কবিতায় শব্দকে তার অর্থ দ্যোতনার বাইরে নিয়ে হাঁটাতে হয়

Share this:

প্রশ্নোত্তর:

শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?

মাসুদার রহমান: কবিতার তাড়না কখন কিভাবে অনুভব করেছিলাম আজ আর সেই কথা ঠিক বলবার উপায় নেই। বরং স্মৃতির হাতড়ে তার খোঁজ করতে গিয়ে নির্দিষ্ট কিছু না পেয়ে এক ধরণের বিপন্নতা জাগলো। শৈশব থে্কেই অপরিচিত অল্পপরিচিত লোকজনের সঙ্গে খুব সহজে মিশতে পারতাম- তা কিন্তু নয়। ফলে এক ধরণের একাকীত্ব ছিল আমার মধ্যে, আর এই একাকী বোধ করায় সবাই যখন খেলাধুলা গল্প গুজবে মেতেছে, তখন আমি তার নীরব দর্শক কিংবা ঘরের ভেতর বড্ড চুপচাপ। আড্ডায় বসে আজও খুব কমই বলতে পারি, আসলে বিপত্তিটি ঘটে বলতে না পারা থেকেই। কিন্তু শ্রোতা হিসেবে নিজেকে বেশ মনযোগী বলেই দাবি করি। খেলাধুলা খুব একটা করতাম না, তাই হয়তো বইপত্রে নির্ভরতা বেড়েছিল। খবরের কাগজ, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন, বাজারে থেকে গৃহস্থালি’র কেনাকাটায় দোকানির দেওয়া নানান দ্রব্যের মোড়ক, রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কবিতার ছেঁড়া-অংশ সবকিছুই আমার পাঠ্য তালিকায় চলে আসে। বাড়িতে বইপত্র তেমন ছিল না, দূর পাড়াগাঁয়ে যা হয় সাধারণত। মাধ্যমিক স্কুলে পাঠের সময় স্কুল-লাইব্রেরি থেকে কিছু বইপত্র পড়েছিলাম, যার পুরো অংশ-ই নভেল। সেই স্কুলপাঠের সময় একটি শিশুকিশোর মাসিক পত্রিকায় ছোটদের বিভাগে আমার কাঁচা হাতে লেখা ছাপা হয়। তারপর বেশ নেশা হল। নিয়মিত লেখা দিতাম, তাঁর কিছু কিছু ছাপাও হতে থাকলো ছোটদের বিভাগে। নিতান্ত কাঁচা হাতের লেখা।

পাশের গ্রামে সাপ্তাহিক একটা হাট বসতো। মনে আছে, গতদিনের ভাঙ্গাহাটের পথে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পেঁয়াজ রসুন খোসা আর ছাই-গাঁদার মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার (সম্ভবত) সাহিত্য সাময়িকীর একটি ছেঁড়া পৃষ্ঠা কুড়িয়ে পাই। তাতে ছিল আল মাহমুদের ‘অস্পষ্ট স্টেশন’ নামে একটি কবিতা- কিন্তু সেটাও আশিংক। কবিতার ক্ষুদে পাঠক হওয়া স্বত্বেও সে কবিতায় কিছু দৃশ্যকল্প আমার মধ্যে সংঘাতিক রকম অভিঘাত ফেলে। বিশেষ করে, ‘সদ্য দুইয়ে নেওয়া গাভীর বাঁটের মত হাল্কা মেজাজের বাংলাদেশ’ কিংবা, ‘আখমাড়াইয়ের কল থেকে ছিটকে আসা মাছির ঝাঁক সরিয়ে/ আমি নীল রুমালে মুখ মুছে নিয়েছি’ এ রকম পংক্তিগুলো। সেই কবিতার ছেঁড়া-অংশটি আমার যত্নে ছিল দীর্ঘদিন। পড়ে এক সময় ওই কাব্যগ্রন্থ কিনে সম্পূর্ণ কবিতার পাঠ নিয়েছিলাম। পড়েছিলাম নিবিড় লোকায়ত ঢংঙের অসামান্য ‘সোনালি কাবিন’ প্রেম-দ্রোহ-সামাজিক সাম্য ও সমবন্টনের ১৪টি সনেট। তখন মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে বিভাগীয় শহরে গেছি। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনে পেয়েছিল অপার বিস্ময়। আমার পাঠ্যে নিবিড় হয়ে উঠে শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ ‘বুক তাঁর বাংলাদেশের হৃদয়’ ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ ‘টেবিলের আপেলগুলো হেসে ওঠে’। পাঠে এলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। সে সময় সারা দেশে তরুণদের সম্পাদনায় অনেক পত্রিকায় লিখেছি। যদিও আজ সে সব লেখা হারিয়ে গেছে, কিংবা ফেলিওয়ালার ঝাঁকায় সের দরে উঠে গেছে। এতো কথা বলার পিছনে ওই একটি জিজ্ঞাসা, ‘কবিতা লিখতে হবে এই বোধের তাড়না কবে থেকে অনুভব করি?’ তাই খড়ের গাদা থেকে সুচ খুঁজে না দিতে পারার ব্যর্থতায় পুরো খড়ের গাদাটি সামনে রাখছি। প্লিজ, সুনির্দিষ্ট বলতে না পারার অক্ষমতা মার্জনা করবেন।

 

শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষাশৈলীর বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী।

মাসুদার রহমান: কবিকে তাঁর কবিতায় সমসাময়িকতাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় থাকে কি? মনে করা যাক, হরপ্পা সভ্যতাকে কবিতায় ধরতে চাইছেন এ সময়ের একজন কবি। তাহলে সেই অতীত সময়ের সঙ্গে সমসাময়িকতা দিয়েই সেতু বাঁধতে হবে কবিকে, না হলে তা সম্ভব হবে কি করে! কবি তাঁর সমসাময়িকতা দিয়েই কবিতার সমসাময়িকতা নির্মাণ করেন। সে সমসাময়িকতা ভেতরেই তাঁর রাজনৈতিক বোধ ভাষাশৈলীর মতো বিষয়গুলো বিদ্যমান থাকে। কবি থেকে কবিতে সমসাময়িকতা বিষয়টি অপেক্ষিক বা ভিন্ন ভিন্ন। একটি সময়ে লিখিত সকল কবির কবিতার সামগ্রিকতা ওই সময়ের  কবিতার সমসাময়িকতা। আমার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষা শৈলী আমার কবিতার মধ্যেই বিদ্যমান।

