সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া একটা পুলিশের বিবৃতি দিয়ে শুরু করি, দৈনিক প্রথম আলো’তে প্রকাশিত একটি সংবাদে পুলিশের বরাতে এই বয়ানটি উপস্থাপন করা হয়েছে –
“গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ভোররাত চারটার দিকে বরগুনা সদর থানার পুলিশ নয়ন বন্ডকে গ্রেপ্তারের জন্য ওই গ্রামে যায়। ওই গ্রামের খলিল মাস্টারের বাড়ির সামনে গেলে নয়ন বন্ড ও তাঁর সহযোগীরা পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই নয়ন নিহত হন। হামলায় বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহজাহান মিয়াসহ চার পুলিশ সদস্য আহত হন। এঁদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর। তাঁদের বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
…… বরগুনার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবির মোহাম্মদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড পালিয়ে ওই এলাকায় অবস্থান করছেন—এমন তথ্যের ভিত্তিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ পূর্ব বুড়িরচর গ্রামে অভিযান চালায়। পুলিশের অবস্থান টের পেয়ে নয়ন ও তাঁর সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি ছুড়লে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। পরে একজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এটা নয়ন বন্ডের লাশ বলে স্থানীয় লোকজন শনাক্ত করে।
ওসির তথ্যমতে, ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, একটি তাজা গুলি, তিনটি রামদা ও তিনটি গুলির খোসা জব্দ করা হয়েছে। লাশ উদ্ধার করে বরগুনা নিয়ে আসা হচ্ছে”।
এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এই বিবৃতিটি বাংলাদেশের কোনো প্রাপ্তবয়স্ক বিবেচনাবোধ সম্পন্ন মানুষ এখন আর বিশ্বাস করেন না। বরং এই রকমের কোনো একটি বিবৃতি পাঠ করার সময়ই একটা চিত্র হয়তো অনেকের মনেই ভেসে ওঠে যে পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় অভিজাত বাহিনীর একটি দল নয়ন বন্ডকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং একটি খোলা মাঠে তাঁকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে, তারপরে সেই লাশের চারপাশে কয়েকটি ব্যবহৃত গুলির খোসা ছড়িয়ে রাখে এবং পুলিশের সংগ্রহ থেকেই একটি পুরোনো অস্ত্র লাশের পাশে ফেলে রাখে। তারপরে পুলিশেরই ভাড়া করা “গ্রামবাসী”দের দ্বারা এক ধরণের দর্শকের নাটক করা হয়। তারপরে মিডিয়াকে ডেকে এই প্রেস রিলিজ ধরিয়ে দেয়া। এটাই বাস্তবতা, কিন্তু এই বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে গত বিশ বছরে প্রায় দশ হাজার মানুষকে এভাবে খুন করা হয়েছে। এবং প্রচার করা হয়েছে ঠিক উপরের এই বিবৃতিটির মতো করে।
কিংবা ধরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বুশের প্রথম পর্বের সামরিক মন্ত্রী কলিন পাওয়েল যখন জাতিসংঘের মতো একটি সংস্থায় একটি হোমিওপ্যাথির ওষুধের বোতল হাতে নিয়ে সবিস্তারে বর্ণনা করেন যে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের জিম্মায় এমন সব মারাত্মক অস্ত্র আছে যা দিয়ে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব, সাদ্দাম হোসেনের পতন না ঘটালে সারা দুনিয়া এক ভয়াবহ পরিনতি ভোগ করবে। সমগ্র বিশ্ব এই প্রচারনায় মেতে উঠলো যে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের কাছে “ওয়েপন অফ ম্যাস ডেসট্রাকশন” নামের এক মারাত্মক অস্ত্র আছে এবং এই অস্ত্রের একমাত্র টারগেট পশ্চিমা বিশ্ব। জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক দল ইরাকে এমন কোনো অস্ত্রের সন্ধান পাননি, কিন্তু তাঁর পরেও আমেরিকা ও ইংল্যান্ড মিলে ইরাক আক্রমন করলো যার ভয়াবহ পরিনতির কথা আজ আমরা সকলেই জানি। সাম্প্রতিক সময়ে ইংল্যান্ডে “চিলকোট কমিশন” তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে সবিস্তারে লেখা আছে কিভাবে সম্পূর্ণ ভুল ও বানোয়াট তথ্যের উপরে ভিত্তি করে আমেরিকা ও ইংল্যান্ড এই দুই শক্তি ইরাক আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয়। সম্পূর্ণ ভুল ও বানোয়াট তথ্যের উপরে ভিত্তি করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম আধুনিক জনপদ ইরাককে ধ্বংস করে দেয়া হয়। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু ও কয়েক কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার কথা আমরা সকলেই জানি।
কিন্তু কেনো আমেরিকা এই রকমের একটি মিথ্যা অভিযোগ কে সারা দুনিয়াতে বিশ্বাসযোগ্য করে তুললো? কিভাবে সম্ভব হলো সারা বিশ্বকে বোকা বানিয়ে একটি দেশ ও একটি সমৃদ্ধ জনপদকে ধ্বংস করে দেয়া? এবং শুধু ধ্বংস করে দেয়াই নয়, সেই ধ্বংস করে দেয়াকে বিশ্ববাসীর কাছে জায়েজ করে ফেলা এমন কি সেই ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের ইতিহাসকে মুছে ফেলা?
