চাঁদনি রাতে প্রাণ আর মৃত্যুর চোরাকারবার

Share this:

চাঁদনি রাতে প্রাণ আর মৃত্যুর চোরাকারবার

 

রাত। আজিরুর বের হয়েছে। একটা শুয়োর আর কয়েকটা শুয়োরের বাচ্চা তার পায়ের শব্দ পেয়ে যাচিবুচ্ছিল তা কোঁৎ করে গিলে নিয়ে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে কঞ্চির বেড়ার ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল।ঘেঁটুর ঝোপে ঢুকে পড়ল জানোয়ারগুলো। শুয়োরেরা ঘেঁটুবনের ভেতর মিলিয়ে গেলেও তাদের ঘূৎকারএখনও ভেসে আসছে। অন্ধকার, শরীর ঢাকতে পারে শব্দ ঢাকতে পারে না।

শুয়োর আর শুয়োরের বাচ্চারা বেড়া ফেঁড়ে শাক-সবজির খেতে শিকড়বাকড় খেতে ঢুকেছিল। বেড়াদেয়া আর বেড়া ডিঙানোর খেলা জগৎ জুড়ে। বেড়া দিয়েছিল আজিরুর, বেড়া ভেঙে ঢুকেছিল শুয়োর।তাকে দীর্ঘনিশ্বাস দিলো বাতাস। সে দীর্ঘশ্বাস দিলো বাতাসকে।

আজিরুর অনুমান করার চেষ্টা করে রাতের গভীরতা। এখন কি রাতদুপুর? রাতবিকেল? দেড়টা বা দুটাবাজছে? আরও বেশি? নাকি মাত্র সন্ধ্যা? বুঝতে পারে না সে। ডানহাতে লুঙ্গি সামলে বামহাতে লিঙ্গেরঘাড় ধরে মুততে বসে সে। মূত্রের বেগে নরম মাটিতে ঘুগরার খালের মতো খাল হয়ে যাচ্ছে। মুত আরমাটির সংঘর্ষে সৃষ্ট শব্দ পেট হালকা হবার সুখের সাথে মিশে সুমধুর এক সংগীত তৈরি করছে।মূত্রসংগীত। এ সংগীত তার ভালো লাগছে। মুতার বেগ কমে আসাতে সুমধুর মূত্রসংগীত থেমেআসছে। আরও কিছুক্ষণ সবেগে মুততে পারলে আরও কিছুক্ষণ মূত্রসংগীত সে শুনতে পারত। তারমুতের সফেন ধারা ফণা তোলা সাপের মতো বুকের ভরে চলে যাচ্ছে জোছনামাখা মাটির ঢাল বেয়ে।তার পেচ্ছাপ মাটির উপর মেখে থাকা জোছনাকে চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছে। আজিরুর মুতসাপের সর্পিলগতির দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে। এগিয়ে যাওয়া নিজের মূত্রধারাকে সত্যি সত্যি একটা জীবই মনেহচ্ছে; জীবন্ত জলসরীসৃপ।

চাঁদনি চোয়া রাত। মসৃণ মসলিনের মতো পাতলা বুনটের চাঁদনি গোটা দুনিয়াকে আবৃত করে আছে।ঘেঁটুবনের মাঝে মাঝে মাঝে মাথা তুলে আছে আম, কাঁঠাল, লিচু, কাঠলিচু, জিয়ল আরও মেলারকমগাছ। রাশি রাশি গাঁদালতা, গুড়ৃচিলতা, গোয়ালিয়ালতা একগাছের সাথে আরেক গাছকে বেঁধেজঙ্গলটাকে বেশ জমাট করে তুলেছে। এগুলোর ভেতর দিয়ে চাঁদের চাঁদনি চুয়ে চুয়ে ছুঁয়ে আছে মাটি,ছোটো ছোটো গাছ, ঘাস। গাছলতার ফাঁক দিয়ে পড়া গাছতলার চাঁদের কুচি কুচি আলোগুলো সোনারপয়সার মতো, সোনার বারের মতো পড়ে আছে।

মুতা শেষ হলে, মুতগান থেমে গেলে ঈষৎ খারাপ লাগে তার। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকে না এ খারাপ লাগা।মুতের চাপে পেটটা টনটন করছিল, সেটা আর নাই; এটাও তাকে ভালো লাগা দেয়। মুতা শেষ হলেশরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে, গায়ের লোম খাড়া হয়। শরীরের এই শিহরানো বেশ মজা করে অনুভব করেসে। শেষ মুতটুকু বের করার জন্য দুবার খকখক করে কৃত্রিম কাশি দেয়। তার খকখকানিতে একগাছহতে একটা নিশাচর খেচর ফড়ফড় করে উড়ে গিয়ে অন্য গাছের ওপর ঝপ করে পড়ল। গাছের পাতাআর পাখির পাখা ঝটপটানোর শব্দে একটা ছুঁচো কিচকিচ করতে করতে গর্তে ঢুকে পড়ল। জমাট বাঁধারাত ক্ষণেকের জন্য ভেঙে আবার জোড়া লেগে গেল, আবার সুনসান হয়ে গেল সবদিক। যেন কিছুইঘটেনি।

আজিরুর ভাবে, এই যে পাখিটা এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে বসল, এই যে ছুঁচো মাটির উপরথেকে মাটির গর্তে লুকিয়ে গেল এর বেশি তো তাদের যাওয়া নেই, যাওয়ার জায়গা নেই। মানুষেরওযাওয়ার জায়গা খুব বেশি নাই। মানুষ পুকুরে থাকা ছটফটে মাছ, যেকোনো সময় জালিয়ার জালপিঠের উপর ফাল দিয়ে পড়তে পারে, টেনে তুলবে, দেখা হয়ে যাবে বঁটির সাথে, মরিচের সাথে, বাটিরসাথে, খাদকের দুপাটি দাঁতের সাথে। মানুষমাছ পৃথিবী-হাঁড়িতে পড়ে আছে, সিদ্ধ হচ্ছে। অবশ্য সবজীবের জন্যই ওই একই অবস্থা আর অবস্থান, একই ব্যবস্থা আর ব্যবস্থান।

আজিরুরের কাশির শব্দ পাখির আরাম নষ্ট করল আর পাখির পাখা ঝাপটানো ছুঁচোর চারণ নষ্টকরল আর ছুঁচোর কিচকিচ আওয়াজ ঝিঙুর পোকার সুর থামিয়ে দিলো আর ঝিঙুরটা পালানোর সময়একটা কালো ডেঁইয়া পিঁপড়াকে উলটে চিত করে ফেলে গেল। পলকেই কতকিছু হয়ে গেল। এর মানে, একজন একটু আঘাত দিলে কতদিকে, কতজনের ব্যাঘাত তৈরি হয়ে যায়। আঘাত-ব্যাঘাত ব্যাপারটাপুঁতির মালা বা তসবির মতো। একটা পুঁতির ঘুম ভাঙালে পরের পুঁতিরও ভেঙে যায়, পরের পুঁতির ঘুমভাঙলে তার পরের পুঁতির ঘুম ভেঙে যায়, এভাবে সব শেষ পুঁতির ঘুম ভেঙে যায়। শেষ পুঁতিতে আঘাতবা ব্যাঘাত আসতে আসতে প্রথম পুঁতি হয়তো এ ফাঁকে ব্যারাম কাটিয়ে খানিকটা আরামের প্রস্তুতিনিচ্ছিল কিন্তু শেষ পুঁতির ঘুম ভেঙে যাবার কারণে বা শেষ পুঁতির জীবনের আরামে ব্যাঘাত ঘটারকারণে আবার প্রথম পুঁতির আরাম ভেঙে যায়। এভাবে আবার, আবার, আবার, বারবারআঘাত-ব্যাঘাত ব্যাপারটা চলতেই থাকে, আরাম আর কেউ পায় না। এমন করতে করতে সবসময়ইচলছে এই আরাম ভাঙার মালা, আরাম ভাঙার মেলা। জগতের জীবজড় সবকিছুই আঘাত-ব্যাঘাতসুতাতে গাঁথা মালা। আঘাত-ব্যাঘাতের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া পুঁতি থেকে পুঁতিতে, জীব থেকে জীবে চলছেআলোর বেগে; কালোর বেগে।

আজিরুর ভাবনার ভেতর ডুবে থাকতে থাকতে বাম হাতের দুআঙুলের আগা দিয়ে লিঙ্গের গলা ধরেবসেই আছে। লিঙ্গমুণ্ডটার দিকে স্থিরচিত্তে তাকিয়েই আছে; একেবারে একদৃষ্টে, চোখের পলক পড়ে কিপড়ে না । অদ্ভুত একটা জিনিস এ শিশ্ন। মানুষজীবে এ যেন এক আলাদা জীব। এর হুঁশ জ্ঞান সবইআছে। ক্ষুৎপিপাসা আছে। এর আলাদা ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে, আলাদা চলন ফেরন আছে। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে জ্ঞান ফেরা বুনো জীবের মতো ছটফট করে, চোরাবালিতেপড়া বুনো হরিণের মতো ছটফটিয়ে বেরিয়ে পড়তে চায়। শরীর থেকে বের হতে গিয়ে যেন এ শিশ্নজীবআটকা পড়ে গেছে। ছটফট করে, বের হতে পারে না। আহা এ শিশ্নজীব যদি শরীরের মাংসকাদা থেকেবেরিয়ে চলে যেতে পারত কতই না ভালো হতো। এভাবে মনে মনে ভাবনার জাবনা চিবুতেই থাকেআজিরুর। এ মগজ যেন একটা গরু সবসময় ভাবনার জাবনা চিবোয় বা জাবর কাটে, এক মুহূর্তবিরাম নাই।

তার শিশ্ন এক প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো ঝুলে আছে, বিস্ময়বোধক চিহ্নের মতো ঝুলে আছে। এর কাজমূত্রত্যাগ করা আর বীর্যত্যাগ করা। একটা মানুষ সারাজীবনে যতবার মূত্র ত্যাগ করে ততবার বীর্য ত্যাগকরে না। কিন্তু বীর্য ত্যাগ করার কারণে বা বীর্য ত্যাগের বাসনার কারণে কতকিছু ঘটে যায় পৃথিবীতে।বীর্য ত্যাগের বাসনা বাস্তবায়িত করার জন্য যতকিছু ঘটে মূত্রচাপ থেকে মুক্ত হবার জন্য তেমন কোনোচাপে পড়তে হয় না, তাপে পড়তে হয় না। বীর্য ত্যাগে সেরা সুখ জন্মে, সেরা লজ্জা জন্মে, সেরা ফ্যাসাদজন্মে, সেরা যুদ্ধ জন্মে। সঙ্গমই সুখরাজ। অথচ সুখরাজাই সবচে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে জীবনে। সঙ্গমইসুখকাজ। অথচ এর আয়ু খুব কম কিন্তু আগে আর পরের বিড়ম্বনা অশেষ।

লিঙ্গ ধরে সে বসেই আছে একথা মনে পড়লে তার একটু লজ্জা হয়। লজ্জা লাগছে এই ভেবে যে,লিঙ্গটা কি তাকে অন্যকিছু ভাবছে, খারাপ কিছু? ঘিনঘিনে চরিত্রের ভাবছে? ‘আমার শিশ্ন আমাকেনিয়ে কি ভাবছে ভাবুক’ মনে মনে বলে, সে লিঙ্গমুণ্ডের দিকে আরও ভালো করে তাকায়। দেখেলিঙ্গমুণ্ডের চোখে অশ্রুবিন্দুর মতো মূত্রবিন্দু লেগে আছে। সে খুব আস্তে করে শাহাদত আঙুল দিয়েআলতোভাবে টোকা দেয়। ফোঁটাটা ঝরে যায় আর সাথে সাথেই আরও একটা মূত্র-ফোঁটা, মূত্রবিন্দুতার শিশ্নের মাথায় উপস্থিত হয়। মূত্রবিন্দুটা একটা তারকা বা চন্দ্র বা সূর্য বা পৃথিবী বা গলা থেকেবিচ্ছিন্ন হওয়া মানুষের মাথা যেন। সে ভাবে বিন্দু নিয়ে। বিন্দু একটা বিন্দু। জগৎ একটা বিন্দু- জগতবিন্দু। মহাজগত একটা বিন্দু- মহাজগতবিন্দু। প্রতিটা কিছুই বিন্দু। বিন্দুর পর বিন্দু সাজানোআছে, বিন্দুর পর বিন্দু জোড়া দিয়ে জগৎ জোড়া, মহাজগৎ গড়া। সূর্যবিন্দু, চন্দ্রবিন্দু, মাথাবিন্দু, স্তনবিন্দু, মায়ের বুকের দুধবিন্দু, গাছের ফল আপেল-কমলা-বরই-বাতাবিবিন্দু। সবই বিন্দু। সূর্য বিশালকারও শিশ্নের মাথায় লেগে থাকা বিন্দু, চন্দ্র অন্য কারও শিশ্নের মাথায় লেগে থাকা বিন্দু; যেমনভাবেআজিরুরের শিশ্নমুণ্ডে মূত্রকণা একটা বিন্দু।

