অনুবাদকের ভূমিকা: করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে টালমাটাল ভারত। প্রথম ঢেউ প্রশমিত হওয়ার পর ভাবা হয়েছিল আপদ কেটে গেছে। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাবতীয় জনসমাগম ঘটেছিল এবং ঘটতে দেওয়া হয়েছিল। স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ম্যাচ দেখা থেকে শুরু করে কুম্ভমেলায় গঙ্গাস্নানের উৎসব ও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বিশাল রাজনৈতিক মিছিলের মতো গণজমায়েতের ঘটনাগুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে সাহায্য করেছে। রাজধানী দিল্লির বড় বড় হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। নতুন জাতের করোনা খুব দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ফুসফুসকে আক্রান্ত করছে। হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। হাসপাতালের বারান্দা, রাস্তা-ঘাটে ও নিজ নিজ বাসায় মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। শ্মশানের চিতা যেন নিভতেই চাইছে না। তরুণেরাও ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। ভারতের স্বাস্থ্যখাত ভেঙ্গে পড়ার দশা হয়েছে। এসব কিছুর বিবরণই আসলে ভারতের নতুন সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়কে ধারণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। পরিস্থিতির এই ভয়াবহতার পেছনে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস ছাড়াও দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় কতখানি? সেটিই খতিয়ে দেখেছেন বিখ্যাত ভারতীয় লেখক, ঔপন্যাসিক ও রাজনৈতিক অধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায়। যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় www.theguardian.com/news/2021/apr/28/crime-against-humanity-arundhati-roy-india-covid-catastrophe এই লেখাটি প্রকাশিত হয় ২৮ এপ্রিল তারিখে।
অনুবাদক: জাকির হোসেন
১.
২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশের বিশেষভাবে মেরুকরণকৃত নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সে সময়ের কলহপূর্ণ পরিস্থিতিকে আরও উস্কে দিয়েছিলেন। একটি জনসমাবেশ থেকে তিনি একটি বিরোধীদলের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়কে তোষণের অভিযোগ তুলেছিলেন। অভিযোগের পেছনে যুক্তিটি ছিল প্রাদেশিক সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্মশানের চেয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের কবরস্থানের পেছনে বেশি অর্থ ব্যয় করেছিল। তার স্বভাবসুলভ মুচকি হাসির সাথে শ্লেষাত্মক বাক্যবাণ মিশিয়ে ভয়ানক এক প্রতিধ্বনি তুলে তিনি জনসমাগমকে উত্তেজিত করে তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “গ্রামে যদি একটি কবরস্থান নির্মাণ করা হয়, তাহলে সেখানে একটি শ্মশানও বানানো উচিত।”
তার সামনে উপবিষ্ট মন্ত্রমুগ্ধ জনতা ‘শ্মশান! শ্মশান!’ বলে প্রতিধ্বনি তুলেছিল।
ভারতে গণহারে শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ফলে শ্মশানঘাটগুলো থেকে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনের শিখা আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতা দখল করেছে দেখে তিনি সম্ভবত এখন খুশী হয়ে উঠেছেন। তাছাড়া তার দেশের সকল কবরস্থান ও শ্মশানঘাটগুলো তার পোষ্য সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার অনুপাতে এবং সেগুলোর ধারণক্ষমতার বাইরেও ঠিকঠাক কাজ করে যাচ্ছে দেখেও তার আনন্দিত হওয়ার কথা।
ভারতের সাম্প্রতিক বিপর্যয় এবং তার জাতীয় সীমানাগুলোর মধ্যে দ্রুতগতিতে সংক্রমণক্ষম নতুন ধরণের করোনা ভাইরাসকে আটকে রাখার মতো কষ্টসাধ্য বিষয়কে সামনে রেখে ওয়াশিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক একটি সম্পাদকীয় কলামে একটি তাত্ত্বিক প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, “১৩০ কোটি জনসংখ্যাসমেত ভারতকে কি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়?” উত্তর ছিল, “খুব সহজ কাজ নয়”। মাত্র কয়েক মাস আগে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপজুড়ে যখন করোনাভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল, তখনও ঠিক একইভাবে এই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। যদিও তখন লক্ষ্যবস্তু ছিল অন্যদিকে। তবে এ বছরের জানুয়ারিতে ওয়ার্লড ইকোনোমিক ফোরামে দেওয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের কথা মাথায় রাখলে সেক্ষেত্রে ভারতবাসীর আহত হওয়ার কোনো অধিকার নাই।
মোদি বক্তৃতা দিয়েছিলেন এমন সময়ে যখন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা এই অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের ধকলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। সে পরিস্থিতিতে ভারতের অবকাঠামো ও কোভিড প্রস্ততির ব্যাপারে এক লম্বা-চওড়া উল্লসিত অহংকারমূলক প্রশস্তি ছাড়া আক্রান্ত ভূখণ্ডের মানুষগুলোর জন্য কোনও সহানুভূতিমূলক বাক্য তার মুখ থেকে বের হয় নি। আমি তার সে বক্তব্যটি ডাউনলোড করে ফেলেছিলাম, কারণ আমার ভয় হচ্ছিল যে মোদী সরকার খুব শিগগিরই যখন ইতিহাস লিখতে বসবে, তখন এটিকে গুম করে ফেলা হতে পারে, অথবা একে খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। এখানে তার কিছু অমূল্য বয়ান উল্লেখ করা হলো:
“বন্ধুরা, এই উদ্বেগের সময়েও আমি ১৩০ কোটি ভারতীয় জনগণের পক্ষ থেকে আত্মবিশ্বাস, ইতিবাচকতা এবং আশার বাণী নিয়ে হাজির হয়েছি… ভারত গোটা দুনিয়ার মধ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হতে পারে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। ভারতে করোনা সংক্রমণের সুনামি বয়ে যাবে বলে বলা হচ্ছিল। কারও কারও মতে, ৭০-৮০ কোটি ভারতীয় করোনায় সংক্রমিত হতে পারে এবং অন্যদের মতে, ২০ লক্ষ ভারতীয় করোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করবে বলে বলা হচ্ছিল।”
”বন্ধুরা, অন্য দেশগুলোর সাথে ভারতের সফলতার তুলনামূলক বিচার যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর সর্বমোট জনসংখ্যার ১৮% মানুষের আবাসভূমি এই দেশটি করোনা ভাইরাসকে কার্যকরীভাবে মোকাবিলা করার মাধ্যমে মানবজাতিকে একটি বিশাল বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে।”
করোনাভাইরাস কার্যকরীভাবে মোকাবিলা করার মাধ্যমে মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য মোদী দ্য ম্যাজিশিয়ানকে কূর্নিশ করা হোক! এখন যখন দেখা গেল যে তিনি আসলে করোনাকে সামাল দিতে পারেন নি, তখন কি আমরা এই বলে অভিযোগ জানাতে পারি যে, আমাদেরকে তেজষ্ক্রিয় পদার্থের মতো করে দেখা হচ্ছে কেন? আমাদের সাথে লাগোয়া অন্য দেশগুলোর সীমান্ত কেন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এবং ফ্লাইটগুলো কেন বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে? আমাদেরকে কেন আমাদের ভাইরাস এবং যাবতীয় ব্যাধি, বিজ্ঞানবিরোধিতা, ঘৃণা এবং নির্বুদ্ধিতাসমেত আমাদের প্রধানমন্ত্রী, তার দল এবং সে দল যে মার্কামারা রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করে সবসহ আটকে ফেলা হল?
