কমিউনিস্ট আন্দোলন: ম্যামথের কথা যেভাবে মিথ হয়ে গেছে

Share this:

বিশ্বব্যাপী বাম আন্দোলনের ব্যর্থতার প্রত্যেকটা কারণ নিয়ে লিখতে বসলে বিশাল একটা থিসিস পেপার লেখা হয়ে যাবে। ব্লগ তো আর থিসিস লেখার জায়গা নয়। তবে একটা পার্টিকুলার একটা পয়েন্টে ফোকাস করলে কম কথায় বামপন্থার ব্যর্থতার কলকব্জা অনেকটা পরিষ্কার করা যায়।

পৃথিবীতে কমিউনিস্ট আন্দোলন যখন শুরু হয়েছে, সেটা ছিল সময়ের তুলনায় একটা অ্যাডভান্স ইন্টেলেকচুয়াল অ্যাপ্রোচ। সেই অ্যাপ্রোচ ততকালীন সময়ের থেকে অগ্রগণ্য চিন্তকদের আকৃষ্ট করেছে, তাঁদের মাঝে সাড়া ফেলছে এবং তাঁদের আলাপ সাড়া ফেলছে টার্গেট সাবস্ক্রাইবার কৃষক-শ্রমিকদের মাঝে। এবং সেই সাবস্ক্রাইবারদের সমর্থনে অগ্রগণ্য চিন্তকদের কোনো একটা গ্রুপ একদিন বিপ্লব’ও সংগঠিত করেছে। বাস্তবতা দিয়েছে কমিউনিজমের স্বপ্নবাজিকে।

কিন্তু বিপ্লবের পর কমিউনিস্ট আন্দোলনের অ্যাপ্রোচ আর অ্যাডভান্স থাকেনি। তা হয়ে গেছে বুরোক্রেটিক। সেই বুরোক্রেসি তাঁদের বেসিক প্রমিসকেই নার্চার করে গেছে নতুন কোনো চিন্তা নির্মাণ ছাড়া। তবে সেই সময়টাতেই বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক সমর্থক অর্জন করতে পেরের কমিউনিজমের ধারণা।

কারণ কিছুকাল আগেও যা মূলত গুটিকয়েক মানুষের স্বপ্নবাজি ছিল, তা তখন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এড়াতে না পারার মতো শক্ত বাস্তবতা। দুটো অপশনই ছিল তখন বিশ্বের মানুষের সামনে। হয়, এমন একটা রাষ্ট্রের অপশন- যেখানে কোনো বেসিক নিডের মিনিমাম সিকিউরিটি নেই। নয়তো আরেক ধরণের রাষ্ট্রের অপশন- যেইখানে রাষ্ট্র সবগুলো বেসিক নিডের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়। ফলে তৃতীয়বিশ্বের নাগরিকদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই বেসিক নিড ফুলফিল করতে পারে, এমন রাষ্ট্রের চাহিদা তৈরি হইছিল।

কিন্তু এই তৈরি হওয়াও তো দাঁড়িয়ে ছিল অলরেডি এক্সিস্টিং একটা রাষ্ট্রের চেহারার উপর। যেই রাষ্ট্র আবার দাঁড়িয়ে ছিল বহুকাল আগের অ্যাডভান্স থিংকারদের প্রতিশ্রুতির উপর। ফলে নতুনত্বের কিছু এখানে ছিল না। এবং নতুনত্ব কিংবা সময়ের চেয়ে অগ্রগণ্য কোনো ভাবনা হাজির না করতে পারার সমস্যাটাও মূলত শুরু হয়েছে তখনই।

বুরোক্রেসির কল্যাণে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে নেতা হয়েছে একেকজন গড়পড়তা দলদাস। প্রধান নেতাকে ঠিকঠাক তোষামোদ করেই বহু পার্টিজান মোটামুটি ভালো পদ বাগীয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে সেসব রাষ্ট্রে। এবং সেই দলদাস পার্টিজানদের হাত ধরে কমিউনিস্ট আন্দোলনে নতুন কোনো মেরিট যুক্ত হয়নি। অ্যাডভান্স কোনো অ্যাপ্রোচ আসেনি। এবং এতে করে দ্রুতই তারুণ্য হারিয়েছে কমিউনিস্ট আন্দোলন।

যেমনটা উপরে একবার উল্লেখ করলাম, এক্সিস্টিং আমলাতান্ত্রিক সোশালিস্ট রাষ্ট্রের কল্যাণে মূলত তখনই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি বিকাশ লাভ করেছেছিল কমিউনিজমের ধারণা। অন্তত সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগে পর্যন্ত।

সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন গঠন হয়, তখন বিশ্ব বাস্তবতায় স্থান হয় দুই ধরণের ধরণের রাষ্ট্রের। ক্যাপিটালিস্ট আর সোশালিস্ট। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পতন হয়, তখন পৃথিবীতে বিরাজ করে বহু ধরণের রাষ্ট্র। ক্যাপিটালিস্ট আর সোশালিস্ট ছাড়াও তখন কল্যাণ রাষ্ট্র, ধর্মীয় রাষ্ট্র, ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্র, ট্যাক্স ফ্রি রাষ্ট্রসহ বহু মডেলের রাষ্ট্র বিরাজমান। ফলে মানুষের কাছে তখন অপশন তৈরি হয়েছে সুবিধামতো একটা কিছুর দিকে ধাবিত হওয়ার। কিন্তু যেই পার্টিকুলার পয়েন্টে আমি আগাতে চাচ্ছি, সেখানে অবশ্য ব্যর্থতার দায় মানুষের কোথাও ধাবিত হবার প্রবণতাকে দেয়া যায় না।

একটু আগে যে অ্যাডভান্স থিংকারদের বুরোক্রেট দলদাস দিয়ে রিপ্লেস করার উদাহরণ দিলাম, সেদিকেই আবার একটু ফেরা দরকার। যেহেতু সেই গড়পড়তা আমলা নেতারাই ছিল সারাবিশ্বে কাঠামোগত কমিউনিজমের পেট্রোনাইজার। এরা যখন পেট্রোন শুরু করছে- তৃতীয় বিশ্বে সেটা স্পার্ক করছে ঠিকই, তবে পেট্রোনাইজারদের সমপরিমাণ ফলাফল তাঁদের ভাগ্যে আসেনি।
আসেনি কারণ, তাঁরা স্পার্ক হয়েছেই ধার করা একটা আইডিয়ার উপর, যেই আইডিয়া ততদিনে আইডিয়া হিসেবেই বন্ধ্যা হয়ে গেছে আমলাতান্ত্রিকতার কল্যাণে। এবং উক্ত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের আমলা নেতাদের সিলেবাসের বাহিরে তৃতীয় বিশ্বের বাম আন্দোলন কখনও বের হতে চায়নি। ফলে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলো, তখন তৃতীয় বিশ্বের বাম আন্দোলনে পতন হলো কমিউনিজমের থিং ট্যাংকের।

কারণ তৃতীয় বিশ্বের বাম নেতারা যেহেতু কমিউনিজমের আইডিয়াটার প্রেমিস বা প্রমিস নিয়ে তেমন কোনো সংযোজন বিয়োজন করেনি।

তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের ফলে এঁদের মোটামোটু একটা দিশেহারা অবস্থাতেই পড়তে হয়। একে তো নিজেদের দিকপাল ঠিক নেই, তাঁর উপর দিয়ে নৌকার মাঝি নিজেই পানিতে ঝাপ দিয়েছে।

এদিকে ততদিন পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের লোকেরা নতুন বইয়ে যেই পুরাতন আইডিয়াও পেয়ে আসছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে গেল সোভিয়েত পতনের মধ্যে দিয়ে। ফাঁপরে পড়ে গেল তৃতীয় বিশ্বের বাম নেতারা। কারণ তাঁরা নিজেরে নিজেদের রাজনীতি নিয়ে নতুন কোনো বোঝাপড়া নির্মাণ করেনি। দেড়শ বছর আগের একটা অ্যাডভান্স আইডিয়ার ফটোকপি মুখস্থ করে গেছে রাজনীতির মাঠে।

উদাহরণ হিসেবে আপনি যেকোনো বামপন্থী দলের পাঠচক্রের পুস্তক তালিকার দিকে নজর দিতে পারেন। দেখবেন অলমোস্ট সবগুলো বই’ই সোভিয়েত প্রগতি প্রকাশনীর। এগুলো দিয়েই এখনও দলগুলো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট রাজনীতির ১০০ বছরেও পাঠচক্রে আলাপ করার মতো তাঁরা নিজেরা কিছু তৈরি করতে পারেনি। অত্যন্ত বেসিক জিনিসের ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলের বামদের ধর্না দিতে হয় বন্ধ্যা আমলাতন্ত্রের হাতে পড়া সোভিয়েতের প্রগতি প্রকাশনীর কাছে।

একটা সময় যেটা অ্যাডোভান্স ইন্টেলেকচুয়াল অ্যাপ্রোচ ছিল, প্রোপার নার্চারের অভাবে অচিরেই সেটা পরিণীত হয়েছে লাইফলেস পিপলদের জীবিকায়। অন্তত বাংলাদেশের বামপন্থী পার্টিজানদের ক্ষেতে তো সেটা অবশ্যই। একসময় যেই আইডিয়ার সাবস্ক্রাইবাররা ছিল সময়ের চেয়ে অ্যাডভান্স, তাঁরা এখন নিজেদের সময়ের থেকেও বহুদূর পিছিয়ে থাকে।

