গুম : দানবীয় রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তবতা

Share this:

অধ্যাপক আলী রিয়াজের মতে, গুম কিংবা ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড সমাজে ভয়ের পরিবেশ তৈরির এবং সেই ভয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয়ার হাতিয়ার মাত্র। তাঁর মতে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সরকারের ‘নৈতিক বৈধতা’ (moral legitimacy) নেই; ফলে, ‘coercion was the only tool left in its political strategy toolbox. Through various measures, the regime ensured that a culture of fear permeates the society which will not only deter the political opposition from taking to the streets, but the members of civil society will be afraid of persecution and humiliation’.

 

বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক ইতিহাসের চরমতম দুর্দশাগ্রস্ত সময় পার করছে। একটি ভয়াবহ শ্বাসরোধী শাসন ব্যবস্থা তার নাগরিকদের জীবনকে কোনও রাজনৈতিক অধিকারবিহীন পশুর জীবনে পরিণত করেছে। কোভিড-১৯ এর মতো অভূতপূর্ব, হতবুদ্ধিকর মহামারির মধ্যেও রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং কার্টুনিস্ট সহ সর্বস্তরের মানুষের ওপন দমন পীড়নের এক ভয়ানক স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে।

এটি যেন এক রাজনৈতিক ‘শক থেরাপি’র মাধ্যমে জনগণের সমস্ত গতিশীল বর্তমান এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনা নষ্ট করার আত্মবিনাশী প্রচেষ্টা! এমনকি এই লেখাটি লেখার সময়েও, মাদক মামলার ভয় দেখিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ এর হুমকি, পুলিশি চাঁদাবাজি এবং এনকাউন্টারের নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃকমানুষ হত্যার মতো ভয়াবহ রাজনৈতিক বাস্তবতা বিরাজ করছে।

অরওয়েলিয়ান ডিসস্টোপিয়া এখন কল্পকাহিনীতে সীমাবদ্ধ নেই; বরং একটি রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।

 

গুম : নিপীড়নের হাতিয়ার

বর্তমান সরকার, যা বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক ও জৈবিক জীবনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার ভূমিকায় লিপ্ত ; যে কোনও সমালোচনা, রাজনৈতিক বিরোধীতা সহ যাবতীয় সক্রিয়তার প্রতি এতটাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে যে, বিরোধীতা দমন করার জন্য এমন কোন দমনমূলক হাতিয়ার নেই যা এটি ব্যবহার করে না।

তন্মধ্যে সর্বাধিক দমনমূলক হাতিয়ারটি হলো ‘গুম’; যা আজকাল বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমানের যে কোনও শাসনের সাথে জড়িত হলেও বিশেষভাবে বর্তমান রেজিমের সাথে জড়িয়ে আছে। আরও স্পষ্টভাবে বললে, বিগত দশকে, রাজনৈতিক বিরোধিতা, মতবিরোধ, সমালোচনা এবং কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জোরপূর্বক গুম’ করা।

অতিসম্প্রতি একজন ইসলামপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট, আশরাফ মাহদী, রহস্যজনক অপহরণের শিকার হন। অপহৃত হবার ঠিক আগ মুহুর্তে তিনি তার অপহরণের জন্য সরকারের ঘনিষ্ঠ ইসলামপন্থী একটি গ্রুপকে দায়ী করতে সক্ষম হন। অপহরণের দুইদিন পর তাঁকে যেখান থেকে অপহরণ করা হয়েছিল, সেখানেই রেখে যাওয়া হয়। আশরাফ মাহদীর বক্তব্য অনুযায়ী,  অপহরণকারীরা তাকে এই শর্তে মুক্তি দিয়েছিল যে, তিনি ইসলামিক নেতাদের একটি অংশের বিরুদ্ধে ফেসবুকে কিছু লিখবেন না।

অর্থাৎ পরিস্থিতির নেতিবাচক পরিবর্তন এতটাই ঘটেছে যে, এমনকি যেকোন শক্তিশালী ‘অ-রাষ্ট্রীয়’ গোষ্ঠীও যে কাউকে গুম করতে পারে। রাষ্ট্র যখন ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে, তখন তা সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে বিস্তৃত ও পুনরুৎপাদিত হয়।

