চিনি তাহারে চিনি
যে মানুষটা আত্মহত্যা না করলে ওর কাজটা পাওয়া হতো না তাকে মনে করেই সকাল শুরু হয় রোজ।আর যে সমস্ত মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় এই শহরে তাদের জন্যই ওর পেটে দুটো ভাত পড়ে।আজও ডাক পড়েছে ছবি তুলতে যাওয়ার জন্য। মুগদায় কেউ খুন হয়েছে। বছরকয়েক আগে এ পাড়াতে এসেছিল একবার। বেশ মফস্বলি ঘ্রাণ আছে এখনও। কারও কারও বাড়ির সামনের দিকটায় সামান্য গাছগাছালি কোনো রকমে সবুজ ধরে রেখেছে। দেয়ালেগুলোতে শ্যাওলার আস্তরণ। তবে হ্যাঁ বাড়িগুলো ভাঙবে অচিরে।
কাঙ্ক্ষিত বাড়িটার সামনে পুলিশের গাড়ি ছাড়াও বেশ কয়েকটি গাড়ি দাঁড়ানো। চোখের কোলের পিচুটি মুছতে মুছতে লোকজন জড়ো হয়েছে বেশ। কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর কাকের কা কা শব্দ ছাপিয়ে ওর কানে ভেসে আসছে মৃদু কান্নার গভীর তরঙ্গ। এই তরঙ্গ ওর মাছ ভাতের মতো চেনা। স্বাভাবিক মৃত্যু বাড়ির চেয়ে এই কান্নার ধরন সামান্য আলাদা। অপ্রস্তুত ঝড়ের ভেতর পির মুর্শিদের নাম ধরে ডাক ছাড়ে খেয়ামাঝি যেমন এই কান্নার হাহাকার ঠিক তেমন। পুরনো ধাচের বাড়ি। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে পাঁচতলাতে।
দোতলায় উঠতেই তাক লাগিয়ে দেয়া সিঁড়িঘর, কতগুলো পুতুলের মুখ দেয়ালে টাঙানো। পাশেই অতিকায় মাথাল। এমন মাথাল তো চা বাগানের শ্রমিকরা ব্যবহার করে থাকে। পেতলের একটা মাঝারি কলস বসানো কাঠের টুলের ওপর। তাতে লাল রংগন আর পাতা বাহারের কয়েকটি ডাল রাখা। দরজায় নামের ফলকে জ্বল জ্বল করছে কস্তুরি বসাক।
তিন তলার সিঁড়ি ঘর আর দশটা সাধারণ সিঁড়ির মতো সাদামাটা। চারতলাও একইরকম। পাঁচ তলাটা ঠিক দোতলার মতো চোখের মান্যতা সুন্দর। যামিনী রায়ের আঁকা ছবি ঝুলছে। তারপাশে ঝুলছে চমৎকার মাটির টেরেকোটা। সেখানেও দৃষ্টি আটকে যাবার জোগাড়। যে কটি টবে গাছ তার সবকটির পাতা রসালো সতেজ সবুজ। এসব অন্দরসজ্জা দেখতে পাবে এই পুরনো বাড়িতে ভাবেনি ও। কান্না, মৃত্যু, বিষাদকে দূরে সরিয়ে রাখতে মনকে, চোখকে আরাম দেয়া উচিত বলে মনে করে ও। গানের আগে যেমন রেওয়াজ করে গায়ক তেমন।
আরে তুমারেই খুঁজতাছে সবাই। হ, হ ইস্পাত আইয়া পড়ছে। ফোনে কথা বলতেই বলতেই সিগারেট ধরালেন মোজাম্মেল ভাই। ইশারায় বোঝালেন কাজ শেষে নিচে আসার জন্য।
লাল শরবতের ভেতর লেবুর নিখুঁত আধাখানা কেটে ভাসালে যেমন দেখায়, লাশটাকে তেমন দেখতে।অনেকগুলো ছবি নিলো। বসার ঘর ছাড়িয়ে রক্তের ধারা গড়িয়েছে অনেক দূর।
