চোখবন্ধ অন্ধ সময়

Share this:

ধারাবাহিক উপন্যাস | শেষ পর্ব

 

আঠারো

মণিষাকে নিয়ে সে বিকেলে সুমনের বাসায় এস হাজির হয়েছিলো আফিফা আর দীপাবলী দীপা। ওদের সুমনের ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায় ওসি খালেদ। ফ্ল্যাটের দরজাতে অপেক্ষা করছিলো সুমন আর অঞ্জলি, ওসি খালেদের সঙ্গে হাই, হ্যালোর সৌজনতাটুকু ছাড়া আর কোনো কথা হয় না ওদের, ওসি খালেদের মন্ত্রীর ডিউটির তাড়া ছিলো বলে সে আর ফ্ল্যাটে আসে না। তবে যে কোনো সমস্যায় ওকে যেন নির্দ্বিধায় ফোন করে তা বারে বারে বলে দীপার কাছে নিজের পার্সোনাল মোবাইল নম্বর দিয়ে গেলো। যেতে যেতে সে কী ভেবে আর একবার সুমন আর অঞ্জলিকে দেখতে গেলে চোখাচোখি হয় দীপার সঙ্গে, চোখ টিপে হাত নেড়ে দ্রুত চলে যায় সে। দীপা বিড়বিড় করে, অদ্ভূত ক্যারেক্টার!

সুমন আর অঞ্জলি, আন্তরিকতার সঙ্গে ছোট দলটিকে অভ্যর্থণা জানিয়ে ঘরে নিয়ে গেলো। অঞ্জলি খুব সংগোপনে, যেন বুঝতে না পারা যায়, তেমনি ভাবে বার বার আড় চোখে দেখছিলো মণিষাকে। অতটুকুন পিচ্ছি মেয়ে, কাঠি কাঠি লিকলিকে হাত পা আর খুব বড়ো আর উজ্জ্বল চোখ।  সদ্য কৈশোরে প্রবেশ করা বয়স, এই সময়টা বড়ো জোর সে কোনো রূপকথার রাজপুরত্রের স্বপ্ন  দেখতে পারে কিন্তু জীবনের কী নিষ্ঠুর আর র্নিমমতা ও জেনে গেছে এক্ষুনি। অঞ্জলির ভেতরটা কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে বিহ্বলিতও হয়ে ওঠে,  কী দারুণ সাহস ছোট মেয়েটির! সব চেয়ে ভয়ঙ্কর হলো দেয়াল। দেয়ালে কতটা পিঠ ঠেকে গেলে একজন কিশোরী এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে!

মণিষা আর আফিফা সুমনের ফ্ল্যাটে এসে ওদের সঙ্গে থাকতে শুরু করার পর অঞ্জলির একাকিত্ব কিছুটা কাটে। সুমন যদিও দিনের বেশির ভাগ সময় বাসাতেই থাকে, কিন্তু সে নিজের কাজ নিয়েই ব‌্যস্ত থাকে। সুমন শিঘ্রই কানাডা ফিরে যাবে কিন্তু যাবার আগে সে মণিষার ভবিষ্যত কী হবে সে বিষয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে চায়। যদিও ওকে কেউ এই দায়িত্ব নিতে বলেনি, সে নিজের মানবিক দায় থেকেই মেয়েটির জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করতে চায়। সুমন অঞ্জলিকে বলেছে, দেখো, মণিষাকে যদি আবার ওর গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয় তবে নারী মুক্তির একটি উদ্যোগ হেরে যাবে। ওকে যদি আবার সে স্বামীর ঘরে যেতে হয়, ওরা মেয়েটির জন্য বিচারের ব্যবস্থা করবে, মেয়েটি যে ধাতুর তাতে করে হয় সে আত্মহত্যা করবে নয়ত মানুসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে যাবে। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, মণিষার জয়ের উপর নির্ভর করে এরকম আরও দশজন মেয়ের প্রতিবাদ করার শক্তি। ওর এই প্রতিবাদ আরও দশজন মেয়েকে সাহস যেমন দিতে পারে তেমনি ধর্মীয় কুসংস্কারও হয়ত কিছুটা কমবে মানুষের মন থেকে। আর মণিষার শুরু করা প্রতিবাদে সে যদি হেরে যায়, রেজাল্ট হবে ঠিক উল্টাটা। তাই কিছুতেই মণিষাকে হারতে দেয়া যাবে না।

মণিষাকে নিয়ে বিভিন্ন বিদেশী অর্গানাইজেসনের সাথে যোগাযোগ করছিলো সুমন, যারা নানান ভাবে বিপদগ্রস্থ মানুষদের অন্য দেশে আশ্রয় এবং নতুন করে বাঁচার সুযোগ দিয়ে সাহায্য করে থাকে। এই মুহূর্তে মণিষার চেয়ে নিজ দেশে আর কে এমন বিপদগ্রস্থ আছে? সারা দেশের একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় শুধু নিজেদের ধর্মীয় ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে, একজন নির্যাতিতা কিশোরীকে ধর্ম অবমাননার দায়ে দেশের প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে, নিজেরা কঠোর হাতে মেয়েটির বিচার করতে চায়। খোলা চোখে বোঝা যায় কী হতে পারে ওদের সে বিচার, মেয়েটির বাকী জীবনটা নষ্ট করে নিজেদের ধর্মীয় কুসংস্কার জিইয়ে রাখা।  অথচ, সাধারণ দৃষ্টিতে মেয়েটি বরং নির্যাতিত, ওর সঙ্গেই অন্যায় করা হয়েছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। যে সময় মেয়েটির পড়াশোনা আর রঙিণ স্বপ্ন বুনে পার করার কথা সে সময়টি সে নিজের অস্থিত্ব রক্ষার তাড়নায় অজানার পথে ছুটছে। পিতামাতা ছাড়া হয়ে, নিজের পরিচিত পৃথিবীর বাইরে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন এবং অপরিচিত মানুষজনের কাছে থাকতে হচ্ছে ওকে। সুমন কাজ থেকে উঠে এসে মাঝে মাঝে মণিষার সঙ্গে কথা বলে ওর মতামত নেয়, জানতে চায় মণিষা নিজেকে নিয়ে কী ভাবছে? সে কি নিজের গ্রামে পরিবারের কাছে আবার ফিরে যেতে চায় নাকি? আর অঞ্জলি বিস্মিত হয়ে সুমনকে দেখে, না জেনে সুমনের সম্পর্কে কত জঘন্য মনোভাব সে পোষন করতো, ভেবে নিজেই লজ্জা বোধ করে।

আফিফা সকালে অফিসে চলে যায়, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পরিয়ে রাত হয়ে যায়, মণিষা এসময়টা কিছুটা ভীত আর অসহায় হয়ে যেতো, অঞ্জলি মেয়েটিকে আগলে রাখার তাড়না বোধ করতো, যদিও জানে, এই মেয়ে নিজের দায়িত্ব নিজেই নিয়ে পথ চলতে পারবে। অঞ্জলি মণিষার সঙ্গে কথবার্তা বলে ওকে সহজ করে তুলতে চাইতো। মণিষাকে সময় দেয়া, ছোটচাচীর বাবা-মায়ের খোঁজ করা, সায়কা পারভীনের সঙ্গে ডিভোর্স সংক্রান্ত কথার্বাতা বলা ছাড়া নিজের জন্য একটি চাকুরী খোঁজা, সব কিছুই অঞ্জলির কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, এবং এই সব কাজ করতে গিয়ে সে নিজেকে বরংবার নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকে যা ওকে অভিভূত করে!  অঞ্জলি মা’কে ফোন করে নিজের ভালো লাগার কথা বললে ওপাড় থেকে মা’ও বহতা নদীর মতো কলকল করে মেয়ের সুরে সুর মেলাতে থাকে, মেয়েকে সমর্থণ করে। মা’র ভেতরেও যে এতো কথা আছে কে জানতো! ওর প্রতি মায়ের এই সমর্থণটুকু এই সময়ে এক বিশাল শক্তি হয়ে কাজ করে। অনেক ঝামেলার ভেতর দিয়ে যদিও ওকে চলতে হচ্ছে তারপরও সব কিছুর পরও নিজেকে সে নির্ভার ভাবতে পারছে, স্বাধীন ভাবতে পারছে, এটাই ওর নবঃ জীবন, তাই নয় কী!