কেনো বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার নাগরিককে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে মিথ্যা প্রেস রিলিজ প্রকাশ করে চলেছে বছরের পর বছর? কেনো এই কাজটিতে সরকার বদলের কোনো প্রভাব পড়েনা? কেনো খালেদা, ফখরুদ্দিন কিংবা হাসিনা সরকারের সকলেই এই ধরণের খুন করার ক্ষেত্রে একই ধরণের পন্থা অবলম্বন করে থাকে সম্পূর্ণ বিনা বাধায়? আর কেনই বা সরকারের এই ধরণের “ক্রস ফায়ার” কে ঠাণ্ডা মাথার খুন জেনেও নাগরিকদের একটা বড় অংশ একে ধীরে ধীরে মেনে নিতে শেখে?
কেনো বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার নাগরিক কে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে মিথ্যা গল্প প্রচার করে আর কেনই বা আমেরিকা –ইংল্যান্ডের মতো কথিত সভ্য পশ্চিমা দেশগুলো অবলীলায় একটি ভিন্ন দেশ দখল করে নেয়, তার জনপদ তছনছ করে দেয়? রাষ্ট্রের এই চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে আমাকে দারুন ভাবে সাহায্য করেন নোম চমস্কি। আজকের এই প্রবন্ধটি নোম চমস্কির লেখালেখি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত। কেনো নোম চমস্কি পাঠ জরুরী সেই প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু মতামত।
২.
নোম চমস্কি, আমেরিকার এমআইটি’র একজন প্রবীন অধ্যাপক এটা আমরা সবাই জানি। তিনি মূলত ভাষাতত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক, ভাষাতত্ত্বে তার মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে এবং সেই সকল অবদানের জন্যে তিনি প্রখ্যাতও বটে। কিন্তু সারা বিশ্বব্যাপী একজন মুক্তিমূখিন বুদ্ধিজীবী হিসাবে তার খ্যাতির মূল কারণ গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁর রাজনৈতিক লেখালেখি, যার প্রধান বিষয় হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষত আমেরিকা ও তার মিত্র দেশসমুহের সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদার নীতি। নোম চমস্কি তাঁর লেখায় তথ্য উপাত্ত সহ ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নিজেদের বানানো বয়ান কে বাস্তবতা বলে প্রচার করে এবং এই সকল বয়ানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দখল নেয়া। সমগ্র পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দখল নেয়াটা কখনও ঘটেছে সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে, কখনও ঘটেছে কোনো দেশে গৃহ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার মাধ্যমে, কখনও কোনো দেশে বা অঞ্চলে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়ে আবার কখনও বা ঘটেছে নিরেট সাহায্য বা “এইড” প্রদানের মধ্যে দিয়ে। এই সকল কৌশলের পেছনে পশ্চিমা শক্তিগুলো ব্যয় করেছে বিপুল অর্থ, মানুষের সময় এবং আধুনিক টেকনোলজি। নোম চমস্কির লেখালেখি ও তাঁর এক্টিভিজম খুব পরস্পর সংলগ্ন, তাই চমস্কির লেখালেখি নিয়ে কথা বলার আগে আসেন দেখে নেই চমস্কির রাজনৈতিক এক্টিভিজম এবং তাঁর লেখালেখির প্রধান এলাকা গুলো কি কি?
