লাশের আশায় না থেকে বাজান
নিশ্চিন্তে গায়েবী জানাযা পড়ান
ইস্যু – দ্রুত বদলায়
দুম করে হলে গুম
ফেরে না কোনো সন্তান
র্যাপিড এ যমানায়
বছর ছয়েক আগের লেখা, গাধার গয়না পরম্পরার। প্রিয় পাঠক, কমপক্ষে তিন বছর আগে গ্রন্থবদ্ধ হওয়া এই কথাগুলো দিয়ে লেখাটি শুরু করার কারণ একটু আগালেই বুঝতে পারবেন। এবার সাম্প্রতিক সময়ে ফিরি। এটা কোভিড-১৯ মহামারীর কাল, সাল ২০২০। জুনের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় থাকাকালে বছরে ৩১৭ জনের বেশি ক্রসফায়ারে নিহত বা গুম হয়েছেন। একই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই সংখ্যা ১৮৭।
মূলত বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী আহমেদের সাম্প্রতিক মন্তব্য, ‘ক্রসফায়ার-গুম-খুনে রাষ্ট্র অমানবিক হয়ে উঠছে,’ সম্পর্কে অভিমত জানাচ্ছিলেন ড. হাছান। তিনি দাবি করেন, “আমাদের দল কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেনা।” দৈনিক প্রথম আলোতে সংবাদটি পড়তে পড়তে বিগত বছরের আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসের স্মৃত্মি স্মরণে আসে। সেদিন সেই মানুষগুলোর সাথে দেখা হয়েছিল, যাদের কেউ কেউ বছরের পর বছর নিখোঁজ পিতা বা স্বামীর অপেক্ষায় আছেন, আবার অনেকে গুম হওয়া সন্তানকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
তাদের কান্না, আহাজারি আর আর্তনাদে শুক্রবার গুমট হয়েছিল জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তন। সেখানেই একত্রিত হয়েছিলেন গুমের শিকার হওয়া পরিবারের সদস্যরা। তাদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত সভা থেকে নিজেদের স্বজনকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।
“২০১৩-১৪ সাল থেকে প্রতিবছরই আমরা এইদিনে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করি। তবে এবার অংশগ্রহণটা একটু বেশী। দেশের বিভিন্ন এলাকার শতাধিক পরিবারের প্রতিনিধি এখানে এসেছেন,” বলেছিলেন সানজিদা ইসলাম তুলি। তিনি মায়ের ডাকের অন্যতম সংগঠক, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন।
যশোরের শংকরপুর থেকে এসে আলোচনায় অংশ নেন ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল গুম হওয়া কাজী সাইদুল ইসলাম সাঈদের মা হীরা খাতুন। একান্ত আলাপে তিনি বলেন, “যদি ছেলের কোনো সন্ধান মেলে, এই আশায় আমি এর আগেও দুবার এখানে এসেছি।” ছেলেকে অপহরণ ও গুমের অভিযোগে কোতোয়ালি থানার সাত কর্মকর্তাসহ ১৬ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন জানিয়ে আরো বলেন, “পুলিশের ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ছেলেকে ফেরত দেয়নি।”
স্বজনদের পাশাপাশি আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন আইনজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। একাধিক বক্তা দাবি করেন, বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ৫৩২টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। সরকার চাইলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফিরে আসা অসম্ভব নয় বলেও উল্লেখ করেন তারা।
সেদিন ক্ষমতাসীন দলের গুম হওয়া নেতাকর্মীদের মা-বাবাও আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকার প্রধানের কাছে নিজ সন্তানকে ফেরত চাইতে দেখেছি। পরে দায়সাড়া গোছের সংবাদ লিখে নিজের পেশাগত দায়িত্ব সাড়লেও ইচ্ছে ছিল তাদের কথাগুলো বিস্তারিত লেখার। ড. হাছান সেটাই উসকে দিলেন।
মায়েদের আর্তনাদ: ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া কুষ্টিয়া জেলা সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজের মা শাহিদা বেগম জানান, সাথে আটক হওয়া দুইজনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও তাঁর ছেলেকে আজও ছাড়া হয়নি।
“আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে গিয়ে আমার ছেলে কি অপরাধ করলো? কেন তাঁকে এভাবে গুম করা হলো?” এমন প্রশ্ন রেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “সে কোথায় তা আমরা আজও জানি না। শাহিদা আরো বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার ছেলে আওয়ামী লীগের একজন বলিষ্ঠ কর্মী ছিল, তাঁকে ফিরিয়ে দিন।”
২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এসএম মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা সালেহা বেগম বলেন, “তিন বছর সাত মাস ধরে ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে আমি নিজেই এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছি। এর মধ্যে ছেলের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে তাঁর বাবাও মারা গেছেন।”
তপুর সাথে যুবলীগ নেতাদের দ্বন্দ্ব ছিল। তাঁকে বহুবার হত্যার হুমকীও দেওয়া উল্লেখ করে তাঁর মা বলেন, “তারাই পুলিশকে প্রচুর টাকা দিয়ে তপুকে গুম করিয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনবার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ৩৭ বার ছাড়াও আইজিপি-র্যাব মহাপরিচালকের সাথে অসংখ্যবার দেখা করেও ছেলের কোনো খোঁজ পাননি তিনি। তবুও সরকার প্রধানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনি নিশ্চয়ই আমার মতো শত শত মায়ের কান্না শান্ত করে দিতে পারেন।”
“আপনার কানে কি এই মায়েদের আর্তনাদ, আকুতি পৌঁছায় না? আমি চাই সব মায়েদের সন্তান ঘরে ফিরে আসুক। আপনি আমাদের খালি হাতে ফেরাবেন না,” প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন নাসরিন আক্তার। তাঁর সন্তান কানাডার মন্ট্রিয়লের ম্যাগসাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ দেশে বেড়াতে এসে ২০১৭ সালের ২৬ আগস্ট ধানমণ্ডি থেকে গুম হয়েছেন।
এছাড়া ২০১৪ সালের ২০ মার্চ গুম ফেনী থেকে হওয়া যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান রিপনের মা রওশন আরা বেগম এবং ২০১৩ সালের ২৬ এপ্রিল গুম হওয়া কেরানীগঞ্জ থেকে গুম হওয়া রনি হোসেনের মা আঞ্জুমান আরা বেগমও আলোচনায় অংশ নিয়ে কান্নায় ভেঙে পরেন।
২০১৯ সালের ১৯ জুন মিরপুর থেকে গুম হওয়া কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন বাতেনের স্ত্রী নাসরিন জাহান স্মৃতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনাটি শুরু হয়। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী, আইজিপি, র্যাবের মহাপরিচালক সবাইকে জানিয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে দুই শিশু সন্তান নিয়ে আমি আজ দিশেহারা।”
পিতাদের হাহাকার: গত বছরের ১০ জুন মিরপুরের নিজ বাসার সামনে থেকে গুম হওয়া ব্যবসায়ী মোহন আহমেদের বাবা জমশের আলী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমার পরিচয় যাচাই করে দেখুন আমি কে? আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ‘শেখ সাহেবের’ (জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান) সাথে আন্দোলন করেছি। আজকে আমার ছেলে নিখোঁজ হবে?” তাঁর সন্তানকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমার কাছে ভিডিওসহ সব প্রমাণ আছে।”
২০১৬ সালের ৪ আগস্ট গুম হওয়া হোমিও চিকিৎসক মোখলেসুর রহমান জনির বাবার শেখ আবদুর রশিদ সাতক্ষীরা থেকে এসেছিলেন আলোচনায় অংশ। তিনি বলেন, “আমার ছেলে জঙ্গি না, সন্ত্রাস না, তাঁকে গুমের পেছনে কারা আছে খূঁজে বের করেন।” ছেলে গুম হওয়ার পর তিনি হাইকোর্টে যে মামলা করেছিলেন, সে মামলাও গুম করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “এখনও প্রতিনিয়ত আমাকে হুমকী দেওয়া হচ্ছে।”
২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে কুষ্টিয়াগামী বাস থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের নেতা আল-মুকাদ্দাসের পিতা আলোচনায় অংশ নিতে এসেছিলেন পিরোজপুর থেকে। তিনি বলেণ, “গত আট বছরের এমন কোনো রাত নেই, যে রাতে আমি মুকাদ্দাসের জন্য চোখের পানি না ফেলে ঘুমাতে পেরেছি।”
