খসড়া ইশতেহার
১
শব্দ মাত্রই জড়। বাক্য তাকে প্রাণ দেয়। আর কবিতা শব্দের জীবনকে ধ্বনিময় করে তোলে। ধ্বনি মানে সুর। শব্দের অনুপ্রাস কিংবা তার সীমানা অতিক্রম করে ধ্বনি। কবিতার শব্দ মানে বাক্যের দ্যোতনা। বাক্যে বাক্যে তার অর্থের রূপ বদলায়। রূপক বদলায়। গঠন বদলায়।গঠন বদলায়। প্রচলিত অর্থে যেমন শব্দ ধরা দেয়, ঠিক তেমনি প্রচলিত অর্থকে আত্মসাৎ করে। কবিতা মৃত কিংবা জীবিত শব্দের উপর অর্থের অপার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কবিতার স্বর তাল লয়, যা কিনা জীবিত অর্থ বোধক কিংবা মৃত অনর্থ বোধক চিহ্নকে নতুন ভাষায় রূপান্তরের এক প্রক্রিয়া। পরাধীন শব্দকে কবিতাই মুক্ত দেয়।
২
প্রথাগত কবিতার ভাষা মৃত। অনেকটাই অভিধানের পাতায় সংকুচিত অর্থ নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। চির নিদ্রার কখনো পুনরুজ্জীবন হয় না। যা একবার লেখা হয়, তা শুধুই লৌকিক। মানে তার কার্যকারণ খোঁজা ছাড়া নতুন দিশা নাই। প্রথাগত একই ঐতিহ্যের ডালপালা হয়ে হারিয়ে যায় তা। তাহলে? নতুন কবিতা তো বস্তু কিংবা ভাবের অদেখাকে দেখানোর প্রস্তাব মাত্র। কারণ যে কোনো কল্পনা বস্তুর স্বাভাবিক রূপককে দূরবর্তী কিংবা নিকটবর্তী অর্থ দেয়। আর সৌন্দর্যের প্রথাগত বিবরণকে নস্যাৎ করে। তাই নতুন কবিতা সকল চলতি ব্যাকরণকে নাকচ করে।মৃতের সৎকার করা কবিতার কাজ নয়, বরং ভাষার সার্বভৌম প্রকাশই কবিতা।
৩
অংক কিংবা দর্শনের যেখানে শেষ, সেখান থেকে কবিতার শুরু। যুক্তি কিংবা ভাবগত বিশ্লেষণ কবিতার কাজ নয়। কবিতা প্রমাণিত যুক্তির কাঠামোকেই গড়ে আর ভাঙে। ফলে যেখানে অংক কিংবা দর্শন তীর্থের কাকের মতো যেখানে স্থির, সেখানেই কবিতা সচল হয়। মনে রাখা দরকার, যে কোনো চিন্তার উৎস মূল প্রকৃতি। উদ্দেশ্যগত দিক দিয়ে তা কখনো স্বভাবগত, আবার তা কখনো অভাবগত। স্বভাবগত রূপজাগতিক বস্তুর নবরূপায়ন। ফলে অর্থান্তর ঘটে যায় রহস্য আরোপণে। এমন রূপায়ণ হতে পারে ঋণাত্মক কিংবা ধনাত্মক। আর অভাবগতদিক রহস্যন্মোচন কিংবা রহস্যের পর্দা ভেদ করা। নতুন কবিতা সৃষ্টির সত্য সেখানেই অসীম।
৪
