প্রশ্নোত্তর:
শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?
শেখ জলিল: সময়টা আশির দশকের শুরু। ১৯৮৩ সাল। এইচএসসি পরীক্ষা পাস করে বিভিন্ন জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি। উচ্চশিক্ষায় ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার জন্য বিশাল প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে আমাদের বন্ধুদের মাঝে। কে পড়বে মেডিক্যাল, কে ইঞ্জিনিয়ারিং আর কে বা পড়বে ভার্সিটিতে এ সব নিয়ে আলোচনা চলছে। যেমন পড়াশোনা করি মন দিয়ে তেমনি তুমুল আড্ডাও দেই সবাই মিলে। কলাবাগান মাঠ, ধানমণ্ডি লেক, নিউমার্কেট চষে বেড়াই আমরা।
হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো আমরা ক’জন বন্ধুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘কল্পতরু সমাজ কল্যাণ যুবসংঘ’-এর পক্ষ থেকে এবারে একুশে উদযাপন করেবো এবং এ উপলক্ষে একটি সংকলন বের করা হবে। সংগঠনের কার্যকরী সদস্য হিসেবে আমার কাছেও লেখা চাওয়া হলো। প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ছড়া, কৌতুক একটা কিছু হলেই চলবে।
বন্ধুরা জানতো আমার লেখালেখির প্রতি আগ্রহ আছে খুব। কারণ ছোটবেলায় ক্লাস সেভেনে থাকাকালীন আমি একবার ছড়া-কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম। আবার হারিয়েও ফেলেছিলাম সে সব। এবার সত্যি সত্যিই চাপে পড়ে গেলাম লিখতে হবে। আমার বড় ভাই সাংবাদিক- উনি নিয়মিত লেখেন। সেক্ষেত্রে আমি না লিখলে কেমন হয়!
ভর্তি পরীক্ষার পড়া পড়ি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই আর কী নিয়ে লেখা যায় ভাবি। এভাবে ভাবতে ভাবতে একদিন মনে হলো এই একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়েই তো লিখতে পারি আমি। একুশের প্রথম প্র্রহরে আমরা শহীদ মিনারে যাই, পুষ্পস্তবক দেই আর গান গাই- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…।
কিন্তু আমার ভাবনা অন্য খানে। শুধু নগ্ন পায়ে শহীদ মিনারে যাওয়া কিংবা পুষ্পস্তবক প্রদানই কী সব? আমাদের রয়েছে অনেক দায়িত্ব। একুশের প্রতিটি শহীদ আত্মার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে আমাদের। তাই লিখে ফেললাম জীবনের প্রথম কবিতা আর ছাপা হলো সেই সংকলনে-
প্রতিবারেরর মতো এবারও এসেছি আমরা
এবারও কি রক্তলাল পুষ্পস্তবক দেবে উপহার?
না না না, দিও না উপহার এ ফুল….
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষা শৈলির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী।
শেখ জলিল: ইদানিং কবিদের অনেকেই দশকে বেঁধে ফেলতে আগ্রহী। সেই হিসেবে আমি নিজেকেও অনেক সময় বলি- আশির দশকের কবি ও গীতিকার। কিন্তু এই যে দশকে বেঁধে ফেলা- এর থেকে কি কবিদের আসল পরিচয় মেলে? একজন কবি তার জীবদ্দশায় বেশ কয়েক দশক ধরেই লেখেন। সে হিসেব করলে তার সমসাময়িকতা বলতে শুধু একটি দশক নয় অনেক বছর ধরে চলতে থাকে।
আমার কবিতায় অবশ্যই সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষাশৈলি ধরে রাখার চেষ্টা করি। তবে এর বিচারের ভার পাঠকের- আমি কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি সে সব। পরিপূর্ণ রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া উৎকৃষ্ট কবিতা আসে না কখনো। তবে জীবিকার তাগিদে কিংবা ধামাধরা সাজতে গিয়ে অনেকেই চলমান সরকারী দলের ছত্রছায়ায় থেকে তাদের মতাদর্শের কবিতা লেখেন, বাগিয়ে নেন নানান পুরস্কার। এতে সত্যিকারের কবিতা চর্চা ব্যহত হয় এবং অনেক প্রতিভাবান তরুণ কবি ছিটকে পড়েন লেখালেখির জগত থেকে।