Peter R. Mitchell এবং John Schoeffel এর সম্পাদনায় নোম চমস্কির সবচাইতে উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিলো ২০০২ সালে। এই রচনা সংকলনের নাম দেয়া হয়েছিলো “Understanding Power”, এই বইটির আলোচনা করা সম্ভব নয় এখানে, কিন্তু বইটির শিরোনাম বা টাইটেলটি উল্লেখ করার জন্যেই এই প্রসঙ্গের অবতারণা করা। বাস্তবিক অর্থেই নোম চমস্কি আমাদেরকে সাহায্য করেন আধুনিক রাষ্ট্রের বিশেষত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর “শক্তি” বা ক্ষমতা বা পাওয়ার এর স্বরূপ বোঝার জন্যে। আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো কিভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শক্তি অর্জন করে থাকে, কিভাবে সেই সকল শক্তির ব্যবহার হয়ে থাকে আর সেই শক্তি ব্যবহারের পক্ষে জনমত উৎপাদন করে এটাই হচ্ছে নোম চমস্কির সকল কাজের কেন্দ্রীয় বিষয়। তবুও আলোচনার সুবিধার্থে আমরা নোম চমস্কির কাজের কয়েকটি দিক তালিকাবদ্ধ করতে পারি এবং সেসবের উপরে খুব সংক্ষেপে একটা পর্যালোচনা করতে পারি। নোম চমস্কির কাজের এলাকাকে মোটা দাগে এই কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে (এই শ্রেনীবিন্যাস টি একেবারেই আমার নিজের করা এবং বলাই বাহূল্য যে এটা কেবলই আমার নিজের পাঠের উপরে ভিত্তি করে করা, যা সকল অর্থেই সীমিত) –
১ – মুক্তিমুখীন বুদ্ধিজীবীতা বা বুদ্ধিজীবির দায় প্রসঙ্গে
২ – প্রোপাগান্ডা মডেল বা রাষ্ট্র কিভাবে প্রোপাগান্ডা মেশিন গড়ে তোলে ও তাকে ব্যবহার করে জনগনের মাঝে এর বয়ানের স্বপক্ষে সম্মতি উৎপাদন করার জন্যে।
৩ – যুদ্ধের রাজনীতি, কিভাবে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রন অর্জনের জন্যে পৃথিবীর একটা বড় অংশের দেশগুলোর উপরে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ।
৪ – সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সংস্কৃতি
৫ – অ্যানারকিজম বা অরাজবাদ
কোনো সন্দেহ নেই যে চমস্কি একজন বহুবর্ণময় লেখক, তিনি শুধু লিখেছেন তা নয়, পৃথিবীর নানান প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর শ্রোতাদের সম্মুখে বক্তৃতা করেছেন, বিকল্প ধারার মিডিয়ার কাছে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যৌথ ভাবে নানান পন্ডিত মানুষদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিয়েছেন যে সকল আড্ডা পরে অনুলিখন হয়ে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই বিপূল লেখালেখির খুব সামান্য অংশ পাঠ করে অধ্যাপক চমস্কির কাজ নিয়ে কোনো পর্যালোচনামূলক লেখা বা রিভিউ করতে যাওয়াটা দুঃসাহসের কাজ। এই লেখাটি কোনো অর্থেই একটি সম্পূর্ণ লেখা নয়, কেবল মাত্র নোম চমস্কি সম্পর্কে এখনো যারা খুব কম জানেন বা জানতে আগ্রহী সেই সকল তরুন পাঠকের জন্যে এই লেখাটি। তাই এই লেখাটির সকল সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেই আলোচনাটিতে অগ্রসর হতে চাচ্ছি। এটাও সত্যি যে এই প্রতিটি এলাকাই দারুন ভাবে বিস্তৃত এবং জটিল, চমস্কি এই সকল আলোচনা করেছেন অসম্ভব রকমের বিস্তারিত ও গভীর মনযোগ দিয়ে। একেকটি বিষয়কে তিনি খুলে ধরেছেন গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে, অজস্র উদাহরণ, তথ্য, উপাত্ত দিয়ে। তিনি অঞ্চল ধরে ধরে আলোচনা করেছেন। পশ্চিমে, লাতিন আমেরিকায়, মধ্যপ্রাচ্যে, এশিয়ায় প্রতীটি মহাদেশে এমন কি কোনো কোনও ক্ষেত্রে দেশ ধরে ধরে তিনি আলোচনা করেছেন। এই সকল সুবিশাল আলোচনা আজকের এই একটি প্রবন্ধে সার সংক্ষেপ করা খুবই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হবে বিধায় আজকের লেখাটিকে কেবল প্রথম দুটি বিষয়ের উপরে সীমিত রাখছি। আজকের এই প্রবন্ধে মুক্তিমূখীনউদ্ধিজীবিতা ও বুদ্ধিজীবীর দায় এবং প্রোপাগান্ডা মডেল প্রসঙ্গে আলোচনা করছি। বাকী তিনটি প্রসঙ্গ নিয়ে এর পরের পর্বে লেখার পরিকল্পনা রেখে শুরু করছি।
মুক্তিমূখীন বুদ্ধিজীবিতা ও বুদ্ধিজীবীর দায় প্রসঙ্গে
