কদম মোবারকের কাছে একদুপুর

Share this:

কদম মোবারকের কাছে একদুপুর

 

নারায়ণগঞ্জের নানাভাইয়া নবীগঞ্জ নিয়ে গেলেন পাথরে খোদানো নবীজির চরণ মোবারক কদমবুছি করাইতে। মাসুম কাবুলি নামের এক আফগান যোদ্ধা এটা কিনেছিলেন আরব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এই ভদ্রলোক ঈশা খাঁ’র সাথে মিলে আকবর বাদশাহর ফৌজের সাথে যুদ্ধ করে বাংলার একাংশকে কিছুদিন স্বাধীন রেখেছিলেন। শেষ রক্ষা করতে পারেন নাই যদিও।

নবীগঞ্জ ছিল পাটের শহর। গুদামের। বৃটিশ কোম্পানির কলোনিয়াল ছাপ এর অলিতে গলিতে। পুরানা আমলের চিকন চিকন রাস্তা। উইলসন রোডে নানার বাবার বাড়ি।

‘মাম তুমি বুঝতে পারছো না, এইটা ট্রায়াঙ্গুলার না, সার্কুলার। সম্পর্ক এরকমই হয়।’ প্রিণন ওর মাকে বলছে।

‘আচ্ছা এখানে কলাগাছিয়া কই?’

নানাভাই অবাক হন, ‘কলাগাইচ্ছা? তুমি এই নাম জানলা কেমনে ভাইয়া?

‘এইখানে ধলেশ্বরীর সাথে শীতলক্ষ্যা মিলেছে না? তারপর মেঘনার সাথে?’

প্রিণন হাতের ট্যাবে মাথা ঝুঁকাইয়া থাকে।

ওর চোখ গুগল ম্যাপে। কিন্তু নানাভাই ভাবছে এতকিছুর ভিত্রে এই বালক নদী খুঁজছে ক্যান?

নারায়ণগঞ্জ থেকে নবীগঞ্জ বড়জোর ৩০০ গজ নদীর এপাড়-ওপাড়। কিন্তু কোনো ব্রিজ নাই। খেয়া নৌকায় হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে। সড়কব্যবস্থার নিদারুণ হাস্যকর প্রহসন। পাটের জমানায় কলকাতার ব্যাংক থেকে মাস পয়লা বেতনের টাকা নিয়া সি-প্লেন নামত, আর নবীগঞ্জের ইংরেজ ক্যাশিয়ারই সেই টাকা রিসিভ করত। নারায়ণগঞ্জ তখন কেবল স্টিমারঘাট আর রেলস্টেশন! ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ-কলকাতা। শহর বলতে নবীগঞ্জ। পাটগুদাম, চিকন রাস্তা, গ্যাসের স্ট্রিট লাইট আর কদম রসুল। পাট শ্রমিকদের দরগা। রসুলের পায়ের ছাপের পাথর টুকরা! কদম রসুল।

এপ্রিলের এই গরমে প্রিণন যাচ্ছে কদম রসুল দরগায়! যাচ্ছে মানে ওদের সাথে ও যাচ্ছে। আগে এইরকম ভ্রমন তেমন পছন্দ ছিল না ওর। বা সেভাবে ভাবতও না। এখন খানিকটা আগ্রহ পায়, তবে তা খুব বেশি তা বলা যায় না। যদিও চাচ্চুরা খুব আনন্দ পাচ্ছে মনে হয়। নানু বিশাল ব্যাগভর্তি করে চিপস-চানাচুর নিয়ে আসছে! কিন্তু খাবারে তেমন আগ্রহ হয় না! ওরা যখন চেন্নাই গেছিল, এমন করে পাপা আর চাচ্চুও ওখানে মুরুগামি’র মন্দিরে গেছিল এক সকালে। ফেরার সময় চিকচিকে পাড়ওয়ালা শাদা তামিল লুঙ্গি নিয়ে আসছিল। ওগুলা নাকি মন্দিরে বিয়ে করতে আসা বরেরা পড়ে। চাচ্চু চিকন হাসি দিয়া ক্ষ্যাপানোর জন্য প্রিণনকে বলে, পরো তো, দেখি কেমন লাগে তোমাকে বরের পোশাকে!

মনে হচ্ছে ওরকমই কিছু হবে কদম রসুলে।

খুব রোদের ভিতর দরগার কাছে গিয়ে দেখে, সামনে আর আগানো যাবে না। রাস্তাটা খুব সরু হয়ে গেছে। সবাই খুব হতাশ হয়ে পড়ে। এখন কীভাবে যাবে!

নানাভাই বলল : আমরা প্রথম যাব পেশোয়ারি হুজুরের দরগায়, ওখান থেকে ফিরে লাহোরি হুজুরকে জিয়ারত করে তারপর কদম মোবারক দর্শন।

*

আচ্ছা ব্রহ্মপুত্রের এই অবস্থা কেন? ম্যাপে তো কন্টিনিউটি পাই না! এখানে কৈ থাইক্কা আসলো?

