প্রশ্নোত্তর:
শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বা বোধের ব্যাপারটা প্রথম কীভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: এটা বলা একটু কঠিন, কারণ ব্যাপারটা ঘটেছিল প্রায় শৈশবে। আর সেটা ঠিক কবিতা লেখার তাড়না ছিল না। ছেলেবেলা, সকল লোকের মাঝে ব’সে তবু এক দুর্ভেদ্য নির্জনতা কচ্ছপ-খোলের মতো আমাকে ঘিরে ছিল। ঘরের-বাইরের বাস্তবটা ছিল একেবারে তেমন, যাতে দম বন্ধ হ’য়ে ম’রে যাওয়া চলে। ফলে, নিজের জন্যে একটা হিরার বুদ্বুদ তৈরি ক’রে নিতে হয়েইছিল আমাকে, যার ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম নানা বইয়ের মানুষদেরকে… কিন্তু লেখা-তো আর অমনভাবে হবার নয়। সেই বয়সে। তবু, কলম ধরবার অভ্যাসটা, পড়াশোনার বাইরেও-যে একেবারেই নিজের জন্যে, নিজের মতো ক’রে, কিছু লেখা, তারই বাবদে কৃতজ্ঞতা আমার সেই বয়সের প্রতি। আর ছিল প্রকৃতি। বাচ্চার চোখে সবই-তো সুন্দর, তবু, মনে হয় যেন পৃথিবীটা সুন্দরতর ছিল তখন। এই ঢাকাতেই, বাসার আশেপাশে ঢোলকলমির জঙ্গল, বিশাল জলা, উঁচু-উঁচু ঘাস, বাওয়ার মতো কত নিম, কৃষ্ণচূড়া, গইনারি, জিকা-গাছ; সজনেরা ঝুলে আছে মুখের উপরে, বুকের উপরে… জমজম-কুয়া, ফুটবল-উঠান, স্কুল পালিয়ে হেঁটে-বেড়াবার মতো নিরবচ্ছিন্ন বাংলা… এইসব ছিল সেই জগতে একদিন।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষাশৈলীর বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিতভাবে শুনতে আগ্রহী।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: আমি একবার রাজশাহি পালিয়ে গেলাম। তখনও ঢা.বি.-র নামকাওয়াস্তা তালেব। সেখানে এক অদ্ভুত বাড়িতে বন্ধু টিকলু (প্রবালকুমার দাস) থাকত। ওর বড়ভাই ছিলেন রাজশাহি আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ। ঐ বাড়িটাতে তিনি এবং তার কলিগ, শিল্পী আমানউল্লাহ-সহ আরও কেউ-কেউ মেসের মতো ক’রে থাকতেন। আমান ভাইয়ের ছোট ভাই সালামও ছিল (এই সেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় চ’লে গেছে সে)। তো, আমান ভাই, প্রথম সাক্ষাতে শুধালেন আমার রাজনীতি কী। বললাম আমি রাজনীতি বুঝি না এবং তার ধারও ধারি না। উনি আমাকে বললেন, এটাও রাজনীতি। কোনোকিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হ’ল। যেন।
সেই থেকে জানি, যে, আমি যা-যা-ই করি বা করি না, সবই রাজনীতি। তো, দেখুন, এই এক পুঁজির পুঁজে মাখামাখি দুনিয়ায়, এই টেকনো-প্রপঞ্চে, কেউ মরিয়া হ’য়ে টিঁকে থাকতে-থাকতে, দাঁত চেপে কবিতা লিখছে, এ-কথা নিশ্চিত জেনে, যে, কেউ পড়বে না, কখনও না, একে কীভাবে ব্যাখ্যা করা চলে? এও-কি একপ্রকার প্রলেতারিয় রেজিস্ট্যান্স নয়?
