ধারাবাহিক উপন্যাস | চোখবন্ধ অন্ধ সময়
সতেরো
বেশ কিছু দিন হয়ে গেলো অঞ্জলির জায়েদের বাড়ি ছেড়ে এসেছে, যা এক সময় ওরও বাড়ি ছিলো। সংসার নামের সোনার কেল্লা ছিলো একটা সময়, আজ ও সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে বুঝতে পারলো, আসলে ওটা ছিলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। একটি জেলখানা। গত কিছু দিন অঞ্জলি একদম বসে থাকেনি, বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ততা আর মানসিক টানাপোড়েনের ভেতর দিয়েও নিজের স্বাধীনতা আর মুক্তির জন্য দিন রাত অনেক কাজ করতে হয় ওকে। এই কাজের অভিজ্ঞতা পুরোই অন্য রকম, অচেনা অজানা আইনি জটিলতা, তারপরও ও এই ব্যস্ততা আর টানাপোড়ন উপভোগ করে সে, মনে হয় ঠিকঠাক সব গুছিয়ে করতে পারলে সামনে অপেক্ষা করছে ওর আর টিনটিনের মুক্তি। এই সময় ওকে সব চেয়ে বিধ্বস্ত করছে যা, বাচ্চাটাকে অনেক দিন দেখে না। অঞ্জলি বারবার ছেড়ে আসা বাড়ির নম্বরে ফোন করেছে প্রতিদিন, টিনটিনের সঙ্গে একটু কথা বলার আহাজারি থেকে, কিন্তু সে বাড়ির নম্বরে ফোন করলে ক্রমাগত সেটি বন্ধ পেয়েছে। বুঝাই যায়, জায়েদ টিনটিনের সঙ্গে ওর সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করবার জন্য এই ব্যবস্থা নিয়েছে, ডিসকানেক্ট করেছে পুরনো নম্বর।
জায়েদ আরও কয়েক দফা ফোন করে অঞ্জলির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, সামনা সামনি দেখা করতে চেয়েছে, অঞ্জলির এক রোখা না শুনে নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে এসে ওকে বুঝিয়েছে, মৃদু কণ্ঠে অনুরোধ করেছে বাসায় ফিরে যাওয়ার, কিছুতেই না পেরে পরে দেখে নেবার হুমকি দিয়েছে। অঞ্জলি যখনই টিনটিনের কথা জানতে চেয়েছে, জায়েদ বলেছে, বাসায় এসে নিজের ছেলেকে দেখে যাও। আমি নিশ্চয় এতো পাষাণ নই মা ছেলের মাঝে বাঁধা দিবো।
অঞ্জলিও জানে, সে বাড়িতে গিয়ে টিনটিনকে দেখাতে জায়েদ কোনো বাঁধা দিবে না, কিন্তু সে বাড়িতে ঢুকলে ও আর কোনো দিনই বেরিয়ে আসতে পারবে না তাও সে ভালো করে জানে। বাড়ি ছেড়ে অঞ্জলির এই চলে আসাকে জায়েদ নিজের পরাজয় হিসাবে দেখে। এই পরাজয় ওর পৌরষত্বকে অপমানিত করেছে তীব্রভাবে। কোনো ভাবেই সে এই অপমান মেনে নিতে পারছে না। অথচ জায়েদ যদি অঞ্জলির আর সংসার করতে না চাওয়াকে সঙ্গিনীর অপাগরতা বা চাওয়া ভেবে সম্মান জানাতো, মেনে নিতো সহজভাবে তবে এতসব উটকো ঝামেলা থেকে সবাই নিস্তার পেতো।
এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঞ্জলিকে শো কজ করা হয়েছে, কারণ, ওর উগ্র চলাফেরা ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক স্খলন ঘটাতে পারে। ও যদি নিজের ব্যবহারে শালীনতা বজায় না রাখে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কমিঠি পরবর্তীতে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে। কমিঠি কাদের ইশারায় চলছে আর শালীনতা বলতে কী বোঝাতে চাইছে বুঝতে পেরে ও নিজ থেকে চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে দেয়। যদিও এই সময়টাতে একটা চাকরী ওর জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। অঞ্জলি চাকুরী ছাড়ার পর মা ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, ও’র টাকা লাগবে কিনা? সে না করেছে, এখনও ও’র নিজের সঞ্চয় কিছু আছে, অবশ্য সে সঞ্চয় শেষ হওয়ার আগেই একটি চাকুরী যোগাড় করতে হবে ওকে।
