আলাঁ বাদিয়্যু এমন একজন সাম্যবাদী দার্শনিক যিনি পাশ্চাত্যের সমসাময়িক মার্কসবাদীদের চেয়ে স্বতন্ত্র। এই ভিন্নতার ক্ষেত্রে তার প্রধান কারণ হচ্ছে তিনি অন্যান্য মার্কসবাদী চিন্তকদের মতো লেনিন বা স্ট্যালিনের রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে মাও সেতুং দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। পশ্চিমা বিদ্যাজগতে এই ধারার দার্শনিকদের উপস্থিতি খুবই সীমিত। বাদিয়্যুর মতে মাও সেতুং-এর চিন্তার মধ্যে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল, আর তা হচ্ছে মাও সেতুং চিন্তা করতেন ‘অনন্ত উপায়ে।’১ এই অনন্ত বা অসীম বিষয়টি তার নিকট খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যা তিনি মাও সেতুং-এর রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখেছেন। অসীম বিষয়টিকে বাদিয়্যু তার রাজনৈতিক ধারণাকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করেছেন।
বাদিয়্যুর ক্রিটিকাল চিন্তায় রাজনীতি হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরি। তার রাজনৈতিক দর্শন সমসাময়িক সঙ্কটসমূহকে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিকল্প এক সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এ প্রবন্ধটি তার রাজনৈতিক ধারণা ও সাম্যবাদী প্রকল্পের একটি পর্যালোচনা।
রাজনীতির ধারণা
রাজনীতিকে ধারণাগতভাবে বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। উত্তর-মার্কসবাদী দার্শনিকদের মধ্যে আলাঁ বাদিয়্যু রাজনীতিকে গুরুত্বের সাথে বিশ্লেষণ করে থাকেন। তার আলোচনায় রাজনীতি হচ্ছে অন্যতম একটি বর্গ। তিনি একে সত্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার অন্যতম শর্ত হিসেবে বিবেচনা করেন। বাদিয়্যু প্রধানত চারটি ক্ষেত্রে সত্য উৎপাদন পদ্ধতির কথা বলে থাকেন। এগুলো হচ্ছে বিজ্ঞান, রাজনৈতিক উদ্ভাবন, শিল্পকলা এবং প্রেম।২ এগুলো নির্দিষ্ট উপায়ে তাদের সত্যকে উৎপাদন করে। বাদিয়্যু রাজনীতি বলতে সাবজেক্টকে বোঝান, যে সাবজেক্ট ব্যক্তিবিশেষকে নির্দেশ করেনা বরং এই সাবজেক্ট হচ্ছে পরিবর্তনের কর্তা। বাদিয়্যুর নিকট রাজনীতি শুধু চর্চার বিষয় নয়। চিন্তা এবং চর্চা এ দুটিই রাজনীতির মধ্যে একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। তাই রাজনীতি হচ্ছে চিন্তা-চর্চার বিষয়। বাদিয়্যুর মতে রাজনীতি হচ্ছে পরিচয়, কর্ম, সিদ্ধান্ত এবং নীতির বিষয় যা একটি সাবজেক্ট বা একটি সাবজেক্টিভ মাত্রা দাবি করে।৩ তার মতে রাজনীতি ও মার্কসবাদ উভয়ই হচ্ছে সাবজেক্ট বা পরিবর্তনের কর্তা। কেননা এগুলোর মধ্যে যদি পরিবর্তনের কর্তা না থাকলে তাহলে একে চর্চা করা সম্ভব হয়না। তাই মার্কসবাদকে যখন নিছক অবজেক্টের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসা হয় তখন তা অর্থনীতিবাদে পরিণত হয়। প্রথম দিকে মার্কসের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে, যখন মার্কস হেগেলীয় ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইতিহাসের দর্শন, দ্বান্দ্বিকতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে মার্কস যখন সমাজের সার্বিক কার্যাবলি ও পরিবর্তনের জন্য নতুন তত্ত্বচিন্তাকে নির্মাণের ব্যাপারে সচেতনভাবে কাজ করা শুরু করেন তখন এই ধরনের প্রবণতা হ্রাস পায়। এ পর্যায়ে মার্কস তার প্রায় সমস্ত