পাখিদের মধ্যে মুরগি মানুষের নিকট সর্বাধিক পরিচিত। কিন্তু ৫/১০টি পাখির নাম বলতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষ মুরগির নাম করে না। যেন মুরগি কোন পাখি নয়। কিন্তু কেন? ধরে নিতেই পারি, মুরগির গৃহপালিতের মতো বশ্যতা মেনে নেওয়া বিষয়টি। কবিদেরও তেমনি মুরগি হলে চলে না, একান্তভাবে কবি হয়ে উঠতে হয়। কবি’র শব্দের কাছে বশ্যতা স্বীকারের কোন দায় থাকেন না বরং শব্দেকে বশ মানিয়ে তাকে নতুন কথা শেখাতে হয়।কবিতায় শব্দকে তার অর্থ দ্যোতনার বাইরে নিয়ে হাঁটাতে হয়। একজন জাদুকর যেমন করে সামান্যকে অসামান্যভাবে উপস্থাপন করেন। তেমনি সামান্যকে অসামান্য এবং অসামান্যকে সামান্যীকরণ কবির কাজ। ‘চাঁদে পানি নেই’ এই সংবাদটি আজ সাধারণ। ‘চাঁদে পানি আছে’ এমন একটি সংবাদ বা তথ্য জনসম্মুখে উঠে এলে এই মুহূর্তে তাকে জাস্ট অসাধারণ ছাড়া আর কি বলবেন? কবিতা তো অসাধারণত্বকেই ছুঁতে চেয়েছে বারবার। নিজের কবিতার শৈলী-চেতনা-বোধ নিয়ে নিজে বলতে চাইছি না। তা পাঠক-সমালোচকের জন্যই ধরা থাকুক।

 

শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

মাসুদার রহমান:  ‘কবিতায় যৌনতা’ পক্ষে বিপক্ষে বলবার মতো কিছু নেই। ভেবে দেখেছি, আপাত নিরীহ ‘বোতাম’ শব্দটিও যৌনতার ইঙ্গিত বহন করে। কবিতা হল সেই ভাষাসম্পদ, যা ব্যবহারিক ভাষা থেকে সামান্য বা বিস্তর আলাদা কিন্তু প্রতিবন্ধি নয়। কবিতাকে নতুন হতে হয়। পূর্বে যা লিপিত হয়নি, যেভাবে লিপিত হয়নি, সেভাবে হওয়া এবং তা স্পর্শ করাই কবি’র কাজ। কিন্তু প্রশ্ন হল, পাঠক তা মানবেন কেন?

-মানবেন। হয়তো মানবেন।

যদি না মানেন?

তার উত্তর আপনি ভালো জানেন আমার চেয়ে। তবে কবিতা লিপিত হওয়া মাত্র তার পাঠক না-ও জুটতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতেও হয়েছে কবিকে তার যোগ্য পাঠকের জন্য। যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত জীবনানন্দ দাশ। তাহলে কী দাঁড়ালো? নতুন এবং একাধারে যেন তা কবিতা হিসেবে গ্রাহ্যতা পায় তবেই তা কবিতা। এখনে সর্বজন গ্রাহ্যতার কথা চিন্তা করা ভুল হবে। শিল্পের সর্বজন গ্রাহ্যতা অবান্তর। মনে করে দিতে চাই, ভাষাকে যখন বিধান রচনার কাজে ব্যবহার করা হয়। পরিপত্র চিঠি দলিল দস্তাবেজ লেখার কাজে প্রয়োগ করা হয়।তখন নিশ্চিতভাবে ভাষার বহুগামিতকে রোধ করতে হয়। ভাষার ভিতরের সকল বিষ-কাম-ক্রোধ নাশ করতে হয়। সম্ভাবনাকে গলাটিপে হত্যা করতে হয়। না হলে বিধানদাতার আসন উল্টিয়ে যেতে বাধ্য। অন্যদিকে কবিতায় প্রয়োজন ভাষার জীবন্ত জংলিরূপটি।  কবিতার ভাষায় বহুগামিতা বিষ-ক্রোধ-কাম থাকতেই হয়। কবির আসন উল্টিয়ে পড়ার ভয় থাকতে নেই। তার ভাষাভ্রমণ তো আসনগুলো উল্টিয়ে পড়া দেখতে দেখতে।কবিতায় তেমন কিছুকেই রোধমূলক কর্মকাণ্ড বোধকরি অশ্লীলতা। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, সারা পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে যে সকল কবিতা বা সাহিত্য কর্ম খারিজ করে দেওয়া হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তাঁর কাব্যমূল্য বা শিল্পমূল্য থেকে থাকলে তা পরবর্তী সময়ে ফিরে এসেছে বহুগুণ গ্রহণযোগ্যতায়। প্রকৃত কবিতা  কোনভাবেই অশ্লীলতার অভিযোগে রোধ করা সম্ভব নয়। আসলে শিল্প সাহিত্য কাব্যে অশ্লীলতা বিষয়টি ফেক এবং অস্তিত্বহীন। এইটা বাইরে থেকে চেপে দেওয়া একটি আরোপিত ব্যাপার।

 

শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/ বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে কোন সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।

