অনুবাদকের ভূমিকা: আফগানিস্তানে তালিবান বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্রগুলো তাদের রাজনৈতিক চরিত্র অনুযায়ী এই পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করছে। মূলধারার ইসলামপন্থী সংবাদ মাধ্যমগুলো তালিবানের এই ক্ষমতা দখলকে আফগান ‘জনগণের বিজয়’ হিসাবে দেখছে। অন্যদিকে সেকুলার রাজনৈতিক সংবাদমাধ্যম গুলো তালিবান শাসনের অতীত ইতিহাসকে আবারও সামনে এনে আফগান জনগণের জন্যে আসন্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হাজির করার চেষ্টা করছে। মূলধারার এই দুইগোত্রের সংবাদপত্রের বাইরে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অন্তরজালভিত্তিক পত্রিকা ও ব্যক্তিগত ব্লগ সমূহ যেখানে বিকল্প চিন্তার মানুষেরা তাদের মতামত দিচ্ছেন। মত প্রকাশের এই বিকল্প পাটাতনে তালিবানের এই ক্ষমতা দখলের স্বপক্ষে খুব সরব অন্তত দুইটি বর্গের বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষেরা। এক – বাংলাদেশের ইসলাম পন্থী বিশ্লেষকেরা এবং দ্বিতীয়ত প্রথাগত অর্থে ইসলামপন্থী নন কিন্তু পশ্চিমের কঠোর সমালোচক এবং পশ্চিমের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিরুদ্ধে একটি অধিকতর কাম্য পন্থা হিসাবে ইসলামকে হাজির করা আত্মদাবীকৃত ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী’ ও ‘মুক্তিমূখীন’ বুদ্ধিজীবীগণ। ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবীগণ মূলত মাদ্রাসা পড়ুয়া এবং পেশাদার ইসলামী আলেম অথবা ইসলামী রাজনীতিবিদ। এঁদের অনেকেই মনে করছেন আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা দখল আসলে বিশ্বব্যাপী ইসলামের জয়ের ধারারই সূচনা মাত্র। আফগানিস্তানের হাত ধরেই সারা দুনিয়াতে আবারও ইসলাম ক্ষমতা ‘দখল’ করবে। তালিবানের বিজয়ের ধারায় সারা দুনিয়া আবারও ইসলামী শাসনের করায়ত্ব হবে। বলাই বাহুল্য ইসলামপন্থীদের একটা বড়সড় অংশের ব্যাখ্যায় বিশ্ব রাজনীতির ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির নানান হিশাব নিকাশকে আমলে নেয়ার বদলে ইসলাম বিষয়ক আবেগতাড়িত ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। কিন্তু প্রথাগত অর্থে ইসলামী আলেম নন এমন বুদ্ধিজীবীদের মাঝে যারা প্রবল ভাবে পশ্চিমের আধিপত্যবাদের বিরোধী তাদেরও কেউ কেউ প্রকাশ্য ভাবে তালিবান বাহিনীকে মহিমান্বিত করছেন এই ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করে। প্রবল পশ্চিম-ঘৃণা’র আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই সম্ভবত এঁরা তালিবান বাহিনীকে ‘আফগান জনগণ’ এর সমার্থক হিসাবে হাজির করছেন। তালিবান বাহিনীকে ‘আফগান জনগণ’ এর ত্রাতা হিসাবে হাজির করছেন। আফগানিস্তানের ভূমির বাস্তবতা যদিও তা বলেনা। এই বর্গের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই মনে করছেন এটা ‘আফগান জনগণের বিজয়’, যদিও বিষয়টি কেবল ক্ষমতার পালাবদল এবং তালিবান বাহিনী গত প্রায় দেড় বছর ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সাথে খুব ঘনিস্ট যোগাযোগ ও আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়েই অতিবাহিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সৈন্য প্রত্যাহার এর পেছনে প্রায় কয়েকবছরের আলাপ আলোচনার ফল হিসাবে একটি চুক্তিতে শামিল হয়েছে তালিবান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঐতিহাসিক ভাবে তালিবানের জন্ম মার্কিন ও পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে হলেও বাংলাদেশের এই বুদ্ধিবৃত্তিক বর্গটি তালিবান বাহিনীকে ‘মার্কিন বিরোধী’ হিসাবে হাজির করে তাদেরকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছেন। একথা সত্য যে সাম্প্রতিক সময়ে তালিবান বাহিনী আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে এক ধরেনর যুদ্ধ জারি রেখেছিলো আবার এটা সত্যি যে ঐতিহাসিক ভাবে শীতল যুদ্ধের সময়ে আফগানিস্তানে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার জন্যেই যে গোত্রগত ইসলামী সংগঠনগুলোকে আমেরিকা ও পাকিস্তান যৌথ ভাবে গড়ে তুলেছিল তালিবান তাদের মাঝে সবচাইতে সুবিধাপ্রাপ্ত একটি বাহিনী। এই সুবিধার মধ্যে ছিলো