বিগত কিছু দিনের এতোসব ঘটনা প্রবাহের মধ্যেও যে ঘটনাটি অঞ্জলিকে সব চেয়ে বেশি অবাক করেছে, তা হলো বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে ওর পাঠানো উকিল নোটিশ পেয়ে জায়েদের করা ফোনে ওর সাথে কথোপকথন। অঞ্জলি যা ভেবেছিলো তেমনি তেড়িয়া মেজাজে কথা বলেনি জায়েদ, ওর ভাষা ছিলো সংযত এবং সে অঞ্জলির এমন ডিসিশনের জন্য কোনো রকম হুমকী ধামকীতে যায়নি তো বটে বরং মাপা কণ্ঠে বলেছিল, হয়ত আমারই অনেক ভুল ছিলো, আমাকে তুমি আগে তো শোধরানোর চেষ্টা করোনি, হঠাৎ  আমার মাঝে ভুল আবিষ্কার করলে এবং ডিসিশন নিলে আমাকে ছেড়ে যাবার। আমাকে একটি বার সুযোগ দিতে পারতে, বাকি জীবনটা তোমার মতো হওয়ার চেষ্টা না হয় করতাম।

অকস্মাৎ জায়েদের অন্য স্বরের কথায় অঞ্জলি থমকে যায়, ওর কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরোয় না।

আমি তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তুমি বোঝনি। তুমি  আমার বা টিনটিনের কথা না ভেবে নিজের জন্য যা ভালো মনে করেছ তেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আমি যদিও তোমার সিদ্ধান্তের বিরোধী তারপরও তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছি। আমি কোনো আইনি লড়াই করতে চাই না তোমার সাথে, তোমার যা করার করো। তোমার আইনের কাগজে আমার যত সই লাগবে পাবে তুমি। এরপর কোর্ট যা সিদ্ধান্ত দেবে অবশ্যই মেনে নেবো। শুধু অনুরোধ, আপাতত ডিভোর্সটা আমি গোপন রাখতে চাই, অকারণে রাষ্ট্র করতে চাই না। আশা করি, অনুরোধটা রাখবে?

ঠিক আছে, অস্ফুট কণ্ঠে অঞ্জলি এটুকুই বলতে পারে।

আর তুমি যদি নিজের সিদ্ধান্ত বদলাও, আমাকে জানিও। আমার ঘর সংসার সব সময় তোমার থাকবে। বলেই ফোনটা কেটে দিয়েছিলো জায়েদ।

তারপর দু’দিন পর জায়েদের ফোন থেকে হঠাৎ টিনটিন মা’কে ফোন করে, দীর্ঘ দিন বাদে ছেলের সঙ্গে কথা হয়ে যায় অঞ্জলির। অঞ্জলির কণ্ঠ বাষ্প হয়ে আসে, ছেলেটার খুব মন খারাপ করা কাঁপা স্বর, তারপরও ওরা কেউ কান্না করে না। আশ্চর্য মানুসিক শক্তি ছেলের, শুধু মৃদু স্বরের বায়না; মা’র কাছে আসতে চায় সে। অঞ্জলি ছেলেকে কথা দেয়, খুব শিঘ্রই সে ছেলেকে নিজের কাছে এনে রাখবে। টিনটিনের সঙ্গে কথা শেষে নিজেকে ধাতস্ত করতে কষ্ট হয় বৈকি ওর, তারপরও মনটা আনন্দে থাকে; দীর্ঘ দিন পর সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে পারার সুখে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বুকে নাক ডুবিয়ে সন্তানের দুধ গন্ধটা বুক ভরে টেনে নেয়ার জন্য ওর ভেতরটা হাহাকার করে, সন্তান আদরের অতৃপ্তি নিয়েও সে জায়েদের প্রতি রুষ্টতা এক বিন্দু কমিয়ে দেয় এই মানবিক ব্যবহারটুকুর  কারণে।

জায়েদকে নিয়ে সুমনের সঙ্গে গত কয়েক দিন কোনো কথা হয় না অঞ্জলির, তাই জানানো হয় না জায়েদের সামান্য মানবিকতার কাহিণী। সুমন মণিষার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত, কানাডা ফিরে যাবার আগে মেয়েটির জন্য একটি নিশ্চিত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে যেত চায় আর অঞ্জলি ভাবে, আপাতত নিজের পরিস্থিতি ও নিজেই সামাল দিতে পারবে।

অঞ্জলি এবং মণিষা, দুই জনের পরিস্থিতিতে যখন একটি থমথমে নিয়ন্ত্রণের আবহ, তেমনি এক সন্ধ্যায়, আফিফার সঙ্গে আসে দীপাবলী দীপা ওদের ফ্ল্যাটে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে অঞ্জলির মনটা বলে ওঠে, আবার এক দুঃসং’বাদ! কী হতে পারে?

মণিষা, তোমাদের পুরো পরিবার ইন্ডিয়া চলে গেছে, কারোকে কিছু না জানিয়ে…. দীপার কথা মণিষার বোধগম্য হয় না, অঞ্জলিরও না। শুধু সুমন জানতে চায়, কবে গেলো?

মানে! হঠাৎ করে কেন গেলো? মণিষা দীপার কাছে প্রশ্ন করে।

দুই দিন আগে। এলাকার মন্দির কমিঠির ক্রমাগত চাপ, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিচারের নামে মণিষাদের পরিবারকে নানান রকম অপদস্ত আর  নির্যাতনের মাধ্যমে বিধ্বস্ত করে তুলেছিলো।  ওদের এক ঘরে ঘোষণা করা হয়েছিলো, ফলে বাজার সদাই যেমন বন্ধ ছিল, খাওয়া দাওয়ার সমস্যা আর বাড়ীর সদস্যদের সুযোগ মতো পেলে মারধোরও করা হচ্ছিল। যদিও মণিষার বাবা বলেছিলো, তিনি কন্যাকে ত্যায্য করেছেন কিন্তু কে শোনে কার কথা। এর মধ্যে যে ছেলেটির সঙ্গে মণিষার বিয়ে হয়েছিল ওদের ইনভল্বমেন্ট আর  ভিলেজ পলিটিক্স, ভিটে বাড়ী দখলের ষড়যন্ত্রে সব কিছু মিলে কন্যা হারানো পিতামাতা ধকলটা নিতে পারেনি শেষ পর্যন্ত।

এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু ঘটে গেলো একটি পরিবারে সঙ্গে? একটি আধুনিক রাষ্ট্রে এও কি সম্ভব? হুট করে একটি পরিবার দেশহিন হয়ে যায় কী করে? সুমন বিড়বিড় করে আপন মনে স্বগোক্তি করে।

সবই সম্ভব এই অসম্ভবের দেশে। প্রতি নিয়ত মানুষরা দলে দলে হাওয়া হয়ে যায় কী শ্রেফ লাস হয়ে পরে থাকে রাজপথে জনারণ্যে। প্রতিদিন অসংখ্য নারী শিশু ধর্ষিত হচ্ছে, কোথাও কোনো রিএ্যাকশন আছে? আগে একটি কথা প্রচলিত ছিলো, যতক্ষণ না নিজের ঘাড়ে বিপদ এসে পড়ছে ততক্ষণ বাঙালী চুপ থাকে। আর এখন আমাদের মাথার উপর আকাশ ভেঙে পরলেও আমরা কেবল গোঙাই, প্রতিবাদ করি না। আওয়াজ করি না, জেনে গেছি আওয়াজ করে লাভ নাই। কোথাও বিচার নাই…..

