ভুমিকা: মিকা নাতিফ Mika Natif আমেরিকান পণ্ডিত; কাজ করেন মূলত ইসলামি জগতের শিল্প ইতিহাস নিয়ে। নিচে অনূদিত ‘Painters will be Punished’ – The Politics of Figural Representation Amongst the Umayyads শীর্ষক তার প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ‘The Image Debate: Figural Representation in Islam and Across the World’ (২০১৯) নামক গ্রন্থে। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেন ক্রিশ্চিয়ান গ্রুবার। গ্রুবারের আরো কিছু আর্টিকেল ইতোমধ্যে শুদ্ধস্বরে প্রকাশিত হয়েছে। ছবি ও ভাষ্কর্য নিয়ে ইসলামি দুনিয়াতে বিভিন্ন সময় যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় বা চালু আছে তাতে এই প্রবন্ধগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক তুলে ধরে পারে আমাদের ধারণা। সেই তাগিদ থেকে, বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায়, এই প্রবন্ধগুলো বাংলা ভাষায় হাজির করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মিকা নাতিফের প্রবন্ধটি হুবুহু অনুবাদ না করে বরঞ্চ ভাবানুবাদ করা হয়েছে। ফলে লেখক প্রদত্ত ফুটনোট, তথ্যসূত্র, ইসলামি শব্দের ব্যাখ্যা [যা আমাদের কাছে বহুল প্রচলিত] বাদ দেয়া হয়েছে। ভাবানুবাদ হওয়ার কারণে তথ্য-উপাত্ত সব ঠিকঠাক রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে প্রদত্ত তথ্য-উপাত্তের সূত্র যাচাই বাছাই করার জন্য আগ্রহী পাঠকদেরকে মূল প্রবন্ধ পাঠের সাহায্য নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে।www.academia.edu/42950254/_Painters_will_be_Punished_The_Politics_of_Figural_Representation_amongst_the_Umayyads_। প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন শুদ্ধস্বরের অনুবাদ টিম।
সাধারণত অধিকাংশ শিল্প-ইতিহাসের বইপুস্তকে বলা হয় ইসলামে ছবির ব্যবহার ও উৎপাদন, বিশেষ করে ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিতে, নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তদপুরি উমাইয়াদের প্রথম মুসলিম সাম্রাজ্যে [661–750 CE] ছবির ছড়াছড়ি ছিল। আপাত এই গরমিলের উৎস হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট হাদিস।সাইদ ইবনে আবু আল-হাসান থেকে বর্ণিত হাদিসটি এর স্পষ্ট নমুনা:
‘আমি ইবনে আব্বাস (রা.) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম, এমন সময়ে তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আবূ আব্বাস! আমি এমন এক ব্যক্তি যে, আমার জীবিকা হস্তশিল্পে। আমি এসব ছবি তৈরি করি। ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁকে বলেন, (এ বিষয়ে) রাসুলুল্লাহ (স:)-কে আমি যা বলতে শুনেছি, তাই তোমাকে শোনাব। তাঁকে আমি বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোন ছবি তৈরি করে আল্লাহ তা’আলা তাকে শাস্তি দিবে, যতক্ষণ না সে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে। আর সে তাতে কখনো প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে না।(এ কথা শুনে) লোকটি ভীষণভাবে ভয় পেয়ে গেল এবং তাঁর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। এতে ইবনে আব্বার (রা.) বললেন,আক্ষেপ তোমার জন্য, তুমি যদি এ কাজ না-ই ছাড়তে পার, তবে এ গাছপালা এবং যে সকল জিনিসের প্রাণ নেই তা তৈরি করতে পারো।’ [ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত বুখারী শরিফের চতুর্থ খণ্ড থেকে]
এই হাদিসে দেখা যাচ্ছে, নবীজী যে কোনো মাধ্যমে জীবের ছবি আঁকাকে আল্লার সৃষ্টির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করেন এবং যারা ছবি তৈরি করবেন তাদেরকে রোজ কিয়ামতের দিন তাদের আঁকা জীবের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। যদি ব্যর্থ হোন তবে আল্লাহ তাকে শাস্তি প্রদান করবেন। চিত্রশিল্পীদের উপর এমন কঠিন ধর্মতাত্ত্বিক রায় বিবেচনায় নিলে আমরা মুসলমান জগতে অতি অল্প ছবিই প্রত্যাশা করতে পারি। হাজার হোক, নিশ্চিত দোজখে যাবেন জেনেও কেন একজন বিশ্বাসী মুসলমান সচেতনভাবে ছবি আঁকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন?
কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে মুসলিম জগতের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ওপর জরিপ করলে স্পষ্টতই দেখা যায় যে, ক্যালিগ্রাফি, অলঙ্কার ও জ্যামিতির পাশপাশি অঙ্কিত জীব-জন্তুর ছবি [ফিগারেল রিপ্রেজেন্টেশন] রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিক ও ধর্মীয় পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।এমন গরমিলের উত্তর দিতে আমরা অনুমান করতে পারি যে, যারা এই ছবি এঁকেছিলেন তারা হয়তোবা অ-বিশ্বাসী বা অন্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের কাছে এই যুক্তিও ধোপে টিকে না, কারণ আমরা এমন অনেক শিল্পীর সন্ধান পাই যারা ধার্মিক মুসলমান ছিলেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন; এদের মধ্যে অনেকেই জীব-জন্তুর ছবি [ফিগারেল রিপ্রেজেন্টেশন] ও প্রতিকৃতি অঙ্কনে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এখন ছবি-বিরোধী ধর্মীয় নির্দেশনা এবং উপরোক্ত শিল্প-চর্চার মধ্যে এই স্ববিরোধীতাকে [প্যারাডক্স] আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবো? ইসলামের শুরুর শতকগুলোতে কি আদৌ এমন স্ববিরোধীতা ছিল?