অস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ, নগদ টাকা ও গোয়েন্দা তথ্য। এমন কি তালিবানের বর্তমান সময়ের শীর্ষ মুখপাত্রদের কেউ কেউ প্রকাশ্য গণমাধ্যমেই উল্লেখ করেছেন যে ঐতিহাসিক ভাবে আমেরিকার সাথে তালিবানের স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব ছিলোনা, এখনও নেই, তারা আমেরিকার সাথে ‘সুসম্পর্ক’ই চান। তালিবানের সাথে আমেরিকার ঝামেলাটি শুরু হয় মূলত আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন কে হস্তান্তর প্রসঙ্গ নিয়ে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার যে ছদ্ম সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের অংশ হিসাবে আমেরিকা আফগানিস্তানকেই বেছে নেয় এই উপমহাদেশে তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করার জন্যে। ওসামা বিন লাদেন ছিলো একটি অজুহাত মাত্র। ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়ার অনুরোধ কিংবা আদেশকে অগ্রাহ্য করেছিলেন সেই সময়ের তালিবান প্রধান মোল্লা ওমর। এই প্রত্যাখ্যানের উপরে ভর করেই আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর যুদ্ধে শামিল হয়, যার খেসারত তালিবান বাহিনী যতটা দিয়েছে তার চাইতে বহুগুণ বেশী দিতে হয়েছে সাধারণ আফগান জনগণকে। ঐতিহাসিক ভাবে আরও অজস্র দেশে আমেরিকার যে অন্যায্য সামরিক ও সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা, আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে উপলক্ষ করে হামলা সেরকমেরই আরেকটি অন্যায্য হামলা। এই বিশ বছর ধরে চলা যুদ্ধাবস্থা যেকোনো যুক্তিতেই অন্যায্য, নোম চমস্কি একে বলেছেন ‘অপরাধ মূলক’। আমেরিকা সারা দুনিয়াব্যাপী বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে নিজের সামরিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থে যে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে, আফগানিস্তান তার একটি উদাহরণ মাত্র। চমস্কির মতে আফগানিস্তানের যুদ্ধ অন্তত দুইটি কারণে অপরাধমূলক। প্রথমত – একটা ভয়ংকর শক্তি ব্যবহার করে আফগানিস্তানের স্থানীয় অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া এবং দ্বিতীয়ত – আফাগানিস্তানের সামাজিক কাঠামো ও বন্ধন বিধ্বস্ত করে দেয়ার জন্যে। আমেরিকার বিদায় তাই আফগানিস্তানের জনগণের কাছে দারুণ কাম্য একটি বিষয়। কিন্তু আমেরিকার বিদায়ে যে শক্তিটি আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করলো অর্থাৎ তালিবান বাহিনী কি আফগান জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে? তারা কি আফগান অধিকাংশ জনগণের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রত্যাশিত ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আফগান বিপ্লবী নারীদের সংগঠন ‘রেভিউলুশনারী আফগান উওমেনস অ্যাসোসিয়েশন’ (রাওয়া)র বিবৃতিতে। আফগান নারীদের সংগঠন রাওয়া’র বিবৃতিটির অনুবাদ এখানে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্যে উপস্থাপন করা হলো।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থি, সেকুলার বা আত্মদাবীকৃত মুক্তিমূখীন বুদ্ধিজীবীগণ আফগানিস্তানের এই ক্ষমতার পালা বদলে কেবল একটি পক্ষের হয়ে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে তাদের বিশ্লেষণ হাজির করছেন। অর্থাৎ হয় তালিবানকে মহিমান্বিত করে আমেরিকার বিরুদ্ধে অথবা তালিবানের বিরোধিতা করে আমেরিকার পক্ষে বা পশ্চিমের পক্ষে তাদের বিশ্লেষণ হাজির করছেন। কিন্তু যেকোনো শুভ বুদ্ধির মানুষ আসলে এই উভয় শক্তির বাস্তব চরিত্রটি বরং তুলে ধরবেন এবং বোঝার চেষ্টা করবেন আফগান জনগণের মুক্তির প্রশ্নে সত্যিকার অর্থেই এই দুটি শক্তির ভূমিকা কি। আফগানিস্তানের বেশীরভাগ মানুষের মুক্তি ও আত্মনির্ভরতার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যেমন প্রতিপক্ষ তেমনি আফগান জনগণের জন্যে একটি সমতাভিত্তিক, প্রতিনিধিত্বমূলক ন্যায্য সমাজ গড়ে তোলার প্রশ্নে তালিবানও এক ভয়ংকর বিরুদ্ধ প্রতিপক্ষ। দুই ভয়ংকর বিরুদ্ধ প্রতিপক্ষকে একই সাথে উল্লেখ করার জন্যে যে বুদ্ধিবৃত্তিক সততা ও চিন্তার স্বচ্ছতা থাকা দরকার দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তা