২.
ভারতে করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউ আসার পরে গত বছরে যখন তা প্রশমিত হয়ে গেল, তখন সরকার এবং তার সমর্থক ধারাভাষ্যকারেরা জয়োল্লাস করছিল। সংবাদবিষয়ক অনলাইন সাইট দ্য প্রিন্টের প্রধান সম্পাদক শেখর গুপ্ত টুইট করেছিলেন, “ভারতে হয়তো চড়ুইভাতি চলছে না। তবে আমাদের ড্রেনগুলো লাশবদ্ধ হয়ে যায় নি, আমাদের হাসপাতালগুলোতে জায়গার সংকট দেখা যায় নি, আমাদের শ্মশানঘাট ও কবরস্থানগুলোতেও কাঠ কিংবা জায়গাসংকট দেখা যায় নি। সত্যের অপলাপ বলে মনে হচ্ছে? দ্বিমত হলে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আসুন। যদি না নিজেকে ঈশ্বর জ্ঞান করেন।” মর্যাদাহানিকর ও নির্মম চিত্রগুলোকে একপাশে সরিয়ে রাখুন—বেশিরভাগ অতিমারির যে দ্বিতীয় ঢেউ থাকে, এই সতর্কবার্তা জারি করতে কি আমাদের ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিল?
যা ঘটছে এখন, তার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল আগেই। যদিও এর তীব্রতা এমনকি বিজ্ঞানী ও ভাইরোলোজিস্টদেরও বিস্মিত করেছে। তবে কোথায় সে করোনার জন্য বিশেষায়িত অবকাঠামো এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘গণআন্দোলন’ যেগুলোর কথা মোদী অহংকারের সাথে বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন? হাসপাতালে কোন জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। বন্ধুবান্ধবেরা স্বাস্থ্যকর্মীবিহীন মেডিকেল কক্ষ এবং বেঁচে থাকা রোগীর চেয়ে অধিকসংখ্যক মারা যাওয়া রোগীর গল্প শোনাচ্ছেন। মানুষ মারা যাচ্ছে হাসপাতালের বারান্দায়, রাস্তায় এবং তাদের নিজেদের বাড়িতে। দিল্লির শ্মশানঘাটগুলোতে দাহ করার কাঠ শেষ হয়ে যাচ্ছে। শহরের গাছ-পালা ব্যবহারের জন্য বন বিভাগকে বিশেষ অনুমতি দিতে হয়েছে। মরিয়া লোকজন হাতের কাছে জ্বালানী হিসেবে যা খুঁজে পাচ্ছে তা দিয়েই শবদাহের কাজ চালাচ্ছে। পার্ক ও গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাগুলো আক্ষরিক অর্থেই শ্মশানে পরিণত হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন আমাদের আকাশসীমায় একটি অদৃশ্য ইউএফও দাঁড়িয়ে আছে এবং আমাদের ফুসফুস থেকে সমস্ত বাতাস টেনে নিচ্ছে। যেন আকাশসীমায় এমন এক অভূতপূর্ব আক্রমণ যার কথা কারও জানা ছিল না।
ভারতের বিষাদগ্রস্ত এক নতুন পুঁজিবাজারে অক্সিজেন যেন এক নতুন মুদ্রার নাম। জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী ইত্যাদি ভারতের কুলীন সম্প্রদায় টুইটারে হাসপাতালে জায়গা, অক্সিজেন সিলিন্ডার এসবের জন্য মিনতি জানাচ্ছেন। সিলিন্ডারের গোপন বাজার ফুলে ফেঁপে উঠছে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন মেশিন এবং ওষুধ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।
অন্যান্য জিনিসেরও বেশ কিছু বাজার আছে। মুক্তবাজারের নীচের প্রান্তে আছে, হাসপাতালের মৃতদের কক্ষে ব্যাগে মুড়িয়ে লাশের স্তূপে ছুঁড়ে মারা প্রিয়জনের মুখ শেষবারের মতো দেখার জন্য দেওয়া ঘুষ। শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে রাজি হওয়া পুরোহিতকে দেওয়া স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সম্মানি। অনলাইনে স্বাস্থ্যসেবামূলক পরামর্শ নিতে মরিয়া পরিবারগুলোকে নির্মম ডাক্তারদের লুন্ঠন। উপরের প্রান্তে, কোনো একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে আপনাকে হয়তো নিজের বসতভিটা ও জমি-জিরাত বিক্রি করতে হতে পারে। তারা এমনকি আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে রাজি হওয়ার আগেই শুধুমাত্র এই আমানত আপনার পরিবারকে কয়েক প্রজন্ম পিছিয়ে দিতে পারে।
এগুলোর কোনোটিই বর্তমানের মানসিক আঘাত, বিশৃঙ্খলা এবং সর্বোপরি মানুষ যে মর্যাদাহানিকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে, তার সম্পূর্ণ গভীরতা এবং পরিধি প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট নয়। আমার তরুণ বন্ধু টি’র সাথে যা ঘটেছে, তা শুধুমাত্র দিল্লিতেই কয়েকশ কিংবা কয়েক হাজার একই ধরণের ঘটনার মধ্যে একটি। কুড়ির কোঠায় থাকা টি তার বাবা-মা’র সাথে দিল্লির উপকন্ঠে গাজিয়াবাদের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। পরিবারের তিনজন সদস্যেরই কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ে। তার মায়ের অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। শুরুর দিকে হওয়ার কারণে হাসপাতালে