বারো:
মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর অঞ্জলী আবার চোখ বন্ধ করে বালিশের সঙ্গে জোর করে নিজের মাথা চেপে ধরে রাখে,এক রাজ্যের ঘুম চোখের পাতায় জমে আছে কিন্তু খিঁচে বন্ধ করে রাখা চোখে এক ফোঁটা ঘুম ছিলনা। গত কিছু দিন ধরে অঞ্জলির ওপর দিয়ে এক অনাহূত ঝড় বয়ে যাচ্ছে কাল সে ঝড় হঠাৎ করে তাণ্ডব প্রলয়ের রূপ নিলে ওর নিজেকে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসের কাছে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর করার কিছু ছিলনা। এখন চোখ বন্ধ কর গতকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একের পর এক দ্বিতীয়বার দেখা সিনেমার মতো খতিয়ে দেখছে। সিনেমা দেখা শেষ হওয়ার পর মনে হলো, ও এখন সুমনের ফ্ল্যাটে। বাস্তব বিষয়টি ওর কাছে এত অকল্পনীয় মনে হয়,গতকাল সকালে, দুপুরে, বিকালে কী রাতে এই ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছানোর আগ মুহূর্তেও ওর ভাবনায় যা ছিল না।
টিনটিনকে খুব মনে পরে,সকালে ঘুম থেকে জেগে প্রথমে সে মা’কে চুমো খেতো; মায়ের কাছ থেকে অনেকগুলো চুমো নিয়ে তবে বিছানা ছাড়তো, আজ ছেলেটি কী করছে? মা’কে মনে করে মন খারাপ করছে হয়ত, কেননা; ওর জন্মের পর থেকে কোনো দিন সে মা ছাড়া থাকেনি। অঞ্জলি ভাবে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে মুক্ত করতে পারলে ও নিশ্চয় টিনটিনকেও নিজের কাছে পাবে, নিজের মুক্তি না হলে দু’টি জীবন কূপমণ্ডুক অন্ধকারে আটকে থাকবে সারা জীবনের জন্য।
শুয়ে শুয়ে অঞ্জলি অনুভব করে, সুমনের ফ্ল্যাটটি খুব সুনসান নীরব। তবে কি সুমন জাগেনি এখনও নাকি বাসায় নেই? ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা নিজেরা যত না শব্দ করে তার চেয়ে বাইরের শব্দে বেশি জর্জরিত হতে হয় তাদের। সুমনের ফ্ল্যাটটি মূল সড়ক থেকে দূরে একটি কানাগলির শেষ মাথায় হওয়াতে বাইরের কোলাহল ঘরে ঢোকার যথার্থ পথ পায় না বলে হয়ত এমন সুশীতল নীরবতা!
বেলা করে অঞ্জলি রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে, কাল রাতে ওর ভেতর বোধ কাজ করেনি, আজ সংকোচ অষ্টেপৃষ্টি জড়িয়ে ধরেছে; হঠাৎ করে সে সুমনের ওপর কেমন এক চাপ তৈরী করে ফেলেছে!
খাবার টেবিলে ল্যাপটপে কাজ করছিল সুমন, অঞ্জলিকে দেখে মাথা তুলে তাকিয়ে বিস্মিত হয়,ওর দৃষ্টিতে যথার্থই মুগ্ধতা;সে জানতে চায়; মনে হচ্ছে ভার্সিটি লাইফে হারিয়ে যাওয়া অঞ্জলিকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি! ত্যানাটি ফেলে দিলে নাকি ভুল করে পরোনি?