আমাদের এই বিশ্লেষকদের লেখালেখিতে বিরল। ইতিহাস থেকে মিশরের নারীবাদীদের রাজনৈতিক অবস্থান স্মরণ করা যেতে পারে। মালাকা হিফনি নাসিফ কিংবা হুদা আল শারাওই’র মতন নারীবাদীর নেতৃত্বে মিশরীয় নারীগণ লড়াই করেছিলেন দখলদার উপনিবেশবাদী শক্তি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ, মিছিল, মিটিং গ্রেফতার সকল ধরনের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে মিশরীয় নারীবাদীরা লড়াই করেছিলেন ব্রিটিশ তাড়ানোর সংগ্রামে কিন্তু বিস্ময়কর বাস্তবতা ছিলো উপনিবেশবাদী শক্তি চলে যাবার পরে মিশরের রাজনৈতিক ক্ষমতা গঠনের প্রশ্নে নারী সংগ্রামীদের বাদ দিয়েই রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগাভাগি করেছিলেন মিশরের ‘পুরুষ’ রাজনীতিবিদেরা। মিশরের জনগণের আত্মমুক্তির আলাপে নারীর প্রশ্নটি রয়ে গিয়েছিলো ‘সেকেন্ডারি’ বা পরের বিষয় হিসাবে। উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামের এই অভিজ্ঞতা থেকে হিফনি নাসিফ কিংবা হুদা শারাওই’র মতো নারীবাদীরা লিখেছিলেন, ব্যাখ্যা করেছিলেন কেনো উপনিবেশবাদীদের প্রস্থানই জনগণের মুক্তির নিশ্চয়তা দেয়না। কেননা ঔপনিবেশিক শক্তির প্রস্থানে ক্ষমতার যে পালাবদল ঘটে তা নিশ্চিত ভাবেই জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক শক্তির হাতে ক্ষমতা অর্পণ নাও করতে পারে। মালাকা হিফনি নাসিফ বা হুদা শারাওই’র মতো নারীমুক্তি সংগ্রামীরা বুঝেছিলেন ভিনদেশী ঔপনিবেশিক শক্তি আর স্বদেশী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামীদের মাঝে একটি বিষয় সাধারণ ভাবেই উপস্থিত থাকতে পারে তা হচ্ছে প্রবল পরাক্রমশালী পিতৃতন্ত্র। ভিনদেশী পিতৃতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করাটা সহজ কেননা তার কোনো স্থানীয় শেকড় থাকেনা, কিন্তু স্বদেশী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা হাজার গুন কঠিন কেননা তার শেকড় থাকে স্থানীয় মৃত্তিকার গভীরে। তাই পৃথিবীর সকল সমাজেই উপনিবেশিত নারীর সংগ্রাম সবসময়ই দ্বিবিধ, একদিকে তাঁকে যেমন ভিনদেশী উপনিবেশবাদীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নিতে হয় তেমনি একইসাথে জারি রাখতে হয় দেশীয় পিতৃতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম যা নারীর জীবনকে উপনিবেশিত করে রাখে স্থানীয় গোত্রতান্ত্রিকতা, সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার, পরিবার, যৌনতার নৈতিকতা ইত্যাদি নানান পিতৃতান্ত্রিক আদর্শবাদ দিয়ে। আফগান নারীর সংগ্রামও দ্বিবিধ, একদিকে তার সংগ্রাম যেমন ভিনদেশী উপনিবেশবাদী পশ্চিমা শক্তি আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে তেমনি তার সমান্তরাল যুদ্ধ স্বদেশী পিতৃতন্ত্র যা হাজার বছর ধরে উপনিবেশিত করে রাখে নারীর জীবন কে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী, সেকুলার ও আত্মদাবীকৃত মুক্তিমূখীন বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সকল বিশ্লেষণে এই দ্বিবিধ সংগ্রামের সমান্তরাল উল্লেখ অনুপস্থিত।
তাই বাংলাদেশী মুক্তিমূখীন বুদ্ধিজীবীদের কাছে তালিবান বাহিনী মহিমান্বিত ‘বীর’ হলেও আফগান নারীর কাছে তালিবান কেবলই এক স্বদেশী ঔপনিবেশিক শক্তি, যার বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম ও যুদ্ধটি ভিনদেশী ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চাইতেও হাজার গুন কঠিন।
আফগানিস্তানের এই ক্ষমতার পালাবদল প্রসঙ্গে আফগান বিপ্লবী নারীদের সংগঠন ‘রাওয়া’র এই সাক্ষাতকার ভিত্তিক বিবৃতিটি তালিবান দখলদার আমেরিকান বাহিনী ও স্বদেশী পিতৃতন্ত্রের পুরোহিত তালিবান বাহিনীর প্রসঙ্গে আফগান নারীদের অবস্থান কে বুঝতে খানিকটা সাহায্য করবে। ‘afgan womens mission’ নামের একটি নারীমুক্তি সংগ্রামীদের সংগঠনের প্রতিনিধি সোনালী কোলহাতকার এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে ‘রাওয়া’র এই অবস্থান তুলে ধরা হয়। মূল সাক্ষাতকারটি ছাপা হয়েছিল RAWAর ওয়েবসাইটে।
অনুবাদক: মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার
রাওয়া প্রসঙ্গে
