ভুমিকা: ক্রিশ্চিয়ান গ্রুবার ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের অধ্যাপক; তাঁর গবেষণার জায়গা হচ্ছে ইসলামি বুক আর্টস, নবী মুহাম্মদের চিত্রকল্প, ইসলাম সম্পর্কিত পাঠ ও চিত্রকল্প। আধুনিক ইসলামি ভিজুয়্যাল সংস্কৃতি, ইরানের বিপ্লব পরবর্তী ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি ইত্যাদি তার আগ্রহের জায়গা। এইসব নিয়ে তাঁর বহু গবেষণা প্রবন্ধ/বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর The Praiseworthy One: The Prophet Muhammad in Islamic Texts and Images গ্রন্থটি।
গ্রুবার The Koran Does Not Forbid Images of the Prophet শিরোনামের আর্টিকেলটি লিখেছিলেন ২০১৫ সালে, নিউজউইকে। ফ্রান্সের শার্লি হেব্দোর ঘটনার পর তিনি আর্টিকেলটি লিখলেও এর প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরিয়ে যায় নি। সেই তাগিদ থেকেই এটি অনুবাদ করা হয়েছে। অনুবাদ করেছেন, শুদ্ধস্বরের অনুবাদ টিম।
শার্লির হেব্দোর প্যারিস অফিসে যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে নবী মোহাম্মদের ইসলামি চিত্রকল্প বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ পন্ডিত হিসেবে আমাকে আহ্বান করা হয়েছিল এটা জানাতে যে, ইসলামে নবী মোহাম্মদের ছবির ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা।
সংক্ষিপ্ত ও সহজ উত্তর হচ্ছে না। কোরআন অঙ্কিত চেহারার ছবি নিষিদ্ধ করে নি। কোরআন বরঞ্চ মূর্তিপূজাকে কঠোর শাস্তি দিয়েছিল, কারণ এগুলোকে বহু ইশ্বরবাদী বিশ্বাসের সুনির্দিষ্ট মূর্ত প্রকাশ হিসেবে দেখা হয়েছিল; ইসলাম সপ্তম শতকে আরবে খাটি একেশ্বরবাদী বিশ্বাস হিসেবে উত্থানের সময়ে এই বহু ইশ্বরবাদের স্থান দখল করেছিল।
উপরন্তু হাদিস সর্বোচ্চ একটি অস্পষ্ট ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে: ঘুরেফিরে আমরা বালিশে আঁকা জীবের ছবি ও অন্যান্য ছবির দেহে শিল্পী প্রাণ সঞ্চারণ করতে পারবেন কি না এমন কথা পড়ে থাকি।
আমরা যদি ইসলামি আইনের দিকে তাকাই, ঐতিহাসিক সংকলনগুলোতে এমন একটা ফতোয়া পাওয়া যায় না যেখানে স্পষ্ট ও সন্দেহাতীতভাবে জীবের ছবি নিষিদ্ধ করেছে, এমনকি নবী মোহাম্মদের ছবিসহ। যদিও নিশ্চিতভাবেই অনলাইন ফতোয়া পাওয়া যাবে, ২০০১ সালের দিকে তালেবানরা এই ধরণের নিষেধাজ্ঞার ফতোয়া অনলাইনে প্রকাশ করে, যেহেতু তারা বামিয়ান বুদ্ধদের ধ্বংস করা শুরু করেছিল।
তাদের ফতোয়াতে তালেবানরা জারি করে যে, সকল অ-ইসলামিক মূর্তি ও মন্দির ধ্বংস করা হবে। তদপুরি এই আধুনিক ফতোয়া খোদ ইসলামের ভেতরকার জীবের ছবি এবং ভাষ্কর্যের বিষয়ে পুরো নিরব থাকে। বিপরীতে, এগুলো উনিশ শতকের মিশরের বিশিষ্ট আইনবিশারদ মুহাম্মদ আবদুহ কর্তৃক দরকারী ও শিক্ষনীয় বলে প্রশংসিত হয়েছিল।
মোদ্দাকথা, প্রাক-আধুনিক ইসলামি পাঠের উৎসগুলোতেও নবীজীর ছবির উপর কোনো নিষেধাজ্ঞার স্পষ্ট ও মজবুত ফলাফল পাওয়া যায় না।