গতকাল নিশ্চয়ই এই ঘরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে মানুষটি। সে কথা ভাবতে ভাবতেই অন্য আর একটি রুমের ছবি নিলো ইস্পাত। দেয়াল ভর্তি নানা বয়সের পারিবারিক ছবি টানানো। এই শহরে এমন সুচারু সজ্জা সংসার দেখা যায় না। বিছানার চাদর, পর্দা, পাপোশ সবকিছুতে তা মেলানো হয়েছে।এমনকি আসবাবপত্রগুলো তৈরি এমনভাবে দেখে মনে হচ্ছে, এই বুঝি কথা বলে উঠবে। খাবার টেবিলে রজনীগন্ধার গোছা। গন্ধ এত সুন্দর! খটাস করে ছবিও তুলল ও। ফ্রিজের গায়ে রান্নার তালিকা সাঁটানো। লাশের ছবি তুলতে এসে এসবের ছবিও তুলে নিচ্ছে। কাজে লাগে অনেক সময়। গত মাসে পুরান ঢাকা আগামসিলেনের ঘটনাতেই তো ওর একটা ছবি খুনের সুরহা করে দিলো এক নিমিষে।মোজাম্মেল ভাই সেই থেকে সিগারেট খাওয়াচ্ছেন।
কিন্তু এই কাজটি সাময়িক। আসল লোকটি গেছে ছেলের চিকিৎসার জন্য চেন্নাই। আত্মহত্যা করে মরে গেছে যে ছেলেটি সেই করত তার বদলে কিন্তু ছেলেটির কী হলো একদিন ছাদ থেকে লাফ দিলো। ঢাকা দিনদিন মানুষখেকো শহর হয়ে যাচ্ছে। যেখানে যায় সবখানে মানুষ খালি বলছে, মইরা গেলে বাঁচি!
এই যে রক্তে জমাট বেঁধে মানুষটি বসার ঘরে শীতল হয়ে আছে, সে কি কখনও ভেবেছিল মরে গেলে বাঁচবে? কেন যে বলে মানুষ এ কথা জানে না ও। মরে গেলে কী করে আবার বাঁচা যায়?
ইস্পাতের সুন্দর একটা নাম আছে। সে নামটা একটু যেন নরম। অনেক মেয়েদের নামও আছে ওর নামে তাই এই আলগা নামটা স্কুল থেকেই জুটে গেছে ওর কপালে। কিন্তু ওর মুখের গড়ন আর মনের গড়নের পার্থক্য কেউ ধরতে পারে না। কঠিন চোয়াল আর চোখের জন্য এমনিতে খুব একটা কাছে ভেড়ে না মানুষ। বেতের ঝোপের মতোন। সহজ যাতায়াতের পথে জন্মায় না আরকি।
সিগারেট খাওয়ালেন মোজাম্মেল ভাই। বললেন বিল পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু সকালে যে না খেয়ে দৌড়ে এসেছে সে নিয়ে এখানে কেউ কথা বলল না। এই বালের শহরটাই একটা বাল!
মেজাজ চড়ে যায় খেতে না পেলে ওর। কয়েকটা মাস হলো বিল-টিল আটকে আছে। এদিকে রাশিয়া যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে ওকে। যেদিকেই হাত বাড়ায় সব খালি বলে, ভাই যুদ্ধের বাজার বলে কথা।হুদাহুদি কিছু নাই।
দুইটা সিংগাড়া নিলো আর এক বোতল পানি। আগামী মাসে একটা খ্যাপ আছে মৈমনসিংহ। মোটা দানের। ইস্পাত আসলে এই ক্যামেরা ট্যামেরা নিয়ে এই সেই করে অন্য কাজ করতে চায় না তাই। ছোট কাকার বউটার মতন ওর কর্মজীবন। সকালে একটা শাড়ি পরে দেখল তো বিকেলে অন্য একটা শাড়িতে। ক্যামেরা কেনার পরপরই ছোট কাকার বিয়ে হয়েছিল। ছোট চাচির ছবি তুলতে তুলতে শরীরটা ওর জেগে উঠেছিল। কাকার সাথে তেমন গল্পই করত না চাচি। সারাক্ষণ ওরা দুজনে গল্প করত। হাসাহাসি করত। একদিন শাড়িতে মাড় দিয়ে রোদ দিচ্ছিল ছোট চাচি, ছোট কাকা ঠাস করে চড় দিলো। পরদিনই বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল শম্পা। কী নিয়ে ঝগড়া বাড়ির কেউ জানতে পারল না।দুমাস পর ডিভোর্স এর কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল। ছোট কাকা ঠাট্টা করে একটু বলেছিল, ঝুটবে না কপালে কিছু!