‘Revolutionary Women’s Association of Afghanistan’ (RAWA) হচ্ছে আফগানিস্তানের নারীদের মুক্তিসংগ্রামের অগ্রণী সংগঠন। সোভিয়েত দখলদারিত্বের সময় মেধাবী আফগান নারীবাদী বিপ্লবী মীনা কিশোয়ার কামাল এর নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। যদিও সেই সময় আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতায় ছিলো একটি সেকুলার ও সমাজতন্ত্রী সরকার, তবু মার্কসবাদী নারীবাদী মীনা কিশোয়ার কামাল প্রবল ভাবেই সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগান নারীদের সংগঠিত করেছিলেন কেননা আজকের মতো সেই সময়েও এই সংগঠনটির রাজনৈতিক অবস্থান ছিলো সকল ধরনের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে। সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরোধিতার কারণে সত্তুরের দশকে মীনা কিশোয়ার কামাল ও তার সংগঠনকে এক রকমের বাধ্য করা হয় আফগানিস্তানের মূল ভূমি থেকে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় সরে যেতে কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি, ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের কোয়েটাতে মীনা কিশোয়ার কামালকে হত্যা করা হয়।পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ও কেজিবি’র যৌথ পরিকল্পনাতেই এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় বলে রাওয়া ও আফগান রাজনৈতিক মহল মনে করে। গত প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে আফগান নারীর মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে এই সংগঠনটি। ‘রাওয়া’ একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী সংগঠন পৃথিবীর সকল দেশের মুক্তিকামী মানুষের সাথে সংগঠনটি সংযুক্ত হতে চায়, সেকারণেই যেকেউ সংগঠনটির সাথে সংহতি প্রকাশ করে এর সাথে যুক্ত হতে পারেন, সংগঠনটিকে অনুদান দিতে পারেন। ‘রাওয়া’ সম্পর্কে আরও জানা যেতে পারে এখানে – www.rawa.org/index.php
মূল সাক্ষাতকারভিত্তিক বিবৃতি
সোনালী কোলহাতকারঃ রাওয়া বহু বছর ধরে আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে আর এখন এটা প্রায় শেষ, তালিবান আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন কি মার্কিন বাহিনীকে আরেকটু ভিন্ন ভাবে প্রত্যাহার করে নিতে পারতেন যেনো আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আরেকটু নিরাপদ হতে পারতো? তিনি কি এমন কিছু করতে পারতেন যাতে অন্তত তালিবান এতো দ্রুত ক্ষমতা দখল করতে পারতোনা?
রাওয়াঃ গত ২০ বছরে আমাদের অন্যতম দাবী ছিল মার্কিন/ন্যাটো দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো এবং আরও ভাল যদি তারা তাদের ইসলামী মৌলবাদী এবং টেকনোক্র্যাটদের সাথে নিয়ে যায় এবং আমাদের জনগণকে তাদের নিজেদের ভাগ্যের সিদ্ধান্ত নিতে দেয়। এই দখলদারিত্ব কেবল রক্তপাত, ধ্বংস এবং বিশৃঙ্খলারই কারণ হয়েছিল। তারা আমাদের দেশকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত, নিরাপত্তাহীন, মাদক-মাফিয়াদের সাম্রাজ্য এবং বিশেষ করে মহিলাদের জন্য বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করেছে।
একেবারে গোড়াতেই আমরা এই পরিণতি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। আমেরিকান দখলদারিত্বের প্রথম দিকে আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের ১১ তারিখে ঘোষণা করেছিলামঃ
“মার্কিন হামলার ধারাবাহিকতা এবং নিরীহ বেসামরিক নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধি কেবল তালিবানদের অজুহাত তৈরী করবে না, উপরন্তু এই অঞ্চলে এমনকি বিশ্বে মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতায়নের কারণ হবে।”
আমরা এই দখলদারিত্বের বিরোধিতা করেছিলাম তার প্রধান কারণ ছিলো এরা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এই সুন্দর শিরোনামের ছায়ায় আসলে সন্ত্রাসবাদীদেরকেই আবার প্রতিষ্ঠা করেছে, লালনপালন করেছে। একেবারে প্রথম দিন থেকেই এরা ‘নরদান অ্যালায়েন্স’ এর লুটেরা ডাকাত আর খুনীদেরকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো ২০০২ সালে আর এখন এই ২০২০ সালে এরা আরেক সন্ত্রাসী দলের সাথে দোহায় বসে শান্তি আলোচনা করছে, চুক্তি করছে, কারাগার থেকে প্রায় পাঁচ হাজার সন্ত্রাসবাদী বন্দীকে ছেড়ে দিচ্ছে, ফলে এটা প্রায় নিশ্চিত যে শেষ পর্যন্ত আমেরিকার এই প্রত্যাহার প্রক্রিয়া কোনো ভালো কিছু বয়ে আনবেনা।