সময় ক্যাপিটাল লেখার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, যা ছিলো তার কাজের কেন্দ্রবিন্দু। একইসাথে এটি ছিলো অত্যন্ত বিশদ, অত্যন্ত বিশ্লেষণাত্মক বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে এমন এক পরিবর্তনের কর্তাকে আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা যেখানে হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতা শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা পালন করেছে। বাদিয়্যুর মতে এইধরনের কাঠামোগত বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতির মাধ্যমে মার্কস মূলত বৈপ্লবিক সাবজেক্ট তৈরি করেছেন।৪
রাজনীতিকে সাবজেক্ট বা পরিবর্তনের কর্তা হয়ে ওঠার জন্য দুইটি বিষয়ের সাথে সংযুক্ত হতে হয়। যার একটি হচ্ছে সত্যতা অন্যটি ঘটনা।৫রাজনৈতিক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এই দুইটি বিষয় বাদিয়্যুর চিন্তাতত্ত্বে অপরিহার্য। বাদিয়্যুর নিকট ঘটনা হচ্ছে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ‘ঐতিহাসিক আন্দোলন’ এবং ‘রাজনৈতিক সংগঠনের’ একটি অস্থায়ী সময়কাল।৬ সত্যিকারের রাজনীতি হচ্ছে বৈপ্লবিক এবং (Eventmental) ঘটনাভিত্তিক। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক সত্য গণমানুষকেন্দ্রিক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে। বাদিয়্যুর নিকট মার্কসের যে বিপ্লবের ধারণা এটি হচ্ছে প্রধানতম রাজনৈতিক ঘটনা। এটি ‘প্রয়োজনীয়’ অথবা ‘অসম্ভব’ কোন ঘটনা নয় বরং এটি হচ্ছে ‘সম্ভাবনা।’৭ ঘটনা হচ্ছে বিদ্যমান কাঠামো বা পরিস্থিতির সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে উদ্ভাবনমূলক পরিস্থিতি তৈরি করা। এটি বিদ্যমানতার মধ্য থেকে সম্ভাবনা বা প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করে না। বরং এর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করাই ঘটনার কাজ। ঘটনার মধ্য দিয়েই উদ্ভাবনমূলক অসীম রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশের পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেখানে ব্যক্তি তার একককে ছাড়িয়ে সমষ্টি এবং সবর্জনীনের মধ্যে প্রবেশ করে। যেখানে ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে এমন কিছু নির্মাণ করে যার সবর্জনীন গ্রহণযোগ্যতা থাকে অথবা এমনকিছু যা বাস্তবের অসীমতাকে স্পর্শ করে।৮
রাজনীতির জন্য সত্য প্রক্রিয়া হচ্ছে আরেকটি মৌলিক বিষয়। বাদিয়্যু রাজনৈতিক সত্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সত্যকে আপেক্ষিক হিসেবে নয় বরং চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচনা করেন। কেননা যদি একে আপেক্ষিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে সত্য এবং মতামতের মধ্যে পার্থক্য থাকেনা।৯ মতামতের মধ্যে পার্থক্য এবং ভিন্নতা থাকে, কিন্তু সত্য একটি পরম অবস্থা যা সার্বিকভাবে সত্য। কোন একক সত্যের মধ্যে যদি মতামতের মতো ভিন্নতা এসে উপস্থিত হয় তাহলে সত্য বলতে কিছু থাকেনা। সত্য চূড়ান্ত হওয়ার পাশাপাশি এটি একটি অসীম বিষয়। বাদিয়্যুর মতে অসীম হচ্ছে বাস্তব, অন্যদিকে সসীম কোন বাস্তব বিষয় নয়। কাজেই সত্য সবসময় বাস্তবতার অসীমকে স্পর্শ করে।১০ অসীম ছাড়া বাস্তবতাকে প্রমাণ করা যায়না। এজন্য দেকার্ত তার দর্শনে অসীমের (ঈশ্বরের) মধ্য দিয়ে বাস্তবতাকে প্রমাণ করেছেন।