“একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসবো না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।“
এই কবিতার জন্য যখনই কোন মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে দাঁড়াই শুধু মনে হয় লোকটা কি এবার কমলালেবু হয়ে যাবে? অনেকেই পৃথিবীর রাত-নক্ষত্র ছেড়ে গেছেন, বিছানার কিনার থেকে পড়ে গেছেন কিন্তু কোন চেহারাই যেন হিম কমলালেবুর দিকে তাকিয়ে আমি বোধ করিনি ফিরেছেন। সাড়ে পঁয়ষট্টি বছর উধাও হয়েও আমি একজনকেই ভেবে, বোধে দেখেছি ফিরেছেন বহুবার। ট্রাম উনার দিকে এগিয়ে আসছে নাকি উনিই গেলেন! রক্তে সিঞ্জিত হয়ে পড়ে রইলেন হাসপাতালের লোহার স্ট্রেচারে “প্রহেলিকাময় কবি”। অক্টোবরে তো শীত পড়েই। সকল বিশুদ্ধ ব্যর্থতা, গ্লানি , অপমান, বিরল বিষন্নতা ফেলে রেখে, বোধহয় দাশখত ছিঁড়ে গেছেন । আলো অন্ধকারে ইতস্তত ঘুরেছেন, থেকেছেন। গাঙ্গুড়ের উপরে সোনালি চিলের সাথে চলে গেছেন বাংলার নীলাভ আকাশে।জীবনানন্দ দাশ চলে গেছেন। তার লেখার মতন যেন গেলেন –
“যতদূর যেতে চাই, এই পটভূমি ছেড়ে দিয়ে –
চিহ্নিত সাগর ছেড়ে অন্য এক সমুদ্রের পানে।“
তাই বুঝি এই উপন্যাসের নাম “একজন কমলালেবু” নাড়া দিয়েছে মনে! শাহাদুজ্জামান সাহেবের লেখা আমি আগে পড়িনি, এই প্রথম। তা’ও জীবনানন্দ দাশের জীবন! পড়তে পড়তে এমন নির্লিপ্ত বোধ হলো বাকি সংসারে যে শুধু এই বইটাই দরকার হলো, আমার। আর কিছু না। আমারও কলকাতাকে মর্গ বোধ হলো। বরিশালের সর্বানন্দ ভবন ছেড়ে কলকাতার ল্যান্সডাউনের ১৮৩ নম্বর বাড়িতে কবির কী হৃদয় কখনো জুড়াল? তার বিষন্নতা টের পাওয়া যায়। এই এখন চাকরি আছে তো কখন যে নেই! সংসারে আনাড়ির উপর নিষ্পেশন আসে। তখন মহাপৃথিবীর তলাতলে নেমে পড়ে বিপর্যস্ত কবির হৃদয়। কোন গভীর শান্তির স্থিতির কিংবা বোধের নিবিড় সান্ত্বনা পেতে। তার কাছে নক্ষত্রের উজ্জ্বল পৃথিবী ধরা দেয়নি, বরং নক্ষত্র ঝরে পড়েছে। থ্যাঁতা ইঁদুরের মড়কের মতো লেগেছে। তাই হয়ত ইচ্ছে হলো কবির বিকেলের শিশুসূর্যের আলো আঁচ যেমন পড়িয়াছে মায়ের কোলে, সুপোরি বনে, পিপুলের ভরা বুকে, মরালির পাখা মালাবার পারাবারের কোলে তেমনি চেয়েছেন হৃদয়ে স্থীর। বিকেলের নরম তুলতুলে মুহূর্ত নামিছে যেমন।
এইসব গভীর অনুভব, বোধ, প্রেম, সংসারের খাদ সব সব তাঁর ট্রাংকে রেখেছেন কবি। আমি এই আনাড়ি কবির সাথে চলি পাতার পর পাতা। উপন্যাসটির ধাঁতটি এমন যে সেও চলে আমার সাথে, আমিও চলি তার সাথে। নিরবচ্ছিন্ন করে রেখেছিল কদিন! চাচাতো কী মামাতো বোন শোভনার প্রতি প্রেম ও ব্যর্থতা, অপরদিকে লাবণ্যের সাথে দাম্পত্য ও দূরত্ব কবিকে আরও ভেতরে ভেতরে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করে। একা থেকে একাচ্ছন্ন হচ্ছিলেন কবি। আছে স্বাক্ষী, তাঁর সাংকেতিক দিনলিপি, কবিতা, উপন্যাস, চিঠি।