শুরু হয়েছে কাপাসিয়ার টোক থেকে। এক মাথা নিচের দিকে নাইমা শীতলক্ষ্যা নাম নিছে, তারপর নানা পথ হয়ে নারায়ণগঞ্জ হয়ে কলাগাছিয়ায় মেঘনা ছোঁয়। আরেকটা হাত চিকন হতে হতে মৃতপ্রায় হয়ে ভৈরব বাজারের কাছে মেঘনায় মিলে গেছে। সেইটা মৃত ব্রহ্মপুত্রের ধারা। আদিধারাটা তাইলে হারাইয়া গেছে। সেইটার ডালপালা আছে সারা নরসিংদী ছড়িয়ে। উয়ারি-বট্টেশ্বর সেইখানে। দুই হাজার বছর আগে?

কিন্তু লাঙ্গলবন্দের কাছেও একটা চিকন প্রবাহ আছে ব্রহ্মপুত্রের। এইটা এক্সিট রুট। মেঘনায়। এইটার অস্তিত্ব শুরু হৈছে বেলাব’র কাছে। এখন সেখানে একটা হলিডে রিসোর্ট আছে। সেখান থেকে শুরু হয়ে অনেক আঁকাব্যাঁকা করে সোনারগাঁ ঘুরে সাপের মতো হিসস করে ছুঁয়ে আছে মেঘনাকে আরেকবার।

খুব মজার না?

মানুষের মতো নদীও কি খেলাধুলা করে? ডেথগেম?

চাচারা সাথে আসছে। মা বাবা আছে, চাচি আছে। কাজিনরা কয়েকজন আছে। কিন্তু সবাই ওকেই কেন্দ্র করে আছে আজকে। চাচির মা-বাবা আছে। বন্দরের নবীগঞ্জ চাচির বাবা, নানাভাইয়ের দাদাবাড়ি। শুনতে খুব জটিল লাগে সম্পর্কগুলি। কিন্তু বাস্তবে যার সাথে যার দেখা হচ্ছে, সে হয়ে উঠছে আত্মীয়। প্রিণনের নানা মারা গেছেন। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে উনি সাথে আছেন। ওর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। গাড়িতে বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে না। অনেকদিন পর ঘরের বাইরে আসা হয়েছে।

‘ভালৈ লাগছে, কী বলো প্রিণন?‘ বড় চাচ্চু চেঁচালেন।

ও সামান্য হাসল। তারপর বলল, ছোট করে: ‘হ্যা তাই!’ ওর গভীর চশমার কাচ থেকে কী যেন নেমে গেছে।

চিটাগাং রোড ধরে মদনগঞ্জ থেকে বন্দরের রাস্তা ধরে যেতে যেতে দেখল নানারকম ইন্ডাস্ট্রিতে ভরা জায়গাটা। আগের খেতখামারের চিহ্ন আছে, তবে তা এখন মেশিনপত্রে ঠাসা। গেমে এটা করা সহজ। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় লাগে। নানারকম ঝামেলা থাকে। এর একটা হচ্ছে নোংরা হওয়া। জায়গাটা গিজগিজ করতে থাকে মানুষে। ছোট ছোট দোকানপাটে ভরে যায় রাস্তার দুইপাশ, একইরকম পুরি, সিংগারা ভাজে। খোলা খাবারের দোকানে ধোঁয়া ওঠা চুলা জ্বলতে থাকে। ক্লান্ত লোকগুলা টিনের দুধে বানানো দুধ চা’য় চুমুক দেয়, সস্তা সিগারেটের দুর্গন্ধ ছিটায়, আর বোকা বোকা পিট পিট করে হাসে।

কদম রসুল পর্যন্ত গিয়ে তারপর কয়েক শ গজ ব্যাটারিচালিত তিনচাক্কায়। পেশোয়ারির মাজার মসজিদের পিছনে। এইটুকু নিজে নিজে যেতে হবে। একটা খোলামেলা ভাব রেখে মাজারটা বানানো। বেশ নিরিবিলি। একেবারে পাশেই শীতলক্ষ্যা, কার্গো নৌকা যেতে দেখা যায়।

‘আমি বিড়াল খেতে পছন্দ করি।’

‘আমি বিড়াল দেখতে পছন্দ করি।’

মাসুম কাবুলি এসে দাঁড়ায় প্রিণনের সামনে। যাও ঐদিকে ঘুইরা আসো। তোমার নানাজীর প্রিয় মানুষ দুজনের কবর জিয়ারত করে আইসো। ফিরে আসলে বাতচিত হবে! কে যেন এসে কানের কাছে বলে গেল। ও অবাক হলো না।