যদিও ইসলামকে প্রধানত অ্যানিকোনিক, অর্থাৎ ছবিকে পরিহার করে এমন বিশ্বাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে, তবু ইসলামিক শৈল্পিক অভিব্যক্তির জন্য, বিশেষত সেকুলার ও ব্যক্তিগত পরিপ্রেক্ষিতে, জীবের ছবি মূখ্য ভূমিকাই পালন করে আসছে। (এবং বর্তমানে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোও বিভিন্ন ধরণের ছবি, পুতুল এবং রেপ্রিজেন্টেশনাল কলাতে ভরপুর।) প্রকৃতপক্ষে, ১৩ শতকের পর থেকে বিভিন্ন মুসলমান পৃষ্ঠপোষকরা মানুষ ও পশুর ছবি যুক্ত সচিত্র পাণ্ডুলিপির অনুমোদন দিয়েছেন।
বিগত সাত শতক ধরে, তুর্কি ও ফারসি দুনিয়াতে (সুন্নি ও শিয়া উভয় ক্ষেত্রেই) নবী মোহাম্মদের চমৎকার চিত্রায়নযুক্ত বহু ঐতিহাসিক ও কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে। এই ছবিগুলো কেবল নবীজীর প্রশংসা ও স্মরণের উদ্দেশ্যেই আঁকা হয় নি, এগুলো মুসলমানদের ধর্মীয় ভক্তিমূলক আচারের উপলক্ষ ও আসবাব হিসেবেও ব্যবহৃত হতো, যেমন নবী মোহাম্মদের জন্মদিন উদযাপন এবং মদিনায় তাঁর মাজার জিয়ারত।
ফলে, এই ভিজ্যুয়াল প্রমাণ স্পষ্টত এই অনুমানকে দুর্বল করে দেয় যে, নবী মোহাম্মদের ছবি ইসলামি আইন ও অনুশীলনে নিষিদ্ধ। যার ফলে, ২০০৫ সাল থেকে এই বিষয়ে যে ক্রমবর্ধমান তর্ক জারি আছে তা নিয়ে মতাদর্শিকভাবে বিভেদসৃষ্টিকারী উপায়ের চেয়ে তথ্য-ভিত্তিক উপায়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

ইসলামি ঐতিহ্যে নবী মোহাম্মদের চিত্রায়ন বা উপস্থাপন বা রেপ্রিজেন্টেশন সময়ে সময়ে বিভিন্ন রকমের হয়েছে, এবং এগুলো বিভিন্ন চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছে। চৌদ্দ শতকের দিকে পারস্যের অনেকগুলো ছবি নবী মোহাম্মদকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত এমন এক নেতা হিসেবে চিত্রিত করেছিল যিনি ফেরশতা ও সাহাবী দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় আছেন (ছবি ১-২)। এই ছবিগুলো নবী মোহাম্মদকে একজন মানবদূত হিসেবে উপস্থাপন করেছিল যার উপর ফেরেশতাদের মাধ্যমে খোদায়ি ওহী নাজিল হয়েছিল, এবং এই ফেরেশতারা তাকে রক্ষা করছিলেন এবং সঙ্গ দিচ্ছিলেন।
অন্যান্য সময়ে, মধ্যযুগের ছবিগুলোতে নবী মুহাম্মদকে অন্যান্য আব্রাহামী নবীদের পাশাপাশি চিত্রিত করা হয়েছে। ষোল শতকের নবীদের জীবনী ও কাহিনী সংক্রান্ত সচিত্র জনপ্রিয় পুস্তকগুলোতে (ক্বিসাস আল আনবিয়া) এমন ছবি ঘুরেফিরে এসেছে। যেমন একটি ছবিতে দেখা যায় নবী মুহাম্মদের সঙ্গী হচ্ছেন ইসা নবী। বলা হয়ে থাকে যে, ইসাইয়াহ দূরদর্শনে এই দুজনকে দেখেছিলেন। (ছবি ৩)।

