ঘোর
রাতের অর্ধেকটা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ঘুম না আসায় নাইকির মনে হয় যে আরও একটা নির্ঘুম রাত মেরুবরফের তুষারজমাট ঢালের নিচে চাপা পড়ে যেতে চলেছে, যদি না কোনো একদিন ওটা গ্ল্যাসিয়ারের সঙ্গে গড়িয়ে কোনো এক শীতলসমুদ্রে সমাধি পেয়ে আবার সাতসমুদ্র পেরিয়ে মেঘ হয়ে ঈশ্বরের প্রিয় কোনো পর্বতে ভেসে বেড়ানোর পর সবুজের শীতল স্পর্শে বৃষ্টি হয়ে দক্ষিণে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা এক নদীর স্রোতে মিশে ওর কোনো এক উত্তরপুরুষের কমলণ্ডুতে ঠাঁই পায় পুজোর জল হিসেবে, ওর গৃহদেবতার পায়ে অর্ঘ্য ছিটাতে। এ এক কষ্টকল্পনা!
আর যদি ওটা অনন্তকালের জন্য জমাট বেঁধে থাকে তবে তা খানিকটা কষ্টছোঁয়া। নাইকির দ্বিতীয় ভাবনাটাই ওর বুকের ভেতর বাসা বেঁধে ফেলে।
কোনো কোনো মধ্যরাতে জেগে থেকেও মনে হয় জেগে আছে সে স্বপ্নের ভেতর ডুবে থাকা মানুষের এলোমেলো চেতনার বিক্ষিপ্ত বহমানতায়। অবসাদ, নাকি অবচেতন মনের কোনো ইচ্ছে, কে জানে কি, কালো কফির তৃষ্ণা জাগিয়ে হেঁসেলের কিনারায় প্রিয় নারীমুখ ভেসে উঠতে না উঠতেই ভদকার তীব্র টানে এক ঝলক তরল আগুন ঠোঁটের আল পেরিয়ে গলনালি চিরে নিম্নগামী হয়। অতঃপর সত্তার গহীনে ঝড় তুলে তছনছ করে দেয় যাবতীয় চিন্তার জটাজাল। তখন কেবল অসীম শূন্যতার আর্তনাদ।
নৈঃশব্দের গুঞ্জনে তখন হাতের মাঝখানে থাকা কাচের গ্লাসটাও আর নেই। অবশ আঙুলগুলো ওর মুঠো করতে চাইলে ভাজা পাপড়ের মতো বোতলের গোলাকার কাচ গুঁড়িয়ে রক্তস্রোত নামে আঙুল বেয়ে। ভদকায় ধুয়ে ফেলে সে ওসব। মনের সাথে ওর শরীরটা কখনও মিলেঝিলে চলে না। এই যা ঝামেলা। হাড়েমাংসে হাড্ডাহাড্ডি ঝগড়ায় মেতে থাকে সারাক্ষণ। রক্ত টগবগিয়ে উঠে হৃৎপিণ্ডের চাপ বাড়িয়ে দেয় ওর। পেশির ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীরটা তখন চায় উষ্ণ জলাধারের তরল পরশ। জলপিপের নিবিড় আলিঙ্গন।
তাহলে শরীরটা যখন ওর নিজেরই মনে হল তখন এটাকে আর নিজের কাছে নিরাপদ মনে না হওয়ায় ভোররাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে সে একজন স্ত্রীর সন্ধানে, যে প্রকৃতই এটার যত্ন নেবে কোনোকিছুর বিনিময়ে হলেও। মনে মনে ভাবে সে, দেখা যাক একটি ভালো দিনের কামনা নিভৃত মনের আকাশে মেলে দিয়ে। কিন্তু বড্ড অসময় তখন। রাস্তার রাজারা নেমে পড়েছে রাস্তায়। কাকডাকা এই ভোররাতে কোনো বাহন প্রত্যাশা করা অবান্তর। তারপর শেষরাতের খেকো-বাবাজীরা তো আছেনই। মানুষের নিঃশ্বাসের ভার কিছুটা কম থাকায় বাতাস কিছুটা হালকা মনে হয় ওর কাছে। নিঃশ্বাস নিতে থাকে সে অন্য সময় থেকে অনেক বেশি করে, অথবা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। খানিকটা উজ্জীবিত মনে হয় নিজেকে ওর কাছে। নিজেকে মনে মনে বলে সে যে দিনের কিছুটা সময় হলেও যদি এভাবে নিঃশ্বাস না নাও তাহলে তুমি কখনোই মনে করতে পারবে না যে তোমার বেঁচে থাকা মানে এই নিঃশ্বাস নেয়া। জীবনে প্রথমবারের মতো কেঁদেছিলে তুমি এই নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য! আর এখনও কেঁদেই চলেছো, যদিও এই কান্না তুমি লুকিয়ে রাখো তোমার ব্যক্তিত্বকে খাটো না করার প্রচেষ্টায়।