একজন বিদ্যায়তনিক বুদ্ধিজীবী হিসাবে নোম চমস্কি প্রথম তাঁর নিজের এলাকা থেকে বেরিয়ে আসেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ করার জন্যে। তিরিশ পেরোনো নোম চমস্কি তখন সহযোগী অধ্যাপক এবং প্রথমবারের মতো তাঁর প্রতিবাদ জানিয়ে প্রকাশ্যে এক্টিভিজমে যুক্ত হন। এ সময় তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জনমত সংগঠনের কাজ করছেন। কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয়য় অধ্যাপকের দায়িত্ব কি এভাবে পথের সংগ্রাম করা? সেই উত্তরটা দেবার জন্যেই তিনি প্রকাশ করেন তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ “Responsibility of intellectuals” যা তাঁকে প্রথমবারের মতো মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে একজন বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ হিসাবে দেশজুড়ে পরিচিতি এনে দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালে* লিখিত এই প্রবন্ধে নোম চমস্কি ব্যাখ্যা করেন বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সামাজিক দায়িত্ব কি এবং কেনো বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব সাধারণ আম-জনতার চাইতে অনেক বেশী ও গুরুত্বপূর্ণ। মূলত তাঁরও আগে আমেরিকান লেখক, চিত্র সমালোচক Dwight Macdonald এর লেখা একটি প্রবন্ধের সূত্র ধরে তিনি এই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই এর ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়ে Dwight Macdonald প্রশ্ন তোলেন এই বলে যে –
“জার্মানি কিংবা জাপান যে ভয়ংকর ধ্বংস যজ্ঞ চালালো আমেরিকা ও অন্যান্য প্রতিপক্ষের উপরে এই হামলার পেছনে জার্মানির সাধারণ জনগনের দায় কতটুকু? কিংবা উল্টো দিক থেকে আমেরিকা যে হাজার হাজার বোমা বিস্ফোরন করে বহু নাগরিক এলাকা ধ্বংস করলো জাপান বা জার্মানিতে এই ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে আমেরিকান সাধারণ জনগনের দায় কতটুকু?” (১)
চমস্কি এই সূত্র ধরে একই ভাবে প্রশ্ন তোলেন সাধারণ জনগনের চাইতে অনেক বেশী গুনে অগ্রসর অংশ, বুদ্ধিজীবীদের দায় প্রসঙ্গে। তিনি খুব সাদামাটা ভাবেই বলেছেন যে –
“বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের মিথ্যা গুলোকে জনগনের সামনে উন্মোচন করা” ……
“বুদ্ধিজীবিরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই এমন একটা অবস্থানে থাকেন যে রাষ্ট্র ও সরকারের নানান ধরণের মিথ্যাকে উন্মোচন করতে পারেন, রাষ্ট্র ও সরকারের নানান সিদ্ধান্ত ও কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারেন, রাষ্ট্রের নানান উদ্যোগের পেছনে লুকানো আসল কারণগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারেন, তাই বুদ্ধিজীবীদের বিশেষত পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের একটা বিরাট দায়িত্ব হচ্ছে এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা, অন্তত এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার মতো বাক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার তাঁদের আছে”। (১)
সেজন্যেই নোম চমস্কি’র মতে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হচ্ছে জনগনের স্বপক্ষে সত্যকে অনুসন্ধান করা ও সেই সত্যকে জনগনের সামনে প্রকাশ করা। কিন্তু এর পরপরই চমস্কি মন্তব্য করেছেন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হলেও আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের মাঝে এই এই দায়িত্বের প্রসঙ্গে দারুন কালো সব উদাহরণ রয়েছে আমাদের সামনে, তিনি জার্মানির প্রখ্যাত দার্শনিক মারটিন হাইডেগার এর উদাহরণ দিয়েছেন। মারটিন হাইডেগার এর মতো অসম্ভব মেধাবী দার্শনিক শেষ পর্যন্ত হিটলারের স্বপক্ষে কাজ করেন, হিটলারের চরম বর্ণবাদী বয়ানের স্বপক্ষে রাজনৈতিক ও দার্শনিক সমর্থন তৈরী করার জন্যে কাজ করেন। মারটিন হাইডেগার জার্মানির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের একজন, হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হিসাবে শপথ নেন ১৯৩৩ সালের জানুয়ারী মাসের ৩০ তারিখে, তিনি অধ্যাপক হাইডেগার