এহেন রাজনৈতিক বাস্তবতার সবচেয়ে নির্মম দিকটি হলো, যে কোনও সময় যে কারোর গুমের শিকার হওয়ার আশংকা ও সম্ভাবনা। এটি খোদ গুমের চেয়েও বিপজ্জনক। কারণ একটি সমাজের সবাই গুমের শিকার হন না। কিন্তু যখন এই শীতল বার্তাটি সমাজের সমস্ত স্তরে পৌঁছায় যে, ক্ষমতার বিরুদ্ধাচরণের পরিণতি হতে পারে গুম, তখন অন্যায়-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জারি রাখা স্বাধীন বুদ্ধিজীবীতা ও সক্রিয়তা স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপের ফাঁদে পড়ে।

ফলে, সমাজ হয়ে ওঠে বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অধিবাসীরা এ জাতীয় দমনমূলক রাজনৈতিক শাসনের যাঁতাকলে দীর্ঘকাল পিষ্ট হয়েছে।

 

দায় অস্বীকারের মাধ্যমে বৈধতা প্রদান..

বাংলাদেশে ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে গুমের ঘটনা বেড়ে চলছে। প্যারিস ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ)-এর মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ এই দশ বছরে কমপক্ষে ৫০৭ জন মানুষ গুমের শিকার হন।এর মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া যায়, ২৮৬ জন জীবিত ফিরে আসে, এবং ১৫৯ জনের এখনো কোন হদিস পাওয়া যায়নি।

এই ধরণের গুমের ঘটনা বরাবরই রহস্যে মোড়ানো থাকে। রাষ্ট্র গুমের ঘটনার কোনও দায় স্বীকার করে না ; বরং কারা গুম করেছে, নিখোঁজ বা অপহরণে কে জড়িত থাকতে পারে, ‘নিখোঁজ’ লোকেরা কোথায় আছে বা কারা ফিরে আসছে, কীভাবে তারা ফিরে এসেছে, কী কারণে তাদের পুনরায় দেখা যায়, কেন বহু লোক এখনও পর্যন্ত ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন তা তদন্ত করে খুঁজে বের করার প্রতিও কোন আগ্রহ, উদ্যোগ দেখা যায় না। এছাড়াও, ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের অনেকে কেন লাশ হয়ে ফিরে আসেন সেই ব্যাপারেও কোন পরিস্কার রাষ্ট্রীয় ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না কখনোই।

অথচ নাগরিকদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট, বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং সমর্থকদের আন্দোলন, চলাফেরা পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি করার পেছনে করদাতা জনগণের অর্থের যথেষ্ট পরিমাণ ব্যয় করা হয়। ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণু সরকার সমালোচক ও ভিন্নমত পোষণকারীদের লক্ষ্য করে গভীর নজরদারি-প্রযুক্তিগুলো কার্যকর করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই করে থাকে।

বিপরীতে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত সরকারের দায়িত্বে থাকা প্রত্যেকেই গুমের জন্য ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের দোষ দিয়েছেন বা গুমের বিষয়ে অত্যন্ত অসংবেদনশীল মন্তব্য করেছেন যা অবশেষে গুমের ঘটনাকে বৈধতা দেয়। এমনকি এমনও বলা হয়ে থাকে যে মানুষজন নিজেরাই গা ঢাকা দিচ্ছে সরকারের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে।

সম্প্রতি নেত্র নিউজ আয়োজিত নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে শীর্ষক লাইভ আলোচনায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর দক্ষিণ এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলীদক্ষিণ এশিয়ার অন্য চারটি রাষ্ট্রের (ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল) গুমের সংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশের গুমের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যকে চিহ্নিত করেছেন। উল্লেখিত চারটি রাষ্ট্রই বিদ্রোহ (insurgency) চলাকালে বিদ্রোহপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে গুমের প্রাবল্য লক্ষ্য করা গেছে।কিন্তু একমাত্রই বাংলাদেশেই, নজিরবিহীনভাবে, কোন রকম আনুষ্ঠানিক গৃহযুদ্ধ কিংবা বিদ্রোহের মতো পরিস্থিতি না থাকার পরেও খোদ রাজধানী শহর থেকে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ‘উধাও’ করে দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এইদিক বিবেচনায়, বাংলাদেশের গুমের ঘটনাগুলো অধিকতর নির্মম।

 