আর টানাতে পারছি না, তাই।
মন থেকে গ্রহন না করলে টানা’র সামর্থ্যের কথা আসে। সুমন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বলে।
অঞ্জলি হাসে, দীর্ঘ অনেক গুলো বছর অতিবাহিত করে আজ সে মাথায় হিজাব পরেনি, লম্বা চুলের রাশি ওর কোমড় ছাড়িয়ে নেমে গেছে। কেনো হিজাব পরেনি? বাথরুমের আয়নায় তাকিয়ে হিজাব পরতে গিয়ে হাত থেমে গিয়েছিল, ও তো কখনও স্বেচ্ছায় এই বস্তুতে নিজেকে আবৃত করতে চায়নি, এটি হলো জায়েদের সঙ্গে বিয়ের অনুচ্চারিত অনুষঙ্গ ও শর্ত। সংসার করতে গিয়ে অনেক গুলো শর্তের বন্ধনে আবদ্ধ হতে গিয়ে হিজাব নামক শর্তেও নিজের মস্তক ঢেকে নিয়েছিল সে। আজ বাথরুমের আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, মস্তকের স্বাধীনতার জন্য, ভাবনার স্বাধীনতার জন্য সবাই’র আগে মস্তককে শর্ত মুক্ত করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মাথার নিউরণের কোণে হারিয়ে যাওয়া একটি তথ্যও মনে পরে গেল, এসব কিছু ধর্মের ধাপ্পাবাজী! জাদু বিদ্যার মতোই আগ্রহমূলক একটি বিষয়, কালো কাপড়ে ঢাকা বাক্সে কী আছে জানার প্রবল আকাংক্ষা। তেমনি বোরখার নিচে ঢাকা পরা রমনী সে না জানি কত সুন্দরী বা হিজাবের নিচের রমনীর চুলের রঙ কী দৈর্ঘ্য নিয়ে পুরুষরা কী ভাবিত হয়না!
সুমন আবার ল্যাপটপে দৃষ্টি নামিয়ে জানতে চায়, ঘুম হয়েছে?
হুম, ভালো।…তোমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম…
তা কিছুটা ঝামেলায় অবশ্যই ফেলেছো। তবে বন্ধুর জন্য এরচেয়ে বেশি ঝামেলা পোহাতে রাজী আছি।
আমি এখন যেতে চাই সুমন।
কোথায় যাবে?
জানিনা। হয়ত মা’র কাছে…
অঞ্জলি বসো, আগে দুই বন্ধুতে কিছু কথা বলি।
সুমন নিজে বসা থেকে উঠে একটি চেয়ার টেনে অঞ্জলিকে এগিয়ে দেয়। অঞ্জলি বসলে ও ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার মেয়ের ছবি দেখবে?
তোমার মেয়ে আছে? বিয়ে করলে কবে? জানাওনি তো, ছবি দেখাও …
অঞ্জলির উচ্ছ্বাসিত আগ্রহের দিকে তাকিয়ে সুমনর ভ্রু জোড়া কৌতুকে কুঁচকে ওঠে, তোমরা বিয়ে করতে পারো আমি বিয়ে করলে সমস্যা কী!
আমি কী তাই বললাম?…আসলে দেখো, আমরা এক সময় এতো ভালো বন্ধু ছিলাম, সময়ের কারণে সবাই কত দূরে চলে গেছি। কেউ কারো সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না।
না অঞ্জলি, আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম না। দেখা হতো তাই সৌজন্য মূলক কথা হতো। আমি কখন তোমার জীবন থেকে সরে গেলাম জানোই না। এক সময় লক্ষ্য করলে, আমি তোমার আশেপাশে নেই কিন্তু কেনো নেই সেটুকু জানার প্রয়োজনও বোধ করোনি কখনও। অঞ্জলি, তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জানো না, বন্ধু হলে অবশ্যই অনেক কিছু জানতে, আমার খোঁজ রাখতে।
সুমন কথা বলছে মৃদু হাসতে হাসতে, সে হাসির প্রেক্ষিতে অঞ্জলি বিপর্যস্ত বোধ করে; আড়ষ্ট স্বরে বলে, ঠিক তাই তো!আসলে সে সময়টা এমন ছিল…
সরি অঞ্জলি টেক ইট ইজি, আসলে আমি তোমাকে বিব্রত করার জন্যে এমন করে বলিনি কিন্তু কথাগুলো তো সত্যি তাই না?
হুম, তা সত্যি।
সুমন ল্যাপটপটি অঞ্জলির দিকে ঘুরিয়ে দেয়, স্ক্রিনে ছয় সাত মাস বয়সী পুতুলের মতো হাস্যজ্জ্বল শিশুকন্যার ছবি। শিশুর ছবিটি অঞ্জলিকে মুগ্ধ করে। সে মুগ্ধ চোখে একের পর এক স্লাইড দেখতে থাকে, নাম কী তোমার কন্যার?