কে ফ্রাইবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেন এপ্রিল মাসের ২১ তারিখে আর তার দশদিন পরে অধ্যাপক হাইডেগার নাজি পার্টিতে যোগ দেন। মাত্র এক মাসের ব্যবধানেই তিনি হয়ে ওঠেন নাজী পার্টির দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গুরুদেবদের একজন। অধ্যাপক চমস্কি অবশ্য আমেরিকানদেরকে এই বিষয়ে আরও চাঁছাছোলা হিসাবে উল্লেখ করেছেন, তিনি হার্ভার্ড অধ্যাপক Arthur Schlesinger এর উদাহরণ উল্লেখ করেছেন এই প্রবন্ধটিতে, এই হার্ভার্ড অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের পদ থেকে পদত্যাগ করে কেনেডি প্রশাসনের প্রোপ্যাগান্ডা উপদেশক হিসাবে যোগদান করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় লোকদের বক্তৃতা লিখে দেবার চাকুরী করেছেন। কিউবার বিরুদ্ধে আমেরিকার চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের নানান ধরণের কর্মসূচীর সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো বিভিন্ন মিডিয়াতে তার প্রকাশিত বক্তব্য ও সত্যিকারের কিউবার বিরুদ্ধে “বে অফ পিগস” আক্রমনের ঘটনার সাথে তার সংশ্লিষ্টতার স্ববিরোধীতা নিয়ে, তিনি অবলীলায় উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি “জাতীয় স্বার্থে” মিথ্যা কথা বলেছিলেন। এই যে “জাতীয় স্বার্থে” মিথ্যা কথা বলার প্রবণতা এই বিষয়টিকে নোম চমস্কি উল্লেখ করেছিলেন এভাবে যে –
“একজন বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ একটা অন্যায্য কারণের স্বপক্ষে মিথ্যা কথা বলে সুখী হচ্ছেন, এটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কিন্তু এর চাইতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই ধরণের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের অপরাপর বুদ্ধিজীবীদের নির্লিপ্ততা, কোনো অনুভূতি নেই …”
এখন ভেবে দেখুন, নোম চমস্কি বুদ্ধিজীবীদের এই দায় সম্পর্কে লিখেছিলেন প্রধানত আমেরিকার প্রেক্ষিতকে বিবেচনায় রেখে। তাও প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশী আগে। আজকের প্রেক্ষিতে কি এই প্রবন্ধটির প্রাসঙ্গিকতা আছে? আজকে কি বুদ্ধিজীবীরা আর বেশী পরিমানে শাসক শ্রেনীর কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া নয়? কিংবা যদি এই প্রবন্ধটিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বা উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে ভেবে দেখা হয়, তাহলেও কি এই প্রবন্ধটি দারুন ভাবে প্রাসঙ্গিক নয়? আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ রাষ্ট্রযন্ত্রের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী হয়ে কাজ করছেন, তাতে তাঁদের বিন্দুমাত্র গ্লানিবোধ নেই, কিন্তু তার চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে দেশের সকল বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের মাঝে এই নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যগণের বিরুদ্ধে ছাত্র অসন্তোষ ও আন্দোলন হচ্ছে। বাংলাদেশে কিভাবে উপাচার্য নিয়োগ হয়, তারা কি করেন, কিভাবে ছাত্রদের বিদ্যায়তনিক কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যান সেসবই আমাদের জানা। আকন্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা এই সকল উপাচার্যগণ মূলত টিকে থাকেন রাষ্ট্রের ও ক্ষমতাসীন দলের তাবেদারী করে। এঁরা শুধু যে ক্ষমতাসীন দলের তাবেদারী করেন তাইই নয়, এঁরা একটা বিরাট শিক্ষক গোষ্ঠী গড়ে তোলেন যাদের কাজ হয় রাষ্ট্রের নানান নিপীড়নমূলক কর্মকান্ডকে নীতিগত বৈধতা দেয়া। বাংলাদেশে এই রীতি চলে আসছে প্রায় চার দশক ধরে অথচ দেশের বিপুল সংখ্যক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এ বিষয়ে রয়েছে এক বিস্ময়কর নির্লিপ্ততা। যদিও আমরা জানি বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশের বিপদের কথা, কিন্তু তারপরেও আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কি তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন?