ট্রমাগ্রস্তদের ‘ফিরে আসা’…

তবে সরকার চাইলে যে ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিরা জীবিত ফিরে আসতে পারে তা আমরা অতীতের নানা ঘটনায় দেখেছি। যেমন ‘নিখোঁজ’ হওয়ার অনেকদিন পরে সাংবাদিক উৎপল দাশ ও শিক্ষক মুবাশ্বার হাসান জীবিত ফিরে এসেছিলেন।

সাংবাদিক উৎপল প্রায় দুই মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন, এবং গবেষক মুবাশ্বার ৪৫ দিন ‘নিখোঁজ’ ছিলেন। তারা নিখোঁজ থাকাকালীন, দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা এবং রাজনৈতিক কর্মীদের অব্যাহত সমালোচনা ও চাপের মুখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন যে নিখোঁজ ব্যক্তিরা ফিরে আসবেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর প্রায় অলৌকিকভাবে উৎপল ও মুবাশ্বার দু’জনেই ফিরে এসেছিলেন। তাদের ফিরে আসার পর থেকে তারা খুবই বোধগম্য কারণে গুমের বিষয়ে পুরোপুরি নীরব ছিলেন; কে বা কারা তাদেরকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, কারা তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে সে সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। তবে, রাষ্ট্র তার ‘নিখোঁজ’ নাগরিকদের গুম হওয়া ও ফিরে আসার রহস্য উন্মোচনে সামান্যতম আগ্রহ দেখায় নি কেন?

এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনও কখনও স্বীকার করে যে তারা অনেকময় কাউকে তুলে নিয়ে গেলেও ‘কৌশলগত’ কারণে ‘কাস্টোডি’স্বীকার করে না।

২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক সভায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ওই সভায় শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আপনাদের মধ্য থেকেও তো কিছুদিন আগে একজনকে নিয়ে গিয়েছিলাম।আপনাদের মতোই শিক্ষানবিশ চিকিৎসক। কি, নিয়ে যাই নাই অ্যারেস্ট করে?…. “উত্তম দা (হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া) সাক্ষী, এক বছর আগে আপনারা মানববন্ধন করেছেন, রাস্তা অবরোধ করেছেন। আমরা নিয়ে গিয়েছি, আমরা তো বলতে পারি না সব সময়। কারণ তার কাছ থেকে তো অনেক কিছু বের করতে হবে। সব কথা বলা যায় না। সহজ কথা যায় না বলা সহজে।”

২০১৬ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের ইন্টার্ন চিকিৎসক শামীম খান নিখোঁজ হন, তার সন্ধান দাবিতে মানববন্ধন করেন সহপাঠীরা। নিখোঁজের ৩০ ঘণ্টা পর অচেতন অবস্থায় শামীমকে মিন্টো রোডে ডিবি অফিসের সামনে পাওয়া যায়।

ওই ঘটনাকে ইঙ্গিত করেই পুলিশের ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উল্লেখিত মন্তব্য করেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘জঙ্গিবিরোধী’কর্মকাণ্ডের ‘অল্প অংশই’ প্রকাশ্যে আসে। এর বাইরে অনেক ঘটনাই ঘটে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কেইস স্টাডি হতে পারে আওয়ামী লীগের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ ও বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির ভাগ্নে সৌরভের হঠাৎ ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি।

ময়মনসিংহের বটতলা নামক একটি জায়গায় তুলে নিয়ে যাওয়ার ১২ দিন পরে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র জানায়, এ সময় সৌরভের গায়ে কোনও শার্ট ছিল না।

এর আগে সৌরভের পরিবারের পক্ষ থেকে এই নিখোঁজের ঘটনার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে  র‍্যাব ও একটি গোয়েন্দাসংস্থাকে গুমের জন্য দায়ী করা হয় এবং সোহেল তাজ নিজেই এই ঘটনার তদন্ত করবেন বলে ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার কিছুদিন পর পুলিশ সৌরভকে ‘উদ্ধার’ করে, যিনি ইতিমধ্যেই‘অজানা’ অপহরণকারীদের হাত থেকে জীবিত ফিরে এসেছেন। বন্দিদশার বেশিরভাগ সময়ে, সৌরভের চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় ছিল বলে সৌরভের পক্ষ থেকে তার পরিবার মিডিয়াকে জানায়।

এই ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অপহরণের আগে কমপক্ষে চারবার সৌরভকে ধরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থা এক ব্যবসায়ীর মেয়ের সাথে তার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে অভিযোগের ভিত্তিতে।