মাসুদার রহমান:  স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের কবিতা দুটো ঐতিহাসিক ঘটনার বিশেষ প্রভাব দেখি, একটি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভিত্তিক ভাষার মর্যাদাকে ঘিরে, অন্যটি ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম আর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ভিত্তিক। বাংলাদেশের কবিতা অনেকাংশেই আবহমান বাংলা কবিতার পরম্পরাজাত। বিশেষ করে গীতলতা বাংলাদেশের কবিতার এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে, যা এখানকার পাঠক রুচিকে মান্যতা দিয়েছে বরাবর। দেশ মাটি মানুষ নিসর্গ বাংলাদেশের কবিতার মূলস্তম্ভ। সে তুলনায় বাংলাদেশের কবিতায় নিরীক্ষা কম হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় নিরীক্ষা আছে। পাঠক রুচিকে চ্যালেঞ্জ করবার মতো বেপরোয়াপোনাও বিদ্যমান। নানা রকম মুভমেন্ট বা আন্দোলন সমান্তরালভাবে প্রবাহমান থাকতে দেখি পশ্চিমবঙ্গের কবিতাকে কেন্দ্র করে। কবিতা বা সাহিত্য কেন্দ্রিক যেমন প্রতিষ্ঠান পোক্ত শিকড়বাকড় চারিয়ে দিয়েছে, তেমনি উল্টো প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মতো ঘটনাও সেখানে বিপুল শক্তিতে মাথা তোলে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বাংলাদেশর জন্ম বাংলাভাষা ভিত্তিক। রাষ্ট্র এখানে বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য, এখানকার সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষাভাষী। কিন্তু হিন্দিসহ অন্যান্য অঞ্চলের বা প্রাদেশের ভাষার চাপ মোকাবেলা করে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষাকে টিকে থাকতে হয়, সেখানে বাংলা কবিতার লড়াইটাও একটু ভিন্ন। তবে সাম্প্রতি অনলাইন সাহিত্য চর্চার ফলে দুবাংলার কবিদের পারস্পারিক চিন্তা ও বোধের নৈকট্য ঘটেছে স্বাভাবিকভাবেই। কবিতা ও সামগ্রিক সাহিত্য তাঁর প্রভাব পড়ছে বৈকি। পরিশেষে বলতেই হয়, বাংলাভাষার সাহিত্য বা কবিতাকে রাষ্ট্রীয় বা ভূগোলগত পার্থক্যের কারণে মোটাদাগে আলাদা করে দেখবার কোন কারণ দেখি না। দু’টি ভূগোলের মধ্যে একটি রাষ্ট্রীয় বিভাজন রেখা আছে, কাঁটাতার আছে আর সেটা রাজনৈতিক বাস্তবতা। আলাদা রাষ্ট্র বা ভূগোলে বসবাস করার সুবাদে একটি ভাষার ভেতরে দেয়াল তুলে দেবার মতো কোন উদ্দেশ্য না থাকাই ভালো। বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রলিয়াসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী কবিদের লেখা কবিতা মিলেই তো সামগ্রিক বাংলাকবিতা।

 

শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোন বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।

মাসুদার রহমান:  বাংলা একাডেমী আয়োজিত ২১শে বইমেলা-২০২২ শেষ হয়েছে কিছুদিন হলো। গত তিনদশক ধরে আমার কবিতাসহ যাবতীয় লেখালেখির প্রকাশ অবলম্বন লিটলম্যাগাজিন ভিত্তিক। আজকাল কয়েকটি অনলাইন ভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকায়ও প্রকাশের স্বস্তি খুঁজে পেয়েছি। ফেব্রুয়ারিতে-২০২২ সময়কালে প্রকাশিত ‘চিহ্ন-৪২’ ও ‘কঙ্কাল-১০’ সহ বেশ কয়েকটি লিটলম্যাগাজিন ইতোমধ্যে আমার হাতে পৌঁছে গেছে। দু’একদিন হয় হাতে পেয়েছি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত গৌতম মণ্ডল সম্পাদিত প্রসিদ্ধ ‘আদম’ পত্রিকা। এসব পত্রপত্রিকাই আমার টেবিল জুড়ে এবং পাঠে রয়েছে এখন। তবে আপনার জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে সদ্য প্রকাশিত যে গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করতে চাই তা ‘আবিদ আজাদের কবিতা সংগ্রহ’। সত্যি বলতে কি, আবিদ আজাদকে সেভাবে পড়িনি, যেটুকু পড়েছি তা খুব বিচ্ছিন্নভাবেই। স্নেহভাজন তরুণ কবি-সম্পাদক অরবিন্দ চক্রবর্তী এক রকম চেপেই ধরে আবিদ আজাদকে নিয়ে লেখার জন্য। আমার সংগ্রহে ‘আবিদ আজাদের কবিতা সংগ্রহ’ ছিল না। অরবিন্দ চক্রবর্তী মেইলে পাঠিয়েছিল পিডিএফ কপি। পিডিএফ পড়েই দুর্দান্ত নেশা হল। একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখে দিলাম। সেই লেখাটিই এখানে রাখছি।

‘শীত সন্ধ্যার এই গ্রামজনপদে হেঁটে হেঁটে নির্জন পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। একা। কিন্তু কেউ তো আছেই আমার সঙ্গে, অনুভব করছি। দূর দিগন্তে সূর্যাস্তের আভা ছড়িয়ে আছে দিগন্তের উত্তর-দক্ষিণব্যাপী। ওই যে দিগন্ত, সে পর্যন্ত দৃষ্টি পৌঁছতে গিয়ে পেরিয়ে আসতে হয়েছে ধান কেটে নেওয়া ধূ ধূ প্রান্তর। হঠাৎ হঠাৎ কিছু আলু আর সর্ষেখেত, আর এই উধাও শেষে চরাচর অন্ধকার হয়ে আসা দিগন্তের নিচেই ততোধিক অন্ধকার হয়ে আসা ইজেলে কাঠকয়লার টানের মতো একগুচ্ছ গ্রাম। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে যে আকাশ, যেখানে ডাক ছেড়ে ছেড়ে উড়ে আসতে লাগলো কতগুলো নিশিবক। ওরা বিমানের মতো আকাশে চক্কর দিয়ে রানওয়েতে নামবার মতো করে নেমে আসছে পুকুরের অন্ধকার লাগা শান্ত জলের মধ্যে কঞ্চিসমেত পুঁতে দেওয়া বাঁশের গায়ে।

