেবতিক; শাহ তোফায়েল; হাসান মোরশেদ; সেজুল হোসেন; রাহুলচন্দ্র দাশ; মোহাম্মদ তামিম;; উজ্জ্বলচন্দ্র দেব; মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী, মনোয়ারা বেগম, আজিমুল রাজা চৌধুরী ও অন্যান্য।
পরিশিষ্ট ৬ : রেফারেন্স
আবদুল হাফিজ, ১৯৯৩-৯৪, ফোকলোর আরকাইভস (১ম খণ্ড–৫ম খণ্ড), ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
আবুল ফতেহ ফাত্তাহ (২০০৮), সিলেট গীতিকা : সমাজ ও সংস্কৃতি, ঢাকা : উৎস প্রকাশন;
আশরাফ সিদ্দিকী, ২০০৮, লোকসাহিত্য, ঢাকা : গতিধারা;
আশুতোষ ভট্টাচার্য, ২০০৪, বাংলার লোকসাহিত্য, (প্রথম প্রকাশ : ১৯৬১-৬৫), কলকাতা : এ মুখার্জি এন্ড কোম্পানী;
ওয়াকিল আহমদ, ২০১১, বাংলা লোকসংগীতের ধারা, ঢাকা : গতিধারা;
কাশীনাথ দাশতালুকদার, ২০১৪), সূর্যব্রত সংগীত ও অন্যান্য, সম্পা. : সুমনকুমার দাশ, ঢাকা : উৎস প্রকাশন;
খালেদ চৌধুরী, ২০০৪, লোকসংগীতের প্রসঙ্গিকথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, কলকাতা : লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র
গিয়স উদ্দিন আহমদ, ১৯৯৬, গিয়াস গীতি সম্ভার, সিলেট : গিয়াস গীতি প্রকাশনা প্রকল্প;
গুরুসদয় দত্ত ও নির্মলেন্দু ভৌমিক, ১৯৬৬, শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত, কলকাতা : কলকাতা বিশ্বদ্যিালয়;
চৌধুরী গোলাম আকবর (১৩৯১), লোক সাহিত্যের কথা, সিলেট : জালালালাবাদ লোকসাহিত্য পরিষদ;
জফির সেতু (২০০৯), উপভাষায়ন ও সমাজভাষা : শ্রেণি, লিঙ্গ এবং ধর্ম, অপ্রকাশিত পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, ঢাকা : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়;
-(২০১৩), সিলেটি বিয়ের গীত, ঢাকা : শুদ্ধস্বর;
জাহান আরা খাতুন (২০১৭), সিলেটের বিয়ের গীত, সিলেট : চৈতন্য;
নন্দলাল শর্মা, ১৯৯৮, সিলেটের ফোকলোর রচনাপঞ্জি, সিলেট : জালালাবাদ লোকসাহিত্য পরিষদ;
প্রফুল্লচন্দ্র পাল, ১৯৯৪, প্রাচীন কবিওয়ালার গান, কলকাতা : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়;
ফোকলোর সংগ্রহমালা ৫৬ (২০১২)। লোকসংগীত। সম্পা. শাহিদা খাতুন। ঢাকা । বাংলা একাডেমি;
ফোকলোর সংগ্রহমালা ৬০, ২০১২, লোকসংগীত, সম্পা. শাহিদা খাতুন, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
ফোকলোর সংগ্রহমালা ৬২, ২০১২, লোকসংগীত। সম্পা. শাহিদা খাতুন। ঢাকা । বাংলা একাডেমি;
ফোকলোর সংগ্রহমালা ৭৪, ২০১৩, লোকসংগীত। সম্পা. শাহিদা খাতুন। ঢাকা। বাংলা একাডেমি;
ফোকলোর সংগ্রহমালা ১২৪, ২০১৬, লোকসংগীত। সম্পা. শাহিদা খাতুন। ঢাকা । বাংলা একাডেমি;
বাংলা একাডেমি, ২০১৪, বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি গ্রন্থমালা : সিলেট, সম্পা. : শামসুজ্জামান খান, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
বাংলা একাডেমি, ২০১৪, বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি গ্রন্থমালা : সুনামগঞ্জ, সম্পা. : শামসুজ্জামান খান, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
বাংলা একাডেমি, ২০১৪, বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি গ্রন্থমালা : হবিগঞ্জ, সম্পা. : শামসুজ্জামান খান, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
বাংলা একাডেমি, ২০১৪, বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি গ্রন্থমালা : মৌলভীবাজার, সম্পা. : শামসুজ্জামান খান, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
মনোয়ারা বেগম,(২০০৪) মুসলিম গানে বাঙ্গালি মুসলিম সমাজ, কলকাতা : হরফ
মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, ১৯৭৮, হারামণি ৭, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
–১৯৭৬, হারামণি ৮, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিস কাসেমপুরী, ১৯৭৩, বাংলাদেশের লোকসংগীত পরিচিতি, সম্পা. ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য ও বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী (সংগ্রহ ও সম্পাদনা), ১৯৮৮, বাউল কবি রাধারমণ গীতিসংগ্রহ, কলকাতা : স্বরসতী বুক ডিপো;