আমি প্রস্তাব করতে চাই যে, উমাইয়া শাসনের অভিজাত এবং তাদের বিরোধী মহলের মধ্যকার যে মতাদর্শিক উত্তেজনা বিরাজ করছিল সাইদ ইবনে আবু আল-হাসান কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটি তার একটা আলামত। সপ্তম শতকের শেষ ভাগ ও অষ্টম শতকের শুরুর ভাগে বিশেষত বসরা অঞ্চলের ধর্মীয় পন্ডিত বা আলেম-উলামারা উমাইয়া শাসনের বিরোধী মহলে ছিলেন। ছবির বিরোধীতাকে বৈধতা প্রদানকারী হাদিসটি প্রচারের জন্য উলামা সদস্যরাই দায়ী ছিলেন।
উমাইয়া সাম্রাজ্যের অধীনে কুফার মতো বসরাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ-শহর এবং সাম্রাজ্যের (আল-মাশরিক) পূর্বাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নগর-কেন্দ্র।যেখানে পশ্চিমাঞ্চল দামেস্কের খলিফার সরাসরি শাসনের অধীনে ছিল, সেখানে পূর্বাঞ্চল পরিচালিত হতো খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত একজন প্রতিনিধি[ভাইসরয়] দ্বারা। আল-মাশরিকের কুফা ও বসরার মতো কিছু সার্কেলের সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের একটা টানাপোড়ন সবসময় জারি ছিল; শিয়া, খারিজি, যুবির, আশাথ এবং মুহাল্লাবিদের মতন বিভিন্ন বিদ্রোহী দলও এতে যুক্ত ছিল। এর আগে উমাইয়া সাম্রাজ্যের প্রথম খলিফা মুয়াবিয়া একইধরণের পূর্বাঞ্চল-বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন; তিনি বলেছিলেন যে তিনি ‘পূর্বাঞ্চলের তুলনায় পশ্চিমাঞ্চলকেই বেশি পছন্দ করেন, কারণ পশ্চিমাঞ্চল তার কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেছে’। ফলে, এই হাদিসটিকে আমরা একটা স্থানিক পরিপ্রেক্ষিতে তাফসির বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ [ইন্টারপ্রেট] করতে পারি এবং সপ্তম শতকে বসরা অঞ্চলে যে ধরণের উমাইয়া-বিরোধী মনোভাব জারি ছিল তারই একটা প্রতিফলন হিসেবেও বিবেচনা করতে পারি। এই হাদিসের আরো সূক্ষ্ম ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ এবং সমসাময়িক শিল্পের কাজকারবার উমাইয়া সাম্রাজ্যের অধীনে ছবিগুলোর সাথে বিভিন্ন সম্পর্কের গভীর অর্থোদ্ধারে সাহায্য করবে।
সাম্রাজ্য স্থাপনের দিক থেকে উমাইয়ারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা প্রথম মুসলমান রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন এবং বহুবিধ নতুন প্রতিষ্ঠান, নিয়ম, আইন-কানুন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, প্রশাসনিক চর্চা এবং প্রতীকী [ভিজুয়াল] ভাষা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত চালু ছিল। যদিও উমাইয়া ও উলামাদের মধ্যে একধরণের বিরোধাত্মক চিত্র প্রায়শই বর্ণনা করা হয়ে থাকে তবু তারা সম্পূর্ণ বিরোধী দল ছিলেন না। স্টিভেন জুড এমন বহু উলামার উদাহরণ দিয়েছেন যারা উমাইয়াদেরকে সমর্থন করেছিলেন এবং তাদের শাসনের অধীনেই কাজ করছিলেন; পাশাপাশি এমন অনেকেই ছিলেন যারা তাদের [উমাইয়াদের] সমালোচনা করেছিলেন এবং শাসনের পৃষ্ঠপোষকতাকে পরিহার করেছিলেন।
এই প্রবন্ধে আমি উমাইয়া সাম্রাজ্যে অঙ্কিত জীব-জন্তুর ছবির [ফিগারেল রেপ্রিজেন্টেশন] কয়েকটি কেস-স্টাডি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবো, এবং এই হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা বিশ্লেষণ করবো। আমার যুক্তি হচ্ছে যে, এই ছবিগুলো উমাইয়াদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব ও খেলাফতের ধর্মীয় কর্তৃত্বের দৃশ্যত চিহ্নের [ভিজুয়াল সাইন] সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলো ‘ধর্মীয়’ ও ‘সেকুলার’ পরিধির মধ্যকার সচলতার [ফ্লুইডিটি] দিকে আলোকপাত করে; একইভাবে উমাইয়া আমলের কর্তৃত্ব, ডিভাইনিটি ও ছবি-তৈরির উপর বাদ-বিবাদ-তর্ক-বিতর্ককেও তুলে ধরে। খলিফার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্বকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে অনেক উলামাই এই হাদিসটি প্রচারের মাধ্যমে বসরাতে সুপ্ত থাকা উমাইয়া-বিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।