র‍্যাবের এনকাউন্টার হৈছে রাত্রে। মারা গেছে কে যেন। তার লাশ পাওয়া গেছে। এলাকা খুব গরম। সাবধানে চলাচল করার পরামর্শ দিলেন এক স্থানীয় মুরুব্বি।

কদম রসুল চত্বরে একটা বুড়ামতো চাঁপা ফুলের গাছ। ফুলফলে পল্লবিত। বেশি ফোঁটা ফুল ঝরে পড়তেছে। লোকজন এসে কুড়াইয়া নিতেছে। বেশি করে নেয় সন্তানকামী বধুরা। এক জটাধারী নেংটি এসে বলে : যার যা নালিশ আছে তা মনে রাইখা গাছে সুতা বান্ধেন। সমাধান হবে।

ওরা ঘুরে ঘুরে সতেরোটা কবর দেখতে দেখতে এক তরুণ আসলো। কাঁদোকাঁদো চেহারা, মাথায় নতুন কিস্তি টুপি। সুতা বাঁধা হলে কাছে গিয়া জিগানো হৈল : কী কারণ, ভাইজান?

উনি নারায়ণগঞ্জ শহরে কালিবাজারে সবজি বেচেন। মাস্তানের পাল্লায় পড়ছেন। চান্দা দিয়াও কুলানো যায় না, তাই শেষমেষ আসছেন এইখানে।

আমরা কই, ক্যান, ওসমান সাহেবের কাছে গেলে কাজ হয় না।

উনি বলেন: এরা তো ওনারই লোক!

থানায় যান না কেন?

ওনারা তো খুন আর ধর্ষণ ছাড়া পাত্তাই দেয় না।

তখন আমরা বলি, কেমন, এখানে সুতা বাইন্ধা কাজ হৈবেতো?

অবশ্যই প্রতিকার পামু। কাইলকাই বাজারের সবাই জানবে, সুতা বাইন্ধা আসছি। এইবার আর উপায় নাই! ওর জানেও তো কিছু ভয়-ডর আছে, না কি?

আরও একজনেরও এরকম প্রতিকার দরকার। তিনি ট্রাকমালিক। ওনার ৫টা ট্রাকের স্বাস্থ্য ভালো, কিন্তু প্রতিমাসেই বড় রকমের এক্সিডেন্ট হয়। উনি ৫টা সুতা বাঁধতেছেন। নরসিংদী থেইকা আসছেন। বললাম, নরসিংদীতে তো কাবুলি সাবের মাজার আছে, ঐখানে যান নাই? উনি বলেন, নারে ভাই, সবাই কি আর সবার জন্য দোয়া করে? এই গাছের খুব জোর।

আমরা কখনও পাথরের কদমছাপের ঘরটার চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে দেখি, সবাই যে যার মতো চাওয়া-চাওয়ির কাজ সারতেছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় জুতা খুলতে হয়। কে আর জুতা নিয়া ঘুরবে? নিচে তাই জুতার পাহারাদার আছে। খাদেম পরিবারও নাকি অনেকদিন হয়ে গেল, মুঘলামলের সামরিক চোকিতে বেশ ছিমছাম জিম্মাদারি করে যাচ্ছে। রসুলে পাকের পায়ের কল্পিত পদচ্ছাপ। চত্বরে অনেক লোক। জীবিত ও মৃতরা একপ্রকার আধাজীবন আর আধামৃত্যু নিয়া সারাদিন ব্যস্ত। তাদের গোসল হয় শীতলক্ষ্যার পানিতে, আহার হয় যারা আসে তাদের দানে, ঘুম হয় কদম মোবারকের পায়ের নিচে।

টিলামতো দরগায় ওঠা প্রিণনের জন্য একেবারেই অসম্ভব। কারণ বেশ কয়েকদিন হলো ও দাঁড়াইতে পারতেছে না। উরুর মাসলে তখন কোনো শক্তি পায় না। সারাদিন হাসিহাসি মুখ করে বসে থাকে। কোলে করে ওঠানামা করাতে হলো। একবার ঠিক হলো উপরে উঠবে না। আবার ঠিক হলো, নাহ, এতদূর পর্যন্ত আইসা ফেরত গেলে ভালো লাগবে না। শেষ পর্যন্ত পাপা ও শেজ চাচ্চু ওঠালো। ২৫টা সিঁড়ি। তবুও বেগ পেতে হল। ১৩ বছরের টগবগে কিশোর। কত ভারি, বাবার কোলে, চাচার হাতের বাঁধনে!

মাসুম কাবুলি এসে বলে, দেখো, ঐ লোকটার একটা পা নাই। পিছলা খাইয়া পড়ছিল, পরে পচন ধরছিল, কাইট্টা ফালাইছে। এখন কেউ জিগাইলে কয়, স্বাধীনতার সময় রাজাকার আছিলাম, মুক্তিরা গুল্লি করছিল।

প্রিণন কাবুলিরে জিগায় : আচ্ছা, এখানে কারা থাকত মুক্তিযুদ্ধের সময়? এখান থেকে তো নদীতে গার্ড দেয়া খুব সহজ! ২৫টা সিঁড়ি, ৬০ ফুট উচু, অন্তত ১৫ কিমি. দূর পর্যন্ত দেখা যাবার কথা না?