বস্তু কিংবা ভাবের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি সব সময়ই রহস্যময়। রোমান্টিক যুগ থেকে আধুনিক কবিতা চেয়েছে সর্বদা এই রহস্য ভেদ করতে। দুনিয়ার প্রস্তাবিত প্রায় সব কবিতা বিষয়ক তত্ত্বই নির্দিষ্ট সময়ান্তরে অচল কিংবা প্রথা হয়ে যায়। ফলে কবিতার যে প্রাথমিক শর্তই কথা বলার সৌন্দর্য আর সুরারোপের ধারণা এখন ক্লিশে। এমন প্রাথমিক তত্ত্বও এখন অচল। বস্তুত কাঠামোগত বিভাজন কবিতাকে মুক্তি দিতে পারেনাই। কবিতা দাঁড়িয়ে আছে পরমানু থেকে কৃষ্ণ গহ্বরের বাইরে অন্য কোথাও। অদেখায় যার রূপ তা নিকট রূপের সহায়। মানে কবিতা সর্বদাবস্তুর রহস্য ভেদ করে অচেনা রূপে প্রকাশিত হয়। কল্পনা আর রূপক ফেলে দিলে যা থাকে বস্তুরই বর্ণনা। মানুষের দৃশ্যমান জগত সীমিত, আর কল্পনার জগত অসীম। ফলে কবিতা ধারণাগত জগতকেই অতিক্রম করে।
৫
প্লেটো বলেছেন, ইতিহাস নির্মিত সত্যের চেয়ে কবিতা সবচেয়ে সত্যের কাছের জিনিস। প্লেটো আকারগত সত্যের কথা বলেছেন। তাহলে সত্যকি নিরাকার? আকারে যা ভাব, নিরাকারে তাই সত্য- এটা প্রচলিত ভাব। ফলে বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসে কবিতা ধারণাগতভাবে ভাবের জগতে চিন্তার একক। চিন্তা মানে ভাব। কিসের ভাব? ভাষা, রূপ, রস, ছন্দ, প্রকরণ, আঙ্গিক আর নন্দনের মিলনে কবিতার গঠন। এটা প্রাথমিক কাঠামোগত শর্ত। কিন্ত কবিতার কাজ প্রকৃতি আর সমাজের সাথে সংস্কৃতির সম্বন্ধ স্থাপন। সম্বন্ধের ভেতরে অধরা জগতকে ধরবার কৌশলই কবিতা। যা ধরা দেয়। হয়ে ওঠে। জগত কবিতাময়- এটা মিথ্যা। বস্তুত মানবের প্রাণ সঞ্চার হলে কবিতা জাগে। ধরা দেয় ইহজগতে সেটা, আনন্দ কিংবা বেদনায়। মানসলোকের সংবেদনশীলতার সৌন্দর্য সেখানেই নিহিত।
৬
সময়ের নিয়ম ধরলে বস্তুজগতে বর্তমান বলে কিছু নেই। যা বর্তমান তাই অতীত। ফলে যা বলা হয়, তা ভবিষ্যত নয়। ভবিষ্যত কবিতার মতোই অধরা। এবং চলমান…
যাও তুমি গর্ভে গর্ভে
ওই ডালে পাতা নাই, শুধু আছে ফুল
ভালোবাসবে বলেই জাগিতেছে কুল।
আমরা কাঙাল নই গেরিলা আগুনে
সব মুখ লাল হচ্ছে কেমন ফাগুনে?
আমাদের তাড়া নাই, ভারানত মন
দেহ যায় শাখা মূলে পরতে পরতে
যদি তুমি রাষ্ট্র হও, হইও না ভাতার
ফলে ফলে টলে প্রেম এমনি বাহার!
বাতাসে উত্থিত গান ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়
আহা রে ফতুর দেহ দশাঙুল ছোঁবে
তুমি কি বাঙালি সাঁওতাল মুরং চাকমা
ভালোবাসতে বাসতে করে দাও ক্ষমা!
দিন খাবে অন্ধকার কোকিলাকে কও
মোমের প্রতিজ্ঞা যেন তাহারে শোনাও
আগুনে চড়াবে আজ শুক্তির পাহাড়
কোথায় বসবে শুনি মায়াবী বাহার?
মাস নাই বাস নাই ভাসমান শিখা
পাতাকে গাছের করে বাকলের লিখা
মন জ্বলে প্রাণ টলে ভালোবাসা হলে
যাও তুমি গর্ভে গর্ভে সকালে-বিকালে!
