সাক্ষাৎকার
শুদ্ধস্বর: আপনি কবিতার মাধ্যমে কী আবিষ্কার করার এবং বোঝানোর চেষ্টা করে থাকেন?
জফির সেতু: শুরুটা করি ঠিক উলটো প্রশ্ন করে, জীবনের মাধ্যমে আমরা কী আবিষ্কার করি? জীবন দিয়ে আমরা আসলে কী বুঝি? তাহলেই উত্তরটা সহজ হয়ে যায়। আপনার প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই যদি বলি কবিতা কী? তা হলে জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়েই বলতে হয় যে; কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুই রকম উৎসারণ! এটা যদি হয়, আমার উত্তর হবে কবিতা কবির সার্বিক জীবনচেতনা থেকে উদ্ভুত বিশেষ উপলব্ধি ও প্রকাশের একটি ভঙ্গি। এই ভঙ্গিটি তৈরি করেন কবি কল্পনা ও ভাষার মাধ্যমে। এখন এখানে দুটি বিষয় দাঁড়ায়; একটি হচ্ছে কবির মানবিক উপলব্ধি, এবং অপরটি উপলব্ধি-প্রকাশের মাধ্যম। বলতে বাধা নেই দুটোই মানুষের মনোদৈহিক বিষয়াগত এবং পরম্পরাগত। মানুষের উপলব্ধি বস্তু-নিরপেক্ষ নয়; ভাষা প্রকাশের ভঙ্গি তো নয়ই। নতুবা সকল মানুষের উপলব্ধির ধরন সমান হতো এবং মানুষের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন না-হয়ে একই রকম হতো। ব্যক্তি-বিশেষের উপলব্ধি তৈরির যেমন কার্যকারণ আছে; আছে ভাষাবোধেও জটিল প্রক্রিয়া-পরম্পরা। এসকলই আবার মানবেতিহাসের সঙ্গেও জড়িত। ফলে কবিতা যেমন ব্যক্তিক প্রকাশ, তেমনি সে সমষ্টিক উচ্চারও। কবি যেমন কালিক তেমন ইতিহাসেরও প্রতিনিধি; ব্যাখ্যাকার। এমনকি কবির আত্মবোধও সমষ্টিক মানুষেরই ব্যক্তিক প্রয়াসমাত্র। কবি সমগ্র মানুষের হয়েই উপলব্ধি করেন; আর করেন বলে কবিতা বিশেষ কালের বা বিশেষ সমাজের না-হয়ে তা সর্বকালীন হয়ে ওঠে। এই জন্য যে-কোনও ভাষা কিংবা স্থান থেকেই কবিতা রচিত হোক না কেন তা মানবেতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মানবের সুগভীর উপলব্ধি ও অন্তর্দৃষ্টিকে মূর্ত করে তোলে।
আমার তো মনে হয় কবিতার প্রত্নচেতনার মূলে কবির আত্মবোধ; আবার এই আত্মবোধেরও রকমফের আছে যেমনটি আগে বলেছি। এর কালিক মাত্রাও আছে। কবি যেমন অতীতমুখী আবার ভবিষ্যৎও তার বিচরণক্ষেত্র। বস্তু ও কল্পনা মিলেও তার কারবার। এইসব মিলেজুলে কবির আত্মবোধ জীবন ও জগতকে উপলব্ধি করার একটি প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার বহুরৈখিক প্রকাশই কবিতা। তাই কবিতাকে জীবনচেতনার বিশেষ প্রকাশ বলতে পারি। যে-জীবন আমি ধারণ করি, জীবনের যে-মর্ম আমি প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করি, কবিতায় তার স্বতঃস্ফূর্ত আবিষ্কার ঘটে বলে আমার মনে হয়। এই আবিষ্কার যেমন নিজেকে, তেমনি অপরকেও। কারণ আমি তো একা নই; মহাবিশ্ব, প্রকৃতি, বস্তুজগত ও অপর মানুষের সঙ্গে আমার নিকট ও দূর সম্পর্কও আছে। এই সম্পর্কগুলো প্রতিনিয়ত আমার মধ্যে কাজ করে; আমাকে‘আমি’ করে তোলে, আবার আমাকে ছড়িয়েও দেয় ‘বহু’র মাঝে। সকল সময়েই আমি আমার মধ্যে একটা মহাজাগতিক রহস্য অনুভব করি; এই অনুভব আমার অস্তিত্বকেও নির্ধারণ করে। এই অস্তিত্ব মানব-অস্তিত্বও; সুতরাং কবিতার ভিতর দিয়ে মানব-অস্তিত্বকে আবিষ্কার ও স্পর্শ করারও একটা বিষয় কাজ করে। একই সঙ্গে কাজ করে আমার অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান; কবিতায় আমি চিহ্নায়িত করি জীবনের রস ও রহস্যগুলো; মানুষের ভিতরকার স্বপ্ন ও সম্ভাবনাগুলো। আবার; জীবন দুর্জ্ঞেয়, যেসব মিথ ও বাস্তব মিলে জীবনের এই দুর্জ্ঞেয়তা-কবিতায় কল্পনার জারক রসে তা প্রতিভাষিত হয় বলে আমি মনে করি। কবিতার আবেদনও মানুষের এই কল্পনার কাছে। আমি বুঝি ও বুঝাতে চাই আলতামিরা গুহায় যে-মানব-মানবীর চিহ্ন পাওয়া যায়; তাদের থেকে আমাদের দৈহিক রূপান্তর হয়তো হয়েছে, তবে চৈতন্যগত ভাবে আমরাএকই। আধুনিক জীবনের উপকরণে যে-মানুষ আমরা, তার সঙ্গে গুহামানবের পার্থক্য সংস্কৃতিগত। উপলব্ধি ও প্রকাশের রকমফেরও তেমন।মানুষের মানুষী উপাদানটা সামগ্রিক জীবন প্রবাহেরই ফল। আমার কবিতাও মানুষের সার্বিক জীবনপ্রবাহের মিথষ্ক্রিয়াজাত শিল্পরূপ।
শুদ্ধস্বর: আপনি বর্তমান বিশ্বকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং বর্তমান ঘটনাগুলো আপনাকে লেখার ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে?