কাবুলি তার ঢোলা কাবুলি পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে কয়েকটা আখরোট বের করে প্রিণনকে দেয়। তার চোখ ছলছল করে ওঠে বালকটির প্রশ্নের ব্যাপ্তি দেখে। কত হুঁশিয়ার বাচ্চা। কতকিছুর খেয়াল।

জানো, আমার খুব ইচ্ছা যুদ্ধ করতে। আমি এমন সব স্ট্র্যাটেজি জানি, যত বড় ফ্লিট হোক না কেন, তার সিকুরিটি হোল ঠিকই বের করে ফেলবোই…তারপর ভ্লাম! কিন্তু এখন তো তা সম্ভব না! দাঁড়াতেই পারি না।

মাসুম কাবুলি তখন প্রিণনকে একটা গল্প বলল।

কাবুলি বলে : দেখো প্রিণন, আমি মানুষকে যুদ্ধ করে দেই। আমি ঈশা খাঁর জন্য লড়ছি। অনেকের জন্যই লড়াই করে দিছি। তারপরেও একটা প্রধান শত্রু লাগে, বুঝছ! অন্যের জন্য যুদ্ধও একরকম নিজের যুদ্ধই। আমার প্রধান শত্রু ছিল মুঘল বাহিনী। বা দিল্লি।

: কেন কেন? মুঘলরা তো অনেক বেশি স্ট্রং। ওদের হাতি আছে, নৌকা আছে। ওরা বড়।

:: ওরা শক্ত শত্রু, ওদের সাথে লাগতে অনেক বুদ্ধি লাগে। আমি বুদ্ধি দিয়া যুদ্ধ করি। তলোয়ার চালাই। মানুষকে জিতাই।

প্রিণনের বেশ ভালো লাগল হঠাৎ পাওয়া এই মানুষটাকে।

জিজ্ঞেস করে : তোমার তলোয়ার কি স্টারট্রেকের বেটলেট থামাতে পারবে? বা ফেজার গান? ধরো, তুমি এখন আঘাত করবা দিল্লি বা কোলকাতা। কীভাবে যুদ্ধটা করবা? তোমার হাতে সময় পাঁচ থেকে দশ মিনিট! আমেরিকানদের মতো তোমার কোনো প্রম্পট গ্লোবাল স্ট্রাইক প্রোগ্রাম আছে?

মাসুম কাবুলি খুব সতর্ক মানুষ, সে প্রিণনের কারসাজিটা ধরে ফেলল। প্রিণন ওকে সময়ের প্যাঁচে ফেলতে চাচ্ছে।

এবার কাবুলি ওকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, বলল, ঠিকাছে, ধরো কোনো এক শ্রাবণ মাসে তোমাকে রাতের মধ্যে এখান থেকে নদী ধরে কিশোরগঞ্জের এগারোসিন্দু যেতে হবে, তুমি কোন পথ ধরবা? কতক্ষণ লাগবে? ঠিক সময়ে পৌঁছাইতে পারবা তো? নইলে কিন্তু মানসিংহ ঈশা খাঁকে মেরে ফেলবে।

: শ্রাবণ মাসটা রিলেট করতে পারলাম না। গুগল ম্যাপ দিয়ে পথটা বের করা সহজ। কিন্তু সময় কেমন লাগবে? কোন ঘাটে… কেমন নৌকা… ১২০ কি.মি.। সারাদিন তো লাগবেই। বেশিও লাগতে পারে।

:: হা হা, আমি ছোট পথ জানি। আমার সাথে পারবে না। আমার লোকেরা আগে গিয়ে খেয়া নিয়ে বসে থাকবে, আমি ঘোড়া দিয়ে চলে যাব নদী পার হয়ে, তোমার আগে। আমি তো একলা চলি না। মানুষ নিয়া চলি।

: ঠিকাছে, তুমি মার্সে যাও তো। বলো, সেখানে আলু চাষ করবে কেমনে? বলো, গ্রিনল্যান্ডের হাঙর চারশো বছর বাঁচে কেমনে?