হাদিসের প্রচার:
ছবি-বিরোধী এই হাদিসের পথচলার একটি রূপরেখা দিয়েই শুরু করা যাক। এর প্রধান বর্ণনাকারী ছিলেন ইবনে আব্বাস [d. 687–88 CE], যিনি আনুমানিক ৬৫৭-৬১ পর্যন্ত বসরার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি চতুর্থ খলিফা হযরত আলী কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে ৬৬১ সাল নাগাদ হযরত আলী নিহত হন। [লেখক প্রবন্ধে উমাইয়াদের হাতে আলী নিহত হওয়ার কথা লিখেন, কিন্তু সেটা সত্য নয়। আলী প্রাণ হারিয়েছিলেন খারিজিদের হাতে] উল্লেখ্য, ইবনে আব্বাস হযরত আলীর সহযোগী ছিলেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনায় তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তাদের এই সম্পর্ক হাদিসটির পিছনে উমাইয়া-বিরোধী মনোভাবের ধারণাটিকে আরো পাকাপোক্ত করে এবং বসরাতে রাজনৈতিক উত্তজেনা উষ্কে দিতে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকাকে আরো জোরদার করে। ছবি বিরোধী এই হাদিসের রাজনীতিকরণ এবং এর উমাইয়া-বিরোধী উদ্দেশ্য আরো স্পষ্ট হয় তফসিরের অন্য আরেক সংস্করণে যেখানে বলা হয়েছে নিন্দিত জীবজন্তুর ছবি তৎকালীন মদিনার গভর্নর (662–69 CE] মারওয়ান ইবনে আল-হাকামের বাড়িতে দেখা যায়। মারওয়ান পরবর্তীতে উমাইয়া সাম্রাজ্যের খলিফাও হয়েছিলেন (r. 684–85 CE)। কুফার বিভিন্ন ধর্মীয় কর্তাব্যক্তিদের মাধ্যমে এই রায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এই শহর [কুফা] উমাইয়া কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য কুখ্যাত বা বিখ্যাত ছিল। এটা মাথায় রেখে এই হাদিসকে উমাইয়া-বিরোধী আরেকটি আলামত হিসেবে দেখা যায়।
ছবি সংক্রান্ত এই হাদিসধারার উৎস ও বিস্তার সঠিকভাবে শনাক্ত করা বিভিন্ন কারণেই [পাঠের ভিন্নতা, হাদিসের সিলসিলা ইত্যাদি] কঠিন। তদপুরি বর্তমানে পদ্ধতিগত পাঠ হাদিস প্রচারের যৌথ ব্যবস্থা, সময় ও ভৌগলিক অঞ্চল আরো নিখুঁতভাবে দেখাতে সাহায্য করে। যেমন, জোয়েল ব্লেচারের গবেষণা কিছু অমূল্য তথ্য আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। দেখা যাচ্ছে যে অষ্টম শতকে উমাইয়া সাম্রাজ্যের সময়ে বিভিন্ন উলামা বা ধর্মীয় কর্তাব্যক্তিদের মাধ্যমে এই হাদিসটি বসরায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ইবনে আব্বাস থেকে এই হাদিস নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের কাছে যায়: বসরার আবু নাদ্রা [d. 727 CE]; বসরার সাইদ ইবন আবি আল-হাসান [d. 727 CE]; এবং বসরার আল-নাদির ইবনে আনাস [d. 727 CE]। এর দ্বিতীয় সিলসিলা গিয়েছে বসরার ইবনে আব্বাসের দাস ইকরিমা ইবনে আব্দাল্লা [d. 723–24? CE] হয়ে বসরার ক্বাতাদা ইবনে দাইমা আল-সাদুসি [d. 735–76 CE] এবং আইয়ূব আল-সিখতিয়ানি [d. 748 CE] পর্যন্ত। যেহেতু উমাইয়া দরবারের অভিজাতরা উচু মানের ছবিসমূহের প্রাথমিক পৃষ্ঠপোষক বা স্পন্সর ছিলেন সেহেতু এই হাদিসের বিস্তারকে উলামাদের তরফ হতে দরবারের সমালোচনা হিসেবে দেখা যায়। এর মানে এটা বলা হচ্ছে না যে এই হাদিস বর্ণনাকারীরাই উমাইয়াদের বিরোধীতা শুরু করেছিলেন বা এর জন্য দায়ী ছিলেন, বরঞ্চ কেবল এটা বলা হচ্ছে যে তারা এই বিরোধিতায় অবদান রেখেছিলেন।
ছবি, রাজনীতি ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব:
উমাইয়া শাসনামলে অঙ্কিত জীবজন্তুর ছবির প্রাথমিক উদাহরণগুলো দরবারের সাথে জড়িত এবং এতে মুদ্রা [কয়েন], দেয়ালচিত্র, ভাষ্কর্য, মোজাইক ছাদ এবং কাপড়ও অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য যে এর কয়েকটি বিশেষভাবে বসরার সাথে সংযুক্ত ছিল। তুলতুল আল শায়েবার ছোট প্রাসাদের পলেস্তারার অলঙ্করণ খিরবাত আল-মাফজারের চিত্রের সমরূপ। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইয়াকুত আল-রুমি [1179–1229 CE] তাঁর মুজাম আল বুলদান গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, উমাইয়া সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি [ভাইসরয়] উবায়েদ আল্লাহ ইবনে জিয়াদের বানানো বসরার গভর্নরের প্রাসাদে বহু ছবি ও পশু-পাখি শিকার সংক্রান্ত চিত্র ছিল।
