শামীম রুনা । চোখবন্ধ অন্ধ সময়

Share this:

উপন্যাস  ৩য় পর্ব

সাত:

  কয়েক দিনের ব্যবধানে অঞ্জলির ভাবনার জগতে উতাল পাতাল পরিবর্তন আসে,ওর মনে একটি চিন্তা ক্রমাগত চলতে থাকে, খুব দ্রুত অনেক গুলো ডিসিশান নিতে হবে। প্রথমত,ও বুঝতে পেরেছে, জায়েদের সঙ্গে সম্পর্কের সূতোটা পুরোপুরি কেটে গেছে। ছেঁড়া সূতোতে মাঞ্জা মেরে একই ছাদের নিচে দু’জনের সংসার করে যাওয়াটি ওর কাছে রুচিকর লাগছে না। কয়েকদিন আগে হলেও হয়ত অঞ্জলি সংসার করে যাওয়ার পক্ষে নিজেই নিজেকে বুঝাত। কিন্তু হঠাৎই সময় বদলে গেছে, ও বদলে গেছে; নিজেকে নিয়ে সম্মানজনক কিছু ও শেষ পর্যন্ত ভাবতে পারছে এটাই অঞ্জলির কাছে গভীর অরণ্যে পথের দিশা পাওয়ার মতো আশার আলো। জায়েদের সঙ্গে সম্পর্কে ফাঁটল ধরেছে, এই ফাঁটল আদৌ ঠিক হবে বলে অঞ্জলি মনে করেনা। আবার এই মুহূর্তে সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে জায়েদের সঙ্গেও কথা বলা যাবে না, জায়েদ বা জায়েদের পরিবারের কেউ অঞ্জলির এই মনোভাব মেনে নেবে না; ওরা অঞ্জলির মনোভাবের পক্ষে কিছু মেনে নেওয়াকে নিজেদের হার হিসাবে দেখবে, ভাববে, এমন ভাবনা ধর্মকে অবমাননা; পুরুষদের অসম্মান করা । অঞ্জলিকে এই রকম ভাবনা থেকে বিরত করার জন্য প্রয়োজনে জায়েদ অনেক দূর পর্যন্ত যাবে। সে সঙ্গে জায়েদ ওর সঙ্গে কোনো রকম চ্যালেঞ্জে আসলে অঞ্জলি তার মুখোমুখি হওয়ার মতো সাহস এখন রাখে। কিন্তু সমস্যা হলো টিনটিনকে নিয়ে। জায়েদ যদি একবার অঞ্জলির মনোভাব বুঝতে পারে তবে টিনটিনকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে ফেলবে, হয়ত সারা জীবনে ও আর ছেলেকে দেখতেও পাবেনা, টিনটিনও দেখতে পাবে না মা’কে; অথচ ছোট টিনটিন মা ছাড়া কিছু বুঝতে চায়না। অঞ্জলির টিনটিনকে না দেখে থাকতে যতটা না কষ্ট পাবে তারচে’ বেশি কষ্ট পাবে, টিনটিনের আর একজন জায়েদ হিসাবে বেড়ে ওঠাতে। ওটা অঞ্জলি কখনও মেনে নিতে পারবেনা।
অঞ্জলির মনে হয় ওর প্রথম প্রয়োজন নিজের একটি বাসার ব্যবস্থা করা তারপর টিনটিনকে যে কোনো ভাবে নিজের কাছে নয়ে আসা। ওর মা এখন একা একা ওদের গাজীপুরের বাড়িতে থাকেন, মা’র কাছে গিয়ে ক’টা দিন থাকা যায়; কিন্তু হুট করে নেয়া ডিসিশান মা কীভাবে নেবে ওর জানা নেই। তাছাড়া ওর জন্য জায়েদ বা ওর পরিবারের কাছে মা’কে অযথা হয়রানি দিতে অঞ্জলির মন চায়না। কী করা যায় ভাবতে গিয়ে অঞ্জলির মনে হয় ওর একজন বন্ধুও নেই যার কাছে গিয়ে ও একটু স্বস্তি পায়, নিজের ভার লাঘব করতে পারে।