এখনও অঞ্জলি সুমনের ফ্ল্যাটে আছে। ঠিক এই মুহূর্তে অঞ্জলির অন্য কোথাও বাসা নিয়ে চলে যাওয়াতে রাজী নয় সুমন, ওর মতে, কয়েক দিন পরেই সে কানাডা চলে গেলে ফ্ল্যাটটি খালি পরে থাকবে তারচেয়ে বরং অঞ্জলি এখানে যত দিন প্রয়োজন থাকুক। আপাতত সুমনের কথা অঞ্জলিও মেনে নিয়েছে। চাচ্চুকে চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক পাঠানো হয়েছে, সঙ্গে চাচী গেছেন। খুব গোপনে দেশ ছেড়তে হয়েছে চাচ্চুকে, এমন করে দেশ ছাড়তে হবে চাচ্চু হয়ত দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। যাবার আগে অঞ্জলিকে জড়িয়ে ছেলে মানুষের মতোই কেঁদে উঠেছিলে চাচ্চু। চাচ্চুকে বিদায় জানাতে গিয়ে অঞ্জলি উপলব্ধি করে, দুঃস্বপ্নের বাইরে গিয়েও পথ বেছে নিয়ে মানুষকে জীবনের পথে হাঁটতে হয়। যেমন ছোটচাচী।
ছোটচাচারা চলে যাবার দুদিন আগে এক সন্ধ্যায় ছোটচাচীর সঙ্গে হঠাৎ করে অঞ্জলির একটা কথোপকথন হয়ে যায়, আর সে কথোপকথনের পথ ধরে অন্য রকম আর একটি জীবনের গল্প ওর সামনে চলে আসে। খুবই সাধারণ গল্প ছোটচাচী, তারপরও জেনে শুনে বুঝে সব কিছু মেনে নেয়ার গল্পটা কেমন যেন মানা যায় না, তবুও মানতে হয়। সবাই যখন উদ্বেগ নিয়ে শুধুই ছোটচাচার কথা ভাবছে, চাচীও তাকে নিয়ে শংকিত, তাই আগ পিছ কিছু না ভেবে সেও স্বামীর চিকিৎসার জন্য দেশ ছাড়ছে কিন্তুও এও জানে দেশে শীঘ্রই ফেরা হবে না তাদের। সে সন্ধ্যায় একাকী হাল্কা অন্ধকার বারান্দায় ছোটচাচীকে বসে থাকতে দেখে অঞ্জলিও তারপাশে চেয়ার টেনে বসে জানতে চায়, চাচী কি কোনো বিষয়ে চিন্তিত?
হ্যাঁ, নিজেকে নিয়ে ভাবছি।
টেনশন হচ্ছে খুব তাই না? চাচ্চু সুস্থ্য হয়ে উঠবে খুব তার ড়াতাড়ি।
জানি অঞ্জলি। তোমার চাচ্চুর সুস্থ্যতা নিয়ে এখন আর ভাবছি না। ভাবছি নিজেকে নিয়ে।
অঞ্জলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ছোটচাচীর দিকে তাকায়।
দেখো তোমার চাচ্চু এখন যথেষ্ট সুস্থ্য। তার বাকি চিকিৎসাটাও দেশে করা সম্ভব কিন্তু তারপরও চিকিৎসার জন্য ওর এই যে বিদেশ যাওয়া এটা তো চিকিৎসার জন্য যাওয়া নয়। দেশ ওর জন্য আপাতত নিরাপদ নয় তাই বাধ্য হয়ে ওকে দেশ ছাড়তে হচ্ছে। কবে যে আমরা দেশে আবার ফিরে আসতে পারবো, আদৌ পারবো কিনা কিছুই জানি না। মৌলবাদীরা যেমন এখন ওর জন্য বিপদজ্জনক তেমনি রাষ্ট্রও কিন্তু ওর পক্ষে নাই। ও তো শুধু মৌলবাদীদের স্বার্থে আঘাত করে নাই, রাষ্ট্রের অনিয়ম দুর্নীতিগুলো নিয়েও প্রতিবাদ করেছে। যখন তখন ওকে গুম করে দিতে পারে যে কোন পক্ষ, তারপর একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাবে। কয়েক দিন এ নিয়ে দারুণ হৈচৈ করবে পাবলিক, শাহবাগে প্রতিবাদ আর কয়েক দফা মানববন্ধন হবে তারপর সবাই ভুলে যাবে। যেমন আমরা সব কিছু ভুলে যাই আর কী।
