The inner meaning of history […] involves […] an attempt to get to the truth, subtle explanation of the causes and origins of existing things, and deep knowledge of the how and why of events.
— Ibn-Khaldun
________________________________________________________________________________
Paraphrasing the historian, Mr. Reagan said Ibn Khaldun postulated that ”in the beginning of the dynasty, great tax revenues were gained from small assessments,” and that ”at the end of the dynasty, small tax revenues were gained from large assessments.”
– ‘Regan Cites Islamic Scholar’, New York Times, Oct. 2, 1981
দুটো উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি; একটি খোদ ইবনে খালদুনেরই, অন্যটি পত্রিকার বরাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের। ১৯৮১ সালে রিগান সাহেব ‘সাপ্লাই সাইড ইকনমিক্স’- এর তত্ত্ব উপস্থাপনকালে ইবনে খালদুনকে কেবল স্মরণই করেন নি, বরং তার তত্ত্বের স্বপক্ষেও খালদুনকে হাজির করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের শিরোনাম, ‘রিগান ইসলামিক পণ্ডিতকে উদ্ধৃত করেছেন’, দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে পশ্চিমা মিডিয়া খুব গুরুত্বসহকারে খালদুনকে উদ্ধৃত করার ঘটনাটা প্রকাশ করেছিল। আবার, প্রথমেই খালদুনের যে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে সেটার ব্যবহার আমরা বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও গবেষক নুরুল কবীরের সাম্প্রতিক (২০২০)[1] বইতে দেখতে পাই। তিনি ইবনে খালদুনের এই উদ্ধৃতি ও হাওয়ার্ড জিনের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে উনষত্ত্বরের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস লেখা শুরু করেন। পাঠকমাত্রই খেয়াল করবেন, রিগান সাহেবের নিওলিবারেলিজম বা নয়া-উদারনীতিবাদের অন্যতম হুজুর হিসাবে খ্যাতি রয়েছে, অন্যদিকে নুরুল কবীর বামপন্থি ও এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচত। কিন্তু, বিপরীতধর্মী দুজন ব্যক্তিত্ব ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তাদের গবেষণা ও তত্ত্বের শুরুতেই নাম নিচ্ছেন একই ব্যক্তির; আবার একজন নিচ্ছেন অর্থনীতির সাথে জড়িয়ে, অন্যজন নিচ্ছেন ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে। ইবনে খালদুনের চিন্তা, কাজ ও প্রভাবের বিচিত্র গতিপথ সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ এতেই পাওয়া যায়। একজন খালদুন বিশেষজ্ঞ তো বলেই ফেলেন, ইবনে খালদুন যে একেকজনের কাছে একেকরকম ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হন এটা আসলে যেমন তাঁর মহত্বের পরিমাপক, তেমনি তাঁর দ্ব্যর্থতা বা অস্পষ্টতারও পরিমাপক।
সম্প্রতি (২০১৮) রবার্ট আরউইনের ‘ইবনে খালদুন: অ্যান ইন্টেলেকচুয়াল বায়োগ্রাফি’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।[2] আরউইন এই গ্রন্থে ইবনে খালদুনকে তাঁর স্থান ও কালের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। চৌদ্দ শতকের মহামারীতে আত্মীয়-স্বজন-পরিবার-পরিজন হারিয়ে এক ধ্বংস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কীভাবে ইবনে খালদুন উত্তর আফ্রিকার সেই আমলের ক্ষমতার লড়াইয়ের একজন ক্রিড়ানকে পরিণত হচ্ছেন তা খুব স্পষ্ট করে আরউইন তুলে ধরেছেন। আরউইন একজন প্রাচ্যবাদীও বটে, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এডওয়ার্ড সাইদের ‘অরিয়েন্টালিজম’ এর কড়া সমালোচনাও করে থাকেন। তার বইতেও সেই দৃষ্টভঙ্গির দেখা মিলে। উল্লেখ্য, আমার এই গ্রন্থ অনুবাদের তওফিক হয়েছে, কিছুদিন পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধটি মূলত আরউইনের সেই বইয়ের একটা নির্দিষ্ট অধ্যায়ের উপর ভর করেই রচিত; ফলে তথ্যাদির সিংহভাগই এই বই থেকে গৃহীত। তবে, কিছু কিছু স্থানে লেখকের [আরউইন] সাথে দ্বিমতে বা তর্কে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। লেখার উদ্দেশ্য, পশ্চিমা জগতে ইবনে খালদুনের যে চর্চা হয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পেশ করা। অনূদিত গ্রন্থের ‘বিজ্ঞাপন’ দেয়ার খায়েশও যে একেবারেই নেই তা অস্বীকার করা যায় না।