জায়গা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। তার বাবা মারাত্মক পর্যায়ের বাইপোলার ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলেন এবং সহিংস হয়ে উঠে নিজের শারিরীক ক্ষতি করতে আরম্ভ করলেন। তিনি ঘুমানো বন্ধ করেছিলেন। গায়ে কাদামাটি মাখতে শুরু করেছিলেন। তার মনোবিদ অনলাইনে কিছুটা সাহায্য করলেও অতি সম্প্রতি সে ডাক্তার মহিলার স্বামী করোনায় মারা যাওয়ার কারণে তিনিও সময়ে সময়ে ভেঙ্গে পড়তেন। তিনি বলেছিলেন যে টি’য়ের বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। তবে তিনি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে তার কোনো সুযোগ ছিল না। অতএব, টি’কে জেগে থাকতে হতো রাতের পর রাত, তার বাবাকে ধরে রাখতে হতো, শরীর মুছিয়ে দিতে হতো, বিছানাপত্র পরিষ্কার করতে হতো। তার সাথে কথা বলার সময় প্রত্যেকবার আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। শেষ পর্যন্ত খবর আসল, ‘বাবা মারা গেছেন’। তিনি করোনায় মারা যান নি, তিনি মারা গিয়েছিলেন তীব্র অসহায়ত্বের বোধ থেকে মানসিক আঘাতের দরুণ উচ্চ রক্তচাপের এক বিশাল আঘাতে।
লাশ নিয়ে কি করা যায়? আমি মরিয়াভাবে আমার পরিচিত সব মানুষকে জানালাম। যারা সাড়া দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন অনির্বান ভট্টাচার্য যিনি সুপরিচিত সমাজকর্মী হর্ষ মান্দারের সাথে কাজ করেন। ২০১৬ সালে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলায় বিচারের মুখোমুখি হতে চলেছেন ভট্টাচার্য। গত বছরে করোনায় মারাত্মকভাবে কাবু হয়ে এখনও পুরোপুরি সেরে না ওঠা মান্দারকে গ্রেফতার এবং তার পরিচালিত এতিমখানা বন্ধের হুমকি দেওয়া হচ্ছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পাস করা মুসলিমদের বিরুদ্ধে চরম বৈষম্যমূলক জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে গণসমাবেশ ঘটানোর পর থেকে। মান্দার ও ভট্টাচার্য হলেন অসংখ্য নাগরিকদের মধ্যে দু’জন যারা সবধরনের প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে হেল্পলাইন ও জরুরি সাড়াদান কর্মসূচী চালু করেছেন এবং অ্যামবুলেন্স জোগাড় করা, শেষকৃত্যগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা ও মৃতদেহ স্থানান্তরের কাজে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলছেন। এই স্বেচ্ছাসেবকেরা যা করছেন তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সংক্রমণের এই ঢেউয়ে তরুণরাই ঢলে পড়ছেন, তারাই আইসিইউগুলো পরিপূর্ণ করছেন। তরুণেরা যখন এভাবে মারা যায়, আমাদের মধ্যে বয়ষ্করা বেঁচে থাকার একটুখানি আশা হারিয়ে ফেলেন।
টি’র বাবাকে দাহ করা হয়েছে। টি ও তার মা সেরে উঠছেন।
৩.
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে ধীরে ধীরে। নিশ্চয়ই সেটা ঘটবে। তবে আমরা জানি না আমাদের মধ্যে কারা সে দিন দেখার জন্যে জীবিত থাকব। ধনীরা তুলনামূলক সহজেই শ্বাস নেবে। গরীবেরা সেটা করতে পারবে না। এখন পর্যন্ত অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রীদের মধ্যে গণতন্ত্রের আভাষ পাওয়া গেছে। ধনীরাও শয্যাশায়ী হচ্ছে। হাসপাতালগুলো অক্সিজেন ভিক্ষা করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের-অক্সিজেন-নিজেই-আনুন কর্মসূচী শুরু করেছে। অক্সিজেন সংকট প্রদেশগুলোকে একে অপরের সাথে তীব্র ও কুৎসিত কলহের দিকে ধাবিত করেছে, সাথে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের উপরে আসা দোষারোপগুলো ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছে।
২২ এপ্রিল রাতে স্যার গঙ্গা রাম নামক দিল্লির একটি বৃহৎ প্রাইভেট হাসপাতালে ২৫ জন সংকটাপন্ন করোনা রোগী উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেনের মধ্যে মারা যায়। হাসপাতালটি তাদের অক্সিজেন পুনঃসরবরাহের ব্যবস্থা করার জন্য কয়েকটি মরিয়া এসওএস বার্তা পাঠায়। এক দিন পর হাসপাতাল বোর্ডের চেয়ারম্যান বিষয়টি খোলাসা করতে ছুটে যান: “আমরা এমনটা বলতে পারি না যে তারা অক্সিজেনের যোগানের অভাবে মারা গেছেন।” ২৪ এপ্রিলে জয়পুর গোল্ডেন হাসপাতাল নামক দিল্লির আরও একটি বড় হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় আরও ২০ জন রোগী। একই দিনে দিল্লি হাইকোর্টে ভারতের আইনজীবী জেনারেল তুষার মেহতা ভারত সরকারের হয়ে ঘোষণা দেন: “চলুন চেষ্টা করি এবং শিশুর মতো কান্নাকাটি না করি… এ পর্যন্ত আমরা এটা নিশ্চিত করেছি যে এই দেশে অক্সিজেনবিহীন কেউ থাকবে না!”
