গণমাধ্যমে নারী চরিত্রের কেলেংকারীকরণ

Share this:

লেখাটা শুরুর আগে চেষ্টা করলাম কতগুলি নারীর  মুখ ভাবতে। যারা যৌন নির্যাতনের শিকার, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমে যাদের কথা বারবার এসেছে। তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অপরাধের কাভারেজ হয়েছে কিন্তু গণমাধ্যমে তাদের চরিত্র খারাপ দেখানোর চেষ্টা হয়নি-এরকম নারীর মুখ ভাবার চেষ্টা করলাম।  গত তিন/চার বছরের তথ্য থেকে এই স্মৃতি মাথায় নেবার চেষ্টা করলাম। একটি মুখ মনে পড়লো সেটি হলো নুসরাত। ফেনীর এ্ই মাদ্রাসা ছাত্রী মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের যৌন প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় তার গায়ে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয়। গণমাধ্যম তার চরিত্র বিশ্লেষন করেনি। নুসরাত ডায়িং ডিক্লেয়ারেশন দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী সংসদে এই জঘন্য হত্যাকান্ডের নিন্দা করেছিলেন। নারী আন্দোলন কর্মী, অ্যাকটিভিস্টরা রাস্তায় ছিলেন। দ্রুত বিচার এবং বিচারের রায় এসেছিল।

এছাড়া আর কোনও নারীর কথা আমি মনে করতে পারিনা যাদের চরিত্র খারাপ দেখানোর চেষ্টা হয়নি। নারী চরিত্র বিশ্লেষনের সবচেয়ে বড় উপকরণ তার পোশাক। এবং এর বিচারক পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। সমাজের একটি স্ট্যান্ডার্ড পোশাক রয়েছে, সেই মাপে পোশাক না পরা কোনও নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তার সাথে যথেষ্ট অপরাধ ঘটেছে বলে মনে করা হয় না। তবে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, সেই স্ট্যান্ডার্ড এর পোশাক পরেও তনু নামে মেয়েটি খল চরিত্রে চিত্রিত হবার হাত থেকে রেহাই পায়নি। কুমিল্লার তনু মাথায় হিজাব পরতো একই সাথে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিল। গণমাধ্যমে ইনিয়েবিনিয়ে ডাক্তারের বরাত দিয়ে তাকে ধর্ষন করা হয়নি, সে মারা যাবার আগে ইন্টারকোর্স করেছিল-এরকম লেখা হয়েছিল। তার চরিত্র ভালো ছিল না, রাত-বিরেতে বাইরে ঘোরাঘুরি করতো এরকমও লেখা হয়েছে। তনু হত্যার মামলা এখনও ঝুলন্ত।

এভাবে গত তিন/চার বছরে নারী সংক্রান্ত যেকোনও অপরাধ সংঘঠনে নারীর পোশাক আলোচনায় এসেছে। এবং তা  এসেছে শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয় মূলধারার গণমাধ্যমেও।

বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির শুরুর দিকে দেশের স্বাস্থ্যখাতের ব্যর্থতা নিয়ে যখনই রিপোর্ট হয়েছে- সামাজিক গণমাধ্যমে আলোচনায় এসেছে আইইডিসি আর এর কর্মকর্তা মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার শাড়ি। জেকেজি হেলথ কেয়ার নামে আরকটি হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডাক্তার সাবরিনা চৌধুরী করোনার ভুয়া টেস্ট এর অভিযোগে গ্রেফতার হলে তার শরীর এবং পোশাক নিয়ে ফেসবুকে চলে অসংখ্য রসালো আলাপ। একই ভাবে মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের সময় তার সাথে কাজ করা নারী শিপ্রার পোশাক এবং মদ ও সিগারেট খাওয়া নিয়ে চলে একই ধরনের আলোচনা। এবং কখনও কখনও মূল ধারার গণমাধ্যমও হেঁটেছে একই পথে।

নারী অধিকারকর্মী, নৃতত্ত্ববিদ রেহনুমা আহমেদ এই ঘটনাকে এককথায় প্রকাশ করেছেন “কেলেংকারীকরণ” নামে। গণমাধ্যমে নারী চরিত্রের কেলেংকারীকরণের সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ প্রকাশ দেখা গেছে চিত্রনায়িকা পরীমনিকে গ্রেফতারের পরের ঘটনায়।

