শিরোনামের ‘সেকুলার’ শব্দ দিয়ে এর কোনো জটিল, ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বা ডিসকার্সিভ অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে না। বলা হয়েছে কারণ একটাই: আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা একে ‘সেকুলার’ বলে থাকেন। এখানে সাদা দিলে কোনো কাদা নেই। প্রতিবছর কিছু কিছু বিশেষ সময়ে ‘আওয়ামীলীগ আমাদের কি কি উপকার করেছে’, ‘বিদ্যমান প্রধানমন্ত্রী না থাকলে কী হতো’, ইত্যাকার বহু আহাজারি-আফসোসমূলক লেখা আমাদের চোখে পড়ে। এইসকল লেখাতে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কঠোর হস্তে সন্ত্রাস দমনকারী’ একজন ‘মমতাময়ী’ হিসাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। অন্যদিকে এই রেজিমের কপালে ‘সেকুলার’ তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে কারণ রেজিমের মূলে রয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। কমবেশি সকল লেখাতে এমন দৃশ্যই বর্তমান।
উপরোক্ত বুদ্ধিজীবীদের কথাবার্তার বাইরেও আওয়ামী রেজিম আরো কিছু উপকার করেছে, যেগুলো আমাদের প্রজন্ম বর্তমানে খুব ভালো করে টের পাচ্ছে। শাহবাগ পূর্ববর্তী জমানায় আমাদের অনেকেই হয়তোবা এমন ‘উপকারে’র কথা কল্পনাও করতে পারেন নি। সংক্ষেপে এমন কিছু উপকারী পয়েন্ট তুলে ধরছি, যেগুলো আসলে আওয়ামী রেজিমই আমাদের কাছে উন্মোচন করেছে। সর্বোপরি এর মাধ্যমে একটা বিশেষ প্রবণতাও হাজির হয়েছে।
এক, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ নামক বর্গের স্বরূপ উদঘাটন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তি ক্ষমতায় নেই বলে বাংলাদেশের রথী-মহারথী বুদ্ধিজীবীরা এককালে পত্রিকার পাতায় পাতায় অশ্রু বিসর্জন করেছেন। তারা এমন এক দিনের স্বপ্ন দেখতেন যখন ক্ষমতায় থাকবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিরোধী দলেও থাকবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। তাদের লেখাপত্র পড়ে বেড়ে উঠা আমার মনে হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ‘ক্ষমতায়’ আসলে দেশে বুঝি বেহেশত নেমে আসবে। কিন্তু লঙ্কায় যেই যাবে সেই তো রাবন হবে। যে পক্ষের শক্তিই ‘ক্ষমতা’য় যাচ্ছেন না কেন, যে ‘ক্ষমতা’ বা ‘ক্ষমতাকাঠামো’র মাধ্যমে এই পক্ষ ‘শক্তি’ পরিচালনা করবেন সেটাকে নিয়ে তো প্রশ্ন তোলা হয় নি। বা তুলতে চাওয়া হয় নি। ফলে, এই কাঠামোর সাথে যখন ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ নামক ইডিওলজিক্যাল নির্মাণ যুক্ত হয়েছে, তখন সেটা যে কিরূপ ফ্যাসিবাদের জমিন তৈরি করেছে, ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামক গোষ্ঠীর মারপিটের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে! তখন তো খোদ আওয়ামীবুদ্ধিজীবীরা বলে উঠেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের নামে এসব বরদাশত করা হবে না। এসব বরদাশত না করতে চাইলেও তাদের দেখানো পথেই তাদের ‘পক্ষের শক্তি’ ক্ষমতায় গিয়ে যাবতীয় দুষ্কর্ম করে গিয়েছে এই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এর নাম নিয়েই। ফলে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’র