অনুবাদকের ভুমিকা: একবিংশ শতাব্দীতে উগ্র জাতীয়তাবাদ, পুরুষতন্ত্র, গণতন্ত্র, জলবায়ু পরিবর্তন, লিঙ্গ বৈষম্য ইত্যাদি বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর যে প্রান্তেই আপনি বসবাস করেন না কেন আপনি এসব সমস্যার সম্মুখীন হতে বাধ্য। কারণ, আজকের পৃথিবীতে স্থান,কাল, পাত্র ভেদে এগুলো বৈশ্বিক প্রবণতা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আল-জাজিরাকে দেয়া এলিফ শাফাকের এই সাক্ষাৎকারটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি আরব বিশ্বের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেও পৃথিবীর সব প্রান্তে এই চিত্র কমবেশি একই রকম। অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার পাঠকদের জন্য এসব বিষয় নতুন কিছু নয়। এলিফ শাফাক এই সাক্ষাৎকারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে এনেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন আমাদের রাজনীতি, পুরুষতন্ত্র, লিঙ্গ বৈষম্য ও সহিংসতা কীভাবে একই সূত্রে গাঁথা। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও বিছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। শাফাকের এই সাক্ষাৎকারে শুধু যে পরিস্থিতির ভয়াবহতা উঠে এসেছে বিষয়টি এমন নয়, তিনি এই সমস্যার মূল উদঘাটন করতে চেয়েছেন। তার ভাষ্যমতে এই সমস্যার মূলে রয়েছে ইতিহাসের সরলরৈখিক চিত্র। আমাদেরকে বাস্তবতার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ করতে হবে। বর্তমান সময় ইতিহাসের পুনর্বিবেচনা ও পুনর্নির্মাণের দাবি রাখে। নিপীড়িত মানুষের গল্পগুলো শুনতে হবে। আমাদেরকে এমন একটি গল্প রচনা করতে হবে যে গল্প সবার কথা বলে, যে গল্প মোহময় সরলরৈখিক বাস্তবতার উর্দ্ধে উঠে প্রতিটি নিপীড়িত কন্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করে।
অনুবাদক: শুভম ঘোষ
এলিফ শাফাক, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী সর্বাধিক পঠিত তুর্কি নারী লেখক। তিনি আরব বিশ্বে নারীদের অবস্থান, পপুলিজম ও নারী অধিকার নিয়ে আল-জাজিরার সঙ্গে কথা বলেছেন। তার নতুন বই ‘This Island of Missing Trees’ এ বছরের শেষ দিকে প্রকাশিত হবে।
আল-জাজিরাঃ মহামারীর সময়ে পৃথিবীব্যাপি বহুমানুষের নিজ মাতৃভূমে ফিরে যাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা তা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এই সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষা আপনি কীভাবে দেখেন।
এলিফ শাফাকঃ এই ভাবনাটি আমাকে ভীষণভাবে অনুরণিত করে। একাধিক মাতৃভূমির বোধ থাকা খুবই সম্ভব। বহুক্ষেত্রে আমি তুরস্ক, তুরস্কের মানুষ, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, সঙ্গীত এবং তুর্কি মুল্লুকের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতি মানসিকভাবে এক ধরনের বন্ধন অনুভব করি। আমি এই সবকিছুর অভাব বোধ করি। অপরপক্ষে, যখন আমি তুরস্কের রাজনীতির দিকে দৃষ্টি ফেরাই তখন আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। ভালো-মন্দের সব বোধ একত্রিত হয়েই ‘মাতৃভূমি’র ধারণা আমাদের সামনে আর্বিভূত হয় এবং আমাদের উচিত এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়পক্ষ নিয়ে কথা বলা।
পপুলিস্টরা বলে, যদি আপনি আপনার মাতৃভূমির সমালোচনা করেন তবে এর অর্থ হচ্ছে নিজ মাতৃভূমির প্রতি আপনার ভালোবাসা নাই। কিন্তু এই বিষয়টি মোটেও এরকম নয়। আপনি দ্ব্যর্থহীনভাবে মাতৃভূমির সমালোচনা করতে পারেন কারণ আপনি দেশকে ভালোবাসেন, দেশের কথা চিন্তা করেন এবং আপনি আপনার দেশের জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যত চান।
আল-জাজিরাঃ জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদরা কি ‘মাতৃভূমি’র ধারণাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে না? নিজ বাসভূমের প্রতি মানুষের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা কি সে সুযোগের অপব্যবহার করছে?