জফির সেতু: এলিসন বেয়ার্ডের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সালমান রুশদি একবার বলেছিলেন, সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীকে বোঝা! আমারও তাই মনে হয়। তবে মনে হয় কি, বর্তমান বিশ্বটা অতীত পৃথিবীরই কার্যকারণের মূর্ত রূপ। বহুস্থানীয় ও বহুজাতীয় নানা ইতিহাস-পরম্পরা, ধর্মনীতি, জ্ঞানকাঠামো, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে আমি বিশ্বপরিস্থিতিকে দেখি এবং ব্যাখ্যা করি। মানবজাতি বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এই জায়গায় পৌঁছোয়; মানুষের বিবর্তন শুধু দৈহিক নয়, বুদ্ধিরও। পরিবর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে পৃথিবীর যে-চণ্ডরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি এর সঙ্গে আদিম পৃথিবীর কিংবা অতীত পৃথিবীর যে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে তাও কিন্তু নয়। প্রথমেই যে-জিনিশটার কথা আসে তামানুষের অস্তিত্ব; যা-কিছু হচ্ছে অস্তিত্বের লড়াইয়ের জন্যই হচ্ছে। ব্যক্তিমানুষকে হত্যা করা কিংবা কোনও জাতিকে নিধন করা সে একই কারণে, একই নীতিকৌশলে ঘটছে। সুতরাং আমি এতে অবাক হই না, পেছনের ইতিহাস দেখলে অবাক হওয়ার কারণও থাকে না। কিন্তু এতে আমরা কষ্ট পাই, মুষড়ে পড়ি। সেটা ওই মানবিক ও সংবেদনশীল সত্তার কারণেই। যে নিপীড়ক তারও মধ্যে সেই সত্তা আছে কিন্তু অস্তিত্বেরজন্যই নিপীড়ন করে। মানুষের প্রথম পরিচয় সে পশু, দ্বিতীয় পরিচয়ে তার মানবীয় সত্তা। পশু-যে পরতে পরতে টের পাই আজকাল। পশু-মানুষটাকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামই মানুষের সংগ্রাম এবং এই সংগ্রাম অন্তহীন বলে জটিল ও বহুকৌণিক। বর্তমান মানবসভ্যতার সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যে অতীত মানুষের সকল কর্মকাণ্ড লুকিয়ে আছে। তাই বর্তমানের ঘটনাগুলোই যে আমার লেখার পিছনে কাজ করে এমন নয়; অতীত পৃথিবীও আমার রচনার পেছনে ক্রিয়াশীল থাকে। এই জন্য দেখা যাবে মানুষের প্রত্নইতিহাস, মিথ-পুরাণ ইত্যাদি আমার কবিতায় অনিবার্যভাবে এসে যায়। আমার কাছে বর্তমান পৃথিবী মিথীয় পৃথিবীরই পুনর্বিন্যাস। তাই বর্তমান বলি, অতীত বলি কিংবা মিথপুরাণই বলি-সকলই আমার লেখার পিছনে একটা ভূমিকা পালন করে। আমার মনে হয় না পৃথিবীতে নতুন করে কিছু ঘটে; সবই পুনরাবর্তিত এবংতা অনিবার্যভাবেই ঘটছে। মানুষ নিয়তির সন্তান; এটাও তার নিয়তি। নিয়তির পালাবদল হয়েছে মাত্র; কর্মই এখন মানুষের নিয়তি। নিজে দানব সেজে নিজেরই মাথা কাটছে। আমরা যেন এই নিয়তি নির্ধারিত পথেই চলছি; কবিতা সে-পথের একমাত্র বিশল্যকরণি। একটা উদাহরণ দিই। ২০১৪ সালে ইসরাইল ফিলিস্তিনে নতুন করে যখন হামলা চালায়; ইসরাইলের সেনারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে ছোট্টশিশুদেরও ওরা রেহাই দেয়নি। সেরকম একটি ভিডিও ক্লিপে কয়েকটি পিতৃমাতৃহীন শিশু দেখলাম রক্তাক্ত পড়ে আছে রাস্তায়। তার একটা ফোটোগ্রাফ পরে ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে ভাইরালও হয়েছিল। ছবিটি দেখে আমি অস্থির ছিলাম কয়েকদিন। মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার দম্ভ, দমনপীড়ন ও অমানবীয় হত্যাযজ্ঞ আমাকে অসহায় করে তুলেছিল। মনে হয়েছিল এজন্য আমিও দায়ী। নিজের প্রতি একটা ঘৃণাও তৈরি হয়েছিল তখন। আমি কারও সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারিনি কিছুদিন এবং এরকম একটা পরিস্থিতিতে একরাতে আমি একটি দীর্ঘকবিতা পেয়ে যাই ভেতরের গভীর ক্ষত থেকে। দুই পর্বের একটি কাব্য লিখি দু-তিন দিনের মধ্যেই। ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ হচ্ছে সে-কাব্য।রক্তাক্ত স্বগতোক্তির মাধ্যমে গ্রিক মিথলজির দুই ট্রাজিক চরিত্রকে ভেঙেচুড়ে নতুন সময়ের প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করি আমি কবিতায়। কবিতার দুই পর্বের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে জুড়ে দিই একাধিক শ্লোকবিশিষ্ট দুটি এপিগ্রাফ। একটি বাইবেলের আদিপর্বের, অপরটি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার। এইদুই এপিগ্রাফ জুড়ে লেপ্টে আছে দুইটি ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ। প্রত্যাদেশের মাধ্যমে আব্রাহাম ও অর্জুন দুই পৃথক-যুদ্ধের কারণ হয়েছিলেন। ঈশ্বরের প্রত্যাদেশে আব্রাহাম স্ত্রী (দাসী) হাগার ও তার পুত্র ইসরাইলকে রাষ্ট্র থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যেখান থেকে আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। আর ভগবানের আদেশে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন ভ্রাতৃসংহারে মেতে উঠেছিলেন এবং যশ ও রাজ্যভোগ করেন। সেই ভারতে যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি আজও; ইসরাইলও ফিলিস্তিনে নতুন করে কামান দাগাচ্ছে চলতি সময়েও, উড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের মাথার খুলি। মিথ-ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের ঘটনা মিলেমিশে এভাবেই জন্ম দেয় ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’। কাব্যটি শেষ হলে পরে আমার ভিতরে একধরনের ‘ক্যাথারসিস’ হয়। আমি স্বস্তি পাই, সুস্থতা বোধ করি। কাব্যের সমাপ্তি ছিল শুভ প্রত্যাশার মাধ্যমে। হত্যাযজ্ঞের পৃথিবীর বিপরীতে আশা জাগানিয়া সুস্থির ও মানবীয় পৃথিবীর দিকে আমি মুখ তুলে তাকাই। আমার মনে প্রতীতি জন্মে যে মানুষ একদিন মুক্তি পাবেই। কবিতা কবির আত্মরক্ষারও কবচ।
শুদ্ধস্বর: কোন সাহিত্য-ফিকশন বা নন-ফিকশন বা কোন লেখক/লেখকরা আপনার নিজের লেখাকে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেছেন? কারা এবং কীভাবে?
