চিকিৎসাশাস্ত্রের উপনিবেশায়ন আফ্রিকার জন্য নতুন কিছু নয়, মূল:কার্সটেন নকো

Share this:
[অনুবাদকের মন্তব্য: করোনা দুনিয়াব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর এর ভ্যক্সিন নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে বিবিধ কথা বলা হচ্ছে, আশা-নিরাশার দোলাচলে ভাসছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো মহল থেকে কোভিড-১৯ এর ভ্যক্সিনের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য আফ্রিকানদের শরীরকে গিনিপিগ বানানোর কথা বলা হয়। একজন ফরাসি ডাক্তার এমন একটা মন্তব্য করার তা নিয়ে বেশ বিতর্কের ঢেউ উঠে। কার্টেন নকো এই মন্তব্যকে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা হিসাবে দেখছেন না, বরঞ্চ কয়েকশন বছরের উপনিবেশেরই উত্তরাধিকারী হিসাবে দেখছেন; পূর্বেও চিকিৎসার অজুহাতে বিভিন্ন সময় আফ্রিকানদের শরীরকে ব্যবহার করা হয়েছে। এর গভীরে রয়েছে উপনিবেশায়ন সৃষ্ট বর্ণবাদ ও বিমানবীকিকরণের গভীর প্রক্রিয়া। কার্সটেন নকো জিম্বাবুয়ের আইনজীবী এবং জনহিতৈষী কাজের সাথে জড়িত আছেন। মেডিকেল কলোনাইজেশন বা চিকিৎসাশাস্ত্রের উপনিবেশায়ন নিয়ে তার লেখাটা প্রকাশিত হয়েছে আল জাজিরায়, ৮ এপ্রিল ২০২০।]

অনুবাদ : শুভম ঘোষ

 

গত বুধবার এক ফরাসি ডাক্তার কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিনের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের বিষয়ে মন্তব্য করে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেন। বিতর্কটা শুরু হয় যখন তিনি প্রস্তাব করেন যে এই পরীক্ষা আফ্রিকানদের উপরে চালানো উচিত কারণ তাদের কাছে পর্যাপ্ত মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর(পিপিআই) অভাব আছে।

শুক্রবার নাগাদ, বর্ণবাদের ব্যাপক অভিযোগ উঠার পর, তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হন এবং তখন তার পূর্বোক্ত মন্তব্যটিকে ‘কথার কথা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

কিন্তু এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে যেরূপ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো তা নতুন কিছু নয়। এবং এরূপ মন্তব্য এই ডাক্তারের কাছে ব্যতিক্রমী বা আচমকা কিছুও নয়। বরং এটি প্রজন্মের পর প্রজন্মের দেখে আসা কয়েকজনের শ্রেষ্ঠত্ব দাবির কারণে কিছু মানুষকে বিমানবীকিকরণ করার প্রবণতারই অংশ।

মার্চের প্রথম দিকে যখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে তখন কিছু কিছু মানুষ জিজ্ঞেস করতে শুরু করে যে আফ্রিকান দেশগুলোতে কেনো করোনার প্রকোপ বাড়ছে না। এই জিজ্ঞাসার মূল সুর ছিল, অফ্রিকানরা জৈবিকভাবে এই ভাইরাস প্রতিরোধে অধিক সক্ষম কিনা সে প্রশ্ন তুলা। কিন্তু এই প্রশ্ন কেন উঠবে যখন আমরা জানি সকল মানুষই জৈবিকভাবে একই গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী?

গ্লোবাল সাউথ-এর গ্লোবাল সাউথ বলতে দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলোকে বোঝায়) মানুষদের বিমানবিকীকরণ করার প্রচেষ্টা দাস ব্যবসা এবং উপনিবেশ স্থাপনের পিছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। (একজন মানুষকে নিজের চেয়ে নিকৃষ্ট বলে মনে না করা হলে মানুষ কেনা-বেচার ধান্ধা কারো মাথায় আসাটা অচিন্তনীয়।

জোসেফ কনরাড তার বই ‘হার্ট অব ডার্কনেস'(১৮৯৯)-এ আফ্রিকায় তিনি যেসব মানুষের দেখা পেয়েছেন তারা আসলেই মানুষ কিনা এই প্রশ্ন তুলেছেন। তার মতে- “না, তারা অমানুষ না। বুঝতেই পারছেন, তাদের এই অমানুষ না হওয়ার সন্দেহটাই সবচাইতে বাজে বিষয়।”

এই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হওয়ার পর ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর মানব’ ধারণার গ্রহণযোগ্যতা পাওয়াটা স্বাভাবিকই, এবং এই গ্রহণযোগ্যতাই দখলদারি ও মানুষ কেনা-বেচার নিকৃষ্টতম ব্যবসাকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার অনুমোদন দেয়।

