সত্য কী? আমরা সত্য শব্দটির মাধ্যমে ঠিক কী বুঝি? অতিবুদ্ধিমান কেউ ‘মিথ্যার বিপরীত বিষয় বা ঘটনা হল সত্য’ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। কিন্তু এতে স্পষ্টভাবে কিছু বোঝা গেল কী? উল্টো সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে সত্যকে বোঝার প্রচেষ্টা অধিক জটিল হয়ে পড়ল।তাছাড়া বর্তমানে আমরা শুনছি ‘Validity of truth expires on’- এর মতো বাক্য। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময় পরে সত্যের গুণগতপরিবর্তন ঘটে। আমরা আরো জানছি, শুনছি—সত্য একটি ‘সাধারণীকৃত’ শব্দ। একে অন্তত তিনটি অংশের সমষ্টি বলে ধরে নেওয়া যায়।যথা : যৌক্তিক সত্য, অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য এবং যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সম্মিলনে সমন্বিত সত্য। বিষয়টি কি অনেকটা সেই বিখ্যাত দার্শনিকবাক্যের মতো হয়ে গেল—‘আমরা বহুকে জানি কিন্তু দেখি না। এক-কে দেখি কিন্তু জানি না’। সত্যের প্রকৃতি এবং মানদণ্ড কী? এ সম্পর্কেমানবচিন্তার ইতিহাস-ই বা কী বলে?
সঙ্গতিবাদ মোতাবেক একটি উক্তি তখনই সত্য যখন তা ইতোমধ্যে সত্য বলে গৃহীত অন্যান্য উক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এই মতবাদের একটিবড় অসম্পূর্ণতা হল—ইতোমধ্যে সত্য বলে গৃহীত উক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মিথ্যা উক্তিকে সংযুক্ত করে এমন বক্তব্য তৈরী করা সম্ভব যাঅর্ধসত্য। তাই সত্যের স্বরূপ নির্ধারণে শুধুমাত্র সঙ্গতির ওপর ভরসা করা চলে না।
প্রয়োগবাদ অনুসারে যা আমাদের জন্য সাফল্য নিয়ে আসতে পারবে, আমাদের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে এবং যাসন্তোষজনক বলে প্রমাণিত হবে তা-ই সত্য। অর্থাৎ আমাদের জন্য যা প্রয়োজনীয় তা-ই সত্য। জন ডিউ’র (John Dewey) মতে ‘যে প্রকল্পকার্যকরী হয় তাই সত্য’। কিন্তু আমাদের বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা বলে ‘এমন অনেক সত্য থাকতে পারে যা সন্তোষজনক নয় কিংবা সাফল্য বয়েআনে না। পক্ষান্তরে এমন মিথ্যা থাকতে পারে যা সাফল্য নিয়ে আসে। সেই অর্থে তা সন্তোষজনকও বটে’। তাই প্রয়োগবাদী মত গ্রহণ করলেসত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করা যায় না।
অনুরূপতাবাদের মতে যা বাস্তবের অনুরূপ তাই সত্য। আমরা কোনো বিশ্বাস, উক্তি (Statement), বাক্য কিংবা যুক্তি-বাক্যকে সত্য বলেদাবি করতে পারি; কিন্তু যাকেই সত্য বলে দাবি করি না কেন তাকে সত্য হতে হলে হতে হবে বাস্তবের অনুরূপ। কিন্তু ‘বিশ্বাস’ নিজেই একটিমনস্তাত্ত্বিক (Psychological) বিষয় যা সত্যের স্বরূপ সংক্রান্ত আলোচনায় প্রতিবন্ধকতা রূপে আবির্ভূত হতে পারে। তাছাড়া বাক্য বাযুক্তিবাক্য নিজে যা ধারণ করে তাকে সত্য বা মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করা যায় না; বরং এদের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কতগুলো যুক্তি উপস্থাপন করাযায় মাত্র। এই মতবাদের সবচাইতে বড় প্যারাডক্স হল বাস্তব বলতে আমরা ঠিক কী বুঝব? কোনো দার্শনিক মতে কার্যকারণ সম্পর্ক মনেরব্যাপার, বস্তুগত নয়। আবার অন্য মতে কার্যকারণ বস্তুতেই নিহিত, চৈতন্য সেই কার্যকারণকে বোঝার চেষ্টা করে মাত্র। সাম্প্রতিক বিজ্ঞানেরআবিষ্কার হল নির্দিষ্ট তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যরে অভিঘাতে আমাদের দর্শন-অনুভূতিতে রং-এর উদ্ভব ঘটে। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল : ‘জগৎ রং-নিরপেক্ষ’। বুঝুন অবস্থা! তাহলে, বাস্তবের বাস্তব স্বরূপটা (!) কেমন?