প্রিণন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। রোদ বাড়ছে।

:: এইটা ভালো বলছ। তুমি ইতিহাসের ভিতর ডুবে থাকলে অনেক দিন বাঁচার উৎসাহ পাবা। কিন্তু ভূগোল নিয়ে বসে থাকলে কোনো রহস্যই খুলতে পারবা না। রাস্তাঘাট দিয়া ট্রাংক রোড বানানো যায়, কিন্তু দিল্লি জয় করা অত সহজ না।

এই কথায় প্রিণনের একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়ল। কাজটা বাসায় টেবিলে ছড়াইয়া রেখে আসছে। খুব জরুরি, কিন্তু কেউ বুঝবে না কত জরুরি। কিছু মানুষ হন্যে হয়ে ওকে এখন নিশ্চয়ই খুঁজতেছে।

কিছুদিন আগে অনলাইন গেমের সময় হঠাৎ টের পায় কে বা কারা যেন মজার মজার মেসেজ ছুড়ে দিচ্ছে, খেলার মধ্যেই। ইন-গেম টেক্সটিং। মজাই লাগছে। কিন্তু এইগুলা ইংরাজি হরফে বাংলা। একটু অবাক হলো, ওর স্কুলের বন্ধুরা তো বাংলায় কিছু লেখে না… এইটা কে? ইংরাজি হরফে লেখে: ‘বাড়ি যাও’ ‘মরো’ ‘ব্যাপারটা ভালোই’… এইরকমের নানা কিছু। একদিন ও মজা করে লিখল: ‘চুপ কর শয়তান’। সেই থেকে শুরু। খেলার চেয়ে একসময় মেসেজিংটাই মজার হয়ে ওঠে। ওর আইডি থেকে ও কই থাকে তা বোঝার উপায় ছিল না। কিন্তু ও যে ঢাকায়, ওদের একজন তা বুঝে গেছে। এখন সেই আইডিটা বারবার কথা বলতে চায়।

তুমি কি প্রিমা অ্যাপ চেন? হঠাৎ একদিন প্রশ্ন!

প্রিমা? কী?

একটা অ্যাপ। খুব এক্সাইটিং। একদিন আসো!

সেক্স?

তার চেয়েও তীব্র!

ড্রাগ? এইটা দরকার নাই।

ড্রাগও না।

কী?

‘জেহাদ’!

প্রিণন কিছু বুঝতে পারে না! কিন্তু একটা শিরশিরে ভাব খেলা করে ওর মেরুদণ্ডে!

পাপাকে কি এটা বলবে? কেউ একজন ওকে সিডিউস করছে? প্রিমা কি কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রুপের অ্যাপ?

পাপাকে জানানোর আগে এসব নিয়া নিজেই খুঁজল কিছুদিন। ততদিনে ওর বিছানা থেকে একা ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। বাথরুম পর্যন্ত!

কিন্তু পড়ে সব বুঝা যায় না।

আবার গেম।

টেক্সট।

জেহাদ কী?

আজ নাকি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে। ওকে বলেছিল এগারটা থেকে বারোটায় সময় গেমে থাকতে।

ও খেলত মানি গেমস। স্ট্র্যাটেজিক গেম। নানারকম কৌশল লাগে। ধৈর্য লাগে। কয়েন জমাতে হয়। কখনও ছাড় দিতে হয়। পাপা এসে মাঝে মাঝে সঙ্গ দেয়। দুজনে মিলে হিসাব কষে। ওর একাউন্টিংয়ে এভাবে হাতেখড়ি।

ওর পাপা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যেটা হচ্ছে তার একজন ঠিকাদার। বিশাল কাজকারবার নাকি হবে। পাপা কি কি সব করে দেবেন। উনি রাশিয়ার অনেক গল্প বলেছেন। চমৎকার দেশ। বিদ্যুৎকেন্দ্রটা খুব চমৎকার একটা লোকেশনে। পাশেই নদী। কিন্তু নদীর পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র খুব খারাপ একটা লক্ষণ। একথা বলতেই উনি বলেন : বড় বড় কাজ করার জন্য অনেক কিছু করতে হয়। হঠাৎ করে তা বোঝা যায় না। সবকিছুর সহজ বিচার করা ঠিক না। কিন্তু প্রিণনের তা মনে হয় না। পাপা অনেক কিছুর গল্প বলে। কিন্তু সে সব কিছুর অনেক সমালোচনা আছে। খুব নেগেটিভ।

*

নানাভাইয়ের কথা শুনতে গেলেই তার মোটা ভ্রুর দিকে চোখ পড়ে যায়। ঐ চোখে যা বলেন তাই খুব ঠিক বলে মনে হয় প্রিণনের। এইরকম ছিল নাকি নায়ক দীলিপ কুমারের। বোম্বের দীলিপ কুমার নানার খুব ফেভারিট। এক ফাঁকে একথা জিজ্ঞেস করতেই খুব সহজেই মেনে নিলেন। বললেন ১৯৫০-এ ঢাকা কলেজে পড়ার সময় খুব সিনেমা দেখতেন। দীলিপ কুমার খুব আদর্শমূলক ডায়লগ দিতেন। আর তখন উনি দেখতে আরও দীলিপ ছিলেন। এইজন্য পেশোয়ারি হুজুর ওনাকে অনেক পছন্দ করতেন। বলতেন, সাব্বাশ বেটা। তোমার মতো নরম দিলের মানুষ চাই। তোমার মতো আদর্শ চাই। যাও, দুনিয়া থেকে শেখো।

আপনি পেশোয়ারি হুজুরের খুব ভক্ত?

