আমাদের শ্রমিকশ্রেণী ও চলমান আন্দোলন

Share this:

করোনাভাইরাস। সমগ্র বাংলাদেশে চলছে ‘অঘোষিত লকডাউন’। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মৃত্যুও থেমে নেই। অঘোষিত লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষরা নিদারুণ কষ্ট আর নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন। লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক কার্যত বেকার হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের একটি সংবিধান রয়েছে। সে সংবিধানে মেহনতি মানুষদের কথাও রয়েছে। কিন্তু সে কথাগুলো বইয়ের পাতাতেই সীমিত, তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। শ্রমিকের পেটে ভাত নেই। শ্রমিক রাস্তায় অবরোধ করছে। বেতন পাচ্ছেন না। চাকরি হারাচ্ছেন। এটাই চিত্র একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে অর্থাৎ কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশগুলোকে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তিদান করা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক প্রতিষ্ঠানই শ্রমিক ছাঁটাই করছে। লে-অফ করছে। এ সংবিধান তাহলে কার স্বার্থে কার্যকর- জনগণ একদিন প্রশ্ন তুলবেই।

ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, পোশাক শিল্প বিকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এখানকার সস্তা শ্রমবাজার। দেশের জাতীয় অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি এই শ্রমিক। সামগ্রিক অর্থনীতিতেও পোশাক শ্রমিকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অথচ এই মহামারির সময়েও যখন গার্মেন্টস শ্রমিকরা মজুরির দাবিতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন। আর রাষ্ট্রের পেটুয়াবাহিনী তাদের উপর চালায় নির্মম নির্যাতন।

ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান থাকলেও, এই মহামারির সময়েও শ্রমিকদের ছাঁটাই করা, বকেয়া মজুরি আটকে রাখা সম্ভব হতো না। যখন সরকারি চাকরিজীবীরা বাসায় বসে বসে বেতন পাচ্ছেন, ঠিক তখন শ্রমিকরা তাদের চাকরি হারাচ্ছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকে পায়ে হেঁটে ঢাকা ফিরছেন। কারখানায় কাজ করছেন। যেখানে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। যেন একেকটা মৃত্যুকূপ!

মালিক-সরকারপক্ষ জানায়, বেতন-ভাতার ৬০ শতাংশ পাবেন কারখানায় না আসা শ্রমিকরা। এর প্রতিবাদ করেছে বিভিন্ন বাম-প্রগতিশীল গার্মেন্টস সংগঠন। তারা শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন এবং গার্মেন্টস ছুটি দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে; কিন্তু সরকার ও মালিকপক্ষ এ দাবি মানতে নারাজ। অথচ সরকারি চাকরিজীবীরা পুরো মাসের বেতন পাচ্ছে ঘরে বসেই। তাদের কোনো ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না! তাহলে শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ বেতন কেন? মূল চালিকা শক্তি শ্রমিক। আর এই শ্রেণীর সঙ্গেই চলে একের পর এক নাটক, নির্মম রসিকতা আর শ্রেণীশোষণ!

 

দুই.

২ মে ২০২০। চট্টগ্রামের বায়েজিদে অবস্থিত জিরাত ফ্যাশন গার্মেন্টস লিমিটেড। এই পোশাক কারখানার সামনে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে। প্রায় দুই শতাধিক শ্রমিক বায়েজিদ বোস্তামি মাজার সংলগ্ন এলাকায় কারখানার গেটের সামনে বিক্ষোভে অংশ নেন।

বিক্ষোভরত শ্রমিকরা জানান, এমন বিপদের দিনে এটি অমানবিক পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন পর গার্মেন্টস খুলেছে। সকালবেলা সবাই কাজে যোগ দিতে যান। কিন্তু কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের প্রবেশে বাধা দেয় । যাদের চাকরির মেয়াদ ৬ মাসের বেশি শুধু তাদের আলাদা করে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। আর যাদের চাকরির মেয়াদ ৬ মাসের একদিনও কম তাদের ছাঁটাই করা হয়। পরে শ্রমিকরা গেটের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন ।

এদিকে, গাজীপুরের সালনা ও টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকার দুটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন জোরপূর্বক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদ ও বকেয়া বেতদের দাবিতে। শ্রমিকদের যখন ঘরে থাকার কথা, নিরাপদে থাকার কথা, তখন শ্রমিকরা পেটের দায়ে রাস্তায় নেমেছেন। এই রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা তাদেরকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। এটাই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার চিত্র।

বিক্ষোভ যেন থামছেই না! একইদিনে সালনা এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে অক্সফোর্ড গার্মেন্টস লিমিটেডের শ্রমিকরা। কারখানাটিতে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে যাদের চাকরিতে এক বছর পূর্ণ হয়নি, তাদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্রে জোর করে সই নেওয়া ও পরিচয়পত্র রেখে দেওয়া হয়।