ছোটচাচার কথা মনে পড়ে, এক সময় চাচ্চু ওর বন্ধু ছিল বটে; সে বন্ধুত্ব ও নিজের হাতে কবে শেষ করে দিয়েছে। তাছাড়া এখন ছোটচাচার ওপর দিয়ে যে ঝড় যাচ্ছে সে সময় নিজের ঝড়ের কথা তাঁকে বলে আর টেনশন বাড়ানোর মানে হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ শেষ করে বেরিয়ে অঞ্জলির ঘরে ফিরতে মন চায়না, ইচ্ছে করে অন্য কোথাও গিয়ে পরিচিত জগৎ থেকে লুকিয়ে থাকে; কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে গিয়ে অঞ্জলি পুণরায় আবিষ্কার করে, এই শহরে ও একেবারেই বন্ধুহীন। তখনই ওর মনে হয়, একবার মা’কে দেখতে গাজীপুর যাওয়া যায়, অনেক দিন মায়ের সঙ্গে দেখা হয় না। অঞ্জলি গাড়ীতে উঠলে ফোনটি বেজে ওঠে, স্ক্রিনে ‘সুমন’ নামটি প্রথমে অচেনা লাগলেও পর মুহূর্তে ও কল রিসিভ করে আন্তরিক কণ্ঠে বলে, কেমন আছো সুমন?
অপর পাশ থেকে সুমনের কথা শুনে বলে, আমি গাজীপুর যাচ্ছি, মা’কে দেখতে। মা তো তোমাকে চেনে, তোমাকে দেখলে খুশী হবে; চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারো।
নিকুঞ্জ থেকে সুমনকে নিয়ে গাজীপুর মা’র বাড়ি যখন অঞ্জলি পৌঁছায় তখন দুপুরের বেলা গড়িয়ে বিকেলে এসে দাঁড়িয়েছে। না বলে হুট করে মেয়ের বাড়ি আসা মা’র কাছে হঠাৎ উপহার প্রাপ্তির মতো মনে হয়। সুমনকে মা আন্তরিক ভাবে আপ্যায়ণ করে, বলে; অনেক দিন হলো, মেয়েদের বন্ধুদের আর দেখিনা। মেয়েকেও তো দেখলাম অনেক দিন বাদে।
মা, কিছু খাওয়াবে?
কী খাবি?
ভাত খাবো। সুমন খাবে তো?
খাবো।
তরকারী আছে, ভাতটা রান্না করতে হবে; বেশি সময় লাগবেনা।
চলো আমি তোমাকে হেল্প করছি। সমুন একা বসতে অসুবিধা নেই তো?
কী যে বলো! আমি বরং মেইলটা চেক করি।
সুমন ওর ট্যাবে ব্যস্ত হয়ে যায়। মা’র সঙ্গে রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে অঞ্জলি দেখে বাড়ির পেছনে এক চিলতে উঠানে কয়েকজন নারী পাটি বিছিয়ে কিছু কাপড় কাটা-কাটি করছে, পাশে তিন চারটে সেলাই মেশিনে কয়েকজন সেলাই করছে।
মা, এরা কারা?
আমাদের সমিতির নারীরা।
তোমাদের সমিতি মানে?
অঞ্জলির কথায় মা কিছুটা লজ্জা পান, রান্না ঘরে ভাতের পাতিলে চাল মেপে দিতে দিতে বলেন, সারা দিন তো একাই থাকি। কিছু করার নেই। আশে পাশের এই দরিদ্র নারীদেরও কোন কাজ কর্ম নেই। বাড়িতে থাকে, দু টাকা পাঁচ টাকার জন্য স্বামীর কাছে হাত পাতে, সব সময় সে টাকাও পায়না। বরং কথায় কথায় চড় থাপ্পড় আর মারধোর জুটে। আবার স্ত্রীদের বাড়ির বাইরে কাজ করতেও দেয়না। তাই ভাবলাম ওদের জন্য যদি কিছু করা যায়। ওরা যে যা হাতের কাজ পারে, তাই করে। কাজ বুঝে নিয়ে কখনো এখানে বসে করে আবার বাড়িতে নিয়ে গিয়েও অবসর সময়ে করতে পারে। অর্ডারি জামা-কাপড় সেলাই করে, কিছু রেডিমেড ড্রেস স্থানীয় মার্কেটে বিক্রি হয়, কাঁথা, অর্ডারি চাদর ফাদর এইসব করে আর কী। ওরা কাজ করে আমি বিক্রি টিক্রি ব্যবস্থা করে দেই। এতে করে মাস শেষে ওদের আয় মন্দ না। সব চেয়ে বড়ো কথা,উপার্জন করে বলে পরিবারেও কদর পায়।
মা হাসে, অঞ্জলি মুগ্ধ চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, অবিশ্বাস্য! মা, তুমি তো বিশাল কাজ করছো!
