অনুবাদকের ভূমিকাঃ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য হত্যার (euthanasia) যে তৎপরতা ও নৈতিক সচেতনতা তা বর্তমানে সুপ্রজননবিদ্যার (eugenics) একটি ক্যাটাগরি হিসেবে রূপলাভ করেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে নৈতিকতার সাথে জৈবিক সংযোগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকশিত জ্ঞানকে ব্যবহার করে এ জৈব-নৈতিকতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে জৈব-নৈতিকতা প্রত্যেক রাষ্ট্রের মধ্যে সুপ্রজনন চর্চাকে কমবেশি প্রয়োগ করে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী কতৃক ইহুদি, প্রতিবন্ধী এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি তাদের আচরণকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য সুপ্রজননবিদ্যা চর্চার কৌশলকে গ্রহণ করা হয়। মানব প্রজাতির মধ্য থেকে থেকে কাঙ্ক্ষিত জনসংখ্যার উত্তরাধিকারী বৈশিষ্ট্যগুলির উপস্থিতি কীভাবে প্রজনন ব্যবস্থার মাধ্যমে বৃদ্ধি করা যায় তা ছিলো সুপ্রজননবিদ্যার মূল বৈশিষ্ট্য। ফ্রান্সিস গ্যাল্টন নামক বহুবিশার দ্বারা মানব প্রজাতির বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে উন্নতির একটি পদ্ধতি হিসাবে এর ব্যাপক বিকাশ ঘটে। বিশ শতকে এসে এ পদ্ধতি ক্রমবর্ধমান অবৈজ্ঞানিক এবং জাতিগতভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে। তবে এই সুপ্রজনন চর্চার কৌশল বর্তমান জাতিরাষ্ট্রের জৈব-নৈতিকতার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। যে জৈব-নৈতিকতার তার নিজ রাষ্ট্রের মধ্যকার নির্দিষ্ট সংখ্যক জনসাধারণকে অপরজ্ঞান করে। একই সাথে এটি বহিরাগত আতঙ্কে ভোগে। কেননা এটি তার নিজ থেকে সংজ্ঞায়িত সুখনীতিকে অন্যদের সাথে বন্ঠন করতে চায়না। সেই সংকীর্ণ সুখনীতিকে সুনিশ্চিত করতে জৈব-নৈতিকতা আইনের কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতার শরণাপন্ন হয়। জৈব-নৈতিকতা সামাজিকভাবে যে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও মৃত্যুর ধারণা তৈরি করে তার অন্তর্নিহিত ক্রটিপূর্ণ ফলাফল হচ্ছে সুপ্রজনন চর্চা ও যন্ত্রণা লাঘবের জন্য মৃত্যু। মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও মৃত্যু মূলত তার কাঙ্ক্ষিত জীবনের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের ব্যাপারে সচেতন এবং অন্যান্য জীবন তার নিকট তাৎপর্যহীন, এমনকি অনেকক্ষেত্রে এই জীবনকে সে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
করোনা মহামারির প্রকোপের সময় পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশকে জৈব-নৈতিকতার যৌক্তিকতাকে চর্চা করতে দেখা গেছে৷ যার লক্ষ্য ছিলো কাঙ্ক্ষিত জনসংখ্যাকে বাঁচিয়ে রেখে উৎপাদনে অক্ষমদের মর্যাদপূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত করা।আলাঁ বাদিয়্যুর (Alain Badiou)এই জৈব-নৈতিকতা সম্পর্কিত আলোচনাটি তার Ethics: An Essay on the Understanding of Evil নামক বই থেকে অনুবাদ করা হয়েছে, যে বইটি ফরাসি ভাষা থেকে Peter Hallward ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
অনুবাদক: জাহিদুল ইসলাম
এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যেসব ‘সামাজিক জটিলতাসমূহ’ মিশে আছে সেগুলোকে মোকাবিলায় নৈতিকতা কমবেশি সুবিধা প্রদান করে থাকে। তবে এসব সুবিধার মধ্যে কোনটিই কখনো ব্যথা এবং যন্ত্রণা উপশম করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে জীবনের মৃত্যু ঘটানো (euthanasia) সম্পর্কিত অনন্ত বিতর্ক প্রসঙ্গে সামান্যতম বোধশক্তি তৈরি করেনা।
