চাকরিজীবী মায়ের ভবিষ্যৎ, শিশুরা থাকবে কার আশ্রয়ে?

Share this:

আমার সর্বশেষ কর্মস্থলে প্রায় আট বছর কাজ করেছি আমি। এ বছর জানুয়ারির ১৯ তারিখে আমার সর্বশেষ অফিস ছিল। আমি এখনও ভাবতে পারি না যে, চাকরি পাওয়া, কাজ শেখা, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ সামলে নিয়ে প্রায় ১৪ বছরের ক্যারিয়ারের আমি দাড়ি টেনেছি। অথচ দেড় বছর আগেও আমার সহকর্মী (আমি নাম বলতে চাইছি না), যখন শুধুমাত্র বাচ্চার দেখাশোনার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলো, আমি কখনও ভাবিনি একই পরিণতি আমারও হবে। কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক দায়িত্ব, বাচ্চাকে সময় দেওয়াসহ নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই চালিয়ে যাচ্ছিলাম কাজ, মানে চাকরি। আমার মায়ের কাছে রেখে যেতাম আমার বাচ্চাকে। কিন্তু মাঝে বাবার অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় মা-ও আর পারছিলেন না, বাচ্চার দেখাশোনা করতে। এদিকে বাসায় কোনো সহকারি না থাকা, কার কাছে রেখে যাব বাচ্চা, এসব কিছুর সমাধান না পেয়ে আমি বাধ্য হয়েছি চাকরি ছাড়তে। আমরা ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হিসাব রাখি, কর্মস্থলে নারীদের সংখ্যা কত বাড়ছে, সে হিসাব রাখি, কিন্তু কতজন মা বাচ্চা দেখাশোনার জন্য চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, তার হিসাব তো রাখি না।

এই যে আমাদের মতো মেয়েরা জব ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, এর সংখ্যা হয়তো উল্লেখ করার মতো নয়, সমাজে এর প্রভাব আসলে কতটুকু তাও আমি জানিনা। কিন্তু আমার কাছে তো এটা তিল তিল করে নিজের স্বপ্নের উপর নিজেকে দাঁড় করিয়ে, নিজেকে নিজে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। আমি ভাবছি এর জন্য দায়ী কে, বা কি? এই যে নারীবান্ধব নীতি, নারীবান্ধব কর্মস্থল, নারীস্বাধীনতা, আরও কতশত নারীর সুবিধার চটকদার খবর, কিন্তু একজন মাকে সন্তানের দেখাশোনার জন্য এখানে দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ার ছেড়ে দিতে হয়। যখন একজন চাকরিজীবী মা হয়ে যায়, তখন আসলে বোঝা যায় এসব সুবিধা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর। আমি সুযোগকে সুবিধা বলছি, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। একটা উদাহরণ দিই : নারীর যাতায়াত- ভোগান্তি কমানোর জন্য বাসে নারীর জন্য আলাদা করে বসার জায়গা নিয়ে কত ধরনের ট্রোল আর ঘৃণাভরা কথা, আপনি যতটা শুনতে পান, তা সমাজের মধ্যে থাকা অনুভবের সিকি ভাগও না। নারীকে কাজের মূল স্রোতে আনতে রাষ্ট্র যখন বসবার এই আলাদা জায়গা করেছে, তখন পুরুষতান্ত্রিক মনগুলো সেটাওমানতে পারছে না। বলতে থাকে : সমান অধিকার চাইলে বসার ব্যবস্থা আলাদা হতে হবে কেন! হ্যা একজন প্রিভিলেজড হিসেবে আপনার অনেক সময়ই হয়তো এই সুবিধা লাগে না। কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে এসব সুবিধা তাদের এগিয়ে যাবার জন্য সহায়ক হয়। যাহোক, মাত্র পাঁচটা সিট দিতে বলায় এই হাল, তাহলে সমান অধিকার হিসেবে অর্ধেক দাবি করলে, কত বড় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, অনুমান করা যায়। এই পুরোনো আলাপ তুলতে হলো, কারণ রাষ্ট্রের এই টেনে তোলার নীতি কতটুকু ঠুনকো, তা বুঝতে একদিনওসময় লাগবে না, আপনার জীবনের সঙ্গে যখন একটি সন্তান যুক্ত হবে। যে কোনও সূচকে যদি ধরেও নিই : নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমি এইটুকু তার সঙ্গে বলতে চাই, এগিয়ে যাওয়া নারীদের, যাদের সন্তান আছে, তাদের এই স্রোতে ধরে রাখতে সক্ষম নয় রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের কাঠামোতে এই নারীর বাচ্চার অস্তিত্বই নেই। আমাদের দেশে, একজন নারী মা হলে, সেই বাচ্চার দায়িত্ব, বড় পরিসরেশুধুমাত্র বাচ্চার মা-বাবার, আর ক্ষুদ্র পরিসরে শুধুমাত্র মায়েরই। জন্মের পর থেকে অন্তত স্কুলে ভর্তির আগ পর্যন্ত, এই রাষ্ট্র সমাজ কেউই, বাচ্চার বেড়ে ওঠায় কোনও ভূমিকা রাখে না।