লিঙ্গমুণ্ডে একটা ঢিল চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায় আজিরুর। দাঁড়িয়েও সে লুঙ্গির নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়েঢ্যালার কুলুখ শিশ্নমুণ্ডে চেপে ধরে থাকে। যখন তার মনে হলো, বিন্দুমাত্র মূত্রবিন্দু বের হবে না তখনসে ঢিলটা ছুঁড়ে মারল খানিকটা দূরে। মাটিতে পড়ার সাথে সাথে ঢিলটাও তার পতনের শব্দ ছুঁড়েমারল আজিরুরের কানে।

শব্দ-ঢিল তার কানে এসে পড়া মাত্র আজিরুরের মনে হলো, এই মূত্রমাখা ঢিল হয়তো কোনো পোকারউপর পড়ল আর তার জান কেড়ে নিল; কোনো ব্যাঙের উপর পড়ল আর তার ঠ্যাঙের হাড় ভেঙে গেল; কোনো ঘুমন্ত ঘাসফড়িংয়ের উপর পড়ল আর তার মাথা থেঁতলে গেল বা কোনো ইঁদুরের উপর পড়লআর একটা চোখ গলে গেল। আচ্ছা মূত্র ত্যাগের ফলে তৈরি হওয়া মূত্রনদী কি কিছু পোকামাকড়কেবাস্তুহারা করে দেয়নি বা তার মূত্রনদীতে হাবুডুবু খেয়ে হাঁসফাস করতে করতে মারা যায়নি? সে তারজোছনা শোভাবিত মাটির উপর শুকিয়ে যাওয়া মূত্রনদীর সোঁতার দিকে তাকাল।

চাপা কণ্ঠ ভেসে আসে- ‘এদিকে রে সাবিরুল, এদিক দিয়্যা আয়।’ আজিরুর সচকিত হয়ে ওঠে, সেজঙ্গুলে পথের ঘন গাছালির আলো-আঁধারির ভেতর দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। দেখতে পায় না। সে চোখবড়ো করে। চোখ বড়ো হয় কিন্তু দেখতে না-পাওয়াটা ছোটো হয় না।

সে যেখানে মুততে বসেছিল তার বামদিকেই বেশ বড়ো আর লম্বাই-চওড়াই মাঠ, তারপর নদী- মহানন্দানদী। আজিরুর যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে দিনের বেলা দাঁড়ালে মহানন্দার জল দেখা যায়,পাশবালিশের মতো মোটা মোটা ঢেউ তার। সূর্যরস পড়ে নদীরস ঝকঝক করে, মাঝেমাঝে শিশুকেরপিঠ উলটানো দেখা যায়। এখন নদীটা তার নিজের খাদখোলসেই ঢুকে আছে, নদীর জল বেঁটে হয়েআছে। মাসখানেক পরই বর্ষাকাল, তখন মহানন্দা আবার জলবন্ত হয়ে উঠবে, জল মাথা উঁচু করেদাঁড়াবে; দেবদারুর পাতার মতো এখনের সরু সরু ঢেউয়ের বদলে মোটা গাছের গুড়ির মতো মোটামোটা ঢেউ জন্ম নেবে। চাপা কণ্ঠস্বর যেদিক থেকে এসেছিল সেদিক থেকে আবার চাপা স্বর ভেসেআসে। সচকিতে আবার তাকায় আজিরুর। চলন্ত চাপা স্বর। স্বর এগিয়ে আসছে তার দিকেই। সে মনেমনে বুঝার চেষ্টা করে কারা ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে আসছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সে কয়েকটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। চন্দ্ররসের ভেতর দিয়ে ছায়ারা মালমাত্তা ঠাসাভারি সাইকেল ঠেলে প্রাণপণে হাঁটছে। সে অবাক হয়ে যায়, এই ব্যাপারটা বুঝতে এতক্ষণ লেগে গেল!মনে মনে বিষণ্ন হাসি হাসে সে, কথাটা ঠিকই- বুড়া হলে ভেড়া। যদিও সে বয়সে বুড়া হয়নি, চুয়াল্লিশবছর বয়স বুড়া হবার বয়স নয়। কিন্তু যার গায়ে জোয়ানি নাই সে-তো বুড়াই, অথর্বতাই তো বুড়ারলক্ষণ। অথর্বতা তাকে বুড়া করে দিয়েছে। এই বয়সেই জ্যান্তে মরা হয়ে গেছে। সে বুড়া হয়ে যাচ্ছে, সেভেড়া হয়ে যাচ্ছে। বেদনায় তার মন ভরে যায়। ছায়াগুলো ধীরে ধীরে কায়া হচ্ছে। আজিরুর বুঝতেপেরে গেছে ওরা বেলাকি। ছায়াশরীরগুলো যখন শরীর হলো, আজিরুর জিজ্ঞাসা করে- ‘কী মাল?’

– ‘চিনি।’ হাঁটতে হাঁটতেই হেঁটে যাওয়াদের একজন উত্তর দেয়। এদের সময়ঘড়ি এবং সর্তকতাঘড়ি চলেসমান তালে। তাদের জোরে চলাটা অবশ্য কর্তব্য। সতর্কতাটা অবশ্য ধর্তব্য। হেঁটে যাওয়ারা হেঁটে চলেগেল। হেঁটে যাওয়ারা হাওয়া হয়ে গেল- যেন ভৌতিক ঘোড়া। আজিরুর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে- সে এখনগতিহারা, বলহারা নিঃস্ব অশ্ব।

এটা সীমান্ত এলাকা। এসব পথ চোরাকারবারিদের স্বর্গের পথ। মর্গেরও পথ। যেকোনো সময় গুলিলেগে সরাসরি পাতালে বা হাসপাতালে যেতে হতে পারে বা ধরা পড়ে বাঁধা পড়তে হতে পারে অন্ধকারজেলপাতালের ঘানিগাছে। আর এসবের কিছুই না হলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তারপর টাকা দিয়ে- যা ইচ্ছেতাই।

সকলেই স্বর্গকামী, মর্গকামী কেউ নাই। তবু তো কতজনকে মর্গে যেতে দেখেছে আজিরুর। সেও তোএকবার যেতে বসেছিল মর্গে; কপাল খারাপ তাই ফিরে এসেছে মর্গের পথ থেকে; মরণ থেকে ফিরেএসেছে জীবনজেল খাটার জন্য।

একবার সে জেলে গেছিল। জেলে যখন যায় সে তখন বিয়ে করেনি, তখন সে অন্যের হয়ে মাল নিয়েআসত। জেলখানা নিদারুণ এক জায়গা, যেন অনেকগুলো মানুষকে একসাথে কবর দেয়া হয়েছে।এখানে বন্দি অপরাধীদের কাছে থেকে নিরপরাধ জেলদারোগাদের ঘুস খেতে দেখেছে। অহেতুক কারণেবা সামান্য কারণে বন্দিদের নির্দয়ভাবে মারতে দেখেছে। আসামিদের খাবারের মান কমিয়ে টাকা মেরেদিতে দেখেছে। মানুষের মাংস খাওয়া নিষেধ কিন্তু মানুষের খাবার মেরে দিয়ে মানুষকে স্বাস্থ্যহীন করেদেওয়া কি মানুষের মাংস খাওয়ার সমান নয়? মাঝে মাঝে নিরপরাধ বড়ো বড়ো অফিসার স্যারেরাআসামিদের দেখতে আসে। তারা আসামিদের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন পোক খাওয়া পেয়ারা বাপচা পটোল দেখছে। যেন গু দেখছে। আহা জেলখানা যেন পায়খানা, আসামি যেন মানুষ নয় গুনুষ বাগুমানুষ। মানবশরীরে যেমন মল উৎপন্ন হয় মানবসমাজে তেমন মলমানুষ তৈরি হয়। জেলে থাকারাযেন সেসব গুমানুষ। অথচ আসল অপরাধীরা থেকে যায় বাইরে। আসল অপরাধীদের কাছ থেকেইকিনে আনা হয় জেলখানার তালা। আজিরুরকে জেলে রেখে ঠিকই তার মালিক মাল ছাড়িয়েনিয়েছিল। তার জায়গায় আরেকজনকে নিয়োগ দিয়ে দিয়েছিল। আজিরুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দীর্ঘশ্বাসেরছাই দিয়ে জেলখানার স্মৃতিতাপ ঢেকে নেয়।

এ মর্গরূপ বা স্বর্গরূপ চোরাপথে ভারত থেকে চোরাই মাল আসে। এখানের অনেক পরিবারইচোরাচালানের সাথে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। কেউ মূলধন খাটায়- তারা মালিক। কেউ মজুরাতেটাকাওয়ালার হয়ে কাজ করে। যখন প্রশাসনের কড়াকড়ি চলে তখন মালমাত্তা সমেত মজুরদের কেউকেউ নিজের বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে এবং এর বিনিময়ে টাকা নেয়। কেউ মালমাত্তা রাখারজন্য গোডাউন ভাড়া দেয়। কেউ কেউ গোয়েন্দাগিরি করে- সীমান্তরক্ষী বা পুলিশের অবস্থানেরখবরাখবর চালান করে চোরাচালানকারীদের কাছে। এর বাইরেও আরেক ধরনের লোক আছে। এরাপুলিশের চেয়েও ভয়ানক, মারাত্মক রকমের ক্ষয়ানক। ঘুস দিয়ে পুলিশের হাত হতে তবু রক্ষা পাওয়াযায় কিন্তু এদের হাতে পড়লে রক্ষা নাই। এরা ডাকাত, চোখা চোখা ছুরি-ছোরা বা কাস্তে কাতান নিয়েবড়ো বড়ো গাছের আড়ে বা উপরে লুকিয়ে বসে থাকে। এরা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে মালমাত্তা কেড়েনেয়, জখম করে দেয়, কখনও কখনও বা মেরেও ফেলে। এপার ওপার দুপারেই এমন কুপোকাত করারমতো ডাকাতদল আছে।

আজিরুর রোজের মতো আজও তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গেছিল। মূত্রের চাপে এই মাঝরাতে তার ঘুমেরসুতা কেটে গেছে। বহুদিন ধরে শিশ্নে মূত্রচাপ ব্যতীত অন্যচাপ অনুভূত হয়নি, অন্য কোনো কাজেলাগেনি। আজিরুরের এখন অনেকক্ষণ ঘুম হবে না। কোমর হতে একটা বিড়ি বের করে ধরায়। তারঘরের পিছন দিয়ে আরও কয়েকটা দল, কয়েকটা দলের মানুষের শরীর ছায়া হয়ে মিলিয়ে গেল। সেধীরে ধীরে বিড়িতে টান দেয়। বিড়িতে টান দিলে বিড়ির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। টান না দিলে মুখ ছাইকরে থাকে। একটা বড়োসড়ো জুনিপোকার মতো তার বিড়ি জ্বলছে। বিড়ি জ্বলছে অন্ধকারের নাভিরমতো। তার ভেতর স্মৃতিপোকা নড়েচড়ে ওঠে। স্মৃতিজন্তুরা তাকে থাপড়ে আছড়ে বিহ্বল করে তোলে। সেস্মৃতির হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়। স্মৃতি তাকে মুক্তি দিতে চায় না। ‘ও রে স্মৃতি, তোর মুখে মুতি’ কথাটি অস্ফুটে উচ্চারণ করে মুখে জমা হওয়া ছ্যাপ সজোরে দূরে নিক্ষেপ করে। এমনভাবে নিক্ষেপকরে যেন স্মৃতিগুলো তরল থুথু। স্মৃতিথুথুকে এমনভাবে ফেলে দিতে চাচ্ছে যেন আর ফিরে না আসতেপারে। কিন্তু স্মৃতি আরও বেশি করে চেপে ধরে তাকে। স্মৃতি তো পোষাজীব নয়, স্মৃতি বুনোজীব।বুনোস্মৃতি মগজ-বনে, জীবন-বনে ইচ্ছেমতো দাপাদাপি করে অস্থির করে তোলে, যেমনভাবে মানুষেরমাথার চুল-বনে লুকিয়ে থেকে উকুনেরা রক্ত চুষে বেড়ায়।