২
বিভিন্ন কারণেই ইবনে খালদুন ব্যাপক চর্চিত হয়েছেন; তাকে নিয়ে কাজ সংখ্যায় যেমন প্রচুর, তেমনি ধরনে বৈচিত্রময়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনের মামলুক গ্রন্থপঞ্জিতে মাঘরিবি ও আন্দালুসিয়ান জিনিসপাতি ছাড়াই ইবনে খালদুনের সম্পর্কে ৮৫৪টি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ তালিকাভুক্ত রয়েছে। প্রাচ্যবাদী চর্চার সাথে ইবনে খালদুনের নাম এতো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে রবার্ট আরউইন তার বইয়ের ভূমিকায় মন্তব্য করেন, কেউ যদি উনিশ শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইউরোপের জ্ঞানজগতে কেবল খালদুনের উপর জিনিসপাতি তালাশ করেন, তাহলে তিনি অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদের অর্ধক ইতিহাসই জেনে যাবেন। ইবনে খালদুন প্রাচ্যবাদের আবিষ্কার কি না এই নিয়েও বহু আলাপ-আলোচনা বিদ্যমান।
১৫৫০ সালে মরক্কোর পণ্ডিত লিও আফ্রিকেনাস ইতালীয় ভাষায় প্রকাশিত তাঁর ‘ডেস্ক্রিপশন অফ আফ্রিকা’ গ্রন্থে ইবনে খালদুনকে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি দস্যু কর্তৃক বন্দী হয়ে ইতালিতে যাওয়ার পর সেখানে পশ্চিমা জগতের সাথে খালদুনকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার একটা প্রয়াস নিয়েছিলেন। তবে, খালদুনের প্রথম দিককার আন্তরিক প্রশংসাকারীদের অটোম্যান তুর্কিদের মধ্যে পাওয়া যায়। ১৫১৭ সালে সেলিমের মামলুক মিসর বিজয়ের পর ইস্তাম্বুলে লুট করে নিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির মধ্যে মুকাদ্দিমাও ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল এবং সর্বত্র বিজয় লাভ করছিল। এক শতক পরেই তুর্কি বিদ্বৎসমাজের মধ্যে তাদের শাসনের অনন্তকাল বা নিত্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতে শুরু করে। তুর্কি অনেক বুদ্ধিজীবী তখন খালদুনিয়ান চক্রাকার ইতিহাসতত্ত্ব অনুসরণ করে বলেছিলেন যে, সাম্রাজ্যের পতনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ইবনে খালদুনের তত্ত্ব যেখানে দেখিয়েছিল তিন-চার প্রজন্মের পর সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী, সেখানে তুর্কিরা অবশ্য আশা করতেন, তাদের সাম্রাজ্যের পতন রোধ করা সম্ভব। ১৭৪৯ সালে শায়েখ আল ইসলাম পিরিযাদে মেহমেদ এফেন্দি মুকাদ্দিমার প্রথম পাঁচটি অধ্যায় তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। ১৮০৫-১৮৪৮ সালের মিসরের শাসক মুহাম্মদ আলী ইবনে খালদুন পড়েছিলেন এবং তুর্কি ভাষায় পুনরায় অনুবাদ করিয়েছিলেন। রবার্ট আরউইন জানান, মোহাম্মদ আলীর শাসনকার্য পরিচালনপদ্ধতি গঠনে ম্যাকেয়াভেলির লেখাপত্র ও নেপোলিয়নের অভিযানের বিবরণের সাথে ইবনে খালদুনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার ভূমিকা থাকতে পারে।
ইবনে আরাবশাহের ‘ফি আক্কবার তৈয়মুর ইয়াজাইব আল মক্কদুর’ গ্রন্থের লাতিন অনুবাদে ইবনে খালদুনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, এবং সেটাও ১৬৩৬ সালে। কেউ কেউ এটাকে ইউরোপে খালদুনের প্রথম আবির্ভাব হিসাবে দেখেন।