দীপার ক্ষেদোক্তির মধ্যে আর্তস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে মণিষা, ও মা…. মাগো আমার…..কই চলে গেলা…

মণিষার সে আর্তনাদের স্বরে সবাই চুপ করে যায়, ওরা পরস্পরের দিকে চাইতেও ভুলে যায়। সবাই ভাবে, এমন আর্তনাদ করে ওরাও কাঁদতে পারলে ভালো হতো, মনের সকল দুঃখ-যন্ত্রণা, ক্ষেদ-ক্লেশ, কান্না হয়ে মনের গভীর থেকে বেরিয়ে যেতো। কিন্তু কাঁদতে পারে না, ওদের গলা ধরে আসে; কান্না আসে না।

আফিফা এগিয়ে মণিষাকে জড়িয়ে ধরে, আম্মার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, যাবার আগে কাকী আম্মার সাথে দেখা করে গেছে। কাকী জানে, তুই আমার কাছে আছিস। কাকী আম্মাকে বলে গেছে, আমি যেন তোরে নিরাপদে রাখি। তুই যেন বেঁচে থাকিস, তিনি কোনো একদিন তোর মুখটা আবার দেখতে চান।

মণিষা তখনও কেঁদে চলেছে, সুমন বলে, কাঁদো ঠিক আছে কিন্তু ভেঙে পরো না। যে প্রতিবাদ তুমি শুরু করেছ সে প্রতিবাদটা তোমাকে চালিয়ে যেতে হবে মণিষা।

হ্যাঁ, প্রতিবাদটা তোমাকে চালিয়ে যেতেই হবে মেয়ে…! অঞ্জলি বলে।

 

কয়েক দিনের মধ্যে সুমন মণিষার জন্য একটি হোস্ট কান্ট্রি পেয়ে যায়, যারা মণিষাকে নিজেদের দেশে আশ্রয় দিতে এবং ওর দায়িত্ব নিতে খুবই আগ্রহী। দেশটির নাম কানাডা, এই রকম বিপদগ্রস্থ আরও অনেক নারীকে নিজেদের দেশে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে। সুমন যখন মণিষাকে খবরটি জানায় সে ভীত হয়ে ওঠে। তা দেখে অঞ্জলি জানতে চায়, তুমি কি ভয় পাচ্ছো মণিষা? ভয়ের কিছু নেই, ওখানে তোমার জন্য নতুন এক জীবন অপেক্ষা করছে, স্বাধীন এক জীবন। তুমি নিজের মতো বাঁচার সুযোগ পাবে ওদেশে। মেয়ে হয়ে জন্মেছো বলে তোমার ওপর কেউ কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে না। সে দেশে তুমি কোনো রকম আতঙ্ক ছাড়া নিজের মতো একটি স্বাধীন জীবন পাবে। তুমি কি জানো, মালাইলা ইউনুফ জাইকেও কানাডা নাগরিকত্ব দিয়েছে। আবার সৌদি  কিশোরী রাহাফ, যে সৌদির নারীদের জন্য বানানো আদিম নিয়ম কানুন থেকে বাঁচার জন্য নিজ দেশ থেকে পালিয়েছিল, সেও কানাডায় আশ্রয় পেয়েছে।

ওর কথা আমাকে দীপাদি বলেছে। মণিষা জানায়।

তাহলে ভয় কী? শুধু তুমি একা নও, তোমার মতো অনেক সাহসী মেয়েরা ওদেশে একাই আছে, ভালো আছে, ওরা নিজেদের জন্য, সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কাজ করছে। তুমিও তেমনি নিজের জন্য, তোমার মতো আরও অনেক মেয়ে যারা বাঁচতে চায় কিন্তু বাঁচার পথ পাচ্ছে না তাদের জন্য কাজ করবে।

আর আমি তো সে দেশেই থাকি, তোমার সঙ্গে মাঝে মাঝেই আমি দেখা করতে যাব মণিষা। আমার মেয়েকেও তোমার সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাবো। সুমন বলে।

মণিষার আনন্দের সংবাদটি জানতে পেরে সে সন্ধ্যায় দীপাবল দীপা আসে আফিফার সঙ্গে। অঞ্জলিও মা’কে ফোন করে জানায় সংবাদটি, শুনে তিনিও গাজীপুর থেকে টিফিন ক্যারিয়ার ভরে খাবার দাবার নিয়ে মণিষাকে দেখতে আসেন বিকেল বেলা। ফলে অনেক দিন পর ওদের ফ্ল্যাটে আনন্দময় এক  আড্ডা হয়, খাওয়া দাওয়া হয়, গান হয়। খালি গলায় দীপা রবীন্দ্র সংগীত গায় আর কারো কোনো অনুরোধ ছাড়াই হঠাৎ করে মণিষা লালনের  “সময় গেলে সাধন হবে না” গানটি করে সবাইকে তাক্ লাগিয়ে দেয়। স্বল্পভাষী মণিষা গান গাইতে পারে তাই কেউ জানতো না আর সেখানে ওর এই হঠাৎ গান করা, এ যেন নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়া। খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসা। সবাই মুগ্ধ হয়ে ওর গান শোনে। গান শেষে দীপা আর আফিফা মণিষাকে আবেগে জড়িয়ে ধরে, অঞ্জলির মা বলে, অনেক দিন পর এমন আবেগ ভরা সুর শুনলাম গো মেয়ে! তুমি তো অনেক গুনবতী কন্যা! নিজের গুনের কদর করো, যত্ন করো নিজের।

সবাই তখনও গানের ঘোরে আচ্ছন্ন এই সময় সুমন জানায়, পরশু আমার ফিরে যাবার ফ্লাইট।

ওর কথা শুনে সবাই হঠাৎ চুপ করে যায়। সুমনই হেসে উঠে বলে, হঠাৎ সবাই এমন চুপ করে গেলে যেন আমি বলেছি পরশু আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হতে যাচ্ছে।

আসলে তুমি যে ফিরে যাবে তা আমাদের মনেই ছিলো না। তাই হঠাৎ সবাই তব্দা মেরে গেলাম। অঞ্জলি বলে।

তব্দা মারার কিছু নাই বন্ধু সকলে। কথা হবে নিয়েমিত। আর আমার সঙ্গে তো কিছু দিনের মধ্যে মণিষার দেখা হচ্ছে। আর আমি আমার মেয়েটাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার ছোট্ট ডল….

সুমনের এই কথায় আবার আড্ডার প্রান ফিরে আসে। গল্পের আসর ভেঙে মা আর দীপা চলে গেলে মণিষা আর আফিফাও ঘুমুতে চলে যায়। ড্রইংরুমে বসে অঞ্জলি সুমনকে বলে, তোমাকে আমি খুব মিস্ করবো সুমন। তুমি না থাকলে আমি এতোটা পথ আসতে পারতাম না।

ওভাবে বলেো না অঞ্জলি। তুমি তোমার পথে একাই এসেছো। সাহস তোমার ভেতরেই ছিলো, বুঝতে পারোনি। তুমি নিজে স্ফুলিঙ্গ ধারণ করছিলে, আমি হয়ত তোমার নিজেকে চিনতে সামান্য সাহায্য করেছি। তুমি আমাকে অবলম্বন ভেবেছো, আমি যা নই, পুরো পরিবর্তনটা তোমার নিজের সাহস আর ইচ্ছার প্রকাশ মাত্র।

তারপরও তোমার হাতটা আমাকে এই পথে হাঁটার সাহস জুগিয়েছে…

বন্ধুর হাত সব সময় পাবে…নিজের খেয়াল রেখো, নিজের উপর আস্থা রেখো। আর…

আর?

আজকের ছোট্ট আড্ডাটা আমার খুব ভালো লেগেছে, সারা জীবন মনে থাকবে। এমন সব মুহূর্তের জন্যই যেন আমরা বেঁচে থাকি….

