কবি যদি ছাড়ে দেশ ব্যথা সত্য জানে

Share this:

ভাবিয়া চিন্তিয়া কয় মুজিব ইরমে

লিখতে হবে কবিতা নিয়ে। লিখতে হবে চিন্তা, অনুধাবন, দর্শন, অনুরাগ সংক্রান্ত  একটি মুক্তগদ্য। প্রকাশ করবে শুদ্ধস্বর। বিশেষ কবিতা সংখ্যায়। শুদ্ধস্বর শুধু আমার প্রিয় ছোট কাগজই নয়, শুদ্ধস্বর আমার প্রিয় প্রকাশকও। মৎ প্রণীত আউট বই, উপন্যাস, ‘বারকি’ প্রকাশ করেছিলো শুদ্ধস্বর। বড়ো সুন্দর করে, বড়ো মন মতো করে। যদিও বইটি আর বাজারে নেই। তবে হৃদয়ে আছে। আহা, শুদ্ধস্বর! আহা, বন্ধু আমার! সেই প্রকাশনী নেই। আছে পত্রিকা। অন লাইনে। টুটুল এখন দেশছাড়া। খেশহারা। আমার মতোই। বিবাগী বন্ধু আমার। তার নির্দেশ আমি অমান্য করি কী করে! তাই লিখছি এই মুক্তগদ্য, কবিতা নিয়ে, বন্ধুর আদেশে।

কিস্তু আমি তো জানি, কবিতা লেখা যতো সহজ, কবিতা নিয়ে গদ্য লেখা ততোই কঠিন কাজ। আমার কাছে তাই মনে হয়েছে বারবার। যতো বার পত্রপত্রিকার ডাক পেয়েছি, ততো বারই পালিয়ে বেঁচেছি। দু’একবার অবশ্য পালাতে পারি নি। বন্ধুদের কাছ থেকে। লিটল ম্যাগাজিনের হাত থেকে। ধান ভানতে শিবের গীত গেয়েছি। শব্দ সংখ্যা বাড়িয়েছি। কাজের কাজ কিছুই হয় নি। এবারও তাই হচ্ছে। গেয়ে যাচ্ছি শিবের গীত। কবিতা নিয়ে ৫০০ শব্দের ধান আর ভানতে পারছি কই!

তবে শিবের গীত গাইতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো কবিতা লিখে চলছি প্রায় ত্রিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে। কতো রঙে, কতো ঢঙে, কতো ভাষায়, বিষয়ে যে কবিতা লিখলাম! লিখতে চেষ্টা করলাম। আর লিখতে লিখতে বুঝলাম, কবিতা লেখা এখনও শুরুই করতে পারলাম না। আমাদের বন্ধু, আমাদের সময়ের একজন বড় কবি, গেলো বছর এই দিনে আমাদের ছেড়ে যে প্রকৃত কবিতার জগতে চলে গেছেন, সেই আত্মবিধ্বংসী কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু বলতেন ‘মানুষ কবিতা লেখে মূলত মৃত্যুর পরে’। আহা, কবিতা! আহা, বন্ধু আমার! হয়তো তারা লিখছে কবিতা, আমরা যাদেরকে একে একে হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শুধু পড়তে পারছি না। লিখতে পারছি না। জগতের প্রকৃত কবিতা মনে হয় অলেখা অধরাই থেকে  যায়।  ভাবি, আর বেদনা বাড়াই।

আর আমার তো বেদনার শেষ নেই।  মাঝেমধ্যেই মনে হয় আমি যেন কবিতা লিখছি ২য় ভাষায়। বন্ধু টুটুল আমার এই বেদনা বুঝবে। সেও তো আমারই মতো সিলট্যা লোক। বৈদেশিয়া। আমাদের ১ম ভাষা, মাতৃভাষা সিলটি। বড়ো কষ্ট করে মান বাংলা, বইয়ের ভাষা শিখেছি। এবং শিখছি। বাংলা কবিতা লিখছি। বিদেশে বসে। কথা বলছি ৩য় ভাষায়। ভিনদেশী জবানে। প্রতিদিন। অথচ, কথা ছিলো, আমিও সিলেটে জন্মে গান বাঁধবো, দোতারা নিয়ে ঘুরবো হাওরে-বাঁওড়ে। নাগরী হরফে লিখবো পুঁথি ও পয়ার। আমিও হাছন করিম রাধারমণের দেশের লোক। মালজোড়া, পীরমুর্শিদীর টানে ঘরহারা হবো, নারীছাড়া, সংসারছাড়া হবো! গাইবো বন্ধুয়ার সুরত। এসব কিছুই হলো না! কবিতা কবিতা করে বাড়িছাড়া, দেশছাড়া হলাম। তবুও কি কবিতার দেখা পেলাম! লিখতে পারলাম কবিতা, অধরা সুরত!