[3] সতের শতকের একেবারে শেষ প্রান্তে বাখথেলেমি দি’হারবোলট এর Bibliothèque orientale গ্রন্থেও খালদুনের খুব সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি দেখা যায়। তবে, পশ্চিমা দুনিয়ায়, উনিশ শতকের শুরুর দিকে, মুকাদ্দিমা সঠিকভাবে আবিষ্কৃত ও প্রচারিত হয়েছিল মূলত দুইজন বিখ্যাত প্রাচ্যবাদীর দ্বারা: এন্থোনি আইজ্যক সিলভেস্ট্রে দে স্যাসি এবং জোসেফ ভন হ্যামার-পার্গস্টাল। সিলভেস্ট্রে দে স্যাসি ফরাসি ভাষায় খালদুনের কিছু কাজ হাজির করেন ১৮১০ সালে, পার্গস্টাল মুকাদ্দিমার নির্বাচিত অংশ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন ১৮১৮ সালে। জোসেফ ভন হ্যামার পার্গস্টাল ছিলেন অস্ট্রিয়ান; তিনি তার এক গ্রন্থে ইবনে খালদুনকে ‘আরব মঁতেসকিয়্যু’ বলে উপাধি দেন। চার্লস দ্য মঁতেসকিয়্যু (১৬৮৯-১৭৫৫) অষ্টাদশ শতকের ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। ইবনে খালদুনের এই উপাধি পরবর্তীতে আরো বহুজনের হাত ধরে সম্প্রসারিত হয়েছিল। মিসরি পণ্ডিত আল-তাহতাউয়ি (রসিকতা করেই বোধহয়) বলেছিলেন, ‘ফরাসিদের মধ্যে মঁতেসকিয়্যুকে বলা হয় ইউরোপের ইবনে খালদুন, অন্যদিকে ইবনে খালদুনকে বলা হয় পূর্বদিকের মঁতেসকিয়্যু বা ইসলামের মঁতেসকিয়্যু’।
৩
দীর্ঘদিন ধরে ইবনে খালদুনের উপর বেশিরভাগ কাজ ফরাসিরাই করেছিলেন, তার কারণও স্পষ্ট : উপনিবেশায়ন। উপনিবেশকরা কেবল জায়গাই দখল করে না, বরং শাসনকার্যের নিমিত্তে উপনিবেশিত অঞ্চল ও অধিবাসীদের সম্পর্কে তাকে জানতে হয়। সেই উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ফ্রান্সে ইবনে খালদুনকে চর্চার প্রায় একটা হিড়িক পড়েছিল। আরব ও বার্বারদের সম্পর্কে জানতে তারা দ্বারস্থ হন ইবনে খালদুনের কাছে, কিন্তু আমরা একটু পরেই দেখতে পাব, কীভাবে অনুবাদ প্রক্রিয়ার হাত ধরে ইবনে খালদুনের বয়ানকে ফরাসি উপনিবেশকরা নিজেদের ঔপনিবেশিক বায়নের মধ্যে আত্তীকৃত করেছিলেন।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, এন্থোনি আইজ্যাক সিলভেস্ট্রি দ্য স্যাসি প্রথম ফরাসি ভাষায় মুকাদ্দিমার কিছু অংশ অনুবাদ করেন। তিনি স্পেসিয়াল স্কুল ফর অরিইয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ এর অধ্যাপক ছিলেন; এই প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কূটনীতিকে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (১৭৯৫ সালে)। পরবর্তী প্রাচ্যাবাদীদের উপর তার ব্যাপক প্রভাবও ছিল। সিলভেস্ট্রির শিষ্য ও উত্তরসূরীরা ইবনে খালদুনকে ইউরোপের বিদ্বত জগতের মানচিত্রে স্থান দেয়ার কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। দ্য স্যাসির উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন এথিয়েন-মার্ক কোয়াত্রেমরা; কোয়াত্রেমরার মৃত্যুর পর ১৮৫৮ সালে তাঁর তিন খণ্ডে সম্পাদিত মুকাদ্দিমা প্রকাশিত হয়েছিল, অংশধোধিত অবস্থায় এবং কোনো ভূমিকা ছাড়াই। মরণোত্তরে প্রকাশিত এই সংস্করণে অনেক ছাপার ভুল ছিল এবং কেউ কেউ সমালোচনা করে বলেছেন, কোয়াত্রেমরা এর সংস্করণে বার্ধক্যের ছাপ রয়েছে, বা এটি বার্ধ্যকের ফসল।
স্যাসির আরেক শিষ্য উইলিয়াম ম্যাকগুকিন দ্য স্লেইন বেলফাস্টে জন্মগ্রহণ করলেও প্যারিসেই বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মজীবন পার করেছিলেন। ১৮৪০ সালে ফরাসি প্রশাসন ও সেনাবাহিনী তাঁকে আলজেরিয়াতে বিভিন্ন মিশনে নিযুক্ত করে। তিনি ফরাসি যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ও অর্থায়নে ‘Ibar as Histoire des Berbères et des Arabes’ অনুবাদ করেন। রবার্ট আরউইন যে সাইদের ‘অরিয়েন্টালিজম’ তত্ত্বের সমালোচক সেটা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে; ফলে এটা খুব স্বাভাবিক, তিনি স্লেইন সম্পর্কিত এই তথ্য আমাদের সামনে হাজির করলেও এর ‘ঔপনিবেশিক’ খাসলত সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু ইবনে খালদুন সম্পর্কিত ফরাসি চর্চার ঔপনিবেশিক খাসলত নিয়ে বহু আলাপ রয়েছে। স্লেইনের অনুবাদ কীভাবে ‘কলোনিয়াল ইমাজিনারি’ তৈরি করেছিল সেটা দূর্দান্তভাবে দেখিয়েছেন আবদেলমাজিদ।[4] স্লেইন কর্তৃক অনূদিত গ্রন্থটিই আসলে উত্তর আফ্রিকা সম্পর্কিত ফরাসি ঐতিহাসিক জ্ঞানের ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছিল। জ্ঞানের সাথে ক্ষমতার সম্পর্কের বিষয়ে আমরা অবহিত রয়েছি। উপনিবেশের হাতে ‘অনুবাদ’ কেবল এক ভাষা থেকে আরেক ভাষাতে রূপান্তরের বিষয়ের মধ্যেই আটকে থাকে না, তা উপনিবেশের বয়ান তৈরির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসাবে হাজির থাকে। পাশাপাশি, উপনিবেশায়ন কেবল জ্ঞান তৈরি-ই করে না, বরঞ্চ সে জ্ঞানকে এতো বিস্তৃতভাবে আরোপ করে যে, উপনিবেশক চলে যাওয়ার পরও সেই জ্ঞান উপনিবেশিতের মনের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকে।