নোম চমস্কি উদারনৈতিক* বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব প্রসঙ্গে যে আরেকটি বিষয়ের উপরে আলোকপাত করেছেন তা হচ্ছে তাঁদের বস্তুনিষ্ঠা নিয়ে। প্রায় একশো পাতারও বেশী ব্যয় করে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে আমাদের উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা প্রায়শই সমকালিন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেন নিজের পছন্দ মাফিক, তারা সমকালীন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেন অনেকটা নিজেকে সুবিধামতো, নিজের স্বার্থের হানি না ঘটিয়ে, কখনও কখনও রাষ্ট্রের সাথে রাজনীতিবিদদের সাথে বা ক্ষমতাসীন শক্তির সাথে নিজের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে। অধ্যাপক চমস্কি বহু উদাহরণ ও বুদ্ধিজীবীদের ঐতিহাসিক ভুমিকাকে উল্লেখ করে দেখিয়েছে যে কিভাবে বুদ্ধিজীবিরা তাঁদের সময়ের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, কিভাবে উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা প্রায়শই ভিন্ন দেশে যুদ্ধের সম্পক্ষে মতামত সংগঠনের বাহন হিসাবে কাজ করেছেন, দেশে ফ্যাসিবাদী সরকারের স্বপক্ষে নিজেদের মতামত কে ব্যবহৃত হতে দিয়েছেন। বুদ্ধিজীবীদের এই ধরণের অবস্থানকে তিনি উল্লেখ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির বস্তুনিষ্ঠতার লঙ্ঘন।
সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশে একটি নজিরবিহীন কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে জনগনের ম্যান্ডেট বিহীন একটি সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সকলেই জানি, দেশী বিদেশী নানান পর্যবেক্ষণ থেকে যে এই নির্বাচনটি একটি গণ-কারচুপির নির্বাচন ছিলো। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি যে এই নির্বাচনকে “জায়েজ” করার জন্যে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের বহু মানুষ প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য অধ্যাপক মুনতাসির মামুন নির্বাচনের আগে ও পরে প্রকাশ্যে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন এই ম্যান্ডেট বিহীন সরকারের “প্রয়োজনীয়তা” ব্যাখ্যা করে।
প্রোপাগান্ডা মডেল ও সম্মতি উৎপাদন
ভাষাতত্ত্বের তাত্ত্বিক অবদানের বাইরে নোম চমস্কির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্ভবত তার “প্রোপাগান্ডা মডেল”। এটা একটা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বা ধারণা যা নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড হারম্যান মিলে গড়ে তোলেন। তাঁরা দুজন ১৯৮৮ সালে প্রথম এই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটি পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন। এই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় তাঁরা দেখিয়েছেন কিভাবে রাষ্ট্র তার নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে বিরাট আকারের প্রোপাগান্ডা বা মিথ্যা প্রচারনা গড়ে তোলেন আর এই প্রোপাগান্ডাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে কিভাবে তারা গণমাধ্যম নামের করপোরেইট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে। চমস্কি ও হারম্যান ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে আধুনিক কালের এই সকল “গণমাধ্যম” নামের প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে একেকটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যাঁদের মূল উদ্দেশ্য আসলে জনগনের কাছে বিজ্ঞাপন বিক্রি করা, সংবাদ পৌছে দেয়া নয়, বরং সংবাদ নামে তারা যা জনগনের মাঝে ছড়িয়ে দেয় সেটাও আসলে রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন শক্তির প্রচারনা।
এই প্রোপাগান্ডা মডেল এর সাথে তিনি যুক্ত করেন সম্মতি উৎপাদন বা “ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট” এই ধারণাকে। অর্থাৎ কিভাবে জনগনের মাঝে মিথ্যা প্রচারনা চালিয়ে এক ধরণের সম্মতি উৎপাদন করা হয়। ঠিক যেভাবে বাংলাদেশে কেউই এখন আর অভিজাত বাহিনী র্যাব এর প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিশ্বাস করেনা, কিন্তু রাষ্ট্র ও তার প্রোপাগান্ডা যন্ত্র ঠিকই এক ধরণের নীরব সম্মতি আদায় করেছে জনগনের কাছ থেকে যে এই ধরণের “ভয়ংকর”সন্ত্রাসীদেরকে আসলে বিচার প্রক্রিয়ায় নেয়ার চাইতে হত্যা করাটাই “শ্রেয়”। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেনীর একটা বিরাট অংশ মনে করে যে এই সকল হত্যাকান্ড সমাজের জন্যে “এক রকমের” কল্যাণই বয়ে আনে, কেননা এই ধরণের “ভয়ংকর” অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রোপ্যাগান্ডা শুধু যে মিথ্যা বয়ান প্রচার করে তা নয়, বরং এই বিপুল মিথ্যাচার প্রচার করার সাথে সাথে জনগনের একটা বিরাট অংশকে সে এর সমরথকে পরিনত করে। ফলে আজকের বাংলাদেশে আমরা দেখেছি সরকারের নানান অপকর্মের বিপক্ষে এক ধরণের বয়ান হাজির করা হচ্ছে – “কিন্তু বিকল্প কি?” অর্থাৎ যেহেতু বিকল্প নেই সুতরাং এই রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন সরকারের সকল দুষ্কর্ম “ঠিক আছে”, এটা হচ্ছে এক ধরণের সম্মতি আদায়ের নমুনা। বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটেছে এই রকমের হাজার রকমের “সম্মতি” আদায়ের ঘটনা যা নীতিগত ভাবে একজন নাগরিক কখনই সমর্থন করেন না, কিন্তু বৃহৎ প্রোপাগান্ডার অংশ হিসাবে তারাও এর অংশ হয়ে দাঁড়ান।