এই ৩০ বছরের হাহাকার, কবিতা লিখতে না পারার হাহাকার, গান ও সুর বাঁধতে না পারার হাহাকার থেকে, বেদনা থেকে সম্প্রতি লিখছি এই কবিতা, লিখছি এই পয়ারপুস্তক। যখনই পয়ার লিখতে বসি, সেই পয়লা পুস্তক থেকে আজ পর্যন্ত, মনে হয়, এই লেখাগুলোই মূলত নিজের জন্যে লিখছি। আর সব লিখেছি, লিখছি অন্যের জন্যে। আর এসব ভাবতে ভাবতে লিখতে থাকি পয়ার, লিখতে থাকি নিজের জন্যে কতো কিছু না-লিখতে পারার বেদনা। মনে হয় এই বইটি নিজের। শুদ্ধস্বর পাঠকদের জন্যে তার থেকে ৫টি পয়ার এখানে রইলো। কবিতা নিয়ে আর কী  লিখবো! ‘জালালী কৈতর আমি শ্রীহট্ট মাজারে। ঘুরিয়া কাটাই দিন দূরের বাজারে॥ শরিয়ত উল্লা দাদা আমি তার নাতি। পয়ারপুস্তক রচে ধরি মারিফতি॥’ ইতি, তামাম শোধ।

 

 

পয়ার বিলাস

কে যেন ঘুমের ঘোরে বলে গেলো কাল। সেই থেকে মন মোর হৈয়াছে বেহাল॥ পয়ার পয়ার আর কতো করিবায়। বন্ধুয়ার রূপ তুমি কতো লিখিবায়॥ নিজ দুঃখ নিজ সুখ পাশরিয়া আজ। লেখো তুমি অন্য কিছু ভুলে লোকলাজ॥ তুমি যে লোকের মাঝে বাস করিলায়। কতো শোকে ভাঙ্গে বুক বলিতে না পায়॥ তুমি যে দেশের মাঝে দেশ দেখিলায়। সেই দেশে দুখি মানুষ করে হায় হায়॥ কৃষক শ্রমিক জেলে মজুরেরা কয়। এ পদ পড়িবে কেবা কেনো তবে ভয়॥ লেখো তবে সুখদুখ লেখো প্রতিবাদ। সোনাই থাকিবে শেষে কেনো খুঁজো খাদ॥ মানুষ মানুষ হোক বুক ভরা প্রীতি। ধর্ম নয় কর্ম হোক মানুষের রীতি॥ পৃথিবীতে মারামারি কাটাকাটি নয়। সুখেদুখে প্রেমেভাবে এক যেন হয়॥ জানি এই পদ লিখে কিছুই হবে না। এমন পদের দাম কোথাও রবে না॥ তবুও লিখিয়া রাখি মনে যতো জ্বালা। লুপ্ত হোক জাতপাত সাদা আর কালা॥

আমি তো তাদের লোক কবিটবি নই। আমিও দুখের দুখি দেশ ছাড়া হই॥ মানবের অপমানে দিবানিশি কাঁদি। ইরম নিজেকে নিজে ভাবে অপরাধী॥

 

 

মানবের পালা

সালাম জানিয়ে লেখা শুরু করিলাম। আদাবে প্রণামে গীত সুর ধরিলাম॥ বন্দনা করিতে চাই কী করিবো হায়। দেখিয়া মানব ঘৃণা কালিও শুকায়॥ স্মরণে রাখিতে চাই আল্লা ভগবান। আরো আরো বহু নামে গাই জয়গান॥ ভিন্ন ভাষা ভিন্ন ডাক ভিন্ন তার রীতি। মূলত উদ্দেশ্য এক মানব পীরিতি॥ এই ধরা মানবের মানবতা সার। মানবের মন ভজি ধর্ম যারতার॥ মানবের নামে পালা শুরু করিলাম। ভালোবেসে মানুষের হাত ধরিলাম॥ আইসো আইসো সবে ভাইবন্ধুগণ। এই পদে হোক তবে মানুষ ভজন॥ পৃথিবীর কতো রঙ কতো তার রূপ। সকলে বাসোরে ভালো মানব স্বরূপ॥ যে কথা লিখিয়া গেছে আমাদের কবি। উপরে মানুষ সত্য আর মিছে সবি॥ পীর আউলিয়া আর সন্ন্যাসী বাউল। যে কথা গিয়াছে বলে কেনো করি ভুল॥ এই পদ রচে যাই সহজ সরল। মানুষ ত্যাগুক নিজে মনের গরল॥ এই পদ নয়া বলে করিও না ভুল। মানুষ ভুলেছে প্রেম ফুটিয়েছে হুল॥ তাই এই পালা রচি পড়ি যথাতথা। কমুক কমুক দিলে জমে থাকা ব্যথা॥