স্লেইন যখন অনুবাদ করেন, তখন আসলে তিনি চৌদ্দ শতকের চিন্তা ও ‘টার্মিনলোজি’কে তার জমানার চিন্তা ও অর্থের সাথে মিলিয়ে অনুবাদ করেছেন। আবেদলমাজিদের প্রবন্ধ থেকে একটা উদাহরণ টানা যেতে পারে। স্লেইন যে শব্দের অর্থ হিসাবে ‘রেস’ এবং ‘নেশন’ করছেন সেগুলো হচ্ছে যিল (jil), উম্মা (umma), এবং তাবাকা (tabaqa)। উনিশ শতকে ফ্রান্স তথা ইউরোপে ‘রেস’ এর যে সংজ্ঞা চালু ছিল সেটা এরকম: দুনিয়া বিভিন্ন অসম ‘রেস’ দ্বারা ভরপুর, এবং এই ‘রেস’গুলো মূলত শত্রুভাবাপন্ন। ‘রেস’কে তখন সহজাত ও স্থায়ী মনস্তাত্ত্বিক, শরিরীক ও বুদ্ধিবৃত্তি গুণ হিসাবে ধরে নেয়া হতো। সব হিসাব নিকাশে আর্যরাই গড়নে-গঠনে সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ, এবং ‘সভ্যতা’ বা সিভিলাইজেশন তৈরিতে এরা সবচেয়ে কার্যকর। সভ্যতাকে ‘রেস’ এর ফসল হিসাবেই দেখা হতো। কিন্তু ইবনে খালদুন যখন ‘যিল’ ব্যবহার করেন তখন এর ভিন্ন অর্থ থাকে। এটা কখনো কোনো একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠির একটা প্রজন্ম হিসাবেও অর্থ প্রকাশ করে থাকে, আবার কখনো মানব বিকাশের কোনো একটা পর্যায় হিসাবেও অর্থ প্রকাশ করে থাকে। ইবনে খালদুন ‘যিল’ দিয়ে এমন কিছু বৈশিষ্ট বোঝান যেগুলো, তার মতে, জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। যেমন কোনো একটা গোষ্ঠীর শরীরের রঙ। আবার, কখনো এটাকে কোনো একটা গোষ্ঠীর সংস্কৃতি দ্বারা সংজ্ঞায়িত করেন, যা কিনা গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফসল হিসাবে তিনি দেখতেন। এরকম অনেকগুলো টার্মিনোলজির অর্থগত পার্থক্য নির্দেশ করে আবদেলমাজিদ বলেন,
“One can see that there in neigher ‘progress’, nor ‘degeneration’, nor ‘racial hierarcy’ in Ibn Khaldun. His historical narrative is regulate by other categories such jil, asabiya, nasab and hasab. In some ways historical events reproduce themselves in the same way: tribes become dynasties due to asabiya and religion; they decline after they reach their peak, only to be replace by another tribe that follows the same pattern of rise and fall.”
ফলে দেখা যাচ্ছে, ইবনে খালদুনের ইতিহাস বয়ানে ‘বর্ণবাদী মতাদর্শ’ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যেটা স্লেইনের অনুবাদে প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল। স্লেইনের এই বয়ান আরব ও বার্বারকে আলাদা করতে এবং তাদের মধ্যে বিরোধাত্মক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যাপক সাহায্য করেছিল। দুনিয়ার যত জায়গায় উপনিবেশ কায়েম করা হয়েছে তত জায়গাতেই স্থানীয়দের মধ্যে এরূপ ‘ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি’ প্রয়োগ করা হয়েছে। এই পলিসি প্রয়োগের পূর্বে আসলে বিভাজনটাকে জ্ঞানজগতে হাজির করতে হয়। পরবর্তীতে যখন এমিল ফিলিক্স গুতিয়ের আরব ও বার্বারদের মধ্যকার শতবছরের পুরনো ‘সংঘাতে’র চিত্রায়ন করেন তখন তার স্বপক্ষের যুক্তি হিসাবে স্লেইনের অনুবাদকে হাজির করেন। গুতিয়ের ও তাঁর পরবর্তী অসংখ্য পণ্ডিতদের লক্ষ্য ছিল ইবনে খালদুনের শরীর থেকে মধ্যযুগের আরব পরিচয় মুছে ফেলে আধুনিক ফরাসি বাস্তবতায় আবিষ্কার করা যার কাছ থেকে হয়তোবা উত্তর আফ্রিকায় ফরাসি সাম্রাজ্যের বৈধতা পাওয়া যেতে পারে!