হাঁটতে হাঁটতে লোকালয়টা অতিক্রম করে যায় সে। সারি সারি বাড়ি, যার প্রতিটাই ভিন্ন গড়নের। অনেকটা ওগুলোর ভেতরের মানুষগুলোর বৈশিষ্ট্যের মতো। দু’একটা বাড়ির সদর দরোজায় এখনও পুরনো আদলে ‘কুকুর হইতে সাবধান’ লেখা। কিন্তু সে জানে যে, ওগুলোর ভেতরে কোনো কুকুরই নেই। নিতান্তই কৌতূহল মেটাতে ওরকম একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে নাইকি। গেটের বাইরে একটা নেড়ি শুয়ে আছে। এতে ওর আরও ভালোভাবে মনে হয় যে, ভেতরে কোনো কুকুর নেই। মনে মনে ভাবে সে বাইরের কুকুরটাকে একটা ছোট্ট আঘাত করে ওকে ‘ঘেউ’ করানো যেতে পারে। পরক্ষণেই মনে হয় ওটার কোনো প্রয়োজন নেই। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে এমন কিছু শব্দ করতে থাকে সে যা শুনে একটা কুকুর নিশ্চিতভাবেই ছুটে আসবে, যদি ওটা আদৌ থাকে ওখানে। কিছুটা সময় পর নিজের মাথাটাই প্রাচীরের উপর উঠিয়ে দেয় সে। কুকুর কেন, মনে হয় কোনো মানুষই নেই এখন এই বাড়িটাতে।
হাঁটতে হাঁটতে অভিজাত এলাকাটার শেষ প্রান্তে এসে পড়ে নাইকি। একটা রেললাইন আবাসিক ঘরবাড়িগুলোকে দুভাগে ভাগ করে রেখেছে। রেললাইনের দুদিকে নদীর দু’তীরের মতো গড়ে উঠেছে বস্তি। হয়তো ওখানেই থাকে আবাসিক এলাকাটা থেকেও অনেক বেশি মানুষ- যদি আমরা ওদেরকেও মানুষ বলে মনে করে থাকি। আর আবাসিক এলাকাটাও বা কতটুকু আবাসিক ওখানের! অর্ধেক ঘরবাড়িই ব্যবসার কাজে লাগিয়েছে ওগুলোর মালিকেরা, যার অধিকাংশই জার্মান শব্দ কিন্ডারগার্টেন নামের শিশুদের পাঠশালা- যেখানে ওরা বলে- ‘বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখানো হয়,’ হাসপাতাল বা ক্লিনিক-জাতীয় কিছু, খাবারের দোকান, কিছু পার্লার, যদিও সবাই জানে যে ওগুলোর অধিকাংশের ভেতর চলে অন্যরকম মাংস-ব্যবসা, এই এমন সব। ওসব প্রতিষ্ঠানের নামগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বা ওইসব দেশের রাজধানীর নামে। বাংলা কোনো নাম খোঁজা কারও উচিত হবে না। যেমন, কেউ যদি কারও সন্তানের নাম বাংলায় রাখে তাহলে সারা জীবন তার সন্তানটিকে উৎসাহীদের কাছে ওই নামের অর্থ বলে যাওয়ার বিড়ম্বনা পোহাতে হবে।
ওই বস্তিগুলো- নদীর দু’তীরের মতো, যেগুলো ভাঙে ও গড়ে-ওখানে যারা বাস করে তাদের উচ্ছেদের কথা কখনও ভাবে না ভবনের অধিবাসীরা। অথচ কোনো না কোনো দলের লোকেরা বছরে দু’একবার উচ্ছেদ করবেই ওদের। তা না হলে ওদের পিতৃ-প্রভুদের চলে না, যাদের অনেকে হয়তো ওই এলাকাতেই থাকে। ওদের বাসার আয়া-বুয়া, বাবুর্চি, ড্রাইভার ওখান থেকেই আসে। ওদের সবদিকই সামলাতে পারে এইসব প্রান্তিক মানুষেরা। রেললাইনের দুপাশের দুটি অভিজাত আবাসিক এলাকার মধ্যখানের বস্তিটি যেন একটা বাফার জোন। রেললাইনটা সীমান্ত। যদিও দুপক্ষে কখনও সংঘর্ষ হয় না। বস্তিবাসীদেরও শান্তিরক্ষা করে চলতে হয়। পাশাপাশি বসবাসের এই সংস্কৃতিটি হয়তো ভালোই। করে খেতে পারছে সবাই।