চমস্কির লেখালেখির সবচাইতে শক্তিমান দিক হচ্ছে নোম চমস্কি ইতিহাসের নানান প্রান্ত থেকে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া হাজার হাজার তথ্য ও উপাত্ত হাজির করেন। প্রোপ্যাগান্ডা মডেল বোঝানোর জন্যেও তিনি একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তার নানান প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও বইয়ে। Chomsky Reader নামের একটি সংকলনে তিনি উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করেছেন আমেরিকান আদিবাসীদের বিষয়ে বর্তমান আমেরিকার প্রোপাগান্ডা বিষয়ে। বাস্তব ইতিহাস হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ দখলদারদের হাতে ঝাড়ে বংশে নিহত হয়েছিলেন আমেরিকান আদিবাসীরা। শ্বেতাঙ্গ দখলদারেরা, যাঁদের আদি প্রতিনিধি ছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস, তার নেতৃত্বে নির্মম জেনোসাইড চালানো হয়েছিলো আমেরিকান আদিবাসীদের উপরে। কিন্তু আধুনিক আমেরিকান’রা জানে যে আদিবাসী আমেরিকানরা এই আধুনিক আমেরিকানদেরকে তাঁদের জমি “দিয়েছিলেন” যেনো এই শ্বেতাঙ্গ “আধুনিক”মানুষদের হাত ধরে আমেরিকা এগিয়ে যেতে পারে। আমেরিকানরা আজ এটাকেই সত্যি হিসাবে গ্রহন করেছে যে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা আসলে আদিবাসীদের উপরে জেনোসাইড চালায়নি, বরং আদিবাসীরাই তাঁদেরকে আলিঙ্গন করে এই ভুমির দায়িত্ব দিয়েছিলো। চমস্কি ও হারম্যান দেখিয়েছেন প্রোপ্যাগান্ডা শুধু যে মানুষকে সুবিধাজনক বয়ানে অভ্যস্থই করেনা, তাদেরকে ভুলিয়ে দেয় সত্য ইতিহাস। সত্য ইতিহাসই হয়ে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ।
চমস্কি ও হারম্যান তাঁদের এই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে মেলে ধরার জন্যে অজস্র “কেইস স্টাডি” ব্যবহার করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন কিভাবে রাজনীতী ও অর্থনীতির নানান উদ্দেশ্যে এই “প্রোপাগান্ডা”কে ব্যবহার করা হয়েছে উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় হিসাবে। সারা বিশ্বব্যাপী মার্কিন ও তার মিত্রদের অর্থনৈতিক দখলদারিত্বের জন্যে কিভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলো রাজনীতিতে এই কৌশল ব্যবহার করেছে। কিভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলো লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানোর কাজে এই সকল প্রচারনা কৌশল কে কাজে লাগিয়েছে। আবার কিভাবে নানান অগনতান্ত্রিক শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে সেটা সাফাই করার কাজে প্রচারনাকে কাজে লাগিয়েছে। কিভাবে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার নানান সামরিক শাসকের সাথে পশ্চিমা কথিত “গণতান্ত্রিক” শক্তির মৈত্রীকে প্রচারনা দিয়ে নৈতিক বৈধতা দেয়া হয়েছে। এই প্রবন্ধের শুরুতেই একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়েছিলাম, জাতিসংঘে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কলিন পাওয়েল এর বক্তৃতা যেখানে ইরাকে এক মহাশক্তিধর অস্ত্রের কথা জানান দেয়া হয়েছিলো সারা পৃথিবীকে। কিন্তু আজ আমরা সবাই জানি এমন কি পশ্চিমা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও স্বীকার করেছে যে ইরাকে আসলে সেই রকমের কোনো অস্ত্রই ছিলোনা। সমগ্র বিষয়টি ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ব্রিটেনের একটা সাজানো প্রোপ্যাগান্ডা মাত্র। একটি মিথ্যার উপরে ভর করে একটি জাতি ও একটি দেশকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এই কাজটির স্বপক্ষে গড়ে তোলা হয়েছিলো এক বিশাল প্রচারনা। ইরাক যুদ্ধের প্রাক্কালে পৃথিবীর সবকটি মিডিয়া তাদের সরবোচ্চ সময় ব্যয় করেছিলো এই যুদ্ধের ন্যায্যতা প্রমান করার জন্যে। আমেরিকার তথ্য সচেতন উচ্চ শিক্ষিত মানুষদের একটা বিরাট অংশ বিশ্বাস করেছিলো যে ইরাককে ধ্বংস করা না গেলে সারা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু কেনো পশ্চিমা “আধুনিক” ও “গণতান্ত্রিক” রাষ্ট্র গুলো এই ধরণের হিমালয় সময় প্রোপ্যাগান্ডার সংস্কৃতি গড়ে তোলে? এই প্রশ্নের একটা আগ্রহউদ্দীপক উত্তর পাওয়া যায়, প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এর ঊর্ধ্বতন পরামর্শক কার্ল রোভ এর একটা উদ্ধত ও তাচ্ছিল্যভরা ব্যাখ্যায়, মূলত নোম চমস্কিকেই ইঙ্গিত করে এই যুদ্ধবাজ পরামর্শক বলেছিলেন এভাবে -“we’re an empire now, and when we act, we create our own reality. And while you’re studying that reality – judiciously, as you will – we’ll act again, creating other new realities, which you can study too, and that’s how things will sort out. We’re history’s actors … and you, all of you, will be left to just study what we do”.