ঘনিয়ে আসা এই অন্ধকারে এই পুকুরপাড়, পুকুরপাড়ের বাঁশের মাচায় বসে দেখি থইথই অন্ধকার জল। তারপর মনে হল, পুকুরের অন্ধকার জলে নিশিবক নয় যেন রাত্রি নেমে এসে পা ডুবিয়ে বসেছে। এবং তা মনে হবার পর-ই নিজের প্রতি সন্দেহ জাগল, পুকুর জলে রাত্রি পা ডুবিয়ে বসে থাকার দৃশ্যকল্পটি মোটেও আমার নয়। কিন্তু কার এই দৃশ্যকল্পনা? এতক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, অন্ধকার নির্জনতার মধ্যে তিনিই আমার ভেতর ক্রিয়া করে যাচ্ছিলেন। ওই যে বলছিলাম, আমার সঙ্গে আরও একজন আছেন। তার-ই রচিত এই দৃশ্যকল্প। আমাকে কীভাবে ভিতরে ভিতরে ক্রিয়াশীল করে রেখেছেন সেই জন। এই নির্জনতায় তিনি সঙ্গে না থেকেও ভাবনায় সঙ্গ দিচ্ছেলেন। কবি আবিদ আজাদ। ওঁকে পুনশ্চঃ পাঠে নিতে গিয়ে আবারও ওঁর কবিতায় বুঁদ হয়ে আছি কয়েকদিন হয়। ওঁর কবিতার মুগ্ধতা ছড়িয়ে থাকে জীবনব্যাপী।

‘স্বপ্ন দেখি একটা শালুকপাতা হয়ে আমি ভেসে আছি ডহর এক বিলে

আমার চারদিকে দুঃখী বিছানার মতো থইথই পানি সেই বিলের

দেখি আকাশ থেকে এক-পা খোঁড়া নারীর মত ধীরে-ধীরে নেমে এসে রাত্রি তার

                                 পায়ের গোছা ডুবিয়ে বসলো ঝুঁকে

তারপর উঠলো চাঁদ কঙ্কালের মতো একরোখা

ঘুমিয়ে পড়ল মাছেরা যার-যার শেওলার শিথানে

তারপর সেই শালুক পাতাটি বড় হতে লাগল… বড় হতে লাগল… বড় হতে

                                              লাগল…

বড় হতে হতে… বড় হতে হতে সেই ডহর বিলের চেয়েও বড় হয়ে গেল

আর একসময় আমি স্বপ্নের ভিতর থেকে জেগে উঠে ঘুমের পাড়ে বসে

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম’

                           (বিল ও শালুকপাতা)

এক কুয়াশার ঘোর বিছিয়ে রাখা হয়েছে এই কবিতায়। যে দৃশ্যকল্পনার ভেতর দিয়ে অন্ধকার বিলপাড়ে মনে পড়ে গেল কবিতাটি ও তার কবিকে। আবারও চোখ রাখি সেই দৃশ্যকল্পে, ‘দেখি আকাশ থেকে এক-পা খোঁড়া নারীর মত ধীরে-ধীরে নেমে এসে রাত্রি তার/ পায়ের গোছা ডুবিয়ে বসলো ঝুঁকে’। কী আশ্চর্য দৃশ্যভাবনা, পাঠের পর চুপচাপ বসে থাকতে হয়। স্বপ্ন দেখা দিয়ে যে কবিতার শুরু এবং স্বপ্নভঙ্গের আর্তনাদ দিয়ে সেই কবিতার সমাপ্তি। কিন্ত সমাপ্তির পরও সেই কবিতার অনুরণন চলতেই থাকে। তাহলে কী দাঁড়ালো? কবির কবিতা সমাপ্তি যেখানে তারপর থেকেই যেন পাঠকের কবিতা শুরু। তাই তো এই নির্জন বিলপাড়ে ঘনায়মান সন্ধ্যায় কবির কবিতা একজন পাঠককে সঙ্গ দেয়। ভাবনা দেয়। দৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্যকে মিলিয়ে দেয়।

কবিতায় বিল এবং শালুকপাতা’র মতো দুটি দুর্দান্ত প্রতীকের ব্যবহার নিঃসন্দেহে বাংলা কবিতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্তগুলোর পর্যায়ে রাখা যায়। আবারও বলছিলাম, কবিতাটির ভেতরের রাখা কুহক ও কুয়াশার কথা। তা ভেদ করে এই পাঠকের দৃষ্টি এক আবহমান গ্রামীণ মানুষের নগরবাসের যন্ত্রণাকে ছুঁতে পায়। যে শালুকপাতাটি বিলের চেয়েও বড় হয়ে উঠে, তার বাস নিশ্চয় আর সেই বিলে হবার নয়। তাকে প্রকাণ্ড হ্রদ বা সমুদ্রের শরণাপন্ন হতেই হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, পাঠকভেদে হয়তো কবিতাটির ভিন্নতর পাঠোদ্ধারও হতে পারে। হতে পারে এক স্বপ্নবান প্রেমিক যুবকের হৃদয়ভাঙা কান্না। এই যে পাঠের নানারকম উদ্ধার তাতে কবিতাটির মহৎত্ব বাড়ে, কমে না।

বলা বাহুল্য আমি চিত্রশিল্পী নই। এমন কি নূন্যতম আঁকিবুঁকি করবারও ক্ষমতা নেই। কবি আবিদ আজাদের রংতুলি এবং ক্যানভাসে সেই আঁকবার সক্ষমতা ছিল কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু তিনি যখন উল্লেখিত কবিতাটিতে বলেন, ‘তারপর উঠলো চাঁদ কঙ্কালের মতো একরোখা/ ঘুমিয়ে পড়ল মাছেরা যার-যার শেওলার শিথানে’। প্রিয় পাঠক, এই দুটি পঙক্তির মধ্যে যে ছবিটি আঁকা হল, তা পৃথিবীর মহান শিল্পীদের রংতুলিতে আঁকা ক্যানভাসের ছবির চেয়ে কম কীসে! ভাষার রংতুলি আর পাঠক হৃদয়ের ক্যানভাস, এক একজন কবি শিল্পীর চেয়েও মস্ত শিল্পী। এই কবিতাটিই যার প্রকৃষ্ট উদহারণ। ‘কঙ্কালের মতো একরোখা চাঁদ’ এবং ‘ঘুমিয়ে পড়ল মাছেরা যার-যার শেওলার শিথানে’, এখানে চাঁদ এবং মাছ আরও দুটি অনন্য প্রতীকের ব্যবহার মুগ্ধ করে। সামান্য গভীর অনুভবে বুঝতে চেষ্টা করলে পাঠকের হয়তো বুঝতে অসুবিধে হয় না, যখন কঙ্কালের মতো একরোখা চাঁদ আকাশে, তখন মাছেরা যার-যার শেওলার শিথানে ঘুমোতে বাধ্য। নিজেকে নিজেই এই সামান্য পাঠক প্রশ্ন রাখে, মাছ এখানে কোন বাস্তবতার চিহ্ন হয়ে আসে? এর উত্তর এই বিশ্বব্রক্ষ্ণাণ্ডের অনেক কিছু দিয়েই হতে পারে। আপাতত ধরে নেওয়া যাক, ‘কঙ্কালের মতো একরোখা চাঁদ’ এখানে- বড় হবার অলিক স্বপ্নের বাস্তবায়নের রূঢ়-রূপ   এবং ‘মাছ’ সহজাত সম্ভাবনা, যা রূঢ়তায় শেওলার শিথানে ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য। এবং তারপর ‘বড় হতে হতে… বড় হতে হতে’ ডহর বিলের চেয়ে বড় হয়ে ওঠা শালুকপাতাটি। এবং একসময় স্বপ্নের ভেতর থেকে জেগে উঠে ঘুমের পাড়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না-ই শেষ পরিণতি। পাঠক জীবনের সঙ্গে আশ্চর্য মিলিয়ে যায়। পাঠক যেন কবিতাটির বিল-রূপ পাড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন।