এলিফ শাফাকঃ যখন আন্তর্জাতিক ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ঠিক তখনই জাতীয়তাবাদ, ট্রিভিয়ালিজম এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের যে উত্থান আমরা দেখছি তা খুবই অদ্ভুত এবং হতাশাজনক। এই সময়টা এমন এক সময় যখন অনেকগুলো বৈশ্বিক বিপর্যর আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে- হতে পারে আরেকটা মহামারী অবিসম্ভাবী হয়ে উঠছে বা সাইবার অপরাধ প্রকট আকার ধারণ করছে অথবা ভয়াবহ জলবায়ু বিপর্যয়ের কবলে পড়তে যাচ্ছি আমরা। যখন আমরা আমাদের গ্রহ নিয়ে কথা বলছি, যা আমাদের একমাত্র বাসস্থান ঠিক তখনই সে পুড়ছে। এর সবকিছুই এটা নির্দেশ করে যে আমরা একে অপরের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, আপনি এটা পছন্দ করেন বা না করেন।
তাই, অন্যের সমস্যাগুলো আর নিজের মাঝখানে দেয়াল তুলে দিয়ে আপনি যদি ভাবেন নিজেকে সকল সমস্যা থেকে আলাদা করে ফেলেছেন তবে আপনার এই ভাবনা নিন্তাতই মরীচিকা ছাড়া আর কিছু নয়। আমার মনে হয় আন্তর্জাতিক ঐক্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আমরা ঠিক এর বিপরীত চিত্রটা দেখতে পাচ্ছিঃ এই যেমন জাতীয়তাবাদের বিষয়টিই লক্ষ্য করুন এবং এসব বাদ(ইজম) সাধারণত তথাকথিত উগ্র ক্ষমতাসীনদের দ্বারাই প্রচারিত হয়ে থাকে। এটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে উগ্র পুরুষতান্ত্রিকতা ও পপুলিস্ট জাতীয়তাবাদ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
আমরা এমন একটি সময়ে বাস করি যখন আবেগ রাজনীতিকে ব্যবহার ও অপব্যবহার করে। আবার রাজনীতিও গণমানুষের আবেগকে সঠিক এবং ভুল পথে পরিচালিত করে। আমার মনে হয় গণমানুষের আবেগ, অনুভূতি এগুলো নিয়ে কথা বলা উচিত কারণ এটি এমন একটি বিষয় যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বরাবরের মতই অবমূল্যায়িত। আপনি যদি আজকের রাজনীতি বুঝতে চান তবে মানুষের উদ্বেগ, ভয়, রাগ, তিক্ততা- এসব বোধগুলো বিবেচনায় নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্ভাগ্যবশত দেখা যাচ্ছে, পপুলিস্ট ধারার নেতারা মানুষের আবেগের শক্তিকে তাদের বিরোধী গণতান্ত্রিক ধারার নেতাদের চেয়ে ভালো বুঝতে পারেন। এটা আমাদের সময়ের আরেকটা প্যারাডক্স। মানুষ কেনো উদ্বিগ্ন বা ভীত বা রাগান্বিত হয় তা আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। এসব সমস্যার এক ধরনের চাতুর্যপূর্ণ সমাধান হচ্ছে পপুলিজম। এটি একটি মিথ্যা বা ভ্রান্ত ধারণা যে পপুলিজম আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করবে। পপুলিজম সবকিছুকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়।
আল-জাজিরাঃ প্রচলিত বাঁধাধরা মনস্তত্ত্বকে ভাঙতে এবং সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক একটি গল্প বলার জন্য আপনার প্রচেষ্টার পরিধি কতটুকু?