জোটাতে হয়নি শম্পাকে। বছরের মাথায় করিতকর্মা একজন মানুষ ওকে বিয়ে করে নিয়ে গেছে অনেক দূর। আজকাল ফেসবুকে খুব কথা বলে ওরা। আমেরিকার সময়ের সাথে ঢাকার সময় মেলে না। কিন্তু ওরা মুখিয়ে থাকে কথা বলার জন্য। সেই শরীরের আড়মোড়া আবার ভাঙতে শুরু করে ওর। শম্পার অদেখা নাভির জন্য ওর বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে। সম্পর্কে যখন চাচি ছিল সেসময় শুধু কথা বলার জন্য ওরা পরস্পরের কাছাকাছি থাকত। আর এখন যখন শরীরই তীব্রভাবে চায় তখন ভৌগোলিকভাবে আলাদা ওরা। ওর এখনকার পয়সার টানাটানিটা ছিল না আগে।
বসুন্ধরায় একটা ফ্লাট কিনতে গিয়ে জবরদস্তি ধরা খেয়েছে। ওর মতো আরও অনেকেই খেয়েছে ধরা।সমস্ত টাকা-পয়সা নিয়ে পগার পার আব্বাস মিয়া। শম্পা দিতে চাইছে যদিও, কিন্তু তা নেয়া যায় না।ইস্পাত বলে মজা করে শম্পা। রোজগারের জন্য যুদ্ধটা না থাকলে সারাক্ষণ ওর বেদিশা লাগে।দিকবিদিক লাগে। সে শুধু শম্পা বলে নয়। শম্পাকে ভালোবাসতে গিয়ে যে দ্বিধা যে দেয়াল ছিল সেসবের সাথে ওর মন পরাস্ত হতে হতে একটা বিরান মাঠ হয়ে গেছে। এই যে আজ যার ছবি তুলে এলো মরা ফ্যাকাসে মুখ তবু ছিল অদ্ভুত সুন্দর মুখ। মানুষ। লাশঘরে যাবে, এর পরে যাবে কবরে।সুন্দর সব হয়ে যাবে মাটি। মাটি হবার আগে যদি শম্পাকে ছোঁয়া যেত!