ইবনে খালদুনকে চর্চার উপনিবেশবাদী মনোভঙ্গির আরেকটা পরিচয় পাওয়া যায় ইবনে খালদুন সম্পর্কিত পশ্চিমা ধ্যান-ধারণায়। যদিও সমাজবিজ্ঞানে ধরে নেয়া হয় যে, এমনকি ‘জিনিয়াস’ও ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার ফসল, কিন্তু ইবনে খালদুনের বেলায় বলা হয় তিনি তার সময়ের ‘একা’ এবং ‘ব্যতিক্রম’। তিনি আধুনিক, কারণ ‘ইউরোপীয় যুক্তির ধারা’ তার লেখাতে পাওয়া যায়, কিন্তু, তার স্থান-কাল অনাধুনিক। যেমন অস্ট্রিয়ান আরববাদী আলফ্রেড ভন ক্রেমার মনে করতেন, ইবনে খালদুন ছিলেন আরব দুনিয়ায় ‘অনন্য’, কোনো পূর্বসূরী নেই এবং পুরোদমে মৌলিক। তিনি তাঁর সময়ের পূর্বেই জন্মেছিলেন। আবার, ইতিবাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি মনে করতেন, খালদুন এমন এক সভ্যতার ইতিহাসে এমন এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন যার সামাজিক জীবন সামগ্রিকভাবে ‘নির্জন, দরিদ্র, নিষ্ঠুর এবং সংক্ষিপ্ত’ ছিল। ফলে খালদুন একাধারে ‘আলোকিত’ এবং অন্ধকার। তাকে তাঁর নিজ অঞ্চলের জনগণ ভুলে গিয়েছিল, তার চিন্তাকে কদর করতে পারেনি, ফলে তাকে আবিষ্কারের মূল কৃতিত্ব ‘ইউরোপ’ এর। এই বয়ান যেমন ইবনে খালদুনকে চিনতে আরব ও ইসলামি ঐতিহ্যের অক্ষমতা তুলে ধরে, তেমনি ইবনে খালদুন বিষয়ে ফরাসি বয়ানের বৈধতা ও কর্তৃত্ব হাজির করেছিল।
বিংশ শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকের দিকে আলজেরিয়াতে যখন উপনিবেশবিরোধী মুক্তিসংগ্রাম চলছে তখন লুইস ম্যাসিগনন, ইভেস লাকোস্তে এবং ম্যক্সিম রোডিনসন সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আরববাদী আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। ভিনসেন্ট মন্টেইল (১৯১৩-২০০৫)ও এই দলে ছিলেন, তিনি মুকাদ্দিমা পুনরায় অনুবাদ করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যের রাজধানীতে ফরাসি দূতাবাসে কাজ করেছেন। ১৯৫৫ সালে তিনি আলজিয়ার্সে Jacques Soustelle এর মন্ত্রীসভার সদস্য হয়েছিলেন, যেখানে তাঁকে সুকৌশলে বিদ্রোহী ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (এফএলএন) মতামত যাচাইয়ের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই ফরাসিদের নির্যাতনের প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন। আলজেরিয়ার বিদ্রোহীদের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক তৈরি করেন, এবং সেনাবাহিনী ত্যাগও করেন। মন্টেইল পরবর্তীতে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রাম ও ইরানি বিপ্লবকে সমর্থন করেছিলেন। মন্টেইল যখন মুকাদ্দিমা অনুবাদ করেন তখন ভূমিকাতে ইবনে খালদুনকে কেবল ম্যাকিয়াভেলির অগ্রদূত হিসেবেই তুলে ধরে নি, বরঞ্চ ফরাসি আলোকায়ন চিন্তারও অগ্রদূত হিসেবে তুলে ধরেছিল। পাশাপাশি এও বলেন যে, ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভাবক ছিলেন, এবং ডারউইনের তত্ত্বের বিষয়েও আন্দাজ করেছিলেন।
ইবনে খালদুনের উপনিবেশবাদী পাঠের প্রচণ্ড সমালোচনা এসেছিল ইভস লাকোস্তে এর তরফ থেকে। তিনি মার্ক্সবাদী ছিলেন এবং উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের সমথক ছিলেন। লাকোস্তে মুকাদ্দিমার একটি মার্ক্সবাদী সংস্করণ তুলে ধরেন, এবং দাবি করেন যে, এটি ১৯৬০ এর দশকের আরব দেশগুলোর জন্য প্রাসঙ্গিক ছিল। লাকোস্তে ফরাসি উপনিবেশবাদী ও তাঁদের একাডেমিক দোসরদের ‘কাল্পনিক ইবনে খালদুন’ নির্মাণের সমালোচনা করেন। লাকোস্তে যুক্তি দেখান যে, হিলালি হিজরত মূলত নির্বাসন ছিল, বহিরাক্রমণ নয়। তিনি ইবনে খালদুনকে দেখেছেন একজন বস্তুবাদী হিসেবে এবং একজন অসম্পূর্ণ মার্ক্সবাদী হিসেবে, যাকে মধ্যযুগীয় মাঘরেবের উৎপাদন ব্যবস্থা বা উৎপাদনের ধরণ জানার গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বার্বার ও আরবদের মধ্যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব উপস্থাপনের ঔপনিবেশিক রাজনীতির দিকে আলোকপাত করে বলেন,