তা না। বরং উনি আমার ভক্ত ছিলেন। আমার মধ্যে ভবিষ্যৎ দেখতেন।

কী নিয়া?

উনি মানুষের সাম্য চাইতেন। ভালোত্ব চাইতেন। আমারে বলতেন, সজাগ থাকবা। খোঁজ রাখবা। কিছু করবা।

আপনি পারছেন?

হুজুর তো নাই, কে বলবে পারলাম কিনা!

প্রিণন বড়দের এইসব কথা বুঝতে পারে না। ওরা কীভাবে যেন কথা বলে। কিছু আগের দিনের সাথে কিছু আগামী দিনের কথা মিশাইয়া ফেলে।

মাজার প্রাঙ্গণে মানুষের আনাগোনার শেষ নাই। সবই দুঃখী দুঃখী চেহারা। নীরব, কাচুমাচু।  দুনিয়ার সবাই কি আমার মতো হয়ে গেছে নাকি? প্রিণনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, ও এসব ভাবছে।

একসময় ওর কোনো রোগ-শোক ছিল না। স্কুলে গিয়ে ওদের গ্রুপটাকে মজা দিয়ে রাখত। সবাই। ওদের স্কুলের নিয়ম হল ৬ জনের একটা একটা গ্রুপ হবে। গ্রুপের মধ্যেই মিশবে, বন্ধুত্ব করবে। ক্লোজ হবে। শক্ত বন্ধুত্ব হবে।

কী একটা জ্বর হলো, নামী হসপিটাল স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ওভারডোজ দিলো। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ওর শরীর খারাপ হতে থাকল।

স্কুল না যাওয়া শুরু হলো। না দৌড়ানো শুরু। একা দাঁড়াতে না পারা শুরু। তারপর এক কঠিন যন্ত্রণার দিন। শুধু ওর মাথাটা পরিষ্কার থাকল। ব্যথায় দাঁত কামড়াইয়া থাকল, কিন্তু হাসি হাসি মুখ ঢেকে গেল না। কেউ মমতা নিয়ে কাছে আসে, ও শুধু হাসে। ভাবটা : বেশ, বেশ। আসছেন দেখতে। দেখেন। দেখেন।

কিন্তু দিল্লি চেন্নাই সিংগাপুর, সবাই বলল, এটা চিকুনগুনিয়া  না। ঠিক বোঝা যাইতেছে না রোগটারে। দেখেন, সবকিছু ঠিকঠাক। সব পেশির ইলেকট্রিক ইমপালস স্বাভাবিক। সবই কাজ করতেছে। আবার ও ঘুমের সময় ব্যথা পাচ্ছে না। কিন্তু জেগে উঠলেই সেটা আসছে। হয়তো কোনো মনদৈহিক কারণ আছে। কিন্তু ক্লিনিক্যালি কোনো সমস্যা নাই। ম্যাসেজ থেরাপি চলুক। সময়ই এর একমাত্র পরিত্রাণ। ওর সবকিছু ঠিকাছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু চোখের সামনে এমন দেখে বসে থাকা যায়? চাচির আব্বা নানাই প্রথম কথাটা তুলেছিলেন। আচ্ছা চল ওকে নিয়া কদম রসুলে যাই। ওখানে একটা ব্যাপার আছে।

চাচ্চু বলল : হ্যাঁ, হতে পারে। ওকে নিয়া একটা মজার ভ্রমন। কতকিছুই তো মানুষকে থেরাপি দেয়।

ও কয়েকটা অপশনের ভিতর বেছে নিল এইটা।

চাচ্চু একটু হাসল, মনে মনে।

আশি বছরের নানাভাই এখন প্রিণনকে হাঁটাতে হাঁটাতে নিয়ে গেল সবচেয়ে মধ্যে, গোলমতো ঘরটার দরজার কাছে। সেবক পরিবারের এক যুবক নিয়ে এলো একটা কষ্টিপাথরের গায়ে খোদানো পদচ্ছাপ। দেখেই বোঝা যায়, এটা একটা কল্পনার কল্পনা, এটা বাস্তব নয়। প্রিণন একবার দেখল। ওর কিশোর চোখের খুব ভিতরে একটা কথা কাজ করে গেল। এইটাও একটা সিম্বল।

আশেপাশে তাকিয়ে মাসুম কাবুলিকে দেখতে পাইল। অজানা ভাইরাসে ওর দাঁড়াবার মাসল কাজ করতেছে না, এইটা নিয়া তার সাথে আরেকটু আলাপ দরকার ছিল। উনি যখন আফগানিস্তান ছেড়ে চলে আসলেন, তখন কি ভেবেছিলেন, এইরকম নদীনালার ভিতর তার জীবন কেটে যাবে? অজানা জীবন থেকে উনি বিশ্বাস তৈরি করতে পারবেন? নদীর উপর দিয়া ঘোড়া দৌড়াবেন? দিল্লি কি অনেক দূর, বাংলা থেকে? পৃথিবীটা কি ছোট হয় নাই?