আশির দশকেও যখন নারীরা এত বেশি চাকরি বা ব্যবসায় যোগ দেননি, তখন আসলে এ ধরনের সমস্যা এতটা প্রকট ছিল না। যারা চাকরি করেছেন, তারা বাচ্চা রেখে গেছেন বাসার অন্য সদস্যদের কাছে, তখনও মানুষে মানুষে এতটা অনাস্থা তৈরি হয়নি। প্রতিবেশীর কাছে, স্বজনদের কাছে, বাচ্চারা হেসে খেলেই বড় হয়েছেন। নিরাপত্তা, ব্যস্ততা, আন্তরিকতাসহ নানা কারণেই এখন এটা কল্পনা করাও যায় না। তার ওপর কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। অন্যদিকে ভেঙেছে যৌথ পরিবার। বাচ্চাদের প্রতিনানামুখী সহিংসতাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। তাহলে রাষ্ট্র কি করেছে! শহর থেকে গ্রামে, নারী ক্ষমতায়নে কত কিছু করছে, ক্ষমতায় থাকা সব রাজনৈতিক দল। কিন্তু কোথায় আমি? আমি তো চেয়েছি আমার বাচ্চা একজন আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল মা পাবে। শক্তির জায়গাটুকু সে শুধু বাবাকে পাবে কেন, মাও তাঁর বেড়ে ওঠায় সমান ভাবে অংশ নেবে। কিন্তু চৌদ্দ বছর পর শুধু বাচ্চাকে রাখার নিরাপদ ব্যবস্থা করতে পারিনি বলে  ছেড়ে দিয়েছি চাকরি । দয়া করে বলতে আসবেন না, ন্যানি বা ডে কেয়ারের কথা। কারণ : তিন বছর ধরে একটা মানুষ পাইনি, যাকে আমি যুতসই বেতন দিয়ে বাসায় রাখব। আমার অনেক আত্মীয়ই নামমাত্র বেতনে অনেককে রেখেছেন, কিন্তু একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে কারও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সেটা করতে পারিনি। কারণ : ১৪ বছরেও আমার সেই আর্থিক সক্ষমতা হয়নি, যাতে আমি এই ব্যবস্থা করি। একইভাবে ডে কেয়ারের খরচাও যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। এই প্রতিবন্ধকতার দায় কে নেবে!