২.

সুন্দর ও নৃশংসতা পাশাপাশি রাখলে তা এক অন্যতর দ্যোতনা তৈরি করে। শুভ্রতার ধারণাকে তার বিপরীত কালিমায় ছেয়ে ফেললে তারও ভিন্নতর প্রতিক্রিয়া হবেই। সৃষ্টিকর্মকে বুঝতে হলে অনেক সময় শিল্পীর জীবন ও যাপনকে বুঝতে হয়। এ ক্ষেত্রে চিত্রশিল্প ক্রিস অফিলি’র চিত্রকর্ম ‘দ্য হলি ভার্জিন মেরি’র কথা মনে করা যাক। ছবির ভেতরে রঙয়ের পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে হাতির বিষ্ঠার (এলিফ্যান্ট ডাং) দু’টি স্তুপের উপর রঙিন পিন দিয়ে একটিতে লেখা হয়েছে ‘মেরী’ অন্যটিতে ‘ভার্জিন’ শব্দ দুটি। এখানেই শেষ নয়, এক মুঠো হাতির বিষ্ঠা দিয়ে মেরীর উদোম সুউচ্চ দুটি স্তন নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে নিউইয়কের ব্রুকলিন মিউজিয়ামে চিত্রকর্মটি এসেছিল খোদ লন্ডন এবং বার্লিন ঘুরে। সাধারণ চোখে সেই চিত্রকর্মটি ছিল, কালো কিম্ভুত একটি নারীমূর্তি। তা যে মেরীকে কেন্দ্র করে শিল্পকর্ম তা দর্শক  মানতেই চায়নি। তবে বিপত্তি ঘটেছিল আরও পরে। স্বযং নগরীর মেয়র এসেছিলেন সেই চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে এবং ‘দ্য হলি ভার্জিন মেরী’ ছবিটি দেখে তিনি ক্ষিপ্ত হলেন। এ কোনো শিল্প কর্ম নয়, বরং অপরাধ। হাতি মলমূত্র পর্ণোগ্রাফির কোলাজ এবং মাতা মেরীর মতো এক চরিত্রে কালিমা লেপন, সব মিলিয়ে বিতর্কিত এবং অশ্লীল। আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন মেয়র। তারপর ঘটল সেই অভাবনীয় ঘটনা। দর্শকের চোখ খুলে যেতে লাগলো। ছবিটিকে নিয়ে তাঁদের আগ্রহ বাড়ল। তারা ছবিটির মধ্যে আশ্চর্য সব আবিষ্কার করতে থাকলেন। শিল্প এভাবেও ক্যুমিউনিকেট করে থাকে। বিশিষ্ট কলামিস্ট এনি রফি বলেন, ‘শিল্পী তার পূর্বপুরুষের পদধূলিতে মাখা আফ্রিকার নিসর্গ মানুষ আর প্রাণীদের  জীবন বৈচিত্রে মজেছেন। আফ্রিকার মায়ের মতোই চিত্রিত করেছেন মেরীকে। আফ্রিকার মাটিতে যেমন সচরাচর দেখা যায় অন্তর্বাসহীন উদোম স্তন, গর্ভবতী শরীরে জুড়ে থাকা রং-চংয়ে নীল দেহবসন; তেমন করে। হাতির বিষ্ঠা দিয়ে স্তন এঁকেছেন আফ্রিকান উর্বরতার প্রতীক হিসেবে। শিল্পী মেরীকে অসন্মানিত করতে চাননি বরং আত্বিকরণ করেছেন।’ আবিদ আজাদের নিম্নোক্ত কবিতাটি পড়তে গিয়ে আফ্রিকান শিল্পী ক্রিস অফিলি’র ‘দ্য হলি ভার্জিন মেরী’র কথা মনে পড়ল।

‘শীতের ভোর, কোমর পর্যন্ত উঠেছে রোদ-

বারান্দায় একটা ফুলকপি তার পাশে সবুজ শিম তার পাশে একটা বটি

তার পাশে দুটুকরো  হয়ে পড়ে আছে একটা মাছ

আর সেই  মাছের হা-এর ভিতর থেকে উঠছে ভোরের রোদ

সব কেমন স্থির সব কেমন লাল।

এরই ভিতর মোরগের গলা কেটে ফিরে যাচ্ছে একটা ছুরি

এরই ভিতর খুব সুন্দর একটা হাত রাজা-বাদশাহের ঝলমলে পোশাকের মতো

                             মোরগটাকে তুলে নিয়ে গেল রান্নাঘরে

এরই ভিতর আশ্চর্য সোনালি কায়দায় একটা মুরগি তীক্ষ্ণ ঠোঁটে গেঁথে ফেলল

                                         একটা লাল আরশোলা

আর সবাই যে যার জায়গামতো  দাঁড়িয়ে আছে

বারান্দায় রোদের পাশে ফুলকপি তার পাশে সবুজ শিম

তার পাশে সূর্যরাঙা হা-অলা দুটুকরো মাছ তার পাশে রক্তমাখা বটি দাও

সব কেমন স্থির সব কেমন লাল।

                                    (খণ্ডদৃশ্য)

