এখানে চলে আরেকটা বড় ধরনের বাণিজ্য। আপনার সিনেমা কয়টি সিনেমা হল পাবে তা ঠিক করবে এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে আপনি যত মাল ঢালতে পারবেন আপনার সিনেমা তত বেশি সিনেমাহল পাবে। আবার আপনার সিনেমা একটি সিনেমাহলে কতদিন থাকবে তাও নির্ধারণ করেন এই সিন্ডিকেট। অর্থ্যাৎ আপনি চতুষ্টয় দুষ্টু সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে সিনেমা সেন্সর করালেন। এবার এই সিন্ডিকেট আপনার সিনেমার রিলিজ ডেট নিয়ে আপনার সাথে দরদামের খেলা খেলবে। আপনার পছন্দের তারিখে আপনি সিনেমা মুক্তি দিতে পারবেন না। এই সিন্ডিকেটের পছন্দের তারিখে আপনাকে সিনেমা মুক্তি দিতে হবে! এই সিন্ডিকেট যতক্ষণ আপনার হয়ে কাজ করবে ততক্ষণ আপনার সিনেমা সিনেমাহলে থাকবে। এরা নাখোস হওয়া মাত্র আপনার সিনেমা সিনেমাহল থেকে নেমে যাবে।
শুরুর কথা:
আপনারা সবাই জানেন যে আমি ‘হরিবোল’ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি। আমার নিজের প্রতিষ্ঠান ‘বলেশ্বর ফিল্মস’-এর ব্যানারে ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে শুরু হওয়া ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রটির নির্মাণযজ্ঞ শেষ হয় ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে। অবশেষে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আমি ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেই।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্রে সেন্সর জটিলতা:
সাধারণত বাংলাদেশে একটি ছবি’র সেন্সর হতে কমপক্ষে ৭ দিন থেকে সর্বোচ্চ এক মাস সময় লাগে কিন্তু আমার জন্য এটি হয়ে গেল পথের কাঁটা। ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড থেকে (নং-১৫.৫৯.০০০০.০০৪.৩১.০৪৯.১৯-২৫২৩) চিঠির মাধ্যমে ‘হরিবোল’ পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ডিজিটাল চলচ্চিত্রের সেন্সর আবেদনপত্রের সাথে সংযুক্তি কাগজ হিসেবে বিএফডিসি’র ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। আমি আমার বক্তব্যে ১৭টি পয়েন্ট তুলে ধরে সেন্সর বোর্ডকে অবহিত করি কেন স্বাধীন নির্মাতা হিসেবে আমার ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের জন্য বিএফডিসি’র ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র প্রযোজ্য নয়।
আমি বরং বিএফডিসি’র ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র জমা দেওয়ার এই প্রক্রিয়াকেই বাংলাদেশে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্ণিত করি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড আমার উপস্থাপিত যুক্তিগুলো যথাযথভাবে খতিয়ে দেখবে।
এরপর শুরু হয় চিঠি চালাচালি:
আমার উপরোক্ত চিঠির জবাবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড থেকে আবারো আমাকে চিঠি দিয়ে বিএফডিসি’র ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র চাওয়া হয়। আমি তখন আবার বিএফডিসিতে যাই বিএফডিসি’র ছাড়পত্রের জন্য। তখন বিএফডিসি থেকে আমাকে একটি তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই তালিকায় সেই পুরানো কাসুন্দি। বিএফডিসিকে আগে চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি ও চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্যপদ দেখাতে হবে। তারপর তাদের ফান্ডে এক লাখ টাকা জমা দিতে হবে। তারপর আমি বিএফডিসি থেকে ছাড়পত্র পাব।
আমি তখন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডকে আবারো চিঠি লিখলাম। সেখানে আবারো উল্লেখ করলাম যে, আমার বলেশ্বর ফিল্মস প্রযোজিত ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ বলেশ্বর ফিল্মস-এর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নির্মিত হয়েছে। বিএফডিসিকে ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের কোনো পর্যায়ে কোথায়ও কাজে লাগানো হয় নাই। বিএফডিসি’র কোনো ইকুইপমেন্টস যেমন ক্যামেরা, লাইট বা প্রোডাকশনের কিছুই ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয় নাই। এমনকি বিএফডিসি’র কোনো শুটিং লোকেশানেও ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্য ধারণ করা হয় নাই।তাই বিএফডিসি’র কথিত ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের জন্য মোটেও প্রযোজ্য নয়।
একজন লেখকের বইপ্রকাশের জন্য কোনো লেখকের যেমন বাংলা একাডেমি থেকে কোনো ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয় না, একজন চিত্রশিল্পীকে যেমন তার চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর জন্য শিল্পকলা একাডেমি থেকে কোনো ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয় না, একজন কৃষকের কোনো ফসল তৈরির জন্য যেমন কৃষি মন্ত্রণালয় বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয় না, তেমনি একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমার নির্মিত ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের জন্য বিএফডিসি’র কোনো ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্রের প্রয়োজন থাকতে পারে না।