হুম। তাহলে ভালোই তো হলো আপনারা দেশ ছাড়ছেন। নিরাপদে থাকবেন।
অবশ্যই ভালো। তোমার চাচ্চু নিরাপদ হবে। কিন্তু আমি তো দেশে নিরাপদ, তবে আমি কেন দেশ ছাড়ছি? আমি খুবই সাধারণ মানুষ, নয়টা পাঁচটা অফিস করেছি, খুব সাধারণ থেকেছি সব সময়। এখানে আমার বৃদ্ধ বাবা মা থাকেন, তাদের আর কোনো সন্তান নেই যে ওদের দেখবে। নিজের সংসার, অফিস সামলে আমিই তাদের দেখাশোনা করেছি কিন্তু এখন আমি তাদের ছেঁড়ে চলে যাচ্ছি। তোমার চাচ্চুর ভাবনা বা লেখালেখির দায় দায়িত্ব আমার নয়, তারপরও আমাকে দায় নিতে হলো। আমি আমার দেশ ছেড়ে, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে, আমার বিন্দু বিন্দু করে গড়ে তোলা ক্যারিয়ার ছেড়ে, আমার বাবা মাকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। কেনো জানো? শুধু আমি নারী হয়েছি তাই।
আপনি চাচ্চুর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেছেন?
না।
বললে চাচ্চু হয়ত আপনার বিষয়টি বুঝতো।
বুঝেই বা কী হবে? ও হয়ত তখন গোঁ ধরে কোথাও গেলো না, দেশেই থাকলো, কে নিবে ওর নিরাপত্তার দায়িত্ব? তারচেয়ে বরং ওর দায়িত্বটা আমিই নিই, ওকে নিয়ে দেশ ছাড়ি, নিরাপদে থাকুক। এতো বড়ো পৃথিবীর কোথাও না কোথাও হয়ত ও নিরাপদ থাকবে, শুধু বাবা মার জন্য টেনশন হয় খুব, অনেক বয়স হয়েছে তো।
আমি যদি তাদের দেখাশোনা করি….
সে না হয় করলে কিন্তু তার আগে তুমি নিজের ঝামেলা শেষ করো। সাহস করে যে বিশাল সিদ্ধান্ত তুমি নিয়েছো, সবাই এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অনেকেই সাহসের অভাবে একটি জীবন অবহেলায় কাটিয়ে দেয়।…এই সময় তোমার পাশে যদি আমরা থাকতে পারতাম।
যোগাযোগ তো থাকবে চাচী। আর আশা করি, একাই সামলাতে পারবো।
ভয় করে, জায়েদ যদি বড়ো কোনো ঝামেলা করে?
কী আর করবে? ওর লোকজন লেলিয়ে খুন করাবে?….এখন মনে হয়, ও তাও হয়ত করতে পারে! কী করে জায়েদের মতো একজন নিষ্ঠুর অমানবিক মানুষের সঙ্গে আমি এতোটা বছর কাটিয়েছিলাম, এখন ভাবলেও আমার নিজের ওপর নিজের ঘৃণা হয়।
ছোটচাচী উঠে এসে অঞ্জলির কাঁধে হাত রাখে, সাহস রাখো অঞ্জলি। তুমি ঠিক ঠিক নিজের যুদ্ধটা জিতবে, দেখো।
ছোটচাচীর দেয়া সাহসের সঙ্গে সঙ্গে সেদিন অঞ্জলি জেনেছিলো, নারী ভালোবেসেও মেনে নেয়, পরাধীন হয়।
সুমনই হাউজ টু ফ্রিড়মের সায়কা পারভীনের সঙ্গে অঞ্জলির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। সায়কা পারভীন লইয়ার, তার প্রতিষ্ঠান হাউজ টু ফ্রিডম নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে। সায়কা সব শুনে বলেছিলেন, জায়েদের ক্ষমতার কারণে বিচার কাজে বেশ ঝামেলা হবে কিন্তু তিনি অঞ্জলির পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে চান। সন্তানকে কাছে রাখার অধিকার এবং বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে উকিল নোটিশটি পাঠানোর পর থেকে কিছুটা নির্ভার যেমন বোধ করছে অঞ্জলি তেমনি পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে জানা জায়েদের তান্ডবের কথা ভেবেও ও শংকিত। বুঝতে পারছে, ভেতরে ভেতরে জায়েদের আতঙ্কে সে এখনও কুঁকড়ে যায়!