পেন্টাগন প্রমাণ করেছে যে এই আক্রমণ বা হস্তক্ষেপের স্বপক্ষে কোনো তত্ত্বই এই অঞ্চলে কোনো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই যখন অন্য কোনো দেশ আক্রমণ করে, দখল করে তখন তা করে তাদের নিজেদের কৌশলগত স্বার্থে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে, যদিও এন্তার মিথ্যা কথা, গালগল্প আর শক্তিমান মিডিয়া সারাক্ষণ চেষ্টা করে তাদের এই আসল উদ্দেশ্যকে লুকিয়ে রাখতে।
আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ ও আক্রমণের কারণ হিসাবে “নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা”, “গণতন্ত্র উদ্ধার” কিংবা “জাতিগত উন্নয়ন” ইত্যাদিকে কারণ হিসাবে দেখানো একটা আপাদমস্তক কৌতুক ছাড়া আর কিছু নয়। আমেরিকা আফগানিস্তানে এসেছিলো এই অঞ্চলকে অস্থিশীল ও সন্ত্রাসবাদ পীড়িত করে রাখার জন্যে, বিশেষত এই ধরনের আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা দিয়ে আমেরিকার সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ভাবে দমিয়ে রাখার জন্যে। কিন্তু এটা সত্যি, অবশ্যই মার্কিন সরকার এমন বিপর্যয়কর, লজ্জাজনক এবং বিব্রতকর প্রস্থান চায়নি যা এমন হৈচৈ ফেলে দেবে যে তারা বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করতে এবং এর কূটনীতিক এবং কর্মীদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে 48 ঘণ্টার মধ্যে আবার সেনা পাঠাতে বাধ্য হবে।
আমরা বিশ্বাস করি আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়েছে তার নিজের দুর্বলতার কারণেই, তার নিজেরই তৈরি করা শক্তি তালিবানের কাছে পরাজিত হয়ে নয়। অন্তত দুইটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে আমেরিকার এই প্রস্থানের পেছনেঃ
প্রথম কারণটি হলো আমেরিকার নিজের বহুবিধ অভ্যন্তরীণ সংকটসমূহ। কোভিড মহামারিতে দুর্বল প্রতিক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনাজনিত কারণে আমেরিকার নানান অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া, ক্যাপিটল হিল বা আমেরিকার সংসদ ভবনের একাংশে নজির বিহীন হামলা সহ গত কয়েক বছরে অনেকগুলো বড়ো গণবিক্ষোভ। নীতিনির্ধারকরা এক রকমের বাধ্য হয়েছেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিজেদের ভেতরের জ্বলন্ত ইস্যুগুলোতে মনোযোগী হবার মতো সিদ্ধান্ত নিতে।
দ্বিতীয় কারণটি আরও সহজ, আফগান যুদ্ধ ছিলো একটি ব্যতিক্রমী ধরনের ব্যয়বহুল যুদ্ধ যা ইতিমধ্যেই ট্রিলিয়ন ডলারের কোটা পেরিয়ে গেছে আর এই সবই হচ্ছে আমেরিকার সাধারণ মানুষের করের টাকা। এই খরচের বোঝা আমেরিকার জন্যে এতোটাই ভারী হয়ে উঠেছিলো যে আমেরিকা বাধ্য হয়েছে এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে, আফগানিস্তান থেকে প্রস্থান ছাড়া যার আর কোনো বিকল্প ছিলোনা।
আমেরিকার যুদ্ধবাজ নীতি প্রমাণ করেছে যে তারা কখনোই আফগানিস্তানকে একটি নিরাপদ জনপদ হিসাবে গড়ে তোলার জন্যে আসেনি, তাই এখন তারা যখন চলে যেতে চাচ্ছে, তাদের ছেড়ে দেয়াই ভালো। আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে তারা আসলে জানতো যে এভাবে প্রত্যাহার একটা গোলমেলে পরিস্থিতি তৈরি করবে, কি তা জেনেও তারা এভাবেই কাজটি করেছে।
এখন তালেবান আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার কারণে আফগানিস্তান আবার আলোচনায় এসেছে কিন্তু গত ২০ বছর ধরেই এই অবস্থা ছিল এবং প্রতিদিন আমাদের শত শত মানুষ নিহত হয়েছিল এবং আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তফাত হচ্ছে খুব কম মিডিয়াতেই সেসব রিপোর্ট হোতো।
সোনালী কোলহাতকারঃ তালেবান নেতৃত্ব বলছে তারা নারীর অধিকারকে সম্মান করবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা ইসলামী আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ থাকে। কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যম এটিকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছে। তালেবান কি বিশ বছর আগেও একই কথা বলে নি? আপনি কি মনে করেন মানবাধিকার এবং নারীর অধিকারের প্রতি তাদের মনোভাবের কোন পরিবর্তন হয়েছে?