আজিরুর চোরাচালানে যুক্ত ছিল এখন ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। শরীরে কুলায় না। মনে কুলায় না। এসবকাজে শক্তি লাগে, সাহস লাগে। যখন সে এ লাইনে নামে তখন ছিল কাঁচা বয়স, শরীরে তাকত ছিলহাতির মতো, বুকের ছাতি ছিল বড়ো। আজিরুর নিজের পুঁজিতে ব্যবসা করত না, অন্যের মাল বহনকরত মজুরাতে। কিন্তু ঐ যে জেল খাটল তারপর অন্যের মাল বওয়া বাদ দিল। তাছাড়া বিয়ে করারপর, পরের মাল বয়ে সংসার চালানোও কঠিন। নিজে যে সামান্য কিছু টাকা জমিয়েছিল সেটাকেই পুঁজিকরে নিজেই মজুর নিজেই মালিক হয়ে চোরাকারবার শুরু করেছিল। ওপার থেকে মাল এনে নিজেইব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি করত। এতে আয় রোজগার হতো বেশি। তার অবস্থা সচ্ছলতার পথ ধরেছিল।ভেবেছিল বাড়িটা পাকা করবে। কিন্তু ভাবলেই তো হয় না, নিয়তি আছে নিয়তি, অমোঘ নিয়তি।অমোঘ নিয়তির তির তার ভাবনাকে, জীবনকে মোঘ করে দিলো। এমনিতেই মানুষের জীবন মোঘতামাখা। আজিরুরের নিয়তি আজিরুরের মোঘ জীবনের সাথে বিপরীত রতি করে নিল জোর করে।আবার ব্যথাটা চাগিয়ে উঠছে, তার ভাবনা কেটে গেল। ব্যথাজলে তার মন ডুবে গেল।

রাতটা স্থির হয়ে আছে। সেও স্থির হয়ে আছে কিন্তু ভেতরটা বড়ো অস্থির। একটা মোটা শুকনো গাছেরগুড়ির উপর বসে আজিরুর। বসে বসে বিড়ি টানে। খুকখুক করে কাশে। একটা গোধা হেলতে দুলতেআসছিল- গোধা কামড়াতে পারে না কিন্তু এরা মানুষের মতো ছ্যাপ ছিটাতে পারে, গোধা সাপ শত্রুরগায়ে জোরে ছ্যাপ ছিটিয়ে পালিয়ে যায়, যেখানে ছ্যাপ লাগে সেখানটা পচে যায় নাকি। তার কাশিরখুকখুকানি শুনে যেদিক থেকে আসছিল সেদিকেই গোধাটা দৌড়ে চলে গেল। আজিরুর ঘেঁটুবনের দিকেতাকাল, থোকা থোকা জুনিপোকা আলোর কুচির মতো অস্থিরভাবে জ্বলে জ্বলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।শুয়োরগুলোর ঘোঁৎঘোতানি আর শোনা যাচ্ছে না।

আজিরুর দেখল, চারজনের আরও একটা দল চিনির বস্তা, মসলার বস্তানি সাইকেলে চাপিয়ে হনহনকরে চলে গেল। এখন চোরাইপথে চিনি আসছে বেশি- সাদা চিনির সাথে সাথে লালচে দলুয়া চিনিওআসছে। সবসময় সবকিছুই আসে কিন্তু কোনো কোনো সময় কোনো কোনো জিনিসের স্রোতটা বেশিনামে। সে যখন ব্ল্যাক করত তখন চিনি, লবণ তো আসতই আরও আসত ভিসিপি, সাইকেল, শাড়ি,টিনের থালা বাটি গামলা, হেরোয়িন, গাঁজা, গোরু আরও কত মুতফরাক্কা জিনিসপত্র। ভিসিপি, গরমমসলা আর নেশাভাঙের জিনিসে লাভ ছিল বেশি। আজিরুর কখনও ভিসিপি আবার কখনও গরমমসলার ব্ল্যাক করত। প্রচুর টাকা আসছিল। শুধু সে নয় আরও কত লোক এই ব্ল্যাক করে কত কতটাকার মালিক হলো, গাড়ি বাড়ির মালিক হলো তার হিসাব নাই। তাদের এখন অনেকেই বিশিষ্টসমাজসেবী হিসেবে নাম ফুটিয়েছে। অনেকেই বড়ো বড়ো নেতা। তারা মেম্বার থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছে।এখনো তাদের অনেকেই চোরাচালানের সাথে যুক্ত আছে গোপনে, বেনামে।

আজিরুর সারারাত মাল আনা নেওয়া করত। ভোররাতের দিকে মাল বেচাকেনা শেষে ফিরত। ঢুলুঢুলুচোখে দুয়োর খুলে দিত রাঙাবউ। আজিরুর কিছু একটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, উঠত একেবারেদুপুরবেলা। নতুন বিয়ে তখন। রাঙাবউয়ের দুধে আলতা রঙ, মায়াময় মুখ। নতুন শরীরের নতুনশাড়ির গন্ধ ছড়িয়ে হাঁটাহাঁটি করে। ঘোমটা টেনে আঙিনায় বসে মাছ কাটে, আলু বেগুন কাটে।রান্নাবান্না করে। তাকে খুব ভালোবাসে সে। সেও খুব ভালোবাসে তাকে।

হেঁশেল থেকে রান্না করা মাছের গন্ধ ভেসে আসত, শাকপাতা তেলে ছাড়ার চড়বড় শব্দ ভেসে আসত।রান্নার চড়বড়ে শব্দে আজিরুরের ঘুমের খুঁটি নড়বড়ে হয়ে যেত। দূরের মুচকুন্দ কী শিরীষ কী ছাতিম কীকোন গাছ থেকে বেনেবউ পাখি ডেকে উঠত। আজিরুরের নড়বড়ে ঘুম ভেঙে যেত। রাঙাবউয়ের চুড়িররিননিন শব্দ তার কানের কাছে এসে নাচত। বিছানা ছেড়ে সে চুপি চুপি গিয়ে রান্নারত রাঙাবউয়েরকোমরে টোকা দিয়ে পিছিয়ে দ্রুত দুয়োরের আড়ালে লুকিয়ে যেত। রাঙাবউ ভয় পেয়ে চিৎকার করেখোরশোলা মাছের মতো বাতাসে সাঁতরে বেরিয়ে ঢুকে পড়ত শোবার ঘরে। কেড়াপোকা বা আরশোলাদেখলেও সে এমন করে খোরশোলা মাছের মতো বাতাসে সাঁতার কেটে পালিয়ে তার বুকে এসে ঝাঁপিয়েপড়ত, বাতাস লাগা বাবুই ঘাসের মতো কাঁপত। বড়ো ভালো লাগত তার।

আজিজুরের চোখ বন্ধ হয়ে আসে, মনে পড়ে- সে দুয়োরের আড়ালে লুকিয়ে থাকত। ঘরে গিয়ে রাঙাবউআজিরুরকে দেখতে না পেয়ে পিছন ফিরতে যেতেই আজিরুর তাকে জড়িয়ে ধরে গড়িয়ে পড়ত বিছানে,রাঙাবউ হাসতে হাসতে কেঁচোর মতো আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে আজিরুরের বাহু থেকে পিছলে বের হয়ে যেতেচাইত। পারত না। হাসতে হাসতে হার মানত, হার হতো আজিরুরের গলাতে। কাচের চুড়ি পটপট করেভেঙে যেত। রাঙাবউয়ের হাত কাটত সে বুঝতে পারত না। আজিরুরের হাত কাটত সে বুঝতে পারতনা। হেঁশেল থেকে কোনোদিন ভাতপোড়ার গন্ধ, কোনোদিন তরকারি পোড়ার গন্ধ ভেসে আসত। এসবগন্ধ তাদের নাকে লাগত না।

পরে ভাত তরকারি পোড়ার জন্য রাঙাবউ আজিরুরকে দোষ দিত- ‘তোমার জন্যই রান্না পুড়ে গেল।’ আজিরুর হেসে বলত- ‘পোড়া তরকারি দিয়ে পোড়া ভাত খাইতে কত্ত মজা, দেখ দেখ’ বলে তুলে দিতরাঙাবউয়ের মুখে। হা হা করে হাসত। হাসি শুনে গাছ থেকে বেনেবউ উড়াল দিয়ে কোনদিকে উড়ে যেত।

দুপুরের পরে থেকে রাত নটা দশটা পর্যন্ত বউয়ের সাথে সদরে অন্দরে, আদরে আদরে, চাদরে চাদরেসময় কাটাত। আনন্দময় সময় ছিল। এমন মধুময় সময় ছিল তিনবছর পর্যন্ত।

তারপর কাঁটাতারের বেড়া বসে যায় সীমান্তের সীমন্তে। আগেও বেড়া ছিল তবে সে সীমান্তের যে পয়েন্টদিয়ে ব্ল্যাক করত সেখানে ছিল না। অবশ্য তার পয়েন্টে বেড়া বসার কয়েকদিন পরই যাওয়া আসারপথ জন্মে যায়। কাঁটাতারের কাঁটা কেটে, তার কেটে তৈরি হয় যাওয়া আসার ছোটো ছোটো সূর্যাকারপথ। কাঁটাতারের এসব সূর্যের মতো গোল গোল ফুটো দিয়ে কেউ হামা দিয়ে যখন মাথা, বুক, হাত, পাবের করে ধীরে ধীরে পুরো বের হয় তখন দেখে মনে হয়, একটা মানুষ যেন মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়েআসছে পৃথিবীতে বা পৃথিবী থেকে বেরিয়ে কবরগর্ভে প্রবেশ করছে।

কাঁটাতারের বেড়া-কাটা-পথ বের হবার পর পুরোদমে আবার চোরাচালানি চলছিল। তারও চলছিলবেশ। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া একদিন তাকে একেবারে থামিয়ে দেয়। এ স্মৃতি সে মনে করতে চায় না।স্মৃতিভীতি আছে। এ স্মৃতিভীতি থেকে মুক্তি পাবার জন্য, স্মৃতি মনে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাবারজন্য সে উঠে দাঁড়ায়। আবার বসে। পুরাতন বিড়ি ফেলে নতুন বিড়ি জ্বালায়। বসে থাকে।

বসে থাকতে থাকতে আজিরুরের আবার মূত্রচাপ আসে। সে যে বিড়িটা টানছিল সেটাতে জোরে জোরেদুটা টান দিয়ে ফেলে দেয়। দূর্বাঘাসের উপর জ্বলন্ত বিড়ি বড়োসড়ো জুনিপোকার মতো জ্বলছে। বিড়িফেলার পরই তার খারাপ লাগে, বিড়ির আগুন কোন পিঁপড়ের চিতা হয়ে গেল, কোন পতঙ্গের পাখাপুড়িয়ে তাকে মরার বাড়া কষ্টে ফেলে দিলো। বিড়ির ধোঁয়ার স্রোত ঊর্ধ্বমুখে লতিয়ে লতিয়ে উঠে যাচ্ছে।জ্বলন্ত বিড়ির মুখে থুথু ফেলার জন্য সে উঠে দাঁড়াল খুব ধীরে।

চলকানো চাঁদনির রাত তবু সে যেখানে পূর্বে মুতেছিল সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় টর্চ হাতে। টর্চ জ্বালায়।টর্চের আলোর সাথে চাঁদের আলো মিশ খায়নি, যেখানে টর্চের আলো পড়েছে সেখান থেকে চাঁদেরআলো সরে গেছে অথবা চাঁদের আলোকে টর্চের আলো এমনভাবে খেয়ে ফেলেছে যে তার ধর্ম তার মর্মতার নর্ম তার কর্ম আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। কোনো আলো কোনো আলোর সাথে মিশ খায় না,কোনো আলো কোনো আলোর সাথে বাস করতে পারে না বা এক আলো আরেক আলোকে খেয়েফেলতে পারে। সে দেখল, দেহপর্বত থেকে মুতের প্রধান গতিটা যেখানে পড়েছিল সে জায়গাটা গর্ত হয়েআছে। গর্তটা দেখে তার ভালো লাগে। নাভির মতো গোল গর্ত। সে নাভিগোল গর্তের দিকে তাকিয়েথাকে। পূর্বের মুত শুকিয়ে গেছে, কিছু কিছু শুকনো ফেনা এখনও আছে। সে লিঙ্গ বামহাতে ধরে বসেপড়ে। পূর্বের গর্ত লক্ষ্য করে আবার মুততে শুরু করে। বেগে বেরিয়ে আসছে মূত্র। মূত্র যেনঅ্যালুমিনিয়াম তারের মতো নরম কিন্তু কঠিন একখণ্ড দণ্ড। মাটির সাথে মুতের সংঘর্ষের ফলে শব্দতৈরি হয়, আগের কয়েনের সমান মূত্রখাল আরও বড়ো হয়, বড়ো হয়ে ক্যারমের গুটির সমান প্রায় হয়েযায়। সাবানের ফেনার মতো ফেনা তৈরি হয়, সমুদ্রের মতো ফেনা তৈরি হয়। তার ভালো লাগে। মাটিতেমুতার মজাই আলাদা। প্রত্যেক মানুষের জীবনে একবার হলেও নরম মাটিতে মুতা দরকার। নরমমাটিতে মুতলে একই সাথে নিজের মুতের গন্ধ, গান আর সাবানফেনা বা সমুদ্রফেনা দেখার মজাপাওয়া যায়। কোনো কাঁচা বা পাকা পায়খানা বা বাথরুমে এ মজা পাওয়া যাবে না।