বিশাল কিনা জানিনা রে। সারা জীবন তো বুঝে না বুঝে কত কী করলাম। বোকার মতো অনেক ছুটলাম। আমি নিজেই জানতাম না আমি কী চাই। বাবার পরিবার থেকে এসে স্বামী শাশুড়ীর ছায়ায় বিবর্ণ আর সজীবতা ছাড়া বেঁচে ছিলাম। যদিও তোর বাবা উদার মনের মানুষ ছিলেন কিন্তু সেও কখনও আমার মনের খোঁজ করেননি। সেও তো নিজের মুক্ত দৃষ্টিভঙির প্রয়োগ করে গেছেন আমার ওপর, তাই না? কখনও আমার কোনো পছন্দ-অপছন্দ ছিলো না, সব সময় কারো না কারো পছন্দ মতো চলেছি। এই পরিণত বয়সে এসে, একা একা সিদ্ধান্ত নিয়ে যা করছি তাতে আমি সুখ পাচ্ছি। আনন্দ পাচ্ছি। এটাই বা কম কী।
অঞ্জলি বিস্ময় নিয়ে মা’কে দেখে,গাঢ় বেগুনী রঙের চওড়া পাড়ের তাঁতের শাড়ী পরে আছেন, তাঁর শ্যামবর্ণের লম্বা ধাঁচের কর্মট হাত জোড়ায় চুড়ি বা কানে কানফুল নেই, তারপরও মা’র ব্যক্তিত্ব সেই সাদামাঠা পুরোনো স্কুল শিক্ষিকার চেয়ে এখন আরো বেশি প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছে। এক সময় শাশুড়ী চাইত বলে মা শাশুড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন আর স্বামীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে বাইরে বেরুনোর সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দাজে কপালে টিপ পরে নিতেন। সে মা এখন নিজে অন্য নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তুলেছেন। অঞ্জলির বুকের ভেতরটা হঠাৎ আবেগে কাঁপতে থাকে, কতটা সময় পার হলে একজন মানুষকে চেনা যায় বা একজন মানুষ নিজেকে চিনতে পারে!
মা টেবিলে তরকারীর বাটি রেখে নিজেও একটি চেয়ারে অঞ্জলির পাশে বসেন, তোর আর জায়েদের মধ্যে কি কোনো সমস্যা চলছে?
তুমি কী করে জানলে?
জায়েদ ফোন করেছিল। বলল, ও চায়না তুই চাকরী করিস।
জানি।
জায়েদ চায়না, তুই তোর চাচ্চুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস…
তুমি কী বললে মা?
