আমাদের এইসব দিনরাত্রি

Share this:

সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ এখন যে দুঃস্বপ্নটি দেখছে সেটা এই করোনা ভাইরাসকে নিয়ে। পৃথিবীতে এর আগেও ঝড়, তুফান, সুনামি অনেক কিছুই এসেছে। কিছু মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে, স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়ে, সে তার দম্ভ প্রকাশ করে আবার চলেও গিয়েছে। কিন্তু সারা বিশ্বকে একসাথে আতংকিত করে দিনের পর দিন এমন অট্টহাসি দিতে পারেনি। সাড়ে ছয়শ কোটি মানুষকে অসহায় প্রতিপক্ষ বানাতে পারেনি।

যত যুদ্ধই এসেছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আমরা এক হয়ে লড়ার শক্তি সঞ্চয় করেছি। কিন্তু এ এমন এক যুদ্ধ, যার সাথে লড়াই করার শর্তই হলো সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী লড়া। এমন যুদ্ধ আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি কেউ। দৃশ্যমান শত্রুর সাথে লড়াই করা যায়, অদৃশ্য শত্রুর সাথে কী করে?

বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, নৃতাত্ত্বিক, সাংবাদিক বন্ধু, বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এখন পর্যন্ত আমাদের যে তথ্য সরবরাহ করে যাচ্ছে তা আশার তো নয়ই বরং  আশংকার। শ, হাজারের ঘর পার করে করোনা আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা লাখ পেরিয়ে গেছে। কোথায় গিয়ে থামবে, কেউ জানে না।

জন্মাবধি দেখে, ঠেকে, শিখে একটা জিনিষ বুঝেছি, বাংলাদেশের মানুষ তিন ‘ভ’ অন্তরে পুষে বাস করে। ‘ভাবাবেগ’, ‘ভাসা ভাসা জ্ঞান’ আর ‘ভাগ্যের উপর বিশ্বাস’। এই জাতিকে মাথায় হাত বুলিয়ে, ভয় দেখিয়ে ঘরে ঢুকাতে, যে সময় লেগেছে ততদিনে ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত ছিল উচ্চ পদস্থ নেতৃস্থানীয়দের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত। এটুকু নাহলে আজ আমাদের এভাবে গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হত কিনা, সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন।

আমরা চীনের ঘটনা জানতাম। কিন্তু শিক্ষা নেই নি। আমরা আমাদের বিমান বন্দরে করোনা মোকাবেলার ব্যবস্থা করিনি। নিজেরা হয়েছি গৃহবন্দী। এখন আর কোনও উপায়ও নেই এই অদৃশ্য মহাশক্তিধর শত্রুর হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার। টিভির পর্দায় আমরা এখন প্রতিদিন গুনি মৃতের সংখ্যা।

লক ডাউন সময়ে নারী নির্যাতন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী কোনো না কোনো সময় নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। এই সংখ্যা এখন দ্রুত বাড়ছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, লকডাউনের প্রথম সপ্তাহেই ভারতে নারী নির্যাতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, তুরস্কে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেয়ার পর থেকে নারী হত্যার হার বেড়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে অন্তত ৯০ হাজার লিঙ্গভিত্তিক  সহিংসতার অভিযোগ এসেছে। অস্ট্রেলীয় সরকারের কাছে অনলাইনে সাহায্য প্রার্থনার হার বেড়েছে ৭৫ শতাংশ, এক সপ্তাহে ফ্রান্সে ঘরোয়া নির্যাতন বেড়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ।

এবার আসা যাক অর্থনীতিতে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, একটি বড় রকমের বিপর্যয় বৈশ্বিক জিডিপি ৫ শতাংশ পর্যন্ত (বর্তমান হিসেবে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) কমিয়ে দিতে পারে। ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশ হবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু  করোনাভাইরাসের বিপর্যয়ের পর তা ২.৫ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।

রাজনৈতিকভাবে করোনা তো আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে। সারা পৃথিবীর সন্দেহের দৃষ্টি চীনের দিকে। সেটা মূলক নাকি অমূলক তা সময়ই কথা বলবে। বেজিংয়ের ওপর অভিযোগ, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে উহানে যে অব্যক্ত নিউমোনিয়া রোগের উৎপত্তি হয়েছিল যা পরে মহামারি কোভিড-১৯-এ পরিণত হয়, সেই ঘটনা লুকিয়ে গিয়েছিল দেশটি। সারা পৃথিবীতে করোনা যখন মহামারী রূপে তখন চীন যেভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেরা তা থেকে মুক্ত হল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র। কিন্তু চীন করোনা প্রসঙ্গে কিছুই বলতে নারাজ।
বিশ্বের অধিপতি হবার সুপ্ত বাসনা চরিতার্থের দাবার কোর্টে কে যে কখন শিকার আর কে যে শিকারী তার কতটুকুই বা আমরা জানি?

আমরা শুধু বিশ্বাস করতে চাই,

একদিন সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে।
একদিন আমরা আর টিভি খুলে আতংকিত চোখে লাশের হিসাব গুনব না।
একদিন অফিস, বাজার কিংবা নামাজের জন্য বাসা থেকে বের হতে চাইলে কেউ চোখের জলে হাত টেনে ধরবে না।
একদিন আমরা লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, ভ্যান্টিলেশন নামের দুঃস্বপ্নমাখা শব্দগুলোকে ভুলে রাজপথে নামব।
একদিন আমরা এই বীভৎস দিনগুলো খুব করে ভুলতে চেষ্টা করব।
একদিন আবার আমরা ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে টং দোকানের আড্ডায় বসব।
একদিন আমরা এক অন্য সকাল দেখব।
সেদিন আমরা সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরব চোখের জলের বন্যা বইয়ে দিয়ে।

 

Sattyajit Biswas worked as an Administrative Assistant at UPHCSDP, Dhaka South City Corporation. As a journalist he is also involved in print media and has fourteen published books. He is living in Dhaka, Bangladesh.

More Posts From this Author:

    None Found

Share this:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!