অন্যান্য কাহিনীতে, বিশেষত যেগুলোতে নবী মোহাম্মদের মেরাজের কাহিনীর সচিত্র বর্ণনা দেয়া হয়েছে, সেখানে দেখা যায়, নবী মোহাম্মদ অন্যান্য আব্রাহামীয় নবীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে জেরুজালেমের গম্বুজের উপর বসে আছেন (ছবি ৪)। মধ্যযুগের এই ছবিগুলোতে – যার কয়েকটি ইরানের একজন সুন্নি শাসক কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছিল- নবী মোহাম্মদের প্রশংসা করা হয়েছিল বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের একজন নেতা হিসেবে, আল্লাহর ওহীর বাহক হিসেবে, এবং একেশ্বরবাদী নবীদের দীর্ঘ ও শ্রদ্ধেয় ধারার একজন বার্তাবাহক হিসেবে।

১৫০০ সালের পর পারস্যের শিয়া এবং অটোম্যনের সুন্নি দুনিয়াতে নবী মোহাম্মদের চিত্রায়নে একটি বড়ধরণের পরিবর্তন ঘটে। নবী মোহাম্মদের মুখের বৈশিষ্ট্যগুলোকে সাদা মুখের ওড়না দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো, এবং পুরো শরীর বিরাট স্বর্ণালী আলোকচ্ছটা দিয়ে পূর্ণ থাকতো; যার মাধ্যমে নবী মোহাম্মদের গায়েবী, অধ্যাত্বিক গুণাবলীর ওপর জোর দেয়া হতো।

যদিও নবী মোহাম্মদের এমন বিমূর্ত চিত্রায়ন নিশ্চিতভাবেই মানবচেহারা পরিহার করার একটি উদীয়মান প্রবণতাকেই দেখাচ্ছিল, তবু এগুলো রুপক অর্থে নবী মোহাম্মদের প্রশংসাই করছিল, যেটি সুন্নি ও শিয়া উভয় জগতেরই সুফি ঐতিহ্যের একটি নির্দেশক। বিশেষভাবে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে নবী মোহাম্মদের জীবনীর ভিত্তিতে ষোল শতকের সুন্নি-অটোম্যানে আঁকা সিরিজ ছবি; যেখানে দেখানো হচ্ছে, নবীজী মক্কার কাবায় প্রবেশকালে খোদ মূর্তিপূজার বিষয়টিকেই মোকাবিলা করছেন। (ছবি ৬)

এই ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে, নবী মোহাম্মদের ছবি আদি-অকৃত্রিম অবস্থায় সংরক্ষিত করা হয়েছে, যদিওবা সোনালী মূর্তি এবং ভূপতিত মূর্তিপূজককে ছবির দর্শকরা মুছে দিয়েছেন। এখানেও নবী মোহাম্মদের চিত্রায়ন খুব একটা সমস্যা না, বরঞ্চ সমস্যা হচ্ছে পৌত্তলিকতা এবং বহু ইশ্বরবাদ, যেগুলো এখানে ভিজুয়ালি অপসারণ করা হয়েছে একটি দৃঢ় একেশ্বরবাদী বিশ্বব্যবস্থার জন্য প্রতীকী পথ তৈরির উদ্দেশ্যে।
যদিও ১৮০০ শতক থেকে নবী মোহাম্মদের ছবি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে, তবু এমন বেশ কিছু আধুনিক ও সমসাময়িক ছবি বিদ্যমান যেগুলো নবী-কেন্দ্রিক চিত্রকর্ম তৈরির একটি অস্থির, ফলে সংহতও নয়, মনোভঙ্গি প্রকাশ করে। যদিও উনিশ ও বিশ শতকে ইরানে নির্মিত নবী মোহাম্মদের‘ব্লেসড আইকন’ নবী মোহাম্মদকে পুরো দেহরূপে এবং স্বর্ণালী আলোকবলয়ের প্রতীকের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছে, তবু সুন্নি ও আরব দুনিয়ায় চিত্রায়নগুলো বহুলাংশে বিমূর্তই রয়ে গিয়েছে এবং তাঁর শারিরীক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পাঠগত উপস্থাপনের পক্ষে স্পষ্ট অগ্রাধিকার দেখিয়েছে। হিলইয়াস নামে পরিচিত এই ‘aniconic’ আইকনগুলো তুরষ্কতে সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) আকারে মুদ্রিত হয়েছে।