জফির সেতু: অনুপ্রেরণা শিল্পসাহিত্য রচনার পেছনকার সবচেয়ে বড়ো শক্তি। এই অনুপ্রেরণার উৎসও বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু কবি বা লেখকের জীবনে একটা সময় আসে যখন নিজেই হয়ে ওঠেন অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎস। নিজের রচনা, জীবনপদ্ধতি, জীবনার্থ অনুসন্ধান-এসবই অনুপ্রেরণাকারী হিসেবে ধরা দেয়। ব্যক্তিগত প্রেম ও সদিচ্ছাও অনুপ্রেরণার উপকরণ হতে পারে। তবে মহৎ সাহিত্য ও শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠা, সাহিত্যপাঠ বা শিল্প-অবগাহন থেকে সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা আসে শিল্পীজীবনে, এটাই ঠিক। আর প্রভাবের কথা বললে বলতে হয় শিল্পীর পক্ষে প্রভাবিত হওয়ার মতো বড়ো গুণ আর দ্বিতীয়টি কী হতে পারে? প্রভাব ছাড়া সাহিত্য-শিল্পকর্ম হয় না। ‘প্রভাব’ শব্দটাকে এখানে গভীর বা বৃহৎ অর্থে ধরতে হবে। যিনি প্রভাবিত হতে জানেন না তিনি কী করে অন্যকে প্রভাবিত করতে পারেন? সাহিত্যের জগতই আসে প্রভাবের খাত বেয়ে, সুতরাং এটা একটা জরুরি আলাপ। প্রভাবিত পথ বেয়েই নবতর নির্মাণ আসে শিল্পকলায়। পৃথিবীর সকল সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রেই এটা ঘটেছে এবং ঘটছে। প্রভাব নানারকম হতে পারে; বিশেষত ফর্ম ও কন্টেন্টের উল্লেখ করা যায় এখানে। মৌলিক সাহিত্যিক বা কবি বলে কিছু নাই। আবার মনে রাখতে হবে প্রভাব কিন্তু অনুকরণ নয়। অনুকরণ শিল্পীর সৃষ্টিশীল সত্তাকে ধ্বংস করে দেয় এবং তা অর্থহীন রূপ সৃষ্টি করে মাত্র।
নানাভাবেই আমি লেখালেখিতে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমার মনন তৈরির ক্ষেত্রে, আমার জীবনদর্শন তৈরির ক্ষেত্রে এবং আমার লেখকসত্তা তৈরির ক্ষেত্রে পৃথিবীর নানা ভাষার লেখক, কবি ও দার্শনিক আমাকে প্রভাবিত করেছেন। এমনকি যে-ধরনের কবিতা আমি লিখি কিংবা যে-ধরনের কথাসাহিত্য রচনা করি তার ক্ষেত্রেও। আমার ফর্ম নির্বাচন এবং কন্টেন্টের বিচিত্রতায় বিভিন্ন অগ্রজের ভূমিকা আছে।প্রথমেই নিজের ভাষার লেখকদের ক্ষেত্রে বললে শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দের ওপর ভর করেই পথচলার শুরু।বাংলাসাহিত্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক আছেন তাঁদের লেখা পড়লে প্রভাবিত না-হয়ে পারা যায় না, এমনই শক্তিশালী এঁরা। সুধীন দত্ত, মনীন্দ্রগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, আবুল হাসান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী প্রমুখের কবিতা আমাকে বারবার সংক্রমিত করেছে।তাঁদের কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমি অনেক কবিতাই লিখেছি, সেটা শুরুর দিকে নিজের একটা স্বর আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত।এমনটা সকলের বেলায়ই ঘটে। বিশ্বসাহিত্যের কথা বলতে গেলে প্রথমে ইংরেজি কবিতা; পরে ফরাসি-জার্মান-স্প্যানিশ-ল্যাতিন ও আফ্রিকার কবিতা আমাকে খুব আলোড়িত করে। বিশেষ নাম যদি বলি টি এস এলিয়ট, ডব্লিউ বি ইয়েটস, শার্ল বোদলেয়র, সাঁ ঝন প্যার্স, ফ্রেডারিশহোন্ডারলিন, মারিয়া রিলকে, বের্টোল্ড ব্রেশ্ট, রামোন হিমেনেথ, গার্থিয়া লোরকা, পাবলো নেরুদা, অক্টাভিও পাজ, ওয়াল্ট হুইটম্যান, ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি, হোর্হে লুইস বোর্হেস, এমে সেজেয়ারসহ আরও অনেকে। মূলত এঁরাই শিখিয়ে দিয়েছেন কবিতা কীভাবে লিখতে হয়।