বৃহত্তর সিরিয়ার ঐতিহাসিক অঞ্চলে অবস্থিত উমাইয়া সাম্রাজ্যের প্রাসাদগুলোতে জীবজন্তুর ছবি সম্বলিত দেয়ালচিত্রের খোজ পাওয়া যায়। জর্ডানের ক্বাসাইর আমরার ছোট প্রাসাদে অষ্টম শতকের এর চমৎকার নমুনা পাওয়া যায়; উমাইয়া শাসনামলের ছবি আঁকা বা তৈরির সমৃদ্ধশালী ঐহিত্যের কিছুটা আন্দাজ এতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন প্রাণী, ক্রীড়া ও শিকারের চিত্রের পাশাপাশি এই ম্যুরালগুলোতে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে বেশ কিছু নগ্ন বা স্বল্পবসনা নারীর চিত্রও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। (ছবি- ১) বিচিত্র ধরণের চিত্র ও ছবি উমাইয়া শাসনের শৈল্পিক ঐতিহ্যের একটা সংক্ষিপ্তরূপ আমাদের সামনে হাজির করে যা কিনা প্রাচীন যুগের শেষভাগ, বাইজেন্টাইন এবং সম্ভবত সাসানিয় বিভিন্ন উপাদানকে ব্যবহার করে একটি নতুন দৃশ্যত বা ভিজুয়াল ভাষা প্রদান করেছিল।

ক্বাসায়ির আমরার ছবির সামগ্রিক অর্থটি আজ অবধি অধরা রয়েছে, ফলে এটি অজস্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্ম দিয়েছে। যেমন, ওলেগ গ্রেভারের মতে এই ছবিগুলো সম্ভবত উমাইয়া সমাজের উচু তলার নারীদের জগত ফুটিয়ে তুলেছে, অথবা নারী জীবনের পরিসরের প্রতি পুরুষালি দৃষ্টি ফুটিয়ে তুলেছে। অন্যদিকে গার্থ ফোডেন প্রাচীন যুগের শেষভাগ ও প্রাক-ইসলামি আরব সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে এগুলোকে বিচার করেছেন; শিকার, নারী সৌন্দর্য এবং খোদ পৃষ্ঠপোষকের বিলাসবহুল জীবনযাপনের আনন্দ-ফুর্তির সাথে ছবিগুলোকে সংযুক্ত করেছেন। নতুন নতুন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই দুই ব্যাখ্যাকেই পুনঃমূল্যায়ন করতে হবে। ২০১১ সাল থেকে প্রাসাদ এবং এর দেয়ালচিত্রগুলো বিস্তর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিশোধন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছে; এগুলো ছবি সম্পর্কিত জ্ঞানের পরিবর্তন ও বিস্তার ঘটাচ্ছে। ফলে পরিচিত অনেকগুলো ছবির বিষয়ে নতুন নতুন বিষয় উঠে আসছে। যেমন,পশ্চিম আইলের পিছনের দেয়ালে অবস্থিত নারী মূর্তিকে এখন পুরুষ মূর্তি ভাবা হচ্ছে, সম্ভবত আল-ওয়ালিদের ছবি।
এর সাথে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক বিষয় হচ্ছে সম্প্রতি শ্রোতাদের কক্ষে [অডিয়েন্স হল] পরিশোধিত আরবি লিপিতে উমাইয়া রাজপুত আল-ওয়ালিদ ইবনে ইয়াজিদের নামোল্লেখ পাওয়া গিয়েছে; তিনিও ভবিষ্যতে খলিফা হন [খলিফা দ্বিতীয় আল-ওয়ালিদ (743–44 CE)]। এই লিপি স্পষ্টত প্রাসাদে অঙ্কিত জীবজন্তুর সাথে উমাইয়াদের পৃষ্ঠপোষকতাকে সংযুক্ত করে এবং ৭২৫ থেকে ৭৪৩ সাল পর্যন্ত এর বিভিন্ন আলংকারিক আয়োজনের সংবাদ প্রদান করে। মজার বিষয় হচ্ছে, সম্ভবত এই সময়েই বসরাতে ছবি-বিরোধী হাদিসটি প্রচারিত হয়েছিল। এই হাদিসের সকল বর্ণনাকারীই অষ্টম শতকের প্রথম অর্ধেকেই বসরাতে সক্রিয় ছিলেন। যদিও বসরাতে এই হাদিসের প্রচারের সাথে জর্ডানের ক্বাসায়ির আমরার সৃষ্টির কোনো সরাসরি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু কালিক পারষ্পরিক সম্পর্কটা লক্ষণীয়।