আমি বাংলাদেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ‘হরিবোল’ নামে যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছি, সেখানে বিএফডিসি’র কোনো ধরনের কোনো যোগসূত্র ছিল না। তাই বিএফডিসি থেকে ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের জন্য কোনো ছাড়পত্রের প্রয়োজন থাকতে পারে না।
এভাবে বেশকিছু চিঠি বিনিময় করার একপর্যায়ে আমার চিঠির জবাবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড আর কোনো সাড়া দেয়নি। যদিও মৌখিকভাবে তারা আমাকে বেশ কয়েকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, যদি বিএফডিসি’র কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে তারা আমার’ হরিবোল’ চলচ্চিত্রের সেন্সর সনদপত্র দিয়ে দেবেন। তারপর দফায় দফায় আমি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান ও সচিবের সাথে দেখা করেছি। কিন্তু আমার ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের সেন্সর সনদপত্র এখন পর্যন্ত পাই নাই।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সেন্সর আইন:
১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার চলচ্চিত্রের সেন্সরের জন্য যে আইন প্রবর্তন করেছিল, সেই আইন অনেকটাই অবিকল রেখে কেবল দেশের নাম বদল করে (পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ) ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৪১ হিসেবে গৃহীত হয়। এরপর এই আইনকেই ১৯৭৭ সালে কিছুটা সংশোধন আকারে নতুন মোড়কে করা হয়। এরপর ২০০৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আবারো কিছুটা সংশোধন আকারে নতুন আইন করা হয়। উল্লেখ্য, এই আইনের অধিকাংশ বিধি মূলত ১৯১৮ সালে করা ব্রিটিশদের চলচ্চিত্র আইনের নিয়ম-কানুন।
গোটা বিশ্বে চলচ্চিত্র এখন যেখানে অবস্থান করছে এবং গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্র বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে দেখার সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সরকারের প্রবর্তিত চলচ্চিত্র সেন্সর আইন দিয়েই (কিছুটা সংশোধনী আকারে) কর্তৃপক্ষ চালিয়ে যাচ্ছে। যা যুগের সাথে এমন কি বিজ্ঞানের অগ্রসরতার সাথে কোনোভাবেই যুতসই নয়। ১৯১৮ সালের যে পৃথিবী কিংবা ১৯৬৩ সালের যে পৃথিবী কিংবা ১৯৭৭ সালের যে পৃথিবী এমনকি ২০০৬ সালের পৃথিবীর সাথেও ২০২০ সালের পৃথিবীর যে পার্থক্য, সেই পার্থক্য চলচ্চিত্র সেন্সর আইনে মোটেও প্রতিফলিত হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন চলচ্চিত্রের জন্য কোনো ধরনের সেন্সরই নেই। বরং সেসব দেশে চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ড চলচ্চিত্র দেখার পর বয়স অনুযায়ী ক্যাটাগরি ভাগ করে দেয়। যেমন- অমুক চলচ্চিত্রটি ১৩ বছরের উর্ধ্বে, বা১৮ বছরের উর্ধ্বে বা ২১ বছরের উর্ধ্বে বয়সী মানুষদের জন্য প্রযোজ্য। বা অমুক চলচ্চিত্রটি সব বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য।
কিন্তু ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড’-এর পরিবর্তে একটি মহল নতুন করে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ নামে একটি নতুন প্রহসনমূলক আইন করার চেষ্টা করছেন। যেটি ‘দ্য সেন্সরশিপ ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩ (সংশোধিত ২০০৬)-এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’ নামে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনের খসড়া যতটুকু আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আরো কঠোর থেকে কঠোরতর সব শর্ত দিয়ে আটকে রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে। যদিও এই আইনটি এখন পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে রয়েছে। আইন হিসেবে কার্যকর হয়নি।
নতুন এই আইনের খসড়ায় আইন শৃঙ্খলার স্বার্থে, স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্পের স্বার্থে, অথবা যে কোনো জাতীয় স্বার্থে একটি সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেট আদেশ জারির মাধ্যমে সার্টিফিকেট বাতিল করা যাবে। আরো জানা যায়, কোনো সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র যদি‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’-এর যে কোনো ধারা ভেঙে প্রদর্শন করা হয় সেক্ষেত্রেও সার্টিফিকেট বাতিল করা যাবে আদেশ জারির মাধ্যমে। নতুন এই আইনটি চালু হলে তা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য ভয়ংকর অশুভ সংকেত নিয়ে আসবে।
অথচ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ ঠিক করার জন্য যেখানে আরো যুগপোযুগী চলচ্চিত্র আইন করা জরুরি, সেখানে আমরা হাঁটছি আরো পেছনের দিকে। এখানে চলচ্চিত্রকে কঠোর আইনের বলি বানানোর যত আইনের কথা ভাবা হয়, চলচ্চিত্র শিল্প মোটেও তা নয়। বরং আইনে যেটা আটকে দেওয়া হয়, ওইটুকু না থাকলে সেটা শিল্প হয় না। আর শিল্পকে আইন দিয়ে বেধে রাখার যে কোনো ধরনের চেষ্টাই শিল্পকে ধ্বংস করার সামিল।