শুক্রবারের সকালগুলো এদিকে অনেকটা জনমানবহীন হয়ে শুয়ে থাকে বা গড়িয়ে যায়। অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন না থাকায় সাহেবরা অনেকটা বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। বেগমরাও সপ্তাহের প্রাপ্তি সুদেআসলে তুলে নিয়ে ওদের সমর্থনে বিছানায়ই পড়ে থাকে। ফলে অনেক চর্বিঝোলা বস্তু দেখতে হয় না এসব সকালে। বস্তিগুলোয় অবশ্য গতরাতের উনুনের ধোঁয়া মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আগুন জ্বালাতে হয়। ওদের ব্যস্ততা অথবা প্রয়োজন অন্য রাতগুলোতে বা শুক্রবার বেশি থাকে।
কোথাও একটা মোরগ ডেকে ওঠায় কানখাড়া করে নাইকি। অবাক ঘটনা! কতদিন এ শহরে মোরগের ডাক শোনেনি সে! মনে মনে বলে সে, কী যেন বলে মোরগের ডাক দেয়াকে? তাও কি ভুলে গেছি- বাগ দেয়া?’
নিয়ন-জ্বলা ধূসর একটা শহরে ভোরের আলো যতটা স্বচ্ছ হতে পারে তা হয়ে গেছে। এ মোরগটা হয়তো ঘুমকাতুরে, অথবা কোনো সাহেবসুবো। গ্রামের মোরগেরা অন্ধকার থাকতেই বাগ দেয়া শুরু করে। হাঁটার গতি কিছুটা বাড়িয়ে দেয়ায় হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে গলার কাছে চলে আসে ওর। সেখানেই আটকে থাকে কিছুক্ষণ। আর মস্তিষ্কে বেশি করে রক্ত পাঠাতে থাকে। যেন ওই মুহূর্তে ভালো কাজ করতে পারে ওটা। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই দৌড়াতে হয় ওকে। কারণ সে দেখে যে, আরও অনেকে দৌড়াতে শুরু করেছে। মনে মনে ভাবে নাইকি, ‘এই একটু আগেও এসব মানুষগুলো ছিল কোথায়? ওরাও কি জানে না যে কেন ওরা দৌড়াচ্ছে? নাকি সেই শুধু জানে না! মানুষগুলোর চোখেমুখে আতঙ্কের তেমন কোনো চিহ্ন নেই! বস্তিগুলোর প্রায় শেষদিকটায় এসে পড়ে নাইকি। সে দেখে যে, মাঝ বয়সের দুটো ছেলেমেয়ে বেশ আয়াসে প্রাতঃকৃত্য সাড়ছে। নাইকিকে দেখেও ওরা পুরোপুরি ভাবলেশহীন, যেন ওদের দৌড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। নাইকির পক্ষে আর সামনে এগোনো সম্ভব হয় না। বাতাস ওখানে সিসার চেয়েও ভারি। বস্তির যত নর্দমা, আবর্জনা, এসে জমা হয়েছে নিচু এই জলাভূমিটাতে। পানি- বলতে যা বোঝায় – তার একবিন্দুও নেই ওখানে। কালো থিকথিকে একটা তরল পদার্থ জমে রয়েছে ঘন কচুরিপানার নিচে।
‘নিঃশ্বাস- এবার এটা নেয়া বন্ধ করতে হবে তোমাকে!’ ভাবতে না ভাবতেই, বস্তিতে অনেকটা বেমানান এমন এক মহিলার হেঁচকা টানে চটের দরোজা, অথবা পর্দা ভেদ করে অন্ধকার এক কুঠুরিতে ঢুকে পড়ে সে। ‘বাঁচতে চাইলে হুইত্তা পড়েন।’ বলেই একটা চাটাইয়ের উপর ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে একটা দুর্গন্ধ কাঁথা দিয়ে ঢেকে দেয়। সত্যি সত্যিই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ওর। ‘ওই দিক ঘুইরা শুন।’ বলে ওই মহিলাও ঢুকে পড়ে কাঁথার ভেতর। কিন্তু ঘুরে শোয় না নাইকি। মহিলার ভারি নিতম্ব ওর শরীর স্পর্শ করায় সে ভাবতে শুরু করে যে কোথাও জড়িয়ে যাচ্ছে কিনা! ওর ঘুরে না শোয়াতে ওই মহিলাই ওর দিকে ফিরে শোয়। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ডর লাগে? ডরাইয়েন না। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কিলিয়ার অইয়া যাইব।’ ওর ওই কথায় সত্যি সত্যি ভয় পায় নাইকি। এ অবস্থাটা থেকে পরিত্রাণের উপায় ভাবতে শুরু করে সে। তখন অনেকটা কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে কান-ফাটানো গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। সত্যি সত্যি ভয় পায় সে, শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে ওই মহিলাকে। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে সে, ‘আরে আমার পুরুষ মানুষরে! কইলাম না ডরাইয়েন না।’