সম্প্রতি একটা ব্যাখ্যায় নাদিয়া আলি ইসলাম ধর্মীয় ছবি সম্পর্কিত একটি পাঠের কথা উল্লেখ করেন। (ছবি-২) তিনি যুক্তি দেখান যে, ড্রেসিংরুমে অঙ্কিত ছবি [ইসা নবীর জন্ম সম্পর্কিত ছবি] মানব জীবনে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের আলামত বা প্রমাণকে তুলে ধরেছে। ইসলামী ঐতিহ্যে ইসা নবীকে আল্লাহর নবী ও নবী মোহাম্মদের পূর্বসূরী হিসেবে দেখা হয়। দেয়ালচিত্রের শিল্পী ‘Dionysus discovering Ariadne asleep on the beach at Naxos’ এবং ‘Leto’s labour’ শীর্ষক গ্রীক পৌরাণিক থিম ব্যবহারের পাশাপাশি যিশু বা ইসা নবীর জন্ম নিয়ে খৃষ্টীয় আইকনোগ্রাফিকে ব্যবহার করেন; প্রতিটা ক্ষেত্রেই তিনি সূক্ষ পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এতগুলো বৈচিত্রময় ঐতিহ্যকে একত্রে মিশিয়ে শিল্পীরা শেষ নবী [মুহাম্মদ] পর্যন্ত নবীদের পরম্পরা বা সিলসিলা দ্বারা প্রকাশিত ঐশ্বরিক বার্তার অবিচ্ছিন্ন ধারা সম্পর্কে উমাইয়াদের ইসলামি ধরণের [islamicate] একটি ধারণার দৃশ্যগত ও মানসিক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন। ঐশ্বরিক জন্মের ছবির মাধ্যমে হবু খলিফা সেই সিলসিলাতে নিজের অবস্থান দাবি করতে পারেন, কিন্তু সেটা নবী হিসেবে নয়, বরঞ্চ তার বিশ্বাসের একজন রক্ষাকারী হিসেবে। এভাবে উমাইয়া শাসকরা তাদের খেলাফতের আল্লাহর সুরক্ষা উপভোগ করেছিলেন এবং ‘তার জনগণের তরফ হতে’ তার হস্তক্ষেপ। এই ব্যাখ্যার সাথে ক্বাসিয়ার আমরার দেয়ালচিত্রে থাকা অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা নবীদের অস্তিত্বের বিষয় যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন, নবী ইব্রাহিম, নবী দাউদ, নবী ইউনুস এবং সম্ভবত নবী আইয়ুব। তারা সকলেই নবীদের সেই সিলসিলায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

উমাইয়া শাসকদের ছবি ব্যবহার [এমনকি ধর্মীয় স্থানেও] ও পৃষ্ঠপোষকতার খবর পাওয়া যায় খলিফা উমর ইবনে আব্দ আল-আজিজের সাথে যুক্ত একটা কাহিনী থেকে [r. 717–720 CE]। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, ক্বাসায়ির আমরার চিত্রাঙ্কনের দুই যুগ পূর্বে খলিফা মানব ছবি সম্বলিত একটু ধুপধানি মদিনার মসজিদে ব্যবহার করতেন যেটা তিনি সিরিয়া থেকে নিয়ে এসেছিলেন। আরো জানা যায় যে আপত্তিকর মনে হওয়ায় তিনি গোসলখানা থেকে একটি ছবি সরানোর আদেশ দিয়েছিলেন। ক্রেসওয়ালের মতে, এই দেয়ালচিত্রে সম্ভবত অশ্লীল [পর্নোগ্রাফিক] ছবি ছিল, এটাই খলিফার অননুমোদনের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে। ফলে এখানে ছবির সমস্যাটা কিন্তু ছবির অবস্থান বা ছবিতে প্রাণীর উপস্থিতি আছে কি নাই সেটা না, বরঞ্চ সমস্যাটা হচ্ছে এর বিষয়বস্তু।
অন্যান্য উমাইয়া খলিফারা ধর্মীয়-মহাজাগতিক বিষয়াদি সম্পর্কিত ছবি আঁকাকে উৎসাহ দিতেন, যেখানে শাসক এবং তার সাম্রাজ্যের উপর আল্লাহর তরফ থেকে আসা সমৃদ্ধি এবং পার্থিব প্রাচুর্যতার লক্ষণগুলোকে তুলে ধরা হতো। যেমন, খলিফা হিশাম ইবনে আব্দ আল মালিক [724–43 CE] নির্মিত ক্বাসর আল-হায়ের আল-ঘারবির দেয়ালচিত্রে শিকারের দৃশ্য, সঙ্গীতময় বিনোদন, প্রাচুর্যতার ছবি, পৃথিবীকে ব্যক্তিরূপে প্রকাশ [পারসোনিফিকেশন] এবং বিভিন্ন ঋতুকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। মহাজাগতিক রেপ্রিজেন্টেশনের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে উমাইয়া শাসকদেরকে আল্লাহর অধীনে আল্লাহর খলিফা [ধর্মীয় কর্তৃত্ব] হিসাবে তুলে ধরা হতো। যেমন, ক্বাসায়িত আমরাতে জ্যোতির্বিদ্যার মানচিত্র বা মহাকাশের পরিমণ্ডলের ছবি আঁকা রয়েছে। [ছবি-৩]
খিরবাত আল-মাফজারে আল-ওয়ালিদের রাজপুত্র থাকাকালে তাকে নিয়ে একটা চিত্রকর্ম রয়েছে। সেখানে চারটি ডানাওয়ালা ঘোড়ার ওপর থাকা একটি গম্বুজের ভেতরে ছয় মাথাওয়ালা একটি ফুল দেখা যায়। এটি সম্ভবত শাসকের মহাজাগতিক উপস্থিতি ও কর্তৃত্বকে তুলে ধরে। [ছবি-৪]খলিফাকে আল্লাহর প্রতিনিধি ও মহাজাগতিক শাসক প্রচার করার অনুরূপ ধারণাগুলো উমাইয়া দরবারের কবিতাতেও পাওয়া যায়, যেখানে শাসককে‘আল্লাহর আসমান’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। উমাইয়া প্রাসাদের বিভিন্ন ম্যুরাল, কারুকাজ ও ভাষ্কর্যের প্যাটার্নগুলো থেকে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আদর্শ, মনোভাব ও জরুরত প্রকাশ করার জন্য একধরণের ভিজুয়াল ভাষা লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়াও বোঝা যাচ্ছে যে, ছবিগুলোর সাথে সম্পর্কিত উমাইয়া পৃষ্ঠপোষকেরাও দুনিয়াবি ও ধর্মীয় [ডিভাইন] কর্তৃত্ব জাহির করতে বেশ কসরত করছিলেন। এই কৌশলগুলো বাইজেন্টাইন, রোমান ও সাসানিয়ের মতো দুনিয়ার অন্যান্য সংস্কৃতিতেও দেখা যায়।

