ব্যক্তি ইরফান সম্পর্কে খুব কিছু জানি না। আসলে ওর অভিনয়ের লগে যে সময়টাতে চিন পরিচয় হইছে, তখন ব্যক্তির চাইতে তার অভিনয়ই মুখ্য হয়ে উঠছিল। তাই ব্যক্তির চাইতে কর্মের খোঁজ রাখছি বেশি। আমি রাখতাম না বইলা তার অন্য ফ্যানরা যে রাখতো না তা নিশ্চয় না। তয় আমার ধারণা, যারা ব্যক্তি ইরফান আর কর্মের ইরফান সম্পর্কে খোঁজ রাখতো সক্কলেই তার দুর্দান্ত অভিনয় সম্পর্কে জানতো। তারে জানার মূল বিষয়টাই হলো, তার বিচিত্র ধর্মী অভিনয়ের বৈচিত্র্যতা। একটা অভিনেতা কী করে সাধারণ ভাবে এক একটা চরিত্র আলাদা ঢং-এ, পৃথক রঙে বার বার দর্শকদের সামনে সার্ভ করে তা পৃথিবীতে শুধু ইরফানসহ গোটা কতক অভিনেতা অভিনেত্রীই জানে। ধারণা করি, (গরীব দর্শকের মনে হওয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু না) সুপার স্টার হওন সহজ কিন্তু পারফেক্ট অভিনেতা হওয়া কঠিন।
ইরফান খানের অভিনয়ের ভক্ত হইলেও তার সব ক’টা ছবি আমার দেখা হইয়া ওঠে নাই । এখানেও আমার থিওরি আছে, “খাদ্যবস্ত্রবাসস্থানের” দৌঁড়ে সবাই ব্যস্ত। এই কর্মব্যস্ত জীবনের অবসরটুকু খালি পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সব ছবি দেখে পার করা যেমন সম্ভব না, তেমনি দেখা উচিতও নয়। একজন অভিনেতা-অভিনেত্রীরে অস্তিত্ব টিকায়া রাখার স্বার্থে নানান ধরণের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। একজন সচেতন দর্শক হিসাবে বাছ-বিচার ছাড়া পছন্দের অভিনেতা- অভিনেত্রীর সব ছবি দেখা মানে তাদের অভিনয়ের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া যেমন আইতে পারে তেমনি দর্শক হিসাবে নিজের প্যাসন এবং স্বত্যন্ত্র রুচিবোধও তৈরী হয় না। দর্শক হিসাবে আমারারও রুচি আছে, চাইলেই ইরফান খান কী ওমর সানি কেউ আমারারে সব কিছু গিলাইতে পারবো না- এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত।
আসেন, ইরফান খানের( তার মৃত্যুর পর জানতে পারি, তিনি খান পদবী ব্যবহারে অনিচ্ছুক ছিলেন, নিজের স্বাতন্ত্র বোধ থাইকা, এটা আমার অজানা ইনফরমেশন। অবশ্য আমি তার মুভি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে ইরফান খান হিসাবে ইন্ট্রডিউস হইতে দেখেছি। আমার এটাও অজানা ছিল, তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, এককালে) সিনেমায় করা কিছু চরিত্র নিয়া একটু নাড়াচাড়া কইরা দেখি। এইটা আসলে, অকাল প্রয়াত প্রিয় অভিনেতার প্রতি একজন দর্শকের সামান্য শ্রদ্ধা নিবেদন মাত্র।
লাঞ্চ বক্স: এইটা একটি রোমান্টিক সিনেমা। এই রোমান্টিকতা আধুনিককালের ইন্সালটেড ফ্রম ফ্যামেলি, রোবোটিক পারসোনালিটি ফ্রম সোস্যাইটি আর নিঃসঙ্গ দুইজন মানুষের মধ্যে আশ্রয় খোঁজার মধ্যে গড়ে ওঠে। তাদের যোগসূত্র খাবার। একজন খাওয়াইয়া সুখ পায় আর একজন দীর্ঘদিন পর ফ্যামেলি টাচিং খাবার খাইয়া আনন্দ পায়। এই যে খাবারের মধ্য দিয়া দুইজন মানুষের পরস্পরের জন্য ভাবনা, ফিলিংস, দিল্লাগী, একে অপরে দেখার-জানার আগ্রহের সৃষ্টি হওন, এই সব চরিত্রের মইধ্যে ঢুইকা দর্শকদের চোখের সামনে তর্জনি উঁচায়া দেখানোর মতো অভিনয় করছে এই সিনেমায় ইরফান খান আর নিমরাত কাউর। যেহেতু ইরফানরে কথা হইতেসে তাই সাজান চরিত্রে থাকি। একজন একাকী মানুষ সাজান, বিপত্নীক। একঘেঁয়ে