পাঁচ নয়, দু’মিনিটের মধ্যেই সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। আরও এক দু’মিনিট পরে মানুষজনের সাড়া পাওয়া যেতে থাকে। যন্ত্রচালিতের মতো বাইরে বেরিয়ে আসে নাইকি। মানুষগুলো ইতোমধ্যে একজন দুজন করে এগিয়ে এসে জলা জায়গাটার দিকে একটা জটলা গড়ে তোলে। সেও এগিয়ে যায় ওদিকে।
কালো ওই তরল পদার্থের ভেতর একটা মানুষের সাড়ে তিন লিটার রক্ত আর কতটুকুই বা! মানুষগুলো ঝুঁকে মৃতের মুখটা দেখার চেষ্টা করে শুধু। স্মৃতি হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করে যে ওদের পরিচিত কেউ কিনা ওই লোকটা। অপরিচিত হলেই বুকটা হালকা করে নেয় একটা বড় নিঃশ্বাস ওই দুর্গন্ধ বাতাসে ছেড়ে দিয়ে। ওর মুখটা দেখতে চায় না নাইকি। ওর কাছে একজন মৃত- তা সে পরিচিত হোক আর অপরিচিতই হোক- একই রকম। ওটা একটা জড় পদার্থ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। বরং ওই মহিলাকে খোঁজার চেষ্টা করে সে। ওই জায়গাটার কাছে ফিরে এসে সবগুলো ঝুপড়ি ওর একই রকম মনে হয়। অপেক্ষা করে সে, ওইরকম কোনো মহিলা কোনো ঘর থেকে বেরিয়ে আসে কিনা। সে হয়তো কোনো এক অভিজাত ঘরের বুয়া। বেশ-ভুষায় ওরকমই মনে হয়েছে নাইকির। বেশ কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পরও কোনো কিছু উদ্ধার করতে পারে না সে। ওকে দেখে কিছুটা সন্দেহজনক মনে হওয়ায় এক প্রায়-বৃদ্ধা মহিলা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কারে খোঁজেন?’
কার নাম বলবে সে? মানুষ তো মানুষকে নামেই চেনে? নাম দূরে থাক, ওর চেহারাটাই হয়তো এখন আর মনে নেই নাইকির। বাফার জোন ছেড়ে আসে সে। নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করে আবার। আহা নিঃশ্বাস! এভাবে নিঃশ্বাস নিতে নিতেই সে চেষ্টা করে ভুলে থাকতে ওর নিকট অতীত, দূর অতীত এবং সকল অতীত…
ফিরে আসে সে আবার নিজের জগতে! আলো, বাতাস, অন্ধকার, উষ্ণতা, প্রকৃতির এসব নিজস্ব বিষয়গুলো যখন অবারিত তখনই প্রকৃত সৌন্দর্য উপলব্ধি করার উপযোগী বাইরের লিকলিকে হাওয়া মুহূর্তের ভেতর ওর হারিয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলিকে আবার পাইয়ে দেয়। যে-সব নেই বলে বিভ্রম ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিল সে, ওর অবচেতন বোধের যন্ত্রণা থেকে সে-সব খুঁজে দেখে, ওগুলো সব এক অর্থহীনতা হাতড়িয়ে বেড়ানো যন্ত্রণা, নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছে সে যে, ওগুলো ওর নয়, কখনোই পাবে না সে ওইসব, নিজেকে তখন ঘরে ফিরে যেতে প্রলুব্ধ করে নাইকি।
প্রশ্নোত্তর
শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?