আমাদের জগৎটা দাঁড়িয়ে গেছে এক প্রতিযোগ, প্রতিহিংসার লেসে-ফেয়ারে। সবাই শত্রু সবার। এমনকি কবিতা যারা লেখে, বা মোড়ের টঙে চা ব্যাচে, তারাও প্রতিযোগ, প্রতিহিংসার শিকারি আর শিকার। আমাদের সবটুকুই গুগুল আর মিডিয়া আমাদের মগজে ঢেলে দেয়, ঢালাই ক’রে চলে আমাদেরকে, নিরন্তর। এমন সময়ে, মিডিয়া বা প্রকাশনার তোয়াক্কাটুকুও না-ক’রে, লেখালিখি করার অর্থ কী হয়? এ-ই রাজনীতি আমার। বিশ্বরাজনীতির বিপরীতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, যাবজ্জীবেৎ।
শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: মানুষেরই শ্লীল-অশ্লীলতায় বিশ্বাস নাই আমার, তো কবিতার! আমি কল্পনা করি তেমন দুনিয়ার, যেথা আবহাওয়াগত কারণে-ছাড়া কাপড়চোপড় অব্দি পড়তে বাধ্য হবে না কেউ, না-ঘরে না-বাইরে।
কবিতা-তো বলা বাহুল্য। প্রতিটা কবিতা একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র বটে। তার আইন-কানুন তারই দ্বারা নির্ধারিত। কোনো অন্য মানুষ বা সমাজ বা রাষ্ট্রের নয়। কবিতায় অশ্লীলতার কথা যারা তোলে, তাদের মনশ্চিকিৎসা জরুরি। কবিতায় অসংসৃষ্টি বা অকবিতা হয়তো থাকতে কখনও পারে, যা নিয়ে ইতংবিতং করাও একটু যায়, কিন্তু কবিতা শ্লীল কি অশ্লীল, ভদ্র না অভদ্র, এসব আলোচনাকে অন্ধকারচনাই বলতে হয়।
শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আাপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে-কোনো সময় ধরে হতে পারে,আপনার যেমন ইচ্ছে।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: এতক্ষণ কবিতা নিয়ে বড়-বড় কথা বললেও, গোপন কথাটা এই, যে, আমি কবিতা পড়ি না। না-পূর্ব না-পশ্চিম। কম-বয়সে যা পড়া হ’য়ে গেছিল, সেটুকুই পুঁজি আমার। আমাদের তারুণ্যে, পুব-পশ্চিমে খানিক মিল লক্ষ করা যেত। মানে ধরুন সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর শামসুর রাহমানের কবিতায় ঘরানাগত ফারাক তেমন ছিল না। ভাষাতেও না। তফাতটুকু হয়তো এই ছিল, যে, সুভাষ যে-ভাষায় লিখতেন, পাড়ার দোস্তদের সাথে হয়তো কাছাকাছি ভাষাতেই বলতেনও। শামসুর তা করতেন না। তাঁর লেখার আর বলার ভাষা ছিল আলাদা। আমাদের সময়েও যে এটা খুব বদলে গেছিল তা নয়। তবে কেউ-কেউ এই দ্বিরাচারকে খুব সহজভাবে নেয় নি। আমি নিজে তাদের একজন। ব্রাত্য রাইসুও। তার পরে দেখতে পাই, যে, ডাইকটমিটা আজও বহাল যদিও আছে, গরিষ্ঠাংশেই, তবু আজকের বাংলাদেশের তরুণ কবিরা, অন্ততঃ ভাষাগত স্বাধীনতাটা ভোগ করতে ভালোই শুরু ক’রে দিয়েছে। এটাকে প্রথম অবস্থায় দুর্ভোগ লাগলেও, কালে এটা সোনার ফসল ফলাতে পারে ব’লেই ধারণা করি। আর, আজ আমেরিকান ইংরেজি যেমন ব্রিটিশ ইংরেজিকে প্রভাবিত করছে, তেমনই, বাংলাদেশের বাংলার আছরও পশ্চিম বাংলায় পড়বে ব’লেই মনে হয়। দুইএকক্ষেত্রে প’ড়ে গেছেই ইতোমধ্যে। আমরা সারা-বাংলার ভাষিক অভিব্যক্তি দেখতে আগ্রহী। একাডেমিয়ার শাসন অনেক হয়েছে। ফল ফলেছে অনেক মাকাল।
