প্রশ্নোত্তর:
শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বা বোধের ব্যাপারটা প্রথম কীভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?
অনুপমা অপরাজিতা: মনে পড়েনা কোন তাড়না থেকে কবিতা লিখতে হবে এমন তাগিদ অনুভব করেছি! ছোট বেলায় গল্প লেখার চেষ্টা করতাম মাঝে মাঝে। দেয়াল পত্রিকায় অন্তঃমিলে ছড়া পদ্য লিখেছি কখনো কখনো…এরপর লেখার গতিটা ফিরে পাই উন্মুক্ত পরিসর ফেবুর পাতায় লিখতে লিখতে…প্রেরণা পাই ঘরের মানুষ বোদ্ধা মানুষের কাছে।
তবে আমার মনে হয় না কোন কবিই কবিতা লিখতে হবে এরকম অনুভূতি থেকে কবিতা লেখার তাড়না অনুভব করেছেন বা করেন। কিংবা তাড়না থেকে লেখার ইচ্ছে ঘটলেও সেখানে কবিতা কতটুকু কবিতা হয়ে ওঠে! কাব্য ভাবনা বা বিশ্লেষণ আর কবিতা লেখা দুটো পুরোপুরি আলাদা ব্যাপার।সংবেদনশীলতা, প্রবল অনুভূতিশীলতার সাথে দেখার দৃষ্টি নিয়ে যারা শব্দের মালা গাঁথেন তখনি বোধ করি একটি কবিতার জন্ম হয়। ভাবনার অতলে ডুবে থাকে কবি মন। চেতনা আর অবচেতনার সংগমেই শুদ্ধ কবিতা প্রাণ পায়…।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষাশৈলীর বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিতভাবে শুনতে আগ্রহী।
অনুপমা অপরাজিতা: কবিরও কবি প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের কলমে যদি বলি,”ছিন্ন এই সমাজকে এক মুঠোয় ধরবার মতো আয়োজন কবিতা থেকে স্খলিত হয়ে গেছে অনেকদিন। অনেকদিন ধরেই কবিতা একটা ছোট সমাজের কাণ্ড। অল্প লোকেই তা পড়ে।আমিও পাঠকের কথা মাথায় না রেখেই লিখে চলি…জীবন যাপনের সমস্যা, বিস্বাদ, প্রণয় প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতি আমার কবিতায় প্রভাব পড়ে।মুখের ভাষায় পারফিউম লাগিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে শব্দের গায়ে জামা পরিয়ে কবিতার বুনন করি।আমি মনে করি কবিতার একটা প্রসাদগুণ থাকা অনিবার্য। ‘বোঝানোর দ্বায়িত্ব নয় কবিতার,কবিতা কেবল প্রাণিত করতে জানে।
কবিতা সব যুগে সবকালেই সব কবিকেই জীবনবোধ, জীবনচৈতন্য বলি বা চেতনা বলি রাজনীতি প্রভাবিত করে থাকে কিছুটা।তবে প্রকৃত রাজনৈতিক সচেতন মানুষের কবি অনুভূতির প্রতি বা শিল্পের প্রতি উদাসীনতা আসতে পারে।যেমন রাজনীতি আমার খুব কম আসে।কারণ রাজনীতিতে আমার জানাশুনা কম বলতে পারেন বা এতে আমার ইন্টারেস্টও নেই।
শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
অনুপমা অপরাজিতা: আসলে শীল অশ্লীল ব্যাপারটাতো আপেক্ষিক। দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। কবিতাকে কবি কোন স্বরূপে চিহ্নিত করবেন,সেটা কবির সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার।যৌন রস বা আদি রসের বর্ণনাতে আগের কালে কাব্য চর্চায় সাহিত্য রূপে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন।সাহিত্যিকরা Divinity আরোপ করে প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করতেন। আবার প্রচীন সংস্কৃত সাহিত্য কালিদাসের “মেঘদূত”‘, জয়দেবের “গীতগোবিন্দ” চণ্ডীদাসের ” শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ” অথবা প্রাচীন বাংলার “চর্যাপদ” পর্যালোচনা করলে এসব আদিরসের ছড়াছড়ি রয়েছে। ইংরাজীতে কীটস, বায়রন, শেলী এই রোমাণ্টিকতা নিয়ে কত সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করেছেন।আধুনিক কবি বিষ্ণুদে, জীবনানন্দ প্রমুখ কবিরাও কবিতায় খুঁজেছেন প্রিয়ার অনুসঙ্গ। জীবনের প্রবলতম প্রবৃত্তি, বিশেষ বয়সের ধর্ম একেবারেই প্রাকৃতিক।
শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আাপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে-কোনো সময় ধরে হতে পারে,আপনার যেমন ইচ্ছে।
অনুপমা অপরাজিতা: ঊনিশ শতকে পশ্চিমা শিক্ষা প্রচলনের শুরু থেকে দুই বাংলার মানসসমাজ তো খণ্ডিত হয়ে আছে।একদিকে পশ্চিমা শিক্ষা বঞ্চিত বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ। দারিদ্র্যের অভিশাপে যাঁদের মনে কৃত্তিবাস -কাশীদাস থেকে শুরু করে কবিগান ব্রতকথা পুঁথি পাচালির প্রভাব এখনো রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অন্য দিকে শহুরে কালচারড বলতে যাঁদের অধিকাংশই রবীন্দ্র নজরুলে প্রভাবিত।তবে পশ্চিম বঙ্গের অগ্রজ কবিদের বাদ দিলে বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক অনুজ কবি তরুণ কবি ওপার বাংলা থেকে অনেক ভালো লিখছেন।তারা কবিতা সম্পর্কে মোটেই উদাসীন নন। এরা বেশির মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উঠে আসা।
শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।
অনুপমা অপরাজিতা: বইটি ২০১৫ তে পড়া। আবার পড়লাম দু’দিন আগেই শঙ্খ ঘোষের ” দেখার দৃষ্টি”।
‘প্রতিদিনই আমরা দেখি, শুনি,জানি।এই দেখা শোনা বা জানা –সব কিছুরই আছে ভিন্নতর তল, যেখানে পৌঁছতে পারলে আমাদের পারস্পারিক সম্পর্কের মাত্রাই যায় পালটে।রবীন্দ্রনাথের অনুসঙ্গে সেইরকমই কিছু মাত্রার খোঁজে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি লেখার এই সংকলন।
দুটি স্মারক বক্তৃতা নিয়ে লেখা বইটি।
দুটি ভাষণই কী অমোঘ বাণীতে ঠাসা।প্রথমটি “অন্ধের স্পর্শের মতো”। প্রণবেশ সেনের প্রতি স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এই স্মারক বক্তৃতা। ঠিক অন্ধের স্পর্শের মতোই তাঁর বক্তব্য পাঠকের একেবারে বুকের ভেতর গিয়ে পৌঁছয়।
আর দ্বিতীয়টি কুমার রায়ের প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মারক বক্তৃতা–‘জানার বোধ’ প্রতিবছর নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ একজন কৃতি নাট্যজনকে বা একটি নাট্যদলকে তাঁর নামে একটি স্মারক স্মৃতি প্রদান করা।
কবিতা:
ফেরারি দিন
মায়াময় মখমল বিকেল
ছায়াময় এলোকেশ বাতাস
ভেসে আসে দুধচিতই দিন
বিস্মৃতির কাসুন্দি ঘাটা
মা’র শাড়ির ঘ্রাণের আঁচল
এপার ওপার করে চৌকাঠ
হাতের সাথে হাতের সঙ্গ
ওয়াইন রঙে ভাসে গেলাস
শিমুল লালে ঘাসের মাদুর
গাইছে দুখিনী বর্ণমালা
অমন গান আহা কীযে সুধা
হঠাৎ ভাবানুসঙ্গী বলে —
আচমকা ব্যারিকেড তুলে
চায়না চপ্পল পায়ে কে সে
ফুসফুসে বাঁধছে বাসা কষে
সূঁচের মতো ঢোকে নিঃশ্বাসে
তছনছ মেদিনীর শরীর
ভেষজ পাতার রাজনীতির
হেডলাইনটি দৈনিকে ছাপা
মুখেতে বেঁধে শোধনপট্টি
উনোনে রান্না হয় বাসনা
হায়রে কতকাল যে ফেরেনা
স্পর্শের সংক্রান্তি
মায়াময় মখমল বিকেল!
শোধবোধ
আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো
তুমি যা দিয়েছো তারও অধিক
আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো
তোমার অহংকারের মূল্য
আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো
আল ধরা সবুজ মেঠোপথ
ওই ধানক্ষেত, অমলকাকার বাড়ি
আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো
আহাজারির সুরা, নেশার কবজ
চাঁদরোদ পাহাড় চূড়া
আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো
রূপের হাঁড়ি হাইব্রিড গোলাপের বদলে
কৃষ্ণচূড়া সোনালু আর জারুলতলা
আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো
দখিনের দেখার জানালা
আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো
কুয়োর জল নয় ঝর্ণা নিরবধি
আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো
মূল্যেরও অধিক যা কিছু!