পৃথিবীতে মারামারি কাটাকাটি দেখে। ইরমে মনের ব্যথা দুঃখ ক্ষোভ লেখে॥ ধর্মবর্ণ করে যারা মানু হত্যা করে। শত ঘৃণা শত ধিক তাহাদের তরে॥

 

 

পয়ার ২০১৯

লজ্জিত পুরুষ আমি  করিও না ক্ষমা। নারী তুমি দেবী তুমি তুমি প্রিয়তমা॥ ভুলিও না ভুলিও না এতো অপমান। পুরুষ নামেতে আমি লজ্জিত সমান॥ এই লজ্জা বড়ো লজ্জা কী করিয়া লিখি। জননী দুখিনী তুমি জ্বলি ধিকিধিকি॥ নামেতে পুরুষ ওরা মনে তো সয় না। ভাবিয়া মায়ের মুখ লজ্জিত হয় না॥ ধিক সেই নরাধম ধিক সেই নর। নারীতে জন্মিয়া করে নারীকেই পর॥ ধর্ষক-মর্ষক হও মানুষ তো নও। মানুষ হলে কি আর এতো ছোট হও॥ কোন বা গালির সুরে কী রচিবো আর। ধর্মকর্ম শিক্ষাদিক্ষা মূলত অসার॥ কী করিয়া এই সব পয়ারেতে বলি। পুরুষ সামান্য অতি ঘৃণাতেই মরি॥

ইরমের বড়ো লজ্জা হৈয়া নর জ্ঞাতি। ধ্বংশ হোক ধ্বংশ হোক কুপুরুষ জাতি॥ অপমানে নির্যাতনে জেগে ওঠো তুমি। কাঁপুক ধরণী আর এই বঙ্গ ভূমি॥

 

মিনতি পয়ার

পয়ারে কি নিতে পারে বাদ প্রতিবাদ। পয়ারে কি দেয় মুছে বেদনা অগাধ॥ পয়ারে কি ধরে রাখে ভাতের বলক। পয়ারে কি দিতে পারে অন্নের ঝলক॥ নিরন্নরে অন্ন দেয় শিশুমুখে দুধ। অভাবের ঘরে সে কি ফিরে আনে রোদ॥ এতো যুদ্ধ এতো ছল এতো যে দহন। তবুও তো আছে প্রেম ফুলে ভরা বন॥ পয়ারে পারে না কিছু ভালোবাসা পারে। প্রেম দাও প্রেম দাও বলে যারেতারে॥ আমিও তোমার কথা লিখে রাখি তাই। তোমারে লিখিলে ভাবি যুদ্ধটুদ্ধ নাই॥ তোমারে লিখিলে দেখি শিশুমুখে হাসি। তোমারে রচিলে বুঝি আজো বেঁচে আছি॥

এ মিনতি রাখো তুমি এ মিনতি রাখো। রোগগ্রস্ত পৃথিবীতে শুশ্রুষা মাখো॥ নিদানের কালে তুমি ইরমেরে দেখো। শত দুখে শত শোকে হাসিটুকু রেখো॥

 

 

 

ইরম বচন

এই বার বলি শোনো শান্ত রেখে মন। রচিয়াছি কান্না সুরে ইরম বচন॥ চারপাশে এতো এতো আয়োজন দেখি। সকলি অসার লাগে সবি লাগে মেকি॥ আমি তো আছি গো ধ্যানে তোমার মোকামে। এই আছি এই নাই সুনামে বেনামে॥ ডাকাডাকি করি রোজ নিরলে নির্জনে। কোন ডাকে সাড়া পাবো পুছি সর্বজনে॥ সকলেই বলে ধাঁধা সকলি অসার। রাত জেগে আহাজারি বাড়াই প্রসার॥ এই নদী  সেই নদী সুমিষ্ট জলের। নিশ্চয় জানিও হবে প্রবাহিত ফের॥ যত মীন করে খেলা জলের ভেতর। তারাও পুরাণ কালে বাঁধিয়াছে ঘর॥ চারপাশে এতো রোদ এতো হাসি আলো। আমি তো আঁধার রাত বাসিয়াছি ভালো॥

ইরমে হঠাৎ কেনো ভাবিলো এমন। পড়িলো মনের মাঝে সেই সে বচন॥ ঢেঁকি যদি স্বর্গে যায় তবু ধান ভানে। কবি যদি ছাড়ে দেশ ব্যথা সত্য জানে॥

 

Mujib Erom (Bengali) was born in Nalihuri village in Moulvibazar district. He studied in Sylhet, Dhaka, and UK. He has published several books, including poetry, stories, novels, and children’s literature.  His writings have received awards, including the Children’s Literature Award for the War of Liberation’s novel Joy Bangla and the Bangla Academy Syed Waliullah Award. He lives in Bangladesh.

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!