জীবন যাপনের রুটিন। দ্বিধাগ্রস্থ মধ্য বয়সী চাকুরীজিবীর চরিত্রে আমরা পারফেক্ট এক্টরকেই সাজান চরিত্রে দেখতে পাই এবং স্ক্রিনের সামনে বসে আমাদের মনে হইতে থাকে, এই মানুষটাই সাজান। এই সেই দুঃখী নিঃসঙ্গ, দ্বিধাগ্রস্থ, একাউন্টেন্ট। মধ্য বয়সী একাউন্টেন্টের নিঃসঙ্গতা আমাদের ছুঁইয়া যায় মধ্য রাইতের শরীর কাঁপাইন্না হিমেল হাওয়ার স্পর্শের মতন। দর্শকরা তব্দা দিয়া খালি সাজানের দুঃখে হাত বুলাইতে চায়-এইখানে একজন অভিনেতা সফল আর এখানেই ইরফানের যত ক্যারিশমা।
পান সিং টুমার: এই সিনেমা নিয়া বেশি কিছু বলার নাই। এই সিনেমায় অভিনয় কইরা ইরফান খান ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড পায়। এই ছবির কাহিনী, পরিচালনা এবং অভিনয়ই সব কিছু নিয়ে ছবিটি একটি পরিপূর্ণ ছবি। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, মুগ্ধ হয়ে ইরফানের অভিনয় দেখতে হয়। স্টেপলচেজ দৌঁড়ে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন, একজন সেনা সদস্য পান সিং টুমারের বায়োপিক সিনেমা এটি। সোনা জয়ী দৌঁড়বিদ সমাজের সিস্টেম এবং দুর্নীতির কারণে কী করে ডাকাইতে(পান সিং-এর মতে, ভাগী) পরিণত হয়ে ওঠে তাই এই ছবিতে তুলে ধরা হয়। ২০১২’র সিনেমা এটি।
তালভার বা তলোয়ার: ২০০৮-সালের রিয়েল লাইফ কেস নিয়া এই সিনেমা। যদিও ভূতের সিনেমা না, তারপরও এই সিনেমা পহেলা বার দেখার পর আমি সারা রাইত স্বস্তিতে ঘুমাইতে পারি নাই। ডাক্তার দম্পতি ট্যান্ডনরা তাদের চৌদ্দ বছরের কিশোরী কন্যা শ্রুতি ট্যান্ডন এবং বাসার সাহায্যকারী ছেলেকে খুন করে। যেইটা আছিল অনার কিলিং। এই ছবিতে ইরফান খানরে দেখা যায় সিডিআই অফিসার হিসাবে। যে ধোঁয়ায় ঢাকা রহস্যে ঘেরা কেইসের জটিলতা খুলতে থাকে এবং নির্লিপ্ত গোয়েন্দা অফিসারের অভিনয়েও ইরফান অনেক দক্ষ আর দর্শকদের বুঝায়া দে; সব গোয়েন্দা চরিত্র সিআইডি প্রোডাক্ট না। কর্মক্ষেত্রে তীক্ষ্ণ বুদ্ধীদিপ্ত, ডার্ক হিউমারাস এবং পেশাগত কারণে বিপর্যস্ত পারিবারিক জীবন, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা- অনবদ্য ছিল ইরফানের অভিনয়। নায়কোচিত বেশবাস আর এ্যাকশন ছাড়াও দর্শকদের বিমোহিত করা যায় খালি অভিনয় দিয়া অশ্বিনী কুমার চরিত্রে অভিনয় করে তাই দেখাইছ ইরফান।
বিল্লু (বারবার): ২০০৯’র ছবি বিল্লু (বারবার)। এই সিনেমায় ইরফান খান প্রত্যন্ত এক গ্রামের সাধাসিধা নাপিতের। যে স্ত্রী এবং দুই সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকে আর অবসরে গ্রামবাসীরে গল্প কইরা বেড়াত হিন্দি সিনেমার সুপার স্টার শাহির খানের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের আছিল। সবই ঠিকঠাক ছিল, সমস্যা হয় যখন সে গ্রামে শাহির খান শুট্যিং করতে আসে, গ্রামের সবাই বিল্লুরে চাপ দেয় তার বন্ধুর সঙ্গে তাদের পরিচয় করায়া দিতে আর এদিকে সুপার স্টারের প্রটোকল ডিঙিয়ে বিল্লু কিছুতেই পুরনো বন্ধুর কাছে পৌঁছাতে পারে না। গ্রামের সবাই বিল্লুকে মিথ্যুক ভাবে, এমন কী স্ত্রী সন্তানরাও। এই ছবিতে যদিও সুপার স্টার শাহরুখ খান আইটেম সং আর সব রকম জৌলুস নিয়ে উপস্থিত তারপরও সাধারণ ধুতি কুর্তার সাধাসিধা চরিত্রে ইরফান অনেক বেশি উজ্জ্বল। বাস্তবতা আর অপারগতা তার অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছ নিখুঁত ভাবে।