মুতের ঝাঁঝালো গন্ধ তার দশপাশে গজখানেক পরিধিতে বিরাজ করছে। মুতের গন্ধ তার খারাপলাগছে তারপরেও উঠে যায় না। বামহাতে লিঙ্গের ঘাড় ধরে বসে আছে। লিঙ্গের মুখে লেগে থাকাঅশ্রুবিন্দুর দিকে চেয়ে থাকে বহুক্ষণ। চকচকে স্বচ্ছ মূত্রবিন্দু। একটা আঙুলের টোকা দিলেই ঝরেপড়বে। সাথে সাথে মাটির সাথে মিশে যাবে। সে আস্তে করে টোকা দেয়। মূত্রবিন্দুর ঝরে পড়া দেখে,মাটির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া দেখে। আসলে মানুষের মূত্র তিনভাগে ভাগ হয়ে যায়। মূত্রের বেশিরভাগটামাটি শুষে নেয়, কিছুটা বাতাসে গন্ধ হয়ে উড়ে যায়, আকাশের চাঁদ তারার গায়ে লেগে যায়, অন্যমানুষের শ্বাসের সাথে ঢুকে যায় আবার আর কিছুটা নিজের ভেতরেই থেকে যায়।

কুকুরের জিবের আগায় ঝুলে থাকা লালার মতো মনে হচ্ছে মূত্রবিন্দুকে। তার নিজেকে ঐ মূত্রবিন্দুরমতো মনে হয়। টুপ করে ঝরে পড়লেই মাটির সাথে মিশে যাবে। মানুষ জগতশিশ্নের আগায় থাকা শেষমূত্রবিন্দু, হঠাৎ ঝরে গিয়ে মাটিতে মিলিয়ে যায়, মিলিয়ে যাবে। সে তার লিঙ্গের দিকে আরোক্ষণতাকায়। লিঙ্গের লম্বালম্বি দাগটা পষ্ট চোখে পড়ে। তার লিঙ্গ লম্বালম্বি ফেড়ে প্রায় দুভাগ হয়ে গেছিল।এ স্মৃতি সে মনে করতে চায় না। তবু চলে আসছে অপ্রতিরোধ্য জোয়ারের জলের মতো।

তার মনে পড়ছে, বউয়ের সাথে শেষবারের মতো মিলিত হয়েছিল সেদিন। মিলনের পর, বাড়ি থেকে বেরহয়ে দেখে, তাতিন, মদুল, মিলু, দিলবর আর সোনাব্বের দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখে চাপা হাসি। ঘরেরফাঁকফোঁকর দিয়ে তারা কিছু দেখে নিয়েছে নাকি! সেও তো কতবার মদুলকে ডাকতে গিয়ে ঘরের ফাঁকদিয়ে তার বউয়ের উপর চড়নরত অবস্থায় দেখে নিয়েছে। তখন সে বিয়ে করেনি। সে মদুলের দিকেতাকায়। মদুলের মুখও হাসি হাসি। আজিরুর লজ্জা পায়। আর কারও দিকে না তাকিয়েই কথার কথাবলে- ‘তোরা চলে এসেছিস! চল চল দেরি হয়ে গেল। বেশি দেরি হলে বেশি দেরি হবে। বেশি দেরি হলেকম দেরি হবে না।’ তার হড়বড় করে বলা কথা শুনে সকলেই হেসে উঠেছিল।

সেদিনও ছিল চলকানো চাঁদনির রাত। তারা সীমান্তের দিকে হেঁটে রওয়ানা দেয়। সতর্ক পা, সতর্কশ্বাস-প্রশ্বাস, সতর্ক একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি। মুখে কোনো কথা কওয়াকওয়ি নাই। মুখের কাজনাই তাদের। মুখ যেন খুলে রেখে এসেছে বাড়ির আলমারিতে বা মুখ খুলে রেখেছে তাদের চোরাপকেটেএকান্ত প্রয়োজন হলে বের করে কথা বলবে। মালকোঁচা মেরে হাঁটে। চারদিকে সতর্ক অন্ধকার, সতর্কচাঁদের আলো। যত সীমান্তের কাছে যায় তত বেশি সবকিছু সতর্ক হয়ে ওঠে। সতর্ক চাঁদ, সতর্ক তারচাঁদনি। চাঁদনি মেখে রাতটা সতর্কভাবে টলটল করছে। তারা যতটা সম্ভব শুধুমাত্র গাছের ছায়ার ভেতরদিয়ে হেঁটে যাবার চেষ্টা করে। ছায়ার নিচে থাকলে ছায়া পড়ে না, আলোর নিচে থাকলে ছায়া পড়ে।ঠান্ডা ও সতর্ক ছায়াগুলোকে তাদের জীবন্ত মনে হয়, আত্মীয়ের মতো মনে হয়।

ছায়ার ভেতর দিয়ে ছায়া হয়ে সীমান্তের কাছে আজিরুরেরা চলে এসেছিল। সীমান্তের কাছে আসার পর, তারা সতর্ক হয়ে এদিক ওদিক দেখে নিয়েছিল, মালকোঁচা ভালো করে এঁটে নিয়েছিল। পুলসিরাত পারহবার মতো প্রস্তুতি যেন। কাঁটাতার কাটা পার হবার পথ একেকটা একেকরকম। কোনোটা দিয়ে আগেদুহাত পার করে মাথা গলাতে হয় তারপর আস্তে আস্তে হাতের ভরে এগিয়ে প্রথমে এক পা তারপরপরের পা ঢুকিয়ে বেরুতে হয়। এসময় চার হাত পায়ে চলা মানুষকে ছোটোখাটো গরু বা বড়োসড়োশেয়ালের মতো মনে হয়। কোনো কোনো পথ দিয়ে পার হতে হয় সরীসৃপের মতো বুকের ভরে। যে পথদিয়ে সরীসৃপের মতো পার হতে হয় সে পথ দিয়ে চারপেয়ে গোরু বা শেয়ালের মতো পার হতে গেলে পিঠফেড়ে ফালাফালা হয়ে যাবে আর যে পথ দিয়ে চারপেয়ে গোরু বা শেয়ালের মতো করে পার হতে হয় সেপথ দিয়ে সরীসৃপের মতো করে পার হতে গেলে চরম বিপদ আছে।

কাঁটাতারের ফাঁক গলে চতুষ্পদরূপে সব আগে আজিরুর পার হয়েছিল, তারপর তাতিন। অন্য ফুটোদিয়ে সরীসৃপরূপ ধরে মিলু, তারপর মদুল, তারপর আর সব

ভারতের মাটিতে পা দিয়েই সতর্কভাবে এদিক ওদিক আবার দেখে। একই অন্ধকার, একই জোছনা, একই মাটি, একই জঙ্গল আর জুনিপোকা। সীমান্তরক্ষীদের দেখা যাচ্ছিল না। পিছন ফিরে তারাকাঁটাতারের বেড়া দেখে। বেড়ার ফাঁক দেখে। এসব দেখে জোছনা এড়িয়ে গাছের ঘন ছায়ার নিচ দিয়েএগোতে থাকে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তারা একটা লোকালয়ে পৌঁছে। লোকালয় ঘুমুচ্ছে। লোকালয়তখন পোকালয়। অজস্র রকমের পোকার অজস্র রকমের বিরতিহীন ডাক। ভারতের চোরাকারবারিরামাল নিয়ে অপেক্ষা করছে কোনো এক চোরাগলিতে বা গভীর ছায়ার ভেতর। তারা অন্ধকারের থেকেআরও ঘন অন্ধকার খুঁজে বের করতে পারে। সেদিন, তখনও তাদের সংকেত পাওয়া যায়নি। তবে শ্রীঘ্রইপাওয়া যাবে। এগুলোতে মোটেও দেরি হয় না। লেনাদেনা খুব দ্রুত ঘটে- দ্রুত মানুষ জমা হয়, দ্রুতফাঁকা হয়ে যায়। একেবারে ভোজবাজির মতো কারবার। তারা তাদের সংকেতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলনিজেদেরকে যতটা সম্ভব অন্ধকারের সাথে মিশিয়ে দিয়ে।

এসব স্মৃতিপথে আর একধাপও হাঁটতে চায় না আজিরুর তবু চলে আসছে। সে স্মৃতির দিক হতে পুবদিকে মুখ ঘুরায়; পশ্চিম দিকে ঘুরায়, উত্তর দিকে ঘুরায়, দক্ষিণ দিকে ঘুরায়। কাজ হয় না।

স্মৃতিবিমুখ হবার জন্য আজিরুর মুখ উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদ আর অজস্র তারা তাদেরআলোর ধারা নিয়ে আকাশকে সাজিয়ে রেখেছে, বাজিয়ে রেখেছে নিঃশব্দ সংগীত। আকাশের গভীরগান তার প্রাণ ধরে টান দেয়। সে মুখ আরও বেশি উঁচু করে তার নিজের খবিন্দুর দিকে তাকাল।মহাবিশাল আকাশের গায়ে এই ক্ষুদ্র মানুষের জন্যও একটা জায়গা আছে। মাথার উপর একটা বাঁশতার উপর আরেকটা বাঁশ তার উপর আরেকটা, এভাবে বাঁশের পর বাঁশ সাজালে আকাশের যেজায়গাটাতে ঠেকবে সেই বিন্দুটা ক্ষুদ্র মানুষের উপরসীমার বিন্দু। এটা খবিন্দু, এটা সুবিন্দু। আকাশেরএ বিন্দু একটা মানুষের একেবারে নিজস্ব। মানুষ যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে পুরো ভর নিয়ে সেটা ভবিন্দু বাভূবিন্দু। মানুষের নাভি থেকে একেবারে সামনে যতদূরে গিয়ে সুতা ঠেকবে সেটা নাবিন্দু, সে তারনাবিন্দুর দিকে তাকাল, নাবিন্দুর কাছে একটা খাটাশ দেখতে পেল, খাটাশের চোখ জ্বলজ্বল করেজ্বলছে। নাভির বিপরীত দিক থেকে পিছনের দিকে গিয়ে যেখানে সুতা ঠেকবে সেটা পিবিন্দু, পিবিন্দুরসাথে কোনোদিন কারও দেখা হয় না, যারা পিবিন্দুর নড়াচড়া বুঝতে পারে তারা অন্যমানুষ, তারাসাধারণ মানুষ নয়, আজিরুর পিবিন্দুর নড়াচড়া, ভাঙাগড়া কোনোদিন দেখতে পায়নি। মাজারডানদিক থেকে সুতো যেখানে ঠেকবে সেটা ডাবিন্দু, সে তার ডাবিন্দুর দিকে তাকাল, তার ডাবিন্দু খুবকাছেই, যেখান থেকে কিছুক্ষণ আগে শুয়োর বেরিয়ে গেছে সে সবজির খেতে আছে, সে সেখানে শখকরে রাংচিতা আর বাঁশের বেড়া দিয়ে পুনকে, পালং, টকপালং আর দুএকটা ঔষধি গাছ লাগাত, এখনএসবের কিছুই নাই, বেড়া ভেঙে গেছে, বাগানের একপাশে মানুষ সমান উঁচু একটা রাধাচূড়া আরেক পাশে একটা কৃষ্ণচূড়া কখন কখন বেড়ে উঠেছে আর মাঝখানের ফাঁকা জায়গা জুড়ে কুকুরচূড়া, দুলফি, ঢেঁকিশাক, বনমরিচ, বনকচু, ঘোড়াদুবোহর আরও কতসব ঘাসাগাছা। এসবের শেকড়বাকড় উখড়েখেতেই খেতে ঢুকে শুয়োর। মাজার বামদিক থেকে সুতা ধরলে সে সুতা যেখানে গিয়ে ঠেকবে সেটাবাবিন্দু, সে বাবিন্দুর দিকে দেখল, ওদিকে জঙ্গল, তার একেবারে বাবিন্দুতে একটা আমগাছ।আমগাছের যেখানে তার বাবিন্দু সেখানে একটা মাত্র হলুদপাতা। হলুদপাতা চাঁদের আলোতে কুকুরেরজিহ্বার মতো কাঁপছে। এসব বিবিধ বিন্দুর নাম সে শিখেছিল তার নানির কাছে থেকে। আকাশেচাঁদতারার অবস্থান আর নাম, জঙ্গলের গাছগাছড়ার নাম, মেঘের রঙ আর ভাষা আরো কতকিছুআজিরুর শিখেছিল। তার নানির ছিল কয়েকটা পোষা পরি আর জিন। জিনপরিরা আসর করলেনানি অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা করত। কখনও পুকুরে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটত, কখনও বাড়ির পিছনের আসশ্যাওড়ার নিচে বসে একবার হাসত, একবার কাঁদত, কখনও বাড়িরআঙিনায় বসে জ্ঞানী মানুষের মতো এমন সব কথা বলত যা অন্য মানুষেরা কখনও জানত না।