হুম, মুহূর্তে বাঁচি আর সে সব মুহূর্ত জড়ো করে একটি জীবন গড়ি। ওদের দুজনের বুক থেকে একত্রে একটি দীর্ঘশ্বাস উঠে এলে দুজনেই এক সঙ্গে হেসে ওঠে।

 

পরের দিন আচমকা সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মুহূর্তের বাঁচার জীবনটাও মুহূর্তে থেমে যায় বৈকি!

সেদিন সকালে আফিফা অফিসে চলে গেছে, আর সবাই বাসায় ছিলো। ওদের কারোই তো বাইরে তেমন কাজ নাই, সুমন নিজের রুমে ল্যাপটপে ব্যস্ত, অঞ্জলিও ইন্টারনেটে হুমড়ি খেয়ে চাকুরীর বিজ্ঞপণ দেখছিলো আর মণিষা হয়ত বাথরুমে শাওয়ার নিচ্ছিল এই সময়ে। দুপুর তিনটা কী সাড়ে তিনটা বাজে, কলবেল বেজে উঠলে অঞ্জলি নিজ রুম থেকে আস্তে ধীরে উঠে আসে দরজা খোলার জন্য, সে ড্রইংরুমে আসতে আসতে দেখতে পায় সুমন সদর দরজার কাছে পৌঁছে গেছে, তাই ও আর না এগিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে, আগত জনকে দেখবে বলে। অঞ্জলি কিছু বুঝে ওঠার আগে দরজার কাছে ধাক্কাধাক্কি আর হুড়ুহুড়ি, কয়েকটি কণ্ঠস্বর এক সঙ্গে চাপা গলায় গালি গালাজ করছে! অঞ্জলি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, হতভম্বয়ে পরিস্থিতি বুঝতে চায় সে, এর ঘরের মধ্যে চার পাঁচ জন লোক সুমনকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পরেছে। ওরা দরজা লাগিয়ে সুমনকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে দরজার কাছ থেকে ড্রইংরুমের মাঝে নিয়ে আসে।

সুমন!…. ওরা কে?…আপনারা কে?…কী চাইছেন আপনারা? অঞ্জলির কথা নিজের কানে পৌঁছার আগে ও আর একটি বাক্য শুনতে পায়, শালা নাফরমান, শুয়রের বিষ্ঠা সমকামী….শক্ত কইরা ধর্ নর্দমার কীটটারে….

তিনজন লোক সুমনকে শক্ত করে ধরে ফ্লোরে উপুড় করে ফেলে দেয়। সুমন কিছু বলে, কিন্তু ওর কণ্ঠস্বর থেকেও জোরালো হয়ে ওঠে আগত লোকগুলোর সমবেত শব্দ, আল্লা… হু আকবর….। অঞ্জলির দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসে, লোকগুলো কী করছে? সে কী দেখছে ঠিক যেন বুঝতে পারে না। তারপরও সে দেখে আগত লোকগুলোর একজন সাথে করে আনা চাপাতি নেমে যাচ্ছে সুমনের পেছনের  ঘাড় বরাবর, সে কিছু না ভেবে আটকানোর জন্য ছুটে যেতে চায়; ওকে আর একজন লোক ঝাপ্টে ধরে শক্ত হাতে; ফিনকি দিয়ে সুমনের ঘাড় দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে নামছে মেঝেতে, মুহূর্তে পুরো ফ্লোর তাজা লাল রক্তে সিক্ত উঠে, এরই মধ্যে সুমন “গোঁ গোঁ” স্বরে আবার কিছু বলে, অঞ্জলি শুধু বিকৃত স্বরে সুমনের গোঙানো শোনে; বোধগম্য হয় না শব্দ। কোরবানী পশু জবাই দেয়ার মতো করে যে লোকটি সুমনের ঘাড়ে চাপাতি চালাচ্ছিল সে নিষ্ঠুর চোখে একবার অঞ্জলির দিকে তাকালে ওর মনে হয়, এই মুখ কেমন পরিচিত, চেনা চেনা! কোথায় দেখেছে এই মুখ… ভাবতে ভাবতে অঞ্জলি জ্ঞান হারায়।

 

 

উনিশঃ

অঞ্জলি মণিষাকে নিয়ে ওর মায়ের গাজীপুরের বাসায় এসে উঠেছে। সেদিনের সে ঘটনা বায়োস্কপের রিলের মতো অঞ্জলির চোখে সেঁটে আছে, যেন সে বায়োস্কপের বাক্সের কাঁচে চোখে রেখেছে, ঘটনার রিল একের পর এক আসছে, ও জানে পরবর্তী ঘটনা কী ঘটতে যাচ্ছে তারপরও সে চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না। বিহ্বল হয়ে দেখছে দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভঙ্কর সে দুর্ঘটনা, সুমনের চিৎকার; খুনীদের পৈশাচিক আনন্দ উল্লাসের ভাষা সব এখন অঞ্জলি স্পষ্ট শুনতে পায়।

মণিষা মানুসিক ভাবে ভয়ানক রকম পর্যুদস্ত। এমনিতে সে এক ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল এর মধ্যে সুমনের মৃত্যু ওকে পুরোপুরি নিশ্চুপ আর আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছে। মণিষা সেদিন ঘরে হৈচৈর শব্দ শুনে বাথরুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে দেখে ড্রইংরুমের মেঝেতে সুমন আর অঞ্জলি দুজনেই রক্তের মধ্যে পড়ে রয়েছে। প্রথমে ওর মাথা কাজ করে না কী হয়েছে বোঝার জন্য, কিছু সময় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে ও গোঙাতে গোঙাতে কারোকে ডাকতে ডাকতে অঞ্জলির শরীরের উপর টলে পরে যায়, বুঝতে পারে না অঞ্জলি কি আদৌ বেঁচে আছে কী মরে গেছে।  একটু দূরে সুমনের নিথর দেহ উপুড় হয়ে পরে রয়েছে, তখনও ওর শরীর থেকে তাজা উষ্ণ রক্তের একটি ধারা গড়িয়ে নামছে মেঝেতে। মণিষার ধাক্কা ধাক্কিতে অঞ্জলির জ্ঞান ফিরে আসে, উঠে বসেই ও হুড়মুড়িয়ে সুমনের কাছে ছুটে যায়, জড়িয়ে ধরে তুলতে চায় সুমনকে। সুমনের মাথাটা দেহ থেকে আলাদা হয়ে  ওর হাতে উঠে আসতে চাইলে অঞ্জলি সেটি আবার একত্রিত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে, ওর ভয় হয় না; ওর ভেতরটা ক্রোধ আর নিদারুণ কষ্টে থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে, ইচ্ছে করে নিজের ক্রোধের আগুনে যদি পারতো সারা পৃথিবীটা যদি পুড়িয়ে দিতে পারতো; তবে যদি কিছু শান্তি পেতো ও। কিন্তু বাহ্যিক দিক দিয়ে ওর অভিব্যক্তি ছিলো গভীর শ্রান্ত, ভয়ঙ্কর ঝড়ের শেষে নদীর জল যেমন আকাশের প্রতিচ্ছবি বুকে নিয়ে স্থির হয়ে শুয়ে থাকে ঠিক তেমন ওর অভিব্যক্তি, সুমনকে দু’হাতে জড়িয়ে রাখে বুকের মধ্যে।

মণিষা দরজা খুলে ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে গিয়ে দেখে বাহির থেকে দরজা লাগানো। ও সমানে দরজা ধাক্কাতে থাকে আর চিৎকার করে সাহায্য চায়। যখন এ্যাপার্টমেন্টর অন্যান্য মানুষরা এসে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে তখনও অঞ্জলি সুমনের নিথর দেহ কোলে নিয়ে স্তব্ধ বসে রয়েছে। আর মণিষা মূর্চ্ছা যাবার আগ পর্যন্ত ক্রমাগত চিৎকার করে অদৃশ্য কারোকে বকা দিয়ে যাচ্ছিল।

পরিচিতজনদের জিজ্ঞাসা, পুলিশি জেরা কারোকেই অঞ্জলি খুনীদের চেহারার বর্ণনা দিতে পারে না। অথচ সে প্রতিটি খুনীকে ঘরে ঢুকতে দেখেছে, সুমনকে ধরতে দেখেছে, খুন করতে দেখেছে কিন্তু ওদে চেহারা সে কিছুতেই স্মরণে আনতে পারে না। সিনেমা রিলের সব কিছু ঠিকঠাক আছে স্মুতিতে শুধু খুনীদের মুখগুলো ব্লার হয়ে যায় বারবার। ডাক্তারী ভাষায়, আতঙ্ক থেকে সাময়িক স্মৃতি বিলুপ্তি ঘটেছে ওর, হতেই পারে এমনটা, যে কোনো সময় আবার ঝট্ করে সব স্মৃতি ফিরেও আসতে পারে। স্মৃতির এই টানা পোড়েনের মাঝেও অঞ্জলির শুধু মনে হয়, একটা পরিচিত মুখ কি ছিল ওই খুনীর দলে! ঠিক স্মরণে আসে না….