বিমানবিকীকৃত জীবন, ফেটিশায়িত মৃত্যু

সার্টজি বার্টম্যান বা সারা বার্টম্যান (যে নামে তিনি অধিক পরিচিত) একজন খইখই(Khoikhoi woman is a member of a group of indigenous peoples of South Africa and Namibia – অনুবাদক) মহিলা ছিলেন। তিনি যেখানে জন্মেছিলেন সেটি আজকের দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৮১০ সালে তাকে অপহরণ করে ইউরোপে নিয়ে আসা হয় যেখানে তাকে তার দেহ এবং প্রশস্ত নিতম্বের কারণে ইউরোপীয় দর্শকদের প্রদর্শনীয় বস্তুতে রূপান্তরিত করা হয়।

অনেক ইউরোপীয় দর্শক তাকে দেখতে আসেন কারণ তাদের ধারণা ছিলো তিনি মানুষ নন। বার্টম্যান মারা যাবার পর একজন ফরাসি সার্জন তার শব ব্যবচ্ছেদ করেন এবং বলেন তার দেহে শিম্পাঞ্জির বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

২০০২ সালে সাউথ আফ্রিকা তার দেহাবশেষ প্যারিসে অবস্থিত ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল মিউজিয়াম থেকে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়। তার আগ পর্যন্ত ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার দেহাবশেষ ওখানে প্রদর্শিত হয়েছে। বার্টম্যানকে জীবিত অবস্থায় বিমানবীকিকৃত এবং মরণের পর ফেটিশায়িত করা হয়েছিল, এমন এক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের তাগিদে সেটি করা হয়েছিল যা সাদা ও কালো মানুষের জৈবিক ও বৈজ্ঞানিক পার্থক্য আঁকার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল।

বার্টম্যানের মৃত্যুর দু’শো বছর পর আজকের পৃথিবীতে কিছু চিহ্নিত গোষ্ঠীর মানুষকে ন-মানুষ হিসেবে প্রকাশ্যে আর মূল্যায়ন করা হয় না। তবে বিভিন্ন উপায়ে কিছু মানুষের জীবনকে বাকিদের স্বার্থে জলাঞ্জলি দেয়ার প্রবণতা আজও বিদ্যমান।

২০১৪ সালে যখন অফ্রিকা জুড়ে ইবোলা ছড়িয়ে পড়ে তখন ডাক্তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্য থেকে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা গবেষনা করার জন্য ও প্রতিষেধক তৈরির জন্য প্রায় আড়াই লক্ষ রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে এবং প্রায়শই রোগীর কোনপ্রকার সম্মতি ছাড়াই।

কতগুলো নমুনা এখনো তাদের কাছে আছে দক্ষিণ আফ্রিকান, আমেরিকান ও ফরাসি গবেষকরা ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ অজুহাতে এখন সে তথ্য প্রকাশ করতে চান না। একজন রোগী বলেছেন, “তারা এগুলো গবেষণার কাজে লাগাচ্ছে, যা থেকে কোটি কোটি ডলার আয় করা যাবে…….. তারা যে ঔষধটি তৈরি করবেন তা সবার জন্য বিনামূল্যে দেয়া হবে না। আপনি আসলে এটি বিক্রি করবেন।”

কারণ আক্রান্ত জনগোষ্ঠী গরীব এবং অসহায়, তারা জানেন না কীভাবে এই গবেষকদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা যায়। তাদের সম্মতি ছাড়াই তাদের রক্তের নমুনা নিয়ে গিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে এবং ওষুধ তৈরি করা হচ্ছ। এই ওষুধ কেবল তাদের জন্যই তৈরি করা হচ্ছে যারা এটা কেনার জন্য অর্থ খরচ করতে পারবেন।

মেডিকেল ট্রায়ালের দীর্ঘ ইতিহাস

১৯৯৬ সালে নাইজেরিয়ার কানো প্রদেশ ম্যানেনজাইটিস সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। তখনকার সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গবেষণাভিত্তিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজার(Pfizer) সিদ্ধান্ত নেয় যে কানোতে তারা একটা ওষুধের পরীক্ষামূলক ট্রায়াল চালাবে। কিন্তু ফাইজার রোগীদের অবিভাবকদের কাজ থেকে কোনোপ্রকার অনুমতি গ্রহন করার বিষয়টি আমলে নেয় নি। যদিও এমন পরিস্থিতে এই অবিভাবকেরা যৌক্তিক সিন্ধান্ত নেয়ার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলেন না। অবশেষে ২০০৯ সালে ফাইজার বিচারিক প্রক্রিয়া এড়িয়ে কানো’র প্রাদেশিক সরকারকে ৭৫ মিলিয়ন ডলায় এবং এই মহামারি ও ক্লিনিকাল ট্রায়ালের সময় মারা যাওয়া চার শিশুর পরিবারকে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

যদিও ফাইজার আইনী প্রক্রিয়ায় নিজেদের আত্মসমর্থনে বলেছে যে ঐ চার শিশু রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে এবং তাদের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য নয়, তবু বিচারিক প্রক্রিয়া বর্হিভূত বন্দোবস্ত ফাইজারের কাছ থেকে আদালতের সামনে চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ ছিনিয়ে নিয়েছে।