‘In terms of colonial ideology, the theory that the Barbary States were conquered by the Arabs was important for two reasons. Firstly, it meant that the French were merely the latest to conquer a land which had always been conquered and which, it was hoped, would always remain so. Secondly, it provided a historical basis for a policy of turning Arabs and Berbers against each other.’[5]
লাকোস্তে মনে করতেন, ইবনে খালদুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের একটি বস্তুবাদী বিশ্লেষণের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিলেন। তাঁর গবেষণার লক্ষ্য ছিল উপনিবেশবাদী ও প্রাচ্যবাদী পণ্ডিত কর্তৃক আরোপিত অতীত থেকে মাঘরবেকে মুক্তি দেয়া। কিন্তু, লাকোস্তের সমালোচনা করে রবার্ট আরউইন বলেন, চতুর্দশ শতকের মাঘরবকে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ হিসেবে উপস্থাপন করাটা তর্কসাপেক্ষ।
একাডেমিয়ার জগতের অনেকেই দাবি করেছিলেন, খালদুন প্রাচ্যবাদের ফসল ছিলেন, এবং তাঁর প্রতি প্রাচ্যবাদীদের যে আগ্রহ ছিল তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে কতটা মূল্যায়ন করা যাবে সেটাও নিশ্চিত না। অবশ্যই, উপনিবেশিত জনগণের ইতিহাস-আচার-আচরণ জানা ও শাসন উপযুক্ত নয়া বয়ান তৈরির জন্য উপনিবেশকের যে তাগিদ তাতে ইবনে খালদুন ও তাঁর টেক্সট খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হাজির করেছিল। কেউ কেউ এমন দাবিও করেছেন, ইসলামি রাজনীতি ও চিন্তা পদ্ধতির প্রতি ইবনে খালদুনের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিই পশ্চিমা পণ্ডিতদের আকৃষ্ট করেছিল। তবে, খালদুন চর্চায় উপনিবেশবাদ ও প্রাচ্যবাদের এই রাজনীতিকে খুব একটা আমলে নেননি রবার্ট আরউইন, নিলেও সেটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চান নি। উপনিবেশ কায়েমে প্রাচ্যবাদ যে বুদ্ধিবৃত্তিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল, এই দাবিকে তিনি ‘অতিসরলীকরণ’ ও ‘অতিরঞ্জিত’ বলে মনে করেন। তিনি বলেন যে, সবাই উপনিবেশায়নের নিয়তে খালদুন চর্চা করেন নি। একেককজনের একেক উদ্দেশ্য ছিল। কোনো কোনো পণ্ডিতের রাজনীতির চেয়ে ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় বেশি ছিল। মিশনারি হিসাবে তারা কাজ করতে চাইতেন, ফলে তারা যুক্তিখণ্ডনের জন্য কোরআন ও তাফসির অনুবাদও করতেন। যেমন, কোয়াত্রেমরা ছিলেন ধার্মিক পণ্ডিত, ফরাসি সাম্রাজ্যে তাঁর খুব অল্পই আগ্রহ ছিল। কিন্তু রবার্ট আরউইন একটা বিষয় আমলে নেননি। দুনিয়াজুড়ে ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়ায় ধর্মপ্রচারকদের একটা ভূমিকা ছিল। প্রভাত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ইউরোপীয়রা ধনজয়ের লোভে বণিক-বেশে ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াময়। তাদের পথ ধরে এসেছিল গোঁসাই পাদরিরা – তাদের পিছু পিছু আসে সৈনিক। ধার্মিকের সামনে ধনিকের মার্চেন্টম্যান জাহাজ, পেছনে রাজার সৈন্য ও ম্যান অব ওয়ার। আলবেয়ার মেমিও অনেকটা একইভাবে বলেছিলেন, গির্জা কলোনিয়ালিস্টদের দারুণ সাহায্য করেছিল।[6]
রবার্ট আরউইন স্বীকার করেন, ইবনে খালদুনের লেখালেখি অনুবাদ করার জন্য দ্য স্লেইনকে ফরাসি যুদ্ধমন্ত্রণলায় থেকে অর্থায়ন করা হয়েছিল। এবং গুয়েতার ও অন্যান্য ফরাসি পণ্ডিতেরা খালদুনকে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত করে আরব অভিযানকে ভুলভাবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তবু তিনি মানতে নারাজ যে, খালদুন-চর্চা কোনো এক নির্দিষ্ট উপনিবেশবাদী এজেন্ডা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। কিন্তু, আমরা পূর্বেই দেখিয়েছি, আসলে এটা উপনিবেশবাদী এজেন্ডার সহায়কই ছিল।
৪