এই নির্দিষ্ট কেইস স্টাডির ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয় যে যথাযথ প্রমাণাদি সরবরাহ করা গেলে এবং পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করা গেলে বা সরকার নিজেই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করলে নিখোঁজ ব্যক্তিরা ‘ফিরে আসে’।

 

 

অনন্ত অপেক্ষা

তবে সবাই উৎপল, মুবাশ্বার কিংবা সৌরভের মতো ‘ভাগ্যবান’ নন। নির্মম পরিহাস ও অত্যন্ত বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো এই যে, নিশ্চুপ-নিস্তব্ধ যারা টানা কয়েক মাস ‘নিখোঁজ’ থাকার পরে ফিরে এসেছেন, তাদেরকেও ‘ভাগ্যবান’ বলতে হচ্ছে! কারণ অনেক লোক এখনও ফিরে আসেন নি, কখনো ফিরবেন কিনা নাকি চিরতরে ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেলেন তাও অনিশ্চিত! বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলী আট বছর ধরে ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন, কল্পনা চাকমার বন্ধুরা দীর্ঘ দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও তার প্রত্যাবর্তনের আশা ছাড়েননি, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন মাইকেল চাকমা।১০ বছর যাবৎ ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন বিএনপি নেতা সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম। ২০১৪’র জাতীয় নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে বিএনপির ২২ নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে, যাদের মধ্যে ১৯ জন আজকের দিন পর্যন্ত ‘নিখোঁজ’। এমনকি বর্তমান সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতারাও ‘গুম’ হওয়া থেকে রেহাই পাননি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আজ পর্যন্ত ‘নিখোঁজ’ আছেন, কারো কারো মৃতদেহ পাওয়া গেছে গুম হওয়ার পরে।

যাদের গুম হওয়ার বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে কিংবা কোন উচ্চবাচ্য হয়নি, তারা আর কখনো ফিরে আসবেন এমন নিশ্চয়তা নেই।

প্রতি বছর, এই নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা প্রতিবাদ করতে এবং তাদের আত্মীয়দের সন্ধানের দাবিতে ‘মায়ের ডাক’ প্ল্যাটফর্মের অধীনে ঢাকায় আসেন। কোনক্ষেত্রে স্ত্রী গর্ভবতী থাকাকালীন স্বামী ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন, পরবর্তীতে জন্মগ্রহণ করা শিশু ইতিমধ্যে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে কিন্তু এখনো বাবার মুখ দেখার অপেক্ষায়।

বংশালের ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজিনা আক্তারের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। ফারজিনা চার মাসের গর্ভবতী ছিলেন, যখন তার স্বামীকে ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাতে “সাদা পোশাকধারী লোকেরা” ধরে নিয়ে যায়। তার সাত বছরের ছেলে এখনও তার বাবার সাক্ষাত পায়নি!

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, অপহৃত ব্যক্তিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, যার গুমের মাধ্যমে গোটা পরিবারই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিই কেবল ‘নিখোঁজ’ হোন না, বছরের পর বছর গেলেও ওই ব্যক্তির পরিবার কখনই তার ফিরে আসার আশা ছেড়ে দিতে পারে না। এই অর্থে, গুম হত্যার চেয়েও হৃদয়বিদারক। গুমের শিকার ব্যক্তি তো বটেই, এমনকি গোটা পরিবারটিই যেন জীবন্মৃত অবস্থায় টিকে থাকে।

তবে অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের সতর্কবাণীও আমাদের মাথায় রাখতে হবে- ‘গুম হত্যার চেয়েও নির্মম’ বলার মধ্য দিয়ে যেন আবার সমাজে হত্যার রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কোনভাবেই স্বাভাবিকীরণ করা না হয়।

 

সর্বগ্রাসী ক্ষমতা ও গুম :

 তবে মূল প্রশ্ন হলো কোন ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গুম শাসনের একটি অনিবার্য শব্দে পরিণত হয়? ক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে কেন ‘গুম’ সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত হয়? এর কারণ সর্বাত্মকবাদী ক্ষমতা সমাজ থেকে সমস্ত মতবিরোধ নির্মূল করার জন্য এতটাই মরিয়া থাকে যে এটি একটি দানব হয়ে ওঠে – যা প্রতিটি ‘আইনি’ ফাঁক গলে বের হয়ে যেতে চায়।