আমার রয়েছে নিপীড়িত মানুষের প্রতি টান, শোষকের বিরুদ্ধে ঘৃণা, অত্যাচারের প্রতি প্রতিবাদ। মূলত আমার কবিতায় গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা, কৃষকের হাহাকার ও দারিদ্র্রতা ফুটে ওঠে বেশি। বাংলাদেশের সমসাময়িক ধর্মান্ধতা, বিজ্ঞানমনস্ক লেখকদের প্রাণনাশ ও তাদের প্রতি হুমকি, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, বিরোধীদের নিপীড়ন, হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার আমাকেও ব্যথিত করে। উত্তর আমেরিকার নাগরিক হিসেবে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাদা পুলিশ অফিসার কর্তৃক কালো মানুষ মেরে ফেলতে দেখেছি তখন অন্তর কেঁদেছে- লিখেছি হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা।
ভাষাশৈলিতে আমি সাবধান ও সচেতন। প্রচলিত চলিত বা কথ্যরীতির সাহিত্য ভাষায় লিখি আমি। তবে মাঝে মাঝে আমার অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাতেও লিখি কবিতা। বিশেষ করে একেবারে গ্রামের মাটির ঘরের সোঁদা মাটির কবিতা যখন লিখি আমি। কবিতার কাঠামোয় আধুনিক মুক্তক ছন্দে স্বাচ্ছন্দবোধ করি বেশি। তবে মাঝে মাঝে গদ্যকবিতাও লিখি আমি। আর আমার কবিতায় ছন্দের প্রয়োজনে বিশেষ করে গীতিকবিতায় সাধু ও চলিত ভাষারীতির মিশ্রণকে আমি বেশ উপভোগ করি। আমি বর্জনের পক্ষে নই, কবিতায় ছন্দ, অন্ত্যমিল ধরে রেখে আধুনিকতা ও বৈচিত্র আনতে চেষ্টা করি সবসময়।
শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
শেখ জলিল: ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হলো মরি লাজে’ গানের কলি নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকেও অশ্লীলতার বাণে জর্জরিত করা হয়েছিলো। তবে রবীন্দ্র-নজরুল যুগে অশ্লীলতারও শালীন রূপ ছিলো। সরাসরি গালিগালি বা অশ্লীল শব্দ কবিতায় প্রয়োগ করা হতো না।
সত্তর দশকে এসে কবি রফিক আজাদ, হেলাল হাফিজ, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিকসহ অনেকেই সরাসরি গালি ব্যবহার করেছেন। হারামজাদা, চুতমারানি, দাঁতাল শূয়োর প্রভৃতি গালি কিংবা ‘রান্নাঘর থেকে টেনে এনে স্তনগুচ্ছে চুমু খাও তাকে/ বাথরুমে ভেজানো দরজা ঠেলে অনায়াসে ঢুকে যাও’- এরকম অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করেছেন কবিরা।
নব্বই দশকের কবি ব্রাত্য রাইসুর ‘দোরা কাউয়া’ কবিতায়….দোরা কাউয়া পাতি কাকের গোয়া মারে রে… এবং কবি মারজুক রাসেল-এর সম্প্রতি লেখা ‘অলটারনেটিভ’ কবিতায় …তোমারে খাইতে পারতেছি না… বা …তোমারে লাগানো হইয়েই উঠতেছে না, হবে …অবশ্যই অশ্লীল।
আমার মতে সময়ের দাবীতে কবিতায় কিছু গালি বা অশ্লীল শব্দ চলে আসতে বাধ্য। তবে স্বশিক্ষিত রুচিশীল কবিরা তার ব্যবহার করেন মার্জিত আকারে এবং অবশ্যই সাবধানে। রাজনৈতিক সচেতন, দলিত-পীড়িত বা মানসিক অস্থির কবিরা এসব শব্দের ব্যবহার করেন সরাসরি। আমিও আমার ব্লগে একবার ‘চাষাভুষার গালি’ নামক একটি কবিতায় গ্রাম্য কৃষকের মুখে আমাদের এলাকার গালি তুলে ধরেছিলাম। আমি অবশ্য কোনো সমালোচনার বা আক্রমনের শিকার হইনি। কারণ সে গালি প্রকাশ করেছিলাম কৃষকের মুখ দিয়ে- আমার নিজের মুখে নয়।