কারিব কারিব সিঙ্গেল: দুই মেরুর দুই মানুষের মধ্যে বর্তমানে প্রেম ঘটকে পারার মতো একটি সিনেমা। ইরফানকে আমার এই ছবিতে কিছুটা অন্য রকম লেগেছে। আসলে তার করা সব চরিত্রই আলাদা আলাদা তো।
পিকু: পিকু বিশেষ করে বাঙালিদের আপ্লুত করা সিনেমা। বাঙালি পরিবারের গল্প, অমিতাভ বচ্চন আর দীপিকার মুখে বাংলা শোনা(যদিও উচ্চারণগত ভিন্নতা ছিল)-সব মিলায়া কেমন চেনা চেনা গল্প। বাপ-বেটার গল্প আর ওদের পাশ কাটায়া মুখ্য হয়া ওঠে আর একটা চরিত্র এবং অবশ্যই বাপ-মেয়ের মাঝে স্যান্ডউইচ হতে থাকা চরিত্রের নাম রানা চৌধুরী। এই চরিত্রে ইরফান খান। অস্থির কিন্তু কেয়ারিং, হিউমারাস এবং দীপিকার সঙ্গে রোমান্স, ভালো লাগার মতো একটি চরিত্র।
লাইফ ইন অ্যা মেট্রো: আহ্! অদ্ভূত ভাবে এই সিনেমায় আমার সব চাইতে প্রিয় ক্যারেক্টার হইলো মন্টি। আমার কয়েকবার দেখা সিনেমা এবং আমি প্রতিবার মন্টিকে মুগ্ধ হয়ে দেখি। অনেকগুলো মুখোশ পরা, স্বার্থপর আর ধান্ধাবাজ চরিত্রের ভিড়ে সহজ সরল একটি চরিত্র। মন্টি ক্যারেক্টারের বিভিন্ন সহজ-সরল স্বীকারোক্তি কী সহজ ভাবেই না থ্রো করেছে ইরফান। আমার কাছে সাধারণ মন্টি একটা “ওয়াও” ক্যারেক্টার।
নেমসেক: জুম্পা লাহিড়ীর উপন্যাস অবলম্বনে বানানো এই সিনেমায় ইরফান খানরে বাঙালি ডাক্তারের চরিত্রে দেখি। সিনেমাতে টাবুও ছিল, ওদের দুই জনের যুগলবন্দী স্বাভাবিকভাবেই সিনেমাতে একটি ইফেক্ট আনবো ভাবসিলাম কিন্তু সিনেমাটা আমার তেমন ভালো লাগে নাই। উপন্যাসটি আগে পড়া ছিল কিন্তু সিনেমা দেখার সময় আমি ঠিক পড়ার মতো আনন্দটুকু পাই নাই।
লাইফ অফ পাই: যদি ছোট পিআই প্যাটেল পুরো সিনেমাটিকে টেনে নিয়ে গেছে তারপরও বড় পিআই প্যাটেল ইরফান খান নিজের ব্যক্তিত্বের কারণে দর্শকদের চোখে ঠিকই আটকা পড়ে। এই সিনেমার কারণে হলিউডে নিজেরে আরও বেশি পরিচিত করতে পেরছিল।
ইরফানের করা চরিত্রের মধ্যে একটা ভেরিয়েশন আছে, এবং এক চরিত্র থাইকা সে সহজেই অন্য চরিত্রে সুইফট করতে পারে। এক একটা চরিত্ররে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার কইরা তোলা -এসব গড় পড়তা আর্টিস্টকে দিয়ে হয় না। এটার জন্য ক্যালিভার লাগে, যা ইরফান খানের ছিল।
ইরফানের শেষ ছবি অ্যাংরেজি মিডিয়াম দেখা হয় নাই, খুব একটা দেখার আগ্রহও নাই-কারণ কিছু আছে। হিন্দি মিডিয়াম আমার ভাল্লাগে নাই। গতানুগতিক, টাইম পাস সিনেমা। বাংলাদেশে তার করা একমাত্র সিনেমা “ডুব” আমার দেখা হয়নি।
ইরফান হিন্দি সিনেমার লগে লগে প্রচুর পরিমানে হলিউডের ইংলিশ সিনেমায়ও অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু সব চরিত্র কি আর দর্শকের মনে দাগ কাটে। কত শত চরিত্র দেখি আমরা অন স্ক্রিনে, তার মধ্যে গুটি কয় হয়ত দর্শকদের স্মরণে থাইকা যায়। তেমন কিছু চরিত্র ইরফান সৃষ্টি কইরা গেছে, যা দর্শকদের হুটহাট কইরা কখনও সখনও মনে হইবো তখন হয়ত অকাল প্রয়াত অভিনেতার জন্য বুকের গভীর থাইকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবো। এটুকু প্রাপ্তি একজন অভিনেতার যথাযথ মরণোত্তর সম্মাননা হইতে পারে তার দর্শকদের কাছ থাইকা।
Shamim Runa, novelist, playwright, film critic, and women’s rights activist.