তবে, কেবলই ভাষাগত বাস্তবতা দিয়ে পুব-পশ্চিমকে বিচার করলে চলবে না। রাজনৈতিক, সামাজিক, এমনকি ধর্মীয় বাস্তবতাকেও আমল করতে হবে। ঢাকার সাথে কলকাতার সার্বিক অবস্থায় কিছু মিল আর আরও বেশকিছু অমিল আছে; স্বাভাবিক কারণেই।
যেমন: পশ্চিম বাংলা (বা অধুনাতন বাংলা) একটা সার্বভৌম দেশ নয়, বৃহত্তর ভারতের একটা প্রদেশ, যা সে প্রায় চিরকালই ছিল। বাংলাদেশ, অন্যদিকে একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র – কিন্তু সে চিরকাল তা ছিল না। ফলে তার মধ্যে একটা নাড়ি-ছেঁড়ার ব্যথা থেকেই গেছে একদিকে, আবার নাড়ি ছেঁড়ার দায়ও মুখ্যতঃ তারই ব’লে, অভিযোগের রাস্তাটাও খোলা নাই তার। কালিদাসের সম্বন্ধে কথিত, গাছের গুঁড়ির দিক্কার ডাল কাটবার দশা বাংলাদেশের। আবার এর অন্যথা ভাববারও কোনো অবকাশ নাই, ভারত “হিন্দুর” দেশ যেহেতু।
যা হোক, বাংলাদেশের, স্বাধীন হবার কারণে যে-বাড়তি জেল্লাটা আসবার কথা ছিল কবিতায়, সাহিত্যে, তা আসে নাই। নানাবিধ দাসত্বে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আছি। ভাষা-দাসত্ব তো বটেই, ধর্ম-রাজনীতি দাসত্ব আরও বেশি। ওখানে নানা আগ্রাসন দিল্লি থেকে আসে ব’লে, তাদেরকে শনাক্ত করা এবং তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সহজ হয়। এখানে আসে নিজের ঘরের থেকে। আঘাত-প্রত্যাঘাত উভয়ই আত্মরক্তক্ষয়ী এবং লজ্জাকর। পশ্চিম বাংলাকে হিন্দির সঙ্গে অসম যুদ্ধ করতে হচ্ছে, কিন্তু সে একটা যুদ্ধই শেষতক, প্রহসন নয়। বাংলাদেশে, যে-মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আমরা বানাল, তা-ই চেপে বসেছে আমাদের কণ্ঠনালিতে, আর তার ফায়দা লুটছে সরাসরি স্বাধীনতা-বিরোধী ইসলামি মৌলবাদ। এর চেয়ে কোনো দুঃখজনক রাষ্ট্র কেবল কল্পনাই করা চলে। কে কী বলবে না-ভাবলে, ব’লেই ফেলা সম্ভব, যে, পাকিস্তান আমলেও, বাঙালিকে এমন ধূলিঝড়ে শ্বাস টানতে হয়-নি। অভিমুখ অন্ততঃ ছিল একটা।