বললাম, এসব তোর ব্যাপার। আমার কথায় ব্যাজার হলো বুঝি।
মা, এসব নিয়ে জায়েদ খুব চাপ দিচ্ছে। ওর এসব এ্যাটিটিউটের কারণে আমার ভীষণ মেন্টাল স্ট্রেচ নিতে হচ্ছে। চাকরীটা আমার একমাত্র ভেন্টিলেশন। চাচ্চুর সাথে অনেক দিন যোগাযোগ রাখিনি শুধু জায়েদ পছন্দ করেনা বলে। কিন্তু তুমি তো জানো চাচ্চুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা আর চাচ্চুর এই সময়….মা, আমার নিজের একা ভাবার কিছুটা সময় দরকার।
মা অঞ্জলির হাতের ওপর হাত রাখে,অঞ্জু, জীবন একটাই। নিজের মতো করে বাঁচ। নিজের মন যা ঠিক বলে তাই কর। পাছে লোকে কিছু বলে বা সমাজ কী বলবে এসব একবিংশ শতাব্দীতে এসে ভাবলে চলেনা। শুধু জানিস, তোর মা সব সময় তোর সঙ্গে আছে। তোর ওপর আমার আস্থা আছে।
ফেরার সময় মা যখন অঞ্জলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে তখন ওর মনে হয় মা’র বুকের ভেতর থেকে একটি তাপ ওর নিস্তেজ হয়ে আসা বুকের ভেতরে যেন উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই প্রথম মা’র সন্তান হওয়ার কারণে ওর ভেতরে দারুণ এক গর্ব অনুভব করে।
গাজীপুর থেকে ফেরার পথে গাড়িতে সুমনকে অন্যমনষ্ক দেখায়, একটু গম্ভীর;কিছু ভাবছিলো। সুমন কখনও অঞ্জলির তেমন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলনা, জায়েদের বন্ধু ছিল; সে সূত্রে ওরও বন্ধু। সেদিন হাসপাতালে চাচ্চুর পাশে সুমনকে দেখে অনেক বেশি ব্যক্তিত্ববান আর দায়িত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ মনে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অস্থির আর কারণে অকারণে বন্ধুদের ক্ষেপানো চঞ্চল তরুণটি নয় কিছুতে। হয়ত অনেকটা সময় আর অভিজ্ঞতা পেরিয়ে আসার ফলে সুমনের আজকের এই ব্যক্তিত্ব। সুমনের এই ব্যক্তিত্ব অঞ্জলির ভাল লাগে।
অঞ্জলি, চলো; কোথাও বসে এক কাপ কফি খাই? ওদের গাড়ি উত্তরায় আসলে সুমন প্রস্তাব করে। অঞ্জলি পরিচিত এক কফি শপের কথা বললে ড্রাইভার গাড়ি সেদিকে নিয়ে যায়।
কফির অর্ডার দিয়ে দু’জনে একটি টেবিল দখল করে বসে কোনো ভনিতা ছাড়া সুমন বলে, তোমার সঙ্গে কিছু কথা শেয়ার করি অঞ্জলি।
সুমনের কথা শুনে অঞ্জলির বহু আগে বন্ধু সম্পর্কে বলা জায়েদের কথা মনে পরে যায়। পর মুহূর্ত সে চিন্তা ধাঁ করে আবার ওর ভাবনার জগৎ থেকে পালায়ও, সুমন নিশ্চয় ভার্সিটি পড়ুয়া সে তরুণটি নেই অনেক বছর বাদে স্বপ্নের প্রেমিকাকে দেখে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছ! নিজের অপ্রাপ্ত বয়স্ক চিন্তায় অঞ্জলি নিজের মনে হাসে।
বলো। দ্বিধার কণ্ঠে অঞ্জলি সম্মতি দেয়।
আমরা খুব দ্রুতই কনকভাইকে দেশ থেকে সরিয়ে নিতে চাচ্ছি। বুঝতেই তো পারছ, এই দেশটা তার জন্য কোনো ভাবেই সেপ্ নয়, তিনি এখন টোট্যালি রিস্কে আছেন।
তাই তো দেখছি। কিন্তু কোথায় সরিয়ে নিবে চাচ্চুকে?
দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশে। এদেশ তার মতো মানুষদের জন্য আগেও সেপ্ ছিলনা এখন তো আরও নয়। হি লাকিলি সারভাইভড…
ও। তোমাদের কি মনে হয়, চাচ্চুকে সরিয়ে নিলে এই ক্রাইসিস সলভড্ হবে? মানে দেশে তো তার মতো চিন্তাধারার অনেকে আছেন, ওদের কী হবে? তোমরা কি সবাইকে সরিয়ে নিতে পারবে? আর সবাই যদি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় তাহলে দেশের কী হবে?