এমনকি খোদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে শত্রু দেশের উপর আক্রমণ করার নির্দেশনা ছিল। কোনো দেশের কোনো জাদুঘর, প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা এগুলো ধ্বংস না করার ব্যাপারে খোদ যুদ্ধেই নির্দেশনা থাকে। সেখানে আইন করে চলচ্চিত্রের শিল্পটুকু ধ্বংস করা মানে, এই শিল্পের বিকাশ নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে আটকে রাখা। যা চলচ্চিত্রের জন্য মোটেও সুখকর ব্যাপার নয়। মুক্তচিন্তার মত চলচ্চিত্র যতক্ষণ স্বাধীন ও মুক্ত না হবে, ততক্ষণ একটি দেশ সত্যিকার অর্থে শিল্প ও সংস্কৃতিতে অগ্রসর হতে পারবে না।
বর্তমান চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড:
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড ১৫ সদস্য নিয়ে গঠিত। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে চলতি বছরের জন্য (সাধারণত এক বছরের জন্য)বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এবারের সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা হলেন- ১. সচিব, তথ্য মন্ত্রণালয় (চেয়ারম্যান), ২. সচিব, আইন মন্ত্রণালয় (সদস্য), ৩. প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব (সদস্য), ৪. অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও চলচ্চিত্র), (সদস্য), ৫. জননিরাপত্তা প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (সদস্য), ৬. ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএফডিসি (সদস্য), ৭. শেখ সাদী খান, সংগীত পরিচালক (সদস্য), ৮. ম. হামিদ, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব (সদস্য), ৯. শাবান মাহমুদ, সাংবাদিক (সদস্য), ১০. আবদুস সামাদ খোকন, চলচ্চিত্র পরিচালক (সদস্য), ১১. খোরশেদ আলম খসরু, সভাপতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি (সদস্য), ১২. মুশফিকুর রহমান গুলজার, সভাপতি, পরিচালক সমিতি (সদস্য), ১৩. অরুণা বিশ্বাস, অভিনেত্রী (সদস্য), ১৪. রানা হামিদ, অভিনেতা (সদস্য) এবং ১৫. ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড(সদস্য সচিব)।
এখানে একটা বিষয় খেয়াল করার আছে। চলচ্চিত্র আইনের ধারা ৩-এ সুস্পষ্টভাবেই বলা আছে যে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে কোনো ভাবেই ১৪ জনের বেশি সদস্য রাখা যাবে না। কিন্তু সরকারিভাবে চলতি বছরের জন্য যে বোর্ড গঠন করা হয়েছে সেখানে সদস্য রাখা হয়েছে ১৫ জন।প্রশ্ন হলো এই নিয়ম ভঙ্গের কারণ কী? চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের আইনে যেখানে সুস্পষ্ট ভাবেই ১৪ জনের বেশি সদস্য রাখার বিধান নাই,সেখানে বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখেছি ১৫ সদস্য বিশিষ্ট সেন্সর বোর্ড। তাহলে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে সেটি হলো- যে সেন্সর বোর্ড আইনের তোয়াক্কা না করেই আইন লঙ্ঘন করে গঠন করা হয়, সেই বোর্ড যে চলচ্চিত্রের জন্য আরো আইন লঙ্ঘন করবে তা কিন্তু শুরুতেই দিনের আলোর মতই পরিস্কার।
এবার একটু এই সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক। তালিকার ১ থেকে ৬ এবং ১৫ নম্বরের এই ৭ জন সদস্যের সবাই সরকারি আমলা। এবং তাদের চাকরি কিছুদিন পরপর অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়। চলচ্চিত্রের মত একটি সিরিয়াস মাধ্যমে এরকম বদলি পরায়ণ নতুন নতুন আমলা দিয়ে চলচ্চিত্রের কী লাভ হচ্ছে? প্রতি বছরের জন্য গঠিত সেন্সর বোর্ডে উপরোক্ত ৭ জন সদস্য থাকেন।
এবার আসুন বোর্ডের অপর ৮ জন সদস্যের ব্যাপারে। ২০১৯ সালের সেন্সর বোর্ডেও ৭, ৮, ৯, ১১, ১৩ ও ১৪ নম্বরের ৬ জন সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন। আর নিয়ম অনুযায়ী, যারাই যখন প্রযোজক ও পরিচালক সমিতির সভাপতি থাকেন, তারাই ক্ষমতাবলে সেন্সর বোর্ডেরও সদস্য হন।
এবার আসুন সিন্ডিকেট কীভাবে গঠিত হয়- তার একটা সরল ব্যাখ্যা করা যাক। বিএফডিসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাধারণত(সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও) চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি ও পরিচালক সমিতির ইশারার বাইরে একটা কথাও বলেন না। আবার সেন্সর বোর্ডের যিনি সদস্য সচিব তিনি সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান। তিনিও একজন আমলা। আবার এফডিসির যিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনিও একজন আমলা। এই দুই আমলা মিলে প্রযোজক সমিতি ও পরিচালক সমিতির সভাপতিদের সাথে যোগসাজশ করে একটি চতুষ্টয় সিন্ডিকেট তৈরি করেন।