কবিতার শিরোনাম ‘খণ্ডদৃশ্য’। পাঠের পর বুঝতে মোটেও অসুবিধে হয় না, নামটি যথার্থ। অজস্র খণ্ড খণ্ড চিত্র সমন্বয় এই কবিতাটি। একটি শীতসকালের দৃশ্য রয়েছে কবিতাটির সূত্রমুখ হিসেবে। শীতকাল একদিকে যেমন মলিনতার প্রতীক অন্যদিকে নানারকম বাহারি সবজির ঘনঘটা আমাদের রসনাকে তৃপ্তও করে। ‘বারান্দায় একটা ফুলকপি তার পাশে সবুজ শিম’ কবিতার এই কয়েকটি শব্দে শীতকালীন সবজি ‘ফুলকপি ও শিম’ এক লাবণ্য ঘন স্নিগ্ধতা ফুটে ওঠে। তাহলে এই স্নিগ্ধ পঙক্তির সঙ্গে পরের লেখা আরও কয়েকটি শব্দ পড়ি, ‘বারান্দায় একটা ফুলকপি তার পাশে সবুজ শিম তার পাশে একটা বটি/ তার পাশে দুটুকরো  হয়ে পড়ে আছে একটা মাছ’। বলেছিলাম, সুন্দর ও নৃশংসতা পাশাপাশি রাখলে তা এক অন্যতর উদ্ভাস তৈরি করে। এখানেও সেই দ্যোতনা এলো। ফুলকপি শিমের পাশে বটি এবং তার পাশেই দুটুকরো হয়ে পড়ে আছে একটি মাছ। কেমন যেন চমকে উঠতে হয়। শিল্প এরকম উদ্ভাসও দেয়। অপাঙতেয় অসঙ্গতির মধ্যেও শিল্পগুন থাকে। কালীমূর্তির ভেতরেও সেই নৃশংসতা রয়েছে। যেমন আপাত দৃষ্টিতে রয়েছে ‘দ্য হলি ভার্জিন মেরী’র মধ্যে।

‘শীতের ভোর, কোমর পর্যন্ত উঠেছে রোদ-

বারান্দায় একটা ফুলকপি তার পাশে সবুজ শিম তার পাশে একটা বটি

তার পাশে দুটুকরো  হয়ে পড়ে আছে একটা মাছ

আর সেই  মাছের হা-এর ভিতর থেকে উঠছে ভোরের রোদ’

উল্লেখিত চারটি পঙক্তির মধ্যে থেকে শেষ পঙক্তিটি লক্ষযোগ্য ‘আর সেই মাছের হা-এর ভিতর থেকে উঠছে ভোরের রোদ’ এখানে নৃশংসতার ভেতর থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরুলো। নিধনের ভিতর থেকেই যেন নতুন জীবন কথা বলে উঠলো। আবিদ আজাদের কবিতায় এ এক অমোঘ খেলা। বিজ্ঞানের খাদ্য-শৃঙ্খলের একটি দূরাভাস এখানে সংকেত পাঠাচ্ছে আমার পাঠক স্বত্ত্বাকে। কিন্তু তার স্পষ্টতর কোন রেখাচিত্র নেই। কবিতাকে এবস্ট্রাক বা অধরা করে তুলবার দুর্দান্ত এক মুন্সিয়ান।

‘সব কেমন স্থির, সব কেমন লাল।’

উপরোক্ত পঙক্তি লিখে কী বোঝাতে চাইছেন কবি, তা কবির বিষয়। সামান্য এই পাঠকের পাঠোদ্ধার, এখানে সবকিছু স্বাভাবিক এবং জীবন্ত রূপে-ই আছ। উপরোক্ত পঙক্তি আমাকে সে আভাস-ই দিচ্ছে।

শীত সকলের বারান্দা, যেখানে উজ্জ্বল রোদ এসে পড়েছে। বারান্দায় রাখা একটা ফুলকপি, ফুলকপির পাশে শিম, তার পাশে একটি বটি এবং বটির পাশে একটি মাছ পড়ে আছে যা দ্বিখণ্ডিত করে কাটা। শুভ, স্নিগ্ধ, সুন্দর এবং নৃশংস, কিন্তু তারপরও সবকিছু স্থির-স্বাভাবিক।

‘এরই ভিতর মোরগের গলা কেটে ফিরে যাচ্ছে একটা ছুরি

এরই ভিতর খুব সুন্দর একটা হাত রাজা-বাদশাহের ঝলমলে পোশাকের মতো

                             মোরগটাকে তুলে নিয়ে গেল রান্নাঘরে

এরই ভিতর আশ্চর্য সোনালি কায়দায় একটা মুরগি তীক্ষ্ণ ঠোঁটে গেঁথে ফেলল

                                         একটা লাল আরশোলা’

কবিতাটি জুড়েই বার বার সুন্দর এবং সেই সুন্দর বিনাশের দৃশ্য পাঠক দৃষ্টিকে ঝলসে দেয়। অস্বস্থিতে ফেলে। ‘এরই মধ্যে মোরগের গলা কেটে ফিরে যাচ্ছে একটা ছুরি’ এই দৃশ্যের গমণে ছুরি সাদৃশ্য একজন মানুষকেই আমি চলে যেতে দেখছি, অবশ্য তার হাতে রক্তাক্ত ছুরিও রয়েছে। লোকটি নৃশংসতার এক শেষ ঘটিয়ে ফিরে যাচ্ছে। ‘এরই ভিতর খুব সুন্দর একটা হাত রাজা-বাদশাহের ঝলমলে পোশাকের মতো/ মোরগটাকে তুলে নিয়ে গেল রান্নাঘরে/ এরই ভিতর আশ্চর্য সোনালি কায়দায় একটা মুরগি তীক্ষ্ণ ঠোঁটে গেঁথে ফেলল/ একটা লাল আরশোলা’