কামাল রাহমান: এখনও খুঁজে পাইনি ওটা। সত্যি বলতে কি, গল্প লেখার জন্য হয়তো কোনো তাড়না বোধ করি না আমি। নয়তো অনেক গল্প লেখা হয়ে যেত এতদিনে। অনেক গল্প জমা হয়ে আছে আমার মাথার ভেতর। কিছু সুন্দর অভিজ্ঞতা, বিস্মরণীয় তিক্ততা, অপার রহস্য, মানুষের চরম অবিমৃশ্যকারিতা প্রভৃতি যে মিথষ্ক্রিয়া সৃ্ষ্টি করে আমার ভেতর তা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলে মনে হয় ভালো হতো। কিন্তু ঐ যে, তাড়না, ওটা পাইনে। এমনকি আমার পাঠকের অতিক্ষুদ্র অংশটি থেকেও কোনো প্রেরণা নেই আমার জন্য।
সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা ঘটনা আমাকে লেখার জগতে পৌঁছে দেয়নি। বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বের অন্যান্য ভাষার অসংখ্য গল্প-উপন্যাস পড়তে যেয়ে আমার মনে হয়েছে যে এমনই কিছু বলার আছে আমারও। ওসব গল্প-উপন্যাস পাঠের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও একই সঙ্গে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, আমার ভেতর জমে ওঠা অনেক বিষয় ও ঘটনার উপলব্ধির মিশেলে অজানা অচেনা ও অভূতপূর্ব এক রসায়নের উপস্থিতি লক্ষ্য করি নিজের ভেতর, ওগুলোর কিছুটা বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে আমার গল্প লেখার দুর্মদ প্রচেষ্টা।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?
কামাল রাহমান: প্রায় সম্পূর্ণভাবে। বানিয়ে গল্প বলার মেধা আমার নেই। আমার গল্পের বিষয়ে অবশ্যই একটা ব্যক্তিগত যোগাযোগ, পূর্বস্মৃতি অথবা পাঠ-অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। যে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই তা নিয়ে লেখার কোনো আগ্রহও বোধ করি না আমি।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।
কামাল রাহমান: বর্তমানে নেই বলে মনে হয়, তবে অতীতে ছিল অথবা এখনও আছে কিন্তু আমার সংকীর্ণ দৃষ্টিতে তা ধরা পড়েনি। খুব বেশি উদাহরণ দেয়ার প্রয়োজন নেই। অতীতে রাজনৈতিক অনাচার ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কত-সংখ্যক বই নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তা ভেবে দেখতে পারেন। বর্তমানে আমাদের ভেতর সোচ্চার ও প্রতিবাদী হওয়ার ঐ মানসিকতা, যোগ্যতা বা সৎ-সাহসটাই নেই। আমার ভুলও হতে পারে।
রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব, সমসাময়িক বা অতীত, যাই হোক না কেন ওটার প্রতিফলন কথাসাহিত্যেই শুধু নয় শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই থাকা উচিত। প্রকৃত শিল্পীর একটা বড় কাজ বা উদ্দেশ্য এই রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন তার পাঠক বা শিল্পভোক্তার সামনে তুলে ধরা। নিকট অতীতেও যদি তাকান, মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘কবর’, কিংবা শওকত ওসমানের ’ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি তখনকার সমাজে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল তা বুঝতে পারবেন। এরকম অনেক উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে রয়েছে। অসংখ্য বই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তথাকথিত রাষ্ট্রবিরোধীতার অভিযোগ এনে।
শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
কামাল রাহমান: না, এমন কোনো ছোট বা বড় গল্পের উল্লেখ করতে পারব না, যা আমাকে কাঁদিয়েছে বা কান্নার মতো কোনো এক বোধের জগতে নিয়ে গেছে। যদি জিজ্ঞেস করতেন ‘হাসিয়েছে’ তাহলে হয়তো অনেক নাম উল্লেখ করতে পারতাম। তবে একটা গল্পের নাম বলতে পারি যা আমার অন্তরে একটা প্রচণ্ড আবেগ সৃষ্টি করেছিল, কান্নার মতো একটা বিষাদময়তা আচ্ছন্ন করেছিল আমাকে, আমার বোধের জগতকে বিপন্ন করে তুলেছিল, ওটা সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প ‘পাদটীকা’ (পন্ডিত মশাই)।
শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
কামাল রাহমান: মনে হয় না গল্প লেখার সময় আমার মাথার ভেতর এসব কাজ করে। গল্পের প্রকৃতিই ওটার কাঠামো গড়ে দেয়। বারবার লিখন-পুনর্লিখনের মাধ্যমে ভাষাটাকে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করি। ব্যাকরণ কখনও আমার গল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেয়নি। কখনও কখনও ওটাকে অগ্রাহ্য করি আমি। কিন্তু দৃষ্টিকটুভাবে না।
আমার মনে হয় না নিজস্ব কোনো ফর্ম আমি গড়ে তুলতে পেরেছি। পূর্বসূরিদের অনুসরণ করি আমি। অন্যান্য ভাষার বিষয়টাও অনেক সময় মাথার ভেতর কাজ করে। তবে বাংলা ভাষা একটা অতি-উচ্চ মান তৈরি করেছে যা ভাঙার ক্ষমতা আমার কল্পনায়ও আসে না। আমি বরং নিজেকে খুব গতানুগতিক ও তুচ্ছ এক সাহিত্যকর্মী হিসেবে দেখতে পছন্দ করি।
শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?
কামাল রাহমান: সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান বলে কিছু আছে কিনা জানি না। অনেকগুলো সদর্থক উপাদান মিলেমিশে একটা ভালো গল্প হয়ে ওঠে। সবকটা উপাদানের ভালো দিকগুলো গল্পটার ভেতর থাকতে হয়। খুব ভালো বিষয়ে একটা যাচ্ছেতাই বা অনাকর্ষণীয় ভাষায় একটা গল্প লেখা হলে ওটা কখনও সার্থক হয়ে উঠবে না। আবার আঙ্গিকসর্বস্ব বা নিরীক্ষামূলক বলে কথিত গল্প, যে-সবের আগাপাশতলা পাঠক খুঁজে পায় না সেসবও ধোপে টেকে না। যে-কারণে ওগুলোকে কখনও সার্থক গল্প হয়ে উঠতে দেখা যায় না। পাঠশেষে গল্পের ভেতর পাঠক কিন্তু গল্পটাই পেতে চায়। গল্প-পাঠকের উদ্দেশ্য কিন্তু ওটাই।
ভাষা, শৈলী, আঙ্গিক, পরিবেশন-বৈচিত্র্য প্রভৃতির সমন্বয়ে একটা গল্পকে উপস্থাপন করা হলে ওটার সার্থক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখককের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
কামাল রাহমান: খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা না থাকার কারণে অথবা ব্যক্তিস্বার্থে এটাকে উপেক্ষা করার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে নিজেদের মেধা ও প্রতিভার অকল্পনীয় অপচয় নিকট অতীতেও লক্ষ্য করা গেছে। সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার মতো রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা একজন লেখক বা শিল্পীর ভেতর না থাকলে তার বস্ত্র বা পাদুকা ব্যবসায়ী হওয়া উচিত। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অন্যায়, অন্যায্যতাই শুধু নয়, সকল প্রকার অন্যায়, অনিয়ম, পশ্চাতপদতা প্রভৃতির বিপক্ষে একজন লেখকের বলিষ্ট ভূমিকা থাকা উচিত বলে মনে করি।
শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!