এবার আরেকটা বিষয় খেয়াল করুন- চলচ্চিত্র সেন্সর আবেদনপত্রের নির্ধারিত ফরমে (পৃষ্ঠা-৩) বর্ণিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের কোথাও বিএফডিসি’র ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র জমা দেবার কোনো উল্লেখ নাই। অথচ সেন্সর বোর্ডে একটি চলচ্চিত্র জমা হবার পর সেই অদৃশ্য বিএফডিসি’র ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র জমা দেবার জন্য সেন্সর বোর্ড নির্মাতাদের উপর চাপ তৈরি করেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের’ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখের ২৩২ সংখ্যক স্মারকে ঘোষিত বিএফডিসি’র ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র ব্যতিরেকে চলচ্চিত্রের সনদপত্র ইস্যু না করার নির্দেশনাটি’ তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বরাবর অনুলিপি পাঠিয়ে একটা বিধি করা হয়েছে। কিন্তু সেই স্মারকের দোহাই দিয়েই আমার’হরিবোল’ চলচ্চিত্রকে সেন্সরে আটকে রাখা হয়েছে।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো বিএফডিসি এবং প্রযোজক ও পরিচালক সমিতির ফান্ডে যে টাকা জমা দেওয়ার নিয়ম এই দুষ্ট সিন্ডিকেট করেছে, সেই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি চালানে জমা হয় না। জমা করার নিয়ম সরাসরি এদের ফান্ডে। যার সুস্পষ্ট অর্থ হলো- খোদ সরকার এই টাকার কোনো ভাগ পায় না। যদি সরকারি ফান্ডে টাকা জমা দেওয়ার বিধান থাকতো তাহলে এই সিন্ডিকেটের এটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা হতো না। যেহেতু এই টাকা তারা ভাগাভাগি করে নেয়, তাই এই টাকা না পাওয়া পর্যন্ত তারা সেন্সর বোর্ডে জমা হওয়া যে কোনো চলচ্চিত্রের জন্য কথিত ওই বিএফডিসি থেকে ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র আনার কথা তোলেন।
যারা স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, এই সিন্ডিকেট কেবল তাদেরকেই টার্গেট করেছে এই ধরনের চাঁদাবাজির জন্য। যা সরকারিভাবে যেমন ফাঁকফোকরের আড়ালে রয়ে যায় তেমনি স্বাধীন নির্মাতাদের জন্য এটা একটা বড় ধরনের অভিশাপ। একজন স্বাধীন নির্মাতাকে যদি তিন/চার লাখ টাকা শুধু চলচ্চিত্রের সেন্সর করানোর জন্য খরচ করতে হয়, তাহলে কীভাবে তারা চলচ্চিত্র নির্মাণের মত একটি সৃজনশীল পেশায় টিকে থাকবে। খেয়াল করুন, যারা এফডিসি ঘরনার নির্মাতা, তাদের এই কথিত বিএফডিসি থেকে ছাড়পত্র/অনাপত্তিপত্র নিতে কোনোখরচ নাই। স্বাধীন নির্মাতাদের দমন করার জন্য সরকারের ভেতরেই এই চতুষ্টয় সিন্ডিকেট আরেকটি ছায়া-সরকার।
আর যারা চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য তারা সবাই সরকারিভাবে একটা নির্ধারিত সম্মানিভাতা পান। পাশাপাশি চলে এই টু-পাইস ধান্ধা।আর বারবার এই সিন্ডিকেট সরকারি আমলা ছাড়া অন্য যে আটজন সদস্যকে (যারা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট) সেন্সর বোর্ডের সদস্য করেন, সেখানেও সুস্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব দিবালোকের মত পরিস্কার।
প্রশ্ন হচ্ছে- বিএফডিসিতে কাজ না করলে সেই চলচ্চিত্রের জন্য তাদের ছাড়পত্র লাগবে কেন? যার সাথে কোনো লেনদেন হয়নি তার থেকে দুইলাইনের ছাড়পত্র (বিএফডিসি’র কাছে অমুক চলচ্চিত্রের কোনো দেনা-পাওনা নাই) নিতে একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাকে কেন এত ঘাটের জল খেতে হবে? কেন একজন স্বাধীন নির্মাতাকে এত টাকার চাঁদা দিতে হবে? তাহলে এদেশে চলচ্চিত্রের উন্নয়নটা হবে কীভাবে? এই যদি হয় আইনের মারপ্যাচ, এই যদি হয় সেন্সর বোর্ডের চরিত্র, তাহলে এদেশে সিনেমার বিকাশ কীভাবে সম্ভব?
কোনো বেসরকারি সমিতির সদস্যপদ কোনো প্রযোজক বা পরিচালক কেন নিবেন? যদি সেই সমিতি থেকে তার চলচ্চিত্রের জন্য লাভজনক কিছু থাকে তাহলেই কেবল তিনি স্বেচ্ছায় সেখানে সদস্য হবেন। কিন্তু এসব সমিতি তো একজন স্বাধীন নির্মাতাকে কোনোভাবেই সহযোগিতা করেন না বরং সিনেমা মুক্তি পাবার আগেই এদের কাছে চাঁদাবাজির শিকার হন। তাহলে এদের সদস্য কেন হবেন? আর একবছরের জন্য সদস্য ফি এত টাকা কেন হবে? এটা তো নামমাত্র মূল্যে একটা ফি হবার কথা। যাতে দেশের সকল প্রযোজক ও পরিচালক নিজেদের সুবিধার জন্য এসব সমিতির সম্মানিত সদস্য হবেন। বছর শেষে নামমাত্র মূল্যে সদস্যপদ নবায়ন করবেন। কিন্তু চাঁদাবাজির শিকার হবেন অথচ নিজেদের সিনেমার জন্য এসব সমিতি কোনো কাজে লাগবে না, তাহলে এসব সমিতির কেন সদস্য হবে?
আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করুন- তিন লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে একজন স্বাধীন নির্মাতা সিনেমা সেন্সর করানোর পর পরবর্তী সিনেমা নির্মাণ করতে এক বছরের মধ্যে সম্ভব হয় না। কিন্তু পরবর্তী সিনেমা সেন্সর করানোর জন্য স্বাধীন সেই নির্মাতাকে আবারো এই সিন্ডিকেটেরচাঁদাবাজির শিকার হতে হবে- এই যে সাইকেল, এই যে চক্র, এই যে চাঁদাবাজির ধরণ, এটা স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দমন করার একটা হাতিয়ার। বাংলাদেশে এই সিন্ডিকেটের কারণে স্বাধীন নির্মাতারা সবসময় ভিকটিম। একটি দেশের চলচ্চিত্র মাধ্যমে এই ধরনের প্রহসন কোনো ভাবেই চলতে পারে না। কিন্তু এদেশে তাই চলছে!