সাম্প্রতিককালে আরবীয় কবিতা আমার কাছে বেশ অনুপ্রেরণার কারণ; তরুণ বয়েসে ইমরুল কায়েস ও কাহলির জিবরান পড়া ছিল; ইদানীং মাহমুদ দারবিশ ও আদোনিস আমাকে বেশ প্রভাবিত করেছেন। ফিকশনের কথা যদি বলি বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দ্যোপাধ্য্যায়, সমরেশ বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখের বেশ প্রভাব আমার মধ্যে আছে। বিশ্বসাহিত্যে বিশেষকরে রাশিয়ান কথাসাহিত্যে টলস্টয়, পুশকিন, গোগোল, শলোকভ, তুর্গেনিভ, দস্তয়েভস্কি আমার প্রিয়। ফরাসি স্তাদাল ও আন্দ্রে জিদ; লাতিনগার্সিয়া মার্কেস ও মারিও ভার্গাস য়োসা, জার্মান কাফকা ও গুন্টার গ্রাস, ইংরেজ লরেন্স ও ভি এস নাইপল, আমেরিকান উইলয়াম ফকনার ওহেমিংওয়ে এবং আফ্রিকান চিনুয়া আচিবি ও নগুগি বা থিয়োঙ্গো নানাভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেন। আরেকটা জিনিশ, প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি আমার দুর্বার একটা আকর্ষণ আছে। বিশেষ করে বিভিন্ন মহাকাব্য ও নাটক; ‘গিলগামিশ’ ও ‘ইডিপাস’ থেকে শুরু করে ‘ফাউস্ট’-এসব ক্লাসিক রচনা আমার মতো যে-কাউকে অনুপ্রাণিত করে বলে আমার বিশ্বাস। ইলিয়াড-ওডিসি-রামায়ণ-মহাভারত-আরব্যরজনি-শাহনামা-ডিভাইন কমেডি-কথাসরিৎসর ইত্যাদি আদিরচনা পৃথিবীর যেকোনও কবির অনুপ্রেরণার উৎস বলে মনে করি। আর শেক্সপিয়ার, আর্থার মিলার ও ও’ নীল সবসময়ই আমাকে ভাবিত করেছেন। একজন কবি বা লেখকের সবচেয়ে বড়ো জিনিশ তার মনোভূমি কিংবা চিন্তার জগত কিংবা ফিলজফি অব লাইফ; এক্ষেত্রে আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন জাঁ পল সার্ত্র। তবে সার্ত্র একদিনে আমার কাছে আসেননি; ধারাবাহিক চর্চার ভিতর দিয়েই তাঁকে আমি লাভ করি অর্থাৎ তাঁর কাছে আমি পৌঁছাই। সেই ধারাবাহিকতার মধ্যে প্লেটো-অ্যারিস্টেটল-রুশো-ভল্টেয়ার হয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল; তাঁর থেকে তবে সার্ত্রের কাছে আসা। সার্ত্রের মানবতাবাদী অস্তিত্ববাদ তরুণ বয়েসেই আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সার্ত্রের কাছে শিখেছি জীবনের স্বরূপ সম্পর্কে এবং জেনেছি কীভাবে লড়াই করতে হয় মানুষের। বিষয়টি আরও প্রত্যক্ষ করেছি জেমস জয়েস ও আলবেয়র কামুর সৃষ্টিতে। এই দুজনও আমার খুব প্রিয় শিল্পী এবং উৎসাহদাতা। বঙ্গ-ভারতীয় লোকায়ত দর্শনের প্রভাবও আমার মানস কাঠামোতে আছে বলে মনে করি।
এখানে যাঁদের নাম আমি উদ্ধৃত করলাম এর বাইরেও এমন অনেক আছেন যাঁরা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন। হয়তো এই মুহুর্তে তাঁদের নাম মনে করতে পারছি না। এঁরা সকলেই আমাকে লেখার পদ্ধতি, শৈলীর কলাকৌশল শিখিয়েছেন। একটি কবিতা কীভাবে কবিতা হয়ে উঠে এবং রচনায় তত্ত্বদর্শন কিংবা জীবনার্থ কীভাবে বিন্যাস করতে হয় তাও শিখেছি এঁদের রচনা থেকে। এঁদের প্রভাব ও অনুপ্রেরণা সকল সময়ই আমার মধ্যে কাজ করে। আমার মনে হয় একজন কবির কোনও কবিতা শুধু তার নিজের নয়, বহু যুগ থেকে অনেকে মিলে কবিতাটি রচনা করেন। কবি শুধু দায়টা নেন; একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। সেটা শৈলী, ভাব বা দর্শন সকল দিক থেকেই। শিল্পসকল সময়েই সমবায়ী রচনা; আমরা তা মানি বা না-মানি।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার কবিতাকে আকার দেয়?