উত্তর প্রদেশের গেরুয়া বসনধারী মূখ্যমন্ত্রী অজয় মোহন বিশ্ত, যিনি যোগী আদিত্যনাথের নামে চলেন, তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তার রাজ্যের কোনো হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো প্রকার সংকট নাই এবং গুজব রটনাকারীদেরকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে বিনা জামিনে গ্রেফতার করা হবে এবং তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
যোগী আদিত্যনাথ কাঁচা কাজ করেন না। হাথরাস জেলায় এক দলিত বালিকার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে সাথে থাকা আরও দু’জন সহ গ্রেফতার হওয়া কেরালার একজন মুসলিম সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান অসুস্থ হয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন এবং তার করোনা সংক্রমণও ধরা পড়েছে। তার স্ত্রী ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নিকট মরিয়া আর্জি জানাতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, তার স্বামী মথুরার একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় ‘পশুর মতো’ শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা অবস্থায় শুয়ে আছেন। (সুপ্রিম কোর্ট বর্তমানে উত্তর প্রদেশের সরকারকে আদেশ দিয়েছে তাকে দিল্লির একটি হাসপাতালে ভর্তি করা জন্য)। সুতরাং, আপনি যদি উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা হয়ে থাকেন, তবে আপনার প্রতি বার্তাটি দৃশ্যত এরকম, অনুগ্রহপূর্বক নিজের প্রতি রহম করুন এবং বিনা অভিযোগে মৃত্যুবরণ করুন।
অভিযোগকারীদের প্রতি সেই হুমকি শুধুমাত্র উত্তর প্রদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ফ্যাসিস্ট হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) যার সদস্যদের একজন হলেন মোদী ও তার কয়েকজন মন্ত্রী মহোদয়, এবং যে সংগঠনটি তাদের নিজস্ব সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী পরিচালনা করে, তার একজন মুখপাত্রের একটি সতর্কবার্তা হলো ‘ভারত-বিরোধী শক্তিগুলো’ এই সংকটকে ‘নেতিবাচকতা’ ও ‘অবিশ্বাস’ উসকে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতে পারে। তিনি গণমাধ্যমকে একটি ‘ইতিবাচক পরিবেশ’ তৈরি করতে আহ্বান জানান। টুইটার সরকারের সমালোচনাকারী অ্যাকাউন্টগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে সে কাজে সাহায্য করেছে।
কোথায় আমরা সান্ত্বনা খুঁজব? কোথায় খুঁজব বিজ্ঞান? আমরা কি সংখ্যাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকব? কতজন মারা গেছে? কতজন সেরে উঠেছে? কতজন সংক্রমিত হয়েছে? কখন আসবে চূড়ান্ত পর্যায়? ২৭ এপ্রিলে ৩,২৩,১৪৪ টি নতুন সংক্রমণের এবং ২,৭৭১ টি মৃত্যুর ঘটনা প্রতিবেদনে এসেছে। উক্ত হিসাবের নির্ভুলতা কিছুটা ভরসা জাগানিয়া। তবে তা আমরা জানলাম কিভাবে? করোনার পরীক্ষা খুব দূর্লভ ব্যাপার, এমনকি দিল্লিতেও। ছোট-বড় বিভিন্ন শহর ও মফসসলের কবরস্থান ও শ্মশানঘাটে করোনা-রীতি মেনে শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সংখ্যা আমাদের নির্দেশ করে যে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আনুষ্ঠানিক সংখ্যার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি পর্যন্ত হতে পারে। মেট্রোপলিটন অঞ্চলের বাইরে কর্মরত ডাক্তারেরা আপনাকে সঠিক হিসাবটা বলতে পারবে।
দিল্লির যদি ভেঙ্গে পড়ার দশা হয়, তাহলে বিহার, উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশের গ্রামগুলোতে কি ঘটছে বলে আমাদের কল্পনা করা উচিত? লক্ষ লক্ষ শ্রমিকেরা যেখানে শহর থেকে ভাইরাস ও ২০২০ সালে মোদীর জাতীয় লকডাউনের ভয়াবহ স্মৃতির তাড়না নিয়ে তাদের বাসায় পরিবারের কাছে ফিরেছে। মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে সেটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোর লকডাউনের ঘটনা। এর ফলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা বিনা কাজে, বাসা ভাড়া দেওয়ার মতো কোনও অর্থ না থাকা অবস্থায়, বিনা খাদ্যে এবং বিনা যানবাহনে শহরে আটকে পড়ে। অনেকেই কয়েকশ মাইল দূরে থাকা নিজ নিজ গ্রামের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। রাস্তায় মৃত্যু হয় কয়েকশ মানুষের।
এই সময়ের মধ্যে কোনো জাতীয় লকডাউন না থাকার দরুণ শ্রমিকেরা যানবাহন চলাকালীন সময়েই ট্রেনে ও বাসে করে চলে গিয়েছে। তারা চলে গেছে কারণ তারা জানে যে যদিও তারা এই বৃহৎ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, তবুও যখন কোনও সংকট সামনে আসে, তখন এই প্রশাসনের চোখে তারা স্রেফ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। এই বছরের দলবদ্ধ প্রস্থানের ফলে নতুন ধরনের একটি বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়: গ্রামের বাড়িতে প্রবেশ করার আগে তাদের সঙ্গনিরোধের জন্য কোনো সঙ্গনিরোধ কেন্দ্র নাই। শহুরে ভাইরাসের হাত থেকে গ্রামকে বাঁচানোর চেষ্টায় ন্যূনতম কোনও ছলনারও আশ্রয় নেওয়া হয় নি।
সে গ্রামগুলোতে মানুষ ডায়রিয়া কিংবা যক্ষার মতো সহজে চিকিৎসাযোগ্য রোগে ভুগে মারা যায়? তারা কিভাবে করোনার সাথে পেরে উঠবে? করোনা পরীক্ষার উপায় কি তাদের হাতের নাগালে আছে? সেখানে কি কোনও হাসপাতাল আছে? সেখানে অক্সিজেন আছে? তারচেয়েও বড় কথা, সেখানে কি ভালোবাসা আছে? ভালোবাসা বাদ দিন, তার জন্য কি ন্যূনতম উদ্বেগের অস্তিত্বও আছে? নাই। কারণ সেখানে শুধুমাত্র শীতল উদাসীনতায় ভরপুর হৃৎপিণ্ড আকৃতির গর্ত আছে যেখানে ভারতের জনগণমন হৃদয় থাকা উচিত ছিল।
৪.