মণিষার কানাডা ফ্লাই করার ডেট আরও মাস খানেক পরে, এখন ওকে একজন মানুসিক ডাক্তার নিয়মিত থেরাপি দিচ্ছেন। আফিফা আর দীপাবলী দীপা ওর জন্য খুব খাটছে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, পুলিশি ঝামেলা, পাসপোর্ট, ভিসা সংক্রান্ত সমস্ত রকম জটিলতা সামলানো থেকে শুরু করে সব কিছু ওরা দেখছে। আফিফা আর দীপাও সুমনের মৃত্যুতে অনেক বেশি আঘাত পেয়েছে। আগের রাতের আড্ডার তরতাজা প্রাণটিকে পরবর্তী দিন লাশ হিসাবে মেনে নেয়া কারো পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তারপরও বন্ধুর লাশের ভার কাঁধে নিয়ে ওরা  শাহবাগে মিছিল, শ্লোগান আর মানব বন্ধন সব কিছুতে সরব থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চেয়েছে আর দিন শেষে অঞ্জলির কাছে এসে কান্নায় ভেঙে পরেছে।  আপু, এইসব মিছিল মিটিং করে কী হবে? আমরা কি সুমন ভাইকে ফেরত পাবো না তার খুনের বিচার পাবো? পুলিশের আশ্বাস বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দম্ভোক্তি সব কিছুই তো প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়।

 

জীবনটা সুন্দর একটা গতি পেতে পেতে আবার যখন হোঁচট খেয়ে পরলো সে সময় এক রাতে আরও দুঃসংবাদ জানানোর জন্য যেন জায়েদের ফোন আসে অঞ্জলির কাছে, সে জানায়, টিনটিন অসুস্থ্য।

কী হয়েছে ওর? অঞ্জলির কণ্ঠে আবার ভয়।

খারাপ কিছু না, জ্বর। তোমার জন্য কাঁদছে খুব, একটু কথা বলো ছেলের সঙ্গে। জায়েদ ফোনটা ছেলেকে ধরিয়ে দেয়।

মাম্মা! তুমি বলেছিলে আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে, নিয়ে যাবে না? টিনটিনের এমন প্রশ্নে অঞ্জলির ভেতরটা ভেঙেচূড়ে যায়।

এই তো বাবা, ক দিন বাদে নিয়ে আসবো। এখন মা বেশি ব্যস্ত তো তাই….

ঠিক আছে মাম্মা! তুমি ফ্রি হলে আমাকে নিয়ে যেও। আমি তোমাকে মিস্ করছি খুব। বাবা বলেছে, আর কিছু দিন পর থেকে আমি তোমার সঙ্গে থাকতে পারবো।

হ্যাঁ বাবা কিছু দিন পর থেকে আমরা এক সাথে থাকবো। তোমার কি খুব জ্বর আমার বাবাটা?

না মাম্মা। একটু একটু জ্বর। বাবা বলেছে ঔষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।

হ্যাঁ বাবা, ঔষুধ খেলে জ্বর চলে যাবে। বাবার কথা শোনো, ঠিক মতোন ঔসুধ খেও।

অঞ্জলির সঙ্গে আবার জায়েদের কথা হয়, জায়েদ বলে, তুমি কি এখনও ছেলেকে দেখবার জন্য একবার আসতে পারো না বাসায়? ছেলেটা তোমাকে চাচ্ছে খুব, আমি নিশ্চয় তোমাকে বেঁধে রাখবো না।

অঞ্জলি বলে, তুমি ওকে দুদিনের জন্য মায়ের বাসায় আমার কাছে দিয়ে যাও না কেন?

জায়েদ আর কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দেয়। অঞ্জলি ল’ইয়ার সায়কা পারভীনকে ফোন দিয়ে জানতে চায়, আপা, আমার ছেলের কাস্টডি পেতে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?

সায়কা পারভীন ফোনের ওপর পাশে কিছু সময় অপেক্ষা করে বলে, আমরা তো প্রসেস শুরু করলাম অল্প কিছু দিন হলো, একটু সময় তো লাগবে সব কিছু আইনের মাধ্যমে করতে।

অঞ্জলি কান্নায় ভেঙে পরে বলে, টিনটিন অসুস্থ্য আপা। আমাকে চাইছে খুব….

সায়কা পারভীন চুপ করে থাকে, জানে এই সময় কোনো কথা বলতে হয় না, চুপচাপ মায়েদের কান্না শুনতে হয়।

 

দুই দিন বাদে প্রায় রাত বারোটার দিকে জায়েদ আবার ফোন করে, ওর কণ্ঠে উৎকণ্ঠা, ছেলেটার উতাল পাতাল জ্বর। ওকে গুলশানে একটি ক্লিনিকে কিছুক্ষণ আগে ভর্তি করতে হলো…

আমাকে দুই দিন কিছুই জানালে কেন? কী হয়েছে টিনটিনের?

তুমি কি আর ওর ব্যপারে কেয়ার করো? শুধু ছেলেটা মাম্মা মাম্মা করছে বলে জানালাম এখন। টাইফয়েড। বেশ সিরিয়াস…

আমি আসছি, ক্লিনিকের নাম বলো….

রাত অনেক হয়েছে, তাই আমি তোমাকে নিতে এসেছি। ক্লিনিকে যেতে নিশ্চয় তোমার সমস্যা হবে না। আমি মায়ের বাসার সামনে আছি। তুমি বেরিয়ে আসো। জায়েদ বলে।

অঞ্জলিকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে মা জানতে চায়, কী হলো অন্জু? এতো রাতে কই যাস্ আবার?

মা, আমার টিনটিন খুব অসুস্থ্য। আমাকে ওর কাছে যেতে হবে। এখন আমার ওর পাশে থাকা জরুরী।

আমিও আসছি তোর সাথে…

তোমার এখন যেতে হবে না। বাসায় মণিষা রয়েছে, ওর একা থাকা ঠিক না এই সময়। আমি গিয়ে ফোন করে তোমাকে সব জানাবো মা। আমি আসি…

অঞ্জলি দ্রুত বেরিয়ে গেলে মা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মেয়েটির উপর দিয়ে কী এক কাল বৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কোথাও দু দন্ড শান্তি পাচ্ছে না।

 

বাসার সামনের ল্যাম্পপোস্টের ছায়া ছায়া অন্ধকারে জায়েদের গাড়ি দাঁড়ানো ছিলো, গাড়ির সঙ্গে হেলান দেয়া জায়েদের ছায়াটা চিনতে অঞ্জলির এক মুহূর্তও লাগে না। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় এই ছায়া আর কায়াকে ঘিরে ওর সব বিশ্বাস আর ভালোবাসা আচ্ছন্ন ছিলো আর মিথ্যে ভিতের ওপর বিশ্বাস বা ভালোবাসা কোনো কিছুই টিকে থাকতে পারে না। অঞ্জলি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে, এই মুহূর্তে ও জায়েদকে নিয়ে আর বেশি কিছু ভাবতে চায় না, ওর সমস্ত দেহ মন টিনটিনের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে। কত দিন ছেলেটি ওর স্পর্শের বাইরে!