অথচ সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে চল্লিশভাগ নারী কর্মী থাকলে, সেখানে অন্তত ৫/৬ টি বাচ্চা দেখাশোনার জন্য ডে কেয়ারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। একদিকে সরকার কর্মস্থলে নারীদের সংখ্যা বাড়াতে উৎসাহ দিচ্ছে, অন্য দিকে এসব সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে না। তাহলে এসব খাতাপত্রের নীতিমালা দিয়ে কিভাবে এগিয়ে যাবে নারীরা? সরকারি এক বিশেষ আদেশে সব সরকারি বেসরকারি অফিসে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার করার কথা বলা হয়েছে। মানে বাইরে থেকে যারা কোনও কাজে সেসব অফিসে যাবেন, বাচ্চা সঙ্গে থাকলে তাকে খাওয়াতে যেন অসুবিধায় না পড়তে হয়, সে কারণে এই ব্যবস্থা। যদিও নামমাত্র প্রতিষ্ঠান এই ব্যবস্থা রাখে। এর বাইরে এই ব্যবস্থার আর কোনও উপযোগিতা আমি পাইনি। কারণ শুধু ব্রেস্ট ফিড করানোর জন্য নিশ্চয়ই কেউ বাচ্চাকে অফিসে নিয়ে যাবে না। এসব অফিসে আপনি খাবার জায়গা পাবেন, নামাজ পড়ার জায়গা পাবেন, কিন্তু ডে কেয়ার সেন্টার পাবেন না। ছয় সাত মাসের এক শিশুকে বাসায় রেখে অফিসের সময়গুলো কিভাবে কাটে একজন মায়ের, তা কেবল ওই মা-ই অনুভব করতে পারেন। আমার মনে আছে, মেটার্নিটি ছুটির পর প্রথম অফিসে গিয়ে জানলাম, আমি যে বিভাগে কাজ করতাম, সেখান আর করতে পারব না। কোনও কারণ দেখানো ছাড়া, তারা আমাকে অন্য একটা বিভাগে কয়েকদিনের জন্য কাজ করতে অনুরোধ করে। আমিও অফিসের প্রয়োজন মনে করে করতে থাকি। পরে বুঝতে পারি তাদের অন্য পরিকল্পনা ছিল। যাই হোক অনভ্যস্ত একটা ডেস্কে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসতে শুরু করল। সহকর্মীদের ভারসাম্যহীন তুলনা, মানে, ওর তো বাচ্চা আছে, ওর তো এই অসুবিধা হয়না, তোমার কেনো হয়, ও তো পাশের বাসায় রেখে আসে, তোমার মতো উদ্বিগ্ন হয় না, তুমি এত ছুটি নাও, আরও তো অনেকের বাচ্চা আছে, তারা তো নেয় না… এ ধরনের নানা রকম কথা শুনতে হয়। এসব চাপের মধ্যেও বুক সারাক্ষণ টানটান হয়ে থাকত। আমাদের অফিসটা অনেক বড়, অনেক জায়গাও আছে। শুধু মনে হতো ইশ এইখানে যদি একটা ডে কেয়ারের মতো করে দিত, এই একটুখানি জায়গায়, বাচ্চাটাকে কাছে রেখে কাজ করতে পারতাম! বসদেরকেও বলি একটা ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা, কিন্ত হয়তো আমার মতো মেয়েরা সংখ্যায় কম, তাই তাদের কথা ভাবা হয় না। এরকম প্রতিদিন কাজের চাপ তার চেয়ে প্রতিযোগিতার চাপ, কে কত কম অসুবিধার কথা বলতে পারে, যাতে অফিস সন্তুষ্ট থাকে। এ‌ অবস্থায় আমি বাসায় গিয়ে বাচ্চাটার সঙ্গে একটু আনন্দে সময় কাটানোর শক্তি পেতাম না।

তার ওপর সহকর্মীদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সেটারও পরিবর্তনের সময় হয়েছে। নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই অসহযোগিতা দেখা যায়। আপনি হয়তো পুরুষ, বা যিনি মা হননি, সেই সহকর্মীর চেয়ে বাচ্চার খোঁজ-খবর নিতে বাসায় বেশি ফোনে যোগাযোগ করেন। বেশিরভাগ সময় এসব যোগাযোগকে অফিসের বসরা ডিসক্রেডিট হিসেবে দেখেন। বিশেষ করে গণমাধ্যমে এই প্রবণতা বেশি বলেই আমি মনে করি। জবের ধরনের কারণে, এইখানে যে যত কম ছুটি কাটায় তার সুনাম তত বেশি। অথচ বাচ্চার কারণে আপনার বছরে বরাদ্দ করা ছুটির বেশিরভাগই আপনার নিতে হয়। এটা নিয়েও কর্মক্ষেত্রে আপনাকে নানাভাবে সহকর্মী-বসদের কাছে অপদস্থ হতে হয়। আপনি বাচ্চার কারণে রাতে ডিউটি করতে পারবেন না, বসরা ক্ষোভ জানিয়ে বলবেন : মেয়েরা রাতে কাজ করতে চান না, এরপর আর নারী নিয়োগ দেবেন না। আপনি আর সবার মতো আট-দশ ঘণ্টা কাজ করলেও এসব কিছু আপনার ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলে। খুব সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলেও, বুঝতে পারার কথা, একটা এক/দুই বছরের বাচ্চাকে রেখে একজন মায়ের কি করে রাতে অফিসে সময় দেয়া সম্ভব। অথচ এটা ভাবার মানুষ পাওয়া যায় না যে, সারাদিন বাচ্চাকে পাশে রাখার ব্যবস্থা করলেই সেই মা-ও যেকোনো সময়ে কাজ করতে পারবেন । কিন্তু অফিসের বেশিরভাগ গেইটকিপাররা সমস্যাটিকে খুবই ফালতু কথা বা ঝামেলার ধরে এটা নিয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে আলোচনা করতেও চাইবেন না। ইদানীং একটি-দুটি প্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে ডে-কেয়ার। ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অফিস এবং দীপ্ত টিভির কথা আমি জানি। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সি বাচ্চাদের কাছে রেখে মা-রা কাজ করছেন সেসব অফিসে। বর্তমানে ৪৩ টি সরকারি চাইল্ড ডে কেয়ার রয়েছে। যার ২৪টি ঢাকায়, বাকিগুলো ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়। বেসরকারিভাবেও অনেক ডে কেয়ার চালু আছে। কিন্তু বেশিরভাগ অভিভাবকরা এর পেশাদারিত্ব, দক্ষতা আর নিরাপত্তা নিয়ে অভিযোগ করে থাকেন। আবার মান ভালো হলেও খরচ পড়ে যায় বেশি, যে কারণে সাধ্যে কুলায় না বেশিরভাগের।