২৮ এপ্রিলের ভোরবেলায় খবর এলো আমাদের বন্ধু প্রভুভাই মারা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে তার মধ্যে করোনার চিরায়ত লক্ষণগুলো দেখা গিয়েছিল। তবে তার মৃত্যু করোনায় মারা যাওয়ার সরকারি তালিকায় উঠবে না কারণ, তিনি মারা গেছেন তার নিজ বাসায়, বিনা পরীক্ষা ও বিনা চিকিৎসায়। প্রভুভাই ছিলেন নর্মদা উপত্যকার বাঁধ নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনের একজন সাহসী কর্মী। আমি কেভাদিয়ায় তার বাসায় কয়েকবার থেকেছি যেখানে কয়েক দশক আগে বাঁধের নির্মাণকর্মী ও কর্মকর্তাদের কলোনি বানানোর জায়গার জন্য আদিবাসীদের প্রথম দলটিকে তাদের নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এখনও সে কলোনির বিভিন্ন প্রান্তে প্রভুভাইয়ের পরিবারের মতো বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো তাদের দারিদ্র্যজীর্ণ অনিশ্চয়তায় ঘেরা জীবন কাটায়। একদা নিজেদের ভূমিতে তারা আজ নিজেরাই অনুপ্রবেশকারী।
কেভাদিয়ায় কোনো হাসপাতাল নাই। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতের প্রথম ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী সরদার বল্লবভাই প্যাটেল, যার নামে বাঁধের নামকরণ করা হয়েছে, তার অনুসরণে ঐক্যের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। ১৮২ মিটার উচ্চতা নিয়ে সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্যের মর্যাদা পেয়েছে যার নির্মাণ খরচ ছিল ৪২.২ কোটি মার্কিন ডলার। ভেতরে থাকা উচ্চগতির লিফট দিয়ে দর্শনার্থীরা সরদার প্যাটেলের বুকসমান উচ্চতায় গিয়ে নর্মদা বাঁধ দেখতে পারে। তবে আপনি নিশ্চয়ই সে নদী উপত্যাকাজুড়ে নির্মিত সভ্যতা দেখতে পাবেন না সেখানে যাকে কিনা ধ্বংস করা হয়েছে, ডুবে গেছে সেই বিশাল জলাধারের গভীরতার মধ্যে। অথবা আপনি শুনতে পাবেন না পৃথিবীর সুন্দরতম ও গভীরতম লড়াই করে যাওয়া মানুষদের গল্পগুলো – যারা কিনা শুধু একটি বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে লড়াই করে নি, বরং লড়েছিল সভ্যতা, সুখ ও প্রগতির সর্বজনমান্য ধারণাগুলোর বিরুদ্ধেও। ভাস্কর্যটির নির্মাণ ছিল মোদীর প্রিয় কর্মসূচী। ২০১৮ সালের অক্টোবরে তিনি এর উদ্বোধন করেন।
প্রভুভাইয়ের মৃত্যুর বার্তা পাঠানো বন্ধুটি বাঁধ নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন নর্মদা উপত্যকায়। তিনি লিখেন: “আমি যখন এটি লিখছি তখন আমার হাত কাঁপছে। কেভাদিয়া কলোনি ও তার আশেপাশের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ।”
ভারতে করোনা সংক্রমণের লেখচিত্র গঠনকারী নির্ভুল সংখ্যাগুলো আহমেদাবাদের বস্তিগুলোকে আড়াল করার জন্য নির্মিত দেওয়ালের মতো, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের সম্মানে আয়োজিত মোদীর ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানের যাত্রাপথে যা নির্মাণ করা হয়েছিল। এই সংখ্যাগুলোর মতোই ভয়াবহ বিষয় হলো তারা আপনার সামনে ভারতের একটি কাঙ্খিত চিত্র উপস্থাপন করবে এবং ভারত আসলেই যা, সে চিত্র দেখতে দিতে চাইবে না। আসল ভারতে মানুষেরা প্রত্যাশিতভাবে ভোট দিবে হিন্দু হিসেবে, কিন্তু মারা যাবে ব্যবহৃত বস্তুর মতো।
“চলুন চেষ্টা করি এবং শিশুর মতো কান্নাকাটি না করি”
এই ব্যাপারটিতে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না যে সরকারের নিজের গঠিত একটি কমিটি ২০২০ সালের এপ্রিলে একবার এবং নভেম্বরে আবারও নিকট ভবিষ্যতে তীব্র অক্সিজেন সংকটে পড়ার সম্ভাবনার বিষয়ে সতর্ক করেছিল। আশ্চর্য হবেন না এই ভেবে যে কেন দিল্লির সবচেয়ে বৃহৎ হাসপাতালগুলোরও নিজস্ব অক্সিজেন উৎপাদনকারী খামার থাকবে না। এটা ভেবেও আশ্চর্য হবেন না যে কেন পিএম কেয়ারস ফান্ড নামক একটি অস্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি তুলনামূলক অধিকতর জনমুখী পিএম ন্যাশনাল রিলিফ ফান্ডকে প্রতিস্থাপিত করেছে, যেটি কিনা জনগণের অর্থ ও সরকারি অবকাঠামো ব্যবহার করে কিন্তু জনগণের নিকট ন্যূনতম জবাবদিহি ব্যতিরেকে কাজ করে একটি প্রাইভেট ট্রাস্টের মতো, সেটি হঠাৎ অক্সিজেন সংকটের প্রেক্ষাপটে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। মোদী কি আমাদের নিঃশ্বাসের যোগানের শেয়ার কিনবেন?
“চলুন চেষ্টা করি এবং শিশুর মতো কান্নাকাটি না করি”
৫.
মোদী সরকারের জন্য আরও অনেক জরুরি কর্মসূচীতে যোগ দেওয়ার ছিল এবং আছে সেটা বোঝা যায়। গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নগুলোকে ধ্বংস করা, অ-হিন্দু সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা এবং হিন্দু জাতির ভিত্তিকে মজবুত করার মতো বৃহৎ কাজগুলো নিরন্তর শ্রম ও সময়সূচীর দাবি করে। উদাহরণস্বরূপ: আসামে ২০ লক্ষ মানুষের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিশাল জেলখানা বানাতে হবে যারা সেখানে কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করে আসছে এবং হঠাৎ করেই তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। (এই প্রসঙ্গে আমাদের স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট দৃঢ়ভাবে সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে)।
কয়েকশ’ ছাত্র, আন্দোলনকর্মী ও তরুণ মুসলিম নাগরিকদেরকে তাদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গত মার্চে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় প্রাথমিক অভিযুক্ত হিসেবে জেলে বন্দি করতে হবে। আপনি যদি ভারতীয় মুসলিম হয়ে থাকেন, তবে আপনার হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়াটাও নিজের অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। আপনার জ্ঞাতিগোষ্ঠীকে এর মূল্য দিতে হবে। অযোধ্যায় নতুন রাম মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রয়োজন ছিল যেটি নির্মিত হচ্ছে সেই মসজিদের জায়গার উপর যেটি কিনা বিজেপির জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের সতর্ক প্রহরায় হিন্দু দাঙ্গাবাজরা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। (এই প্রসঙ্গেও আমাদের স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট দৃঢ়ভাবে সরকারের পক্ষাবলম্বন করে এবং হালকাভাবে দাঙ্গাবাজদের পক্ষ নেয়)। কৃষি খাতকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া বিতর্কিত নতুন খামার বিল পাস করাতে হবে। শত শত এবং হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে আসা প্রতিবাদরত কৃষকদের পেটাতে হবে এবং কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে হবে।