সুমন বলে, যদিও আমরা দেশের জন্য কাজ করছি। দেশের সব শুভবুদ্ধির মানুষই দেশের সম্পদ। তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। সরকার কতটা করছে তা তো আমরা সবাই দেখছি। কিছু কিছু মানুষ আর সংস্থা এই শুভবুদ্ধির মানুষদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সবাইকে সরিয়ে নেয়া যেমন সম্ভব নয় তেমনি উচিতও নয়, তেমন দিন আসার আগে নিশ্চয় দেশের এই সব উগ্রবাদ, মৌলবাদ সমস্যা দূর হবে। তবে আমরা এই মুহূর্তে কনকভাইর নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তিত। আপাতত ওকে নিরাপদ কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাই তারপর তিনি সুস্থ্য হয়ে নিজেই ঠিক করবেন কোথায় থাকবেন।
অঞ্জলি বলে, শুধু চাচ্চু নিরাপদ হবে। অনেকের ক্রাইসিস থেকেই যাচ্ছে…
সুমন বলে, ঠিক।
অঞ্জলি কিছুটা দ্বিধাম্ভিত স্বরে বলে চাচ্চু, তুমি তোমরা যারা ফ্রি থিংকার বা মুক্তচিন্তার কথা বলে চেঁচাচ্ছো তোমাদের সাথে সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিরোধীতার জন্য উদ্বুত সমস্যার সমাধান হবে কি?
সুমন চিন্তিত দৃষ্টিতে অঞ্জলির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, অঞ্জলি, তুমি কি শ্লেষ করে কিছু বলতে চাইছো? সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারনার সঙ্গে তো ফ্রি থিংকিং মতবাদের কোনো সমস্যা নাই। সমাজটা তো সবাই’র, আমার, তোমার আমাদের সবাই’তাই না? আর সাধারণ মানুষ যারা, খুব সাধারণ, তারা তো জানেই না মুক্তচিন্তা মতবাদ কী বা ধর্মের কূপমন্ডুকতা কী। ওরা ওদের মতবাদ নিয়ে আছেন, নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে আছেন। যুগ যুগ আগে প্রবর্তিত ধর্মগ্রন্থগুলো যেমন একবিংশ শতাব্দীতে পুরোপুরি সঠিক হতে পারে না তেমনি ধর্ম বিশ্বাসও এমন ঠুনকো হবে কেন যা কয়েকজন মানুষের কথায় হেলে পড়বে। ধর্ম ব্যবসায়ী বা বক ধার্মিকরা ধর্মের ভয়াবহতার অশরীরি গল্প বুনে শুনাচ্ছে আর সাধারণ মানুষদের বুদ্ধিমত্তাকে বনসাই করে নিজেদের প্রভুত্ব বজায় করছে- এটাই তো পৃথিবীর আদি অন্ত রূপ তাই না? আর এই নিয়মের বিরুদ্ধে যুগে যুগে কিছু মুক্তিকামী মানুষ বিরোধীতা করে এসেছে, কখনও ওরা জয়ী হয়েছে আর কখনও সব অত্যাচার সহ্য করেও লড়াই চালিয়ে গেছে। বর্তমানেও তেমন এক লড়াই চলছে।