যন্ত্রণা উপশম করার জন্য মৃত্যু কথাটি খুবই স্পষ্টভাবে এই প্রশ্নকেই হাজির করে: ‘আমাদের নিজের তৈরিকৃত সুখের ধারণার ভিত্তিতে, আমরা কি কাউকে হত্যা করতে পারি? সেটি কেন এবং কিভাবে?’ এটি নৈতিকতার একটি স্থিতিশীল মর্মস্থলের জানান দেয় যার উপর নৈতিক অনুভূতি নির্ভরশীল। আমরা সবাই জানি যে নৈতিক ‘চিন্তাভাবনাকে’ অপরিবর্তনীয় হিসেবে উল্লেখ করার মাধ্যমে ‘মানবীয় মর্যাদা’কে নির্মান করা হয়। মর্যাদার নির্মাণ এবং মৃত্যুর জন্য হয়ে ওঠার (being for death) সমন্বয় যথাযথভাবে ‘মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যুর’ ধারণাকেও নির্মাণ করে।
কমিশন, সাংবাদিক, বিচারক, রাজনীতিবিদ, পুরোহিত, চিকিৎসক সবাই একটি মৃত্যুকে মর্যাদার সঙ্গে পরিচালনা করার জন্য নৈতিকতার সংজ্ঞায়ন নিয়ে বিতর্ক করেন এবং আইনের মাধ্যমে তার অনুমোদন প্রদান করেন।
এটি নিশ্চিত হতে হবে যে, কষ্টে ভোগা এবং পতন ঘটা ‘মর্যাদাপূর্ণ’ নয়। আমাদের যেসব প্রজন্ম রয়েছে তাদের অধিকারসমূহের মসৃণ, উদ্যম এবং সুপুষ্ট ভাবমূর্তির ব্যাপারে কখনো নিশ্চিত হয়ো না। যন্ত্রণা উপশম করার জন্য মৃত্যু, এ বিতর্কের পক্ষে বার্ধক্য এবং মৃত্যুকে যেভাবে প্রতিকায়িত করা হয় তার মধ্যে যে আমূল দুর্বলতা রয়েছে তা লক্ষ্য করতে কে বা ব্যর্থ হবে? যেখানে বেঁচে থাকার দৃশ্যকে বর্তমানের অসহীনয় বৈশিষ্ট্যসূচক হিসেবে দেখানো হয়? এখানে নৈতিকতা হচ্ছে স্পষ্টতই দুইটি বিপরীত দিকে পরিচালিত হওয়ার সংযোগস্থল। যেহেতু মানুষ একে মন্দহীন হিসেবে ‘সুখ’ এবং জীবন দ্বারা সংজ্ঞায়িত করে, একই সাথে এটি মৃত্যুতে মুগ্ধ হয় যদিও এ সম্পর্কে প্রামাণিকভাবে চিন্তাভাবনা করতে অক্ষম। এই ধরনের বোঝাপড়ার ফলাফল হচ্ছে যতটুকু বিচক্ষণভাবে সম্ভব হয় মৃত্যু নিজেই নিজেকে একটি মনোরম দৃশ্যে রূপান্তর ঘটায়। একইসাথে বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যাশা করার যে অধিকার রয়েছে এটি যেনো তাদের সন্তুষ্টজনক অজ্ঞতার বিভ্রান্তিকর স্বভাব দ্বারা বাধ্যগ্রস্ত না হয় এই বিষয়টিকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করা হয়। নৈতিকতার জ্ঞানভাষ্য একইসাথে অদৃষ্টবাদী এবং অনড়ভাবে অ-বিয়োগান্তক। এটি মৃত্যুকে প্রতিরোধের যে অবিনশ্বরতা রয়েছে তাকে ব্যবহার করে কোনধনের বিরোধিতা করা ছাড়াই মৃত্যুকে ‘তার নিজের কাজ করার ব্যাপারে’ অনুমোদন দেয়।
আমরা স্মরণ করতে পারি, এটিই সত্য যে, জৈব-নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রের আসক্তির সাথে যন্ত্রণা থেকে উপশমের জন্য হত্যা বিষয়টি নাৎসিবাদের স্পষ্ট ক্যাটাগরি হিসেবে ছিলো। ভিত্তিগতভাবে, নাৎসিবাদ ছিলো জীবনের সর্বব্যাপী চলমান নৈতিকতা। এটির মধ্যে তার নিজস্ব ‘মর্যাদাপূর্ণ জীবনের’ ধারণা ছিলো। অনমনীয়ভাবে এটি মর্যাদাহীন জীবনের মৃত্যু ঘটানোর ব্যাপারটিকে অনুমোদন করেছিলো। নাৎসিবাদ বিচ্ছিন্ন ছিলো এবং একসময় এটি তার নাস্তিবাদী (nihilist) কেন্দ্রের মধ্যে জল্পনাকল্পনার চেয়ে রাজনৈতিকভাবে কোনকিছুর মাধ্যম হওয়ার নিজস্ব বন্দোবস্ত করেছিলো। এবং এটি (নাস্তিবাদ) ‘নৈতিক’ স্বভাবজাতের চূড়ান্ত সমাপ্তিকে বহন করেছিলো। একই কারণে জৈব-নৈতিকতা সম্পর্কে আমাদের দেশের রাষ্ট্রিয় অধিদপ্তসমূহের যে প্রধান উপস্থাপনা রয়েছে তা অশুভের পূর্বাভাস দেয়। এখানে একে প্রতিহত করার জন্য উচ্চস্বরে প্রতিবাদ হবে। আর এটি হবে বলেই সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, কেননা এই ধরনের নাৎসিবাদী