আমার মতে গালি আসুক প্রতিবাদস্বরূপ, মানুষের পক্ষে বা কল্যাণে। আর অশ্লীলতা- যা আমাদের সমাজকে কলুষিত করতে পারে তার ব্যবহার যেন আমরা না করি কোনোভাবেই। মনে রাখতে হবে আর্ট বা ছবি আঁকায় যে নগ্নতা শিল্প হিসেবে গণ্য হয় কবিতায় অশ্লীলতা বা নগ্নতার ব্যবহার কিন্তু সে রকম না।
শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আাপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/ বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে কোনো সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।
শেখ জলিল: আমার দশক ছিলো আশির দশক- যখন আমি কবিতা লেখায় ও চর্চায় তুঙ্গে ছিলাম। নিয়মিত পত্রিকার সাহিত্য পাতায় বা লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপা হতো। তখনও এনালগ যুগ- বই কিংবা পত্রিকায় পাতায়ই পড়তাম বিখ্যাত কবিদের কবিতা। মাঝে মাঝে রেডিও কিংবা টিভিতে কিছু নামকরা কবির কবিতা আবৃত্তি শুনতাম। উক্ত কবিদের মাঝে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু বড়জোর শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা আবৃত্তি হতো। সে সব দিনে একুশ কিংবা স্বাধীনতা দিবস এলে এক ঝাঁক কবিরা আবির্ভূত হতেন টিভি পর্দায়। মফস্বলের কবি হিসেবে আমার সৌভাগ্য হয়নি সে সব অনুষ্ঠানে। তবে এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলাম প্রথম থেকেই। কলেজ ক্যাম্পাসে মিছিল করেছি, লিখেছি স্লোগান স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। আর কবি হওয়ার সুবাদে জড়িত হয়েছিলাম ঢাকার জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে। দু’দিনব্যাপী প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসবে পড়েছি কবিতা।
পত্রিকা বা বইয়ের পাতায় পড়তাম পশ্চিমবঙ্গের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষসহ কিছু নামী কবির কবিতা। আমাদের সমসাময়িক কবিদের ছাপানো সব কবিতা পড়া হতো না। তেমন সুযোগও ছিলো না সে সময়, যেটুকু পড়তাম আনন্দবাজার পত্রিকায় শারদীয় পূজা সংখ্যায়। যেটুকু মনে পড়ে তখন বাংলাদেশের আশির দশকের কবিরা অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন কবিতায়। কবিরা কবিতা ভাঙচুর করে তুমুল পরিবর্তন আনছেন, ঝুঁকছেন পরাবাস্তবতা বা সুরিয়ালিজমের দিকে, কবিতা হয়ে উঠছে উত্তর আধুনিক। সত্তরের আবেগী কবিতা থেকে তারা আটসাঁট এবং নিটোল কবিতা নির্মাণ করেছন। এক্ষত্রে আবিদ আজাদ বা ফরিদ কবিরেরর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বেশিরভাগ কবিই প্রথাগত ছন্দ ও অন্ত্যমিলকে অস্বীকার করে লিখছেন গদ্যকবিতা। সেই সাথে বাংলাদেশের অস্তিত্বের ইতিহাস, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রভাব চলে আসতো সমসাময়িক কবিতায়।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় অস্তিত্বের লড়াই ছিলো না। তাদের কবিতা যতটা না ছিলো উত্তর আধুনিক তার বেশি ছিলো একাডেমিক। তখনও প্রথাগত ছন্দ ও অন্ত্যমিলকে তারা অস্বীকার না করে লিখছেন নতুন আঙ্গিকে নতুন ছন্দের ব্যবহার। সেই সাথে তাদের কবিতায় বেশি উঠে আসছে প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা কিংবা জীবনবোধ। এক্ষেত্রে জয় গোস্বামী বা মলয় রায় চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এরপর বিখ্যাত কবি শ্রীজাত-এর কবিতাও সেই ধারাই বহন করেছ। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে শুধুমাত্র মানুষের প্রেম-ভালোবাসা ও জীবনবোধ নিয়ে লেখার কারণে পশ্চিবঙ্গের কবিতা পঠিত হচ্ছে বেশি এবং আবৃত্তিও হচ্ছে বাচিকশিল্পীদের মুখে মুখে। অধুনা অনলাইন বা ইউটিউব সার্চ দিলেই বোঝা যায় কোন্ কবি কত বেশি জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালে কবি অভিজিৎ দাশগুপ্ত, গৌরব চক্রবর্তী, তম্ময় ধর, মানিক সাহা, বিশ্বজিৎ লায়েক, রোশনি ইসলাম প্রমুখ বেশ ভালো কবিতা লিখছেন।
শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।
শেখ জলিল: সাম্প্রতিক সময়ে আমার পাঠ অভিজ্ঞতা অর্থাৎ যা আমাকে বেশি আন্দোলিত করছে তা হলো গল্পকার ও কবি মাহবুব লীলেন-এর লেখা ‘পথুয়া গল্প’ সিরিজ। ‘অভাজনের মহাভারত’ খ্যাত লেখক মাহবুব লীলেন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে প্রবাসী। নিয়মিত তার ফেইসবুক পেইজে তিনি লিখছেন এসব পথুয়া গল্প। সম্ভবত তার লেখা প্রথম ‘পথুয়া গল্প’ পড়েছিলাম ‘সচলায়তন’ ব্লগে সেই ২০১৫ সালে। যতদূর মনে পড়ে প্রথম গল্পের নাম ছিলো ‘কাণ্ডারি’। তবে ইদানিংকার তার লেখা পথুয়া-০২ সিরিজে পান খাওয়ার কাহিনি পড়ে বেশ হেসেছি- সিলইট্টা চোদনাগুলা চাপিলা মাছরে কয় ‘হুগা’ আর সুপারিরে কয় ‘গুয়া’।
পর্ব ২০-এ সিলেট অঞ্চলের ঘাটুদের কথা তুলে ধরেছেন, লিখেছেন তৎকালীন গ্রাম্য সালিসের ধরণের কথা। তবে পর্বের নাম কেন যে ‘উরাতবাজ ও বেটাবাজ’ দিলেন না বুঝলাম না। ময়মনসিংহের ঘাটুদের কথা শুনেছি বহু; তবে এ প্রথা সিলেট অঞ্চলে যে দুই ভাবে হয় তা জানতাম না। আর এখানেই মাহবুব লীলেনের গদ্য লেখার কারিশমা বা কেরামতি। একেবারে সহজ গল্পে তুলে আনেন ঐতিহ্য কিংবা আখ্যান।
মাহবুব লীলেনের গল্পে তার নিজস্ব স্টাইলি ভাষায় যেমন আখ্যান উঠে আসে তেমনি তার লেখা হিউমার ও রিউমারে ভরপুর। তার পিতৃপুরানে বাবার মরা দেহ দিয়ে স্বপ্নে শুটকি বানানোর কাহিনিতে চরম বাস্তব দারিদ্রতাপূর্ণ জীবনে অভাবের চিত্র ফুটে ওঠে উঠেছে অকাতরে। মাহবুব লীলেন পর্ব ২১-এর পরে কোনো পথুয়া গল্প পোস্ট করেন নি ফেইসবুকে। শুরু করেছেন অভাজনের রামায়ণ, কন্যাদান পর্বসব আরও কিছু নতুন লেখা।
ভেবেছিলাম এইসব পথুয়া গল্প নিয়ে মাহবুব লীলেন এবার একটি বই বের করার ঘোষণা দেবেন বইমেলায়। তাহলে আমার অনিয়মিত পড়া গল্পগুলো একত্রে পেতাম, পড়তে পারতাম মাঝে মাঝে আর সংগ্রহে রাখতে পারতাম প্রিয় কাহিনিগুলো।
কবিতা:
আমি কেউ না, কিছু না
আমি কেউ না, কিছু না
অনন্তকাল যাবৎ জেগে আছি ঘাসে
দুরন্ত বাতাসে ঘুড়ির ডানায় উড়ে চলি
কথা বলি পাখির ভাষায়, রাখালি বাঁশিতে
মধুর হাসিতে হাসি শিশুর মায়ায়৷
আমি কেউ না, কিছু না
লিখি মায়ের ভাষায়, গাই সুরের ধারায়
শ্যামল ছায়ায় হেঁটে চলি আলপথে
স্বপ্নরথে ফলবতী হয় সোনা ধান
কাঁদে প্রাণ বন্যায়, খরায়, অকাল বর্ষণে৷
আমি কেউ না, কিছু না
ভাসি মেঘের পাখায়, বজ্র ও বিদ্যুতে
উল্কার গতিতে নেমে আসি মাটির ধরায়
আলোর ফলায় বিদীর্ণ করি চোখের মণি
অকাল শনি বিধ্বস্ত করে আমার কৃপাণ৷
আমি কেউই না, কিছুই না
অনন্ত সময় মিশে আছে তবু বুকে
সৃষ্টিসুখে নিত্যানন্দে নাচে আমার হৃদয়
দীপ্তিময় আমার আমিতে ব্যাপ্ত আমি
দিবাযামী, মাস ও বছর এই বিচরণ৷
বাস স্টপ
সড়ক চলে যায় সড়কের গন্তব্যে
আমার বাস থামে অজানা স্টেশনে।
নির্জন রাত, সুনসান নীরবতা
পাশ থেকে কে যেন বলে- হ্যালো
ছড়ি হাতে বৃদ্ধ পথিক ফিরছে ঘরে
জীবনের প্রশ্নবোধক জড়িয়ে গায়ে।
কী যেন আহ্বান ছিলো আমাকে ঘিরে
ফিরে চাই আমি নিষ্পলক চোখে
কিছু কি বলবে সে?