এরপর আরও আছে নয়াদিল্লির পুরনো জৌলুস হারানো রাজকীয় বাসভবন ভেঙ্গে ফেলে তার জায়গায় বৃহদাকার মাল্টি-মাল্টি-মাল্টি মিলিয়ন ডলারের নতুন বাসভবনের পরিকল্পনা জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের কাজে যোগদান করতে হবে। সর্বোপরি, নতুন হিন্দু ভারতের সরকার কিভাবে পুরনো ভবনগুলোতে বসবাস করতে পারে? দিল্লি যখন লকডাউনের মধ্যে অতিমারিতে বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে, তখন জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষিত ‘সেন্ট্রার ভিস্তা’ কর্মসূচীর আওতায় নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে। শ্রমিকদেরকে কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা পরিকল্পনার একটু হেরফের করে সেখানে একটি শ্মশানও নির্মাণ করতে পারে।
তাছাড়া কুম্ভমেলারও আয়োজন করতে হবে যাতে করে ছোট্ট একটি শহরে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পুণ্যার্থীরা গঙ্গাস্নানের জন্য ভিড় করতে পারে এবং পবিত্র ও আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়ে পুরো দেশজুড়ে তাদের নিজ এলাকায় ফেরার সময় স্বচ্ছন্দে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে। এবারের কুম্ভ দারুণ জমে উঠেছিল, যদিও মোদী নম্রভাবে প্রস্তাব দেন যে পবিত্র স্নানের ধারণাটি হলো ‘প্রতীকী’-এর অর্থ যাই হোক। (গতবারে একটি ইসলামি সংগঠন তাবলীগী জামাতের একটি সম্মেলনে যোগ দেওয়া পর তার সদস্যদের সাথে যা ঘটেছিল, এবারে তার কিছুই ঘটল না। গণমাধ্যম তাদের বিরুদ্ধে ‘করোনা জিহাদি’ বলে কোনো প্রচারাভিযান চালায় নি কিংবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের দায়ে তাদেরকে অভিযুক্তও করে নি।) একটি সেনাঅভ্যুত্থানের মধ্যেও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে জরুরি ভিত্তিতে মিয়ানমারের গণহত্যাকারী সরকারের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে যেখান থেকে তারা পালিয়ে বেঁচেছিল। (আরও একবার এই প্রসঙ্গে আমাদের স্বাধীন সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানানো হলে তিনি সরকারের সাথে সম্মত হন)।
সুতরাং, আপনি বলতেই পারেন, তাদের খুব, খুব, খুবই ব্যস্ত দিনকাল যাচ্ছে।
যাবতীয় জরুরি কাজের মধ্যেও সর্বোপরি আরও একটি জরুরি কাজ সম্পাদন করতে হবে। সেটি হলো পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে জিতে আসতে হবে। তার জন্য আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মোদীর লোক অমিত শাহকে তার মন্ত্রীসভার দায়িত্ব পালন কমবেশি বাদ দিয়ে কয়েক মাসের জন্য সমস্ত মনোযোগ বাংলার দিকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে, তার দলের পক্ষ থেকে ভয়াবহ প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে দিতে হবে, প্রত্যেকটি শহর ও গ্রামে মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে হবে। ভৌগলিকভাবে, পশ্চিমবঙ্গ একটি ছোট রাজ্য। সমস্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়া একদিনেই সম্পন্ন হয়ে যেতে পারত, অতীতে হয়েছেও তেমন। তবে বিজেপির জন্য এটি একটি নতুন এলাকা হওয়ার কারণে দলের পক্ষ থেকে ভোট পর্যবেক্ষণের কাজে নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রে নিজেদের ক্যাডারদের স্থানান্তরের জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন হবে, যাদের অধিকাংশই কিনা আবার বাংলার বাইরে থেকে আসা। নির্বাচনী সময়সূচীকে আটটি পর্যায়ে ভাগ করে পুরো মাসব্যাপী নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী সময়সূচীর বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে পুনরায় ভেবে দেখার অনুরোধ জানিয়েছিল। নির্বাচন কমিশন সে আবদন নাকচ করে দৃঢ়ভাবে বিজেপির পাশে এসে দাঁড়ায় এবং নির্বাচনী প্রচারণা চলতে থাকে। বিজেপির তারকা প্রচারকারী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং উৎফুল্ল ও মাস্কবিহীন অবস্থায় সামনে উপবিষ্ট মাস্কবিহীন জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন এবং তার জনসভায় অভূতপূর্ব সংখ্যায় শামিল হওয়ার জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন, এমন ভিডিও সকলেই দেখেছেন। সে দিন ছিল এপ্রিলের ১৭ তারিখ, যেদিন নতুন সংক্রমণের সরকারি হিসাব রকেটের গতিতে ২ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে।
এখন ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে বাংলা নতুন জাতের করোনা ভাইরাসের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে, নতুন একটি জাত যেটি কিনা তিনবার নিজের মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে করোনার নতুন ‘বাংলা জাত’ হিসেবে নাম ধারণ করেছে। সংবাদপত্রগুলোর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, প্রাদেশিক রাজধানী কলকাতায় প্রতি সেকেন্ডে পরীক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে করোনা ধরা পড়ছে। বিজেপি ঘোষণা দিয়েছে তারা বাংলার নির্বাচনে জয়ী হলে প্রত্যেকে যেন বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পায় তা নিশ্চিত করবে। যদি তারা না জেতে?
“চলুন চেষ্টা করি এবং শিশুর মতো কান্নাকাটি না করি”
৬.