পরের পঙক্তি সমষ্টি আবারও পড়ি। সুন্দরের কী অসামান্য উদ্ভাস, রাজা-বাদশার পোশাকের মতো একটি মোরগ। আমরা জানি, মোরগ গৃহপালিত হলেও ভীষণ স্বাধীনচেতা। এখানে কবিতায় বর্ণীত মোরগটিকে এক মুহূর্ত আগেই হত্যা করা হয়েছে। সেই মোরগটিকেই একটি হাত তুলে নিয়ে রান্না ঘরে পাঠাচ্ছে। খুব অবাক করা একটি দৃশ্য, তারপাশে একটি মুরগি একটা লাল আরশোলাকে ধরে গলধকরণ করতে দেখি। খানিক আগেই বলছিলাম, খাদ্যশৃঙখলের কথা। এবার এখানে বিষয়টির আর কোন অস্পষ্টতা থাকে না। বিষয়টি বড়ই স্বাভাবিক। জীবন এভাবেই একে অন্যকে ভক্ষণ করে প্রকৃতিতে টিকে থাকে। যা একচোখে নৃশংস অন্য চোখে তা স্বাভাবিক।

‘আর সবাই যে যার জায়গামতো দাঁড়িয়ে আছে

বারান্দায় রোদের পাশে ফুলকপি তার পাশে সবুজ শিম

তার পাশে সূর্যরাঙা হা-অলা দুটুকরো মাছ তার পাশে রক্তমাখা বটি দাও

সব কেমন স্থির সব কেমন লাল।’

অদ্ভুত দর্শন আর বায়োলজিক্যাল বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায় কবিতাটিকে। ‘আর সবই জায়গা মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে’ কবিতার এই বাক্যটি হত্যা ও রক্তপাত সত্তেও সবকিছু শান্ত স্বাভাবিকতার বার্তা বহন করে। জগতের এ এক চিরায়ত নিয়ম, কেউ খাদক আর কেউ খাদ্য। প্রিয় পাঠক, অনেকের মতো আপনারও যদি ডিসকভারি বা এনিমেলপ্ল্যান্ট টিভির ক্যাবল চ্যানেলটি ফেভারিট হয়ে থাকে, তাহলে আপনি নিশ্চয় বনের নিয়মকানুন বিষয়ে ওয়াকিবহাল আছেন। যেখানে বেঁচে থাকার লড়াই এবং একে অন্যের খাদ্যে পরিণত হবার দৃশ্য দৃশ্যায়িত হচ্ছে সমস্ত দিনরাত্রি জুড়ে। বাংলা কবিতার ইতিহাসে এ এক অনন্য আর অদ্ভূত কবিতা।

৩.

‘ঝরাপাতা দেখলে তোমার চিঠির কথা মনে পড়ে আমার

ফিঙেপাখির কথা মনে পড়ে

সাঁকো দেখলে মন-খারাপ-করা দিগন্তের কথা মনে পড়ে আমার

ধুলোয় কোঁচড়ভরা ধু-ধু পথের কথা মনে পড়ে আমার

চাঁদ দেখলে তোমার একজোড়া ছেঁড়া চপ্পলের কথা মনে পড়ে আমার

সারাদিন টিপকলের সাদা ফোয়ারায় কথা মনে পড়ে

ঝরাপাতা দেখলে তোমার চিঠির কথা মনে পড়ে আমার

ফিঙে পাখির কথা মনে পড়ে’

আজকাল চিঠি আর কেউ লেখে? বোধ করি স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট প্রজন্মের এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাদের চিঠি সংক্রান্ত আবেগঘন অভিজ্ঞতা আছে। প্রকৃত হিসেবে আমরা-ই চিঠি প্রজন্মের শেষ মানুষ। আমরা যারা চিঠিযুগের অবসান দেখেছি।  আবার আমরাই একমাত্র প্রজন্ম স্মার্টফোন এবং ইন্টানেট অভিজ্ঞতাকেও তুলনা করতে পারি চিঠির সঙ্গে। যা একদিকে অকৃত্রিম এবং অন্যদিকে কৃত্রিম।

ঝরাপাতা দেখে কবির প্রিয়ার লেখা চিঠির কথা মনে পড়েছিল, ফিঙেপাখির কথা মনে পড়েছিল। কবি আবিদ আজাদ ছিলেন ঘোর চিঠিযুগেরই মানুষ। আজ চিঠি লুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু পাতা যে এখনো ঝরে! গ্রামবাংলায় চলতে গিয়ে এখনো ফিঙেপাখির দেখাও মিলে যায়। কবিতার প্রথম দুটি লাইন পাঠের পর চিঠিযুগ হারিয়ে ফেলার বিষাদ ছুঁয়ে যায় পাঠককে। পঙক্তি দুটির বাইরে আরও গভীর কিছু হারিয়ে ফেলার দুঃখ আচ্ছন্ন করে বৈকি। এইটিই চিরায়ত বাঙালি পাঠকের এক দুর্বল কর্নার। যে মনখারাপে ব্যাখ্যা হয় না। কেবল আকাশ ঝেপে মেঘ করে এলে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে মন। মনখারাপের অনুষঙ্গের সঙ্গে কবি আবিদ আজাদ আরও একটি অনুষঙ্গ যুক্ত করে দেন, ‘সাঁকো দেখলে মন-খারাপ-করা দিগন্তের কথা মনে পড়ে আমার’।

‘চাঁদ দেখলে তোমার একজোড়া ছেঁড়া চপ্পলের কথা মনে পড়ে আমার

সারাদিন টিপকলের সাদা ফোয়ারায় কথা মনে পড়ে’

এই অমোঘ পঙক্তিটি পাঠ করবার পর জীবনে চাঁদ দেখার সমস্ত অভিজ্ঞতাই পাল্টে যায়। প্রেমিকার একজোড়া ছেঁড়া চপ্পলের সৌন্দর্য চাঁদের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয় অবধারিতভাবে। এই হল কবিতার শক্তি, আবিদ আজাদের কবিতার শক্তি। প্রিয় পাঠক, ভুলে যাবেন না এই মুহূর্তে বসে আছি অন্ধকার থইথই এক নির্জন পুকুরপাড়ে। এতক্ষণে রাত সাবালকত্ব লাভের পর আবছা আলো-আঁধার আরও ঘন হয়ে উঠেছে চারপাশ। ধূধূ মাঠের পুব আকাশ জুড়ে উঠে এসেছে শীতকালের কুয়াশা লাগা শীতার্ত এক চাঁদ, যাকে আবিদ আজাদের কবিতা পাঠঅভিজ্ঞতায় বলা-ই যায়, প্রেমিকার পায়ের ছেঁড়া চপ্পল।’