প্রতিবছর নারী দিবস আসে, কত কিছু নিয়ে আলোচনা হয়। আবার চাপা পড়ে যায় কত বিষয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা না করলে, ব্যক্তি পর্যায়ে আসলে সম্ভব না। একজন কর্মজীবী নারীকে নানাভাবে একটা রাষ্ট্র তৈরি করছে,পুরুষের পাশাপাশি সমানভাবে যেকোন কাজে অংশ নিতে তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে তাঁর যখন সবচে বেশি সহযোগিতা দরকার তখন সেই নারীটি আর কাউকে তার সঙ্গে পচ্ছেন না। তাহলে তার পেছনে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের যে সময়, অর্থ ব্যয় হলো তা তো সব বৃথা হয়ে যায়।

আমরা জানি একদিনে সব কিছুর পরিবর্তন হয়ে যায় না। নতুন নীতিমালা যেমন হচ্ছে, এসব বাস্তবায়নেও দেখা দিচ্ছে বিভিন্নরকম চ্যালেঞ্জ। প্রাসঙ্গিকভাবে মাতৃতত্বকালীন ছুটির বিষয়টি যদি দেখি। সরকারি বিশেষ আদেশে কর্মজীবী নারীদের ছয় মাস ছুটি দিয়েছে সরকার। খুব সাধারণ হিসেবে এই ছুটি একজন মা সাধারণত নেয় বাচ্চা জন্মের একমাস বা দেড় মাস আগ থেকে। তার মানে বাচ্চা জন্মের পর তার হাতে সময় থাকে আর পাঁচ মাস। এদিকে পিতৃত্বকালীন ছুটি ১৫ দিন। দীর্ঘ সময় গণমাধ্যমে কাজ করার কারণে এই ছয় মাস ছুটি আসলেও কতটুকু দেওয়া হয় তা শুনলে বিস্মিত হবেন। সরকারি দপ্তর, ব্যাংক, কিছু উন্নয়ন সংস্থা এবং গণমাধ্যম ছাড়াএই ছুটি ছয় মাস পান না নারীরা। কোথাও চার মাস, কোথাও তিন মাস দেয়া হয়। যদি কেউ ছয় মাস ছুটি কাটায়, তাতে বাকি দুই মাস বিনা বেতনে ছুটি কাটাতে হয়। আবার কোথাও ছয় মাস বা তারও অধিক ছুটি কাটাতে চাইলে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বের হতে হয়। সরকারি নীতিমালা থাকলেও যে সেটা কার্যকর হয় না, বেশিরভাগ জায়গায় এর কারণ কি? আমি যতটুকু দেখেছি, মনে হয়েছে সরকার নীতিমালা করেই বিষয়টা নিয়ে আর দেখভাল করে না। কেউ ছুটি না পেলে কোথায় গিয়ে অভিযোগ করবে সে ব্যবস্থা নেই, আবার অভিযোগকারী যে নির্ভয়ে অভিযোগ করবেন তাও হবেনা, কারণ চাকরি হারাবার ভয় থাকে। অন্যদিকে অফিসগুলোতেও এই ছুটি নিয়ে কর্মকর্তা সহকর্মীদের মধ্যে আছে উদাসীনতা, আমি অবহেলাই বলতে চাই। কোনও দায়িত্ববোধ নেই বেশিরভাগের। নানারকম মানসিক পীড়নতো থাকেই। ছুটিতে যাওয়া অনেক নারীই আবার কর্মস্থলে ফিরতে পারে না। নানা কায়দায় ছাটাইও করা হয় তাদের। পোশাক শ্রমিকদের কাছ থেকে এই অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।