সন্তান-সহোদরের কান্না: ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে গুম হওয়া সিলেটের বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর পুত্র ব্যারিস্টার আবরার ইলিয়াস অর্নব বলেন, “তখন প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাসায় গিয়ে বলেছিলেন ৭২ ঘন্টার মথ্যে বাবাকে ফেরত দেবেন। আজকে সারে সাত বছর হয়ে গিয়েছে। তার কোনো খোঁজ মেলেনি। সরকার এখন আমাদের এড়িয়ে যেতে চায়। আমার ছোট বোন বা আমাদের ড্রাইভার আনসার আলীর সন্তানও বাবাকে ছাড়াই বড় হচ্ছে।”
২০১২ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হওয়া বিএনপি নেতা সুমনের নবম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে হাফসা ইসলাম রাইতা বলেন, “আমার বাবা যখন যখন গুম হয় তখন আমি ‘ক্লাস ফোরে’ পড়ি। আজ ছয় বছর হয়ে যাচ্ছে তাঁর কোনো খোঁজ নেই। এখানে (সভাস্থলে) আমার যে ছোট ভাইবোনগুলো এসেছে, আমি তাদের সবার বাবাকে ফেরত চাই।”
২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর গুম হওয়া বংশালের সাবেক ছাত্রল নেতা পারভেজ হোসেনের চার বছরের ছোট্ট মেয়ে হৃদিও মাইক্রোফোনের সামনে এসে কান্না জড়িত কন্ঠে জানায়, “বাবাকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না। আমি তাঁর সাথে স্কুলে যাবো। বাবা কবে আসবে? আমি তাঁর বুকে ঘুমাতে চাই।”
“আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি আমার বাবাকে চাই,” ফোঁপাতে ফোঁপাতে জানায় সে। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল গুম হওয়া ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমার বোন সুভদ্রা চাকমা, ২০১৩ সালে ৭ ডিসেম্বর গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা মাহবুব হাসান সুজনের ভাই জাহিদ খান শাকিলসহ আরো অনেকেই আলোচনা করতে গিয়ে কান্না থামাতে পারেননি।
বিশ্লেষকদের মতামত: যারা গুম করেছে বা গুমের পেছনে আছে তারা অত্যন্ত শক্তিশালী উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, “তবুও প্রকৃত সত্যকে পরিস্ফূটিত করার জন্য বিচারের দাবি অব্যাহত রাখতে হবে।” সরকারকে উদ্দেশ্য করেন তিনি বলেন, “আপনরা গুম না করলে কারা গুম করেছে ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে সেটা কেন বের করতে পারলেন না?”
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “গুমের ক্ষেত্রে শাসনের সঙ্কট যতটা, তাঁর চেয়ে অনেক বেশী সঙ্কট বিচারের। শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়, ব্যবসায়িক শত্রুতার কারণেও এখন অনেকে গুম হয়ে যাচ্ছেন।” বাংলাদেশর আইনে গুমের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা দরকার বলেও মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, “নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের (২০১৪ সালের এপ্রিলের) ঘটনার পর আর কোনো সন্দেহ নেই যে এই জাতীয় ঘটনার সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।”
“রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন এই জাতীয় ঘটনার সাথে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে এবং এগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন এর দায় থেকে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানও অব্যাহতি পাবেন না,” বলেন তিনি।
শেষ করতে গিয়ে ২০১৭ সালে লেখা দুটো লাইন মাথায় এলো, যার শিরোনাম ছিল ‘গুমতত্ত্ব’;
হারালে চিন্তা-ক্ষমতার দম
মানুষেই করে মানুষ হজম।
Sharif Khiam Ahmed Eon, a youth in his thirties, is adept in using the pen and camera. With his knack for multimedia journalism, he is a popular face in his arena, fondly known by his nickname Eon. He works in poetry, screenplay, photography, and filmmaking, and he is well-known in the industries of film, advertisement, and literature.