ক্ষমতা আরোহণের মধ্যে আসলে একাত্তরে এই অঞ্চলের মানুষের যে গণজাগরণের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ তার কোনো সংযুক্তি নেই। যারা ‘ক্ষমতা’য় আসার জন্য সেই ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে ব্যবহার করেছিল, এবং আমি-আপনি এর বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনও যুগিয়েছি, তারা ক্ষমতার যখন একচেটিয়া দখল লাভ করল তখন তাদের কাছে এই ‘মুক্তিযুদ্ধে’র উপযোগিতা হচ্ছে কেবল রাষ্ট্রীয় (ও দলীয়) ভায়োলেন্সের বৈধতা হাসিল। ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোনো ‘ইজমে’র বেলাতেই এটা সত্য। ফলে, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’র সাথে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এর দূরত্বটাকে স্পষ্ট করার কৃতিত্ব আওয়ামীরেজিমকে দেয়াই যায়।
দুই, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনার ‘পবিত্রকরণ’ ফ্যাসিবাদী চিন্তার উত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামক একটা গোষ্ঠী যখন শিক্ষার্থীদের মারপিট করলো, তখন অনেক বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ করে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের মতন পবিত্র বিষয়ের নামকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। তারা প্রতিবাদের মাধ্যমে এটাও জানিয়ে দিলেন যে, মুক্তিযুদ্ধ একটি ‘পবিত্র’ বিষয়। কিন্তু পৃথিবীর যে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনারই রাজনৈতিক পটভূমি থাকে, রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকে। ঐতিহাসিক ঘটনার ইতিহাস, ইতিহাসের বয়ান, ইতিহাসের নির্মাণ সময়ের সাথে সাথে, রাজনীতির সাথে বদলাতে থাকে; বর্তমানে যাপিত রাজনৈতিক জীবন ও সমস্যার নিরিখে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে চোখ ফিরাতে হয়। ফলে প্রয়োজন পড়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের, উদ্ভব ঘটে নানান তত্ত্বের, নানান মতের, নানান পথের। কিন্তু ঘটনার ‘পবিত্রকরণ’ দিনশেষে খোদ ‘ঘটনা’কেই কাটছাঁট করে ফেলে, একধরণের নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে ‘ঘটনা’কে আটকে দেয়। অর্থাৎ, ‘ঘটনা’র কোন অংশ আপনি আলোচনা করতে পারবেন, আর কোন অংশ করতে পারবেন না, এমন একধরণের সরব বা নীরব নিষেধাজ্ঞা বা সেলফ-সেন্সরশিপ চালু হয়ে যায়।
এই ‘পবিত্রকরণ’ একটি ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমাদের সেকুলার জাতীয়তাবাদীরা, যারা কিনা মুক্তিযুদ্ধকে সেকুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেন, তারাই আবার মুক্তিযুদ্ধের আলোচনার মধ্যে এই ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য আরোপ করেন। এটা আসলে রাষ্ট্রের হাতে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার আইনকানুনের হাতিয়ার হয়েও উঠতে পারে। আবার, ‘ঘটনা’র পবিত্রকরণ ‘ঘটনা’র সাথে জড়িত গণমানুষের বিচিত্র অংশগ্রহণের বিচিত্রতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে একটা নির্দিষ্ট মন-মাফিক খোপে আটকাতে চায়; যার ফলে যেখানে জনগণই ইতিহাসের নির্মাতা, সেই জনগণ তখন