যাইহোক, ভ্যাকসিনের খবর কী? নিশ্চয়ই সেগুলোই আমাদের ত্রাণকর্তা? ভারত কি ভ্যাকসিন-শক্তিকেন্দ্র নয়? আসলে ভারত সরকার দুটি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ভারতীয় সেরাম ইনস্টিটিউট (এসআইআই) ও ভারত বায়োটেকের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এই দুই প্রতিষ্ঠানই পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যবয়বহুল ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে দুটি বাজারে আনার অনুমোদন পেয়েছে। এই সপ্তাহে তারা ঘোষণা দিয়েছে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর কাছে তারা কিছুটা চড়ামূল্যে এবং রাজ্য সরকারগুলোর কাছে কিছুটা স্বল্পমূল্যে ভ্যাকসিন বিক্রি করবে। নানা তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে হিসাব-নিকাশ করে দেখা যাচ্ছে ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলো বীভৎস রকমের মুনাফা অর্জন করতে যাচ্ছে।
মোদীর শাসনামলে ভারতের অর্থনীতি অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করা লক্ষ লক্ষ মানুষকে শোচনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বিশাল সংখ্যক মানুষ বর্তমানে ২০০৫ সালে কংগ্রেস সরকার কর্তৃক জারিকৃত জাতীয় পল্লী কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের (এনআরইজিএ) অধীনে পোলট্রির খামারের আয়ের উপর নির্ভর করে টিকে আছে। এই পরিবারগুলো অনাহারে থেকে তাদের মাসওয়ারি উপার্জনের বড় একটা অংশ ব্যয় করে ভ্যাকসিন গ্রহণ করবে এমনটা আশা করা বৃথা। যুক্তরাজ্যে ভ্যাকসিন পাওয়া মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে এবং সেখানে তা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। যারা নিয়মবহির্ভূতভাবে ভ্যাকসিন পাওয়ার চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যায়। ভারতে ভ্যাকসিন প্রচারণার মূল চালিকাশক্তি দৃশ্যত করপোরেট মুনাফা অর্জন।
মোদীর সহযোগী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যখন মহাকাব্যিক এই বিপর্যয়ের প্রতিবেদন দাখিল করছে, আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, তারা সকলেই কিভাবে একটি মাত্র শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া কন্ঠে আবৃত্তি করে যাচ্ছে। তারা বারবার করে বলছে ‘ব্যবস্থা’ ভেঙ্গে পড়েছে। এই ভাইরাস ভারতের স্বাস্থ্য “ব্যবস্থাকে” ভয়াবহ পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছে।
‘ব্যবস্থা’ ভেঙ্গে পড়ে নি। বরং এই ‘ব্যবস্থার’ কোনো অস্তিত্বই ছিল না। বর্তমান সরকার ও তার আগের কংগ্রেস সরকার স্বাস্থ্যখাতের ন্যূনতম অবকাঠামো বলতে যা কিছু ছিল সেগুলোকেও ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করেছে। প্রায় অস্তিত্বহীন গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি দেশে যখন অতিমারি আঘাত হানে, তখন যা হয় সেটাই ঘটছে এখানে। ভারত জিডিপির ১.২৫% ব্যয় করে স্বাস্থ্যখাতে, যা কিনা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ এমনকি সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর চেয়েও অনেক কম। এই হিসাবটিও অতিরঞ্জিত কারণ, গুরুত্বপূর্ণ হলেও স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে পুরোপুরি পড়ে না এমন বরাদ্দও এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অতএব, প্রকৃত সংখ্যা হবে আনুমানিক ০.৩৪% এর মতো। ট্রাজেডির ব্যাপার হলো, ২০১৬ সালে ল্যানসেট সাময়িকীর একটি হিসাব মতে, ভয়াবহ দারিদ্র্যপীড়িত দেশটির শহরাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার ৭৮% এবং গ্রামাঞ্চলের ৭১% এখন নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি খাত। গণস্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান সম্পদগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, অনৈতিক সুপারিশ ও বিমা কোম্পানিগুলোর অশুভ যোগসাজশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বেসরকারি খাতের নিকট পাচার হয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা হলো একটি মৌলিক অধিকার। বেসরকারি খাত অনাহারী, অসুস্থ ও মৃত্যু পথযাত্রী গরীব মানুষদেরকে সেবা দেবে না। ভারতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে বেসরকারীকরণ অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
”ব্যবস্থা” ভেঙ্গে পড়ে নি। সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ‘ব্যর্থতা’ শব্দটি সম্ভবত এক্ষেত্রে লাগসই হবে না কারণ, আমরা এখানে অবহেলাজনিত অপরাধ লক্ষ্য করছি না, এখানে আমরা মানবতার বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর এক অপরাধ সংঘটনের সাক্ষী হচ্ছি। ভাইরোলোজিস্টগণ ভারতে প্রত্যেকদিন নতুন সংক্রমণের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে ৫ লক্ষ পর্যন্ত পৌঁছানোর ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। আসন্ন মাসগুলোয় তারা লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন। আমার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আমি সবার উপস্থিতি একে অপরকে জানান দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রত্যেকদিন একে অপরকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনেকটা ইস্কুলের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি নেওয়ার মতো। আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে কথা বলছি চোখের জলে, মনে গভীর শঙ্কা নিয়ে, পরস্পরের আর কখনও দেখা হবে কিনা সেই অনিশ্চয়তার মধ্যে। আমরা লিখছি, আমরা কাজ করছি, যে কাজ শুরু করেছি, সে কাজ শেষ করতে জীবিত থাকব কিনা সেটা না জেনেই। কি ভয়াবহতা, কি অসম্মান আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে আমরা জানি না। সর্বোপরি আছে মর্যাদাহানির ভয়। এই জিনিসটাই আমাদের তছনছ করে ফেলছে।
৭.