চলচ্চিত্র মুক্তি নিয়ে নাটক:
একজন প্রযোজক বা পরিচালক তার স্বপ্নের চলচ্চিত্রটি অনেক পরিশ্রম, মেধা ও অর্থ খরচ করে নির্মাণ করেন। সিনেমাটি যিনি নির্মাণ করেন, সেই সিনেমা নিয়ে সকল সিদ্ধান্ত তারই হওয়া উচিত। অথচ যিনি চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করলেন, সিনেমা মুক্তি দেবার জন্য তাকে আবার প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির পেছনে ঘুরতে হবে। এটা কোন ধরনের আইন? যিনি সিনেমা নির্মাণ করবেন তিনিই তার সুবিধা অনুযায়ী সিনেমা মুক্তি দিবেন, এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে এ এক অদ্ভুত নিয়ম। সেন্সর পাওয়ার পর প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি আপনাকে যে তারিখ দেবেন, সেই তারিখের আগে বা পরে আপনি সিনেমা মুক্তি দিতে পারবেন না। আপনি যদি তাদের থেকে সিনেমা মুক্তির তারিখ না পান, তাহলেও মুক্তি দিতে পারবেন না।
এখানে চলে আরেকটা বড় ধরনের বাণিজ্য। আপনার সিনেমা কয়টি সিনেমা হল পাবে তা ঠিক করবে এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে আপনি যত মাল ঢালতে পারবেন আপনার সিনেমা তত বেশি সিনেমাহল পাবে। আবার আপনার সিনেমা একটি সিনেমাহলে কতদিন থাকবে তাও নির্ধারণ করেন এই সিন্ডিকেট। অর্থ্যাৎ আপনি চতুষ্টয় দুষ্টু সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে সিনেমা সেন্সর করালেন। এবার এই সিন্ডিকেট আপনার সিনেমার রিলিজ ডেট নিয়ে আপনার সাথে দরদামের খেলা খেলবে। আপনার পছন্দের তারিখে আপনি সিনেমা মুক্তি দিতে পারবেন না। এই সিন্ডিকেটের পছন্দের তারিখে আপনাকে সিনেমা মুক্তি দিতে হবে! এই সিন্ডিকেট যতক্ষণ আপনার হয়ে কাজ করবে ততক্ষণ আপনার সিনেমা সিনেমাহলে থাকবে। এরা নাখোস হওয়া মাত্র আপনার সিনেমা সিনেমাহল থেকে নেমে যাবে।
সিনেমা বানানো একটা যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ সফলভাবে শেষ করার পর বাংলাদেশে এরকম কয়েকটি সিন্ডিকেটের কাছেই নির্মাতারা জিম্মি থাকেন।এই সিন্ডিকেটের ইশারার বাইরে এদেশে কোনো সিনেমা আলোর মুখ দেখে না। পরিশ্রম করে সিনেমা বানাবেন আপনি আর সেই সিনেমার ঘি খাবে এই সকল সিন্ডিকেট!
এবার আসুন সিনেমাহল থেকে আপনি টাকা পাবেন কীভাবে?
এখানে আবার আরেক কিসিমের সিন্ডিকেট। হল মালিক সিন্ডিকেট। এরা পরিবেশক সমিতির সাথে যোগসাজশ করে আপনার সিনেমার ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে। বাংলাদেশের সিনেমার দর্শক আপনার ছবির ভবিষ্যৎ ঠিক করবে না। আপনার ছবির ভবিষ্যৎ বা ভাগ্য ঝুলে থাকবে এসব হলমালিক ও পরিবেশক সমিতির মর্জির উপর। এদের সাথে আপনি যতক্ষণ টাকার বিনিময়ে লিয়াজোঁ করবেন ততক্ষণ আপনার ছবি সিনেমাহলে থাকবে। আপনার ছবি হিট হবে নাকি চরম ফ্লপ করবে তা ঠিক করে এই সিন্ডিকেট। অথচ একটি সিনেমা সাধারণত দর্শকদের ভালো লাগা খারাপ লাগা নিয়ে ভাগ্যবরণ করার নিয়ম। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো সিনেমা এই সিন্ডিকেটের বাইরে হিট বা ফ্লপ করে না। ছবির ভাগ্য বিধাতা এই সিন্ডিকেট। আপনি হয়তো আপনার স্বপ্নের সিনেমাটি নির্মাণ করলেন কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো- সেটির ভাগ্য ঝুলে থাকে এই দুষ্টু সিন্ডিকেটের উপর।
এসব সিন্ডিকেট হাত করেও কী আপনি সিনেমার লগ্নি ঘরে তুলতে পারবেন? প্রথম কথা- মোটেও না। কয়েক বছর আগে অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার কথাই ধরুন। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে এটি সুপার-ডুপার হিট একটি সিনেমা। তাহলে অমিতাভ রেজার তো কয়েকশো কোটি টাকার মালিক হবার কথা ছিল! বাস্তবে কী হয়েছে? বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর। অমিতাভ রেজা সিনেমা ছেড়ে আবার বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতে চলে গেলেন। পরবর্তী সিনেমা নির্মাণে কেন যেতে পারলেন না? কারণ সিনেমাহল থেকে অমিতাভ রেজা টাকা ফেরত পাননি।তাহলে এত লাখ লাখ দর্শক, এত ডামাডোল, এত সুপার-ডুপার হিট একটা সিনেমার নির্মাতা সিনেমায় লগ্নি করা পুঁজি ঘরে তুলতে পারলেননা কেন? কেন তিনি পরবর্তী সিনেমা নির্মাণ করতে নামতে পারলেন না? কারণ ওই সিন্ডিকেট। ‘আয়নাবাজি’ একটি ব্যবসা সফল সিনেমা কিন্তু নির্মাতা ফতুর! কারণ নির্মাতা টাকা ঘরে তুলতে পারেননি।
তাহলে সিনেমাহলে ছবি সুপার ডুপার হিট হলেও নির্মাতা বা প্রযোজক হিসেবে আপনি যে এদেশে টাকা ফেরত পাবেন, তার কোনো গ্র্যারান্টি নাই। কতিপয় সিন্ডিকেট আপনার টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে আপনাকে কাঁচকলা দেখিয়ে দেবে। এটাই বাংলাদেশের সিনেমার বাস্তবতা। এটাই এখানে বহাল তবিয়তে চলছে।
মিডিয়া সিন্ডিকেট:
বাংলাদেশের কোন সিনেমাটি ব্যবসা করবে আর কোনটি ব্যবসা করবে না তা অনেকটাই নির্ভর করে এই মিডিয়া সিন্ডিকেটের উপর। আপনার সিনেমা নির্মাণের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত এই মিডিয়া সিন্ডিকেট আপনার ছবির কতটা প্রচার ও প্রসারে কাজ করলো, তা দিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা দর্শক আপনার সিনেমার দর্শক হবে। যদি এই মিডিয়া সিন্ডিকেট আপনার পক্ষে থাকে তাহলে আপনার সিনেমা সুপার-ডুপার হিট।আর যদি এরা পক্ষে না থাকে তাহলে আপনার সিনেমা চরম ফ্লপ করবে। দর্শক এখানে কোনো ফ্যাক্টর না।
আপনার সিনেমাটি যখন রিলিজের অপেক্ষায় পত্রপত্রিকায় সেটির কোথাও নিউজ দেখতে পাবেন না। যদি এদের পেছনে আপনি ঘি ঢালেন সেই অনুযায়ী এরা আপনাকে ট্রিটমেন্ট দেবে। আর যদি আপনার ঘি ঢালার মত সক্ষমতা না থাকে তাহলে বিনোদন পাতা ভরাট হবে বিদেশি সিনেমার কোন নায়িকা গত সপ্তাহে কোথায় কী করেছেন, তার কোনো স্ক্যানডাল, তার জন্ম বা বিয়ের খবর, তার নেইল পালিশের খবর, তার ব্রা’র রঙ এসব দিয়ে মুখরোচক খবরাখবরে। অথচ ওই বিদেশি নায়ক নায়িকা থেকে এরা কেউ কিন্তু এক টাকাও পায় না। কিন্তু আপনাকে বঞ্চিত করে এরা এসব নিয়েই মেতে থাকবে। আপনার মরা বাঁচা, আপনার সিনেমার ভবিষ্যৎ নির্মাণে এদের টু’টি পর্যন্ত দেখবেন না।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিদেশি সিনেমার যত খবরাখবর প্রচার হয়, সেই তুলনায় দেশী সিনেমার খবর একদম হাতে গোনা। তো আপনার সিনেমার কীভাবে বাজার তৈরি হবে বলুন? আপনি যদি এই মিডিয়া সিন্ডিকেট ম্যানেজ করতে না পারেন তাহলে এরা বিদেশি সিনেমার খবরদিয়ে আপনাকে অতিষ্ট করবে কিন্তু আপনাকে সাহায্য করতে ভুলেও এগিয়ে আসবে না। তাহলে ভাবুন একবার- লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আপনি একটা সিনেমা বানালেন। আর এত এত সিন্ডিকেট আপনার বিপক্ষে একপায়ে খাঁড়া। তাহলে বাংলাদেশে সিনেমা সফল হবে কিভাবে?
সিনেমাহল ও সুবিধাসমূহ:
একুশ শতকের শুরুর দিকেও বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজারের উপর সচল সিনেমাহল ছিল। সিনেমাহল গুলো বন্ধ হতে হতে সেগুলো এখন দুইশো-আড়াইশোতে এসে ঠেকেছে। যার প্রধান কারণ এই সিন্ডিকেটের দুষ্টু কারবারি। নব্বই দশকের পর থেকে যখন বাংলাদেশের সিনেমায় বিএফডিসি ঘরনার ছবিগু লোতে নকল-কাটপিছ-অশ্লিলতা-নোংরামি চালু হলো, তখন থেকেই পারিবারিক বিনোদন হিসেবে দর্শক সিনেমাহল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের সিনেমা দর্শক তারপর থেকে খুব হিসেব করেই সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে যায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সিনেমা হলগুলোতে মৌলবাদীদের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হামলা। ফলে দর্শক সিনেমার মান ও নিরাপত্তা বিচারে সিনেমাহল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশের সিনেমার এই প্রতিকূলতার ভেতরেও কিছু স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা (বিএফডিসি’র বাইরে) কিছু কিছু ভালো চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন। কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান কিছু সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করেছেন। ভালো সিনেমা আর আধুনিক সিনেমাহল এই দুটোর হাতছানি দেখে আবারো দর্শক সিনেমাহলে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু সেখানে যখন নানান কিসিমের সিন্ডিকেট পেছন থেকে ঘুটি চালায় তখন একটি ভালো সিনেমাও চরম ফ্লপ করতে বাধ্য। ধর্মীয়ভাবে এখানে সারা বছর সিনেমা দেখা, গান শোনা, নাচ দেখা, থিয়েটার দেখা, অথবা যে কোনো ধরনের ক্রিয়েটিভ কাজকে ধর্মের জন্য শত্রু হিসেবে দেখা হয় এবং সারা বছর ধরেই এসবের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। বাংলাদেশের ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীর এই প্রচারে যতটা ব্রেনওয়াশ হয়, তার বিপক্ষে গিয়ে সিনেমাহলে দর্শক টানার কাজটা সত্যি সত্যিই খুব চ্যালেঞ্জিং।
একটি দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যখন সিনেমার মত একটি বড় মাধ্যমের বিরুদ্ধে সারা বছর জুড়ে অপপ্রচার ও অপপ্রচারণা চালানোহয়, তখন সেই জনগোষ্ঠীতে সিনেমার দর্শক কারা? নিতান্তই শিক্ষিত সমাজের একটি বিদ্বৎ সমাজ। সেই বিদ্বৎ সমাজের আবার সবাই সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখার মত ভরসা পায় না। ইভটিজিং থেকে শুরু করে নানান ধরনের নিপীড়ন ও হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়ে কোনো ভদ্র পরিবারের কেউ সিনেমাহলে যাবার দুঃসাহস দেখায় না। ফলে সিনেমাহলে দর্শক বৃদ্ধি পাওয়াটা এখানে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। সেসব বৈরি পরিবেশ মোকাবেলা করে এখনো যেসব সিনেমাহল টিকে আছে, সেগুলো আবার ওইসব সিন্ডিকেট ও দালালদের খপ্পরে নির্যাতিত। ফলে বাংলাদেশে সিনেমা কালচারটা যে এখনো নিভু নিভু আলোর মত বেঁচে আছে, এটাই বরং একুশ শতকের এক চরম বিম্ময়!