গত ৭ মে গাজীপুরের শরিফপুরে লুইটেক্স ম্যানুফ্যাকচারিং লিঃ-এ ৬০ শতাংশ বেতন দেওয়ার কারণে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করেন। আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর রাষ্ট্রীয় পেটুয়াবাহিনী লাঠিচার্জ ও টিয়ালসেল নিক্ষেপ করে; কিন্তু শ্রমিকরা বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন। ১০ মে তাদেরকে আশ্বাস দিয়ে বিক্ষোভ বন্ধ করা হয়।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, কোনো শ্রমিককে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়ার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই করতে পারবে, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই আইনের বিধান মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ১২ এবং ২০-এ লে অফ করার বিধান রয়েছে। ১২(১) অগ্নিকাণ্ড, আকস্মিক বিপত্তি, যন্ত্রপাতি বিকল, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ, মহামারি, ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা অথবা মালিকের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত অন্য কোনো কারণে প্রয়োজন হলে কোনো মালিক যে কোনো সময় প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা বা শাখাসমূহ আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারবেন এবং যে কারণে কারখানা বন্ধের আদেশ দেওয়া হবে তা বিদ্যমান থাকা পর্যন্ত এই বন্ধের আদেশ বহাল রাখতে পারবেন এবং এই ক্ষেত্রে শ্রমিকরা তাদের বেসিক বেতনের অর্ধেক এবং বাড়িভাড়া পাবেন। কিন্তু ‘করোনাভাইরাস’কে সরকার এখনও মহামারি ঘোষণা করেনি। বাংলাদেশের অবস্থা দুর্যোগপূর্ণ তাও ঘোষণা করেনি। আর এর আইনি ফায়দা নিচ্ছে কারখানা মালিকরা। শ্রমিকদের সঙ্গে এই জোরজুলুম চলছে যুগের পর যুগ থেকে। এর পরিত্রাণের জন্য সংগঠিত শক্তি দরকার। যার অভাব রয়েছে।

এই বৈশ্বিক দুর্যোগের সময় অনেক কারখানায় রাষ্ট্র ঘোষিত ‘সাধারণ ছুটি’র মধ্যেই বেতন প্রদান ও কারখানা খোলার কথা বলে শ্রমিকদের অবর্ণনীয় পরিস্থিতিতে কারখানায় এনে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের দিন কাটছে চরম অনিশ্চয়তায়। এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় ছিল রানা প্লাজাসহ অন্যান্য গার্মেন্টসে ঘটে যাওয়া নিপীড়নের ইতিহাস থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আসন্ন দূর্যোগ মোকাবেলা করা; কিন্তু রাষ্ট্র তার কোনো দায়িত্বই নিচ্ছে না। নানান ধানাই-পানাই করে শ্রমিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করাটাই প্রমাণ করে সংবিধানে জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক বলে উল্লেখ করা থাকলেও, প্রকৃত অর্থে এ রাষ্ট্রের মালিক হলো ওই গার্মেন্টস মালিকরা। যাদের কথায় প্রশাসন চলে, রাষ্ট্র চলে। দায়িত্বশীল মন্ত্রী নিজেই বলেন- তিনি নাকি কিছুই জানেন না!

 

তিন.

অপরদিকে, ত্রাণ দেওয়ার নামে ‘লুট’ করছে সরকারদলীয় পাতি-নেতারা। শ্রমজীবী মানুষ ত্রাণের দেখা পাচ্ছেন না। ত্রাণের জন্য হাহাকার লেগেই আছে। পরিবার নিয়ে টিকে থাকাটাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমন কথাই জানাচ্ছিল- চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ প্রাইম লেভেল অ্যান্ড অ্যাসেসিয়েশন হাশেম টেক্সটাইলের ছাটাইকৃত শ্রমিক মোহাম্মদ জুয়েল। তিনি ছিলেন লেভেল প্রিন্টিং অপারেটর। আইডি নং ০১২। ক্ষোভ প্রকাশ করে জুয়েল বলেন, ‘আমরা শ্রমিকরা গার্মেন্টসে আসছি। আমাদের বেতন দেওয়ার কথা বলে ডেকে এনে ম্যানেজার আমাদেরকে জানাল, তোমাদের আর চাকরি নেই। কেন নেই, কী কারণে নেই প্রশ্ন না করে চলে যাও।’ এ কথা শুনে জুয়েল ও মোহাম্মদ আলমগীর (লেভেল কাটিং অপারেটর) প্রতিবাদ করেন। যার ফলে তাদের ওপর ম্যানেজার ক্ষিপ্ত হয় এবং তাদেরকে বের করে দেয়। তাদের এখন ঘরে খাবার নেই। ত্রাণের জন্য ঘুরছেন।