জায়েদ অঞ্জলির জন্য গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো, ওকে দেখে কোনো কথা না বলে গাড়ির দরজাটি খুলে দিয়ে সে নিজেও পেছনের সিটে অন্য পাশে গিয়ে বসে। ওরা দুজন বসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলতে শুরু করে, অঞ্জলি একবার সামনের সিটে ড্রাইভারের মুখ দেখার চেষ্টা করে আনমনে, হাল্কা অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না তবে পুরনো জন নয়। সে এবার জায়েদের দিকে ঘুরে জানতে চায়, সত্যি করে বলো জায়েদ, টিনটিন কতটা অসুস্থ্য?

চলো আগে, নিজের চোখে দেখবে।

কোনো ক্লিনিক?

চলো তো…। জায়েদ একটু বিরক্ত হয়।

ম্যাডাম, বেশি চিন্তা করবেন না, বাবা ভালোই আছে। ড্রাইভারের সিটের লোকটি বলে।

অঞ্জলি উত্তরদাতার মুখ দেখার জন্য  আবার গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে তাকায়, রাস্তার নিউন বাতির আলো বা অন্য কোনো গাড়ির হেড লাইটের আলো এসে লোকটির মুখের উপর পড়ে আবার সরে যায়, অঞ্জলির মনে হয় পরিচিত মুখ। কিন্তু কে, মনে করতে পারে না সে। এসময় গাড়ি রাস্তার পাশে স্লো করলে অঞ্জলি জানতে চায়, এখানে কেন গাড়ি থামালে?

আমাদের সঙ্গে আরও একজন যাবে, তাকে নেয়ার জন্য গাড়ি থেমেছে। জায়েদ বলে।

রাস্তার অন্ধকার থেকে একজন লোক গাড়ির দিকে এগিয়ে আসে, অঞ্জলি কিছু বুঝার আগে বাইর থেকে ওর পাশের দরজাটি খুলে ফেললে সে কিছুটা জায়েদের দিকে সরে যায় আর লোকটি অনেকটা ওকে ধাক্কিয়ে ওর পাশের সিটে বসে যায়।

একি! এ কে?  বিরক্ত এবং ভয়ার্ত কণ্ঠে অঞ্জলি ধমকে ওঠে।

এতো হিসহিস করো না তো। চুপ করে বসো। জায়েদ চাপা স্বরে ধমকে ওঠে।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। অকস্মাৎ অঞ্জলির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিপদের আভাস পেয়ে জানান দেয়, ও শিকারে পরিণত হয়ে গেছে! ওর গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে, এতো সাবধানে থেকেও শেষ রক্ষা হলো না ওর? কিন্তু জায়েদের প্ল্যানটা কী? ওকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখবে? এইটাও কি সম্ভব? অঞ্জলির মনে হয় এক্ষুনি মাকে ফোন করে জানানো দরকার,  ব্যাগ থেকেফোন বের করতে গেলে নবাগত লোকটি ওর হাত থেকে সেটি কেঁড়ে নিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে ছুঁড়ে দেয়।

রাহেলা, তুমি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছ। আপাতত এসব বন্ধ করে কিছু সময় ভদ্র হয়ে থাকো।

তুমি টিনটিন অসুস্থ্য বলে আমাকে এনেছো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছো।

হ্যাঁ মিথ্যে বলেছি। টিনটিন সুস্থ্য আছে, তোমার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে সে।

এয়ারপোর্টে কেন?

আজ রাতে আমরা তুরষ্ক যাচ্ছি, তাই।

তুরষ্ক!

অঞ্জলির মাথা ফাঁকা হয়ে যায়, সে নিজেও ওজন শূণ্য হয়ে ব্যালান্স হারিয়ে টলে ওঠে। ওর করা ভবিষ্যত সব প্ল্যান কর্পূর হয়ে হাওয়ায় মিশে যেতে থাকে ওর চোখের সামনে, অনুভূতি হয়; উড়তে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ঢিল ছুঁড়ে ওর ডানা ভেঙে দেয়া হয়েছে, ওর আর কখনও ওড়া হবে না, একটি স্বাধীন জীবন আজন্ম স্বপ্ন থেকে যাবে কি!

তুমি এভাবে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারো না। আমার অনুমতি ছাড়া আমাকে কোথাও নেয়ার অধিকার তোমার নেই।

অঞ্জলির কথায় এই প্রথম জায়েদ মাথা নেড়ে অবজ্ঞা ভরে হেসে উঠে, ওর সঙ্গে গাড়িতে বসা অন্য লোক দুজনও খিক্ খিক্ শব্দে হাসিতে যোগ দেয়।

তুমি আমাকে ঠিক মতো চিনতে পারো নাই রাহেলা। আমি কতটা কী করতে পারি সে সম্পর্কে তোমার বিন্দুমাত্র ধারণা নাই। তোমাকে কীভাবে তুরষ্ক নিয়ে যাবো কিছুক্ষণ পরই টের পাবে।

ভাবী বেশি টেনশন নিয়েন না, ঘুমাইতে ঘুমাইতে চলে যাবেন।

সামনে বসা লোকটির একটু মাত্রাতিরিক্ত রগড় করার অভ্যাস, সব কথাতে টক্কর দিতে হবে তাকে। অঞ্জলির পাশের লোক বিরক্ত হয়ে গোঁৎ করে শব্দ করে, সে জানতে চায় জায়েদের কাছে, হুজুর, ইন্জেকশন কি কখন পুশ্ করবো?

অঞ্জলি এখন ওদের কথার রেশ ধরার চেষ্টা করছে, কীভাবে ওরা কী করতে চায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় ও, গাড়ি গাজীপুর চৌরাস্তার মোড় পার হচ্ছে, ওর ভেতরটা হুঁ হুঁ করে ওঠে, আহারে এই ভাষ্কার্য কি ও আর কখনই দেখতে পাবে না! বেশ রাত হলেও রাস্তায় গাড়ির হাল্কা ভিড় রয়েছে কিন্তু কেউ জানতে পারছে না এতো মানুষের ভিড়ের মধ্য দিয়ে ও কি চতুর কৌশলে অপহৃত  হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অঞ্জলি অপহৃত হতে চায় না, আবার যদি সে জায়েদের খপ্পরে গিয়ে পরে ওর নিজের জীবন আর নিজের থাকবে না।

সব ব্যবস্থা ঠিক আছে তো? জায়েদ মৃদু কণ্ঠে জানতে চায়।

এয়ারপোর্টে সবাইকে সাইজ করা আছে। কেউ কিছু জিজ্ঞাস করবে না। ড্রাইভারের সিটের লোকটি আবার কথা বলে। অঞ্জলি রিয়ার ভিউ মিররে দেখে, পরিচিত মুখ; কোথায় দেখেছে এই লোককে? কখনও কথা হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না।

জায়েদ ফোন করে কারোকে, টিনটিনকে নিয়ে রওনা হয়েছো?…. এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেছো? বাহ্, রাখি। জায়েদ ফোন কেটে দিয়ে অঞ্জলির দিকে ফিরে, শোন রাহেলা, তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে প্লেনে তোলা হবে। তুমি অসুস্থ তাই তোমাকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেয়া হচ্ছে। প্রথমে সিঙ্গাপুর তারপর তুরষ্ক। এখন বলো, তুমি কি টিনটিনের সঙ্গে দেখা করে ঘুমাতে চাও নাকি এখনই ইন্জেকশনটা দিয়ে দেবে তোমাকে?