যখন হাসপাতালে পড়ে রইলেন কবি, লাবণ্য যেন দায়সারা ও অনাগ্রহে এলেন একদিন মাত্র। লাবণ্যেরও জিজ্ঞাসা এই লোক কী অমৃত শান্তি একতিল দিয়েছে তাঁকে? এই হাসপাতালে মুমূর্ষুর মত পড়ে সংসারটার কী উপকার হলো? লাবণ্যও নির্বিকার। ভাব নিঃশেষ নির্বিকার দম্পতি হাসপাতালে মুখোমুখি; চুপ।
উপন্যাসের দুটো হৃদয়ংকর ঘটনা খুব দুলিয়ে দিল। উপন্যাসের শেষ পাতা দুটোর গম্ভীর বিষন্নতা ছাপিয়ে চোখ আর্দ্র হলো। কখনো শুনিনি বাংলাদেশে কোন নার্স অজ্ঞাত প্রায় কোন কবি পরিচয় শুনে কাউকে সম্ভ্রমে দেখিয়েছেন। কলকাতায় সম্ভব হয়েছে। ঐ সময়ে। সেদিন ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর। শম্ভূনাথ পন্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করা হলো কবিকে। এই প্যাশেন্টের নার্সিং করছেন নার্স শান্তি মুখার্জি । প্যাশেন্ট একজন কবি শুনেছেন । প্যাশেন্টের সঙ্গী ভূমেন্দ্র গুহ, সঞ্জয়, জগদিন্দ্র, দিলিপ এরা নিজেদের চাঙ্গা রাখার জন্য কিনে আনলেন “বনলতা সেন” এবং হাসপাতালে কবির সেবারত সবাইকে এক কপি দিলেন। শান্তি মুখার্জিকেও দিলেন। শান্তি মুখার্জি কবিতার বইটি পড়লেন ইতোমধ্যে। সম্ভবত তারপরদিন “সারা রাত ডিউটি শেষ করে সকালে নার্সের পোশাক বদলে একটি ছাপা শাড়ি , কপালে টিপ দিয়ে খুব ভোরে শান্তি মুখার্জি এসে হাজির হলেন ভূমেন্দ্রদের ময়ূখ-এর আস্তানায়। অপ্রস্তুত সেই যুবকদের সামনে গিয়ে ভীষণ সংকোচে বলতে লাগলেন, “ এত বড় একজন লোকের জীবন-মরণ সংকটে নার্সিং করার সুযোগ পেয়েছি, একজন নার্স এর চেয়ে বেশি আর কী কামনা করতে পারে? আপনারা আমাকে বইটা দিলেন বলেই না জানতে পেলাম। কবিতাগুলো পড়েছি, ভালো করে তো সব বুঝতে পারি না কিন্তু তবু টানে তো………’ হতভম্ব হয়ে থাকেন ময়ূখ-এর সকলে।“ প্রকৃতি মানুষকে মুগ্ধ করে দেবার ও নেবার ক্ষমতা দিয়েছে । জগতের লীলাকে সে মুগ্ধ করে রেখেছে। অত্যন্ত মুগ্ধ। অত্যন্ত মুগ্ধ মানুষ আনন্দের মধ্যে থাকেন। গভীর বেদনার উপর এইরকম আনন্দ জন্ম লয়।
পরেরটিতে আরও বিষ্ময়ে ফেলেছেন জীবনান্দের লেখার ঘোর সমালোচক – সজনী কান্ত।