উপনিবেশায়নের কারণে ফ্রান্সে যে তরিকায় খালদুন ব্যবহৃত হয়েছেন সেভাবে জার্মান, ইংল্যান্ড বা আমেরিকাতে ঘটেনি; কিন্তু ফরাসী ভাষাতেই খালদুন বেশ আগ থেকে এবং ব্যাপকভাবে চর্চিত হওয়ার কারণে বাদবাকীরাও ফরাসী পাঠ দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত ছিলেন। পোলিশ সমাজবিজ্ঞানী লুডভিগ গুমপ্লোভিচ এবং জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্জ অপেনহেইমার খালদুনকে সমাজতাত্ত্বিক হিসাবে পাঠ করেছিলেন। বহু পশ্চিমা পণ্ডিতই খালদুনকে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী আর্নেস্ট গেলনার মুকাদ্দিমায় প্রস্তাবিত তাত্ত্বিক মডেলের সাথে বিভিন্ন পশ্চিমা দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীর চিন্তার যোগসূত্র তৈরি করেন, এর মাধ্যমে সেই মডেলের ইউরোপীয়করণ এবং সেকুলারকরণ করা হয়। তিনি ইবনে খালদুনের তত্ত্বগুলোর সাথে প্লাটো ও ডেমিড হিউমের তত্ত্বকে মেলানোর চেষ্টা করেন।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি খালদুনের উচ্চকিত প্রশংসা করতেন। রোজেন্থল মুকাদ্দিমা ইংরেজিতে অনুবাদ করার পূর্বে ইংরেজি ভাষাভাষীদের কাছে ইবনে খালদুনকে জনপ্রিয় করার মূল কৃতিত্ব টয়েনবির; জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তিনি প্রচুর কাজও করেছিলেন, পরবর্তীতে যারা তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন হ্যামিল্টন গিব, মার্শাল হজসন, আলবার্ট হউরানি এবং আর্নেস্ট গেলনার। টয়েনবি যখন অ্যা স্টাডি অফ হিস্টোরিতে বিভিন্ন সভ্যতার উত্থান পতনের কারণ তালাশ করছিলেন, তখন তিনি এই সিলসিলার পূর্বসূরীদের খোঁজ করছিলেন, যারা কিনা তাকে তার উচ্চবিলাসী প্রকল্পের বৈধতা দিতে পারেন। খালদুন ও মুকাদ্দিমা খুঁজে পেয়ে টয়েনবি পুলকিত হয়েছিলেন।
মুহসিন মাহদি (১৯২৬-২০০৭) ইবনে খালদুনকে যুক্তিবাদী এবং রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবে তুলে ধরেন। তার মতে, ইবনে খালদুন মূলত গ্রেকো-ইসলামি ঐতিহ্যের একজন দার্শনিক ছিলেন। কিন্তু চতুর্দশ শতকের মাঘরেবে দর্শনের প্রতি বৈরিভাব থাকার কারণে তিনি তাঁর দার্শনিক যুক্তিগুলোকে পরোক্ষভাবে উপস্থাপন করেছেন। মাহদির মতে, ইবনে খালদুন দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা করেছিলেন, এবং তিনি ধর্মতত্ত্ব থেকে দর্শনকে মুক্ত করার জন্য এরিস্টটলীয় পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ইবনে রুশদের মতোই দার্শনিক ছিলেন। যদিও ইভস লাকোস্তে মাহদির এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এবং তিনি এও বলেন যে, ইবনে খালদুন কোনোভাবে কোনোধরণের সংস্কার প্রস্তাব করেননি।
আমেরিকান একাডেমিক অ্যালেন ফ্রমহার্জ খালদুনের চিন্তাভাবনাকে চতুর্দশ শতকের উত্তর আফ্রিকার পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি মনে করেন যে, খালদুন সুফি সুফি ছিলেন, এবং ইতিহাস লিখনে ইবনে খালদুনের একটি সুফিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। [ইতিহাসের] গোপনীয় সত্য ‘উন্মোচন’ এবং ঘটনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অর্থের সন্ধান বিষয়ে ইবনে খালদুনের বর্ণনা সুফিবাদ বা ইসলামি মরমিবাদের সাথে সমান্তরাল। মুর্শিদের হাতে একজন মুরিদের ‘মারা যাওয়া’ এবং তারপর আবারও পুনর্জন্ম করার সাথে খোলা চোখেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার চক্রাকারে বিলোপ ও পুনর্জন্মের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইবনে খালদুন সুফিবাদের মাধ্যমেই ক্ষমতা ও সম্পত্তির নিরর্থকতা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। ফ্রমহার্জের মতে, সুফিবাদই তাঁকে ঐতিহাসিক ঘটনার জাহেরি (বাহ্যিক চেহারা) অবস্থানকে ছাড়িয়ে সেই ঘটনাগুলোর নির্ধারণকারী নিয়মের বাতেনি (অন্তর্নিহিত সত্য) অবস্থানের দিকে নজর দিতে উৎসাহ দিয়েছিল। যদিও রবার্ট আরউইন তার এই যুক্তির সমালোচনা করে বলেন, জাহেরি এবং বাতেনি শব্দের উপর সুফিদের কোনো একচেটিয়া দখল নেই। এগুলোর ব্যবহার খুব সাধারণ ছিল। সুফিরা আসাবিয়া নিয়ে কোনো আলোচনাও করেননি। অনেক ইতিহাসবিদই, যারা সুফি ছিলেন না, তারা ইতিহাসের অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