চন্দ্রকণা।
চন্দ্রকণা? বাহ্!যথার্থ নামকরণ।
চন্দ্রকণাকে কোলে ফ্রেঞ্চকাট এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোকের বেশ কিছু ছবি দেখে অঞ্জলি জানতে চায়, কে লোকটি? তোমার বন্ধু?
আমার বয়ফ্রেণ্ড মার্টিন।
চকিতে অঞ্জলির হাত কী বোর্ডের ওপর থমকে যায়, ও বিভ্রান্ত মুখ তুলে সুমনের দিকে তাকায়। সমকামিতা সম্পর্কে অঞ্জলির জ্ঞান শূণ্যের কোঠায়,তবে গত কিছু দিনে সে এই বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করেছে, বিশেষ করে ছোটচাচ্চুর বইগুলো পড়ার পর বিষয়টির প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ বোধ থেকে সে আরও কিছু সমসাময়িক বই আর ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল গেঁটেছে। সেসব বই-জার্নাল সমকামিতাকে বিকৃত যৌনতা হিসাবে না ধরে বরং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে গবেষণা-বিশ্লেষণ করে বুঝানো হয়েছে এই প্রতিক্রিয়াটিও মানব প্রকৃতির একটি সহজাত যৌনক্রিয়া। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের মতো সমলিঙ্গের প্রতিও অনেকের আকর্ষণ থাকবে,বিষয়টি কোনো ভাবে অনৈতিক বা গর্হিত অপরাধ হতে পারে না। ঈর্ষনীয় বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে পৌঁছেও বিশ্বে সমকামিতা সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের জ্ঞান শূণ্যের কোটায়, ওর মতোই;এই বিষয়ে দৃষ্টিভঙি সমান্তরাল হওয়া উচিত হলেও সমকামিতা এখনও প্রচীন যুগের মতো ঘৃন্য অপরাধ বলে মনে করে অনেকে। অনেক দেশ সমকামি বিয়েকে যেমন বৈধতা দিয়েছে তেমনি সমকামিতার কারণে এখনও দেশে দেশে বহু মানুষকে প্রান দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে মৌলবাদীরা সমকামিতাকে পাপ বলে গন্য করে,মুসলিম, খ্রিস্টান,হিন্দু নির্বিশেষে সব ধর্মের মৌলবাদীরা মনে করে সমকামিরা নরকের কীট, ওদের স্থান হবে দোযখ বা হেলে। সুমনের দিকে তাকিয়ে অত কিছু ভাবছিল না অঞ্জলি তবে ও ভাবতে পারেনি সুমন একজন সমকামি। নিজের পরিচিত কেউ সমকামি হতে পারে তা ওর ধারণায় ছিল না,তার মানে কি সমকামিতা এখনও ওর কাছে অগ্রহনযোগ্য একটি বিষয়? মোটেও তা নয়, বিষয়টি হলো অপ্রচিলত ধারণা গ্রহন করার অভ্যস্থতা ওর মাঝে গড়ে উঠেনি। হ্যাঁ,যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে নিজেকে মানবিক আর স্বচ্চ দৃষ্টির মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবার জন্য সে প্রস্তুত, চোখে বিস্ময় নিয়ে অঞ্জলি সুমনের দিকে তাকায়।
অঞ্জলির বিস্ময় বুঝত পেরে সুমন হেসে ওঠে, তোমার কী আমাকে ঘৃনা টৃনা লাগছে নাকি? লাগলে বলো….
ছি সুমন! কী যে বলো…
তাহলে ওভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
এতো সহজে বললে।
সহজ কথা ঘুরিয়ে বলার কী আছে? আমি যাই তাই বলেছি, এতো লুকোচুরির কী আছে! তুমি জানতে না আমার বিষয়টি?
কোন বিষয়?
আমি সমকামি…
না।
জায়েদ তোমাকে বলেনি?
জায়েদ জানতো?
সুমন বলে, হ্যাঁ জানতো। জায়েদ আমাকে তখন বলেছিল, আমার সম্পর্কে সে তোমাকে জানিয়েছে।
কই! নাতো, সে তোমাকে নিয়ে কিছু বলেনি আমাকে!