এই রাজনীতি তথা প্রহেলিকাকে চিনতে পারলে ভালো অনেককিছুই (সাহিত্য-সমেত) হ’তে পারত বাংলাদেশে, কিন্তু তার সুযোগও আর খোলা রাখা হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধ-চেতনা আর কওমি-চেতনার শাঁখের করাতে শেষ রেশটুকু যা বাঙালিয়ানার, উবে গেছেই বলা যায়। কাজেই আমাদের কাছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলির পাওয়ার কিছুই নাই আর। পশ্চিম বাংলার অবস্থা অনেক ভালো তার চেয়ে, তবে হিন্দির সাথে যুদ্ধে সে জিততে না-পারলে, তারও ভবিষ্যৎ ঝরঝরা।
শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আমি পাঠ করিই না আর কিছু। পারি না করতে। সময় নাই। সুযোগ…। কবে মনে নাই, শেষ যে-বইটা প’ড়ে ভালো লেগেছিল, তা সাদা বিড়ালেরা । লেখিকার প্রথম উপন্যাস। এমনিতে গল্প লিখতেন। দুইএকটা গল্প-ছাড়া, এই উপন্যাসের ধরনটা তাঁর নিজের লেখাতে প্রকট ছিল না আগে। সে-হিসাবে, এখানে তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছিলেন। জাদুবাস্তবতার মোহ-ব্যতিরেকেই, বা তার জন্য কোনো আলগা প্রয়াস ব্যতিরেকেই কোনো লেখা কেমন ক’রে তার এপিটোমি হ’য়ে দাঁড়াতে পারে, এ-উপন্যাস পড়লে সহৃদয় পাঠকমাত্রই সরেজমিন দেখতে পাবেন। আর প্রকৃতির সঙ্গীত বাজানো, পাতায়-পাতায়… কখনও সে-সঙ্গীত বাজে ব্যাকগ্রাউন্ডে, কখনও গল্পকে ছাপিয়ে ফোরগ্রাউন্ডে চ’লে আসে। তেমনই, খেলে চ’লে সময়ের নানা স্তর, গল্পের সাথে। বয়ানের বিনুনিটা তবু এতটা শক্তত যে, কখনোই পুঁতিগুলি খুলে পড়ে ছড়িয়ে যায় না। এবার লেখিকার দ্বিতীয় উপন্যাস বেরিয়েছে ব’লে জেনেছি। সাফল্য কামনা করি সেটারও। এই-তো। ও হ্যাঁ, ইচক দুয়েন্দে (শামসুল কবির) “চি-বেদ” নামে একটা অদ্ভুত লেখা লিখেছেন ক’বছর আগে। হাতে-লেখা বইটা আমায় দিয়ে গেছিলেন সিডনিতে বেড়াতে এসে। তবে ওটা নিয়ে আমি কিছু বলব না। কোনো প্রচলিত সমালোচনার ঊর্ধ্বে সে-লেখা। নিজে পারলে প’ড়ে দেখবেন। পাবেন কিনা কে জানে। যদি…।
কবিতা:
বায়ুসূক্ত
হাওয়া, তুমি আমার বুকে লাগো,
হাওয়া, স্তনস্পর্শফেনিল সাগর,
এ-জংধরা চেরাগে দাও ঘষা,
এখন আমার এখন-তখন দশা।
আমিই যদি নাই আমাদের মাঝে
স্বর্গে-মর্ত্যে তোমরারা সঙ সাজে?
হায় রে ভূমি! তুমিও তুমি হ’লে
আমি কোথায়? আমারই ব্ল্যাকহোলে?
হাওয়া, আমি পথ-হারানো নদী।
হাওয়া, আমার মানা-র কানাত যদি
হঠাৎ ঘোচে আলগোছে এক-সেকেন্ড
আমার থেকে আমায় বাঁচাবে কে?
আমরা হ’ব, ফের যদি যাই ফিরে?
জলের তলার বেবাক জমিজিরেত
ভোরের মতো অবাক্ যদি জাগে?
তার মুখটা— তার মুখটাই, যাকে—
হাওয়া, এ কোন্ লুপ্ত যুক্তপ্রদেশ?
ধোঁয়া উঠছে নিবে-যাওয়া রোদের,
সারি-কে-সারি ডোরিক কলাম, ভাঙা—
সূর্য-জন্ম— জবাকুসুম-রাঙা।
হায়, যেদিকেই ঘুরছ তুমি, আমার
বাস-টা থামছে, ঘণ্টা বাজছে নামার,
ঘুমিয়ে গিয়েও পারছ কই এড়াতে
অনেক জলের ভিতর অনেক রাতে?