পঞ্চম খলিফা এবং উমাইয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের নামে চালু থাকা একটা উক্তিও এই ধর্মীয়-রাজনৈতিক অবস্থানকে সমর্থন করে: ‘এই দুনিয়া আল্লাহর এবং আমি আল্লাহর প্রতিনিধি [ডেপুটি]’। ‘আল্লাহর খলিফা’ খেতাব আরো অনেক উমাইয়া শাসক গ্রহণ করেছিলেন।প্যট্রেসিয়া ক্রোন ও মার্টিন হিন্টস ব্যাখ্যা করেন, এই সম্মানসূচক খেতাব দিয়ে উমাইয়াদের সাথে ধর্মের সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করা হতো। খলিফার এই খেতাব তাকে ধর্মীয় কর্তৃত্ব এবং একইসাথে রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে হাজির করতো। সে সময়ে বিভিন্ন উলেমাদের সাথে যে উত্তেজনা ও ক্ষমতার লড়াই চলছিল সেটাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করেছিল। রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে উমাইয়ারা নিজেদের ভূমিকাকে রাজনৈতিক পরিসর ছড়িয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসের রক্ষক হিসেবে দেখেছিল। আল্লাহর খলিফা খেতাব দিয়ে উমাইয়ারা নিজেদেরকে ‘আল্লাহর ধর্ম রক্ষা করার মিশনে নবী মুহাম্মদের সিলসিলার’ একজন হিসেবে স্থান দিয়েছিলেন; ফলে জনগণকে তাদের মানতে হবে।
খলিফার এমন প্রতিচ্ছবি সমসাময়িক দরকারি কবিতাতেও পাওয়া যায়, যেখানে শাসককে ‘প্রার্থনা কিবলা বা দিক ‘ হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে; তিনি জনগণকে হেদায়তের পথে নিয়ে যাবেন, তিনি ‘এমন এক আলো যা জমিনকে আলোকিত করেছে’; এবং ‘ফিতনার পর আল্লাহর খলিফা মানবজাহানকে পথ দেখাবেন’। সম্ভবত সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃত্বের এমন ভয়াবহ দাবি কুফা ও বসরাসহ উমাইয়া-বিরোধী অঞ্চলের বৈরি মনোভাবকে আরো দৃঢ় করেছিল।
উমাইয়াদের মুদ্রায় ছবি ও সার্বভৌমত্ব:
‘আল্লহর ধর্মের অভিবাবক’ হিসাবে খলিফারা ক্ষমতা ও বৈধতার [লেজিটিমেসি] বেশ কিছু নিদর্শন রাখতেন, যেগুলো কিনা নবীজীর কাছ থেকে আবু বকর, উমর ও উসমানের মাধ্যমে তাদের [উমাইয়া খলিফাদের] হাতে এসে পৌঁছেছে। একটি মূল্যবান নিদর্শন ছিল সিলমোহর বসানো আংটি, এতে তিন লাইনে ‘মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ’ লেখা ছিল। ৬৯১-৯২ ও ৬৯৬-৯৭ মধ্যকার উমাইয়া মুদ্রাতে একই জিনিস লেখা হত; এর মাধ্যমে নবীজীর বরাত দিয়ে খলিফার কর্তৃত্ব দাবি করা হতো। এর মধ্যে কয়েকটি মুদ্রায় নবীজীর উল্লেখের পাশপাশি একজন সাসানীয় সাম্রাজ্যের শাসকের (শাহানশাহ) আবক্ষ একটি ছবিও থাকতো। এভাবেই ধর্ম ও সাম্রাজ্যের প্রতীক মিশে যেতো।
উমাইয়াদের অন্যান্য মুদ্রাগুলোর সাথে ধর্মীয় ঘোষণাসহ খলিফার ছবি আরো সরাসরি যুক্ত। ৬৯২ সালে দ্বিতীয় ফিতনার পর আব্দ আল-মালিক অর্থনৈতিক ও প্রাশাসনিক সংস্কার শুরু করেন, এবং প্রকাশ্যে ধর্মীয় ঘোষণা প্রচার শুরু করেন। যেমন, সে সময়ের রৌপ্য ও স্বর্ণ মুদ্রায় আরবিতে কালেমা শাহাদাত খোদাই করা থাকতো [আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, মুহাম্মদ তাঁর রাসুল]।
৬৯৩-৯৬ এর মধ্যকার কিছু কিছু মুদ্রায় কালেমা শাহাদত বা অন্যান্য ধর্মীয় বাণীর সাথে খলিফার ছবিও যুক্ত থাকতো। মুদ্রাগুলোতে খলিফাকে দাড়িওয়ালা, লম্বা চুল, আল্লাখাল্লা পরিহিত, তলোয়ার হাতে দাঁড়ানো অবস্থায় ফুটিয়ে তোলা হতো। উপস্থাপনের কিছু কিছু বিষয় খিরবাত আল-মাফজারের খলিফার ভাষ্কর্যের [এটা আরো পরে নির্মিত, আকারেও বড়ো] সাথে মিল থাকতে পারে, যদিওবা এই ভাষ্কর্যের গায়ে রয়েছে সাসানীয় পোশাক। [ছবি-৭] খলিফার ছবিওয়ালা মুদ্রার দুই পাশে দুটো আরবি লিপি রয়েছে: একটাতে লেখা রয়েছে তার উপাধি, আমিরুল মুমিনিন; এবং অন্যটাতে তাকে আল্লাহর খলিফা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সামরিক অধিনায়কত্ব [তলোয়ার হাতে], ধর্মের রক্ষক এবং ধর্মীয় কর্তৃত্ব হিসেবে উমাইয়া শাসকের একটা ছবি হাজির করে।