অঞ্জলি গাড়ির মৃদু আলোতে দেখে, জায়েদের সমস্তটা মুখ মন্ডল পৈশাচিক আনন্দে উদ্ভাসিত, ওর প্রতিটি কথা জয়ের আনন্দে মোড়ানো। সে মুখ দেখতে দেখতে কিছু একটা মনে হলে ও আবার রিয়ার ভিউ মিররে তাকায়, এবার সামনের লোকটির মুখ স্পষ্ট, চিনতে পারে লোকটিকে; ঢাকা মেডিক্যালে এই লোকটিকে প্রায় দেখতো সে, ভেবেছিলো; ওখানকার কর্মী। আরও স্মৃতি মনে পড়ে অঞ্জলির, সুমনের ফ্ল্যাটে। সুমনের ফ্ল্যাটেও ছিরো এই মুখ, সুমনকে কয়েকজন চেপে ধরেছে আর এই লোক চাপাতির ধারালো দিকটা সুমনের ঘাড়ের উপর….।

অঞ্জলির সব মনে পড়ে আবার সব ঝাপসা হয়ে যাসে, কান্না ঘৃণা, পরাজয় সব কিছু মিলে। সূত্রগুলো ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ছোটচাচ্চুর উপর আক্রমণ, সুমনের খুন হয়ে যাওয়া আর ওকে অপহরণ-সব কিছুতে এই একটি লোকের উপস্থিতিতে অঞ্জলি বুঝতে পারে, নির্দেশদাতা কারা।  অঞ্জলির ভেতরটা হিম হয়ে আসে নিজের পৃথিবীতে আর থাকতে পারবে না জেনে , ওর ভেতরটা কেঁদে ওঠে সুমনের অসময়ে চলে যাওয়ার বেদনায়, ছোটচাচ্চুর দেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশে হারিয়ে যাওয়া। সে কোনো কথা বলতে পারে না, জলভরা চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, গাড়ি উত্তরার রাজপথ ধরে বিমান বন্দরের দিকে ছুটছে। অঞ্জলি ভাবে, যা কিছু করার বিমান বন্দরে পৌঁছানোর আগে করতে হবে, গাড়ি থেকে বেরুতে হবে কিন্তু এই গাড়ি থেকে কী করে বেরুবে ও?

অঞ্জলির বামে বসা অপরিচিত লোকটি দরজা লক করে রেখেছে আর ডানে জায়েদের পাশের দরজা আনলক্। জায়েদের ঠোঁটে উপহাসের হাসি, অঞ্জলির দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে তখনও। অঞ্জলি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, জায়েদকে কোনো ভাবে জিৎতে দেয়া যাবে না, সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে সে জায়েদের পাশের গাড়িরে দরজাটি এক ঝটকায় পুরো খুলে ফেলে। অঞ্জলির আকস্মিক এই কাজে জায়েদ বুঝে উঠতে পারে না, অঞ্জলি কী করতে চলেছে। গাড়ি তখন ফাঁকা রাস্তা পেয়ে স্প্রিড তুলে ছুটছিলো, এর মধ্যে অঞ্জলি গায়ের সব শক্তি একত্রিত করে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিলে অপ্রস্তুত জায়েদ গাড়ির বাইরে ছিটকে পরে। জায়েদের সঙ্গী দুজন অঞ্জলির কাছ থেকে এমন প্রতিরোধ আশা করেনি, তখনও ওরা পরিস্থিতি বুঝে ওঠেনি এর মাঝে অঞ্জলি নিজেও বাইরের রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে।

মাঝ রাস্তায় পরেই অঞ্জলি দেখে কিছু দূর থেকে একটি লরি ছুটে আসছে ওর দিকে, ও গড়িয়ে রাস্তার একপাশে যেতে না যেতে লরিটি ওর গা ঘেঁষে শব্দ করে চলে যায়। অঞ্জলি হাঁচড়ে পাঁচড়ে নিজেকে দাঁড় করায়, দেখে ওকে অপহরণের গাড়িটি রাস্তার এক পাশে থেমে গেছে আর কিছু দূর থেকে মাঝ রাস্তা ধরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে জায়েদ দৌঁড়ে আসছে। দিকদ্বিক হয়ে ও উল্টো মুখো হয়ে দৌঁড়াতে গিয়ে বুঝে, সম্ভবত বাম পা ভেঙে গেছে, তারপরও নিজেকে রক্ষা করার তাগিদে সে দৌঁড়াতে থাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে দেখে গাড়িতে থাকা লোক দুজন রাস্তার ওপাশ থেকে চলন্ত গাড়ির ফাঁক গলে ছুটে আসছে ওকে ধরার জন্য। ও বুঝতে পারছে, একটু পরই লোক দুজন ওকে ধরে ফেলবে, তারপর?

যখন ধরতে পারবে তখন দেখা যাবে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অঞ্জলি লড়াই করতে চায়, দেখতে চায় নিজ চেষ্টা ওকে কত দূর নিয়ে যায়। সে দৌঁড়াতে থাকে, খুঁড়িয়ে, ল্যাংচিয়ে রেসের শেষ পর্যন্ত সে যেতে চায়!

অঞ্জলির পেছন পেছন ছুটে আসছে লোক দু’জন, তাদের পেছনে জায়েদ। ওরা প্রায় অঞ্জলিকে ধরে ফেলার দূরত্বে ঠিক তখন অন্ধকারে থাকা গাড়ির জোরালো হেড লাইটের আলো এসে পরে ওদের প্রত্যেকের উপর।

আলোর উৎসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অঞ্জলি ভাবে, তবে কি হেরেই গেলাম? ওর পেছনের লোক দু’জন থমকে দাঁড়িয়ে পরেছে, ওদের পেছনে জায়েদও। সামনের গাড়ি থেকে নেমে এসে অঞ্জলির মুখোমুখি দাঁড়ায় ওসি খালেদ।

কী বিষয় এখানে? এতো রাতে আপনারা সবাই রাস্তায় খেলাধুলা করছেন নাকি?

অঞ্জলি হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ওরা আমাকে কিডন্যাপ করতে চাইছে?

ওরা কারা?

জায়েদের লোক দু’জনের একজন, যে অঞ্জলির পাশে বসেছিল তার হাতে পিস্তল ছিলো, সে তা আলগোছে শার্টের পেছনে লুকিয়ে ফেলে। পেছন থেকে জায়েদ এগিয়ে আসে ওসি খালেদের সামনে।

আমি জায়েদ….

জ্বি স্যার! আপনার পরিচয় দিতে হবে না, আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি, বিজন্যাসম্যান জায়েদ সাহেব । সমস্যাটা কী হয়েছে বলেন তো স্যার….

আমার স্ত্রী অঞ্জলি। বেশ কিছু দিন ধরে ও অসুস্থ্য। আমি দেশে টিট্রমেন্ট করেছি কিন্তু সারছে না দেখে এখন সিঙ্গাপুর নিতে চাই ওকে টিট্রমেন্টের জন্য। কিন্তু কিছুতে সে যাবে না, বুঝতেই চাইছে না নিজের অসুস্থ্যতা, দেখেন না কেমন গাড়ি থেকে নেমে পালাতে চাইছে সে।

ও তাই নাকি? তা উনার কী অসুস্থ্যতা? দেখে তো সুস্থ্য মনে হচ্ছে।

মানুসিক সমস্যা…

পাগল!

ওই আর কী….