রামকানাই দাশ (২০১১), সঙ্গীত ও আমার জীবন, ঢাকা : নবযুগ প্রকাশনী;
শামসুজ্জামান খান, ১৯৮৫, বাংলার লোকসাহিত্য, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
–২০১৬, বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি গ্রন্থমালা : সিলেট, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
সামীয়ূল ইসলাম, ২০০৭, বাংলাদেশের লোকসংগীতের শ্রেণিবিন্যাস, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
সিরাজুদ্দীন কাশিমপুরী, ১৯৯৫, বাংলাদেশের লোকসংগীত পরিচিতি, ঢাকা : বাংলঅ একাডেমি;
সুজতকুমার বিশ্বাস, ২০০৪, ‘লোকসংগীত’ বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, সম্পা. : দুলাল চৌধুরী,
সুমনকুমার দাশ, ২০১০, বাংলদেশের ধামাইল গান, ঢাকা : বাংলা একাডেমি;
–২০১৪, রামকানাই দাশের নন্দনভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ। সিলেট। চৈতন্য;
সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী, ১৯৭৩, বাংলাদেশের লোকসংগীত পরিচিতি, ঢাকা : বাংলা একাডেমি।
হাছন রাজা, ২০০০, হাছন রাজা সমগ্র, সম্পা. : দে. মো. তাছাওয়ার রাজা, ঢাকা : পাঠক সমাবেশ;
হারুন আকবর, ২০০৯, সিলেটের লোকসংগীত ধামাইল, সিলেট : জালালাবাদ লোকসাহিত্য পরিষদ।
Grierson, George A. (1903-27), Linguistic Survey of India, Vol. v. part 1: ‘Indo-Aryan family—Eastern group.Specimens of the Bengali and Assames language’, Calcutta Rept. New Delhi.
সিলেট, মে ১৯, ২০২১
অভিনন্দন। মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। একটি মাত্র গান নিয়ে এত বিস্তারিত গবেষণা আমি আগে পড়িনি। কোনো প্রশ্ন স্পর্শ করা বাকি রাখেননি গবেষক। এই লেখা পরবর্তিকালের অনেক গবেষণার জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।
মাইগুডনেস! দীর্ঘ রচনা। যেন ইতিহাসের পাঠ নিলাম। একটি গানকে কেন্দ্র করে এত এত আলোচনা, সমালোচনা সত্যিই অসাধারণ। লেখক, কবি জফির সেতু অত্যন্ত নির্মোহভাবে সমস্ত বিতর্ককে আমলে নিয়ে যেভাবে রচনাটি উপস্থাপন করেছেন, তা, এককথায় অনবদ্য। আমি অভিভূত। বিশেষ করে, আলোচ্য গীতটির রূপতত্ত্ব,মূলতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং পারিপার্শ্বিকতা বা লোকগানের বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধানে, মৌলিক ব্যাখ্যার যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, তাও অত্যন্ত প্রশংসার। আশাকরি, বিদগ্ধজন, সংগীত পিপাসু জনগণ তথা আমাদের এই লোকসমাজ কিছুটা হলেও তার সারবত্তা অনুধাবনে সক্ষম হবেন। সুস্থ বিতর্ক সবসময়ই শান্তি প্রদায়ক বা জ্ঞান পরিবাহক। কিন্তু, অসুস্থ বিতর্ক অস্থিরতা প্রদায়ক। তাই, পরিশেষে বলব, কিছুকিছু হার জেতার চে’ও ভাল। ভাল লাগত, আমাদের এই আলোচিত গানটি যদি, লেখকের নাম ভূমিকায় উল্লেখিত ‘ক্যারিক ফেরগাসের’ সমাজ ব্যাবস্থার মত হত। লেখককে ধন্যবাদ জানাই তিনি আমার নামখানি তার লেখার একাংশে দয়াপরবশত উল্লেখ করেছেন। সবার মঙ্গল হোক। জয়তু, ‘আইলারে নয়া দামান…..’
নিখুঁত বিশ্লেষণ। নিরন্তর ভালোবাসা ও শুভকামনা জানবেন স্যার।
গবেষণাধর্মী এ বিশাল লেখাটা পড়তে কিছুটা সময় লাগলো। আসলে অনেক বিখ্যাত সৃষ্টিই মুগ্ধ করে বিশ্ববাসীকে। সময়ের বিবর্তনে নানা রূপে, নানা রঙে তা পরিবর্তিতও হয় নানা কারণে। তবে কখনো কখনো তার মূল শ্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া যায় না! তারপরও তা মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটে, স্মরণীয় হয়ে থাকে।
তথ্যসমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ এ লেখার জন্য তোমাকে মোবারকবাদ বন্ধু।
অসাধারণ লেখা
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো লেখা। সাধারণ পাঠকও খুব আগ্রহ নিয়ে পড়বে। অধ্যাপক মহোদয়কে অশেষ ধন্যবাদ নজর ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য। শহরের ব্যস্ততম মানুষের বিনোদনের খোরাকের উৎস যে বাঙালির নির্মল নীড়, তা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।