‘দাঁড়ানো খলিফা’ ছবির বিচিত্র ডিজাইন স্বর্ণ, রৌপ্য ও তামার মুদ্রায় পাওয়া যায়। [ছবি-৮] এই ধরণের মুদ্রাগুলো বহু ধরণের ব্যাখ্যা প্রকাশ করে:বাইজেন্টাইনের একটি প্রতিক্রিয়া থেকে শুরু করে একেবারে নবী মুহাম্মদের রেপ্রিজেন্টেশন পর্যন্ত। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে তবু কিছু কিছু মুদ্রাতে (খলিফ আব্দ আল-মালিক বা তার ভাইয়ের নাম খোদাইকৃত মুদ্রাগুলো ব্যাতীত) হয়তো নবীজীকেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেমন, একটি তামার মুদ্রাতে একটি দাঁড়ানো ছবি [ফিগার] দেখা যায়, পাশে ‘মুহাম্মদ’ নাম খোদাই করা। [ছবি-৯] যুবনা থেকে প্রাপ্ত আরেকটি মুদ্রায় বর্ণবলয় যুক্ত একটি দাঁড়ানো ছবি পাওয়া যায়। [ছবি-১০] যুবনা থেকে প্রাপ্ত মুদ্রাগুলোতে সাধারণত ‘মুহাম্মুদ রাসুলুল্লাহ’ লিপি সম্বলিত একটা ছবি থাকতো। যেহেতু বর্ণবলয় রোমান ও সাসানীয় জগতের দেবত্ব বা দেবতাদের সাথে সম্পর্কিত, সেহেতু এই কয়েনগুলোতে খলিফা ও নবীজীর পরিচয়ের একধরণের মিশেল ঘটারও সম্ভাবনা রয়েছে। তলোয়ার হাতে বর্ণবলয় যুক্ত ফিগারের সাথে নবীজীর পদমর্যাদা সম্পর্কিত বাক্য জোড়া লাগিয়ে আগ্রহী খোদাইকারী খেলাফত ও নবুয়তির উপমার একধরণের আইকোনগ্রাফিক মিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
আব্দ আল-মালিকের ভাই বিশর ইবনে মারওয়ানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বসরা ও কুফাতে ধর্মীয় বাণী সম্বলিত জীবের ছবিওয়ালা কয়েন তৈরি করা হয়েছিল। ৬৯৪-৯৫ সালের বসরাতে চালু থাকা একটি মুদ্রার উলটা পিঠে তিনজন পুরুষের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। [ছবি-১১] কেন্দ্রের ব্যক্তিটি প্রার্থনার মত করে দু হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশের দুইজন সম্মানের সহিত হাত জোড় করে কেন্দ্রের ব্যক্তির দিকে মাথা ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লুক ট্রেডওয়েল বিশরের এই মুদ্রাকে মাশরিক [পূর্ব] অঞ্চলে নবায়িত উমাইয়া শাসনের আলোকে ব্যাখ্যা করেন; যে অঞ্চল কিনা‘দামেস্ক থেকে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রতি বৈরিভাবাপন্ন এবং ইরাকে উমাইয়া শাসনের পূর্বতন ইতিহাসের প্রতি গভীরভাবে অসন্তুষ্ট ছিল’। অতএব বসরাতে নবায়িত উমাইয়াদের উপস্থিতির প্রতি বৈরিভাবের সাথে মিলিয়ে সেখনকার ছবি-বিরোধী হাদিসের প্রাথমিক বিস্তারকে বিবেচনা করতে পারি।
যখন বিশর ৬৯৪ সালে মারা যান আব্দ আল-মালিক তখন আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফকে কুফা, বসরা ও পূর্বাঞ্চলের ভাইসরয় হিসেবে নিযুক্ত করেন।আল হাজ্জাজ তার আমলেও ছবি সম্বলিত মুদ্রা চালু রাখেন যা দৃশত উমাইয়া-সাসানীয় মুদ্রাব্যবস্থার সাথে যুক্ত করা যায়। দামেস্কে উৎপাদিত মুদ্রার মত আল-হাজ্জাজ ‘মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ’ বাক্য রাখেন এবং এর সাথে আরেকটি ধর্মীয় আহ্বান হিসেবে শাহাদতও যুক্ত করেন। ধর্মীয় বাণী এবং খলিফার চিত্রের আন্তঃসংযোগ উমাইয়া শাসনামলের একটি বহুল প্রচলিত প্রথাকে হাজির করে। এমনকি আব্দ আল-মালিক নতুন নকশা প্রবর্তনের পরও,যেখানে কিনা জীবের ছবি কোরআনের আয়াত দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, আল-হাজ্জাজ মাশরিকে ছবি সম্বলিত মুদ্রাই চালু রাখেন।