হাওয়া, তোমার যোনিগন্ধে যা বুঁদ
রাংতা-মোড়া যত-না তার সাবুদ
বোরকা খুলে যুগল পূর্ণমাসী
খ্যামটা নাচে, বেগম বাজার, মাসি।
হাওয়া, আমার হাউই ফিরে আসে
নির্বাপিত তটস্থ আকাশের
তইলা তলায়; কে তার বিভাটুকু
টিপে মারল— পট্— মনসার উকুন?
ডালপট্টির মোড়ে রাতুল ঘোড়া,
ফেনসিডিলের বোতল, বাঁকা-ছোরা,
বাঁকা-হাওয়া, ভুতুড়ে মেজবানি—
বাঁকা, আমি বাঁকারে না-জানি।
চিৎপ্রকোষ্ঠে কোষ্ঠকাঠিন্য রে!
গর্ভে আমার ফসিল-শিশু নড়ে,
চ’ক্ষে আমার মরীচিকা, সেও
হরপ্পা-গর্ভিণীর মাটির জেয়র।
হাওয়া, তুমি আমার বুকে থাকো
ফেনসিডিলে চুবিয়ে-রাখা চাকুর
যুগল বাঁকা-চাঁদের মতন চোখা—
অঙ্গে জ্বলে অঙ্গারের ওঁকার।
বেলা দ্বিপ্রহর, ধুধু বালুচর
এই রক্ত-মুহূর্তের তীব্র সূচনায়
সবেমাত্র যে-শিশুটি ম’রে গেল ইথিয়োপিয়ায়
মার্কিন প্রেজিডেন্টের পুণ্যনাম শোনার আগেই—
মাইক্রোসফ্ট বা ইন্টেল কিংবা পেন্টাগন
করুক-না কায়েম যতখুশি এনক্রিপশন— তবু এই
পৃথিবীটা বদলে গেছে আদ্যোপান্ত, আপাদমস্তক,
সময়েরও ঘ’টে গেছে মৃত্যু আর পুনরুজ্জীবন,
সম্পূর্ণ নূতন এক পৃথিবীতে, লিখি আমরা বালির পুস্তক।
অমৃত কোথায়?
ঈশ্বরের মৃত্যু হ’লে তবু-কি অমৃত র’য়ে যায়
জন্মের-মৃত্যুর সাঁকো? জন্মের-মৃত্যুর দরোজায়
পাহারা-কি তারই? সে-কি দ্বিতীয় ঈশ্বর?
যে-ঈশ্বর ম’রে যায়, মরতে বাধ্য, যে-মুহূর্তে তার
ঊনতম সৃষ্টিটিও নষ্ট হয়— হ’তে বাধ্য। অমৃত-কি তা-ই
যাকে কেউ বলে সেই খোলা বৃত্ত, যার
পরিধি কোথাও নেই, কেন্দ্র সর্বথাই?
অগণিত (গণিত যদিও অবান্তর)
ভাল্ভে-ভরা দেহ (দেহ অ্যানালজি, দেহহীনতাই
চিহ্ন তার, নাকি রূপ? না অরূপ? — গূঢ় এক প্রতিভাবিতান),
শূন্যের নাড়ির তাল জন্ম কিংবা মৃত্যু -রূপে দোলে নিরন্তর
সোন্নয়নশীল প্রসেসরে।
শূন্য তাহলে কী? তার বিহিত কে করে?
ঈশ্বরের কে ঈশ্বর? কে তার ঈশ্বর?
যে আমার পিতা, সে-ই আমার সন্তান?
এইমতো নানা মনোভাব
দুপুরের ভস্মে কত ঘি ঢেলে বোজায়—
যে-ই তাকে খুলতে যায়, উল্টে যায় সে-ই!