জফির সেতু: পূর্বেই বলেছি আত্মবোধ বা আত্মচেতনাই কবিতার মর্ম হিসেবে কাজ করে। সেই আত্মবোধও বস্তুনিরপেক্ষ নয়। একটা ঘনিষ্ট যোগাযোগের ভিতর দিয়েই এই চেতনা লাভ করেন কবি। আমার আত্মবোধের সঙ্গে আমার পরিপার্শ্ব, আমার অভিজ্ঞতা, আমার জ্ঞান, আমার মিথ ও ইতিহাস-চেতনা জড়িত। এসব ক্রিয়াশীল উপাদান বর্তমানের সঙ্গে গভীর একটা যোগাযোগ তৈরি করে। সেই যোগাযোগ নিজের ভিতরে একটা সংবেদন তৈরি করে, একটা উপলব্ধির আকৃতি দেয়। সেই উপলব্ধি প্রকাশিত হয় ভাষার মাধ্যমে। সেই ভাষা আবার হাজির হয় নানা মেটাফর নিয়ে। সবমিলিয়ে একটা ম্যাজিক তৈরি হয়; শিল্পসৃষ্টির মতো ম্যাজিক আর দ্বিতীয়টি নেই। কারণ তখন স্রষ্টাও তাজ্জব বনে যান, কী ঘটতে যাচ্ছে তা দেখে। কবিতাটি লেখার পর প্রথম পাঠক হয়ে ওঠেন কবি নিজে। তখন তিনি বিস্মিত হন কবিতা পড়ে; তিনি আবার পড়েন কবিতাটি। কবি দূর থেকে তখন হাসেন। কবিতা রচনার পরই কবির মৃত্যু ঘটে। এটাও আশ্চর্য বিষয়। ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা কীভাবে কবিতায় কাজ করে এর একটি উদাহরণ দিই। ২০১২ সালে আমি কাশ্মীর ভ্রমণ করেছিলাম। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। নিজ চোখে দেখেছিলাম সৌন্দর্য ও রক্তপাত। আমি কাশ্মীরি মুসলমানদের সঙ্গে মিশেছিলাম; জানতে চেয়েছিলাম তাদের দুঃখকথা; আবেগ ও অনুভূতির কথা। সবুজের বুকে জওয়ানদের তাক করে থাকা বন্দুক দেখেছি কয়েকশ মিটার পরপর। দেখেছি মানুষের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা; মলিন মুখ। আমি ফিরে এসে লিখেছিলাম কবিতার বই ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’। সারাটা কাব্য ছিল প্রেম-প্রকৃতির-মিথ-ঐতিহ্যের ভাব-কল্পনার। কিন্তু কথা ওখানে নয়। অনেক বছর বাদে ২০১৯ সালে ভারতীয় জওয়ানরা যখন কাশ্মীরি জনতার টুটিচেপে ধরল নতুন ভাবে এবং শক্তিমানরা ঘোষণা করল কাশ্মীরের মানুষ নয়, মাটিই দরকার তাদের। তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ল জনগণ কাশ্মীর জুড়ে; শুরু হলো দখলদারিদের হত্যাযজ্ঞ ও নানা নিপীড়ন। আমার ভিতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হলো; প্রায় অস্থির আমি কাশ্মীরিদের সঙ্গে লড়াইয়ে আসীন হয়ে জ্বরের ঘোরে লিখি পাঁচপর্ব বিশিষ্ট ‘তিনভাগ রক্ত’ কাব্যটি। আমার মনে হয় না কাশ্মীর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না-থাকলে; কাশ্মীরের রক্তমাংসের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত না-হলে কবিতাগুলো আমি লিখতে পারতাম; তাদের আবেগ ছুঁতে পারতাম। কবিতাগুলো এত স্বতঃস্ফূর্ত ও কম সময়ে লেখা যে আমি নিজেই বিস্মিত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল কবিতাগুলো আমি রক্তের অক্ষরেই লিখেছি। কবিতায় অভিজ্ঞতা এমনই কার্যকর হয়ে ওঠে।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার বক্তব্য উচ্চারণ করতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্বফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
জফির সেতু: এটি নির্ভর করে বক্তব্য-বিষয় কী, তার ওপর। আমার মনে হয় না কবি আগে থেকে কিছু ভাবিত হন। কবিতার বিষয়ের ওপরই আমার কবিতার কাঠামো, ভাষা ও অপরাপর নির্মাণ ঘটে। আমার দুই পঙক্তির কবিতাও আছে, আবার দুইশ পঙক্তির কবিতাও আছে। ভাবও বক্তবের ভিত্তিতেই এমনটা হয়েছে। একজন কবি জানেন তার বিশেষ ভাবের কবিতাটি কোন কাঠামোয় নির্মাণ করবেন। যেসব মেটাফর ব্যবহার করবেন তা নেবেন কোথা থেকে। প্রয়োজনে তিনি কবিতার ফর্মের ভাঙাগড়া করেন। শুধু ফর্মের ভাঙাগড়াটাই কবির কাজ নয়, ফর্ম ভেঙে যে-নতুন ফর্ম গড়লেন সেটা কতটা প্রাসঙ্গিক এবং কবিতার জন্য উপযুক্ত সেটাও বিচার্য বিষয়। দুর্বল কবিরা ফর্মের ওপর কাজ করতে গিয়ে কবিতা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন না, কবিতা হারিয়ে যায় পথেই। কবিতার নামে কঙ্কালসর্বস্ব কিছু হয়; সেটা আরাধ্য কিছু হতে পারেনা। প্রতিভাবান কবির পক্ষে ফর্মের পরীক্ষানিরীক্ষা যথার্থভাবে হয়। আমি কতটা সফল তা সময় বলে দেবে কিংবা আমার পাঠক বলতে পারবেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আমি বরাবরই অভ্যস্ত। এই জন্য আমার একটি কাব্য থেকে আরেকটি কাব্য আলাদা; সেটা উপস্থাপনা, শৈলীএমনকি ভাবের দিক থেকে। এরূপ ফর্ম ভাঙা-গড়ায় আমি আনন্দ পাই।