সুমন সম্পর্কে আলাদা করে জায়েদ কী জানিয়েছিলো? সুমন ওকে স্বপ্নে বিছানায় নিয়ে গিয়েছিলো সে কথা? মোটেও তা নয়, তবে কী? জায়েদ তো বরাবরই সুমন সম্পর্কে কোনো কথা বলা থেকে বিরত থেকেছে। তবে কী?
কী?
অঞ্জলি সুমনের মুখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকে, কিছু একটা হিসাব মেলোতে চায়; তারপর দৃষ্টি নামিয়ে বলে; সত্যি, বন্ধু হলে বন্ধুর সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে হয়! প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, তোমার মেয়ে সম্পর্কে বলো সুমন।
চন্দ্রকণা! চন্দ্রকণা! আমার আর মার্টিনের সারোগেট চাইল্ড। কী বলবো ওটুকু পিচ্চি সম্পর্কে! এটুকু ছোট্ট মানুষটা, আমাদের দু’জনকে কী দারুণ ভাবে বেঁধে নিয়েছে। কী এক প্রচণ্ড ভালোবাসায়! দেশে এসেছি, আমার মন কানাডায় মেয়ের কাছে পরে রয়েছে। আমার মনের অবস্থা বুঝে কাল ছবিগুলো পাঠাল মার্টিন।
ল্যাপটপের স্ক্রিন জুড়ে হাসছে চন্দ্রকণা, সেদিকে তাকিয়ে আচমকা অঞ্জলি বলে উঠে; এই সন্তানটি তোমার আর জায়েদের হতে পারতো, পারতো না?
এত দিন ধরে একটি সরল অংক মেলানোর জন্য সূত্রের অভাবে অঞ্জলিকে অনেক গলদঘর্ম হতে হয়েছে। আজ গরল অংকটি সরলভাবে মিলে যাওয়ার আনন্দে দীর্ঘ দিন ধরে ঝেঁকে বসা জ্বর ঘাম দিয়ে ছেড়ে যায় ওকে। অঞ্জলির নিজেকে ভারমুক্ত লাগছিল, সুমনকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ গল্প বানিয়ে শুনিয়েছে জায়েদ ওকে, যাতে ওর গোপন করা সম্পর্ক বিষয়ে জানতে না পারে। তাই গত পরশু রাতে সুমনের ফিরে আসার কথা শুনে ভড়কে গিয়েছিল সে! নিজের সহজাত যৌনাকাঙ্ক্ষাকে জায়েদ নিজেই সহজ ভাবে নিতে পারেনি, সমাজের কাছে তা লুকানোর জন্য সে অঞ্জলিকে বিয়ে করেছে। হঠাৎ করে অঞ্জলি বুঝতে পারে, ওর সঙ্গে জায়েদের কোনো স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক ছিল না, যতটুকু যৌনতা না করলে সমাজের চোখে ধুলো দেওয়া যায় না তেমন একটি যৌন সম্পর্ক নিজের অনিচ্ছায় জায়েদ ওর সঙ্গে গড়ে তুলেছিল। জায়েদ যদি উভয়গামীও হতো তাহলেও হয়ত ওদের মধ্যে একটি স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারতো কিন্তু সে বরাবরই অঞ্জলির শরীরের প্রতি নির্লিপ্ত থেকেছে আর দোহাই দিয়েছে ধর্মের! অঞ্জলিকে বুঝিয়েছে, শরীর নিয়ে এতো উচ্ছ্বাস ঠিক না, এতে আল্লাহ্ নারাজ হন। নির্বোধ অঞ্জলির একবারও ভাবনায় আসেনি, আল্লাহ্ নারী-পুরুষকে পরাস্পরিক শারীরিক আকর্ষণ বোধ দিয়েছে যদি তবে কেনো তাদের শারীরিক উচ্ছ্বাসকে মেনে নিতে এতো আপত্তি? পৃথিবীতে নিত্য ঘটতে থাকা ভয়ঙ্কর সব অনাচার বাদ দিয়ে কে কার শরীর নিয়ে কতটুকু মেতেছে তা দেখার জন্য সাত আসমানের ওপর থেকে টেলিস্কোপ সেট করে বসেছেন আল্লাহ্! নাকি সে নিজেই ইচ্ছে করে অজ্ঞ হয়েছিল? জেনে ঝামেলায় পরার চাইতে হয়ত অজ্ঞতাকে ভালো আশ্রয় হিসাবে আকড়ে ধরেছিল।