আমি মোটেও পাগল নই। আমি ওকে ডিভোর্স দিতে চাই কিন্তু সে তা কিছুতেই মানছে না। আমাকে জোর করে দেশ থেকে নিয়ে যেতে চায় এখন, যাতে আটকে রাখতে পারে। হাঁফাতে হাঁফাতে অঞ্জলি বলে।

স্যার মিয়া বিবির কেইস প্যাচ খাইছে। ওসি খালেদের পাশের এক কন্সটেবল হেসে বলে। কন্সটেবলের হাসির কারণে জায়েদের সঙ্গের লোক দু’জন একটু সহজ হয়ে উঠে। যে গাড়ি চালাচ্ছিল সে এগিয়ে আসে খালেদের সামনে, আসলেই স্যার মিয়া বিবির মান অভিমানের কেইস। ছেড়ে দেন, ফ্লাইটের সময় হয়ে আসছে…

বলছেন যেতে দিতে? ওসি খালেদ হেসে জানতে চায়।

আমি ওকে চিনতে পেরেছি! অঞ্জলি হঠাৎ তিক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, এই লোক, এই লোক সুমনকে খুন করেছে।

অঞ্জলির হঠাৎ এই রকম একটি বোমা ফাটিয়ে বসবে তা সবার ধারণাতীত ছিল, ওসি খালেদের সঙ্গে থাকা কন্সটেবলরা হঠাৎ করিৎকর্মা হয়ে হাতের অস্ত্র তাক করে জায়েদের সঙ্গী দু’জনের দিকে।

তাই নাকি? কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠে ওসি খালেদ শিষ বাজিয়ে জানতে চায়।

ওসি সাহেব আমি তো বলেছি আপনাকে ওর মাথায় সমস্যা আছে…

এই লোক দু’জন জায়েদের জন্য কাজ করে। জায়েদ আর ওরা একই  পার্টির মেম্বার। আমার চাচ্চুকে হত্যা করার চেষ্ঠা করেছে ওদের পার্টি, সুমনকেও এরা হত্যা করেছে এখন আমাকে কিডন্যাপ করে তুরষ্ক নিতে চায় জায়েদ। আমার ছেলেকে জায়েদের লোকেরা অলরেডি এয়ারপোর্ট নিয়ে গেছে। নিজের ছেলেকে জায়েদ জঙ্গী বানাতে চায়।

জায়েদের সঙ্গের লোক দু’জন পিছু হটছিলো, ওসি খালেদের ইশারায় কন্সটেবলরা ওদের ধরে ফেলে। জায়েদ অঞ্জলির কথায় হতচকিত হয়ে যায়, নিজেকে ধাতস্ত করে সে ওসি খালেদকে সিরিয়াস কণ্ঠে বলে, ধরে নেন এসব আমার স্ত্রীর প্রলাপ। কত চান আপনি?

ওসি খালেদ জায়েদের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, ওরা দুজনই হাইওয়ের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো, রাতের লরি ট্রাক বাস শব্দ করে ওদের পাশ ঘেঁষে যাচ্ছিলো। ওসি খালেদ ওর সাথের লোকজনের দিকে একবার তাকিয়ে হেসে বলে, কত দিতে চান?

আপনি যা বলেন, ব্লাঙ্ক চেক, এমাউন্ট বসিয়ে নেবেন নিজে। ওরাও পাবে….

এরপরই অকস্মাৎ ভাবনার বাইরের ঘটনা ঘটে, যা সেকেণ্ড খানেক আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, এমন কী অঞ্জলি নিজেও নয়। দশ কী বিশ সেকেণ্ড কিংবা হয়ত একযুগ পর, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো দলটি বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখে মাঝ রাস্তায় পড়ে রয়েছে জায়েদের থোবড়ানো-থ্যাতলানো এলোমেলো শরীর। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করে একটি মাল বোঝাই “সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন” জায়েদকে পাঁচ ছয় ফুট দূরে উড়িয়ে নিয়ে তারপর পুরো বডি দিয়ে চাপা দিয়ে গেছে। রাস্তার নিয়ন বাতির নিচে জায়েদের শরীরটা তখনও থরথরিয়ে কাঁপছিলো, আর ওসি খালেদের পাশে প্রবল উত্তেজনায় অঞ্জলি হাঁফাচ্ছিলো, কিন্তু ওর মুখটা অপার্থিব আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ভাসছিলো।  একটু আগে অঞ্জলিই অশরিরী আত্মার মতো ঘটনাটি ঘটিয়েছে, ও যখন দেখলো, জায়েদ কিনে নিচ্ছে ওসি খালেদকে তখনই সে দৌঁড়ে এসে ফুল স্প্রিডে হাই ওয়ে ধরে ছুটে আসা একটি ট্রাকের সামনে প্রচণ্ড জোর ধাক্কায়  জায়েদকে ছুঁড়ে দেয়, এমন আকস্মিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করবার জন্য জায়েদ বা ট্রাক ড্রাইভার কেউ প্রস্তুত ছিলো না। ফলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে জায়েদের থ্যাতলানো শরীর এখন মাঝ রাস্তায় শুয়ে কাঁপছে।

ওসি খালেদের প্রথম সম্বিৎ ফিরে আসে, কিছু দূর গিয়ে জায়েদকে চাপা দেয়া ট্রাকটি থেমে পরেছে দেখে। সে একজন কন্সেটেবলকে বলে, ট্রাকটি এখনই বিদায় করো, এদিকে যেন না আসে। ওসি  খালেদ  অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে দেখে, সে শ্রান্ত ভঙ্গিতে রাস্তায় পরে থাকা জায়েদকে দেখছে, ওকে দেখে মনে হচ্ছে; জয়ী বিজেতাকে দেখছে প্রশান্তি নিয়ে। জায়েদের সঙ্গী দুজন ততক্ষনে সেখানে পৌঁছে গেছে। ওসি খালেদের মাথা দ্রুত কাজ করে, জটলা তৈরী হওয়ার আগেই কাহিনী শেষ করতে হবে….

 

 

বিশঃ

অঞ্জলি এখন এক এনজিওতে চাকুরী করে, ছেলেকে নিয়ে নিজের ভাড়া করা ছোট ফ্ল্যাটে থাকে। ওকে দেখার জন্য প্রায়ই মা আসে আর আসে দীপাবলী দীপা আর আফিফা। প্রায় মাস খানেক হলো, মণিষা কানাডা চলে গেছে, ওর সঙ্গে সুমনের বয় ফ্রেণ্ড দেখা করেছে ওদের মেয়েকে নিয়ে। মণিষা নিজের নতুন জীবন মানিয়ে নেয়ার খুব চেষ্টা করছে, অঞ্জলি, দীপা, আফিফা মনে করে সে তা পারবে। অসম্ভব তেজস্বী এক মেয়ে মণিষা, এরা কখনও হারে না, হারের জন্য এরা জন্মায় না।

আর অঞ্জলি? সে কি হার মানতে জানে? না, জানে না। সেও তেজস্বী এক নারী। সে রাতের আসল ঘটনা ওসি খালেদের টিম ছাড়া আর যে জানে সে হলো মা। মায়ের কাছে ফিরে এসে কান্নায় ভেঙে পরেছিলো অঞ্জলি, মা বলেছিলো, তুই আমার দুর্গা, অসুর বধ করে এসেছিস্। তুই কোনো অন্যায় করিসনি অঞ্জু।

ওসি খালেদের সে রাতের তদন্ত রিপোর্টের সারর্মম ছিলো অনেকটা এরকম, অঞ্জলিকে অপহরণ কালে পুলিশ অপহরণকারীদের গাড়িকে সন্দেহ করে ধাওয়ার এক পর্যায়ে প্রধাণ আসামী জায়েদ গাড়ি থেকে নেমে পালাতে গিয়ে ট্রাক চাপায় মৃত্যু বরণ করে  আর ওর সঙ্গী দুজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে অত্র এলাকায় নিহত হয়। বন্দুকযুদ্ধে পুলিশের এক কন্সেটেবল আহত হয় এবং পরবর্তীতে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ্য হন। পুলিশ বাহিনীর সুনিপুন দক্ষতার কারণে অপহৃতা অঞ্জলিকে অক্ষত এবং নিরাপদে উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। বিমান বন্দর থেকে আর একজন অপহরণকারীসহ অঞ্জলির সন্তানকেও নিরাপদে উদ্ধার করে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।

অঞ্জলি নারীদের নিয়ে কাজ করে, কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারে,পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ বন্ধুর পথ। এই বন্ধুর পথে সুমনের মতো বন্ধুর হাতের অভাব বোধ করে অঞ্জলি।

 

 

Shamim Runa, novelist, playwright, film critic. and women’s rights activist.

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!