তৎপরতায় জীবন ও মর্যাদার অধিকারকে রক্ষা করার জন্য আইন কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিজ্ঞানের বেগবান সুবিধা আমাদেরকে সব ধরনের জৈবিক আধিপত্য পরিচর্চা করার উপায় প্রদান করেছে। আমাদের এসব প্রতিবাদে মুগ্ধ হওয়া উচিত নয়। বরং এই ধরনের রাষ্ট্রিয় অধিদপ্তর এবং আইনসমূহের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমাদেরকে জোরালোভাবে বিতর্ক করতে হবে। এগুলো যে ইঙ্গিত বহন করে তা হচ্ছে পাবলিক এবং প্রাইভেট মানসিকতার অবয়ব স্থাপনের মাধ্যমে সমস্ত সমস্যার ব্যাপারে অপরিহার্যভাবে সন্দেহভাজন হতে হবে। ‘নৈতিকতার’ সাথে ‘জৈবিক’ এই সংমিশ্রণ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হুমকিস্বরূপ। যেভাবে সুপ্রজননবিদ্যার সাথে যন্ত্রণা থেকে উপশমের জন্য হত্যা করার বিষয়টি মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা হুমকিস্বরূপ। ‘ভালোভাবে মৃত্যুবরণ’ করার একটি সুখবাদী (hedonistic) মতবাদ ‘ভালোভাবে বেঁচে থাকার’ জন্য অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, এবং এটি কখনো ‘ভালোভাবে উৎপাদনের’ জন্য যে শক্তিশালী ও সত্যিকারের হত্যাকারী আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তার বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ করবে না।
সমস্যার মূলভিত্তি হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট উপায়ে প্রত্যেক ব্যক্তির সুখের সংজ্ঞা নাস্তিবাদী। এটা স্পষ্ট যে নাস্তিবাদী অভিযানের বিরুদ্ধে আমাদের অসুস্থ সমৃদ্ধি রক্ষার জন্য যে বহিরাগত প্রতিপক্ষ রয়েছে, তা নৈতিক কমিশনের বিদ্রুপাত্মক এবং জটিল বাধা হিসেবে অন্যদের অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ হিসাবে হাজির হয়।
যখন নাগরিক নৈতিকতার রাজনৈতিক স্তাবক হিসেবে একজন প্রধানমন্ত্রী১ এটি ঘোষণা দেন যে ফ্রান্স ‘পৃথিবীর সমস্ত দুর্দশাকে স্বাগত জানাতে পারবে না,’ তখন কথিত দুর্দশা অংশটিকে আলাদা করার জন্য আমরা যেসব মানদণ্ড এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে কোন অংশকে স্বাগত জানানোর জন্য অনুরোধ করতে পারব সেগুলো না বলার ব্যাপারে তিনি সতর্ক থাকেন। সন্দেহাতীতভাবে এর মধ্য দিয়ে বন্দিশালার মধ্য থেকে এর বিনাশের জায়গায় ফিরে যাই। যার ফলে আমরা সেইসব অংশীদার মুক্ত ঐশ্বর্যগুলি উপভোগ করতে থাকি যেগুলোকে আমরা আমাদের সুখ এবং আমাদের ‘নৈতিকতা’ উভয়ের শর্ত হিসাবে জানি। একইভাবে এর মাধ্যমে স্থিতিশীল, ‘দায়িত্বশীল’ এবং অবশ্যই সম্মিলিত মানদণ্ডে মীমাংসা করা অসম্ভব। যে ঐশ্বর্যের নামে জৈব-নৈতিকতার কমিশনগুলি সুপ্রজননবিদ্যার সাথে যন্ত্রণা থেকে উপশমের জন্য মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য করবে, শ্বেতাঙ্গ মানুষের বৈজ্ঞানিক উন্নতি সাথে তার সুখের এবং দানবের ‘মর্যাদার সাথে’ যারা কষ্টভোগ করে বা দেখতে অপ্রীতিকর হয়ে ওঠে তাদের মধ্যকার পার্থক্য ও নির্মূল করবে তা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
সম্ভাবনা, জীবনের পরিস্থিতি, বিশ্বাসের জট এগুলো ক্লিনিক্যাল চিকিৎসার ব্যতিক্রমী অবস্থা নয় বরং এগুলো কঠোর এবং নিরপেক্ষ চিকিৎসার সাথে সংমিশ্রিত। এটি জৈব-নৈতিক কর্তৃপক্ষের আড়ম্বরপূর্ণ, মিডিয়ার জন্য তৈরি করা বাধ্যতামূলক তৎপরতার চেয়ে হাজার গুণ বেশি মূল্যবান [উদাহরণ] এমন বাধ্যতামূলক কর্মতৎপরতা যাদের কাজের জায়গা ও সুনাম জৈব-নৈতিকতার জঘণ্যতা সম্পর্কে আভাস প্রদান করে।
নোট
১) বাদিয়্যু এখানে মাইকেল রকার্ডের কথা উদ্ধৃত করেছেন।