জায়েদ একজন সমকামি হয়েও সমাজের দৃষ্টিতে নিজেকে পুত-পবিত্র দেখানোর মানসিকতা থেকে প্রবল অনীহায় অঞ্জলিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে নিপুণ অভিনয়ে,শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে সে-কতটা নিম্ন রুচির আর ধূর্ত বুদ্ধির হলে একজন মানুষ অন্য একজনের সঙ্গে এমন অনাচার করতে পারে! অঞ্জলির নিজেকে অপব্যবহৃত নোংরা মনে হয়, জায়েদের বানিয়য়ে বলা মিথ্যা গল্পের কথা ভেবে ঘৃনায় রি রি করে ওঠে।
না পারতো না। আমাদের মাঝে শারিরীক সম্পর্ক থাকলেও তা ছিল অপরিণত আর অস্থায়ী সম্পর্ক। আমি আর জায়েদ দু’জনেই সে সময় সদ্য কৈশোর উত্তির্ণ তরুণ ছিলাম,একটি সম্পর্ককের মাঝে শারিরীক চাহিদা ছাড়াও বিশ্বাস, আস্থা নির্ভরতার মতো কিছু বিষয় থাকে যা আমাদের মাঝে কখনও ছিলো না। শরীর ছাড়া আমাদের আর কোনো মতাদের্শের মাঝে মিল ছিল না। পরে আমি বুঝেছিলাম, আমার সিলেকশন ভুল ছিলো। আমার এও মনে হয়েছে,জায়েদ সমকামি নয়,আমার সঙ্গ ওর সম্পর্ক হয়ত একটি এক্সপেরিম্যান্টাল কিছু ছিলো। আর তোমাকে যখন ভালোবেসেছিলো নিশ্চয় তোমার শরীরকেও ভালোবেসেছে।
অঞ্জলি ওর দীর্ঘশ্বাস গোপন না করে তা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বলে, জায়েদ আমাকে ভালোবেসেছে কিনা জানি না তবে ও কখনোই আমার শরীরকে ভালোবাসেনি। সমাজের সামনে নিজের প্রবৃদ্ধিকে লুকানোর উপায় হিসাবে ও আমাকে ব্যবহার করে এসেছে। তোমার সাথে তার যা সম্পর্ক ছিলো তাও সে অসম্মান আর ঘৃণা করেছে। সে কত বড় প্রবঞ্চক!
সরি অঞ্জলি।
কেনো?
সুমন অঞ্জলির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি অনেক সহজ সরল বুদ্ধির একজন মানুষ।যা হয়ত এই সময়ের সাথে যায় না।
হয়ত তাই। একজন মানুষের প্রবৃদ্ধি জানতে এক যুগ পার করে দিলাম। তোমার মতো আমার সিলেকশনও ভুল ছিলো বুঝতে এতোটা সময় নিলাম,অঞ্জলি হাসে।
শুধু কী তাই? এখন আমার মনে হচ্ছে, তুমি হৃদয়ে এক মতাদর্শ ধারণ করো আর তোমার যাপিত জীবন সম্পূর্ণ উল্টো এক মতাদর্শের মাঝে। ওহ্ নো সুইটি! তুমি তো ভেতরে ভেতরে ভীষণ ক্ষয়ে যাচ্ছ! অথচ আমি কিনা তোমার সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা করে তোমাকে এড়িয়ে যেতাম। তোমার ওপর রাগ হচ্ছিল আমার; জায়েদের স্ত্রীর ওপর রাগ। যদি না কণকভাই বলতেন…।
কী বলেছে চাচ্চু?
কনকভাই আর আপা ক’দিন আগেই বলছিল, তুমি কী করে এখনও জায়েদের সঙ্গে এতটা সময় ধরে আছো। কনকভাই বলছিলেন, তোমার এবার বেরিয়ে আসা উচিত, তবে সমস্যাটি তুমি নিজে উপলব্ধি করে তোমার যা সঠিক মনে হয় তেমন একটি সিদ্ধান্ত নেবে তিনি তা আশা করেছিলেন।
আমি কী বোকা!