এলিফ শাফাকঃ গল্পের সাথে যে দ্বৈততা ও গতানুগতিকতাগুলো (Cliche) আসে সেগুলোকে আমি প্রচুর পরিমাণে প্রশ্নবানে জর্জরিত করি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্যের যে প্রচলিত ধারণা আছে সেটাকে আমি প্রশ্ন করি। *শৈশব থেকেই পূর্ব-পশ্চিম জুড়ে আমার যাতায়াত ছিলো। আমি সবসময়ই প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সম্পর্কিত সরলরৈখিক ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করে এসেছি। আমি সবকিছুকে নীরিক্ষা করে দেখতে চাই এবং সর্বোপরি পুরুষতান্ত্রিকতার যে ভূত পুরো বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেটার মুখোশ উন্মোচন করতে চাই। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদেরকে এমন পরিস্থিতির সামনাসামনি হতে হয়।
আমি সবসময়ই না-বলা গল্পগুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করি- সেসব মানুষের গল্প যাদেরকে বৃত্তের পরিধির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। যারা বাকরুদ্ধ আমি তাদেরকে আরেকটু কন্ঠস্বর দিতে চাই এবং আমি দুর্বলের ক্ষমতায়ন চাই। আমি এও জানি যে বিশ্বজুড়ে উদার মনের অসংখ্য মানুষ আছেন যাদেরকে বিশ্বের বিবেক বলা যেতে পারে।
যখন গণতন্ত্র বিপন্ন হয়, রাজনীতিতে সর্বস্তরের অন্তর্ভুক্তি বাঁধাপ্রাপ্ত হয়, যখন বৈষম্যের মাত্রা বাড়তে থাকে তখন দুঃখ কষ্টের পরিমাণও বাড়তে থাকে। যখন জনগণকে সমতা, বৈষম্যহীনতার বার্তা দেয়া হয় না তখন জালে আটকে পড়ার দমবন্ধকর অনুভূতি মানুষের মধ্যে তীব্র হয়ে উঠে। অসুখী মনোভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। অবশ্য, মানসিক সমস্যা নিয়ে আমরা খুব একটা কথা বলি না।
আল-জাজিরাঃ পপুলিস্ট রাজনীতির প্রতি মানুষের আর্কষণের পেছনে নস্টালজিয়ার (স্মৃতিকাতরতা) প্রভাব কতটুকু বলে আপনি মনে করেন।
এলিফ শাফাকঃ পপুলিস্ট রাজনীতিতে নস্টালজিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এই ধারার রাজনৈতিক ভাষা এমন একটি ধারণার সাথে যুক্ত যে ধারণা অনুযায়ী অতীতের কোনো এক কালে আমাদের স্বর্ণযুগ ছিলো এবং সে সময়ে ফিরে যাওয়াই আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হওয়া উচিত। এটাও একটা মিথ্যা আশ্বাস। ঐ নির্দিষ্ট স্বর্ণযুগ বলতে আদতে কিছু ছিলোই না। এটা নির্ভর করে কে এই ঐতিহাসিক গল্পটি নির্মাণ করছে তার উপর।
দুর্ভাগ্যবশত আমেরিকা, ভারত, হাঙ্গেরি, তুরস্ক সহ পুরো বিশ্বজুড়ে পপুলিস্ট রাজনীতিবিদরা এই ধারণাকে পুঁজি করে রাজনীতি করেন। এই ধারণা কখনও কখনও নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী স্মৃতিকাতরতা (imperial nostalgia) হিসেবে প্রকাশ করে- যেনো অতীতের কোনো একটি সাম্রাজ্যকে ফিরে পাওয়াই আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য, যে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব জাতিরাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের আগেই ছিলো।
কিন্তু আপনি যদি অটোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে একজন কুর্দিশ কৃষকের গল্পের খোঁজ করেন অথবা একজন আরব কৃষকের গল্প বা একজন ইহুদি, একজন আমেরিকান, একজন গ্রীক কারিগর, বলকানের কোনো শ্রমিক বা রাজকীয় কোনো হারেমের রক্ষিতার জীবন কেমন ছিলো তা জানতে চান তবে আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গল্প পাবেন, বস্তুত যে গল্পের সাথে আমাদের স্কুলের ইতিহাস পাঠ্যবইয়ের গল্পের কোনো মিল নেই। কোনো নারী যদি অটোমান সাম্রাজ্যের গল্প বলতেন তবে তা কখনোই বতর্মানে প্রচলিত গল্পের মত হতো না। যদি সংখ্যালঘুরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বিনিময় করার সুযোগ পেতেন তাহলেও সেটা একটা ভিন্ন গল্প হতো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের গল্পগুলো অশ্রুত থেকে যায়, আবার কখনো কখনো এগুলো মুছে ফেলা হয়। তাই তুর্কির ইতিহাস আপাতদৃষ্টিতে সমৃদ্ধ হলেও দেশটির ইতিহাস সামগ্রিকভাবে বিস্মৃত।
আল-জাজিরাঃ ইতিহাসের এই ভুল উপস্থাপন বা ম্যানিপুলেশনের বিরুদ্ধে একজন ব্যক্তি কী করতে পারে?