আল-হাজ্জাজ উলামাদের সাথেও সম্মানসূচক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। তবু বসরার অনেকেই যে কোনো উমাইয়া কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বৈরি মনোভাব প্রকাশ করতেন। ৬৯২ সালে বিদ্রোহী ইবনে যুবায়ের পরাজিত হওয়ার পরও বসরা (পূর্বের অন্যান্য অঞ্চলসহ) অস্থির ছিল। বসরাতে আরো দুটো বড়ো উমাইয়া বিরোধী বিদ্রোহ দেখা দেয়। একটা ৭০০ সালে ইবনে আল-আশাতের নেতৃত্বে এবং আরেকটি ৭১৯-২১ সালে ইয়াজিদ ইবনে আল-মুহাল্লাবের নেতৃত্বে। প্রথম বিদ্রোহ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে থাকা বহু বিচিত্র গোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করেছিল, এবং ‘উল্লেখ্যযোগ্য ধর্মীয় সুরও গ্রহণ করেছিল’। মুহাল্লাবি বিদ্রোহ খলিফা দ্বিতীয় ইয়াজিদের সময়ে বসরাতে সংগঠিত হয়েছিল [৭২০-২৪]। উমাইয়া-বিরোধী বিদ্রোহে ইবনে মুহাল্লাব‘আল্লাহর কিতাব ও নবীজীর সুন্নত’ পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানান। পাশপাশি উমাইয়া নীতি, বিশেষত আল-হাজ্জার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলোকে প্রত্যাখ্যানের ডাক দেন।
উলামাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যিনি কিনা বসরাতে ৬৯৪-৯৭তে [এবং সম্ভবত ৭২০ সালেও] বসরাতে কাজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং উমাইয়া-বিরোধী বিদ্রোহকেও সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন আল-নাদির ইবনে আনাস ইবনে মালিক। ছবি বিরোধী হাদিসটার শুরুর দিককার একজন বর্ণনাকারী হিসেবে তাঁর নামও পাওয়া যায়।
প্রশাসনিক দায়িত্ব এড়ানোর প্রচেষ্টা থেকে বসরার অন্যান্য কাজী ও উলামা সদস্যদের উমাইয়া-বিরোধী অবস্থান ফুটে উঠে। অন্তত তিনজন পণ্ডিতকে পাওয়া যায় যারা ‘নিয়োগ এড়াতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিলেন’, যেখানে অন্যান্যরাও উমাইয়া শাসনের অধীনে কোনো দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক ছিলেন।উমাইয়াদের সহযোগিতার ব্যাপারে বসরার কিছু উলামার অনীহা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তারা সরকারি নিয়োগকে রীতিমতো ভয় পেতে শুরু করেন। এই মনোভাবটা বসরাতে স্বতন্ত্র বলে মনে হয় এবং ৭১৪ সালে আল-হাজ্জাজের মৃত্যুর পর সেটা আরো বেগবান হয়। ফলে এটা বলা যায় যে, ছবি-বিরোধী হাদিসটি সম্ভবত উমাইয়া-বিরোধী মনোভাবকে ফুটিয়ে তোলে।
উপসংহার:
এটা পরিষ্কার যে উমাইয়া শাকরা তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে স্থাপত্য ও মুদ্রাতে বিভিন্ন ছবি ও নকশা ব্যবহার করেছিলেন।বসরার কয়েকজন হাদিস বর্ণনাকারী ছবি আঁকা বা তৈরির বিরোধীতা করেছিলেন এবং সে অঞ্চলের উমাইয়া-বিরোধী অস্থিরতায় অবদান রেখেছিলেন।কেনইবা বসরাতে কয়েকজন উলামা সক্রিয়ভাবে এই হাদিস প্রচার করলেন তা ব্যাখ্যা করা মুশকিলের হয়ে পড়ে যদি না উমাইয়া শাসনের বৈধতাকে খারিজ করার রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে এটা তৈরি করা হয়। এমন ধরণের কিছু সমান কৌশল আব্বাসীয়রাও ব্যবহার করেছিলেন, যারা ৭৫০ এর দিকে উমাইয়াদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।
ছবি বিরোধী হাদিসটিকে তার ঐতিহাসিক ও দৃশ্যগত পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করলে উমাইয়া আমলে ছবি আঁকা বা তৈরির প্রতি যে বিচিত্র ধরণের মনোভাব চালু ছিল সে বিষয়ে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। বর্তমানে ইসলামি শিল্প সম্পর্কিত আলাপে এই হাদিসের প্রচণ্ড প্রভাব রয়েছে।তদপুরি, প্রাথমিক যুগে এর প্রচারকে উমাইয়া-বিরোধী রাজনৈতিক লড়াইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। উমাইয়াদের বৈধতা ও খলিফার ধর্মীয় কর্তৃত্বকে খারিজ করতে এটা ব্যবহৃত হয়েছিল [ছবির মাধ্যমেই এই কর্তৃত্বকে জাহির ও প্রচার করা হতো]। ফলে ছবি আঁকার বিষয়ে এই ‘নিষেধাজ্ঞা’কে স্থান ও কালের উর্ধ্বে বিবেচনা না করে বরঞ্চ উমাইয়া শাসনের বিরোধীতা করার জন্য তৎকালীন স্থানীয় রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে।হাদিসের আরো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য এমন নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত ও উপাদানের সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষা একটি কার্যকরীয় পদ্ধতি হতে পারে।