ইস্পাতের মেজর বন্ধু আহসান চাকরি ইস্তফা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। মৈমনসিংহের বেশ কিছু পুকুর কিনে নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছে। সেসব আবার কচুক্ষেতের বাজারে সাপ্লাই দিচ্ছে। মাছের সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে অনলাইনে মার্কেটিং করছে ও। সেই সাথে থাকা খাওয়া ফ্রি। ঢাকা শহরটার জন্য যদিও মন খারাপ হয়। শম্পার অদেখা নাভির মতন। শুধু অন্ধকার তাও অনিবার্য আকর্ষণ। সপ্তাহে দু’বার আসে মাছের ট্রাকের সাথে। সেদিন উত্তরায় ভীষণ ট্রাফিক। ধুম বৃষ্টি সাথে। ড্রাইভার মুখে যা আসছে তাই বলছে। শালার গালাগাল জিনিসটা তখনই বেশি সুন্দর যখন সত্যিই রেগে যায় মানুষ। এই ড্রাইভার মানুষটা এমনিতে বেশ ভালো মনের। তিন বছরের জেল খাটা শরীর তার। পান খেতে খেতে বলবে, জেল তেমুন কষ্টের না ভাই, তয় হালার মাইয়া মানুষের শরীরের যে একটা তাপ আছে না, হেই জিনিসের কষ্ট হলো গিয়া আসল কষ্ট। বুজ্জেননি, জেলে ছয় মাস যাইতে না যাইতে পোলার মা ছাইড়া গেল গিয়া। মানুষ ভাবে এক হয় গিয়া আরেক। এহন এক পাগলির লগে থাহি। চাইরটা রাইন্ধা দেয় খাই। ওর অসিলা হইলো আমারও হইলো। পাগলির লগে দ্যাখা হইবো বইলাই জেল খাটলাম মিয়াভাই।
পাগল বিয়ে করলেন? অসুবিধা হয় না?
আরেহ মিয়া কন কী? যত পাগল থাকবেন তত ভালা! দুইইনাডা শয়তানে ভরা!
ওদের পাশে একটা সাদা টোয়েটা। ড্রাইভারের এক হাতে গামছা অন্য হাতে তার নিজের স্টিয়ারিং! হেল্পার ছেলেটি চেঁচাচ্ছে, ওই হালার পুত, রাইতে কই আছিলি? হালা গিদরের গিদর! অন্য ট্রাক থেকে আরও একটি ছেলে চেঁচাচ্ছে, আরও জোরে হেইয়ো। হাত মারো শালা হেইয়ো। ইস্পাত এদের সাথে চলতে চলতে জানে এরা কত অল্পতে উত্তেজিত হতে পারে, কত অল্পতে তৃপ্ত হতে পারে। তাই এই মানুষগুলোর মুখের ভাষা, এদের খিদে সেটা পেট হোক আর শরীরের হোক সবকিছু বড় সত্য। ভান নেই ভনিতা নেই।
সাদা মেঘের মতো বীর্যপাত গামছায় মুছে নিলো যখন ড্রাইভার লোকটি অন্য পাশের ছেলেটি শিষ দিলো জোরে। লোকটা অম্লান বদলে হেসে জবাবও দিলো। ইস্পাতের অনেকদিন পর শম্পার কথা মনে পড়ল। ভাত গলে গেছিল বলে ছোট কাকা খুব রেগে গেছিল একদিন, এই ভাত মুখে তোলা যায়? বলেই থালা সরিয়ে উঠে গেছিল। শম্পা গজ গজ করেছিল , নরম ভাত মুখে দেয়া যায় না আসলেই!
বৃষ্টি ছাড়ে কিন্তু ট্রাফিক ছাড়ে না। মাছ কচুক্ষেতে আসতে আসতে দুপুর প্রায়। মোজাম্মেল ভাইয়ের ফোন এখনও আসে মাঝে-সাজে। তবে সেই মরা মুখ, আর রক্তের ছবি তুলতে ওর আর ভালো লাগেনা। তাজা মাছের ঝকঝকে ছবি তোলার ভেতর একটা অসুর অসুর ছন্দ আছে। কিন্তু মোজাম্মেল ভাইয়ের জরুরি তলব, মিথ্যে বলে লাভ নেই।
মোজাম্মেল ভাইয়ের জন্য একটা বড়-সরো রুই নিলো ও।
মাছ দেখে সে কী খুশি মানুষটা। ইস্পাত তুমি দেবতা হয়ে যাচ্ছ দিনদিন। তবে বেশ কিছু কাজ আছে।তুমি তো ঢাকা থাকো না, জানো না আজকাল কী হচ্ছে! ফেসবুক চালাও না ক্যান? না কি ব্লক মারছো।
কী যে কন, আপনি পুলিশ মানুষ। ব্লক মারলে চিবায় খায়া ফেলবেন না!