এলিফ শাফাকঃ আমাদের প্রয়োজন বই, জ্ঞান, ভিন্নভাবে চিন্তা করার সংস্কৃতি, সহমর্মিতা ও সাহিত্য। গল্প বলার যে শিল্প, সে শিল্পের স্মৃতিশক্তি আমাদের দৈনন্দিন রাজনীতির তৈরি করা ভ্রান্ত নস্টালজিয়ার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আপনি যদি এমন এক জায়গায় বসবাস করেন যেখানকার বইপত্রে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করা যায় না সেখানে একটি নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক আখ্যানকে খুব সহজেই সবকিছুর উর্দ্ধে প্রতিষ্ঠা করা যায়। সর্বোপরি সবগুলো রাষ্ট্রেরই তাদের নিজের ইতিহাস সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক আখ্যান আছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আমি তেমন কোনো পার্থক্য দেখি না।
কিন্তু যে দেশগুলোতে তুলনামূলক ভালো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে এবং যে দেশগুলোতে গণতন্ত্র নেই বললেই চলে তাদের মধ্যে একটি মৌলিক তফাৎ আছে। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে আপনি সহজেই একটি বইয়ের দোকানে গিয়ে এমন একটি বই কিনতে পারেন যে বই ঐ প্রাতিষ্ঠানিক আখ্যানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সামর্থ্য রাখে। এখানে আপনি অনায়াসে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো পড়তে পারবেন এবং ভিন্নমতের কন্ঠস্বর ও বহুমাত্রিক গল্পগুলোর খোঁজ পাবেন। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্র নেই সেখানে সব ‘his-stories’ অথবা ‘her-stories’-কে চাপা দেয়া হয়, সেন্সর করা হয় এবং কৌশলে মুছে ফেলা হয়।
আল-জাজিরাঃ আপনার ভাষ্য অনুযায়ী আপনি ‘গল্প বলেন’, কিন্তু আপনার বলা কিছু গল্প রাজনৈতিকও বটে। আপনি কি এর থেকে বেরিয়ে এসে বলতে পারবেন যে ‘এটা শুধুমাত্রই একটা গল্প ছিলো’।
এলিফ শাফাকঃ একজন গল্পকথক হিসেবে অবশ্যই আমি গল্প ভালোবাসি, গল্পে বিশ্বাস রাখি, কিন্তু একইসাথে নীরবতার প্রতিও আমি সমানভাবে আকৃষ্ট। আমি বরাবরের মতই দুঃখ ও হিউমারের মাঝে জীবনের যে নৃত্য সেটি নিয়ে খুব আগ্রহী এবং আমি বিশ্বাস করি জীবনে এ দু’টোরই অস্তিত্ব আছে। বিশেষত আপনি যদি কোনো ভঙ্গুর গণতন্ত্রের কোনো দেশ থেকে আসেন যেখানকার ইতিহাস খুব জটিল তাহলে আপনি পাহাড়সম দুঃখ ও যন্ত্রণা দেখতে পাবেন। কিন্তু একইসাথে আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে এগুলো হিউমারেরও উপাদান।
আমি হিউমারকে সম্মান করি এবং আমি মনে করি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আমাদের সম্মিলিত স্বাস্থ্যের জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গি কখনো হারানো উচিত নয়। আমি হিউমার বলতে এমন কৌতুকের কথা বলছি না যা অন্যকে নিচু করে দেখায়। আমি সহানুভূতিশীল, বৈষম্যহীন হিউমার ভালোবাসি। আমি নিজেকে নিয়েও মজা করি। আমরা সবাই একই জীবনচক্রের অংশ। কিন্তু আমি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করি সেগুলো বেশ ভারী বিষয় এবং মাঝেমধ্যে এগুলো আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। মাঝেমাঝে এমন দিন আসে যেসব দিনে আমি লেখালেখি করি আর কাঁদতে থাকি। এটা কখনোই এমন না যে আমি আমার গল্পের অনুভূতিগুলোর প্রতি সহনশীলতা অর্জন করে ফেলেছি। সাহিত্যকে যে সবসময় আত্মজীবনীমূলক হতে হবে তা নয়, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি একটি গল্প ও গল্প-কথকের মধ্যে মানসিক যোগাযোগ থাকতে হবে।