অঞ্জলির নীরব মুখের দিকে তাকিয়ে সুমন জানতে চায়, কোনো সমস্যা?
জায়েদের কথা ভাবছি। সে নোটিশটি পেয়ে কী করবে?
কী আর করবে! তোমাকে ফোন করে বলবে, এতো দিন পরে তুমি যে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন তার জন্য তোমাকে অভিভাধন হে প্রিয়তমা…
সুমনের কথায় হেসে দেয় অঞ্জলি। সুমন বলে, যাক! তোমাকে হাসাতে পারলাম।
আমাকে হাসানো মোটেও কঠিন কাজ নয়।
কিন্তু তুমি যে মন খারাপ করে থাকো আজকাল।
টিনটিনের জন্য মন খারাপ করে খুব।
কিছু দিন অপেক্ষা করো, নিশ্চয় ছেলের কাস্টডি তুমি পাবে।
জায়েদকে তুমি চেনো না….
তোমার থেকে ভালো চিনি।
সুমনের কথার পর পর ঘরের পরিবেশ মুহূর্তের জন্য থমকে যায়, পর মুহূর্তে আবার ওরা দুজন হো হো করে হেসে ওঠলে সব গুমট হাওয়ায় উড়ে যায়। সুমন এবার বলে, সায়কা আপা আমাকে একটা রিকোয়েস্ট করেছে।
কোন ব্যপারে আবার?
তোমার কোনো ব্যপারে না। মণিষা নামে এক কিশোরীকে নিয়ে দুই তিন দিন আগে একটি অন লাইন পত্রিকায় একটি নিউজ হয়েছে, দেখেছো কি? বিয়ের রাতে মেয়েটিকে ওর স্বামী শ্বশুড় মন্দিরের পুরহিতের কাছে রেখে এসেছিলো। পরে মেয়েটি পুরহিতকে মেরে ওখান থেকে সে রাতেই পালিয়ে সোজা ঢাকা চলে আসে ওর পরিচিত এক মেয়ের কাছে।
হ্যাঁ, আমি পড়েছি মেয়েটির সম্পর্কে। সম্ভবত ওর নাম মণিষা।
একজেক্টলি। সায়কা আপা ফোন করে বললো, মেয়েটির আপাতত কোথাও থাকার জায়গা নেই। পরিচিত যে মেয়েটির সঙ্গে হোস্টেলে থাকতো সে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ ওদের দুজনকে রাখতে চাইছে না। মোটামুটি বেরই করে দিয়েছে। যতদিন না মেয়েটির জন্য একটি নিরাপদ জায়গা পাওয়া যাচ্ছে ততদিন যদি আমাদের এখানে ওদের দুজনকে থাকতে দেই, ওদের উপকার হয়। আমি বললাম তোমার সঙ্গে কথা বলে জানাবো।
অবশ্যই মেয়েটিকে আশ্রয় দেয়া উচিত। আমি জানি, নিরাশ্রয় কী! সে রাতের কথা ভাবলে এখনও আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে, এতো বড়ো শহর কিন্তু কোথাও একরাত্রি থাকবার মতো আশ্রয় নেই! কী যে অসহায় সে সময়গুলো! অথচ দেখো মণিষাকে, কী দুর্দান্ত সাহসী একটা মেয়ে। অতোটুকু এক রত্তি একটা মেয়ে, কিন্তু হার স্বীকার করেনি। সে লড়েছে। অচেনা এতোটা পথ সে যখন পার হয়ে এসেছে এবার আমাদের কর্তব্য মেয়েটিকে সাহস দেয়া। সুমন, মেয়েটিকে এখানে আসতে বলো, আমি ওই আগুন পাখীটাকে দেখতে চাই। কথা বলতে বলতে অঞ্জলি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সুমন মুগ্ধ চোখে সে কান্না দেখতে দেখতে ভাবে, মানুষের জন্য মানুষের এতো ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবী আজও টিকে আছে।
ঠিক তখন টেবিলে রাখা অঞ্জলির ফোনটি বেজে ওঠে, সে এবং সুমন দু’জনে চমকে ফোনের দিকে তাকালে স্ক্রিনে লেখা “জায়েদ”নামটি দেখতে পায়।
Shamim Runa, novelist, playwright, film critic and women rights activists.