কিছুই বলে না নিশীথ রাতের সাথী
অবশিষ্ট জীবনের আশীর্বাদ জড়িয়ে চোখেমুখে
হেঁটে যায় সম্মুখে
আর শুধু বলে যায়- হ্যালো।
রাধারা যায় না তরুতলে
কে আর বাঁশি বাজায়
আজকাল রাধারা কি কদমতলায় যায়?
রাখাল হয়েছে বাঁশিহারা
বাউল ভুলেছে একতারা
নদীতেও নেই সেই কলতান
শুনি না বৈঠার টান, সারি গান
মাঠে কিষাণও ভরে না পরাণ
তুলে ঐক্যতান গেয়ে জারি গান৷
নেই গুণ টানা, ইঞ্জিনের নৌকা চলে
পালে লাগে না বাতাস ঢেউ কলকলে
বাঁশি, একতারা, ঢোলক গিয়েছে যাদুঘরে
অ্যাপসে আঙুল টেপাটেপি এতো কার তরে?
রাধারা যায় না তরুতলে, অরণ্যের দিকভালে
তারা থাকে ফেইসবুকে, ইনস্টাগ্র্যামে, অন্তর্জালে
আজকাল পাড়ার যুবক বাজায় না বাঁশি
থেকে নিজঘরে যেন এখন সবাই পরবাসী!
বহাও ধারা যমুনা
বহাও ধারা যমুনা
দেখাও প্রেমে নমুনা
এসে তোমার শানবাঁধানো ঘাটে
দেখি মনোহারা স্রোতস্বী তল্লাটে
বিকল্প নেই কোথাও
রূপ নিয়ে বয়ে যাও!
আমি তীরের বালক
দেহে পাখির পালক
উড়ে উড়ে যাই তোমার চরায়
ঝাউ, কাশফুলে হৃদয় হারায়
দেখে যৌবন তোমার
বাড়ে প্রণয় আমার৷
পাড়ে আমি ও যমুনা
না না কাউকে কমু না
পড়েছি তাহার প্রেমে
আর কোথাও যামু না৷
ঘাস জানে রোদ জানে
ঘাসের উপর রোদে শুয়ে রয়েছে কবিতা
নায়িকা ববিতা এখন আর করে না অভিনয়
তবুও সময় কাটছে কবির তার স্বপ্ন-ধ্যানে
জ্ঞানে অজ্ঞানে সে জপে সেই প্রিয় নাম
দেয় বদনাম লোকে তবু কিচ্ছু আসে না কবির
পুরনো পোস্টারে এই ছবির মূল্য অপরিসীম৷
ক্রিকেটার তামিম বা পরীমণি টানে না কবিকে
এ ছবিকে সে রাখছে সারাক্ষণ বুকে চেপে ধরে
জল পড়ে, পাতা ঝরে কিচ্ছুই খেয়াল নেই তার
চেয়ে দেখবার নেই সময় কোথায় কী ঘটছে
নাম রটছে পাগল না ছাগল কী বা আসে যায়
সে থাকে তার মায়ায় কাব্যকথায় ববিতা ধ্যানে৷
ঘাস জানে এই রোদ জানে সে কোন্ ববিতা
চোখে ছবিতা কবির আর লিখছে কবিতা৷
তোমাকে আশীর্বাদ
হে পুত্র আমার- তোমাকে আজন্ম আশীর্বাদ!