শোন একটা গভীর সংকটে আছি। চল আগে সেখানে যাই।
মোজাম্মেল ভাই আর ইস্পাত যখন রাস্তায়, কী সুন্দর চাঁদ আকাশে। সেই সাথে নাবিস্কোর মোড়ে বিস্কুটের সুঘ্রাণ! আহা! ঢাকার সুদৃশ্য অদৃশ্য জ্যান্ত প্রেম আরও জ্যান্ত করে দেয় এই রোড। মোজাম্মেল ভাই, ঢাকা শহরের কী ভাল্লাগে আপনার?
আর কইয়ো না! মাঝে মাঝে রাগ লাগে আবার টুস কইরা পানি হয়ে যায় গিয়া। এই গিজ গিজা মানুষ, তামাশা সব ভাল্লাগে। তুমি আগের ছেলেটার মতন মইরা টইরা যাবা না তো।
আরেহ, নাহ! ইস্পাত না আমি!
মানুষটা লাশ হয়ে এসেছে গত সপ্তাহে। কিন্তু পরিচয় শনাক্ত হয়নি। মানে পাওয়া যাচ্ছে না। তার জিনিসপত্রের ছবি তুলতে তুলতে ইস্পাতের মনে হলো খুব পরিচিত লাগছে কিছু জিনিস। বিশেষ করে পায়ের আংটিটা। মনের ভেতর খুঁতখুঁত ভাবনাটা বেড়েই চলেছে। কিন্তু লাশের চেহারা চেনার উপায় নেই। নামটা বেশ পরিচিত কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছে না এই মুহুর্তে।
শম্পার জন্য ফেসবুক ছেড়েছে ও। খুব একটা আর কথা বলছিল না। সব সময় ব্যস্ত আছি, নয়তোঅসুস্থ এসব বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল। মাছের পুকুরগুলো বাঁচিয়েছে ওকে। এই বিরাট যন্ত্রণার শূন্য হা মুখ ওকে গিলে খেত না হলে। গত সপ্তাহের দিকে একটা প্লেন ক্রাশ করে ভুটানে। সেটায় বাংলাদেশের যাত্রী যে কজন ছিলেন সবাই মারা যায়। পরিচয় অনুযায়ী লাশ হস্তান্তর হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। খবরটা নিয়ে ইস্পাতের মাথা তেমন কাজ করেনি। এত এত মরা মানুষের ছবি তুলেছে ও আর এত দুর্ঘটনা চারিদিকে এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না ও। বিশ্রী চোয়ালের তোবড়ানো মুখটা মনে করতে পারে আংটিটা কোথায় দেখেছে। আর সুমনা ইয়াসমিন নামটা মনে পড়ে লাফানো মাছের লেজের মতো।
ওর ছোট কাকার বিয়ে পড়ানো হচ্ছিল যখন, সুমনা ইয়াসমিন, কবুল বলেন কবুল বলেন কবুল। একটা মিষ্টি পায়ের ছবি ও তুলেছিল সেই পায়ে এই আংটিটি ছিল। মস্তিষ্কের ঝিলিক একই সাথে দুটো দৃশ্য নিয়ে এলো ওর মনে।
শম্পা!