স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়। এর একটা নমুনা হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে ‘বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন’ টাইপের বাক্য বা বয়ানের উদ্ভব ঘটেছে। এই বাক্যটা কেবল এই অঞ্চলের জনগণের জন্য অবমাননাকরই নয়, বরঞ্চ অনৈতিহাসিকও বটে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীও এই বয়ানকে খারিজ করে দেয়। [বিস্তারিত: সহুল আহমদ, ‘সময়ের প্রয়োজন: জহির রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ-দর্শন’, জহির রায়হান: মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক ভাবনা,গ্রন্থিক, ২০২০] জনগণকে হাওয়া করে দিয়ে, জনগণের অবদানকে ‘গৌণ’ অবস্থানে ঠেলে দিয়ে, জনগণকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে ‘ব্যক্তি’কে চালকে আসনে বসিয়ে দেয়াটা ফ্যাসিবাদী চিন্তা ও রাজনীতির পক্ষে সহায়ক। মুক্তিযুদ্ধের ‘পবিত্রকরণ’ তাই আওয়ামীরেজিমের ফ্যাসিবাদী কলকব্জার গুরুত্বপূর্ণ অংশ; এটা তো এতদিনে আওয়ামীরেজিমই তার কর্মকাণ্ড দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছে।
তিন, বুদ্ধিজীবীদের রঙ চেনা এবং মুখোশহীন অবস্থায় আবিষ্কার করা। বাংলাদেশের মূলধারার বুদ্ধিজীবীদের আসল চেহারা আওয়ামীরেজিমেই পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। কে কখন কোন আলাপ চাউর করেন, কে কার ইশারায় নাচেন এই রেজিমের আগে সেটা এতো স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে বলে মনে হয় না। ক্রসফায়ার ইস্যুতে আমাদের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানকে পরীক্ষা করলেই এটা বোঝা যায়। আমি ও সারোয়ার তুষার এক যৌথ লেখাতে ক্রসফায়ার ইস্যুতে বিএনপি আমলে এবং আওয়ামী আমলে দেশের একজন প্রযিতযশা বুদ্ধিজীবীর দুইটা লেখাকে তুলনা করে দেখিয়েছিলাম, কীভাবে রেজিম পরিবর্তনের সাথে সাথে একই ইস্যুতে বুদ্ধিজীবীদের মতামত পরিবর্তন হয়ে যায়। [বিস্তারিত: সহুল আহমদ ও সারোয়ার তুষার, ‘ক্রসফায়ারের আইনি ভিত্তি’, রাষ্ট্রচিন্তা, ৫ম সংখ্যা, ২০২০] বুদ্ধিজীবীদের এই বাস্তবতা প্রায় সকল ইস্যুতেই পাওয়া যায়। কিংবা, এবার যখন দিল্লীতে মোদিবাহিনী রক্তাক্ত অধ্যায়ের জন্ম দিল, তখন এর প্রতিবাদ ঢাকাসহ সারাদেশেই দেখা দেয়। মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে মোদিকে না আনার জন্য আন্দোলন করা হলে দেশের নামকামানো বুদ্ধিজীবীরা বললেন যে, যারা মোদিকে আনার বিরোধিতা করতেছে তারা আসলে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
এবার যখন চীন-ভারত দ্বন্দ্ব একটু তুঙ্গে উঠলো, তখন পত্রিকার পাতায় বুদ্ধিজীবীরা চীনের একাত্তর-পঁচাত্তরের ভূমিকা নিয়ে লেখা/বলা শুরু করলেন। চীনের সাথে ব্যবসায়ী চুক্তির খবরাখবর বাদ দিয়ে তারা আসলে একাত্তরে চীনের ভূমিকা নিয়ে লেখা শুরু করলেন। এই যে কখন কোন ইস্যুকে নিয়ে লেখা হচ্ছে, এবং সেটা কীভাবে উপর থেকে নির্ধারিত হচ্ছে, কার মন যুগিয়ে বুদ্ধিজীবীতা করা হচ্ছে, এটা এতো পরিষ্কারভাবে আওয়ামীরেজিমের পূর্বে ধরা পড়েছে বলে মনে হয়না। বছর তিনেক পূর্বে যখন জর্জ অরওয়েলের নোটস অন ন্যাশনালিজম প্রবন্ধ পড়ছিলাম, তখন তো রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলাম, আরে এতো দেখি আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কথা বলছেন: ‘কাজ ভালো হলো নাকি মন্দ হলো, সেটা কাজের উপর নির্ভর করে না, বরং সেটা নির্ভর করবে কে কার সাথে সেটা করছে। এবং, এমন কোন ধরণের নির্যাতন নাই যার নৈতিক রঙ বদলায় নি যখন সেটা ‘আমাদের’ দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছে।’ [জর্জ অরওয়েল, নোটস অন ন্যাশনালিজম, অনুবাদ: সহুল আহমদ]
চতুর্থত, ইসলামিকরণে ‘সেকুলার’ সরকারি দলের দায়। এই পয়েন্টকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা জাসমিন লর্চের একটা গবেষণার দ্বারস্থ হবো। সেকুলার দলগুলো কেনো ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে পড়ে তার একটা বাংলাদেশী নমুনা জাসমিন লর্চ ২০১৮ সালের গবেষণায় দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশের আপামর বুদ্ধিজীবী-জনসাধারণ আওয়ামীলীগকে যেভাবে ‘সেকুলার’ দলই মনে করেন, বা করতে চান, লর্চও একইভাবে আওয়ামীলীগকে সেকুলার দল বলে মেনে নিয়েই অগ্রসর হয়েছেন। তার মূল প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো একটা সেকুলার দল ইসলামিকরণে উদ্বুদ্ধ হয়। তিনি তিনটা উপাদানের মেলবন্ধনের কথা বলেছেন, মানে এই তিনটা উপাদানের মিশেল হলেই সেকুলার দল বা রাষ্ট্র ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে।
প্রথম উপাদান হচ্ছে, ইসলামি পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন বা ইসলামি সামাজিক আন্দোলন। সমাজে ধর্মীয় ও সেকুলার উপাদানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলেও রাষ্ট্র ইসলামিরকরণের দিকে ঝুঁকে। সেকুলার সরকার যখন বেসরকারি মসজিদ-মাদ্রাসার প্রভাবের মুখে পড়ে তখন রাষ্ট্রের ধর্মীয় অবকাঠামো ধীরে ধীরে শক্তিশালী করা হয়। এতটুকু বলে লর্চ সাবধানবাণী উচ্চারণ করে জানাচ্ছেন, এইটাই একমাত্র বা কেবল দায়ী নয়। বরঞ্চ, মূল প্রশ্ন হচ্ছে, কোন রাজনৈতিক পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে সেকুলার সরকার ইসলামি আন্দোলনের সাথে আপোষ করে, বা সাড়া দেয়!
এইখানে তাই এসে পড়ে দ্বিতীয় উপাদান: তীব্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইসলামি আন্দোলন কখনো তীব্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করতে পারে। বা কোনো শক্তিশালী ধর্মীয় বিরোধী দল থাকতে পারে। এই ক্ষেত্রে সরকারী সেকুলার দল ইসলামিকরণের মাধ্যমে নিজেদের ভোট বা জনপ্রিয়তা ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু, এই রাষ্ট্রীয় ইসলামিকরণের পৃষ্ঠপোষকতা ইসলামি দলগুলোকে আরো গোঁড়াকে আঁকড়ে ধরতে প্রলুব্ধ করে, কেননা এতে তারা সরকারি সেকুলারদের সাথে নিজেদের ‘ফারাক’টা যেন আরও বেশি করে চিহ্নিত করতে পারে। পাশাপাশি, এই ঘটনা দুই সেকুলার দলের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার বেলাতেও সত্য। দুই সেকুলার দলই একে অপরকে ঘায়েল করতে এবং নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে। এটা মূলত কোনো ধর্মীয় আন্দোলনের ফসল নয়, বরঞ্চ আসলে অনেকটা দলগুলোর নিজেদের রাজনৈতিক ‘বাচা মরার’ প্রশ্নের সাথে জড়িত!