রাওয়াঃ এসব করপোরেইট মিডিয়াগুলোর কাজই হচ্ছে সবদিক থেকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ক্ষতকে বোঝার চেষ্টা না করে তাতে লবণ ছিটিয়ে দেয়া; যেভাবে আজকে তারা তালিবানের নৃশংসতাকে ‘সুগার কোট’ করে অর্থাৎ নরম সরম করে বোঝার চেষ্টা করছে তাতে তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। তালিবান মুখপাত্র খুব পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন যে ১৯৯৬ আর আজকের মাঝে তাদের আদর্শের কোনো রকমের পরিবর্তন ঘটেনি, কোনো তফাত নেই। আর আজকে তারা নারীর অধিকার সম্পর্কে যা বলেছে ঠিক একই কথা তারা বলেছিল বিশ বছর আগেঃ শরীয়া আইনের বাস্তবায়ন।
আজকাল তালিবানরা আফগানিস্তানের সমস্ত অঞ্চলে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করছে এবং তাদের স্লোগান হচ্ছে ‘সাধারণ ক্ষমার আনন্দ যা দিতে পারে, প্রতিশোধ তা দিতে পারে না’। কিন্তু বাস্তবে তারা প্রতিদিন মানুষ হত্যা করছে। মাত্র গতকালও তালিবানের সাদা পতাকার বদলে তেরঙ্গা আফগান জাতীয় পতাকা বহন করার জন্য নানগারহারে একটি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে । তারা কান্দাহারে চার সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, হেরাত প্রদেশের এক তরুণ আফগান কবি মেহরান পোপালকে ফেসবুকে তালেবানবিরোধী পোস্ট লেখার জন্য গ্রেফতার করয়েছে এবং তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার কি অবস্থা এখন কেউ জানেনা। এগুলো হচ্ছে তালিবানের নৃশংসতার সামান্য কয়েকটা উদাহরণ মাত্র যদিও তাদের মুখপাত্রদের মুখে আপনি শুনবেন “সুন্দর” আর “পালিশ” করা সব শব্দ আর বাক্য।
আমাদের বিশ্বাস এই দাবীগুলো আসলে তালিবানের আরও অসংখ্য নাটকেরই একটি, এই সব নাটুকেপনা করার মাধ্যমে আসলে তারা আরেকটু সময় পেতে চাচ্ছে নিজেদেরকে গুছিয়ে নেয়ার জন্যে। সবগুলো ঘটনা এতো দ্রুত ঘটেছে যে তারা সময় পায়নি, এখন তারা চেষ্টা করছে তাদের সরকারের কাঠামো তৈরি করার জন্যে, গোয়েন্দা ব্যবস্থা আর মন্ত্রণালয় তৈরির কাজ করছে যেনো তারা আবার মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কোনটা পাপ আর কোনটা পুণ্য তাদের সেসব বোঝাপড়া আরোপ করতে পারে মানুষের উপরে, গজ ফিতা দিয়ে মেপে মেপে ঠিক করে দিতে পারে মানুষের দাড়ির দৈর্ঘ্য কত হবে, মানুষ কি পরিধান পারবে আর কি পারবেনা, নারীর জন্যে কারা অভিভাবক আর কারা নয় এসব। তালিবানরা বলে তারা নারীর অধিকারের বিরোধী নয় কিন্তু তা হতে হবে ইসলামী বা শরিয়া আইনের কাঠামোর ভেতরে।
ইসলামি আইন বা শরিয়া আইন নানান দিক থেকেই খুব স্পষ্ট কোনো কাঠামো নয়, বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রে শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা অর্জনের জন্যে একে নানান ভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে। আবার এটা সত্যি যে তালিবান চায় পশ্চিমা দেশগুলো তাদেরকে স্বীকৃতি দিক, তাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করুক, তালিবানের এই সকল উদার হবার দাবী আসলে পশ্চিমের কাছে নিজেদেরকে একটু দুধে ধোয়া তুলসী পাতা হিসাবে হাজির করার প্রয়াস। এমনটাও হতে পারে যে কয়েক মাস পরে হয়তো তারা বলবে আমরা নির্বাচন দিতে চাই কারণ আমরা ন্যায্যতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি! কিন্তু এধরনের নাটক তাদের প্রকৃত চেহারাটা আড়াল করতে পারবেনা, তাদের সত্যিকারের চেহারা হচ্ছে চরম ইসলামী মৌলবাদী চেহারা।চরম লিঙ্গ-বৈষম্যবাদী, অমানবিক, বর্বর, প্রতিক্রিয়াশীল ও গণতন্ত্র বিরোধী স্বরূপ, এক কথায় তালিবান তাদের এই চরিত্র বদলায়নি আর কখনো বদলাতেও পারবেনা।
সোনালি কোলহাতকারঃ আফগান সেনাবাহিনী ও আমেরিকা সমর্থিত সরকার ঠিক কি কি কারণে এতো দ্রুত ভেঙ্গে পড়লো?