তবে আশার কথা হলো- ধীরে ধীরে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো সিনেপ্লেক্সের মত আধুনিক সিনেমাহল তৈরি হচ্ছে। ফলে দর্শক সিনেমা থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। বরং দর্শক ভালো সিনেমা পেলেই সিনেমাহলে ভিড় করছে। আধুনিক সিনেমাহল বলতে ডলবি সাউন্ডসিস্টেম, উন্নত স্ক্রিন, উন্নত প্রজেকশান, ভালো কালারসম্মত প্রজেকশান, সিনেমা হলের আধুনিক আসন ব্যবস্থা, সিনেমাহলের পরিবেশ এবংনিরাপত্তার বিষয়গুলো জড়িত। সিনেমাটা খুব ভালো কিন্তু দর্শক ভালো কালার দেখতে পেল না, তাহলে দর্শক কিন্তু সিনেমা দেখতে আসবেনা। আবার সবকিছু ভালো কিন্তু সিনেমাহলের বাথরুম ব্যবস্থা খারাপ, তাও দর্শকদের জন্য বিড়াম্বনার।
বিকল্প সিনেমা মাধ্যম:
সিনেমাহলের বাইরে আজকাল অনলাইন মাধ্যমে সিনেমা দেখা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আপনার মুঠোফোনেই আপনি দেশ-বিদেশের ভালো ভালো সিনেমা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। কিংবা বাসায় বসে নিজের কম্পিউটার স্ক্রিনে সিনেমা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। সিনেমা ডাউনলোড করে পরে নিজের সময় বের করে তখন দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। এটা হলো সিনেমা দেখার বিকল্প মাধ্যম। যারা সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখার সুযোগ পান না, সাধারণত তারা এই বিকল্প মাধ্যমে এখন সিনেমা দেখছেন।
এটা অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মত। সিনেমাহলের বড় পর্দায় সিনেমা দেখে আপনি যে বিনোদন পাবেন, সেটি এসব ছোট ডিজিটে দেখে পাবার কোনো সুযোগ নাই। সিনেমার সাউন্ড, কালার, বড় পর্দায় এর বিস্তার, ক্যানভাস এসব এই মিনি-ডিজিটে কোনোভাবেই সেই পুরো মাত্রার আনন্দ দিতে পারে না। কারণ সিনেমা বানানোই হয় বড় পর্দার জন্য। তা আপনি ছোট পর্দায় দেখে তার কতটুকু হজম করতে পারবেন? আপনি তো সিনেমার আসল টেস্টটাই মিস করবেন।
বাংলাদেশে কী শিল্পসম্মত রুচিবান সিনেমা বানানো সম্ভব?
ইয়েস, অবশ্যই শিল্পসম্মত রুচিবান সিনেমা বাংলাদেশেও বানানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের যে পরিবেশ, আমাদের যে কালচার, আমাদের যে সিনেমা মাধ্যম, আমাদের যে বিএফডিসি ও সেন্সর বোর্ড, আমাদের যে সিন্ডিকেট বাণিজ্য, আমাদের যে মিডিয়া নীতি, এসব মোটেও ভালো সিনেমার পক্ষে নয়। আপনি সিনেমা বানাতে যাবেন, প্রথম যে বাধাটি আসবে, সেটি আপনার নিজের পরিবার থেকে। তারপর প্রতিবেশী থেকে, তারপর সমাজ থেকে, তারপর এসব যুদ্ধে জয়ী হবার পর যদি সিনেমা বানানো শেষ হয়, তখন আবার নানান কিসিমের সিন্ডিকেট বাণিজ্যের খপ্পরে আপনার সিনেমা বানানোর ইচ্ছা এবং প্রেরণায় সারাক্ষণ ঘাই খাবেন।
আমি ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রটি বানানোর বিভিন্ন পর্যায়ে যে পরিমাণ বাধা ও প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছি, তা আমি আমার ত্রিশ বছরের লেখক জীবনে কখনো ওয়ান পারসেন্টও হইনি। আমার সিনেমার গল্প, বিষয়-আশয়, ক্যানভাস না জেনেই আমার প্রগতিশীল বন্ধুরা পর্যন্ত সিনেমার নাম বদল করার জন্য আমাকে অনবরত খুঁচিয়েছেন। তাহলে বুঝুন প্রগতিশীল বন্ধুদের যদি এই দশা হয়, সেখানে ধর্মান্ধ একটি দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা অনুমান করাও অনেক কঠিন কাজ!
আমাদের এখানে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সৃজনশীল রুচিসম্মত শিল্পমান সম্পন্ন সিনেমা বানানোর প্রবল ইচ্ছা আমি দেখতে পাই।নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সাথে আমার আলাপ হয়, তাদের সিনেমা সম্পর্কে জ্ঞানগরিমা বিশেষ করে বিশ্ব সিনেমা দেখার সুযোগের কারণে,আমাদের প্রবীনদের তুলনায় অনেক এগিয়ে। কিন্তু প্রবীনরা আপনার সিনেমার ভাগ্য নির্ধারণ, আইন কানুন বানানো থেকে শুরু করে সিন্ডিকেট বাণিজ্যের সাথে যুক্ত। তো একপাল অন্ধকার যুগের মানুষের কাছ থেকে আপনি এদেশে কী প্রত্যাশা করবেন?