শুদ্ধস্বর: রাজনৈতিক কবিতা এবং সাধারণ কবিতার মধ্যে সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব এবং সংহতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
জফির সেতু: ‘রাজনৈতিক কবিতা’ অভিধাটা কন্টেন্টের দিক থেকে, আর যেহেতু কন্টেন্টের ওপর নির্ভর করেই কবিতার ফর্ম তৈরি হয় কিংবা নির্মাণ প্রক্রিয়া গড়ে ওঠে সেহেতু রাজনৈতিক কবিতার শিল্পপ্রকরণে একটি ঝুঁকি থাকেই। কিন্তু সে-ঝুঁকি তো সাধারণ প্রেমের কবিতায়ও থাকে ভাবাবেগগত দিক থেকে। আবার, মানুষ রাজনৈতিক জীব; জীবনের ওপর রাজনীতির প্রভাব এত বেশি যে, বলা যায় জীবন রাজনীতি-নিরপেক্ষ হতেই পারে না। হ্যাঁ, রাজনৈতিক কবিতার বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে কিংবা সমকালীন ঘটনায় কবিতা এতটাই উত্তপ্ত হতে পারে যে, সেখানে শিল্পবস্তু ম্লানও হয়ে যেতে পারে; অনেক ক্ষেত্রে হয়েও যায়। রাজনৈতিক কবিতার নামে বাংলা ভাষায় অনেক ম্যাড় ম্যাড়ে কবিতা লেখা হয়েছে; হয়ে উঠেছে বিবৃতির পর বিবৃতি। অন্য অপর ভাষায়ও এমন উদাহরণ প্রচুর আছে। তবে সেটা নির্ভর করে কবিপ্রতিভার ওপর। পাবলো নেরুদা কিংবা নাজিম হিকমতের কবিতা যখন আমরা পড়ি তখন আমরা সে-অভিযোগগুলো করতে পারি না। বের্টোল্ড ব্রেশট, এমেসেজায়ার, মাহমুদ দারবিশ প্রমুখের কবিতায় শিল্পের কোনও ঘাটতি আমরা দেখতে পাই না। সে-ক্ষেত্রে কবি শিল্প-সংহতি বজায় রেখেই কবিতা নির্মাণ করেন। বিশ্বকবিতায় রাজনৈতিক ধারার কবিতা শিল্পসাহিত্যের অতুল সম্পদ এবং মানুষের অধিকার আদায়ের রক্ষাকবচ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকবে চিরকাল। আগামীতেও রাজনৈতিক কবিতা হবে মানুষের বাঁচামরার হাতিয়ার।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতা কি জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে বলে আপনার ধারণা? এটি অন্যান্য জাতীয়তা বা ভাষাগোষ্ঠীর কাছে আবেদনরাখতে পারে বলে কি আপনার মনে হয়? তাহলে কীভাবে?
জফির সেতু: কবি প্রথমে নিজভাষায় নিজের কবিতাটি লিখেন। নিজের দেশের মাটিতে পা রেখে; নিজের প্রতিবেশ থেকে মেটাফর সংগ্রহ করে কবিতায় চিহ্নায়ন ঘটান। পরে ভাব ও শৈলীর গুণেই সে-কবিতা ভাষা, দেশ ও কালকে অতিক্রম করে। মহৎ শিল্পেরও বৈশিষ্ট্য এই। মহৎসাহিত্য স্থানীয় বা জাতীয় নয়, সেটা আন্তর্জাতিক। সেটা যে-ভাষায়ই রচিত হোক না কেন। এমনকি সে-যদি লোকসাহিত্যও হয়, তাহলেও।কবিতার কাছেও জাতীয়তা বা ভাষাগোষ্ঠী আলাদা কোনও সীমানা হতে পারে না। যেকোনও জাতির, যেকোনও ভাষার উৎকৃষ্ট কবিতা পৃথিবীর সকল জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর সম্পদ বলে বিবেচিত। এক্ষেত্রে ভাষান্তর একটা বড়ো মাধ্যম। আমার কবিতার ক্ষেত্রে যেটা বলা যায়; আমি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কবিতা-ঐতিহ্যের একজন বাহক মাত্র। আমি বিশেষ একটি ভাষায়, বিশেষ একটি প্রতিবেশে কবিতা লিখি সত্য কিন্তুসে কবিতা তো ভাব ও প্রকরণে বিশ্বকবিতারই একটি ঢেউ। যে-প্রেমের ভাব, যে-রাজনৈতিক সংক্রাম কিংবা যে-মানবিক যোগাযোগ থেকে কবিতা উদ্ভব হয় তা একই সঙ্গে আমার নিজের; আমার জাতির কিংবা ভিন্ন জাতির মানুষেরও। আর এখন, এই বিশ্বায়নের যুগে; কিংবা বহুকাল আগ থেকে কবিতায় আন্তর্জাতিক অনুষঙ্গ; বহুজাতীয় মিথ-পুরাণ ও ইতিহাসের যে-বস্তু তার সঙ্গে বিশ্বমানবের একটা নিকট সম্পর্কও স্থাপিত হয়েছে। দেখা যায় আমার কবিতায়ও বঙ্গীয় লোকপুরাণের কিংবা ভারতীয় মিথের সঙ্গে গ্রিক-রোমান মিথের সমন্বয়েরও একটা চেষ্টা আছে। একইভাবে সমকালীন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে পারসিক মিথের সঙ্গে আফ্রিকার মিথের ব্যবহার কিংবা বিশ্বরাজনীতির আবর্তে রচিত হয়েছে ব্যক্তিক অনুভূতির বিশেষ কাব্যভাষ্য। এভাবে আমার কবিতা স্থানীয় বা জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক পরিসরে আত্মপ্রতিষ্ঠার চারিত্র্য ধারণ করেছে বলে বিশ্বাস করি। যে-প্রেমানুভূতি বা অধিকার আদায়ের লড়াই তা শুধু আমার নয়; অপরেরও। এছাড়া আমি যখন লিখি তখন মানুষের হয়েই লিখি যে-বিশ্বমানব। আমার কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদও হয়েছে; আমি নিজেও একাধিক দেশে অবাঙালি পাঠকের সামনে আমার কবিতা ইংরেজিতে পাঠ করেছি। সেসব কবিতাপাঠে কিংবা পাঠ শুনে অনেকে তাদের সংরক্ত আবেগের কথাও জানিয়েছেন। আমি মনে করি কবিতা যত বেশি ভাষান্তরিত হবে; মানুষের পরিসর হতো বাড়বে। কবিতাকে ঠিক নিজের ভাষায় পড়ে থাকতে নেই।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন কবিতার সংক্রাম দিয়ে মানুষের ইতিহাস পালটানো সম্ভব? আপনার জবাবের পক্ষে বলুন।