… সাইন্স বলে, পৃথিবী ক্রমাগত বদলাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ধ্যান-ধারণা-মতবাদেরও পরিবর্তন হবে, এটাই স্বাভাবিক, তুমিও তা জানো। পরিবর্তনের হাওয়াটাকে যুক্তি আর বিজ্ঞানের আলোকে বিচার করাটাই তো মুক্ত চিন্তা। এর পক্ষে কথা বলাই মুক্ত বাক। সাইন্স আর লজিকের বাইরে পৃথিবীতে কোনো কিছুই ঘটছে না, সাইন্স লজিক নিয়ে ওরা কথা বলতে আসুক, তর্ক করুক, যুক্তি দিয়ে যুক্তি খণ্ডান করুক। যুক্তি দিয়ে পারবে না তাই হত্যা করবে? যুক্তি খণ্ডন করতে না পারার দণ্ড খুন করা-এটা সঠিক বিচার নয়। লজিকের বাইরে আমরা কোনো কিছু ভাবছি না যেমন তেমনি প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব ভাবনা চিন্তার করার স্বাধীনতা রয়েছে বলেও আমরা মনে করি। তোমার কাছে যা ঠিক বলে মনে হবে তুমি তাই করবে, তুমি কেনো আমার অসাড় কূপমন্ডুক মতবাদ আঁকড়ে থাকবে? ….অঞ্জলি, তুমিও এমন মনে করো বলে আমার ধারণা। তারপরও, তোমার ভাবনা চিন্তা অন্যের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কেউ তোমাকে বুঝাচ্ছে, এভাবে চলোনা, এভাবে বলোনা, এভাবে ভেবোনা, এভাবে ভাবে চলা-বলা-ভাবা নারীকে মানায় না, আর তুমি তাই মেনে নিচ্ছ। তুমি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছ সারা পৃথিবী থেকে। নিজের ভাবনার জগৎকে একটি গণ্ডির মাঝে আটকে রাখছো।
অঞ্জলি ভাবেনি সুমন ওকে এভাবে কথা দিয়ে আক্রমন করবে। ও প্রতিবাদ করতে যেয়েও চুপ করে যায়। সুমনের  কথাগুলো ওর মনে হয় চাচ্চুর বই’র কোটেশন বুঝি। হঠাৎ ঝুপ করে ওদের মাঝে নীরবতা নেমে আসে,ওয়েটার এসে টেবিলে দুই কাপ কফি রেখে যায়। অঞ্জলি সুমনের দিকে কফির কাপ এগিয়ে দিতে দিতে জানতে চায়, তুমি কী করে বুঝলে আমার ভাবনা-চিন্তা অন্যের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে?
সুমন অঞ্জলির মুখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বলে, তোমাকে বুঝা কী কঠিন কিছু? তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। একজন মানুষ কী করে এতটা বদলাতে পারে নিজের শিক্ষাবোধ আর বিবেচনাকে বিসর্জন দিয়ে! আমি তোমাকে কনকভাই’র দেশ ছাড়ার বিষয়টি জানাতে চাইনি। তোমার ওপর আস্থা হচ্ছিল না, কিন্তু কনকভাই বললো,তুমি নিরাপদ। তিনি চাইছেন, তুমি উনার দেশ ছাড়ার বিষয়টি জানো।
অপ্রতিভ কণ্ঠে অঞ্জলি বলে, চাচ্চু এখনও?
সুমন হাসে, হয়ত কনকভাই বুঝে তোমাকে, আমরা বুঝি না ।
কফি শেষ করে টেবিল ছেড়ে ওঠার আগে সুমন অন্য রকম প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় অঞ্জলির উদ্দেশ্যে,
জায়েদের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?
অঞ্জলি বিস্মিত হয়, এই প্রথম সুমন জায়েদ সম্পর্কে কিছু একটা জানতে চাইলো তাও এমন একটি প্রশ্ন! ওদের দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে সুমন এমন অস্বস্তিকর প্রশ্ন করবে ভাবেনি অঞ্জলি। উত্তর দিতে গিয়ে অঞ্জলি দ্বিধায় পরে যায়, তাই ও ইতস্তত স্বরে বলে, কেনো?