দেশে বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া পড়ানো হয়। সেখানে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে সিনেমা নিয়ে পড়াশুনা করছেন।সিনেমা নিয়ে তাদের আগ্রহ এবং নতুন নতুন আইডিয়া ওইসব তথাকথিত অন্ধ প্রবীনদের চেয়ে কয়েক হাজারগুণ বেশি এবং রুচিসম্মত। কিন্তু ওইসব প্রবীনদের চেয়ে আগামী প্রজন্মের এসব তারুণ্যের মাধ্যমেই একদিন বাংলাদেশের সিনেমার বিকাশ প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি। কারণ এসব নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের চিন্তা ও আইডিয়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের সিনেমার মতই আধুনিক। ফলে বাংলাদেশের সিনেমার বিকাশ এদের হাত ধরেই আসবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
আমরা যতদিন এই পুরানো সিস্টেম ভাঙতে না পারবো, যতদিন ওই প্রবীনদের অন্ধত্ব দূর না হবে, যতদিন এসব সিন্ডিকেট বাণিজ্য বন্ধ না হবে, ততদিন আমাদের সিনেমা সত্যিকার অর্থে আলোর মুখ দেখবে না। আমরা যদি দেশের চলচ্চিত্র কেমন হবে, চলচ্চিত্র আইন কেমন হবে তা এখনো ঠিকমত নির্বাচন করতে না পারি, তাহলে আমাদের ওই সোনার হরিণের জন্য আরো বহুযুগ অন্ধকারে কাটাতে হবে। এই দুষ্টু সিন্ডিকেট ভাঙতে স্বাধীন নির্মাতাদের জোটবদ্ধ হয়ে যৌথ ইশতেহার নিয়ে মাঠে নামতে হবে। সেটা যতদিন না হচ্ছে ততদিন কাজীর গরু কেবল কাগজে থাকবে গোয়ালে দেখা যাবে না।
চলচ্চিত্র কেন্দ্র:
আমাদের দীর্ঘদিনের চাওয়া রাজধানীসহ দেশের সকল বিভাগীয় ও জেলা সদর এমনকি উপজেলা পর্যায়ে চলচ্চিত্র কেন্দ্র থাকবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৫০ বছর হতে চলেছে। অথচ দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ মাত্রার চলচ্চিত্র কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়নি। যেখানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভাল, চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা, সেমিনার, ফোরাম, সবকিছুই একই ছাতার নিচে থাকবে। চলচ্চিত্র কেন্দ্রে লাইব্রেরি থেকে শুরু করে সবধরনের সুযোগ সুবিধা থাকবে। সিনেমার এ টু জেড যেখানে গেলে একসাথে পাওয়া যাবে, সেরকম চলচ্চিত্র কেন্দ্র নির্মাণের জন্য বারবার আমরা সরকার বাহাদুরকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
যে দেশ স্বাধীনের পর বিগত ৫০ বছরে একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্র তৈরি করেনি, সেই দেশে সিনেমার স্বপ্ন দেখা আমাদের মত গুটিকয় মানুষ যে কত ধরনের বিড়ম্বনা নিয়ে বেঁচে থাকে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। বিএফডিসি নামে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে সেখানে কোনো সুস্থ মানুষ যায় না।গেলে তারা অসুস্থ হয়ে যায়। চলচ্চিত্র কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে ঢাকার কালচারাল হেডকোয়ার্টার শাহবাগে।
এখন যেখানে শাহবাগ থানা, ওই জায়গাটি চলচ্চিত্র কেন্দ্রের জন্য সবচেয়ে উপযোগী স্থান। কিন্তু সরকারিভাবে চলচ্চিত্র কেন্দ্র বানানোর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। সম্প্রতি গাজীপুরে যে বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সেন্টার নির্মিত হচ্ছে, তা শহরের বাইরে থাকায় রাজধানীতে বসে চলচ্চিত্রের যে প্রাণ যে জোয়ার সৃষ্টি করা সম্ভব, তা সেখানে করা সম্ভব নয়। ওটা বরং বিএফডিসি মডেলের আরেকটি ভাঙা রেকর্ড হতে চলেছে।
খেয়াল করুন- আমাদের বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে জাতীয় নাট্যশালা আছে, জাতীয় চিত্রশালা আছে কিন্তু একটি জাতীয় চলচ্চিত্রশালা নাই। অথচ শিল্পের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র আর সেখানে কিনা খোদ চলচ্চিত্রের জন্য শিল্পকলা একাডেমিতে একটি আলাদা ভবন নাই। তাহলে এদেশে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ও বিকাশ কীভাবে সম্ভব?
চলচ্চিত্র মূলত বাংলাদেশের শিল্পসংস্কৃতি অঙ্গনে সবচেয়ে অবহেলিত এবং সংখ্যালঘু মাধ্যম এবং যতটুকু আছে তাও সিন্ডিকেট বাণিজ্যেরচরম খপ্পরে নির্যাতিত। অথচ একটি দেশের সংস্কৃতি বিকাশে চলচ্চিত্র মাধ্যম সবচেয়ে কার্যকর এবং বড় মাধ্যম। যতদিন এদেশে স্বাধীনচলচ্চিত্র নির্মিত না হবে, যতদিন এদেশে মুক্ত চিন্তার অবাধ বিকাশ সম্ভব না হবে, যতদিন এখানে ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশান প্রতিষ্টিত হবে না, ততদিন আমাদের এই স্বপ্ন কেবল অংকুরেই থেকে যাবে।
Reza Ghatok is a contemporary writer and filmmaker. He has 16 published books.
More Posts From this Author:
- None Found