 

 

 

কবিতা:

গান

গাইছে কে মাঠের ওপারে, উঁচু-নিচু ঢালের আড়ালে

তাকে ঠিক দেখাও যায় না

সূর্য অস্ত যাবে- মুহূর্তটি এরকম, কিন্তু সূর্যাস্ত হয়নি এখনো

এ ঘোর অব্যয়-দৃশ্য

সবুজ ঘাসের দেহ শিশিরে ভিজছে

পাখি তার ডানার পরিধি গুটিয়ে নিচ্ছে ধীরে

কিন্তু সন্ধ্যা আসেনি

ঝুঁকে পড়া রঙিন সূর্য- বিপরীতে পূর্ণদৈর্ঘ্য চাঁদ

সরে যাচ্ছে জেগে উঠছে মাঠের জোয়ারে

 

রঙিন টিনের বাড়ি

রঙিন টিনের বাড়ি- মাথার উপরে তার

প্রকাণ্ড অশ্বত্থগাছ

অশ্বত্থ ছায়ায় কখনো দুপুর দাঁড়ালে

জলঘরে তুমুল স্নানের শব্দ

বিবাহিত রমণীর বিস্তারিত বর্ণনা করে

 

দুপুর রহস্য, একটি লাল কুকুর

বাঁশের মাচান জুড়ে এসে বসো, তোমার পায়ের কাছে তোমার কুকুরটিও বসবে তাহলে

ওর নাম কী রেখেছ?

মাথার উপর নিম ডালে ফিঙেপাখি ডেকে ডেকে ওর নাম-ই জানতে চাইছে

ধূধূ মাঠের ওপারে ধুলো ওড়া মাটির সড়কে সমস্ত দুপুর জুড়ে রহস্য রচনা করে কেউ দূরে চলে যাচ্ছে

লাল কুকুর কান খাড়া করে দূর রহস্যের দিকে তীব্র তাকিয়ে রয়েছে

 

জাতীয় সড়ক যেখানে মুছে গেছে

নির্জন মাঠের মধ্যে আমাদের জাতীয় সড়ক

ডুবে গেছে

আমার সবুজ সাইকেল ঘাসে মুখ গুঁজে রূপান্তর হল ঘাসে

ফেরাও হল না তাই যে কারণে, রোদ-শীতে ধান ফুটে

ছড়িয়ে রয়েছি খই

বরফের নীচে চাপা পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ঠিকঠাক

কিন্তু কারও পাঠেও আসে না

অস্পষ্ট রেখার মতো নগর ও পাড়াগ্রাম

দূরে দূরে রাখাল ও গোধূলি উড়ছে

 

ব্রহ্মাণ্ডের ইশকুল   

কলাপাতার উপরে বসে দোল খাচ্ছে সকালের রোদ

রাস্তা মাড়িয়ে

এইমাত্র সবুজ সাইকেল বালিকা দল বেঁধে চলে গেছে ইশকুলে

ঘাসের উপরে মুখ রেখে দু’টি ঘোড়া চড়ে খাচ্ছে ইতস্তত

তার পিছে

ইউনিফর্ম পরে উড়ছে এক ঝাঁক রঙিন ফড়িং

আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা মাথার উপরে ধীরে উঠে আসবে

সূর্য

ইশকুলের রাগী হেডমাস্টার

 

ফাল্গুনে রচিত একটি আষাঢ়ে পদ্য

দু’একটি পাখি মাত্র বসে আছে

বিকেলের ডালে

আর সব উড়ে গেছে উঁচু উঁচু

মেঘের আড়ালে।

উঁচু মেঘ নিচু মেঘ যত মেঘ

সব মেঘ-ই সতী

এ ঘন আষাঢ় মাস, এ আষাঢ়

ঘোর মেঘবতী।

দূর গঞ্জের হাটে চলে গেছে

হাঁটুরের দল

তাঁদের যাত্রা পথ ভিজে দেয়

তুমুল বাদল।

ঠাকুরের জোড়াসাঁকো সেইদিকে

ওড়ে সাদাবক

প্রিয় এ গীতাঞ্জলী আষাঢ়ের

গীতা ত্রিপিটক

ত্রিপিটক! ত্রিপিটক! মনে পড়ে

তাকে বারবার

সে যুগে কেমন ছিল গৌতম-

বুদ্ধের আষাঢ়?

আমার আষাঢ় জুড়ে আমি একা

তুমি কবে ছিলে?

দু’একটি শালিক মাত্র আর আমি

বৃষ্টি বিকেলে।

 

পাতা

গাছের দিকে চেয়ে আছি। হঠাৎ দমকা হাওয়া আসে

দেখি, হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে অনেক সবুজপাতা

পাতারাও করে বুঝি পাখির কণ্ঠে ডাকাডাকি!

পাতাগুলো টিয়েপাখি

About The Author

  • More From This Author:

      None Found

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

1 thought on “কবিতায় শব্দকে তার অর্থ দ্যোতনার বাইরে নিয়ে হাঁটাতে হয়”

  1. Aminul Islam

    পড়লাম। মাসুদার রহমানের সাক্ষাৎকারটি ভালো লাগলো। আমি বহু বছর যাবত আবিদ আজাদের কবিতা পড়ি এবং ভালোবাসি। ৬/৭ বছর আগে আমি আবিদ আজাদের কবিতা নিয়ে ‘‘ আবিদ আজাদের কবিতা : শিল্পের বাগানবাড়ি ’’ শিরোনামে গদ্য লিখেছিলাম যা আজাদ নোমান সম্পাদিত ‘চর্যাপদ’ ছেপেছিল। কিন্তু তখন তাকে ন্যারেটিভ কবিতার কবি বলে উড়িয়ে দিতে চাইতেন নতুন প্রজন্মের কবিগণ। এখন ভালো লাগছে যে তার কবিতা নিয়ে অরবিন্দ চক্রবর্তীরা সংখ্যা করছেন এবং মাসুদার রহমানদের মতো কবিরা কথা বলছেন দীর্ঘ মুগ্ধতায়। মাসুদার রহমানের কবিতাগুলো বরবারেই মতোই ছিমছাম এবং নিজস্বতার রঙে রাঙানো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!