আল-জাজিরাঃ ইস্তাম্বুল কনভেনশন থেকে সম্প্রতি তুরস্কের বের হয়ে আসাকে আপনি কীভাবে দেখেন? এই কনভেনশনটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এলিফ শাফাকঃ আমি মনে করি ইস্তাম্বুল কনভেনশন হচ্ছে সবচেয়ে প্রগতিশীল আঞ্চলিক কনভেনশন যার মাধ্যমে নারী ও শিশুকে নিরাপত্তা দেওয়া যায়। এটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। এই কনভেনশনে বিশ্বের পয়তাল্লিশটি দেশসহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও যুক্ত হয়েছে। তুরষ্ক এদের মধ্যে সর্বপ্রথম দেশ হিসেবে এই কনভেনশনে যুক্ত হয়েছিলো। আর এখন এই কনভেনশনকে সফল করার পরিবর্তে তুরস্ক এটা থেকে বেরিয়ে আসছে। এই কনভেনশন বাস্তুহীন নারীদের জন্য আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করে, অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেয় এবং এটি মানসিক সহায়তাও প্রদান করে। সহিংসতার সাথে জড়িত অপরাধীদের যেন জেল হয় এই কনভেনশন সেটা নিশ্চিত করে অথবা অপরাধের শিকার ব্যক্তির থেকে অপরাধীকে দূরে রাখে। এটি নারীদের জন্য আইনি ও পুলিশি সহায়তার ব্যবস্থা করে৷ এখানে অনেকগুলো ব্যাপার আছে যা আমাদের খুব প্রয়োজন। তাই এই কনভেনশন থেকে তুরস্কের বের হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি আসলেই বেশ ঝামেলাপূর্ণ। কিন্তু এসবকিছুর উর্দ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তুরস্ক এমন একটা সময়ে কনভেনশন থেকে বেরিয়ে আসছে যখন নারীদেরকে হত্যা করার(femicide) প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং লিঙ্গ কেন্দ্রিক সহিংসতা বেড়েই চলেছে। তাই তুরস্কের বেরিয়ে আসার ঘটনাটি সন্দেহাতীতভাবে বেশ সমস্যার সৃষ্টি করবে।
আল-জাজিরাঃ ২০০৯ সালের পর তুরস্কে আর কোনো ফ্যামিসাইড (Femicide)-এর ঘটনা রিপোর্ট করা হয় নি। এই হিসাব কে রক্ষণাবেক্ষণ করছে?
এলিফ শাফাকঃ হ্যাঁ, তুর্কি কর্তৃপক্ষ ২০০৯ সালের পর থেকে তথ্য প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে, তাই এ সম্পর্কে কোন সরকারি তথ্য নেই এবং এই নীরবতা খুবই ঝামেলাপূর্ণ৷ কিন্তু এখানে ‘We Will Stop Femicide Platform’- এর মত কিছু সংগঠন আছে যারা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে, তারা বেশ প্রতিকূলতার মধ্যেও বীরত্বের সাথে এ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করছে। এই কাজটি কখনোই সহজ নয়, কারণ এখানে অনেক খুনের ঘটনায় কোনো রিপোর্টই হয় না। এখানে আরও কিছু রহস্যজনক ঘটনা ঘটে যেগুলোকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আপনি যখন ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে যাবেন তখন দেখবেন ওটা আত্মহত্যা ছিলো না। তাই এখানে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রকৃত চিত্র ভয়াবহ।