ভূগর্ভস্থ রোদ্দুরের সাইজমিক তরঙ্গে বোঝা যায়:
এই এখনই যে-শিশুটি মারা গেল নেভারল্যান্ড বা হার্জিগোভিনায়
অপার সাইবার স্পেসে বাঁ-পা তার ফেলার আগেই,
সে-ই তার সাথে নিয়ে চ’লে গেল যাবতীয় সওয়াল, জওয়াব।
ওরে মন
তুমিই-তো খুঁড়েছ গড়খাই
তোমার থাকা-র চারিপাশে—
যেন মৃত্যু— বাইরে থেকে আসে,
যেন তা জানে না ব্যূহভেদ,
যেন তারও নাই রে ধনুর্বেদ,
যেন তারও পূর্বাপর নাই,
যেন সে-ই খাইবারের খাদে
প’ড়ে আছে দুঃস্থ-দুঃসংবাদে
ঢেকে রেখে এমনি-কোনো ক্ষত
যাকে তার মুষ্টিমেয় ঢাল,
বর্মচর্ম, সমুৎকর্ষ যত,
লোকচক্ষুর্লজ্জার আড়াল,
ইত্যাকার থেকে বাঁচিয়েও
প্রায় কোনো অজুহাত-বিনা,
রেখেছে চোখের নীচে হেয়,
দেহের মুখোশে-ঢাকা ঘৃণা,
কামের বয়াম-ভরা ভয়—
কোথায় তোমার বরাভয়?
ও.টি.
শুধু কাঁচি-চালনায় যা-কিছু আমোদ ছিল তোর!
কত গৌড়-রমণীর গরদের পাড়
বিবর্তিত হয়েছিল কত নদীতীরে
মরো-র দ্বীপের মতো টেবিলের পিঠে, আজি আর
কাঁচিটায় নাহি তত ধার…
হহ্বা-র খেচর পা-দু’টিকে
কেটে তুই দিয়েছিলি মাছের লেজুর জুড়ে, ঝানু শল্যবিৎ!
সেও পরে স’রে গেল ভূগর্ভস্থ সমুদ্রের দিকে…
আমি শেষে টেবিলে এলাম।
চলল না আমার কল্বে আলো-কাঁচি তোর;
ম’রে গেল চোখে তোর জল্লাদ-উল্লাস,
নিবে গেল ইডেনের ভোর—
আকাশের চোখ থেকে খ’শে পড়ল ফোঁটা-দুই নুন,
আমার সেটুকু খালি সমুদ্রের স্বাদ…
শুধু কাঁচি-চালানোয় যা-কিছু প্রমোদ ছিল তোর,
ধুয়ে নিল, ইডেনের প্রথম প্রমাদ।
চাঁদমারি
হায়, আমি কেন আমাকে চিনি না, চাঁদ, তুমি যত চেনো?
তবে-কি আমাকে পড়তেই হবে ফের ক্রিতো ফিদো মেনো?
কেন আমি কোনো খানা, কোনো ফাঁদ দেখি না রে স্বপ্নেও
আমার নবির পথে-পথে যারা খুঁড়েছে খুরের ক্ষত—
হর-হরকতে পড়তে-পড়তে দেখি সে-গর্তে কেহ
পুতে গেছে লাল-পতাকা আগেই, তোমার দস্তখতও
ঝিলিক মারছে হান্টার; তবু উদ্বাহুরিব বামন
তোমারই হাতটি না-ধ’রে কী ক’রে তোমার ধরবে হাত?
তোমার বাসরশয্যা-অব্দি কয় শ্মশানের ঘাট?
ক’বার মরলে, ও চাঁদ, জায়েজ হবে অগম্যাগমন?