সুবহনীয় আইকন হিসেবে এই কার্ডগুলো নবী মোহাম্মদের জন্মতারিখ, জন্মস্থান এবং নবুয়ত প্রাপ্তির তারিখ সম্পর্কে বিশদ তথ্য দেয়া আছে। তাছাড়া এগুলো নবী মোহাম্মদকে তিনটা রূপক দিয়ে চিত্রিত করেছে: গোলাপ (‘নবীজীর গোলাপ’ হিসেবে পরিচিত), তাঁর সিলমোহর (লেখা আছে ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল’), এবং আরবিতে তাঁর নামের ক্যালিগ্রাফি।
নবী মোহাম্মদের সমসাময়িক এই পরিচয়পত্র এমন অনেকগুলো বিষয় তুলে ধরে যেগুলো আজ বিশেষ উদ্বেগের। প্রথমত, গত সপ্তাহে তুরষ্কে নবীজীর জন্মদিন উদযাপনের অনুষ্ঠানে [ল্যামিনেটেড] হিলিয়াস আমন্ত্রণপত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ঠিক একই সময়ে আইএসআইএস ইরাজে নবী মোহাম্মদের জন্মদিন উদযাপন দমন করেছে। সম্প্রতি একটা দলিল জানাচ্ছে যে, সৌদি আরব মদিনায় অবস্থিত কবর হতে নবী মোহাম্মদেরঅবশিষ্টাংশ তুলে ফেলার চিন্তা করছে, সম্ভবত জিয়ারত রোধ করার উদ্দেশ্যে।
সামগ্রিকভাবে এই ছবি, স্থান এবং উদযাপনে একটি সাধারণ বিষয় রয়েছে; সেটা হচ্ছে, নবী মোহাম্মদের প্রতি বিভিন্ন আকারের যে গভীর অনুরক্তি বা ধার্মিকতার প্রকাশ রয়েছে চরমপন্থী ও সালাফিদের থেকে উদ্ভুত ডিসকোর্সগুলোর তা মুছে ফেলার প্রবণতা। এই ডিসকোর্স, যা কিনা নিজেদের ‘সহি ইসলাম’ হিসেবে দাবি করে, তা জনপরিসরে বেশ জোরেশোরেই উপস্থিত রয়েছে।
নিয়মাত্মক হিসাবে তুলে ধরার মাধ্যমে এবং একইভাবে একটি সাধারণ ঐক্যমত্য চিত্রায়নের মাধ্যমে তারা নবী মোহাম্মদের ছবিগুলোকে এমন কিছু বস্তুতে পরিণত করেছে যা নীতিগতভাবে যেন থাকার কথা না। অন্তত এটা বলা যায় যে, এখানে তত্ত্ব এবং চর্চা, পাশপাশি তথ্য এবং বিশ্বাস, একধরণের অদ্ভুত অবস্থানে নিজেদের হাজির করেছে।
যখন কেউ ইসলামে নবী মোহাম্মদের ছবিগুলোর ‘নিষেধাজ্ঞা’ বিষয়ে কথা বলেন, তখন এর অনেকগুলো নেতিবাচক ফল আছে। প্রথম, এই বিষয়ে শুরুতেই সকল গঠনমূলক আলাপ-আলোচনার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে আজকের মেরুকৃত বয়ান থেকে মুক্ত হয়ে ঐতিহাসিক ইসলামি ছবিগুলোর সূক্ষ ও অরাজনৈতিক আলাপের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়। পাশপাশি, এই ছবিগুলো নিয়ে কথা বলা বা আঁকাকে যদি ফলদায়ক এবং পুনর্গঠনমূলক হিসাবে না দেখে কেবল নাশকতামূলক হিসেবে দেখা হয়, তাহলে এই ছবিগুলো শৈল্পিক ঐতিহ্যের রূপ হিসেবে কার্যত আরো বিপন্ন হয়ে পড়বে।
এবং নিজেদেরকেই আমাদের আরেকটা প্রশ্ন করা উচিত: অশোভন কার্টুনগুলো না দেখে আমরা কেন সুন্দর ছবিগুলো দেখে চোখের প্রশান্তি আনয়নেরমাধ্যমে এই বৈশ্বিক শৈল্পিক উত্তরাধিকারকে উদযাপন করতে পারছি না? এটি করার মাধ্যমে ছবিগুলো আমাদের অন্তত কিছুটা হলেও এই চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে যে, ধর্ম, মতদার্শ নির্বিশেষে এই সবকিছুই দৃশ্যমান মানবজাতি হিসেবে আমাদেরকে সংযুক্ত করেছে।
More Posts From this Author:
- None Found