কামাল রাহমান: উপন্যাস।
আমার লেখালেখিই আমার পাঠকের সঙ্গে মৃদুস্বরে সামান্য কথা বলে, ভিন্নভাবে কী আর বলব। শুনে এসেছি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস. . . ওটার একটা স্পষ্ট রূপরেখা সংক্ষিপ্তাকারে খুঁজতে যেয়ে উপন্যাসের জগতে হারিয়ে গেছি। পাঁচটা উপন্যাসের একটা পেন্টালজি তৈরি করেও বিষয়টা শেষ করতে পারিনি। পাল, সেন, মোগল আমল নিয়ে লেখা তিনটে উপন্যাস বেরিয়েছে। বাকি দুটো, সুলতানি ও ইংরেজ আমল, আগামী দুবছরে বেরোবে। আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা বা দুর্বল মেধার কারণে প্রথম পেন্টালজিতে ঐ সময়টাকে পুরোপুরি ধরতে পারিনি। আরও পাঁচটা উপন্যাস নিয়ে দ্বিতীয় পেন্টালজিতে আশা করি বিষয়টা শেষ করতে পারব এবং নিজের কাছে থাকা দায়টা থেকে মুক্ত হতে পারব। উপন্যাসগুলোর খসড়া হয়ে গেছে। আগামী দুতিন বছরে মনে হয় পূর্ণরূপ পাবে। এ সাগাটি প্রকাশ করে চলেছে ধ্রুবপদ।
আমার মূল সংস্কৃতি ও বিলেতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার কারণে নতুন আরেকটা সংস্কৃতি আমার কাছে প্রায় নিজের হয়ে ধরা দিয়েছে। ইংরেজরা প্রায় দুশো বছর আমাদের সঙ্গে বসবাস করে আমাদের কাছ থেকেও কিছু নিয়েছে। কিন্তু আমরা ওদের ভালো দিকগুলোর কোনোটাই নিইনি। ওদের রক্ষণশীল সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। এসবের মিথস্ক্রিয়া ও বিশ্বের প্রায় সবকটা মহাদেশের অনেকগুলো দেশ ভ্রমনের অভিজ্ঞতা আমাকে বাঙালি ডায়াস্পোরা বিষয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছে। এসব নিয়ে লিখতে নিজের ভেতর একধরনের তাগাদা অনুভব করি। এই ডায়াস্পোরা সাহিত্য নিয়ে কাজ করছি দীর্ঘদিন থেকে। বেশ ক’টা উপন্যাস বেরিয়েছে এসবের উপর ভিত্তি করে। এবারও (২০২৩ বইমেলায়) ‘অনুপ্রাণন’ একটা উপন্যাস এনেছে, ‘ইউনিয়ন জ্যাক ও জুন ট্র্যাজেডি’ নামে।
কবিতা অনুবাদ করে আনন্দ পাই আমি। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার কবিতা বৌদ্ধিক ও দার্শনিক স্তরে অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করেছে। যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে তবে আমার মনে হয় যে, আমাদের কবিতা এখনও প্রেম ও অতীত-স্মৃ্তিকাতরতার মতো অতিক্লিশে বিষয়গুলো নিয়ে পড়ে রয়েছে! এটা বেশ অবাক করে আমাকে। কিছু ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে।
ভিন্ন স্বাদের তিনটি কবিতাগ্রন্থের একটা সেট অনুবাদ করেছি। মেসোপটেমীয় মহাকাব্য : গিলগামেশ; প্রেম ও যৌনতার দেবী: ইনান্না; পৃথিবীর আদিনবী : জরথুস্ত্র। এ তিনটের প্রথম দুটো বের করেছে নাগরী, শেষটি ওরা আনবে আগামী বইমেলায়।
পঞ্চাশজন নোবেল লরিয়্যাট কবির পাঁচশো কবিতা অনুবাদ করছি। দশজন কবির একশটি কবিতা নিয়ে একটা বই প্রকাশ করেছিল কথাপ্রকাশ। তারপর আরও বিশজন কবির দুশো কবিতা নিয়ে আরেকটা বই প্রকাশ করেছিল ধ্রুবপদ। বাকি দুশো মিলিয়ে পাঁচশো কবিতার একটা সংকলনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
একটা দুর্লভ বই, দিওয়ান-ই-মাখফির অনুবাদ করেছি। নতুন আঙ্গিকে ওমর খৈয়ামের অনুবাদ করেছি। ফাঁক পেলে হাইকু ও তান্কা লিখি। এসব আরকি, মাকড়শার মতো অকারণে জাল বুনে চলেছি, যা যে-কেউ ঝেরে ফেলতে পারে!