জফির সেতু: মানবজাতির অতীত-ইতিহাস খুব বিচিত্র। প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা আমরা জানি না, তবে গত পাঁচ হাজার বছরের যে-ইতিহাস জানি তা থেকে আমরা দেখি মানুষের ইতিহাস রচিত হয়েছে কবিতার মাধ্যমেই। প্রাচীন কালের ‘গিলগামেশ’ থেকে শুরু করে অর্বাচীনকালের ‘কোরান’ পর্যন্ত সকল ধর্মগ্রন্থ রচিত বা আবির্ভূত হয়েছে কবিতার মাধ্যমে। আমার কাছে এসব গ্রন্থের গুরুত্ব কবিতা হিসেবেই।এসব কাব্য-আঙ্গিকসম্পন্ন গ্রন্থের প্রভাব রয়েছে গোটা মানবজাতির ইতিহাসজুড়ে; যা আমি অস্বীকার করতে পারি না । সেসব গ্রন্থের ভাবের কংকাল আজও বহন করে চলেছে মানুষ; মানুষে মানুষে বিভাজন, মানুষকে শোষণ কিংবা মানুষকে সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণে এদের প্রভাব পৃথিবীর দেশে দেশে আজও বিদ্যমান। তা যদি হয়, তাহলে আমার তো ধারণা কবিতা মাধ্যমেই মানুষের নবতর ‘ধর্ম’ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। মানুষের ধর্ম মানবতা ভিন্ন কিছু নয়; তার প্রধান ও সংবেদনশীল বাহন হতে পারে কবিতাই। কেননা কবিতার নিজের একটা শক্তি আছে; সেই শক্তি জীবনের শক্তির মতোই অফুরন্ত এবং তা রহস্যে-ভরা। বলা হয়ে থাকে জীবনের উৎস যেখানে, কবিতারও উৎস সেখানে। তা যদি হয়, তাহলে কবিতা ও জীবন পরস্পরের জমজও। এখানেই কবিতার সম্ভবনা। আগামীদিনে মানুষের কাছে ধর্মগ্রন্থের জায়গা দখল করবে কবিতা, এ আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি। কারণ মানুষের সুগভীরসংবেদন; তার স্বপ্ন, সম্ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা ও শিল্পবোধে আমার বিশ্বাস আছে।
____________________________________
কবিতা
তিনভাগ রক্ত
১.
ভূ-উপগ্রহের চোখে তাকালে
মনে হবে একটি অগ্নিগর্ভ
অথবা মনে হতে পারে
জলপাই-পাতায় ঢাকা স্ত্রী-অঙ্গ
হয়তো এজন্যই উপত্যকাটিতে
জন্ম ও চিৎকার দুই-ই চলছে!
২.
পৃথিবীর মানচিত্রে কাশ্মীরটা কোথায়?
যতবার প্রশ্ন করেছি,
আমাকে সবাই দেখিয়েছে একটি হৃৎপিণ্ড!
আমিও লক্ষ করেছি ওটা বর্তুল আকৃতির কিছু
আর শীর্ষবিন্দুতে রক্তের সূর্য-আঁকা।
৩.
কুরুক্ষেত্রের বিস্তার এখানেও
কুরু আর পাণ্ডবকুলের রক্তে এককালে
ভিজেছিল পৃথিবীর মুথাঘাস
আবারও মেদিনীযুদ্ধে পুড়ছে আকাশ
আর অতি কাছ-থেকে-ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ
হচ্ছে বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ ও শিশু
জাফরানের খেত ভিজে যাচ্ছে মানুষের রক্তে।
৪.
জাফরান ছয় পাপড়িবিশিষ্ট বেগুনি রঙের ফুল
কিন্তু তার গর্ভমুণ্ড সূর্যরঙের
আর পুংকেশর রক্তরং
উপত্যকার লোকের অভিমান এই যে,
হত্যা করা হলে তারা
জাফরান হয়েই জন্মায়!
৫.
যুদ্ধ শেষ না আসন্ন?
কুরুক্ষেত্রে এই সংলাপ ছিল রাজা ধৃতরাষ্ট্রের
তিনি অন্ধ ছিলেন
এখন জগৎসুদ্ধ সকলেই অন্ধ।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে উপত্যকার মাটি
অক্ষৌহিণী সেনাদল চারদিক থেকে চিৎকার করছে
জিতেছি জিতেছি
আর অন্ধেরা প্রশ্নও করছে,
যুদ্ধ শেষ না আসন্ন!
৬.
‘লোকেনেতি নিরর্গলং প্রলপতা সর্বং বিপর্য্যাসিতম’
এই সূক্ত-বাণী প্রাচীন এক ঋষিকবির
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়,
অসংখ্য মিথ্যা রটনা করে বৈপরীত্য ঘটানোই রাজধর্ম!
৭.
রাজা চিৎকার করছে,
আমি হিতকামী, আমি হিতকামী!
রাজার দাঁতে মানুষের মাংস লেগে আছে
আর হাত দুটোতেও নৃমুণ্ড-ধরা।
কুরুক্ষেত্রের বিস্তার
১.
প্রথমে ওরা লাইন টানল
তারপর পাঠাল ট্রাকভরতি জওয়ান
জওয়ানরা তাদের দৃষ্টিতে ছড়িয়ে দিল ঘৃণা
আমরা দেখতে পেলাম বাতাসে শুধুই বিষবাষ্প
পরে তা সমতলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।
২.