এর বাইরেও কয়েকজন দার্শনিকের সত্য সম্পর্কে ব্যক্তিগত মত রয়েছে। যেমন : টার্স্কির মতে কোনো উক্তি তখনই সত্য হবে, যদি এবংকেবলমাত্র যদি (If and only If) এই উক্তিটি ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। (অ্যারিস্টটলের যুক্তির If, Then সম্পর্কের কথা স্মর্তব্য)।যেমন : ‘কাক কালো’ উক্তিটি সত্য হবে যদি এবং কেবলমাত্র যদি কাক কালো হয়। এখানে উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে যা প্রকাশিত হচ্ছে তা হলউক্তিটির নাম। এই নাম দিয়েই আমরা ঘটনাকে বুঝি। টার্স্কির এই মত থেকে আমরা সত্যের সংজ্ঞা জানতে পারি বটে, কিন্তু এই সংজ্ঞারবাইরের কিছু জানতে পারি না। যেমন : ‘কালো’ আসলে কী?
স্পিনোজার মতে যা কালিক, ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের সঙ্গে যার সম্পর্ক, তা কখনও সত্য হতে পারে না। যা ত্রৈকালিক, যা শাশ্বত, তাই সত্য, তার সত্তা অনস্বীকার্য। কিন্তু স্পিনোজার এই সংজ্ঞা মাত্রাতিরিক্ত বুদ্ধিবাদী। যুক্তির ‘সত্য’ সবসময় বাস্তবের সত্য নাও হতে পারে। তাছাড়া‘সত্য’ যদি কালনিরপেক্ষ হয় তাহলে জগতে এর অবস্থান তাত্ত্বিকভাবেই অসম্ভব। কারণ দার্শনিক মতে দেশ (Space) ও কালের (Time)সমন্বয়েই জগৎ গঠিত। তাছাড়া আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে : ভাষার বাঁধাধরা কোনো অর্থ নেই। ভাষা বিষয় বা ঘটনাকে উপস্থাপন করেমাত্র।
বিংশ শতাব্দীর দার্শনিক ভিটগেনস্টাইনের মতে—সত্য যাই হোক না কেন, তাকে প্রকাশ করতে গেলে ভাষাটি যেভাবেই নির্মিত হোক, বাক্যটিরকাঠামো এবং সত্যের মাঝে অবশ্যই সাধারণ (Common) কিছু থাকতে হবে। অর্থাৎ এই দার্শনিক সত্যের অলোচনায় সত্য প্রকাশেরউপায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বিষয়টি অনেকটা ‘গরু গোসল করাতে গিয়ে নদীর বর্ণনার মতো নয় কি’?
‘সত্য’ সম্পর্কিত উপরের আলোচনায় সত্যের মানদণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সত্য কী বা সত্যের অর্থ কী তা কি প্রকাশিত হয়েছে? সত্যেরস্বরূপ বা অর্থ বা সংজ্ঞা বিভিন্ন হতে পারে না। কারণ তাহলে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য অর্থহীন বলে প্রতিপন্ন হবে। সত্যকে সনাক্ত করার মানদণ্ডবিভিন্ন হলেও সত্যের সংজ্ঞা বা অর্থ একটাই। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে চাকরিতে নিয়োগের কথা। চাকরিতে যোগ্যতম প্রার্থীর নিয়োগের অর্থমাত্র একটাই : যোগ্যতম প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু যোগ্যতম প্রার্থীকে সনাক্ত করার মানদণ্ড বিভিন্ন হতে পারে।