১১ দেকার্ত সংশয়বাদকে বাস্তব জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি ব্যবহার করে, অসীমের পর্যায়ে এসেই তিনি নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি পরিবর্তন অথবা বিপ্লব অসীমকে স্পর্শ করে। রাজনৈতিক অসীমকে সবসময় শাসকগোষ্ঠী বা ক্ষমতার দ্বারা অবদমন করে রাখা হয়। আরব বসন্ত চলাকালীন সময়ে মিশরের জনগণ যখন ‘আমরা সবাই মিশরীয়’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল বাদিয়্যুর ব্যাখ্যা মতে তারা তখন মূলত এমন কিছুকে স্পর্শ করতে সক্ষম হচ্ছিল যার অসীমত্বকে অবদমিত করে রাখা হয়েছে।১২ সত্যিকারের আন্দোলন বা বিপ্লব হচ্ছে অসীমের মধ্যে প্রবেশ করা। যেখানে রাজনৈতিক উদ্ভাবনের বিভিন্ন সম্ভাবনা থাকে। এটি তার অসীমত্বের কারণেই রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। প্রত্যেকটি আন্দোলনের ঘটনা হচ্ছে সাম্যভিত্তিক স্পৃহার প্রতিফলন। বাদিয়্যুর মতে সাম্যবাদের অস্তিত্ব শাসন ক্ষমতার মধ্যে নয় বরং এর অস্তিত্ব হচ্ছে আন্দোলনের মধ্যে।১৩
বাদিয়্যু রাজনীতির ধারণাকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা সমসাময়িক উত্তর-আধুনিক দার্শনিক ঐতিহ্যের বিপরীত। কেননা তিনি রাজনীতির বিভিন্ন ধারণা হিসেবে সাম্যবাদ, ন্যায্যতা, সত্য ও মিথ্যার ভিত্তি সহ অপরাপর মূল্যবোধসমূহকে সার্বজনীন হিসেবে বিবেচনা করেন। গণিত এবং গাণিতিক যুক্তির সাথে দীর্ঘ সময় ধরে সম্পৃক্ততার কারণে সম্ভবত সার্বজনীনতার পক্ষে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। যদিও নাৎসিবাদ বা সর্বাত্মকবাদী রাজনীতির উৎস হিসেবে সার্বজনীনভাবে বিভিন্ন মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়াকে দায়ী করা হয়। বাদিয়্যুর মতে এইধরনের রাজনীতি ক্ষেত্রে সার্বজনীনতা দায়ী নয় বরং বিশেষতা (particularity) দায়ী। নাৎসিরা ‘জার্মান’ বিশেষতাকেই প্রচার করত।১৪এই বিশেষত্বকেই তারা নাৎসিবাদের মৌলিক ক্যাটাগরি হিসেবে ব্যবহার করেছে। স্ট্যালিনের সমাজতন্ত্রও ছিলো সার্বজনীন আন্তর্জাতিকতাবাদ বিরোধী বিশেষ রাষ্ট্রতন্ত্র। একইভাবে বুশ যখন ঘোষণা করেছিলেন যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ইরাকে যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন তখন এটি হচ্ছে তার ভাবাদর্শকেন্দ্রিক বিশেষ অবস্থান। যার ফলে এগুলোর প্রত্যেকটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের কর্তা বিরোধী। আর পরিবর্তনের কর্তা বিরোধী রাজনীতি সত্য কিংবা ঘটনাকে নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী থাকেনা বরং এটি ক্ষমতা এবং বিচ্ছিন্ন মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যার ফলে পরিবর্তনের কর্তা অবস্থানগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সামাজিক ন্যায্যতা বাধাগ্রস্ত হয়।
এই ধরনের তৎপরতা বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের দল কতৃক পরিচালিত হচ্ছে কিন্তু এখনো এদেশে রাজনীতি তৈরি হচ্ছেনা। রাজনীতি বলতে এখানে শুধুমাত্র ক্ষমতা অধিগ্রহণের মাধ্যমে শাসন করাকে বোঝায়। কিন্তু রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে জীবনের সম্ভাবনাকে বিস্তৃত করা। বিপরীতে আমাদের দেশে রাজনীতির চর্চার বিষয়টি শুধুমাত্র ক্ষমতা আদান প্রদানের প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিকে শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক উপায় বা সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করলে রাজনীতির যে নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে যেগুলো ঘটনা ও সত্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কাজ করে তা আড়ালে থেকে যায়। একইসাথে এইধরনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে রাজনীতির মধ্যে পরিবর্তনের নিজস্ব কর্তাসত্তা তৈরি হয়না। মূলত ক্ষমতাকে রূপান্তরের মাধ্যমে জীবনের সম্ভাবনা ও প্রস্তাবনাকে সম্প্রসারণ করাই হচ্ছে রাজনীতি। স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ সময় থেকে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক, সেনা শাসকদের কতৃত্ববাদ সহ বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু এদেশের রাজনীতির তেমন গুণগত পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতির এই সমস্যা শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক বা সাম্প্রতিক কোন সমস্যা নয়। তাৎক্ষণিক সমস্যাকে দেখতে হবে উৎপত্তিসন্ধান (genealogical) পদ্ধতির আলোকে। বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তনের কর্তা তৈরি না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে রাজনীতি হয়ে ওঠার যে ঘটনা ও সত্য প্রক্রিয়া রয়েছে তার সাথে কার্যকর সম্পর্কের অনুপস্থিতি। ঘটনা ও সত্য উৎপাদন প্রক্রিয়াকে কার্যকর হওয়ার জন্য নৈতিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিকসহ তার সার্বিক পরিসরকেই সঠিকভাবে বিকশিত হওয়ার প্রয়োজন ।
সাম্যবাদী প্রকল্প
বাদিয়্যুর সাম্যবাদের আদর্শের মধ্যে তিনটি মৌলিক বিষয়ের উপস্থিতি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে রাজনীতি, ইতিহাস এবং সাবজেক্ট বা পরিবর্তনের কর্তা।১৫ বাদিয়্যুর আদর্শের সাথে প্লেটোনিক ভাববাদী সম্পর্ক রয়েছে যা সমসাময়িক গণতান্ত্রিক বস্তুবাদ বিরোধী। তার সাম্যবাদের আদর্শ হচ্ছে মানব প্রজাতিকে একটি ‘সামষ্টিক মুক্তির’ দিকে অগ্রসরবর্তী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করা। তিনি সাম্যবাদের ধারণাকে রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক সমন্বিত ধারণা হিসেবে দেখেন।১৬ মাও সেতুং-এর মতো বাদিয়্যুও মনে করেন আদর্শ সাম্যবাদের ধারণার উৎপত্তি হয় রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়ে।১৭
রাজনীতির ক্ষেত্রে কোন ঘটনার মধ্য দিয়ে কোনকিছু সত্য হয়ে ওঠে, তাই সাম্যবাদের আদর্শ ঘটনার মধ্য দিয়েই সত্য হিসেবে নির্মিত হয়। সাম্যবাদের আদর্শ তখনই সত্য হয়ে ওঠে যখন এটি ঘটনাভিত্তিক মুক্তিকামী রাজনীতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। তবে ঘটনা তার নিজের মধ্যে ‘দল-নেতার’ আদর্শকে ধারণ করেনা। ধ্রুপদী মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের ভিত্তি হিসেবে ‘অগ্রবর্তী শ্রেণীর দল’, ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’, ‘গণবাহিনী’ ইত্যাদি ধারণা বাদিয়্যু নিকট সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাৎপর্যহীন। এগুলো উনিশ শতকের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হলেও একুশ শতকের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। দল-নেতার আদর্শ যে এখন আর কাজ করেনা তার উদাহরণ হচ্ছে একুশ শতকের বিভিন্ন ঘটনা বা আন্দোলন। আরব বসন্ত, হংকং-এ চীনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা ভারতের কৃষক আন্দোলন সহ প্রায় সবগুলো আন্দোলন নেতাকেন্দ্রিকতা বিহীন। একইসাথে এই ঘটনাগুলো রাষ্ট্রিয় ক্ষমতাকে বিভিন্নভাবে সংকুচিত করছে। এই ধরনের প্রবণতাকে বাদিয়্যু নাম দিয়েছেন ‘আন্দোলনবাদ’ যা আরব বসন্ত পরবর্তী সময় থেকে সূচনা ঘটে।