পরীমনিকে যেদিন গ্রেফতার করা হলো সেদিন তার বাসার সামনে টেলিভিশন রিপোর্টারদের মধ্যে কেউ কেউ পরীমনির চরিত্র কতটা খারাপ, তিনি কি পোশাক পরেন, কতজনের সাথে তার শারিরীক সম্পর্ক রয়েছে, তিনি যে মদ খান, ক্লাবে যান, পার্টি করেন-এই বিষয়গুলোকে নানাভাবে বর্ণনায় আনেন লাইভ টেলিকাস্টে। এর ঠিক কিছুদিন আগেই একইভাবে মৌ এবং পিয়াসা নামের দুজন মডেল এবং ব্যাবসায়ী নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীরকেও একই উপায়ে গ্রেফতার করা হয়।

অধিকাংশ টেলিভিশন এবং পত্র-পত্রিকা এক পুলিশ কর্মকর্তার দেয়া একটি ইন্টারভিউ থেকে “রাতের রানী” শব্দটি পিক করে।  সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যমে এই শব্দটি একরকম “ভাইরাল” হলে মূলধারার গণমাধ্যমও তা তুলে নেয়।

এবং তারপরেই ক্রমাগত দেখা যেতে থাকে নারীর চরিত্রে নানান ধরনের ট্যাগ লাগানোর প্রতিযোগিতা। মূল ভূমিকা পালন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। পরীমনি সংক্রান্ত যেকোনও খবরের নিচে অকথ্য অসংখ্য অশ্নীল, সমাজ দ্বারা নির্মিত “খারাপ চরিত্র” বোঝায় এরকম শব্দে তাকে গালি দেয়া হয়। মূল গণমাধ্যমও এই ভয়েরিজম, এই ঘৃণা, নারীর প্রতি এই বিদ্বেষের মুখে প্রতিনিয়ত খাবার তুলে দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।

প্রশ্ন উঠেছে, গণমাধ্যমের ভূমিকা আসলে কী? এ ধরনের ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকা কী হওয়া উচিত বা প্রয়োজন ছিল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলছেন, “

গণ মানুষের মুখপাত্র বলেই একে গণমাধ্যম বলা হয় অথচ আমরা এখন দেখছি গণমাধ্যম গণমানুষের নয় বিশেষ কোনও বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হয়ে কাজ করছে। গণমাধ্যমে নারী সংবেদনশীল, পেশাদার,জবাবদিহিতার মধ্যে থাকা বিশেষ প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের থাকার কথা কিন্তু পরীমনিসহ নারী সংক্রান্ত যেকোনও ঘটনায় নারীকে যেভাবে ক্রিমিনালাইজ করা হচ্ছে তাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে মূলধারার গণমাধ্যমের পার্থক্যটা ঘুচে গেছে

ফরাসী একটা বহু পুরাতন প্রবাদ আছে, “ঘটনার পেছনের নারীটি কে?” অর্থাৎ যেকোনও খারাপ ঘটনার পেছনে একজন নারী আছে। এই সেক্সুয়াল পলিটিকসটা করাই হয় আসল ঘটনাকে আড়াল করতে। যেকোনও ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব শুধুমাত্র কোনও একটি নারী চরিত্র সেই ঘটনায় ঢুকিয়ে দিয়ে। বাংলাদেশেও এই মুহুর্তে তাই চলছে। এবং গণমাধ্যম সেই আড়াল করার রাজননীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

এই কেলেংকারীকরণের বিরুদ্ধে তাহলে সোচ্চার হবে কারা? যদি মূলধারার অধিকাংশ গণমাধ্যমই এই ভূমিকা নেয় তাহলে কি আগে যে গণমাধ্যম দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেয়া হতো-সেটি কেবলই আরো দূরে সরে যাচ্ছে না বা যাবে না?

রাষ্ট্র তার বিভিন্ন অসংগতি ঢাকার লক্ষ্যে নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে-এমন একটি প্রবণতা আমরা সম্প্রতি লক্ষ্য করছি। নারীকে কোনও অপরাধে ধরা হলে তার চরিত্রে মিথ্যা কালি আবিস্কার করা, সেটাকে সবার সামনে আনা, সাধারণ মানুষের সেই বিদ্বেষে সমর্থন আদায় করা হয় এবং সেটি জারি রাখা হয়। রাষ্ট্রের অন্যান্য অসংগতি ঢাকতে নারীর প্রতি বিদ্বেষকে চাউড় করে দেয়ার এবং জারি রাখার এই প্রবণতা বা কৌশলটি নতুন। এটি নিতান্তই  কৌশল এবং অত্যন্ত নোংরা কৌশল সন্দেহ নাই। কিন্তু চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যম  রাষ্ট্রের এই কৌশল এবং লক্ষ্য পূরনের হাতিয়ার হবে কি না সেটা ভেবে দেখতে হবে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদেরই।

 

 

 

 

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!