এরপরেই আসে তৃতীয় উপাদান: (সেমি-) অথোরিটেরিয়ানিজম। আধা- স্বৈরতন্ত্র। যখন সেকুলার শাসকদের গণতান্ত্রিক বৈধতার অভাব পড়ে তখনই স্বৈরাচারীরা ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকে নিজেদের বৈধতা হাসিলের প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। এই পয়েন্টটা প্রায় যে কোনো স্বৈরাচারী শাসকদের সাথে মিলে যায়, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে বা অন্য কোনোখানে। কেননা, আমরা দেখেছি যে, এখানকার মিলিটারি স্বৈরাচারী শাসকরা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় বিধি-বিধান মানতে যতটা অনাগ্রহী ছিলেন, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মীয় তোড়জোড়ে ততই যেনো আগ্রহী ছিলেন। যেখানে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি রয়েছে বা স্বৈরতন্ত্র রয়েছে, (লর্চ বারেবারে মুসলমান-অধ্যুষিত দেশগুলোর কথা বলছেন) সেখানেই সেকুলার সরকার কর্তৃক ব্যাপক ইসলামিকরণ সাধিত হয়েছে। লর্চ এরশাদ ও জিয়ার আমল নিয়েও কথা বলতে গিয়ে মন্তব্য করছেন যে, কোনো শক্তিশালী ইসলামি আন্দোলন না থাকলেও সেই ‘অ-গণতান্ত্রিক সেকুলার’ শাসকরা ক্রমাগত রাষ্ট্রের ইসলামিকরণ করে গিয়েছেন। এই ঘটনাকে আসলে তিনি (আধা-)স্বৈরতন্ত্র যে সেকুলার সরকার কর্তৃক ইসলামিকরণের শক্তিশালী উপাদান তার একটা নমুনা হিসেবে হাজির করছেন।
লর্চ যা দেখানোর চেষ্টা করছেন বা যে দিকে ইঙ্গিত করছেন তা উপরোক্ত হালকা ইশারা থেকেই আমরা বুঝতে পারি। বাংলাদেশে সেকুলার সরকার কর্তৃক কেনো ইসলামিকরণ ঘটে থাকে তার মূল কারণ হিসেবে তিনি এই তিনটার মিশেলকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন যে, এখানে হেফাজতে ইসলামীর মতো দলগুলো ইসলামি আন্দোলন করেছে, কিন্তু কেবল এই আন্দোলনগুলো সেকুলার শাসককে ইসলামিকরণের দিকে প্ররোচিত করে নি। বরঞ্চ, এটি তখনই করেছে যখন রাজনৈতিক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং আধা-স্বৈরতান্ত্রিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এই আন্দোলনগুলো সেকুলার শাসকদের রাজনৈতিক ‘টিকে থাকা’কে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর একটা দুর্দান্ত উদাহরণ হিসেবে তিনি হাজির করছেন আওয়ামীলীগের সাথে হেফাজত ইসলামের সম্পর্কের বিবর্তনকে। হেফাজত যখন ‘সেকুলার পদক্ষেপ’সমূহের বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম শুরু করে তখন আওয়ামীলীগ প্রথমে কোনধরনের ছাড় দেয় নি। কিন্তু যখন ২০১৩ সালে রাস্তায় নেমে এলো এবং বিএনপি তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করলো বা এটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলো, তখনই ‘সেকুলার’ আওয়ামীলীগ সরকার হেফাজত ইসলামকে ছাড় দেয়া শুরু করলো। এবং, ২০১৪ সালের ‘নির্বাচনে’র পর যখন একেবারে (আধা-)স্বৈরতন্ত্র কায়েম হয়ে গেলো তখন হেফাজতের সাথে সম্পর্ক আরো ভালো হলো। ‘কওমি জননী’ উপাধির কথা আমরা সকলেই জানি। লর্চের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর। এর তিন মাস পর ভয়াবহ ‘৩১ ডিসেম্বরের নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হলো। পরের ইতিহাস সবার জানা।