রাওয়াঃ অনেকগুলো কারণের মাঝে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে –
১. আসলে প্রায় সব আয়োজন শেষ করে রাখা হয়েছিলো চুক্তি মোতাবেক তালিবানের কাছে আফগানিস্তানকে হস্তান্তর করার জন্য। আমেরিকান প্রশাসন আসলে পাকিস্তান ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সাথে দেন দরবার করছিলো একটা ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর জন্যে যে তালিবান কে ভিত্তি করে একটি সরকার গঠন করার জন্যে। আফগান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা খামোখা যুদ্ধ করে প্রাণ দিতে তৈরি ছিলোনা কেননা তারা জানতো এই যুদ্ধ করে আফগান জনগণের কোনো লাভ নেই, পর্দার আড়ালে রুদ্ধদ্বার বৈঠকগুলোতেই আসলে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে তালিবানকে ক্ষমতায় আনার জন্যে। সবকিছুই আসলে ঠিক হয়ে গেছে পর্দার আড়ালে । তালিবান কে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার মতো জঘন্য কাজের জন্যে জালমে খলিলজাদ* হচ্ছে এখন সবচাইতে ঘৃণিত ব্যক্তি।
২. বেশিরভাগ আফগান জানে যে আফগানিস্তানের এই চলমান যুদ্ধ আসলে আফগান জনগণের মুক্তি বা কল্যাণের জন্যে কিংবা আফগানিস্তানের ভালোর জন্যে নয়, বরং এই যুদ্ধের শুরু করা হয়েছিলো বিদেশী রাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের কারণে, আফগান জনগণ ছিলো সেখানে জ্বালানী মাত্র। আফগান সেনাবাহিনীর একটা বড়ো অংশের তরুণ বাহিনীতে যোগদান করেছে কেবল চরম দারিদ্র্য আর বেকারত্বের কারণে, ফলে সেনাবাহিনীর প্রতি, সৈনিক হিসাবে প্রতিরোধ ও যুদ্ধের প্রতি তাদের কোনো নৈতিক প্রতিশ্রুতি নেই। এ প্রসঙ্গে বলে নেয়া ভালো যে গত বিশ বছর ধরে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো আফগানিস্তানকে কেবল একটি ভোক্তা সমাজ হিসাবেই গড়ে তুলেছে, এবং কোনো শিল্পায়ন বা উৎপাদনশীল খাত গড়ে উঠতে বাধা দিয়েছে। এই অবস্থা একটা ভয়ংকর দারিদ্র্য ও বেকারত্বের জন্ম দিয়েছে যা আমেরিকার বশংবদ সরকার ও তালিবানের জন্যে লোকবল পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে আর বাড়িয়ে দিয়েছে আফিম চাষ ও উৎপাদন।
৩. আফগান বাহিনী এতোটা দুর্বল নয় যে তারা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভেঙ্গে পড়বে, কিন্তু তারা সরাসরি রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে নিয়মিত নির্দেশ পেয়ে আসছিলো তালিবানের বিরুদ্ধে কোনো সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে না তোলার জন্যে বরং তালিবানের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্যে। ফলে বেশিভাগ প্রদেশেই খুব শান্তিপূর্ণ ভাবেই এই আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেছে।
৪. আমেরিকার পুতুল সরকার প্রধান হামিদ কারজাই এবং আশরাফ গণি সবসময়ই তালিবানদের কে বলে এসেছে “অভিমানী ভাই” হিসাবে এবং সেকারণেই বছরের পর বছর এই পুতুল সরকার কারাগার থেকে ছেড়ে দিয়েছে ভয়ংকর নৃশংস আফগান সামরিক কমান্ডার ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেককে।তালিবানদের একদিকে “শত্রু”র বদলে অভিমানী “ভাই” হিসাবে গণ্য করা আর অন্যদিকে আফগান সৈনিকদেরকে তাদের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে দেয়ার মতো স্ববিরোধীতা দিয়ে আফগানিস্তানের সৈন্যদের নৈতিক মনোবলকেই ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।
৫. আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনী হচ্ছে কল্পনাতীত দুর্নীতিতে ডুবে থাকা একটি সংগঠন। অধিকাংশ জেনারেল (বেশীরভাগই আসলে নর্দার্ন এলায়েন্স এর নৃশংস যুদ্ধবাজ সাবেক নেতারা) কাবুলে বসে বসে নিজেদের ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি ডলার পুরেছেন, এমন কি তারা সৈন্যদের বেতন ভাতা ও খাবারের রেশনের বাজেট থেকেও দুর্নীতি করে টাকা আত্মসাৎ করেছে। সেনাবাহিনীতে অদৃশ্য সৈনিক বা “ঘোস্ট সোলজার” উপস্থিতির মত ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা সিগার এর তদন্তে উঠে এসেছে। সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা হাজার হাজার ভুয়া সৈনিক এর নামে তাদের বেতন ও রেশনের জন্যে বরাদ্দ অর্থ নিজেদের ব্যাংক একাউন্টে পাচার করেছেন।
৬. যখনই সম্মুখ সমরে কোনো আফগান সেনাসদস্য তালিবানদের হাতে ধরা পড়েছে, কাবুল সবসময়ই তাদের সাহায্যের আবেদনকে উপেক্ষা করেছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে যখন তালিবান কয়েকশো আফগান সেনাকে হত্যা করেছে যখন তাদের কাছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে কোনো অস্ত্র-গোলাবারুদ ও খাবার ছিলোনা। এসব কারণে আফগান সেনাবাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা ছিলো খুব বেশী। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় আফগান রাষ্ট্রপতি আশরাফ গণি স্বীকার করেছিলেন যে ২০১৪’র পর থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার আফগান সৈন্য নিহত হয়েছে যেখানে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনীর মাত্র ৭২ জন সৈন্য প্রাণ দিয়েছেন।
৭. মোটের উপরে আফগান সমাজের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, অবিচার, বেকারত্ব, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা, প্রতারণা, সীমাহীন দারিদ্র্য, মাদক ও চোরাচালান এর সবই প্রেক্ষিত তৈরি করেছে তালিবানের উত্থানের পেছনে।
সোনালি কোলহাতকারঃ আমেরিকান নাগরিকদের জন্যে আফগান জনগণ ও আফগান নারীদের সাহায্য করার সবচেয়ে ভালো পথ তাহলে কোনটা?