সত্যি কি বোকা!তুমি কী কিছু বুঝোনি? কিছুই জানো না?
কিসের বুঝা আর জানার কথা বলছো সুমন?
জায়েদ কী করে তার কিছুই তুমি জানো না?
জানবো না কেন! অবশ্যই জানি,ও ব্যবসা করে।
আর ?
আর ! আর কী করবে? ধর্মীয় একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছে সে,ওদের কাজ সহী্হ কোরাণ পাঠ,কোরাণের বিকৃতি ঠেকানো, সহীহ হাদিস সংগ্রহ এসব। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন দেশে বিদেশে তাবলীগের দলের সঙ্গে আসা যাওয়া করে। এই তো।
হুম, কনকভাই ঠিকই বলেছেন, তুমি আসলেই কিছু জানো না। তুমি একটি বোকা মেয়ে,সুমনের কণ্ঠে ক্ষুব্ধ শোনায়।
আর অঞ্জলির কাছে সুমনের কথা হেঁয়ালীর মতো লাগে, মনে হয়;ও যেন অন্ধকার কক্ষে হাতড়ে দিয়াশলাই’র একটি কাঠি খুঁজছে।
তুমি কি বিশ্বাস করতে পারবে জায়েদের সংগঠনই কনকভাইকে হত্যা করতে চেয়েছে?
আচমকা ঘরে যেন বোম ফাটায় সুমন, প্রবল এক ধাক্কায় অঞ্জলি হতজ্ঞান হয়ে পরে, সে বোবা দৃষ্টিতে সুমনের দিকে তাকায়, এটা কী করে হয়!
ধুম করে নীরব হয়ে সময় যখন আটকে পরছিলো সে মুহূর্তে অঞ্জলির মোবাইল ফোনটি টেবিলের ওপর তুলকালাম যান্ত্রিক স্বরে বেজে উঠলে ওরা দু’জনেই চমকে ওঠে। ওদের নির্বাক হয়ে পরার কারণ ছিল, সুমন ভাবছিল; অনুমাণ করা একটি ইনফরমেশন ঠিক এই বিপর্যস্ত সময়ে অঞ্জলিকে জানানো কতটা ঠিক হলো তার। হয়ত ঘটনাটি জায়েদের সংগঠন ঘটাতে চেয়েছে কিন্তু তার মানে এও তো নয়, বিষয়টি জায়েদ জানে বা সে এর সঙ্গে জড়িত। আর দীর্ঘ দিন এক সঙ্গে বসবাস করা সঙ্গী সম্পর্কে এমন অপ্রিয় তথ্য কীভাবে অঞ্জলি গ্রহন করবে তাও আর একবার ভেবে নেওয়া উচিত ছিল। আর অঞ্জলির মনে হলো, ওর বোধ বারবার টেনিস বলের মতো এক একবার কঠিন কংক্রিটে আছড়ে পরছে আর নতুন নতুন উপলব্ধি নিয়ে বারংবার ফিরে এসে ওকে বিমুঢ়, হতবাক তথা বেকুব বানিয়ে ছাড়ছে!
ফোন করেছে অঞ্জলির বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান, ওর ভুরু কুঁচকে ওঠে; এই ভদ্রলোক কখনও তেমন ফোন করেন না। আর কয়েক দিনের ছুটি চেয়ে ও নিজেই সকালেই মেইল করে দিয়েছে। ফোন অন করে হ্যালো বলতেই ওপাশে ভদ্রলোক আনন্দে হৈচৈ করে ওঠে, তারপর বলে; আরে কোথায় আপনি বলুন তো?
কেনো? আমি ছুটি চেয়ে সকালেই আপনাকে মেইল করেছি, পাননি?
তা পেয়েছি। কিন্তু মিসেস রেহানা সংসারে ঝগড়া ঝাটি হলে এভাবে রাগ করে কেউ বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যায়? আপনার হাসব্যাণ্ড বেচারার তো অবস্থা কাহিল! সে সকাল থেকে বসে আছে, আমি অন্য একটি মিটিং সেরে কিছুটা দেরীতে অফিসে এসে তাঁকে দেখে লজ্জিত হয়ে পরেছি। আপনার হাসব্যাণ্ডের কিন্তু স্ত্রী শোকে কাঁদো কাঁদো অবস্থা, হা হা হা। বাই দা ওয়ে,বিজন্যাসম্যান জায়েদ আযম আপনার হাসব্যাণ্ড কখনও তো বলেননি।
আপনি কী এই ইনফরমেশন জানানোর জন্য ফোন করেছেন স্যার?