যদিও ঐতিহাসিকভাবে রাষ্ট্র উদারপন্থীই হোক বা নিদেনপক্ষে ছদ্ম-গণতান্ত্রিক হোক না কেন, প্রায়শই এটি আইনি কাঠামোর মধ্যেই সমস্তটি সন্ত্রাস ও সহিংসতার পথ খুঁজে বের করতে তৎপর থাকে। তবে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ‘বৈধ’ সন্ত্রাসের উপর নির্ভর করলে চলে না, তাকে সহিংসতার ‘অবৈধ’ উপায়ও আবিষ্কার করতে হয়। (এই ‘অবৈধ’ সহিংসতা আবার ‘বৈধ’ সহিংসতার কাঠামোগত যমজ)।

নৃবিজ্ঞানী বখতিয়ার আহমেদ তাঁর একটি দুর্দান্ত রচনায় ‘গুমকে’ হত্যার কথকতা (discourse) হিশেবে আরও করুণ, আরও নির্মম বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, ক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে গুম অধিক কার্যকরী।

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুলে ধরছি :

“ক্ষমতার নিজস্ব একটা চরিত্র আছে। ক্ষমতা যখন অর্পিত হয় কারো হাতে, এই ধরনের খুন করবার ক্ষমতা; সেই ক্ষমতা তখন নিজেই ইতিহাসের চরিত্র ধারণ করে চালকের আসনে বসে যায়। যখন সেই ক্ষমতা টোটালিটারিয়ান হয়ে উঠে, যে মনে করে যে কোন ভিন্নমতকেই আমি একদম নাই করে দেব, তখন বিষয়টি কী দাঁড়ায়? আমরা জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ‘১৯৮৪’তে দেখি যে কল্পিত ওশেনিয়া নামের সেই দেশটিতে শুধুমাত্র একজন মানুষকে যে গুম করে দেয়া হত, তা না। মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ, মানে সত্য বা তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিলো যাদেরকে গুম করে দেয়া হলো তাদের জন্ম থেকে শুরু করে সবকিছু ইরেজ করা। পরে খুঁজতে গিয়ে দেখা যাবে ওই নামে কখনো কেউ যে ছিলো এটাই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তো গুমের ক্ষেত্রে এরকমই ঘটে। প্রথমত এটা আইনকে কলা দেখানোর একটা কৌশল। কারণ আইনের দৃষ্টিতে ‘মৃতদেহ উদ্ধার’ না হওয়া পর্যন্ত কেউ মৃত নন। ফলে এক্ষেত্রে আইনীভাবে এটাকে হত্যা হিসেবে প্রমাণ করা যায় না। নির্মম ভূক্তভোগীরা জানেন যে এটা কতো বড় একটা নির্মমতা হতে পারে। ধরেন একটি লোককে গুম করে ফেলা হলো। ধরা যাক আমাকেই। এখন আমার ব্যাংকে কিছু টাকা আছে। আমার পরিবারের টাকাটা দরকার। আমি যাকে নমিনী করে গিয়েছি তিনি টাকাটা তুলতে পারবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মৃতদেহ উদ্ধার না হচ্ছে। কারণ আইনের দৃষ্টিতে আমি তখনও মৃত না।আর যেহেতু আমি মৃত না, সেহেতু ওই টাকা ক্লেইম করা যাবে না। ব্যাংক দেবে না সেই টাকা।

আইনের মধ্যেই যে ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা আছে সেটা ইংল্যান্ডের আইনজ্ঞরা টের পাচ্ছিলেন সেই সপ্তদশ শতকের দিকেই। ১৬৬৯ সালে একারণেই ইংল্যান্ড আরেকটি আইন তৈরি করে যার নাম হ্যাভিয়াস কর্পাস। এখানে কর্পাস বলতে আসলে শরীর বোঝায়। এই আইনটার মূল বক্তব্য হচ্ছে যখন কোন আইনী বাহিনী কাউকে নিজেদের হেফাজত বা কাস্টডিতে নেয়, সেটা গ্রেফতারই হোক বা আটকই হোক, তখন আইনের বা কোর্টের ক্ষমতা আছে সেই বাহিনীকে হুকুম দেয়ার যে সেই ব্যক্তিকে ‘সশরীরে’ আদালতে হাজির করবার। বাংলাদেশের আইনও যেহেতু ইংলিশ কমন ল’য়ের ভিত্তিতে তৈরি, এখানেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটককৃতদের আদালতের কাছে সমর্পন করবার বিধান রয়েছে। না করলে কেউ হ্যাভিয়াস কর্পাসের আবেদন করতে পারেন, বা আদালত নিজেই আদেশ দিতে পারেন। আমাদের দেশে ১৯৭০ এর দশকে কিছু হ্যাভিয়েস কর্পাস হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে আইনের এই বিধানটি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় হয়ে দাঁড়ায় কারো কাস্টডি বা হেফাজত স্বীকার না করা। যেটা আমাদের বাহিনীগুলো এখন করে। প্রথমে স্বীকার করে না যে গ্রেফতার করেছে, পরে দেখা যায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সেই লোক মারা পড়েছে। আইনী বাহিনী যদি স্বীকার না করে যে কেউ তাদের হেফাজতে আছে তাহলে আদালত হেভিয়াস কর্পাস জারি করতে পারে না। এর ফলেই হ্যাভিয়াস কর্পাস খুব একটা কার্যকর হয়ে ওঠেনি কখনো।” (বখতিয়ার/ ২০১৯)