আবারও আসি চাইল্ড ডে-কেয়ার প্রসঙ্গে, আমি সত্যিই অবাক হচ্ছিলাম আসলেই কি কর্মজীবী মাদের টিকিয়ে রাখতে বাচ্চা সহায়ক বা যে কোনো কাঠামোতে কোনও কর্মসূচি নেই, এটা ভেবে। একটু মহিলা (নারী) ও শিশু মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট ঘাটাঘাটি করলাম। একটা কর্মসূচির শিরোনাম দেখে আমি তো খুশি হতে না হতেই শেষ পর্যন্ত আর সেটা স্থায়ী হয়নি। তবে আশান্বিত হয়েছি কিছুটা। কারণ একটা কিছু শুরু করা থাকলে সেটা অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নেয়া যায়। যাইহোক, পাইলট প্রকল্প হিসেবে ২০১১ সালে

কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল বাস্তবায়ন কর্মসূচি চালু হয়। প্রকল্পের মুখবন্ধে কিছু তথ্য আছে যা হবহু তুলে দিলাম এখানে :“বাংলাদেশের জনসংখ্যার তিন চতুর্থাংশ নারী ও শিশু। তাদের উন্নয়ন বাংলাদেশের উন্নয়ন। তাই নারী শিশুর সার্বিক উন্নয়ন ও দারিদ্র নিরসনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এসব কর্মসূচির অংশ হিসেবে শহর অঞ্চলে কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল কর্মজীবী মাদের শারীরিক, মানসিক ও আর্থসামাজিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।“

এরপর প্রকল্পে কারা সুবিধাভোগী হবেন, কত টাকা পাবেন, এগুলো দেওয়া আছে। কিন্তু আসলে এটা এত ক্ষুদ্র যে এর তেমন কোনও প্রভাব পড়ে না। দিনমজুর, শ্রমিক এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত। এবং খুব সামান্য টাকা। আমি বলতে চাইছি এর পরিসর বাড়াতে হবে। বড় প্রকল্প হাতে নিতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি দুই বছর করতে হবে। সেটা কতদিন পর্যন্ত বেতনসহ দেওয়া যাবে, কেউ আরও ছুটি চাইলে সেটা কতদিন পর্যন্ত বাড়াতে পারে, কেউ চাইলে বাসায় বসে অফিসের কাজ করতে পারবে কিনা, তেমন সুযোগ করা যায় কিনা,ছুটি না বাড়লেও ডিউটি আওয়ার কমানো সম্ভব কিনা, সেক্ষেত্রে বেতন কমিয়ে আনা বা সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু করা, সব কিছু নিয়ে অনেক আলোচনার দরকার আছে। যাতে একটা সুন্দর, সুস্পষ্ট কার্যকরী নীতিমালা

তৈরি করা যায়। এখন কর্মক্ষেত্র ডিজিট্যালি অনেক উন্নত। ছয় মাস এক বছর পর বাসা থেকেও ওই মা কাজ করতে পারে, এরকম ব্যবস্থা করা, কিংবা কাজের ধরন পাল্টে সে বাসা থেকেই কাজ করতে পারে, এমন কোনও দায়িত্ব দেওয়া, এসব অনেক বিকল্পই হতে পারে। শুধু দরকার সদিচ্ছা।

এসব না করতে পারলে হয়তো সবাই চাকরি ছেড়ে দেবে না কিন্তু একজন মানসিকভাবে সুস্থ এবং দক্ষ কর্মী তৈরির ক্ষেত্র অবশ্যই নষ্ট হবে। আর যারা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হবেন, সেসব মায়েরা সারাজীবন অন্যের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে থাকবেন। আর তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা হারিয়ে যাবে এসব অবহেলায়।

 

Khadijatul Kobra is a mother and  journalist.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!