আজিরুর তার খমধ্যর দিকে আবার তাকাল। খবিন্দুর সাথে তার দৃষ্টিবিন্দু অনেকক্ষণ মিলিয়ে রাখল।মনে মনে তার সুবিন্দুতে একটা তারা খুঁজল, কোনো তারা দেখতে পেল না, তার জন্য কোনো তারানাই। হতাশ হয়ে সে সুবিন্দু থেকে সরাসরি ভূবিন্দুর দিকে তাকাল। তার ভূবিন্দুতে ইঁদুরের লাদি পড়েআছে। আজিরুর ব্যথাতুর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, খবিন্দু থেকে ভবিন্দু শুধু ব্যথা ভরা। ডাবিন্দু থেকে বাবিন্দুবিপদে পোরা। নাবিন্দু পর্যন্ত কঠিন পাথর। পিবিন্দু বড়োই অনিশ্চিত, সেদিক থেকে আসা কোনোকিছুর একবিন্দু ইশারা একবিন্দু সময় আগেও জানা যায় না।

রাতের খুব বেশি নাই। রাতের সময়ের একটা একটা করে বিন্দু খুলে যাচ্ছে, তার ঘুম পাচ্ছে না। সেগাছের গুড়িতে বসেই আছে। এর মধ্যে একবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে যাবার জন্য সে গাছের গুড়ি ছেড়েউঠেছিল। দুয়োরের কাছে থেকে ফিরে এসেছে। দুয়োরের মুখেই শুয়োরে হেগে রেখেছে। গুয়ের গন্ধে তারগা ঘিনঘিন করে ওঠে। ‘বালের ঘরেই আর ঢুকব না, দুনিয়ার যেদিকেই যাই, খালি কুকুর, মেকুর আরশূকরে অথবা তাদের গুয়ে ভরে আছে’ মনে মনে বলে ঘৃণা ভরা মন নিয়ে ফিরে এসেছে। এমন বিরক্তিনিয়ে ফিরে এসেছে যেন আর কোনোদিন ঘরে ঢুকবে না।

তার লিঙ্গে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। চলকানো চাঁদনি চকচক করছে। চন্দ্ররসে ভিজে যাচ্ছে নদীনালারজলমালা, বনবাদাড়ের গাছপালা, বাড়িঘরের দেয়াল-চালা। একেবারে দিনের মতোই আলো। সে লুঙ্গিরউপর দিয়েই আলতো করে হাত দেয় ব্যথার উপর। নরমভাবে হাত বোলায়। এ ব্যথা মাঝে মাঝে ওঠে।এ জন্য তার ঘুম ভালো লাগে, ঘুম ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু ঘুম হয় না। ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধদিয়েছিল। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত সে। কিন্তু কয়েক বছর থেকে ঘুমের ওষুধ খেয়েও আর ঘুম হয়না। সে ওষুধের মাত্রা বাড়িয়েছিল। দুটা, তিনটা, চারটা, পাঁচটা বা আরও বেশি কিন্তু ঘুম আসেনি।এসব ঘুমের ওষুধের গায়ে তার ঘুমের নাম লেখা নেই, ঘুমের গায়ে তার নাম লেখা নাই। ওষুধ নিজেইঘুমিয়ে আছে তার টেবিলের ওপর, ওষুধের নাম ঘুমিয়ে আছে ডাক্তারের লেখা কাগজের বিছানায়।

যখন থেকে ওষুধ হয়ে গেছে আটার গোলা তখন থেকে সেই ঘুমগুণহীন ওষুধ খাওয়া বাদ দিয়েছে। সেবুঝে গেছে ওষুধের বোমা মেরে ঘুমকে বশে আনা যাবে না। তারপর থেকে তার শরীর প্রতিদিন একটুএকটু করে নেতিয়ে পড়ছে। জীবন্ত থেকে জড়ন্ত হচ্ছে। জীব থেকে জড় হচ্ছে সে ধীরে ধীরে।

মাঝে মাঝেই অঙ্গটা ব্যথিয়ে ওঠে, ব্যথায় গুঙিয়ে ওঠে। সে আস্তে আস্তে হাত বোলায়। ব্যথা চাগিয়েওঠে। সে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে শিশ্নের ব্যথা সহ্য করে। অদ্ভুত লাগে তার কাছে, যে শিশ্ন তার সীমাহীনআনন্দের উৎস ছিল এখন সেই শিশ্নের ব্যথা সে সহ্য করতে পারছে না। মাঝে মাঝে এত ব্যথা করে যে,খুব ধীরবে সে দীর্ঘোচ্চারণ করে- ‘মরণ আয়।’ মরণ আসেনি। হ্রস্বোচ্চারণ করে- ‘মরণ আয়, ভাইআমার।’ মরণ আসেনি। এখন নীরবে মনোচ্চারণ করল- ‘মরণ আয়, তুই-ই তো আমি, আমিই তোতুই।’

আহত শিশ্নের পিছনে ব্যয় হয়ে গেছে চোরাচালানি করে আয় করা সব টাকা। তাতেও তার মন ভাঙেনিকিন্তু যেদিন তার বউ নোনাবুরের সাথে চলে গেল সেদিন থেকে সে পুরোপুরি ভেঙে গেছে, মনোপুরী মরেগেছে তার। তার বউকে বলেছিল- ‘যেও না বউ, এ অঙ্গ একদিন ঠিকই তোমার অঙ্গের সাথে কথা বলেউঠবে।’ বউ বারণ শুনেনি। তার সামনে দিয়েই মাথা নিচু করে বউ বেরিয়ে গেছিল কোনো কথা নাবলে। তার বউ হয়তো বুঝে গেছিল- এ শিশ্ন নিহত শিশ্ন, এ শিশ্ন আর কোনোদিন জীবিত হবে না; বউবুঝে গেছিল- এ ফর্দাফাঁই মানুষের সাথে থেকে কোনো ফায়দা নাই। জীবন্ত যোনি আর নিহত শিশ্নকীভাবে কথা বলবে! ভালোবাসার চেয়ে জীবন্ত একটা শিশ্নের প্রয়োজন বেশি ছিল বউয়ের। নারীরকাছে শিশ্নই ভালোবাসা? পুরুষের কাছে যোনিই ভালোবাসা? দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে বউয়ের চলে যাওয়াদেখে। দীর্ঘশ্বাসের কাঁটাতারে সেই আটকা থেকে গেছে, বউ বেরিয়ে গেছে, নোনাবুর বেরিয়ে গেছে। চাঁদ,জোছনা, পাখি, ফুল সব বেরিয়ে গেছে।

নোনাবুরকে সে কতই না ভালোবাসত। মিলুকেও সে ভালোবাসত। কিন্তু নোনাবুরের পক্ষ হয়ে সে মিলুরসাথে একবার বিতণ্ডাতেও জড়িয়েছিল। মিলু মারতে উঠেছিল নোনাবুরকে। মিলুর বউকে নোনাবুরখারাপ কোনো ইঙ্গিত করেছিল সম্ভবত। নোনাবুরকে মিলুর মার থেকে বাঁচানোর জন্য আজিজুরমাঝখানে দাঁড়িয়ে গেছিল, বলেছিল- ‘নোনাবুর তো ভালো ছেলে সে এমন কিছু করার কথা নয়।’ মিলুআজিরুরকে মান্য করত তবু রেগে গিয়ে বলেছিল- ‘আইজ্জ্যা তুই নোনার হয়ে মুতসুদ্দিগিরি করিস না, ও একটা হাড়েহাড়ে বজ্জাত, তার মনে-মজ্জাতে কোনো লজ্জা-শরম নাই, অন্যের ইজ্জতে হাত দিয়েহুজ্জত করতে চায়। শুধু তোর জন্য ওকে ছেড়ে দিলাম আজ। আবার যদি এরকম কিছু হয় তবে একটাখুনখারাবি হয়ে যাবে।’ তারপর অবশ্য আর তেমনকিছু হয়নি। আজিরুরের জন্যই হয়নি। দুজনকেইসে ভালোবেসে আগলে রাখত।

যখন বউটা চলে যায়, তখনও তার শিশ্নের ক্ষতের কাঁচা অবস্থা। প্রচণ্ড ব্যথাতে একা একা কিছু করতেপারে না। ছয় মাস সে কষ্ট করেই ওষুধ খেয়েছে। দোকান থেকে চিড়া মুড়ি গুড় কিনে খেয়েছে। কখনওকখনও কেউ দয়া করে দুটো ভাত দিয়ে গেছে। তাতিনেরা মাঝে মাঝে এসে তার সেবা শুশ্রূষা করেছে।এখনও মাঝে মাঝে এসে দেখা করে, মন খারাপ করে বসে থাকে। তার শিশ্ন যেদিন আহত হয় সেদিনইবিএসএফের গুলি খেয়ে মিলু মরে গেছিল।

সেদিনের কথা সে মনে করতে চায় না তবু তার মন গোঁয়ার গরুর মতো স্মৃতিখেতে ঘাস খেতে নেমেপড়ে, যেমনভাবে বেয়াড়া গরু নিষিদ্ধ খেতের বেড়া ফেড়ে ঢুকে যায় বারবার রাখালের পাচনবাড়িখেয়েও। তার মনে পড়ছে, সেদিন রাতে তারা মাল নিয়ে ফিরছিল ভালোয় ভালোয়। কিন্তু ভালোয়ভালোয় ভরে গেল কালোয় কালোয়, ভালোয় ভালোয় ভরে গেল আলোয় আলোয়। কিছুদূর আসারপরই হঠাৎ একপাশ থেকে ভারতের সীমানারক্ষী বাহিনী বিএসএফের হুঁশিয়ারি শোনা গেল, তাদেরপাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলোকফলা বর্শার মতো তাদের চোখের মণি পর্যন্ত গেলে দিল যেন, চোখ ধেঁধেগেছে একেবারে। বিএসএফেরা আজিরুরদের চিৎকার দিয়ে ডাকছে। ‘চিৎকারের দিকে যাবে না’ এসীলছাপ মারাই থাকে ব্ল্যাকিদের বুকের ভেতর। টর্চের আলোক ফলকে গলে যাওয়া চোখ নিয়েই তারাদৌড় শুরু করে। তারা তারকাঁটার পাশ দিয়ে দৌড়ায় কানামাছির মতো। যেখান দিয়ে তারা ঢুকেছিল সেফাঁকটা কোনদিকে আছে সেটা এই হঠাৎ আসা হুজ্জতে ভুলে গেছে। পথের গায়ে ভুলের তালা মারা।ভুলের তালা খোলার ঠিকচাবি তাদের কাছে নেই। ভুলের তালা ভাঙার হাতুড়ি তাদের কাছে নাই।কোনোকিছুতে একবার ভুলের তালা লেগে গেলে সে তালা খোলা সূর্যের গতিপথ উল্টানোর মতোইকঠিন। তারা যেমন ছুটোছুটি করছে তেমন পথও যেন ছুটোছুটি করছে। তারা ছুটোছুটি করছে, পথছোটাছুটি করছে, টর্চের আলো ছোটাছুটি করছে, বন্দুকের গুলি ছোটাছুটি করছে। ছোটাছুটিময় জগৎ।এ ছোটাছুটি থেকে ছুটি নেই যেন। গর্ত হারা উদ্ভ্রান্ত ইঁদুরের মতো তারা ছোটাছুটি করতেই থাকে।

ছোটাছুটির এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই বেড়ার একটা ছোটো ফাঁক দেখা যায়। ফাঁকটা যেন দয়া করে হঠাৎকরে দয়াবান দরবেশের মতো উদয় হয়েছে- ‘বৎসগণ, ছোটাছুটি করিয়া বহুত তকলিফ হইলোতোমাদিগের, এক্ষণে আইসো আমার শরণে, আমার ক্রোড়ে। আইসো, আমার ভিতর দিয়া নিরুপদ্রবেনিষ্ক্রান্ত হইয়া যাও।’

খুব সাবধানে ঢুকলে একজন করে বের হতে পারবে। তাতিন আর আজিরুরের অনেকটা সামনেনোনাবুর। সে সব প্রথমে ন্যাংলা শরীর নিয়ে সহজেই বেড়ার ফুটো গলে বের হয়ে গেছিল।