যখন কাউকে অপহরণ করা হয় কিংবা তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে কি না, বা তার বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার কার্যকর করা হবে কিনা ; এই গোটা ব্যাপারটাই নির্ভর করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর।

সাংবাদিক কাজলের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে তাকে  ৫৪ দিন গুম করে রাখা হয়েছিল এবং পরে তাকে অন্য এক ‘অনুপ্রবেশ’ এর মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে প্রথম জনসম্মুখে আনা হয়েছিল। এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত তিনি নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মামলায় আটক আছেন।

অর্থাৎ, এহেন বর্ণবাদী ক্ষমতার কাছে গুম, ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকাণ্ড এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলো ভিন্নমত, সমালোচনা ও রাজনৈতিক বিরোধীতাহীন সমাজ তৈরির ভিন্ন ভিন্ন হাতিয়ার মাত্র।

কোন কোন ক্ষেত্রে, এই হাতিয়ারসমূহ একটা আরেকটার পরিপূরক। প্রথমত কোন কাস্টোডি স্বীকার করা ছাড়াই আপনাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, তারপর আপনি হয় চিরতরে গুম হয়ে যাবেন অথবা কোন না কোন নিবর্তনমূলক আইনে আপনাকে গ্রেফতার দেখানো হবে। আরো করুণ পরিণতির ক্ষেত্রে, কোন এক ভোরে নদীর ধারে আপনার মৃতদেহ ভেসে উঠবে। কেউ আপনাকে হত্যা করেনি , আসলে আপনার অস্তিত্বই ছিল না!

 

‘ভয়ের সংস্কৃতি’র উৎপাদন

অধ্যাপক আলী রিয়াজের মতে, গুম কিংবা ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড সমাজে ভয়ের পরিবেশ তৈরির এবং সেই ভয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয়ার হাতিয়ার মাত্র। তাঁর মতে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সরকারের ‘নৈতিক বৈধতা’ (moral legitimacy) নেই; ফলে, ‘coercion was the only tool left in its political strategy toolbox. Through various measures, the regime ensured that a culture of fear permeates the society which will not only deter the political opposition from taking to the streets, but the members of civil society will be afraid of persecution and humiliation’.

ফলে , রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার পাশাপাশি ভিন্নমতের পরিসর ক্রমাগত সংকুচিত করতে থাকা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়।

অধ্যাপক রিয়াজ মনে করেন, এমনকি গুম ও ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ডের ক্রমবর্ধমান ঘটনার তুলনায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতা খর্ব করার মতো ভয়াবহ ঘটনা রীতিমতো ম্লান হয়ে গেছে।

২০১৭’র আগস্ট থেকে নভেম্বর এর মধ্যে ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বই আমদানিকারক, ব্যাঙ্কার, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং প্রাক্তন কূটনীতিক গুমের তালিকায় ছিলেন। অন্যদিকে, গুমের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ প্রধান এবং এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন সময়ের মন্তব্য গুমের বীভৎস বাস্তবতার স্বাভাবিকীকরণ ও বৈধতা প্রদানের বিষয়ে পরিণত করে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অস্বীকৃতিপূর্ণ বক্তব্য প্রত্যেকের কাছে একটি শীতল বার্তা পৌঁছে দেয় : কেউই নিরাপদ নয়। (Riaz 2019)

এহেন পরিস্থিতিতে, অধ্যাপক রিয়াজ অত্যন্ত সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন, ভিন্নমতাবলম্বী কন্ঠস্বর ক্রমাগত ম্রিয়মাণ হতে থাকে, কিন্তু এই কবরের নিস্তব্ধতা খোদ কথা বলতে শুরু করে :

‘from denying the opposition permission to hold rallies to muzzling press, from wanton extrajudicial killings to enforced disappearances, to choking the cyber-space — all these have created a climate of fear. A sense of anxiety sets in day by day. Fewer voices are heard, but the silence has begun to speak volumes.’