যন্ত্রণার যাদু
তোমার বাড়িতে সারি সারি পিঁপড়ার বহর
ভালো না বাসলেও নড়েচড়ে লালমুখোঘর
গোপন জীবন ফেলে আসা অস্থির জীবন
দুহাতে ঠুমরি বাজে রোজ নৃত্য করে মন
হায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় উদ্বেল বাতাসে
তবুও কে যেন টানছে হৃদয় মাটির কাছে
এমনি চিবুক যদি দাও মরবার আগে
গোরেও গোলাপ ফোটে রতির সম্ভোগে
আমার বাড়িতে তুমি লাল পিঁপড়াই পোষো
পরতে গোপন প্রেম তাই ছেড়ে দিয়ে আসো
যদি টের পাও বিষ, বলো যন্ত্রণার যাদু
গোপন চুমুকে সখি একা টেনে নাও মধু
ভাষার অধিক ভালোবাসা
ভালোবাসা নাম যে তোমার, কার কাননের মধুবালা
হাত টলে না আঙুল গাঁথা, দুলছে ওরাও হরমালা।
কথার ফাকেই ফাঁকি রাখা, অব্যক্ত কি বুঝে নেবে
বুকের ভেতর অগ্নিডোরা, যত্ন করে কে নেভাবে!
মন খুলে যে রেখে ছিলাম, কপাল ছাওয়া পা নাগাদ
রাতের দিকেই তাকিয়ে লো, ছুঁড়ে দিলাম একটা চাঁদ।
দুধেল আকাশ নাচছে কোথাও, সমুদ্র কি টের পাবে
কাল গ্রহণে জলের বানে মরা কাটাল টল্কাবে।
বাক্য একা রাঙাবালি, চমকাবে কোন সত্তা ভাব
টেউ গুনছে অন্তমিলের, দেহের উপর আবির্ভাব।
একটা আকার ত্রিভূজ সমান, অন্য আকার চেতনা
বৃত্ত ভেদে অশরীরি, আলোক রেখার বিস্মরণা।
খুলে যাচ্ছে এমনি এমনি, গোপন বাহুর নিত্য হুক
ভালোবাসা ভাষার অধিক, বিন্দু ভরা নিখাদ অসুখ।
বিচ্ছেদ
তুমি কি আড়াল হচ্ছো
পরার্থপরতার খোপে?
যদি বৃষ্টি নামে, সহসা বাগড়া দেয় পথে
তবে হুড তুলে বাতাস থামাবে তাতে।
চাকা ঘোরাবার মত নড়বে পাদানি
জানি টিকবে না ধোপে!
মুখ মুছতে মুছতে শিউরে উঠবে দেহ
এবার একটু করে রহস্য আলগা হবে।
বলবে, হাতটা সরাও এবার সোনা!
আগুন বাইরে রেখে ঠাণ্ডা হও প্রিয়তমা!
দেহ গেছে অকাল সন্ন্যাসে, ওমা!
আজকাল স্তন ছুঁলে মনে হয়, বোমা!
মথুরা গায়েন
ছবির আড়ালে তুমি অনেক চঞ্চল
যদি ছবি হও তবে স্থির কেন বল
ছুঁয়ে দেখি সোনা কাঁচের উপরে কাঠ
মায়া সভ্যতার আগে যেন ত্রোস্তপাঠ
আঙুলে যে লেগে আছে সমস্ত ইন্দ্রিয়
নিতে পারো হাত মুখ যতি বায়বীয়
যে জীবন আমার না সেইকি তোমার
দেহ ছেড়ে বের হয় অতীন্দ্রিয় ভার
দুপুর গড়ায় রোজ মহাকাশ ডোরে
ইশারা স্মৃতির তারা রাতমাখা ভোরে
ফলিত মাঠের পর গোপন শরীর
জানু পাতা বোবাতুর মাদুলি বধির
আমি তব বিন্দু সম তুমি যত দূর
বাগে কি ইন্দ্রিয় সহে না করে কসুর
এখন কি গান গাইবে মথুরা গায়েন
স্তনের আড়ালে মুখ ঠোঁটে রাখা ধ্যান
Shakhawat Tipu (Bengali), born in 1971, lives in Dhaka where he is a distinguished bilingual poet, editor, translator, and critical thinker from Bangladesh. He is also a journalist. He is a prominent figure of the new Bengali poetic language movement. He published seven poetry books, and his poems are translated into Spanish, Italian, Serbian and English. As an editor, he edited Jatiya Shahittya (2008), a magazine of linguistics and philosophy, and Charalnama (2011), a collection of street people’s interviews with a subaltern dictionary.
More Posts From this Author:
- None Found