তা কেন হতে যাবে? মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে বিরত রাখছে এই সত্যটি যেন না হয়। কিন্তু অপরদিকে সেই অবহেলা সেই না পাওয়া এসে ওকে আলতো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তবে ভালোবাসার জোরালো চাবুকে সেটি টিকে থাকতে পারছে না বেশিক্ষণ।
লাশের ফয়সালা হয়ে গেল পরদিন বিকেলেই। মোজাম্মেল ভাই কষে জড়িয়ে ধরলেন। তুমি ভাই দেবতা হয়ে যাচ্ছ দিনদিন। সত্যি সত্যিই।
হ্যাঁ শম্পাই ছিল! গোলমালটা ছিল তথ্যে। আমেরিকা থেকে ও এসেই সোজা ভুটান গেছে কাউকে না জানিয়ে। স্বামী ভদ্রলোক প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নাকি। মোজাম্মেল ভাই, এত হেসেছেন এ কথা বলে! শালার ভাগ্য দেখো, আর একবার বিয়ের জোগাড় করতে হবে সেই আনন্দে কোথায় নাচবে তা না ! যত্তসব ন্যাকামি।
বাগেরহাট থেকে মা বা দুজনেই এসে লাশ নিয়ে গেলেন। দূর থেকে ইস্পাত দেখল এক নজর। আসলে মোজাম্মেল ভাই চাচ্ছেন তথ্য, ছবি সব থাকুক। এমন কেস তো রোজ রোজ ঘটে না। সেই কবে দেখেছিল শম্পাকে, চাচি বলে খুব একটা ডাকত না ও। পায়ের গড়ন সুন্দর ছিল, মুখের গড়ন সুন্দর ছিল। যা যা বাহিরের অঙ্গ দেখতে পাওয়া যেত সব সুন্দর ছিল। সম্পর্কটা যে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছিল জানত না ইস্পাত। জানত না বলেই আরও সুন্দর ছিল ভালোবাসা। অদেখা অজানা সব সুন্দর। এই যে এখন জেনে গেছে শম্পা নেই আর। কী বীভৎস এই সত্য।
নতুন প্রেমিকের সাথে লুকিয়ে যাচ্ছিল ভুটানে বেড়াতে কিন্তু সে আর হলো কই!
ফেসবুকে ওর পায়ের ছবি ছিল বেশ কয়েকটা। ওদের বাড়ির ছাদেই তোলা হয়েছিল সেসব। তখন কী যে ইচ্ছে হতো একটু ছুঁয়ে দেখতে। পুলিশের লোকগুলোর কদিনের হাসি তামাশা জুটিয়ে গেল কেবল সেই সুন্দর পায়ের মানুষটি। ইস্পাতের খুব জ্বর জ্বর লাগছে।
পালাতে ইচ্ছে করছে কোথাও। সমস্ত রাগ ছোট কাকার ওপর গিয়ে ঠেকছে। একটু কী ভালো আচরণ করতে পারত না কাকা। চাচি হয়েই থাকত শম্পা না হয় চিরকাল। মৈমনসিংহ শহরে ফিরে এসেও শান্তি নেই ওর মনে। মাছের ছবি তুলতে গেলেও মরা ফরা মুখগুলো চলে আসছে। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে কাশফুল ফুটেছে। নৌকাগুলোতে প্রেমিক যুগল মগ্ন হয়ে শরীর খুঁজে পিপাসায় মরে বেহুশ। ইস্পাতের নিজেরও বড় পিপাসা লাগে। ওর ভেতরে যে নরম কাশফুলের মতো বন আছে সেখানে শম্পাকে নিয়ে বড় আদর করতে ইচ্ছে করে। দূরের নৌকাগুলো ফিরে আসছে ক্লান্ত যুগলদের নিয়ে। এই ভর সন্ধ্যেবেলা ইস্পাতের মস্তিকের ভেতরে কেউ যেন বলছে, মর তোরা সব ডুবে মর!
এবং আশ্চর্যজনকভাবে একটি নৌকা ডুবে গেল।
প্রশ্নোত্তর
শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?
মুর্শিদা জামান: সাধারণত যে ঘটনা আমাকে হন্ট করে সেটি নিয়ে আমি লেখার চেষ্টা করে থাকি।এবং যে বিষয়টির ভেতর মানুষের অন্তর্গত দর্শন রয়েছে তা নিয়েও ভাবি। এর ফলে গল্পে তার একটা প্রভাব পড়ে।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?