রাওয়াঃ আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে আমেরিকার প্রকৃত মুক্তিকামী মানুষ আমাদের সাথে ছিলো এবং আছেন এই দীর্ঘ সময় ধরে। আমরা মনে করি আমেরিকান জনগণ আমাদেরকে সত্যিকারের সাহায্য করতে পারেন যদি তারা তাদের রাষ্ট্রের এই সকল যুদ্ধবাজ নীতির বিরোধিতা করেন, তাদের প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর জারি রাখেন। তাহলেই এই সকল বর্বরতার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের মানুষের নিজেদের সংগ্রাম শক্তিশালী হবে।
ইতিহাস সাক্ষী, মানুষের প্রকৃতিই হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আমরা দেখেছি “অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট” বা “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস” এর মতো প্রতিবাদ সংগ্রামগুলো। আমরা দেখেছি হাজারো নিপীড়ন, নির্যাতনও মানুষের মুক্তির সংগ্রাম কে দমিয়ে রাখতে পারেনা। আফগান নারীদেরও আর দমিয়ে রাখা যাবেনা। এমন কি তালিবান ক্ষমতা দখল করার পরেরদিনই কাবুলের একদল সংগ্রামী নারী দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকেছেন, শ্লোগান লিখেছেন “তালিবান নিপাত যাক”। আমাদের মেয়েরা এখন অনেক রাজনৈতিক সচেতন, বিশ বছর আগে যত সহজে তাদেরকে বোরকার ভেতরে বন্দী করা সম্ভব হয়েছিলো, এখন আর তা সম্ভব নয়, আফগান মেয়েরা এখন আর বোরকার ভেতরের বন্দী জীবন চায়না। আমরা আমাদের সংগ্রামের কার্যকর পথ খুঁজে নেবো, আমরা আমাদের সংগ্রাম, প্রতিবাদ জারি রাখবো।
আমরা মনে করি, এই অমানবিক মার্কিন সেনাবাহিনী শুধু আফগান জনগণের জন্যেই হুমকি নয় বরং তারা সারা বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যেই হুমকি স্বরূপ। আমেরিকার এই ব্যবস্থা এখন ভেঙ্গে পড়ার মুখে, এই মুহূর্তে পৃথিবীর সকল শান্তি প্রিয়, প্রগতিশীল, বামপন্থী, ইনসাফকামী মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন ও ক্যাপিটোল হিলের এই সকল যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জোরদার করা। আমেরিকার এই যুদ্ধবাজ পচে যাওয়া রাষ্ট্রনীতি ও ব্যবস্থাকে একটি সত্যিকারের মানবিক ব্যবস্থা দিয়ে পাল্টে ফেলতে পারলে শুধু কোটি কোটি আমেরিকার শোষিত নিপীড়িত দরিদ্র মানুষকেই মুক্তি দেবেনা বরং তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে।
আমাদের ভয় হচ্ছে একটা সময় হয়তো মানুষ ভুলে যাবে আফগানিস্তানের জনগণ ও আফগান নারীদের কি করুন অবস্থা ছিলো নব্বুই এর দশকের সেই ভয়ংকর তালিবানী শাসনামলে। আমেরিকার প্রগতিশীল মুক্তিকামী মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আফগান নারীর কথা ভুলে যাওয়া ঠিক হবেনা।
একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজের জন্যে আমরা আমাদের সংগ্রাম জারি রাখবো, আমাদের প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর জারি থাকবে।
* জালমে খলিলজাদ – আফগান বংশোদ্ভূত মার্কিন কূটনৈতিক যিনি আমেরিকার হয়ে আফগান ইস্যুতে নানান দেন দরবার, আলোচনা ও চুক্তির প্রেক্ষিত তৈরি করেছেন।