গুলির শব্দ আবার। পিছন ফিরে আজিরুর দেখে মিলু পড়ে গেছে, মিলুর ঘিলু বেরিয়ে ঘাসের উপরচকচকে পয়সার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সে কী করবে বুঝতে পারে না, মিলুর ঘিলুপয়সা সে আর গোটাকরতে পারবে না।

মিলুকে, মিলুর ঘিলুকে নিজের ঘিলু থেকে ঝেড়ে ফেলে আজিরুর ঐ ছোটো ফাঁকের দিকে এগিয়ে যায়।আবার গুলির শব্দ। গুলি তার কানের পাশ দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গেল। সে ঐ ছোটো ফাঁকের ভেতরদিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। প্রাণের তাড়নায় সে ফেঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়।

কাঁটাতারের এই ফাঁক তাতিন আর নোনাবুরের জন্য দয়াবান দরবেশের আচরণ করলেও আজিরুরেরজন্য সেই আচরণ করেনি। ফাঁকটা তার বেলাতে ফাঁদ হয়ে গেছিল। ফাঁক দিয়ে বের হবার সময়তাড়াহুড়োতে তার পিঠের চামড়া কাঁটায় বিঁধে একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ফেড়ে যায়। সে কিছুইবুঝতে পারেনি। আর নিচের একটা কাঁটা তার লিঙ্গের ঠিক গোড়া থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্তলম্বালম্বিভাবে ফেঁড়ে যায়। সে কিছুই জানতে পারেনি। সে আরও কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে ধপ করে পড়েযায় ঘাসের উপর। ঘাসের উপর পড়েছিল একলা একা।

চারদিক নিস্তব্ধ। এতটা নিস্তব্ধতা তার জীবনে কোনোদিন আর আসেনি। আগের পরিচিত কিছুইদেখতে পাচ্ছিল না সে। সে দেখতে পাচ্ছিল লাল অন্ধকার। অন্ধকার লাল হয়ে গেল কেন? রাতেরগায়ের চামড়া খুলে ফেলেছে কি কেউ তাই এত লাল দেখাচ্ছে যেমনভাবে গরু ছাগলের চামড়া ছিঁড়েফেললে লাল মাংস দেখা যায় খালি। সে দেখতে পাচ্ছিল, তার দিকে চারদিক থেকে শেয়াল গুটিগুটিপায়ে এগিয়ে আসছে, আকাশ থেকে পাখির মতো শেয়াল নেমে আসছে, মাটির তল থেকে শেয়াল উঠেআসছে। চারদিক থেকে আসা সব শেয়ালের চোয়ালে করাতের মতো দাঁত। আকাশ থেকে উড়ে আসাঅসংখ্য বাতাসদেহী শেয়ালের চোয়ালে নির্দয় হাসি ঝুলছে। মাটির নিচ থেকে আসা মাটির শেয়ালেরচোয়ালে শিলনোড়ার ঘষাঘষি চলছে বিকট শব্দে। শেয়ালদের মিলিত দরবার দেখে, শেয়ালদের মিলিতকারবার দেখে, তাদের সবার দাঁতের তরবার দেখে, আজিরুর চোখ বন্ধ করে, চোখ বন্ধ করেও মনে হয়চোখ খোলা আছে। আজিরুর চোখ খুলে, চোখ খুললেও মনে হয় চোখ বন্ধ আছে। এতদূরই তার মনেপড়ে, এসব বোধই মনে পড়ে শুধু, আর কিছু মনে নাই।

তারপর কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। ডাক্তার তার কাটা পিঠ, ফাটা মুষ্ক, ফাড়া শিশ্ন জোড়াদিয়েছিল সুচ ফুঁড়ে ফুঁড়ে।

এইসব স্মৃতি তার উপর দিয়ে চলে গেল রাস্তা সোজা করা রোলারের মতো। চোখ মুখ কুঁচকে বসে আছেআজিরুর। চলকানো ব্যথা চাগিয়ে উঠছে শিশ্নে। ঝকঝকে জোছনা। ঝকঝকে চাঁদ আকাশে। সে তারশিশ্নটা বের করে লুঙ্গির ভেতর থেকে। সে দেখার চেষ্টা করে ব্যথাকে। ব্যথাকে দেখতে পায় না। আশ্চর্য, নিজের ব্যথাকে নিজেই দেখতে পাওয়া যায় না। ব্যথা তবে কে? ব্যথা কী দিয়ে তৈরি? ব্যথার শরীর মনেহয় দয়ামায়া দিয়ে তৈরি নয়। ব্যথা দয়ামায়াহীন আলাদা এক জীব না কি? জিনের মতো, দেওদানোরমতো অদৃশ্য জীব? ব্যথার দাঁতই তবে জগতের দাঁত! ব্যথাই জগৎ, জগৎই ব্যথা। সে সেলাই দেওয়াজায়গা দেখার চেষ্টা করে। সেলাইয়ের জায়গা স্পষ্ট দেখা যায়। সেলাইয়ের চিহ্নটা একটা বিছার ছাপেরমতো হয়ে আছে। বাতাস লাগছে নগ্ন অঙ্গের গায়ে, বাতাস আর ব্যথায় গা শিরশিরিয়ে উঠছে। চাঁদনিরচাদর পড়েছে নগ্ন অঙ্গের গায়ে। চাঁদটা আজিরুরের নির্লজ্জতায় অবাক স্থির হয়ে থাকে। আজিরুরচাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, নির্জনতায় একটু নির্লজ্জতা হলোই-বা তাতে লজ্জা কেন পাচ্ছচাঁদ! ব্যথার কাছে কোনো লজ্জা কি টেকে গো চাঁদ চান্দু!

ব্যথাটা বাড়ছে। জীব বাড়ে। ব্যথার জীবন আছে। ব্যথা একটা জীব। জীবের ভেতরে থাকা জীব।ব্যথার বেড়ে ওঠা আছে, মরণ নাই? যে জীবের ভেতর ব্যথা বাসা বেঁধে থাকে সে জীবের মরণ না হওয়াপর্যন্ত তার মরণ নাই। ব্যথার মরণ নাই, রূপান্তর আছে। ব্যথা একরূপ থেকে আরেক রূপে প্রকাশ পায়, এক অঙ্গ থেকে আরেক অঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে। সে খেয়াল করে পিঠের ব্যথাটাও উঠেছে। পিঠেরদিকটা এতদিন তেমনভাবে ব্যথা করেনি। তার বুকও ব্যথা করছে সে খেয়াল করল। মাথাটাও চরমব্যথিয়ে উঠেছে। ফেটে যাবে মনে হয়। সে ব্যথা থামাতে পারে না। ষাঁড়ের মতো ব্যথা ফেঁড়ে ফুঁড়ে বাঁকাশিং দিয়ে গুঁতিয়ে চলেছে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে। ব্যথায় কাতর আজিরুর কাঠেরগোলগুড়ির উপর অনেকটা শামুকের মতো হয়ে শুয়ে পড়ে। দুহাত দিয়ে শিশ্নের ব্যথাকে চেপে ধরে মেরেফেলতে চায়। ব্যথা মরে না। ব্যথা নড়ে না, ব্যথা চড়ে উঠছে আরও, প্রাণ নড়ে উঠছে।

জোর করে মিলিত চোখ সামান্য একটু ফাঁক করে আকাশের দিকে তাকায় আজিরুর, চন্দ্রের রূপ যেনফেটে পড়ছে, রূপের পর রূপ সাজছে। আকাশের চুপ যেন ফেটে পড়ছে, চুপের পর চুপ সাজছে। চোখখুলে রাখতে পারছে না আর। আজিরুরের সাথে তারই নিজের চোখের পাতা জোরাজুরি করে।আজিরুরের চোখ আজিরুরের আদেশ অমান্য করে, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে তারই চোখেরপাতা মিলিত হয়ে যাচ্ছে। আজিরুর ভাবে- অথচ মানুষ তো ভাবে চোখ মানুষের চাকর। এখন দেখাযাচ্ছে কখনও চোখ চাকর কখনও চোখের চাকর মানুষ। চোখের উপর আর জোর করার চেষ্টা করে নাআজিরুর, চোখের ইচ্ছের কাছেই আত্মসমর্পন করে। চোখ মিলন করে আজিরুর অবসন্নভাবে শুয়ে থাকে।

শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় তার কান কপাট খুলে। এর মানে এতক্ষণ কানটা ইচ্ছে করেই বন্ধহয়েছিল। তার কান তাকেই কোনোকিছু শোনা থেকে বিরত রেখেছিল যখন চোখের সাথে তার যুদ্ধচলছিল তখন। এখন কানকপাট খুলেছে তাও মাত্র একটু, খুলেছে তেমনভাবে, যেমনভাবে নতুন বউদুয়োরের পর্দা বা জানালার খড়খড়ি কেবল একটু সরিয়ে দেখে নেয় নির্দিষ্ট কোনোকিছু বাকোনোকাউকে। কান একটা মাত্র শব্দ শোনার জন্য যেন একটা মাত্র দুয়োরের কপাট খুলে দিয়েছেএখন। সে ঝিনঝিনি পোকার ডাক, রাতজাগা পাখির ডাক, শুয়োরের ঘূৎকার, দূরে চৌকিদারের‘হুঁশিয়ার সাবধান, তফাত যাও, তফাত যাও’ হুঁশিয়ারি কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। সে শুনতে পাচ্ছেএকটা রাগের সুর। চন্দ্রকোষ রাগ বাজছে ধীর লয়ে। ব্যথার মতো সুর, কান্নার মতো সুর ভেসে আসছে।কোন সুদূর দূর থেকে, কোন অজানা দূর থেকে, কোন অচেনা দূর থেকে এ সুর ভেসে আসছে? না কিতার খুব ভেতর থেকেই, তার খুব জানা থেকে চেনা থেকে এ সুর বের হয়ে আসছে। খুব দূর মানুষেরাঅচেনা অজানা আর খুব কাছ মানুষেরা অচেনা অজানা। মানুষের সাথে মানুষের মানুষ-মানুষ সম্বন্ধপাতানোর জন্য, সুগন্ধ পাতানোর জন্য- সুগন্ধময় সুন্দর আর পরিমিত দূরত্ব দরকার। দূরত্ব সুরত্ব তৈরিকরে, দূরত্ব বেসুরত্ব তৈরি করে; মাঝখানে ‘পরিমিতি নদী’। পরিমিতি নদীর জলের গভীরতা, পরিমিতিনদীর ঢেউ, পরিমিতি নদীর স্রোতকে আয়ত্ত করতে হয় কিন্তু সেটা মানুষ কখনোই পারে না বা করারচেষ্টা করে না। পরিমিতি একটা বৃক্ষ, পরিমিতি বৃক্ষে সম্বন্ধ সুর ফোটে, সম্পর্ক-আঠা শক্তিশালী হয়, ভক্তিশালী হয়। এগুলো সবই রোদন বাউলের কথা। তিনি তুম্বি বাজিয়ে হৃদয়চুম্বি গান করেন আর কীসুন্দর সুন্দর কথা বলেন।

একসময় আজিরুরের দূর অদূরের, চেনা অচেনার ঘোরের ডোর খুলে যায়। ঘোর কাটা আজিরুর ঠিকঠিক বুঝতে পারে, কোথা থেকে এ সুর ভেসে আসছে। সুরের ঠিকানা সন্ধান পেয়ে আজিরুরের ব্যথাপূর্ণমরণাপন্ন মুখে সামান্য হাসি চুয়ে পড়ে যেমনভাবে এক ফোঁটা মধু দেয়ালে রাখলে চুয়ে চুয়ে নিচে নামে।আজিরুর বুঝতে পেরেছে, শুকতারির ঘর থেকে ভেসে আসছে এ সুর। এ ক্যাসেট আজিরুরই তাকেএনে দিয়েছিল বর্ডারের ওপার থেকে। শুধু এ ক্যাসেট নয় আরও অনেক ক্যাসেট আর বই সে এনেদিয়েছে। শুকতারি মাঝে মাঝেই ক্যাসেটের নাম লেখা; গল্প, উপন্যাস, কবিতার বইয়ের নাম লেখাচিরকুট তার চাচাতো বোন বিন্তির হাত দিয়ে পাঠাত। খুব খুশি হয়ে আজিরুর শুকতারির জন্য এসবআনত। শুকতারির চাওয়া মোতাবেক কিছু আনার মতো সুখ আর অন্যকিছুতে পায়নি সে।