মুর্শিদা জামান: এর প্রেক্ষাপট সেই ছোট থেকেই গড়ে ওঠে। নানান মানুষের সাথে চলাচল, অভিজ্ঞতা, এবং সেইসব বর্ণাঢ্য অতীত, বর্তমান সবই লেখায় উঠে আসে। তাছাড়া শুধু অভিজ্ঞতাই সব নয় নীরব পর্যবেক্ষণও জরুরি গল্পের কাঠামোর ভেতর।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।
মুর্শিদা জামান: একদম মনে করি। রাজনৈতিক দর্শন এবং এর বাস্তবতার নিরিখেই তো কথাসাহিত্য গতিশীল থাকে। আমার বেশ কয়েকটি গল্পই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা। এবং এর ফলে মানুষের জীবনাচরণে যে আমূল-পরিবর্তন ঘটে সেসব নিয়েই লিখতে চেষ্টা করেছি। গ্রাম বা শহরের দুই রকম পরিবেশেই রাজনীতি যে বদল ঘটিয়েছে তার প্রধান বদল তো মানুষের মননে। মানুষ ক্রমাগত ভয়ের ভেতর দিয়ে একটা অজানা অন্ধকারে তার স্বাভাবিক অনেক কর্মকাণ্ড থেকে সরে গেছে। আমি তো অবাক হয়ে যাই যখন দেখি পুরনো বাতিল জিনিস বিক্রির তালিকায় এখন হারমনিয়াম উঠে এসেছে।এবং সেই যে সকালে বা দুপুরে বাড়ি বাড়ি গান শোনার প্রবণতা ছিল সেসব দিনে দিনে গায়েব হয়ে গেছে। এমনকি পোশাকের যে আমূল-পরিবর্তন এসেছে তার জন্য সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দায়ী। এবং এর ফলে সাহিত্যেও বিরাট ধাক্কা এসেছে। অনেক কিছু আড়াল করে লিখতে হয়। এতে ভাষার বা ঘটনার স্বাভাবিক প্রবাহ অনেকটাই ক্ষুণ্ন হয়।
শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
মুর্শিদা জামান: সেই ছোটবেলায় স্কুলের বইতে পড়া মহেশ গল্পটি প্রথম কাঁদিয়েছে। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফটিক গল্পটিও সমানভাবে কাঁদিয়েছে। চিন্তা ও বোধকে নাড়া দিতে পেরেছে অনেক গল্পই।মানিকের গল্প তার ভেতর অন্যতম।
শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
মুর্শিদা জামান: এটা ঠিকঠাক পাঠকই বলতে পারবেন। আমি যে বোধ থেকে লিখি তার ভেতর তোবসবাস করি ফলে নির্দিষ্টভাবে বলা এখনই বেশ মুশকিল। চেষ্টা থাকে যা আমাকে ভাবায় তা ভাষায় ঠিকঠাক উঠে এলো কিনা। তাছাড়া জীবন পাল্টায়, ভৌগোলিক পরিমণ্ডল পাল্টে যাচ্ছে। মানুষের ভাষা, গল্প, আদর্শ সবই পরিবর্তন ঘটছে। গল্পেও এর বিস্তৃত ভাঙন অবশ্যই চলে আসে স্বাভাবিকভাবেই।
শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?
মুর্শিদা জামান: যা বলা হচ্ছে তা বুঝতে পারা।
শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
মুর্শিদা জামান: লেখকের তো প্রধানতম বোধ হলো সত্যকে প্রকাশ এবং এর সাথে অনড় থাকা। আর রাজনৈতিক বোধ ছাড়া লেখক দেশ ও মানুষের কথা লিখবে কী করে!
লেখক সমাজের আয়না। তাকে নিজেকেই আগে সেই আয়নায় পরিষ্কার দেখতে হয়। শুধু রাজনৈতিক অন্যায় নয় সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধেই লেখককে আদর্শিকভাবে সৎ থাকতে হয়। এবং সোচ্চার তো বটেই।
শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!
মুর্শিদা জামান: এই তো এ বছর বেঙ্গল পাব্লিকেশন থেকে গল্পের বই প্রকাশ হলো। তাছাড়াও যখন যা লিখতে ইচ্ছে করে কবিতা বা গল্প লিখতে চেষ্টা করি।