৬ মে ২০২০। শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছিলেন ধামরাইয়ে ডাউটিয়া এলাকায়। আরুগাস ম্যাটাল প্রাইভেট লিমিটেডের শতাধিক শ্রমিক কারখানার সামনে বিক্ষোভ করেন। এখানেও কারণ ওই ছাঁটাই। কারখানায় প্রায় ১১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। করোনাভাইরাসের কারণে কারখানা গত ২৬ মার্চ বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। বন্ধ থাকাকালীন কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ফোনে জানিয়ে দেয়, তাদের আর কারখানায় আসতে হবে না, অন্য কোথাও যেন চাকরি খুঁজে নেয়। এপ্রিল মাসের বেতন তখনও দেয়নি কারখানা কর্তৃপক্ষ।

ওই কারখানায় সাত বছর ধরে কাজ করেন শ্রমিক সাইদুল ইসলাম। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই মুহূর্তে চাকরি নাই বলে ফোন করে সবাইকে বলা হচ্ছে। আমরা প্রায় ১১০ জন শ্রমিক আছি কারখানায়। চাকরি হারালে আমরা কোথায় যাবো, কি করবো? এখন তো কোথাও চাকরিও পাবো না।’

প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন বলে বক্তব্য দিয়েছে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (জিটিইউসি)। এমনকি ছাঁটাইয়ের সময় অধিকাংশ কারখানা বকেয়া মজুরিও দিচ্ছে না।

গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামে কেইপিজেডে পাঁচ শতাধিক শ্রমিক ছাঁটাই করে ইনটিমেট এপারেলস লিমিটেড নামে চীনের হংকংভিত্তিক একটি  প্রতিষ্ঠান। সেখানে সাত শতাধিক শ্রমিক কাজ করতেন; কিন্তু গত মার্চ মাসের বেতন দিয়ে পাঁচ শতাধিক শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়। শ্রমিকরা জানান, ছাঁটাইয়ের বিষয়টি যাতে বাইরে প্রকাশ করা না হয় সে জন্য তাদেরকে আবার চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসও দিয়ে রেখেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। যা একটি অপকৌশল বলে মনে করছেন তারা।

ওই কারখানার শ্রমিক পারভিন আক্তার (২৪) জানান, ‘করোনাভাইরাসের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কারখানা বন্ধ হওয়ার পর ৬ এপ্রিল বেতন তুলেছি। এরপর ফ্লোর ইনচার্জ বলে দিয়েছেন- আপাতত কারখানায় না আসতে।’

কর্ণফুলী উপজেলার আশরাফ হোসেন, বান্দরবানের লক্ষীরানী, রাঙামাটির মুন্নি আকতার, রাউজানের ফিরোজা বেগম,হাটহাজারীর আলাউদ্দিন, ভোলার নাসরিন আক্তারসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীকে একই জবাব দেন ফ্লোর ইনচার্জ মহিউদ্দিন।

ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকাগুলোতে প্রায় সবসময়ই আন্দোলন লেগে থাকে বেতন-ভাতার দাবিতে। এই মহামারিতেও আন্দোলন থেমে নেই। আশুলিয়ার সিগমা গ্রুপের পোশাক কারখানার ৭০৩ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে।  মূল ফটকের দেয়ালে নোটিশ লাগিয়ে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরা নিরূপায় হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। তারা কান্নাবিজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘পেটে ভাত নাই! কিসের ঘরে থাকা! আমাদেরকে বেতন না দিয়ে নোটিশ ঝুলাচ্ছে- আপনারা দেখছেন না!’ কারখানার সামনে উপস্থিত ছাঁটাইকৃত শ্রমিক শোভা, মনোয়ারা, সামছুন্নাহার, ফাতেমা, আশরাফুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, কাজলী বেগমসহ অসংখ্য শ্রমিক জানান, হঠাৎ করেই শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই মালিকপক্ষ লে-অফ ঘোষণা করে। কারখানাটিতে শ্রমিকদের দুই মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে।

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মোবাইল ফোনে কারখানার ম্যানেজার আমাকে জানায়- অফিস খুলছে। তোমরা চলে আসো। যেভাবে হোক কারখানায় আসো। তখন আমরা ১২জন প্রত্যেকে এক হাজার টাকা করে দিয়ে ট্রাকে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলিয়াকৈরে আসি। ট্রাকে আমরা বসা ছিলাম। আর আমাদের ওপর ত্রিপল রেখে নিয়ে আসে।’

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা এভাবেই দলে দলে কর্মস্থলে আসছেন। রাস্তায় হাজারটা বাঁধা পেরিয়ে তারা গার্মেন্টসে আসেন। এটাই তাদের জীবন। এ জীবনের কোনো রঙ নেই। মূল্য নেই। আছে শুধু গ্লানি। হাহাকার। অর্ধাহার-অনাহারে রাত পেরিয়ে সকাল হওয়া। এভাবে বেঁচে থাকাটাই যেন সার!

উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের দুই হাজার ৪৫৯টি শিল্প কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করেন সাত লাখ এক হাজার ৪০৪ জন শ্রমিক। এর মধ্যে পুরুষ চার লাখ এক হাজার ৬০ জন ও নারী শ্রমিক রয়েছেন তিন লাখ ৩৪৪ জন। বর্তমানে দুই হাজার ৩৭৬টি কারখানাই বন্ধ রয়েছে,  সচল রয়েছে ৮৩টি।

বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে,  নারায়ণগঞ্জে বিকেএমইএভুক্ত ১৫ শতাধিক কারখানার মধ্যে এখন পর্যন্ত শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতন পরিশোধ করেছে চারশ’র মতো কারখানা। আর বিজেএমইএভুক্ত ২৬৯টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করেছে ৭১টি প্রতিষ্ঠান। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও ছাঁটাইয়ের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ একেক সময় একেক বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে- নারায়ণগঞ্জে চলমান লকডাউনে সব ব্যাংক বন্ধ থাকায় বেতন দিতে দেরি হচ্ছে। অথচ শ্রমিক ছাঁটাই প্রতিমাসে নিয়মানুযায়ী হয়ে থাকে।

শ্রমিক ছাঁটাই প্রসঙ্গে কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘প্রতিমাসেই কারখানাগুলোতে শ্রমিক পরিবর্তন হয়। কোনো শ্রমিক চলে যায় অথবা কাজে অপারদর্শী হওয়ায় ছাঁটাই করে দেওয়া হয়।’ কার্যত এসব অজুহাত দেখিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই অব্যাহত রয়েছে। চলমান করোনা সংকটের মধ্যেও দেশের ৫৫টি পোশাক কারখানায় ২৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। যে সব পোশাক শ্রমিকের চাকরির বয়স এক বছরের কম তাদের জোরপূর্বক চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে। তারা এখন যাবেন কোথায়? এর দায় কার?

 

চার.

করোনাভাইরাসের সময় এরকম বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কোনোরকম সাংগঠনিক পদক্ষেপ ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাবিদাওয়াভিত্তিক আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হলো- আন্দোলনরত শ্রমিকদের জন্য আমাদের করণীয় কি? সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে লড়াইয়ে যুক্ত হওয়াটা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি এ মুহূর্তে শ্রমিকদের পাশে থাকাটাও জরুরি।

এ মুহূর্তে রেশন বা আর্থিক সহায়তার দায়িত্ব সরাসরি রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক উদ্যোগে কেউ ত্রাণ দিতেই পারেন; কিন্তু এটা রাজনৈতিক লাইন হতে পারে না। এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। সরকারকে এজন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এই মহামারির সময়ে সব শ্রমিকদের জন্য রেশন কার্ডের ব্যবস্থা ও সস্তায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যাতে শ্রমিকরা ন্যায্যমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারেন। আগামী তিন মাস সব শ্রমিকের মজুরি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রাপ্য মজুরি, বোনাস ও অন্যান্য পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ করতে হবে। শ্রমিকদের কাজে যোগদান,বেতন-ভাতা পরিশোধসহ যাবতীয় বিষয়ে মালিক ও সরকারের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করতে হবে। কোনোরকমে ছাঁটাই চলবে না। ইনিয়ে-বিনিয়ে শ্রমিকদের বেতন কাটা যাবে না। ঈদ বোনাস দিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও মালিকপক্ষের সিদ্ধানহীনতার কারণে আর কোনো শ্রমিকের যেন মৃত্যু না হয়, ভোগান্তির শিকার না হতে হয়- তা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকরা কর্মাবস্থায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে যথাযথ চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। বর্তমানে এ আশু দাবিগুলো খুবই জরুরি ও যৌক্তিক। আবার এ দাবি আদায়ের সংগ্রাম তখনই জোরদার হবে,যখন শ্রমিকশ্রেণী রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও সংগঠিত ভূমিকা রাখতে পারবে। এ কারণেই দাবি আদায়ের সংগ্রামের সঙ্গেই যুক্ত হবে সংগঠন গড়ে তোলার সংগ্রাম, মতাদর্শিক, রাজনৈতিক সংগ্রাম। শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের গণক্ষমতা কায়েম, বা নয়াগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মুক্তি সম্ভব। সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে এ সংগ্রামই আমাদের পথ দেখাবে।

 

Laboni Mondol is an organizer of Revolutionary Workers Movement.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!