কবির বুকের পাঁজড় ভেঙ্গে গেছে। ইমার্জেন্সির এক লোহার স্ট্রেচারে পড়ে রয়েছেন। যখন হাসপাতালে কোন সিট পাওয়া যাচ্ছিল না তখন উপায় না পেয়ে উপস্থিত সঙ্গিরা কবির আজীবনের শত্রু সজনী কান্তের দ্বারস্থ হলেন। সজনী কান্ত ক্ষমতাবান মানুষ। “সবাইক বিষ্মিত করে সজনীকান্ত মুখ্যমন্ত্রী ডা, বিধানচন্দ্রকে নিয়ে হাজির হলেন হাসপাতালে। “ উন্নত চিকিৎসা ও ক্যাবিনে নেয়ার নির্দেশ দিলেন ডা, বিধানচন্দ্র। “সঞ্জয় কৃতজ্ঞতা জানাতে গেলে সজনীকান্ত এবার সবাইকে বিমূঢ় করে বললেন, ‘ আমি কি জানতাম না যে জীবনান্দ বাবু কত বড় কবি, কত বড় মানুষ। নইলে তার কবিতা নিয়েই এত কথা বলার তো দরকার হতো না আমার।“ ভাবছিলাম, মানুষের আশ্চর্য করবার অদ্ভুত ক্ষমতা লয় হয় না! অথচ এই লোকই বুদ্ধদেব বসুর প্রগতিতে কবির যেই কবিতা ছাপা হতো তা নিয়ে শনিবারের চিঠিতে পুঁচিয়ে পুঁচিয়ে সমালোচনা বিদ্রুপ লিখতেন যা কাঁটার মত বিঁধতো জীবনানন্দ দাশকে। এটি দুঃসহ ছিল কবির জন্য।
লেখার উপেক্ষার চেয়ে ট্রাংকে রাখাই ভালো। তাই “ঝরা পালক” ১৯২৭ এ প্রকাশের পর বই বের করেন নি অনেকদিন। তারপর ১৯৪৪ এ মহাপৃথিবী বেরোল। দুটো বইয়ের জন্যই রবীন্দ্রনাথের বিশদ সমালোচনার আকাঙ্খা নিয়ে দীর্ঘ স্তুতিভার চিঠি লিখেছিলেন। হায়! গুরুদেব কবিতার এই নুতন পরিমন্ডলকে শব্দের জবরদস্তি বলেই চিনলেন, নুতন ধারা নয়। তাই কি জীবনানন্দ দাশ তার কোন বই গুরুদেবকে কখনো উৎসর্গ করেন নি? কবিতার এই নুতন প্রণালিকে, হ্রদকে যারা চিনলেন না, কবির চিন্তার ধার দিয়েও গেলেন না। তাই নিজেই কবিতা কী তা নিয়ে লিখলেন একান্ত ভাবনা – “কবিতার কথা”। লিখলেন বিখ্যাত প্রথম লাইন – “সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।“
তাঁর লেখা কবিতা কি সবটা বুঝেছি? নাহ। কিন্তু তবুও পড়ি! কেন? ঐ “ সব বুঝতে পারি না কিন্তু তবু টানে তো”। আরও আছে। “ আমাদের হাড়ে এক নিধূম আনন্দ আছে জেনে” ও পড়ি।
কবিও ম্যাসে থাকতেন, আমিও থেকেছি পাঁচ বছর। তাই আমরা ম্যাসতুতো বলা যায়। ঐ ২০০৪ সালে, রেখা বেকারির উনুনের উপরের গনগনে ম্যাসের বারান্দায় বসে অহরহ খুলতাম খয়েরি লাল শ্রেষ্ঠ কবিতা –র বইটি। কত কত অবিরাম পড়েছি – কুড়ি বছর পরে, ঘাস, যতদিন পৃথিবীতে, বনলতা সেন, তোমাকে, যাত্রী, ভিখিরি, স্বপ্নের ধ্বনিরা, নদী, ক্যাম্পে, লোকেন বোসের জার্নাল, সুরঞ্জনা। তবে কমলালেবু আত্মস্থ করেছিলাম। আহিড়িটোলার ভিখিরিকে মনে না ধরলেও আহিড়িটোলা নামটা টানতো বেশি। আরও আরও নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল – কোথাও দেখিনি আহা, বুনো হাঁস, পিপাসার গান আরও আছে, সব মনে আসছেনা এখন। একটা কবিতার এক চরণ এমন ছিল– “আতার ক্ষীরে-গড়া মূর্তীর