এরকম শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক বাস্তবতায় কেবলমাত্র বিরোধীতাকারীরাই গুম হয়ে যান না ; গোটা সমাজ ও মানবীয় সত্তা সমস্ত সম্ভাবনাসহই গায়েব হয়ে যায় আসলে। বিদ্যমান দানবীয় রাজনৈতিক বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহসও ক্রমেই হারিয়ে যেতে শুরু করে…

 

প্রতিরোধ! অকুপাই!

 সার্বভৌম ক্ষমতার বর্ণবাদ (পারভেজ/২০২০) এবং এই সর্বাত্মকবাদী রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অবশ্যই সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক কায়দায় মোকাবেলা করতে হবে। গুম, ‘ক্রসফায়ার’ এর নামে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত অঘোষিত ‘জরুরি অবস্থা’কেই নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে। খোদ রাষ্ট্রই ব্যক্তি ও সমাজের জন্য একটি রাজনৈতিক ‘মহামারী’ হয়ে উঠেছে। ফলে, প্রকৃত জনসংশ্লিষ্ট সংকট মোকাবিলার চেয়েও রাষ্ট্রের কাছে সমালোচনা ও ভিন্নমতকে দমন করাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। অন্য অর্থে খোদ জনগণের বিরুদ্ধে অন্তহীন এক ‘যুদ্ধে’ লিপ্ত হওয়া; ব্যক্তি ও সমাজকে রাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত করার মতো বীভৎস রাষ্ট্রপ্রণালী আমরা দেখতে পাচ্ছি।

গুম-খুন-ক্রসফায়ার-ডিজিটাল ‘নিরাপত্তা’ আইনের মতো কুখ্যাত নিবর্তনমূলক আইনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সক্রিয়তার যেমন কোন বিকল্প নাই, ঠিক তেমনি বিকল্প নাই এহেন স্বৈরাচারী আইন প্রণয়ন করতে পারার মতো একব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক গণক্ষমতাতন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপনের, যে গণক্ষমতাতন্ত্র হবে: ‘রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাণহীন যন্ত্রপাতিওয়ালা বর্তমান রাষ্ট্র-সংগঠনের জায়গায় স্বাধীন মানব-সম্প্রদায়সমূহের একটা সঙ্ঘ’; গঠনের দিকে থেকে হায়ারার্কিমুক্ত, আনুভুমিক ও ফেডারেটিভ। আর তা কেবল সম্ভব, ‘যাবতীয় অর্থনৈতিক একচেটিয়া এবং সমাজের মধ্যকার যাবতীয় জবরদস্তিমূলক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অবলুপ্তির মাধ্যমে।’

একদিকে রাষ্ট্র যেখানে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী সেখানে তাকে মানুষের অধিকার বাস্তবায়নে বাধ্য করা এবং মানবমুক্তির পথকে সে আদলেই প্রসারিত করা ; অন্যদিকে সমাজকে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংগঠন ও সেল্ফ ম্যানেজমেন্টের দিকে ক্রমাগত প্রসারিত করার দায়িত্বও আমাদের সামনে। এমন সংগঠন ও সম্পর্কপ্রণালী আমাদের গড়ে তুলতে হবে যেখানে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংহতিই সামাজিক নীতি।

 

তথ্যপঞ্জি:

বখতিয়ার আহমেদ ( ২০১৯ ), ‘গুম-খুন-আতঙ্ক : শাসন প্রণালী ও হত্যার কথকতা’, অরাজ

পারভেজ আলম (২০২০), ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের বিজ্ঞাপন: জৈবক্ষমতার ভাষা ও মতাদর্শিক  কারবার’, মদিনা, আদর্শ; ঢাকা।

Ali Riaz (2019), Voting in a Hybrid Regime: Explaining the 2018 Bangladesh Election, Springer.

 

Sarwar Tusher is an author and activist; interested in studying the state, power, authority, sovereignty, violence, and social relations.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!