আবার, রবার্ট আরউইন এটাও বলেন যে, আরবে ইবনে খালদুনকে পুনরাবিষ্কার আসলে উনিশ ও বিশ শতকের গোঁড়ার আরব রেনেসাঁর পটভূমির অংশ, এবং সেই রেনেসার ফসলও বটে। এই সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ বিভিন্নভাবে সেকুলারিজম, জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী পুনর্জাগরণবাদের উপর নির্ভর করে হয়েছিল। যদিও এটি ছিল ইউরোপের উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া, তবু এই রেনেসা পশ্চিমা মূল্যবোধ ও ঘরণার উপর ভর করেই ঘটেছিল।
৫
এই প্রবন্ধে মূলত ইউরোপে খালদুনকে কীভাবে চর্চিত হয়েছে তার একটা ছোটখাটো বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। পাশপাশি সেই চর্চায় কীভাবে উপনিবেশবাদ ও প্রাচ্যবাদ জড়িয়ে আছে তার কিছু নমুনাও তুলে ধরা হয়েছে। দেখা যায়, বিভিন্নজনের হাতে খালদুন বিভিন্ন চেহারায় হাজির হচ্ছেন। কেউ কেউ খালদুনের সেকুলার চিন্তা ও ইতিহাসের আধুনিক ধারণার উপর জোরারোপ করেছেন। আরেক গোষ্ঠী খালদুনকে ইসলামি পরিপ্রেক্ষিতে হাজির করার চেষ্টা করেছেন, সেক্ষেত্রে খালদুনের বিশ্বাস, ফকিহ হিসাবের তার পরিচয়ের উপর জোর দিয়েছেন। আবার আরেকগোষ্ঠী ইবনে খালদুনের উপর প্রাচীন গ্রিক দর্শনের প্রভাবের উপর জোর দিয়েছেন। আরেক দল আবার খালদুনের সাথে ইউরোপীয় চিন্তার ফারাকটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ খালদুনের দিকে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন, আরবের হারানো ঐতিহ্য উদ্ধারে তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রতিটি চিন্তাস্কুলেরই সঙ্কট ও সম্ভাবনা নিয়েও আলাপ বিদ্যমান।[7] আবার, বর্তমান সময়ে কেউ কেউ সমাজবিজ্ঞানের ইউরোসেন্ট্রিক ধারার সঙ্কট চিহ্নিত করে এর বিপরীতে সমাজবিজ্ঞানের খালদুনিয়ান ধারা তৈরির প্রস্তাবও করেন।[8]রাজনৈতিক বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, দার্শনিক, এথনোলজিস্ট এবং অর্থনীতিবিদ সবার মধ্যেই তারা যা চর্চা করেন তার বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্বসূরী বা পূর্বপুরুষ খোঁজার তাগিদ লক্ষ্য করা যায়। রবার্ট আরউইন এটাকে ‘পূর্বপুরুষ পূজা’ হিসাবে চিহ্নিত করছেন, একে ‘বিপজ্জনক’ বলছেন। তবে, রবার্ট আরউইন ‘ইবনে খালদুন: অ্যান ইন্টেলেকচুয়াল বায়োগ্রাফি’তে খালদুনের মুসলমানিত্বকে একটু বেশি জোর দিয়েছেন, এবং চতুর্দশ শতকের একজন কঠোর মুসলামান লেখকের প্রতি আধুনিক পশ্চিমা খ্রিষ্টান বা সেকুলার চিন্তকদের এমন আগ্রহের কারণে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
তথ্যনির্দেশ :
[1] Nurul Kabir, (2020), Deposing of a Dictator: Revisiting a Magnificent Mass Uprising After 50 Years, Samhati Prokashan
[2] Robert Irwin,(2018), Ibn Khaldun: An Intellectual Biography, Princeton University Press
[3] Syed Farid Alatas (2015), Applying Ibn Khaldūn: The Recovery of a Lost Tradition in Sociology, Routledge
[4] Abdelmajid Hannoum, (2003), ‘Translation And The Colonial Imaginary: Ibn Khladun Orientalist’, History and Theory (42), 61-81
[5] Yves Lacoste, (2017), Ibn Khaldun and The Myth of “Arab Invasion”, Verso
[6] উদ্ধৃতি: মোহাম্মদ আজম, (২০১৭), উপনিবেশিতের ধর্ম ও সংস্কৃতি এবং নয়া-সাম্রাজ্যবাদী জমানায় ‘মৌলবাদী’ সন্ত্রাস, বিবিধ, ইকতিজা আহসান সম্পাদিত, ৭ম বর্ষ, ২৪ তম সংখ্যা
[7] Mohammad Salama, (2011). Islam, Orientalism and Intellectual History: Modernity and the Politics of Exclusion since Ibn Khaldūn. London: I.B.Tauris. Retrieved July 29, 2020
[8] Syed Farid Alatas (2015)
চমৎকার একটি লেখা।ভাল লাগল।