আর না না। আমি আপনার হাসব্যাণ্ডকে বলেছি আপনি আমার কথা ফেলতে পারবেন না, আমি বললেই আপনি আপনার এড্রেস আমাকে জানাবেন আর মি. জায়েদ আপনাকে নিতে যাবেন।
স্যার আপনার এমন অযাচিত ধারণা হলো কেন আমি আপনার কথা ফেলতে পারবো না?
মানে!
এটি আমার আর জায়েদের মাঝে একটি পার্সোনাল বিষয়। এখানে আপনার এভাবে এন্টার আপ করা উচিত হয়নি। এন্টার আপ যখন করেই ফেলেছেন তখন জায়েদকে বলবেন, প্রয়োজন হলে আমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিবো। রাখছি।
অঞ্জলি ফোন কেটে দেওয়ার এক মিনিটের মাঝে আবার একই নম্বর থেকে ফোন এলে দ্বিধাম্বিত অঞ্জলি কল রিসিভ করলে ওপাশ থেকে জায়েদের হিসহিসে কণ্ঠস্বর শোনা যায়, তোমার খুব তেল বেড়েছে রেহানা? আমি বলে রাখছি, তোমার এই গুয়ার্তুমির জন্য তুমি ভুগবে। এখনও সময় আছে,বাসায় ফিরে আসো, আমি তোমাকে কিছু বলবো না।
অঞ্জলি কোনো কথা না বলে চুপ করে জায়েদের কথা শুনতে গিয়ে রাগে কাঁপতে থাকা মুখটি এখানে বসেও দেখতে পায়।
হ্যালো, কথা বলছো না কেন রেহানা?..তোমার এড্রেস বলো, আমি আসছি…
তোমাকে আসতে হবে না জায়েদ।
কেনো?
আমি আর তোমার কাছে ফিরতে চাই না।
তুমি জানো কী বলছো তুমি?
জানি। আমাদের সম্পর্কটি আমার কাছে বোঝা হয়ে গেছে, টানতে পারছি না। আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটা দু’জনের জন্য ভালো হবে।
এই ডিসিশন তোমার নাকি অন্য কেউ তোমাকে বুদ্ধি জোগাচ্ছে? অবশ্যই তোমার ডিসিশন হতে পারে না, নিজে কোনো ডিসিশন নেওয়ার ক্যাটাগরির মেয়ে তুমি না। কে তোমাকে উসকাচ্ছে? বল, নামটা বল, তার জ্বিবটা টেনে ছিঁড়ে নেবো।…তোমার ছোটচাচা?
ছিঃ! সব কিছুতে ছোটচাচ্চুকে টানা তোমার একটি অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। তাকে তোমার এতো ভয় কেন?
তোমার ধারণা নেই আমি কী। তুমি যদি ভালোয় ভালোয় বাসায় ফিরে না আস আর কোনো দিন টিনটিনকে দেখতে পাবে না, ভেবে দেখো।
টিনটিনের কথায় অঞ্জলির বুকের ভেতরটা গুমড়ে ওঠে। ও অনুভব করে, টিনিটিনের লিকলিকে হাতজোড়া ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে। ওর ভেজা নরম তুলতুলে ঠোঁটজোড়া মা’র গলায় চেপে বসেছে, বলছে, মা, আমি তোমাকে এতো এতো ভালবাসি। জায়েদের হুমকিতে অঞ্জলির কণ্ঠস্বর ভেঙে আসতে চায়,তবু নিরুত্তাপ কণ্ঠে সে বলে, এখন ফোন রাখছি।
সুমন দেখে অঞ্জলির চোখ ভর্তি জল কিন্তু এক ফোঁটাও গড়িয়ে পরছে না, ওর তা ভালো লাগে; অঞ্জলি নিজেকে ধরে রাখতে পারছে।