এবং আপনি চাইলে এই মুহূর্তেই বিষয়টা পরখ করে নিতে পারেন। হাতে থাকা সেলফোনটা নিয়ে আপনার নিকটস্থ বামপন্থী দলপ্রধানরে কল করুন। কল করে তাকে জিজ্ঞেস করুন ‘জিপিটি-৪’ আমরা কিভাবে শ্রমিক সংগঠিত করার কাজে লাগাতে পারি? কিংবা তাঁর সাথে এলজিবিটিকিউ++ নিয়ে একটু আলাপ করুন। দেখবেন সেই বেচারা আমতা আমতা শুরু করছেন। এমন আরও অজস্র উদাহরণ দেয়া যায়। এবং সেই অজস্র উদাহরণের সবগুলোই সাম্প্রতিক চিন্তা, কোনো অ্যাডভান্স চিন্তা না। এবং সেইসব সাম্প্রতিক চিন্তা নিয়ে তাঁরা পুরোপুরো ক্লুলেস হয়েও বিপ্লবের ঝাণ্ডা উড়িয়ে যাচ্ছে।

একটা পরিসংখ্যানগত উদাহরণ দেই আপনাদের। ধরুন বিপ্লব টিপ্লব বাদ। এমনিতে বাংলাদেশের বামপন্থীরা যেই রাজনীতি করে, সেটা তো ভালো রাজনীতিই। তবু কেন লোকে তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয় না?
এই প্রশ্ন কোনো বামপন্থী নেতাকে করা হলে তিনি বলবেন- কলকারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেয়া হয়না, অন্য বেসরকারি কর্মীদের চাকরীচ্যুত করা হয় বাম রাজনীতি করলে, ছাত্রাবাস ক্ষমতাসীন দল নিয়ন্ত্রণ করে, ইত্যাদি। যার সবই আসলে সত্য। কিন্তু পার্সিয়াল সত্য। কারণ দেশের অধিকাংশ পেশাজীবীই কোনো প্রথাগত চাকরি করে না। এখনও দেশে মোট গার্মেন্টস শ্রমিকের চেয়ে রিক্সা ও ভ্যান চালকের সংখ্যা বেশি। আরও বেশি ছোটোখাটো দোকানদার ও কৃষি কিংবা মৎস্যজীবীর সংখ্যা। তাঁদের কোনো চাকরি হারানোর ভয় নেই।

এরপরেও যদি বাম নেতাদের ফিকশনাল রিয়েলিটির বয়ান আমলে আমলে নেয়া হয়, তবুও প্রশ্ন থাকে- ভার্চুয়ালিও তাঁদের সমর্থক এতো কম কেন? দেশের সবগুলো বাম দলের পেজে লাইকের সংখ্যা মিলিয়েও তো এক লাখ হবে না। অথচ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি।

তখন হয়তো বাম নেতারা কথা ঘুরিয়ে ফেলতে পারেন। বলতে পারেন, তাঁদের দল কৃষক শ্রমিকের দল। তাই অনলাইনে তাঁরা সরব না। নিশ্চিতভাবে তাঁরা এটা বলবেনই। এবং এজন্যই উপরে কৃষক শ্রমিকদের মাঝেও এঁদের সমর্থনহীনতার উদাহরণ আগেই দিয়ে রেখেছি।

ভার্চুয়ালিও তাঁরা পেছনে থাকার কারণও আসলে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাঁরা বুঝতেই পারেনি যে- ইন্টারনেটও একটা সিরিয়াস বিষয়। সময়ের চেয়েও পেছনে বাস করার এটা একটা ভালো উদাহরণ। এমনকি যখন তাঁরা ইন্টারনেটে এলোই, তখনও সেখানে মানুষকে তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট করার মতো কিছু তুলে ধরতে পারেনি। সেখানেও তাঁরা সময়ের চেয়ে পিছিয়ে থাকার পরিচয় দিয়েছে। এবং মোটাদাগে এটা বলেই দেয়া যায়, যতবার নতুন করে চিন্তা করার মতো কিছু সামনে আসবে, ততবারই তাঁরা নতুন করে পেছনে পড়ে যাবে।

কারণ তাঁদের চিন্তার জৌলুশই ছিল ধার করা চিন্তায়, সেই ধার যেদিন থেকে বন্ধ হয়ে গেছে, সেদিন থেকে তাঁদের জৌলুশ ও লোকসংখ্যা দুটোই কমতে শুরু করেছে। কমতে কমতে চলে এসেছে শূন্যের কোঠায়।

এবং এভাবে চলতে থাকলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিয়মে তা একেবারে শূন্যে চলে আসবেই। যদি না, ট্র্যাডিশনাল বামপন্থী বিপ্লবী দলের ভেতরেই আরেকটা বিপ্লব হয়ে যায়। যদি না সেই একেবারে প্রথমের মতো সময়ের চেয়ে অগ্রগণ্য চিন্তকরা নিজেদের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়ে ধার করা চিন্তার বোঝা থেকে বেরিয়ে আসে।

নয়তো সময়ের চেয়ে অ্যাডভান্স এপ্রোচ নিয়ে যাত্রা শুরু করা কমিউনিজমের মৃত্যু পুঁজিবাদের হাতে নয়, ব্যাকডেটেড কমিউনিস্টদের হাতেই অবরাধিত হয়ে আছে।

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!