মাসুম একটু হাসে। তার সেই ৫০০ বছরের বিদেশি দাড়ি-গোফ সব বাংলার পাটের আঁশের মতো হলদেটে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শীতলক্ষ্যায় ডাইয়িং ফ্যাক্টরির পানি আর নবীগঞ্জের বাতাসে সিমেন্ট কোম্পানির ধুলা। বলেন : প্রফেটের কদম মোবারক কিনেছিলাম কেন? এইটা তো ছিল একটা রাজনৈতিক উপহার। ইস্তাম্বুল, কায়রো, জেরুজালেম সবখানেই তো কদমছাপ আছে। এই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মনে মহাপুরুষের স্মৃতি কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম!

সতেরোটা বাঁধানো কবরের পাশে একটু নিচু দিকে নির্জন একটা মসজিদ। এখানে নাকি রাতে অশরীরী কারা এসে নামাজ পড়ে। গমগম করতে থাকে নড়াচড়ার শব্দ। কিন্তু কাউকে দেখা যায় না।

ফুল খাওয়া নারীরা তখনও আসছিলেন। সারাদিনই আসে। আচ্ছা, যাদের সন্তান হবে, সেই সন্তানেরা কি কখনও বড় হলে এখানে এসে এই ফুলের ঘ্রাণ নেয়? তখনই ওর মনে হল, তাহলে কি আমিও এমন একটা ফুলের থেকে জন্ম নিয়েছিলাম? আমার মাম এরকম এক সুতা বাঁধা চাঁপাগাছ থেকে আমাকে খুঁজে পেয়েছিল? সেই চাঁপাফুলের তীব্র ঘ্রাণের ভিতর এই ভাইরাসটা ছিল?

 

 

প্রশ্নোত্তর

শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?

কাজল শাহনেওয়াজ: আমি গল্প লিখতে শুরু করি কয়েকজন চরিত্রকে অনুসরণ করতে গিয়ে। তারা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। কখনও কৌতূহলী করেছিল, কখনও ক্রোধ তৈরি করেছিল। কখনও কখনও সেই চরিত্রকে লিখতে গিয়ে তার ইকোলজি, পরিস্থিতি সর্বোপরি তার রাজনীতি আমাকে তাকে লিখিয়ে নিয়েছিল।

আমি সেই মানুষগুলিকে অন্যরকমভাবে দেখতে চাইতাম। তাদেরকে তার পরিস্থিতির ভিতরে ফেলে দেখতে চাইতাম সে কীভাবে রিয়েক্ট করে।

কিন্তু অনেক সময়ই গল্পগুলি যাকে নিয়ে লেখা সে পড়ে নাই। কিন্তু অন্যেরা পড়েছে। কখনও কখনও মনে হয়, এতে কি আমার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে? এই যে আমার চরিত্ররা তাদের দেখতে পারল না আমার চোখে, এতে তাদের কী এসে গেছে? তাদের জীবন তো বয়েই গেছে জীবনের নিয়মে! তখন ভাবি সাহিত্য তো এরকমই, একজনের গল্প অন্যজন পড়ে।

শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?

কাজল শাহনেওয়াজ: চরিত্রকে গল্পে আনতে গেলে তার সাথে একটা সম্পর্ক তো থাকতেই হয়। তাকে বুঝতে গিয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা খুবই কাজে লাগাই। ব্যক্তিগত জায়গা থেকেই গল্প শুরু করি! আসলে অভিজ্ঞতাই আমার গল্পের শক্তি।

এতটা সময় ছিল, সেই কিশোরকালে, তখন আমি ছিলাম খুব মুখচোরা। মানে কারও সাথে কথা বলতে গেলে কান গরম হয়ে যেত, মাথা খালি হয়ে যেত, জিহ্বা জড়ায়ে যেত। কী বলব, কোন ভাষায় বলব কিছুই মনে আসত না। তখন শরীরে ছিলাম রোগা, দাঁড়ায়ে কথা বলার সময় পা ক্রস করে হাঁটুর ওপর হাঁটু দিয়ে দাঁড়াতাম। একদিন প্রতিবেশি এক ডাক্তার তা দেখে বললেন, ওভাবে দাঁড়াও কেন? সোজা হয়ে দাঁড়াও! তখন কথাও বলতাম অস্পষ্ট, অস্ফুটভাবে। নিজের কোনো ভাষা ছিল না। কিছু বড় হবার পর দেখলাম আমি শুধু নিজের সার্কেলেই মন খুলে কথা বলতে পারি। অন্যখানে চুপ হয়ে যাই। আন্তব্যক্তিক যোগাযোগ নিয়ে এসব সারাজীবনই আমি ভেবে আসছি। এসব অভিজ্ঞতা গল্প লিখতেও মোকাবিলা করি। তাই তো একেক গল্প একেক রকম হয়ে যায়।

 শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।

কাজল শাহনেওয়াজ: কথাসাহিত্যকে সরাসরি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা খুব বিপজ্জনক। তবে কথাসাহিত্য আর রাজনীতি একই পরিবারের দুই ভাইবোন বলে মনে করা যায়। এরা পরস্পর নির্ভরশীল, একে অপরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন।

সমসাময়িক রাজনীতি তো বটেই, এমনকি অতীত রাজনীতিরও কথাসাহিত্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে। বিভিন্ন ভাষার শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্য পড়ে দেখা যায়, সবারই রয়েছে তার ভূ-রাজনীতির সাথে গভীর সম্পর্ক। ভারতীয়, রুশ, লাতিন, আফ্রিকান, চীনা যে ভাষার দিকে তাকান না কেন, তার সব মণিমানিক্য রয়েছে তার জনসম্পৃক্ত কথাসাহিত্যে। কারণ সেই গল্পগুলিতে যে আছে তাদের ভূগোল, রাজনীতি লোক ও ইকোলজি।

শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।

কাজল শাহনেওয়াজ: কোনো নির্দিষ্ট গল্পের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। অনেক গল্পই জীবনের বিভিন্ন বয়সে আমাকে নানান রকম অনুভূতিতে জড়িয়েছে তা বলা যায়। কান্দছি কিনা তা অবশ্য মনে পড়ছে না।

শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?

কাজল শাহনেওয়াজ: গল্প নিজেই তার কাঠামো, ভাষা বা বানান পদ্ধতি তৈরি করে নেয়। সচেতন চেষ্টা করে এসব করার চেষ্টা করি না আমি।

আমি ঠিক কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো বা নির্মাণরীতি ব্যবহারে অভ্যস্ত নই। অনেকটা লেখার টানে আমার ফর্ম তৈরি হয় বলে মনে হয়। একেক সময়ে আমার আগ্রহের সীমা বদলায় বিভিন্ন প্রকারে। সেইমতো লিখি। কখনও যাকে বলে টাইম পিরিয়ড ধর্মী, কখনও মনোদৈহিক, কখনও বিজ্ঞানধর্মী।

শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?

কাজল শাহনেওয়াজ: একটা লেখা যখন জ্যান্ত হয়ে ওঠে পাঠের সময়, সেটাকেই আমি সার্থক গল্প বলে মনে করি।

শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখককের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

কাজল শাহনেওয়াজ: প্রথমত, একজন সাধারণ নাগরিকের বাস্তবসম্মত কাণ্ডজ্ঞান তো লেখকের থাকতেই হবে। রাজনৈতিক সূক্ষ্ণজ্ঞানও খুব দরকারি। তবে এসবের সাথে তাঁর ভাষাশৈলী, গল্প বলার মৌলিক কায়দা থাকাটা খুব জরুরি। তদুপরি পাঠককে আকৃষ্ট করার গুণটাও থাকতে হবে।

বিশেষ জরুরি অবস্থা ছাড়া একজন লেখককে নাগরিকের সবধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুসরণ বাঞ্ছনীয়। তবে বিশেষ অবস্থায় লেখক অনেক ভূমিকা পালন করতে পারেন। লেখার বিশেষ শক্তি রয়েছে। তা লেখার মাধ্যম নির্বিশেষে সর্বত্র অনেক ক্ষমতা বহন করে। লেখা– মত পাল্টাতে পারে, নতুন মতামত সৃষ্টি করতে পারে। একটা লেখা মানুষকে দিতে পারে আত্মমর্যাদাবোধ, সহনশীলতা শেখাতে পারে সমাজকে।

অসম্ভব শক্তিশালী এই বাক্যজগত।

আমাদের উচিত এই শক্তিতে মানুষের জন্য ব্যবহার করতে শেখা।

শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!

কাজল শাহনেওয়াজ: গত কিছুদিন ধরেই দুইটা গদ্য রচনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছি। পিরিয়ড গল্প বলা যায় এদেরকে। একটার ব্যাপ্তি তিন জেনারেশন বা শ’খানেক বছর। আমাদের চেনা ভূগোল, অচেনা গল্প! অনেকটাই এগিয়েছে লেখা।

আরেকটা বেশ কিছু আগের। সেখানে নানারকম অনুসন্ধান রয়েছে, ইতিহাস পাঠ রয়েছে। পুনর্বিবেচনা রয়েছে।

এ বছরটা এই ধরনের লেখাতেই মত্ত থাকতে চাই।

More Posts From this Author:

    None Found

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!