শুকতারি পড়াশোনায় ভালো ছিল। আইএ-বিএ পাস করেছে, গ্রাম থেকে একটু দূরের এক কলেজেপড়ায়, কিন্তু বিয়ে করেনি। আজিরুর আর শুকতারির বাল্যপ্রেম ছিল। শহর থেকে বড়ো বড়ো পাসদিয়ে আসার পরেও শুকতারি আজিরুরকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু শুকতারির বাপ-মা রাজিহয়নি। আজিরুরও রাজি হয়নি- ‘তুমি কত কত পড়ালেখা করা আর আমি সেই ম্যাট্রিক পাস করেকলেজে থেকে পড়া বাদ দিলাম, আর তো পড়ালেখার সাথে যোগাযোগ করিনি।’

শুকতারি আর কিছু বলেনি। পরে কলেজে চাকরি নেয়। তারপর থেকে কলেজে পড়ায় আর রাতদিন মৃদুঢেউয়ে গান বাজিয়ে গান শোনে। কী কী সব গান। এসব গান গাঁয়ের কেউ শুনতে পছন্দ করে না।আজিরুরেরও ভালো লাগে না, বরং তার ভালো লাগত ভারতের হিন্দি সিনেমার গান। রোদন বাউলেরগান ভালো লাগে এখন।

আজিরুরের বিয়ের পরেও শুকতারির কাছে থেকে ক্যাসেটের নাম লেখা, গল্প উপন্যাসের নাম লেখাচিরকুট এসেছে, কিন্তু দেখা হয়নি আর। এত কাছাকাছি থেকে এটা কীভাবে সম্ভব তাই ভেবে পায় নাআজিরুর। এ গ্রামে একমাত্র দোতালা বাড়ি শুকতারিদের। আজিরুর মাঝে মাঝে দোতালার যে ঘরেশুকতারি থাকে সেদিকে তাকায়, দেখতে পায় না, দেখা যায় শুধু টবে লাগানো পাতাবাহার, ফুলফোটাগোলাপ, স্থলপদ্ম, দোপাটি ফুলের গাছ। এগুলোতে সে কখন পানি দেয় কখন যত্ন করে কে জানে।ফুলগাছের উপর আজিরুরের কোনো আগ্রহ ছিলই না কখনও। মানুষ কেন কষ্ট করে ফুলদ গাছ লাগায়কে জানে, যে ফুল থেকে কোনো ফল হয় না, সে গাছ লাগিয়ে ফল কী! তার চেয়ে ঐ একই কষ্ট দিয়েফলদ গাছ লাগানোয় তো ভালো, ফল পাওয়া যায়, ফল খাওয়া যায়।

আজিরুরের সাথে দেখাদেখি যাতে না হয় সে ব্যাপারটা কত যত্ন করে দেখাশোনা করে শুকতারি। কিন্তুআসলে তাই কি হয়, ‘দেখাদেখি’র ‘দেখা’টা হয়তো হয় না কিন্তু তার পক্ষ থেকে ‘দেখি’টা নিশ্চয় হয়, নইলে হঠাৎ করে কোনো একবার দেখা হয়েই যেত। সে খুব ভালো করে আজিরুরের রুটিনের উপরখেয়াল রাখে বলেই ‘দেখাদেখি’র ‘দেখি’টা ঘটে কিন্তু আজিরুরের ‘দেখা’টা হয় না। দেখা না হোক, আজিরুর চিরকুট অনুযায়ী ক্যাসেট, বই এনে দিয়েছে। যে ক্যাসেট এখন বাজছে সে ক্যাসেটের গায়েলেখা ছিল- ‘চন্দ্রকোষ রাগ, এ রাগ রাত্রি তৃতীয় প্রহরে শ্রাব্য বা গেয়’।

চন্দ্রকোষের রসে এখন আজিরুরের কান্না আসছে। এর আগে কখনও এমন হয়নি। বরং এসব সুর তারবিরক্তই লাগত, কী শুনে শুকতারি এসব। নিজের কান্নার মানে করতে গিয়ে শুকতারির মনের মানে তারকাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। তার মনে হয়, তাহলে শুকতারি প্রতিরাতে চাঁদনি কেদারা বাজিয়ে, তিলংবাজিয়ে, চন্দ্রকোষ বাজিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান্না করে! আচ্ছা শুকতারি কি আজিরুরকেইভালোবাসে? না আজিরুর শুধু তার প্রেম রাখার পাত্র মাত্র? আজিরুর উপলক্ষ্য মাত্র! আজিরুরকেপাত্র করে শুকতারি তার প্রেমসাধনা করছে! শুকতারির প্রেমের প্রতি আজিরুরের প্রেম বেড়ে গেল আরওএ ভাবনা আসার পরে।

আজিরুর কাঠের উপর কাঠ হয়ে শুয়ে আছে। ডান হাতের ডানায় তার মাথা রাখা। মাথাটা যেনশুকনো বোঁটায় আটকে থাকা একটা তাল, যেকোনো সময় খুলে পড়বে। মরণাপন্ন অবসন্ন আজিরুরক্ষুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ দীর্ঘশ্বাসে তেমন কোনো শক্তি নাই, গতবল গতির দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাস যেভাবেপড়ে সেভাবে পড়েনি; তার দীর্ঘশ্বাস চুয়ে পড়েছে যেমনভাবে জিয়ল গাছের গায়ে খোঁচ দিয়ে খোঁচা দিলেবহুক্ষণ পর আঠা চুয়ে পড়ে তেমনভাবে। দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার হাতের ডানাতে। দীর্ঘশ্বাস ডানা থেকেচুয়ে চুয়ে পড়ল শুয়ে থাকা শুকনো কাঠের উপর।

সে শিশ্নের ব্যথায়, পিঠের ব্যথায়, মনের ব্যথায় একেবারে মুষড়ে পড়েছে। প্রচণ্ড মুষল মেরে মেরে ব্যথাতাকে পাছড়ে ফেলেছে। কানও মুদে আসে তার, চোখ যেমন নিজে নিজে মুদে যায়।

আজিরুর মনে মনে দেখতে পায়, অজস্র শেয়াল আকাশ থেকে নেমে আসছে। আচ্ছা, আকাশেরতারাগুলো তাহলে তারা নয়, ছদ্মবেশী শেয়াল। চাঁদসুরুজ আসলে চাঁদসুরুজ নয়, ভেক ধরা শেয়াল।আজিরুরের ব্যথা কমে যাচ্ছে, সে অচেতন।

অচেতনে আজিরুর দেখতে পায়, মাটির তল থেকে অজস্র শেয়াল বের হয়ে আসছে, যেন জলের তলথেকে উঠে আসছে এমনই সহজতা তাদের উঠে আসায়। তাহলে মাটির তলে থাকা বালু, তেল, সোনা, কয়লা, জহর, জহরত, হীরা আসলে শেয়াল। শেয়ালেরাই খনিজবেশে ঘুমিয়ে থাকে। এখন সেসবখনিজরূপ শেয়াল ভোল পাল্টে ভুসভুস করে উঠে আসছে।

দূর নদীর জলের তলা থেকে শেয়াল উঠে আসছে তার দিকে। আজিরুর অবাক হয়। জলে থাকা মাছ,শামুক গুগলি গেঁড়ি, শ্যাওলা, পানকৌড়ি তাহলে আর কিছু নয় শেয়াল! মহাতন্দ্রা নেমে আসছেআজিরুরের শরীরে।

মহাতন্দ্রায় ডোবা আজিরুর দেখে, পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ দিক থেকে, ঈশান-অগ্নি নৈর্ঋত-বায়ুকোণথেকে শেয়াল ছুটে আসছে তাদের নখ আর দাঁত বের করে। নখে আর দাঁতে চাঁদনির নেলপালিশমাখা। ঐ যে নিমগাছটা শেয়াল হয়ে গেল, শেয়াল হয়ে সে ছুটে আসছে। ঐ যে মাহবুরের বাড়িটাশেয়াল হয়ে গেল, শেয়াল হয়ে ছুটে আসছে তার দিকে। ঐ যে কয়েকজন চোরাচালানকারী আর তাদেরমালমাত্তা আর সাইকেল শেয়াল হয়ে গেল আর শেয়াল হয়ে ছুটে আসছে তার দিকে। আজিরুর ভাবে, যেগুলোকে মানুষ গাছ ভাবে, নদীনালা পাহাড় পর্বত ভাবে, গাড়ি বাড়ি জমিজমা ভাবে, ট্রেন ট্রাক বাসভাবে, পোশাকআশাক গয়নাগাটি ভাবে, শিশু নারী পুরুষ বা মানুষভাবে সেগুলো আসলে সেগুলোনয়। সেগুলো সবই ছদ্মবেশী শেয়াল।

সব শেয়াল শ্বাস ফেলতে শুরু করেছে আজিরুরের শ্বাসের উপর। শ্বাসে শ্বাসে প্যাঁচ খেলা হচ্ছে।শেয়ালের শ্বাসসুতা আজিরুরের শ্বাসসুতার সাথে প্যাঁচিয়ে যাচ্ছে। আজিরুরের আর কোনো ব্যথা নাই।মহাঘুম আসছে চোখে, সারা শরীরে। সারা শরীর সারা হয়ে যাচ্ছে, সারা প্রাণ সারা হয়ে যাচ্ছে।

 

প্রশ্নোত্তর

শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?

আনিফ রুবেদ: গল্প একটা আধার যেখানে কথাগুলোকে রাখা যায়। গল্প একটা মঞ্চ যেখানেচরিত্রগুলোকে তাদের চরিত্র মোতাবেক হাঁটাচলা করিয়ে নেওয়া যায়। গল্প হলো ক্যানভাস যেখানে ছবিআঁকা যায় এবং যেখানে ছবিও কথা বলে রঙও কথা বলে।

কবিতা উপন্যাস ছড়া প্রভৃতি যেমন একেকটা ফর্ম তেমনভাবে গল্পও একটা ফর্ম। একেক ফর্ম একেকধরনের কথা বলার জন্য বলে মনে হয় আমার। উপন্যাসে যা এবং যেভাবে বলা যায় কবিতা বা গল্পেবা ছড়ায় তেমনটা হবে না। ফলে যা বলতে চাই তার অনিবার্য দাবি অনুযায়ীই গল্প লেখার তাড়নাআমার ভেতর কাজ করেছে।

আমি কবিতা লিখি এবং গল্পও লিখি। গল্প-উপন্যাসকে আমার মনে হয়, একটা বিরাট বিশাল অথবাঅসীম খেপলা জালের মতো যা সমগ্র সমুদ্রে বিছিয়ে দেবার পর টানতে টানতে একেবারে একটা বিন্দুতেনিয়ে আসা এবং কবিতাকে মনে হয় সেই খেপলা জালই কিন্তু প্রক্রিয়াটি ঠিক উল্টো; যেটা গুটানোঅবস্থায় থাকে একটা বিন্দুর মতো যা পাঠ করতে শুরু করা মানে সেটা বিছিয়ে যেতে শুরু করে সমগ্রসমুদ্রব্যাপী। গল্প সমগ্র সাগরকে টেনে এনে পাঠকের ঘরে বা হৃদয়ে প্রবেশ করিয়ে দেয় আর কবিতাপাঠককে ঘর থেকে বের করে বা পাঠকের হৃদয়কে বের করে সমগ্র সমুদ্রের স্বাদের সাথে বেঁধে দেয়।

আমি নিজেকে প্রথমে একজন দেখক হিসেবেই আবিষ্কার করেছিলাম। পরে, লেখক হবার দিকে এগিয়েগেছি। এখনও তাই, প্রথমে দেখক তারপর লেখক। ব্যক্তির দেখার সীমা আছে কিন্তু তার হৃদয়ে থাকেসমগ্র বিশ্বকেই প্রকাশ করার দায়। এ দায় কেউ দেয় না, লেখক নিজেই নেয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই। যেসামান্য কিছু দেখি তাকেই পুঁজি করে পৃথিবীর সমস্তটাকে, সমস্ত কিছুকে, সমস্ত কিছুর সাথে সমস্ত কিছুরসম্পর্ককে নির্ণয়ের চেষ্টা করি। একজন রাজাকে বা মন্ত্রীকে বা এমন কাউকে দেখে একজন সাধারণমানুষের জীবনের গভীর তত্ত্ব ও তথ্য মিলানোর চেষ্টা করি। দেখা যায়, একজন রাজা তার প্রজাদেরসাথে যে আচরণ করে সে-ই সাধারণ মানুষটি হয়তো তার পরিবারের সাথে সে-ই আচরণ করে।আবার, একজন সাধারণ মানুষকে দেখে রাজাকেও বুঝে নেবার চেষ্টা করি; রাজারও খিদে পায়, গ্যাঁড়াকলে পড়লে অধমেরও অধম হয়ে যায়। আমার দেখা গাছটির সাথে পৃথিবীর অপর প্রান্তে থাকাকোনো গাছের স্বভাব বোঝার চেষ্টা করি এবং লেখাতে আনার চেষ্টা করি। এসব ক্ষেত্রে গল্প ফর্ম হিসেবেখুব একটা কার্যকর বলে আমার মনে হয়, ফলে গল্প লিখি।

শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?