‘মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলবে’, ‘হযরত ডাকার বাসনা’, ‘আওলাদে ওলী ঘোষণা দেয়া’, ‘আল্লার বানাইছেনই তাকে অমুক-তমুক কাজের জন্য’, ‘কোরআন-হাদিস মেনে সবার চলাফেরা করা উচিৎ’,- এমনতর বক্তৃতা-বিবৃতি যার/যেসবের আলামত হিসেবে আমাদের চতুর্দিকে আজকার চলাফেরা করে, তার কিছুটার হদিস লর্চের এই গবেষণায় পাওয়া যায়। এমনকি যারা আওয়ামীলীগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সেকুলার রাষ্ট্র বানানোর বাসনা মনে পুষে রাখেন (বাসনা থাকাটা খারাপ নয়, রাখতেই পারেন), এবং আওয়ামীলীগ না থাকলে রাষ্ট্র ‘ধর্মওয়ালাদের খপ্পরে’ পড়ে যাবে এমন আশঙ্কা যারা বারেবারে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে থাকেন তাদের জন্য লর্চের গবেষণা চিন্তার খোরাক দিতে পারে। কেনো বা কোন পরিস্থিতির কারণে এমন বহু-আকাঙ্ক্ষার ‘সেকুলার’ সরকার মনের এই বাসনা পূরণ করতে ব্যর্থ হলো বা হচ্ছে, সেটাও তলিয়ে দেখার দিশা পাইতে পারেন। গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকলে কোনো ‘বিশুদ্ধ’ দল দিয়েও খুব একটা কামনা-বাসনা পূরণ হবে না, হওয়ারও নয়।
উপরে যে কয়টা আলামতের কথা উল্লেখ করলাম, এগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন মনে হলেও পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আলামত মোটেও অভূতপূর্ব কিছু নয়। এই আলামতগুলোকে সাধারণত অতি ডানপন্থার আলামত হিসাবে দেখা হয়। অর্থাৎ, ইতিহাসকে দলীয়করণ করা, উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারণা, জাতীয়তাবাদী ইতিহাসকে রক্ষা করার জন্য আইন প্রণয়ন ইত্যাদি [পাঠককে এই স্থলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্মরণ করিয়ে দিতে চাই]। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন এই আওয়ামী রেজিমের পরতে পরতে অতি-ডানপন্থার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ভিন্নমতকে আইনি ও বে-আইনি উপায়ে দলন ও দমন করা হচ্ছ, ভয়াবহ সার্বভৌম সহিংসতার সামনে নাগরিকদের জীবনকে উন্মোচিত করা হচ্ছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নাম দিয়ে আইনি পাহারায় একটি একক বয়ান তৈরি করে সমস্ত বৈচিত্র্যকে গিলে ফেলা হচ্ছে। সেকুলার-বাঙালি-জাতীয়তাবাদী বয়ানের মাধ্যমে যে শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ ও নৈতিক খবরদারি শুরু করেছিল সেটা আজকে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক মুসলমান পরিচয়বাদী রাজনীতিরও পৃষ্ঠপোষক। সেটা কীভাবে তার কিছু আলামত/নজির উপরে দাখিল করা হয়েছে। [বিস্তারিত: সারোয়ার তুষার, ‘ডানপন্থার বৈশ্বিক উত্থান: অর্জুন আপ্পুদারাই এর তত্ত্বতালাশ ও পর্যালোচনা’]
যদিও বাংলাদেশের অতি ডানপন্থাকে সাধারণত কেবল ধর্মীয় ডানপন্থা হিসাবেই দেখার রেওয়াজ আছে। কিন্তু আওয়ামী রেজিমে আমরা দুটোই দেখছি। অতি-জাতীয়তাবাদী ডানপন্থা আবার গোড়া ধর্মভিত্তিক ডানপন্থার উত্থানেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন আইনি খড়গ নেমে আসার উদাহরণও দেখা যাচ্ছে। মিডিয়াতে ‘আদর্শ’ নারীর চেহারা নির্মাণের প্রয়াস লক্ষণীয়। এইসবই অতি-ডানপন্থার ‘রক্ষণশীল’ মনোভাবের আলামত। সম্প্রতি সাইমুম পারভেজ যথার্থ বলেছেন, ‘বাংলাদেশে অতি ডানপন্থী এই দুই শিবিরের উত্থান সমাজে অস্থিরতা, মেরুকরণ এবং রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়াচ্ছে। তীব্র জাতীয়তাবাদ ও গোঁড়া ধর্মভিত্তিক মতবাদের মধ্যে আসলে তেমন পার্থক্য নেই। তারা একে অপরের শত্রুতাকে নিজেদের শক্তিশালী করার পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে।’ সহজেই অনুমেয়, বাংলাদেশে এই অতি-ডানপন্থার উত্থানের সাথে গণতন্ত্রহীনতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।