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ #মোদীমাস্টরিজাইন এখন চালু হয়েছে। কিছু কিছু মিম ও ব্যাঙ্গচিত্রে দেখা যাচ্ছে কঙ্কালের একটি স্তূপ মোদীর দাড়ির পর্দা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে। মসীহ মোদী লাশের এক শোভাযাত্রার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। মোদী ও অমিত শাহ শকুনরূপে আকাশপ্রান্তে চক্কর দিচ্ছেন লাশেদের মধ্যে থেকে ভোট পাওয়ার আশায়। তবে এটি আসলে গল্পের একটি খণ্ডাংশ। গল্পের অন্য অংশটি হলো, অনুভূতিহীন, শূন্য দৃষ্টিসম্পন্ন এবং নিরানন্দ হাসিসমেত একজন ব্যক্তি অতীতের বহু অত্যাচারী শাসকের মতো অন্যদের মধ্যে প্রগাঢ় অনুভূতির সঞ্চার করতে সক্ষম। তার ব্যাধিটিও সংক্রামক। এটিই তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে ফেলে। তার সবচেয়ে বৃহৎ ভোটভাণ্ডার উত্তর ভারত, যেখানকার বিপুল জনসংখ্যা ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়, সেখানে তিনি যে যন্ত্রণা আরোপ করেন তাই দৃশ্যত অদ্ভুত এক আনন্দে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
ফ্রেডরিক ডগলাস যথার্থই বলেছেন: “অত্যাচারী শাসকের মেয়াদকাল নির্ভর করে অত্যাচারিতের সহ্যসীমার উপর।” ভারতে আমরা নিজেদের সহ্যক্ষমতা নিয়ে কতই না গর্ব করি। কত দারুণভাবেই না আমরা নিজেদেরকে ধ্যান ও অন্তর্মুখী যাত্রার প্রশিক্ষণ দিয়েছি, আমাদের ক্রোধকে ঝাড়-ফুঁক দিয়ে নামিয়ে এসেছি এবং সমমাত্রিক একটি সমাজ তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের অক্ষমতাকে জায়েজীকরণ করেছি। কত বিনম্রচিত্তেই না আমরা আমাদের অপমানকে আলিঙ্গন করেছি।
২০০১ সালে গুজরাটের নতুন মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন মোদীর রাজনৈতিক অভিষেক হলো, তখন থেকে ২০০২ সালে সংঘটিত গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মোদী তার ও তার বংশধরদের স্থান পাকাপোক্ত করেছিল। যাত্রীবাহী এক ট্রেনে আগুন দিয়ে ৫০ জন হিন্দু তীর্থযাত্রীকে হত্যা করার ”প্রতিশোধ” হিসেবে সদা জাগ্রত হিন্দু দাঙ্গাবাজেরা পুলিশ প্রহরায় এবং মাঝে মাঝে সক্রিয় সহযোগিতায় কয়েক হাজার মুসলিমকে হত্যা ও ধর্ষণ করে এবং জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে। সহিংসতা কমে আসার পর দলের পক্ষ থেকে সদ্যনিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রী মোদী একটি অগ্রীম নির্বাচনের ডাক দেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তাকে হিন্দু হৃদয় সম্রাট বলে চিত্রিত করা হয়, যা তাকে এক ভূমিধস বিজয় উপহার দেয়। তারপর থেকে মোদী কোনও নির্বাচনে হারেন নি।
সাংবাদিক আশিষ খেতান গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় কয়েকজন খুনীকে কিভাবে তারা মানুষকে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করেছিল, গর্ভবতী মহিলাদের পাকস্থলী কেটে বের করেছিল এবং শিশুদের মাথা পাথর দিয়ে বাড়ি দিয়ে টুকরা টুকরা করে ফেলেছিল, গর্বসহকারে তার বর্ণনা দেওয়া অবস্থায় পরবর্তীকালে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। তারা বলেছিল, তারা যা করেছে, তা করতে পেরেছিল শুধুমাত্র মোদী তাদের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন বলেই। সেই ধারণকৃত ভিডিওগুলো জাতীয় টেলিভিশনে প্রচার করা হয়েছিল। মোদী ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই আশিষ খেতানের ধারণকৃত ভিডিওগুলো আদালতের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল এবং আদালত সেগুলো পরীক্ষা করে দেখেছিল। তিনি নিজেও কয়েকবার চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে ঘাতকদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়েছিল। তবে অনেককেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তার সম্প্রতি প্রকাশিত বই আন্ডারকাভার: মাই জার্নি ইনটু দ্য ডার্কনেস অব হিন্দুতভা তে মোদীর মূখ্যমন্ত্রীর মেয়াদে গুজরাট পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী, কৌঁসুলি এবং অনুসন্ধানী কমিটিগুলোর একক যোগসাজশে প্রমাণাদির উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ, সাক্ষীদেরকে ভীতিপ্রদর্শন এবং বিচারকদেরকে বদলি করা হয়েছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
সবকিছু জানার পরেও ভারতের তথাকথিত গণবুদ্ধিজীবীদের অনেকে, বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর সিইও এবং তারা যেসব গণমাধ্যম কারখানাগুলোর মালিক সেগুলোসহ সবাই মিলে মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রাস্তা খুলে দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছিল। আমাদের মধ্যে যারা প্রতিনিয়ত সমালোচনায় স্থির ছিল, তাদেরকে তারা অপমান ও গলাবাজি করে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাদের মন্ত্র ছিল ‘এগিয়ে চলা’। আজও তারা মোদীর প্রতি তাদের কর্কশ বাক্যগুলোকে লুকিয়ে রেখে তার বাগ্মীতা ও যাবতীয় ‘কঠোর পরিশ্রমের’ গুণগান গায়। বিরোধী দলগুলোর প্রতি তাদের নিন্দাবাদ, তর্জন-গর্জন ও মৌখিক হেনস্তা অনেক বেশি প্রবল। তারা তাদের সবচেয়ে তীব্র গালাগাল বাঁচিয়ে রাখে রাহুল গান্ধীর জন্যে, একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি কিনা প্রতিনিয়ত আসন্ন করোনা সংকটের ব্যাপারে সতর্কবাতা দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং বার বার করে সরকারকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বলে আসছিলেন। তাদের প্রচারণার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলকে বিরোধী দলসমূহ ধ্বংস করার কাজে সাহায্য করার অর্থ হলো তাদের সাথে অশুভ গোপন আঁতাতে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে নামা।
অতঃপর আমরা এসে দাঁড়িয়েছি তাদের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত জাহান্নামে। কার্যকরী গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য প্রত্যেকটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত ও শূন্যগর্ভ করে ফেলা হয়েছে। সাথে আছে লাগামছাড়া এক ভাইরাসের তাণ্ডব।
এই সংকট-উৎপাদী যন্ত্র যাকে আমরা সরকার নামে ডাকি, এটি আমাদের এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করতে অক্ষম। তার কারণ হিসেবে এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, এই সরকারের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি এবং সে ব্যক্তিটি বিপজ্জনক এবং খুব বেশি মেধাবীও নন তিনি। এই ভাইরাসটি একটি আন্তজার্তিক সমস্যা তৈরি করেছে। একে মোকাবিলা করার স্বার্থে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলীয় কিছু সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও জননীতি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নির্দলীয় কাঠামো তৈরি করার প্রয়োজন হবে।
মোদীর ক্ষেত্রে বলা যায়, আপনার সকল অপরাধ থেকে পদত্যাগের জন্য কি কোনো সম্ভাব্য বিবৃতি আসতে পারে? তিনি সম্ভবত তার যাবতীয় কঠোর পরিশ্রম থেকে একটি বিরতি নিতে পারেন। তার মতো ভিভিআইপি যাত্রীর জন্য ৫৬.৪ কোটি মার্কিন ডলারে কেনা এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ানের বোয়িং ৭৭৭ বিমান রানওয়েতে অলস বসে আছে। তিনি ও তার লোকজন স্রেফ চলে যেতে পারেন। বাকি সবাই মিলে আমরা নিজেদের সাধ্যমতো তাদের বিশৃঙ্খলা সামাল দেওয়ার জন্য যা করতে পারি করব।
Photo credit: Anupam Nath/AP, from The Guardian