আর হাঁটবই না আমি; চাইলে তুমি নেমে এসো নিজে
ভাঙা মাস্তুলে, আমি পেরেশান এই ডুবো-পিরেনিজে।
লাল শুক্কুর — নীল শনি
ডিমের ভিতর ডিম আবার ডিমের ভিতর ডিম
সূর্য মাথায় স্থির আমার সমুদ্র নিঃসীম
ডাকছে আমায় ফেউ আমার রক্তে উথাল ঢেউ
তুমি-কি তুমিই নাকি তোমার মতন কেউ
তুমি-তো অন্ধ আমার মস্তকলন্দর
মিথ্যা-কি এই শাড়িসায়ায় দুধেলা গন্ধ
রমণীর বনফায়ারে আমি সাতজোড়া শরীর
খাঁড়া-চাঁদ নামছে নীচে গলাতেই সরাসরি
তার আগে গ্রাবু-গ্রাবু খাব ছয়-দু’গুণ বারো
কলিজার বটিকাবাব শনিবার শুক্রবারও
যদি আজ কালকে আবার যদি কাল আজকে ফেরে
আজকের বাসি-খাবার ভুলে কাল গিলিস নে রে
গুড ফ্রাইডে, ২০১২
লাল হ’য়ে গেছে একটা তারা,
উজানে ফিরেছে বসুধারা,
তোমার আড্ডায় আজকে নাই
কালকেও হাজির ছিল যারা।
তুমি অবিমৃশ্যকারিতায়
নাক গলিয়েছিলে চিতায়,
সতী কই! কে কারে বাঁচাবে!
শূন্যস্থান পুরালে-কি তাই?
আজকে যিশু ক্রুশে চড়েছিল?।
ঈশ্বর আজকেই মরেছিল?।
দ্বিতীয় জগৎও তার ঢাকা
খুলে দিয়ে চুপটি ক’রে ছিল?।
আজিকে সেথায় কে পশিবে?
কালকে কার পুনশ্চ-প্রসবে
ফুটে উঠবে নক্ষত্রের ফুল?
তুমি একা পড়েছ হিসাবে।
ত্বমসি মম ভূষণম্
আমরা আজকে কবিতা লিখব, আজ আমাদের ছুটি,
আজকে আমরা করব না কিচ্ছুটি,
খুবলে খুলব, রৌদ্রে শুকাব পেশার শল্কবল্কল,
পানির অপর নাম ব’য়ে যায় পানির লাহান কলকল।
আজকে আমরা আবার একুশ উনিশশ’-ছিয়াশিতে।
ঘুমিয়ে কাটাল সার্বভৌম শীতে
ফর্মালিনের বয়ামে জারানো অঙ্কুর,
আজ দৃষ্টির ভঙ্গুর কাচে পাড়া দিয়ে গেছে কোন্ খুর!
সুরতাপসী, তোমাতে পশি’ ফুটি অতসী তোমার বুকে।
আঘাত-বিহনে নাদ জাগে না,
কলঙ্ক-বিনা চাঁদ।
তোমার শিরিশ-কাগজ জিবে,
বজ্রশলাকা-সুচালো নিবে
আমারে করো আবাদ।
আমাকে নাও, ঘুম জাগাও, আমাকে গাও চতুর্মুখে।
আমাকে উপড়ে ফেলছে কার
কালো-কোদালের বুভুক্ষা?
আগামী-জন্মে আবিষ্কার
গত-জন্মের আশঙ্কা।
আমাকে নাও, ঘুম জাগাও, আমাকে গাও চতুর্মুখে।
এই নিকোটিন-কালো কল্বে
একবার ফের আলো জ্বলবে
পটদীপকীর তানে,
কয়লা-খনিতে হিরা ফলবে
তোমার অধিষ্ঠানে।
আমাকে নাও, ঘুম জাগাও, আমাকে গাও চতুর্মুখে।
আজিকে উধাও সব প্রবলেম,
আজিকে লোপাট দেহ,
নৈহর ভেঙে আমি চললেম
পাহুন পিয়ার গেহ।
আমাকে নাও, ঘুম জাগাও, আমাকে গাও চতুর্মুখে।
ত্বমসি মম ভূষণং
ত্বমসি মম জীবনং
ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্।
পড়লাম…
কবির সাথে গল্প এমনই মনে হল। ধন্যবাদ শুদ্ধস্বর কে।