একই ধরনের পরীক্ষামূলক গবেষনা চালানো হয়েছিলো জিম্বাবুয়েতে ১৯৪৪ সালে। সেক্ষেত্রে আমেরিকা ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিডিসি(CDC) এবং এনআইএইচ(NIH)-এর অর্থায়নে এজেডটি(AZT) নামক এক ওষুধের পরীক্ষামূলক ট্রায়াল চালায়, রোগীদের মধ্যে যার প্রভাব ছিলো ভয়াবহ। উনিশ শতকের শুরুর দিকে নামিবিয়ায় জার্মান ডাক্তারেরা হেরেরো(a member of a people living in Namibia, Angola, and Botswana- অনুবাদক) নারীদের উপর স্টেরিলাইজেশনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। এই ডাক্তাররা মিশ্র-জাতি বিবাহ নিষিদ্ধ করার জন্য “বৈজ্ঞানিক” পাঠাতন খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন।

গবেষকরা খুব ভালো করেই জানেন গ্লোবাল নর্থ-এ(উন্নত দেশগুলো) এ ধরনের গবেষণা পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব এবং বহু আইনি বেড়াজাল রয়েছে। কিন্তু গ্লোবাল সাউথে(অনুন্নত দেশগুলো) বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যালসগুলো প্রায়ই দূর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সাহায্যে তেমন কোনো জটিলতা ছাড়াই এসব গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন।

যেহেতু তাদের উদ্দেশ্য থাকে শুধুমাত্র লাগামহীন মুনাফা তাই রোগীদের জীবনের বিষয়টি প্রায়শই মূল বিবেচনার বাইরেই রয়ে যায়। স্পষ্টতই আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর উপর চালানো এসব গবেষণার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে কিছু ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করা যারা নিজেদেরকে জনহিতৈষী বলে দাবি করেন।

আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এখনো টিবি, ম্যালেরিয়া এবং হ্যাপাটাইটিস এর মত ব্যধিতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায় অথচ এগুলো নিরাময়ের জন্য যে পরিমান সম্পদ ব্যয় করা হয় তা কোভিড-১৯ বা ইবোলা দমনে ব্যয় করা সম্পদের ধারেকাছেও নেই। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কোন ব্যধি গুরুত্ব পাবে আর কোনটি পাবে না তা নির্ধারিত হয় সেটি কোন জাতিগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করছে বা করার সম্ভাবনা আছে।

কল্পিত সংশয়?

২০১১ সালে, ওসামা বিন লাদেনকে খোঁজাখুঁজি করার সময় সিআইএ একটি আন্তর্জাতিক এনজিও’র মাধ্যমে প্রতিষেধক বিতরনের পুরোপুরি বানোয়াট একটি কর্মসূচির নাম করে পাকিস্তান থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে। এই ঘটনার প্রভাবে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান জটিল সম্পর্ক আরও জটিলতর হয়েছে। কিন্তু যারা সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, গ্লোবাল নর্থ থেকে ওষুধ সরবরাহ রাখার পিছনে গোপন স্বার্থ রয়েছে, তাদের সন্দেহের পালে এই ঘটনা আরো হাওয়া দিয়েছে।

করোনা মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টায় কাজের ভারে নতজানু চিকিৎসাবিদদের সবর্শেষ প্রয়োজন হচ্ছে তাদের সহকর্মী চিকিৎসাবিদদের কাছ থেকে তথাকথিত ‘আনাড়ি’ মন্তব্য।

কিন্তু যখন একজন ফরাসি ডাক্তার বলেন আফ্রিকাকে (যেখানে করোনার প্রকোপ অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম) করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক ট্রায়ালের আওতায় আনতে হবে তখন এর পেছনে অন্যকিছুর গন্ধ খুঁজে পাওয়া ও ক্রোধান্বিত হওয়া আশ্চর্যজনক কোনো বিষয় নয়।

করোনা প্রকোপের বর্তমান পরিস্থিতিতে, আফ্রিকায় চলমান মেডিকেল উপনিবেশের ইতিহাস মাথায় রেখে আমরা কীভাবে ফরাসি ডাক্তারের এমন মন্তব্যকে অব্যাহত বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ধারাবাহিকতা (কিছু মানুষকে খরচযোগ্য হিসেবে দেখার বিমানবীকিকরণ মূলক প্রবণতা) ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করতে পারি?

এটা কীভাবে আশা করা হয় যে আফ্রিকানরা এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাবে না যেখানে কার্যকরী ওষুধ তৈরি করার জন্য তাদেরকে আরেকবার গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হবে, যে ওষুধ গ্লোবাল নর্থের মানুষদের উপকারে আসবে যাদের কিনা জীবন রক্ষাকারী দামী ওষুধ সরবরাহ করতে সক্ষম সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়েছে অথচ যার অভাবে প্রায়ই অফ্রিকানরা মারা যাচ্ছে?

Shuvom Ghosh, Completed graduation in English Literature from Shahjalal University of Science and Technology. Involved in Literary translation. Topics of interest are literature-criticism, politics, political theory.

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!