আনিফ রুবেদ: ব্যক্তি আমার কাছে মুখ্য। কারণ সমষ্টি তৈরিই হয় ব্যক্তি দিয়ে। ফলে ব্যক্তির বেদনামানে সমষ্টিরই বেদনা বলে মনে করি। ‘সব ফুল ছিঁড়ে গেলেও একটা ফুল থাকলেও আজ বসন্ত’ এরকমমনোভাব আমার পছন্দ নয়। ‘সব ফুল যদি থাকে আর একটা ফুলও ছিঁড়ে যায় তবেই বসন্ত নয়’ বলেইভাবি আমি। এরকম কোনো ধারণাকে আমি প্রশ্রয় দিই না যে, একজনের জীবনের বিনিময়ে একটা গ্রামবা শহর বেঁচে থাকবে। অবশ্য এ দায় ব্যক্তি নিতে পারে কিন্তু কোনোভাবেই অপরের কাছে থেকে এসিদ্ধান্ত আসতে পারে না। কোনো ব্যক্তি যদি নিজে সিদ্ধান্ত নেয় যে আমার জীবনের বিনিময়ে সমগ্রপৃথিবী বেঁচে যাক তবে তা ভালো কিন্তু কারোই জোর খাটানো উচিত নয় যে, তুমি জীবন উৎসর্গ করোতাহলে পৃথিবীর সকলেই বেঁচে থাকতে পারবে।

ব্যক্তি বলতে এবং ব্যক্তির অভিজ্ঞতা বলতে এমনই বুঝি আমি। এখন ব্যক্তি হিসেবে আমি এবংআমার অভিজ্ঞতা কীভাবে আমার গল্পকে আকার দেয়, বিষয় দেয়, চিন্তা দেয়, দৃশ্য দেয়, ডায়ালোগ দেয়সে বিষয়ে কথা বলা যেতে পারে। ব্যক্তি অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো কিছুই নয়। কিছুই নয় ব্যক্তি চেতনাবা চিন্তা পদ্ধতির বাইরে। কোনোকিছুই আমি বুঝতে পারি না যা আমার ভেতর নেই, আমার দেখারভেতরে নেই। নিজের কোনো কোনো সময় মনে হয় বুঝতে পারছি কিন্তু প্রকৃতই তা হয় না। সেই বুঝাটাআসলে বাওবাব বৃক্ষকে বটগাছ দিয়ে বোঝার মতো।

আমার গল্পগঠন আমার অভিজ্ঞতারই ফসল সেটা হতে পারে চারপাশে ঘটে যাওয়া কিছু বা সংবাদপত্রথেকে পাওয়া কোনো ঘটনা। সেটার সাথে জুড়ে দিই আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা করার, বয়ন করার, দর্শনকরার পদ্ধতি। আমার নিজের শব্দ ভান্ডার, বাক্যগঠনের ক্ষমতা, উদাহরণ তৈরির ক্ষমতা প্রভৃতিগল্পটাকে উপস্থাপন করে যেভাবে সেটাই অন্য একজন লেখকের গল্প থেকে আলাদা করে তোলে।

শুদ্ধস্বর:  আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।

আনিফ রুবেদ: রাজনীতির কর্মকাণ্ড প্রকাশের মোটাদাগে দুরকম ধরন আছে। এক ধরনের প্রকাশেমানুষ সরাসরি বা তাৎক্ষণিক আক্রান্ত হয় বা সুফল পায়। অন্য ধরনের প্রকাশটা খুব ধীর; বহু সময়নিয়ে তার প্রভাবপ্রবাহ চলমান থাকে। যেকোনো একটা কর্মকাণ্ড পুরো ব্যক্তিক জীবন বা সামাজিকজীবন বা বৈশ্বিক জীবনকে একেবারে বদলে দিতে পারে। ফলে মানুষের জীবনে রাজনীতির প্রভাবঅত্যন্ত গভীর। এটা কথাসাহিত্যকেও সুতরাং প্রভাবিত করে। কারণ, মানুষের জীবন নিয়েইকথাসাহিত্য। যদি কোনো গল্প মানুষকে ছাড়াও হয়; কোনো একটা গাছকে বা নদীর কোনো একটাঢেউকে নিয়ে হয় তবুও সেখানে রাজনীতির প্রভাব থাকে। কারণ রাজনীতি ঠিক করে দেয় আমাদেরদেশে কোন গাছ থাকবে কোন গাছ থাকবে না; ঠিক করে দেয় নদী থাকবে, না নদীর তলা থাকবে।আবার রাজনৈতিক ক্ষমতা ঠিক করে দেয়, কী লেখা যাবে কী লেখা যাবে না; ঠিক করে দেয়, কোন শব্দব্যবহার করা যাবে কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এসব বিধিনিষেধের ভেতরেও একজন লেখক থেমেথাকেন না। নিষিদ্ধ ব্যাপারটাকে তখন অন্য কোনো রূপক, উপমা-উৎপ্রেক্ষার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করতেপ্রয়াস পান। ফলে রচনাটির ভেতর যে পরিবর্তন দেখা গেল তা ঐ রাজনৈতিক বাধা-বিঘ্নতারই ফল।

আমার পাঠের অভিজ্ঞতা উপরের ভাবনাকে সমর্থন করে এবং নিজের অভিজ্ঞতাও সমর্থন করে।এদেশে একবার পুরো দেশে বোমা হামলা হয়। এই বোমা হামলার ফলে সারাদেশের মানুষের দেহে ওমনে কী হয়েছিল তা নিয়ে একটা গল্প রয়েছে আমার। আবার কিছুদিন আগে এক রাজনৈতিকগোলযোগের ভেতর পড়ে একজন গর্ভবতী মহিলা; তার পেটে গুলি লাগে; গর্ভের শিশুরও গুলি লাগে; শিশুটি জন্ম নিয়েছে বিকলাঙ্গভাবে। এই ঘটনা নিয়েও একটা লেখা লিখেছি আমি; যদিও তা একটানাটক; যদিও তা এখনও প্রকাশ পায়নি।

আবার যেসব রাজনীতিক কর্মকাণ্ড, সিদ্ধান্ত, নীতি বহুদিন ধরে ধীরে ধীরে ক্রিয়া করে তার মধ্যে রয়েছেবিশেষ করে শিক্ষানীতি, অর্থনীতি। এগুলোও কথাসাহিত্যের ভেতর আসে বহুবার বহুভাবে।

শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।

আনিফ রুবেদ: বাংলা অনেক গল্পই আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। কিন্তু একটা গল্পের কথা বলতে গেলেঅবশ্যই রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের কথা বলতে হবে আমাকে। বহুবার পড়েছি এ গল্প। এ গল্পেপ্রেম, সমাজপতিদের ব্যাপার-স্যাপার, ইংরেজদের ব্যাপার-স্যাপার, প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রতিটা ক্ষেত্রইমারাত্মক রকমে নাড়া দিয়েছে আমাকে। এ গল্পের শশিভূষণ এবং গিরিবালাকে আমার এতই ভালোলেগেছিল যে আমার ‘এসো মহাকালের মাদুরে শুয়ে পড়ি’ কাব্যগ্রন্থের যে দুটো চরিত্র রয়েছে তাদেরনামকরণই করেছি এই নাম দুটো গ্রহণ করে।

শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?

আনিফ রুবেদ: বাস্তবিকই, একজন পূর্ণবয়স্ক রাখালের গল্প শুনেছিলাম আমি, যে রাখাল গোরু চরাতেগিয়ে মাঠের প্রান্তে- বিলের পাড়ে কাদা দিয়ে শায়িত নারীমূর্তি তৈরি করত আর মূর্তিটার সাথে বিভিন্নভঙ্গিমায় শুয়ে থাকত, বসে থাকত। একেবারে ইচ্ছেমতো। এটা দেখে অনেকেই হাসাহাসি করলেও সেএটা করত একেবারে মন থেকে একজন ধ্যানী প্রেমিকের মতো। ঐ রাখাল প্রেমিকের জন্য সত্যিকারকোনো প্রেমিকা ছিল না। হয়, কোনো নারীকে সে পছন্দ করেনি অথবা কোনো নারী তাকে পছন্দকরেনি।

ফর্মের ক্ষেত্রে, ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে, ব্যাকরণ মানা বা না মানার ক্ষেত্রে অনেকটা ঐ রাখালের মতোআমি। নিজের তৈরি করা ফর্মের সাথে, ভাষার ক্ষেত্রে, ব্যাকরণের ক্ষেত্রে ইচ্ছেমতো বিচরণ করি। এটারহিসেব দেওয়া বা কোনো নকশার আভাস দেওয়া খুব কঠিন।

অবশ্য এসব বলার উদ্দেশ্য এমনও নয় যে, আমার গল্পের ফর্ম, ভাব, ভাষা একেবারে আলাদা। না, আলাদা নয়। তবে একেবারে একরকমও নয়। যেমনভাবে, রাখালের তৈরি সেই নারীমূর্তি হেঁটে চলেবেড়ানো নারীদের রূপের থেকে গঠনের থেকে আলাদা নয় একেবারে আবার একেবারে অন্য নারীদেরমতোও নয়। আলাদা এবং একই। একই এবং আলাদা।

শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?

আনিফ রুবেদ: একটা সার্থক গল্পের উপাদান অনেককিছুই। রান্নার মতোই। একটা সার্থক গল্পেপ্রথমেই দরকার একটা ভালো কাহিনি। এবার তার সাথে অবশ্যই যুক্ত হতে হবে দর্শন, যুক্ত হতে হবেউপযুক্ত ভাষা। বাক্যগুলোকে অবশ্যই এমনভাবে তৈরি হতে হবে যাতে দর্শনের চরিত্র এবং চরিত্রেরদর্শন পরিষ্কার ফুটে ওঠে।

শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

আনিফ রুবেদ: লেখকের রাজনৈতিক চেতনা বা বোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্যক্তিজীবনের, সমাজজীবনের, রাষ্ট্রজীবনের, বিশ্বজীবনের বেশিরভাগটাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। রাজনীতির শুভদিকগুলো, শুভনীতিগুলো সম্পর্কে এবং তার বিপরীত দিকগুলো সম্পর্কে লেখকের স্পষ্ট ধারণা থাকাদরকার। এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে লেখকের লেখা খুব একটা উপকারে আসবে না মানুষের।লেখক সরাসরি কোনো দিশা দেন না বটে কিন্তু আভাস দেন অবশ্যই।

রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক নির্মমতা, নির্মোমতা, অন্যায়, অবিচার, অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের স্পষ্টঅবস্থান অবশ্যই দরকার। তবে লেখককে যে সরাসরি এক্টিভিস্ট হতে হবে এমন ধারণা আমি পোষণকরি না। যদি কেউ লেখক এবং এক্টিভিস্ট একইসাথে হতে পারেন তবে ভালো; না হতে পারলে তাকেদোষ দেবার পক্ষপাতী নই। লেখকের মূল কাজটি লেখা। সকলেই যেমন লিখতে পারেন না তেমনভাবেসকলেই এক্টিভিস্টও হতে পারেন না। আবার দুটোই হয়েছেন এমন উদাহরণও কম নেই।

শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন।

আনিফ রুবেদ: এবার বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছে ‘মানুষাশী মানুষ’ নামের একটা গল্পের বই। বইটাতেচারটি গল্প রয়েছে। একজন মানুষের জন্য তার নিজের দেহই কীভাবে সমস্যা তৈরি করে, একজনমানুষের জন্য তার পরিবার কীভাবে সমস্যা তৈরি করে, একজন মানুষের জন্য রাজনীতি, ধর্মনীতিকীভাবে সমস্যা তৈরি করে, একজন মানুষের জন্য তারই একমাত্র-সঙ্গী কীভাবে সমস্যা তৈরি করেএইসব নিয়েই গল্পগুলো।

একটা উপন্যাস নিয়ে কাজ করছি। যদিও তা নতুন নয়। কয়েকবছর আগে লেখা। বইটির নাম ঠিককরতে পারিনি বলে গত ছয়বছর ধরে বের করতে পারিনি। সেটা নিয়েই এটা ওটা করি; এখানে ওখানেআঁচড় বসাই; রঙ চড়াই বা রঙ ফিকে করি; বানানকে মানানসই করি; বাঁকা বাক্যকে সোজা করি।এসবই।

একই সাথে কাজ করছি ‘হৃথিবী রথের যাত্রী’ নামের একটা কবিতার বই নিয়েও।

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!