মনস্তত্ত্বে শীত
সঙ্গত কোন তাড়া নেই আমার
পড়ে আছে ঘরদোর সংসার
সৌরভ থমকে বাতায়ন পাশে
শীতের সাথে জেঁকে বসেছে শীত
মনস্তত্ত্বের কোঠায় উথালী
শালগ্রামের নিকষিত সন্ধ্যা
রোদেলা দুপুরেও বেশ প্রকাশ্যে
আধেক চাঁদে ঝলসানো আকাশ
নির্জনে খমক বাজায় হৃদয়ে
তুলে রেখেছি ঘ্রাণটুকুর ওম
উষ্ণতার কাশ্মীরি শাল
ফরাসি গেলাসে উপচানো রঙ
ছড়িয়ে পড়ে ঘুম সাগরে, রাতে।।
নিয়তি
সটকে যাচ্ছে জীবন
তমসা হাতে অপেক্ষায় ভোর
ইন্দ্রসভা একদিকে
অন্যদিকে কাওয়ালির সুরে
ঘোর ককটেল যামিনী
অভিমানী আকাশে জমেছে
শাদা বরফকুচির মতো শিশির
পাত্র উপচানো প্রাণমদিরা
নিয়ে পর্দার ওপারে দাঁড়িয়ে
প্রণয়তীর্থ থেকে ভেসে আসে
বিক্ষত আয়ুরেখা
অথবা লাইফ সাপোর্ট।
পড়ে থাকা সময়
আসক্তির চোখ কিছু কী দেখে
অন্তর্গত স্বপ্ন!
ধুতুরা ফুল
নাকি বকুল!
চুমুর লবন আয়োডিন ভেবে তুলে রাখি বাকসোয়
ভ্রুর ঠিক ওপরে কপাল জুড়ে অনিদ্রার রেখা
ঠিক যেন আঁক-বাঁকা মরা নদীর সোতা
নিকুটিনের প্রলেপে ওষ্ঠ মরিচীকাময়!
আয়নার চোখ আজকাল পোড়া ঘর
দেখে,লকলকে জিহবায় বলিরেখা গোনে!
পাশাপাশি রঙমাখা সঙে একাকার হয়
নৈকট্য। গিলে খায় ঘোর তমসা!
কালিমা জমেছে চোখের কোলে, কপোলে ও কপালে!
মর্মস্থল দ্বিধার তিমিরে ক্ষয়ে যাওয়া সাবানের ঘ্রাণ
ফুরিয়ে যাবার আগে মুঠোয় তুলে নেই
আর আমি কপাল ভাঁজ করে রাখি সদা অলখে …
শিউলি
শেফালিবোঁটার বর্ণ গন্ধ ভোরের শিশির মেখে
মুদিত নয়ন চুমিয়া যায় আবেশে মালা গেঁথে
মাটির কুসুম সুরভী ছড়ায় কপোল ওষ্ঠ ছুঁয়ে
বনবিথী ছুঁতে চায় আকাশ নির্মানে মেতে মেতে
বাহারি পাতায় সকাল দুদোল কেঁপে ওঠে হিয়া
নভোচারী মন গায় গান স্নায়ুর শরীর বেয়ে
অনুভবে মলিন আলোটুকু এসে পড়ে সহসা
জোছনা ভেবে পান করেছি রাতের অমানিশা
উষ্ণতাটুকু লেগে থাকে ময়েশ্চারাইজার হয়ে
কাজলের জল দুলে ওঠে খোয়াব রঙ চুইয়ে।
দিঠি
অধীর হয়েছে চোখ
কাজলে কাজলে জল
আলতো সরিয়ে রাখি
‘ঘুমন্ত ঘুঙুর অামি’
চুমুতে চুমুতে বাজি…
খুঁজিছো কাহারে যেন
আমার খাঁচার মাঝে
নির্জন দুপুরে পাখি
গোপনে পাঠালো চিঠি
সিঁথির সিঁদুর পরা
নিছক নাটক কলা
রাতের আদিম ছল
কথায় মুখোশ জামা
নতুন পেয়ালা ছেয়ে
সবই বনেদি ফেরা।।