প্রথম প্রথম আমাদের পূর্বপুরুষেরা শুনতে পেত
অবিরাম গুলির শব্দ;
আতঙ্কে রাতে তাদের ঘুম আসত না
তারপর দিনের বেলাও গুলির আওয়াজ
তারপর একদিন গ্রামের দিকে
শুরু হল অবিরাম গুলিবর্ষণ।
৩.
হঠাৎ শোনা গেল কেউ একজন গুম হয়ে গেছে
সে-আর বাড়ি ফিরল না
তারপর আরও একজন
তারপর আরও একজন
কেউই আর বাড়ি ফিরল না
পুলিশস্টেশন থেকে বলা হলো,
মিসিং কেস রজ্জু করো।
৪.
আমাদের শিশুরা একটা নতুন শব্দ পেল ‘মিসিং’।
একদিন খেতে কাজ করতে গিয়ে শুনি
একজন বলছে, আমার পুতুলটা মিসিং হয়ে গেছে
অন্যজনের জবাব, কী করে হল শুনি?
প্রথম জন : আমার সঙ্গে চালাকি?
তোমার জওয়ানই আমার পুতুলকে গুম করেছে!
৫.
একদিন গ্রামে এসে জওয়ানরা ঢুকল
তাদের হাতে একে-৪৭
তারা-সব উঠোন দিয়েই হেঁটে গেল,
গ্রামবাসীর মুখ আতঙ্কে পাণ্ডুবর্ণ হল,
আর মুখে মুখে পড়ল কলেমা।
৬.
আমাদের শিশুরা ওদের তাঁবুকে ভাবল
জিপসিদের গ্রাম,
স্বাধীন মৃগের মতো শিশুগুলো
একসময় তাঁবুর পাশে ভিড়ও জমাল
তারপর দেখা গেল মেয়ে শিশুগুলো
আর বাড়ি ফিরছে না।
৭.
প্রথমে ওদের লোভ ছিল
আমাদের ভূমির প্রতি,
তারপর ভাবল, ফরসা আর লম্বা
মেয়েদের ওপর তো তাদের অধিকার আছে!
তারপর থেকে আমাদের মেয়েরা অরক্ষিত
হয়ে আছে নিজঘরেই।
৮.
ওরা আমাদের উপত্যকায় আগুন দিল
আমাদের মেয়েদের রক্তাক্ত করল
আমাদের ছেলেদের ধরে নিয়ে গেল
মাবুদ, বুঝি না ওরা আসলে কী চায়?
৯.
একদিন সত্যি সত্যি ওরা ট্রাক নিয়ে গ্রামে এল
বেধড়ক পেটাল নিরীহ গ্রামবাসীকে
যাবার সময় তুলে নিয়ে গেল যুবকদের
ট্রাকভরতি করে
বলল, ওদের নামে অভিযোগ রয়েছে।
১০.
আমাদের পশুগুলো আমাদেরই প্রতিনিধি
এই যেমন পনি,
হাড়জিরজিরে দেহ নিয়ে
ওই যে পাহাড়ে ওঠে পর্যটকদের নিয়ে
আমরাও সমানভাবে সাম্রাজ্যের ভার বহন করি।
১১.
পৃথিবীতে আরেকটি মানচিত্র দেখাও
যেখানে তিন দেশের কাঁটাতার দিয়ে মোড়ানো
আর দশদিকেই চব্বিশ ঘণ্টা তাক করা আছে
তিনলক্ষ একে-৪৭
১২.
পশুর লোম দিয়ে যে-উল হয়
তার উত্তম শিল্পী আমাদের মেয়েরা
আমাদের মেয়েগুলো মিষ্টি স্বভাবের
উলের শালে নানারঙের চিত্র বোনে
আর দিন গোনে প্রেমিকের প্রতীক্ষায়।
১৩.
আমাদের মেয়েগুলো প্রতীক্ষা করতে জানে।
কেউ হয়তো জানে স্বামী বা প্রেমিক কখনওই ফিরবে না
তবু তারা প্রতীক্ষার গান গায়,
যতদিন না-মৃত্যু এসে আলিঙ্গন করে।
১৪.
আর ছেলেগুলো?
এক-একটা তাজা টিউলিপ তাদের কম্পমান হৃদয়!
প্রেমিকার মুখ স্মরণে নিয়ে
বেরিয়ে পড়ে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে
তারা অকাতরে ঝরে পড়ে।
১৫.
আমাদের চোখে ঘুম নেই
পেটে দানা নেই
কিন্তু আমরা বেঁচেবর্তে আছি
অথচ আপনাদের কানে পৌঁছায় তাজাসব খবর-
আমরা ঠিকঠাকই আছি।
আমরা আজ বোবাকালা হয়ে আছি
যদিও জানি ঠিকই,
ওরা কীভাবে মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করছে।
১৬.
বিশ্বাস হয় আমরা মানুষ?
শ্রীনগরের রাস্তায় একটা পাগল-কিসিমের লোক
আমাদের পথরোধ করে।
কী যে বলব? আমি এর জবাব খুঁজে পাই না।
লোকটি পথ ছেড়ে দেয়
আমার স্ত্রীর দিকে কটমট চোখে তাকায়
মানুষ নই মানুষ নই, আমরা পোকা, পোকা, হাহাহা
১৭.
ওই যে উঁচু পাহাড়গুলো দেখছেন
ওগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের স্পর্ধা
আর ওই শুভ্র তুষার বেয়ে নামছে সানুদেশে
তা আমাদের পূর্বনারীদের স্তন্যধারা
সুতরাং আমরা আজও কাপুরুষ হয়ে যাইনি।
১৮.
আমাদের খাঁচায় বন্দি করা হল এবার!
অডিও-বার্তায় জানালেন এক নারী
আরও জানালেন, পাখিকে কেউ যখন খাঁচায় পুরে
তার অর্থ এই যে, পাখিটা বশ মানছে না
আর শেকল দিয়ে বেঁধে-রাখার দিনও খতম!