মতো স্থির”। আতা দিয়ে ক্ষীর হয় নাকি?! তারপর মূর্তী?! এইরকম শব্দের চিত্র আমাকে আকৃষ্ট করতো । তারপর “তোমাকে” –র ঐ একটা লাইন খুব স্নিগ্ধ লাগতো – তোমার মুখের থেকে বিভা চেয়ে আছে চলে যায় জলের প্রতিভা। কোন এক নারীর উজ্জ্বল মুখ আবছা হয়ে উঠতো, মনে হতো সকালের রোদ্দুর ঐ নারীর মুখ থেকে বিভা নিয়ে জলের উপর ঝিলমিল করছে। বাড়ির পুকুরে ভোরবেলা সেই বিভা দেখতাম। চেনা অচেনা মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে এই বিভাটা আসে কিনা দেখতাম, কিন্তু কারও মধ্যেই এই বিভা পাই নি। আমার এইরকম বিচিত্র কল্পনায় টেনে নেয়া জীবনানন্দকে জানার ইচ্ছে হতো খুব। কিন্তু সেরকম কোন মনের সাথে সাথে চলা কোন লেখা ছিল না।
এই উপন্যাসে সেই মানুষটার সাথেই যেন আমি চলছিলাম। এই উপন্যাসের মতো এতটা জীবন্ত সংসারযাত্রীর গতিময়তা বোধ হয়নি আর কোথাও। মলাট, উৎসর্গ পৃষ্ঠার পর সপ্তম পাতার ট্রামের দূর্ঘটনা দিয়ে শুরু। তারপর ম্যাসের জীবন, দিল্লির জীবন, লাবন্যের সাথে বিয়ে, বেকারত্বের টানাপোড়েন, বেবির স্মৃতিতে মূহ্যমান সংকেতিক দিনলিপি, চাকরি চলে যাওয়া, প্রেসের কাজের চাপাচাপি টার্গেটের নাভিশ্বাস ফুরিয়ে যেন জেগে উঠতো বরিশালের সর্বানন্দ ভবন আমার কল্পনার এক রোমন্থন করা বাড়ি, ভূমেন্দ্রর সাথে পথে পথে হেঁটে বেড়ানো, গাঢ় বেদনা-আশা-সাধ-রুচির অসমন্বয় জীবনের উপর লিখে যাওয়া কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ নিয়ে কবির সাথে আমার ট্রাংকে থাকা থেকে পুনশ্চ শম্ভূনাথ হাসপাতালের স্ট্রেচারে ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় সবই সপ্রাণ পেয়ে আছে পাতায় পাতায়। এই ব্যক্তিময় জীবনের আমি পরোক্ষলোকের দর্শক, সাথে সাথে থেকেছি। পাঠক আর বলবো না। রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে কবি মারা গেলেন। ময়ূখের সঞ্জয় মাদুরে বসে লিখলেন, “ একটি জাহাজ ছেড়ে গেল………”। তবুও বই অবন্ধ। আমার মনে হলো জলঢুপের অজস্র কমলালেবু উড়ে যাচ্ছে আকাশে। জ্যোৎস্নার মাতাল আকাশ ভরে আছে অজস্র কমলালেবু। তার একটিও কোন মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে ফিরে আসেনি। দেখিনি।
Mahbubul Alam Chowdhury dives into literature, despite being a busy banker in Dhaka. His insights have been inspired by the poet T.S. Eliot, Jibananda Das, & Tagore. He explores how intelligence and emotion drives perception. He sees there is no pure logic. Survival governs life.