“আমরাই হচ্ছি এখন একমাত্র সাম্রাজ্য, আমরা যখন কাজ করি, আমরা দুনিয়াটাকে, বাস্তবতাকে আমাদের মতো করে তৈরী করি। আর যখন আপনারা সেই বাস্তবতাকে পাট করেন, বিবেচনাবোধের সাথেই পাঠ করেন, এবং আপনারা ভবিষ্যতেও করবেন, আমরা তখন আবারো সক্রিয় হবো আমাদের নতুন বাস্তবতা গড়ে তোলার জন্যে, এবং সেটাও আপনারা পারবেন বটে, এবং এভাবেই চলতে থাকবে। আমরা হচ্ছি ইতিহাসের কর্তা, আর হ্যাঁ আপনি, আপনারা, আপনাদের কাজ হবে শুধু পড়া, আমরা যা তৈরী করি তা পাঠ করা”।
শুধুমাত্র সাম্রাজ্য গড়ে তোলার জন্যে, সাম্রাজ্য দখল করার জন্যে, দখলে রাখার জন্যে পশ্চিমা শক্তিগুলো ঠিক এইভাবেই “নয়া বাস্তবতা” কে গড়ে তোলে, যে বাস্তবতা সাধারণ মানুষের বাস্তবতা নয়, যে বাস্তবতা পশ্চিমা শক্তির, দখলদার শক্তির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে গড়ে তোলার জন্যে প্রোপ্যাগান্ডা ও যুদ্ধের এই বিশাল আয়োজন। আর চমস্কি কিংবা তাঁর মতোন মুক্তিমূখীন বুদ্ধিজীবিরা আমাদেরকে জাগিয়ে তোলেন, জাগিয়ে রাখেন এই সকল প্রোপাগান্ডাকে বোঝার জন্যে আর সেজন্যেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে সারা দুনিয়াকেই পড়তে হচ্ছে চ্যালেঞ্জের মুখে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে তাই প্রতিনিয়তই নতুন বাস্তবতা গড়ে তুলতে হয় নিজের বৈধতা ধরে রাখার জন্যে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিপরীতে এই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই এ চমস্কি সন্দেহাতীত ভাবেই একজন প্রেরণাদায়ী মানুষ।
Muhammad Golam Sarowar is a Bangladeshi blogger, his main interest is in politics and role of western powers in the rest of the world. He has translated Two books of Noam Chomsky and a keen reader of alternative thinkers like Chomsky. He writes in MuktoMona and in his personal blog (sarowar-blog.com).
রেফারেন্স ও তথ্যসূত্রঃ
Responsibility of intellectuals
Understanding Power: The Indispensible Chomsky Paperback – February 1, 2002, Noam Chomsky (Author), John Schoeffel (Editor), R. Mitchell (Editor)
Manufacturing Consent: The Political Economy of the Mass Media, Edward S. Herman and Noam Chomsky Jan 15, 2002
The Chomsky Reader, Noam Chomsky – Pantheon; 1 edition, September 12, 1987
* ইংরেজী Liberal শব্দের সাধারণ শব্দের বাংলা অর্থ উদারনৈতিক হয়। তবে পশ্চিমে রাজনৈতিক ধারা হিসাবে বামপন্থি এমনকি কমিউনিস্টদেরকেও প্রায়শই সাধারণ অর্থে Lliberals বলা হয়ে থাকে।