১৮ এই আন্দোলনের পিছনে বিশেষ বা একক কোন কারণ নয় বরং অনেক গুলো কারণই আংশিকভাবে প্রভাবিত করে আন্দোলনের একটি সামষ্টিক রূপদান করেছে। এসব আন্দোলনের ঘটনা যে বিষয়টিকে সার্বজনীন সত্য হিসেবে উৎপাদন করছে তা হচ্ছে সাম্য বা সমতা। তাই বাদিয়্যু মতে একমাত্র সমন্বয়ী চিন্তা ও তৎপরতার মধ্য দিয়েই এসব আন্দোলনকে গণ সাম্যবাদের রূপ দেওয়া যাবে।১৯
সাম্যবাদের দ্বিতীয় মৌলিক বিষয় হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাসের মধ্য দিয়ে সত্য প্রক্রিয়া হাজির হওয়ার ক্ষেত্রে বাদিয়্যু বিভিন্ন আন্দোলনের কথা বলেন যা সাম্যবাদের স্পৃহা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। এইসব আন্দোলনগুলো ভালোর ধারণার প্রায়গিক সম্প্রসারণের জন্য আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয় এবং একইভাবে বিলীন হয়ে যায়। তাই ঐতিহাসিক প্রতিফলন হচ্ছে এমন একটি আকস্মিক সন্ধিক্ষণ যা মুক্তির ধারণাকে আরো বেশি সম্প্রসারিত ও প্রায়োগিক করে তুলে। ঐতিহাসিক আন্দোলনসমূহ যে সাময়িক সত্য প্রক্রিয়াকে সম্ভব করে তুলে তা শুধু বর্তমান নয় বরং পরবর্তী আন্দোলনগুলোকেও সম্ভাবনাময় দিকনির্দেশনা প্রদান করে। বাদিয়্যুর বিশ্লেষণে এই ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফরাসি বিপ্লব, চীনের স্বাধীনতা আন্দোলন, বলশেভিক বিপ্লব এবং চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব।২০ ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে সাময়িক সত্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ার কথা বললেও বাদিয়্যুর অবস্থান ইতিহাসবাদের বিরুদ্ধে। ইতিহাস এখানে শুধুমাত্র ‘প্রতীক’ হিসেবে কাজ করে, এটি কখনো সত্যিকারের ‘সাবজেক্টিভিটি’ বা ‘ভাবাদর্শ’ হয়ে উঠতে পারেনা।২১ ইতিহাস কোন সাবজেক্টিভ বা ‘গৌরবময়’ ইতিহাস নয়। বাদিয়্যুর প্রস্তাবণা হচ্ছে ইতিহাসের পরিবর্তে বা বিকল্প হিসেবে ‘রাষ্ট্রিয় ইতিহাস’ কথাটিও ব্যবহার করা যায়।২২ কেননা মানুষের জীবনের ইতিহাস হচ্ছে রাষ্ট্রের ইতিহাস। যা দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তি প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে সীদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর ধর্ম, রাজনীতি, প্রথা, পরিবার, মূল্যবোধ সবই হলো রাষ্ট্র ও মানুষের এই সম্পর্কের মধ্যস্থতাকারী।
বাদিয়্যুর সাম্যবাদী আদর্শের তৃতীয় উপাদান হচ্ছে সাবজেক্ট। সাম্যবাদী প্রকল্প হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সাবজেক্ট বা পরিবর্তনের কর্তা।২৩সাম্যবাদী প্রকল্পের জন্য এটি রাজনীতি এবং ইতিহাসের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর সঙ্কটই মূলত সাম্যবাদের প্রকল্পকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ করে, যেভাবে সাম্যবাদ বাধাগ্রস্থ হয়েছে চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে। সাবজেক্ট বা পরিবর্তনের কর্তা হচ্ছে প্রত্যেকটি ঘটনা এবং সত্য প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতাকারী। প্রত্যেকটি ঘটনাই সাবজেক্টের ধারণাকে কেন্দ্র করে মুক্তিকামী স্পৃহার সম্প্রসারণ ঘটায়। আর এগুলোর সত্য প্রক্রিয়া হচ্ছে মূলত ‘সাবজেক্টের সত্য প্রক্রিয়া।’ সত্য প্রক্রিয়াকে যখন ‘দল-নেতার’ ভিত্তিতে ব্যক্তি পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসা হয় তখনই মুক্তির ধারণা সংকুচিত হয়ে একটি বিশেষ রূপ লাভ করে। তবে দল-নেতার বিপরীতে মুক্তিকামী রাজনীতি হচ্ছে সাম্যবাদের সত্যিকারের শর্ত। এই মুক্তিকামী রাজনীতি হচ্ছে ‘নামহীন’ গণমানুষের রাজনীতি।২৪ বাদিয়্যুর নামহীন গণমানুষের বর্গ হচ্ছে দল-নেতার বিপরীতে সম্ভাবনাময় একটি বর্গ। যাদের মুক্তির মধ্য দিয়েই সাম্যবাদকে অনিবার্য করে তুলে। এই ধরনের সাম্যবাদ কোন সাম্যবাদী রাজনৈতিক দল অথবা শাসনের অধীনে পরিচালিত হবেনা। কারণ বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ধরনের আদর্শ পরিবর্তন ও সাম্যবাদের জন্য ‘উপযুক্ত নয়।’২৫
পরিশেষ
বাদিয়্যুর চিন্তাধারা গভীরভাবে রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘ সময় রাজনীতিতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। তার রাজনীতির তত্ত্বসমূহ সমসাময়িক ফ্রান্সের প্রভাবশালী বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতাগুলির সাথে বিভিন্নভাবে বিপরীত অবস্থান দখল করেছে। বাদিয়্যু রাজনীতির ধারণা হচ্ছে চিন্তা এবং চর্চার তাৎপর্যপূর্ণ সমন্বয়। এটি জনজীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করে। মুক্তিকামী রাজনীতিকে সম্ভাবনাময় করে তুলার জন্য বাদিয়্যু অনবরত রাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলোকে বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমসাময়িক রাজনৈতিক ব্যবস্থার যে আধিপত্যশীল কাঠামো তৈরি হচ্ছে তা থেকে মুক্তির একটি স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা আমাদের সামনে হাজির হয়।
তথ্যসূত্রঃ
১) Miri Davidson, Alain Badiou: “Mao thinks in an almost infinite way” 16 May 2016, Verso.
www.versobooks.com/blogs/2033-alain-badiou-mao-thinks-in-an-almost-infinite-way
২) Translated by Susan Spitzer, Philosophy and the Idea of Communism: Alain Badiou in conversation with Peter Engelmann, Polity Press, UK, 2015, p.96
৩) Ibid, p.3
৪) Ibid, p.33
৫) Ibid, p.5
৬) Alain Badiou, Can Politics be Thought?, Translated by Bruno Bosceels, Duke University Press, Durham and London, 2018, p.10
৭) Translated by Susan Spitzer, Ibid, p.34
৮) Ibid, p.60
৯) Ibid, p.13
১০) Ibid, p.14
১১) Ibid, p.16
১২) Ibid, p.20
১৩) Ibid, p.50
১৪) Ibid, p.73
১৫) Alain Badiou, The Communist Hypothesis, Translated by David Macey and Steve Corcoran, Verso, London and New York, 2010, p.230
১৬) Ibid, p.236
১৭) Ibid, p.47
১৮) Alain Badiou, On the Current Conjuncture, 21 December 2020, Verso.
www.versobooks.com/blogs/4954-on-the-current-conjuncture
১৯) Ibid.
২০) Alain Badiou, The Communist Hypothesis, Ibid, p.232
২১) Ibid, p.236
২২) Ibid, p.245
২৩) Ibid, p.8
২৪) Ibid, p.249
২৫) Ibid, p.257