এ বাংলার নদী-মাঠ-পাহাড়-সবুজ-সমতল
উর্বরা সুফলা হোক তোমার কর্ষণে, ধ্যানে-জ্ঞানে
কার্তিকের ভোরে দীঘল প্রান্তরে, স্বপ্নের উঠোনে
ভ’রে উঠুক সোনালী ধান দু’হাতে তোমার।
শীতের শীর্ণতা পূর্ণতা পাক ঐ বসন্ত উৎসবে
ফাগুনের কোকিলেরা ডাকুক সবার আঙিনায়
ফুটুক প্রাণের শত ফুল সব জীবনের গুলবাগে ।
হে পুত্র তোমাকে দিলাম কবিতা- স্বপ্নাবিষ্ট গ্রন্থাগার
ক্ষুরধার কবির কলম, আদিগন্ত শব্দের নীলিমা
তোমার অন্তরে ফুটুক গোলাপ- মানবিক হৃদয়ের
অমল অক্ষরে লিখো তুমি জীবনের জয়গান।
তোমাকে দিলাম শৈশবের ফুল, ফেলে আসা স্মৃতি
কৈশোরে ঘুড়ি ও লাটাইয়ে গোত্তা খাওয়া দুরন্ত দিন
লিকলিকে দেহে দুর্ভিক্ষের করাঘাত, জীবন সংগ্রাম
যৌবনে নিশ্চুপ না-পাওয়ার প্রহর, বিরহের ভার।
তোমাকে দিলাম কর্মজীবনের ক্লান্তি, বিষন্ন বিকেল
অধুনা জীবনে খাপ না খাইয়ে চলা, পথের পাথর
থরে থরে সাজানো দুঃখের অমিতাভ পদাবলী
আমৃত্যু হৃদয়ে আঁকো তুমি কবিতার ক্যানভাস।
হে পুত্র তোমাকে দিলাম আমার শ্যামল নিবাস
প্রাণেতে বাঁধন গড়ো, করো আমৃত্যু স্বপ্নের চাষ।
কালো মেয়ে
কালো মেয়ে, কাজল মেঘের পরী-
হরিণী চোখের মাঝে বিন্দু বিন্দু জল
কার লাগি কাঁদছে হৃদয়?
ভেঙে গেছে বিয়ে-
বরপক্ষ ফেরায়নি চোখ গায়ের শ্যামল বর্ণ দেখে?
নাকি ও-পাড়ার সোনা মিয়া
ঘরে এনেছে হঠাৎ লাল টুকটুকে বউ
দিয়েছে কি দাগা অবুঝ শৈশব প্রেমে!?
কালো মেয়ে, তাকিয়ে দ্যাখোনা তুমি
দূরের কাজল গ্রাম এক শ্যামল মায়ের ছবি
এতো জন্মভূমি বাংলাদেশ- আজন্ম মাটির টান।
বসন্তে ডাকছে যে কোকিল- সেও কালো
ও চুলে তোমার, ও চুলে সবার
ও চোখে তোমার, ও চোখে সবার
জড়িয়ে রয়েছে দ্যাখো কতো কাজল রঙের খেলা
ভয় কী তোমার বলো কাজল বরণে!?
কালো মেয়ে, কাজল ধরণী কায়া-
কখনো দিও না ঝাঁপ নদীজলে
দ্যাখো পশ্চিমে আসছে কাল-বৈশাখী হাওয়া
এখনি উড়িয়ে নেবে জমাট কষ্টের জ্বালা
তোমাকে ছেড়েছে যারা অপমানে, অসম্মানে
গুড়িয়ে দেবে সবার প্রমত্ত অহংকার
আসবে ঝড়, উন্মত্ত লু-হাওয়া
কাজল রঙেই ঢাকবে তাদের চোখ-দর্প-স্পর্ধা!।
কালো মেয়ে, কাজল মানিক মায়া-
আমিও তো তোমরই মতোন শ্যামকৃষ্ণ যুবক
কখনো পারিনি হ’তে কোনো রূপের রাজকুমার
ঐশ্বর্যও নেই, নেই প্রেমের জীবন
অপেক্ষায় তবু ঠিক তোমার কারণে বহুকাল
কালো মেয়ে, এবার ফেরাও মুখ!।