আট :

 বেশ কিছু দিন হয়ে গেল জায়েদ অঞ্জলির সঙ্গে ঘুমায় না, নিজের রিডিং রুমেই থাকে। কয়েক দিন পর সে রাতে জায়েদ বেডরুমে এসে ঢুকলে অঞ্জলির সারা শরীর আক্রান্ত হরিণীর মতো সতর্ক হয়ে ওঠে। অন্তত, আজ রাতটা ও জায়েদের সঙ্গে কোনো রকম শারিরীক ক্রিয়ায় যেমন লিপ্ত হতে চায় না তেমনি বাক-বিতণ্ডায়ও জাড়াতে চাইছিল না, সারা দিন নিজের মতো করে কাটিয়ে; মায়ের ওরকম স্বাধীন জীবন যাপন আর সুমনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ এক সন্ধ্যা আড্ডার পর জায়েদকে জীবন্ত ফসিল আর ক্লান্তিকর মনে হচ্ছিল। মন চাইছলো, এক দৌড়ে এই ঘর-সংসার-গৃহকোণ ছেড়ে পালায়, কিন্তু চাইলেই নারীর সব ইচ্ছে পূরণ হয় না।
রাতের খাবারের পর টিনটিনকে জায়েদ ওর মা’র ঘরে গল্প শোনানোর ছলে নিয়ে যায় আর পরে বুয়া জানিয়ে যায় টিনটিন দাদীর ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। অঞ্জলি ল্যাপটপে কান্দিল বালোচের ওপর একটি আর্টিক্যাল পড়ছিল, স্ক্রীনে চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে ভাবে; মা-ছেলের নিখুঁত ছককাটা প্লানিং। জায়েদ উগ্র আঁতরের গন্ধ নিয়ে আর্ম চেয়ারটিতে বসে নীরবে কিছু সময় চোখ বুঁজে দুলতে থাকে, অঞ্জলী ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে সতর্ক হয়ে ওঠে। নিজের অজান্তে ও নিজেকে কান্দিল বেলোচের স্থানে আবিষ্কার করে মুহূর্তের জন্য, কান্দিল বালোচ নিজ বাসায় আপন ভাই’র হাতে খুন হয়েছিলো। কান্দিল বেলোচ ভাই’র সঙ্গে শৈশব-কৈশোর হয়ত তারুণ্যেও অনেকটা সময় নি:শ্চিত আনন্দে কাটিয়েছিল, ক্ষণিকের জন্যও কি কান্দিলের মনে হয়েছিল ভাই ওকে কখনো খুন করতে পারে? নিশ্চয় মনে হয়নি; তাই যত বচসা হোক ভাই’র সঙ্গে একই বাসায় সে ছিল, কিন্তু ওর ভাই ধর্মীয় উন্মাদনায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ওর কাছে ভাই বোনের সম্পর্কের চেয়ে পরিবারের সম্ভ্রম, বংশ মর্যাদা আর ধর্ম বিকট রূপ ধারণ করেছিল।
অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসের তাণ্ডব অঞ্জলির চোখের সামনে ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে আর ও ততই ভেতরে ভেতরে আতংকিত হয়ে উঠছে। ওকেও জায়েদ খুন করতে পারে, ওকে খুন করে জায়েদ তা সমাজের সামনে জায়েজও করে তুলতে পারবে-ভাবতেই অঞ্জলির শিরদাঁড়া বেয়ে হিম পানির ধারা নেমে আসে। আমাদের সমাজে হর হামেশা স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন হচ্ছে তারপরও এই মুহূর্তে জায়দ ওকে খুন করতে পারে এমন একটি ভাবনা মাথায় আসায় নিজেকে পঙ্কিল মনে হয়। হয়ত কান্দিলও ভাইকে এমনি ভাবে নিজের খুনী ভাবতে চায়নি। এসব ভাবনা ও মাথা ঝাঁকিয়ে উড়িয়ে দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ ভাবে, আজও জায়েদ চাকরী ছাড়ার কথা তুলে ঝগড়া করবে নাকি অন্য কিছু?
তোমার মাসিকের পর আজ কত দিন পার হলো?
জায়েদের আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে অঞ্জলির হতভম্ব দশা হয়। ওদের দাম্পত্য জীবনে শারিরীক সম্পর্ক টিনটিনের জন্মের পর থেকে তেমন হয়না, আর যখন হয় তা এত ক্ষণ স্থায়ী আর হাতে গোনায় যা অঞ্জলির সামান্য সতর্কতায় অবাঞ্চিত সমস্যা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। পরস্পরের শরীর নিয়ে ওদের মাঝে যেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই তেমনি এই সম্পর্কে দীর্ঘদিন কোনো কথাবার্তাও হয়না। হঠাৎ জায়েদের এমন প্রশ্নের কারণ বুঝতে গিয়ে অঞ্জলি খেয়াল করে জায়েদের শব্দ চয়ণের ধরণটি, মাসিক; রুচিসম্পন্ন কোনো পুরুষ এমন রগরগে আদি শব্দ ব্যবহার করে কথা বলতে পারে বলে অঞ্জলির ধারণা হয়না। বিতৃষ্ণায় অঞ্জলি ঠোঁট ঠোঁট চেপে ধরে। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে জায়েদ বলে, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাওনি রেহানা?
অঞ্জলি এবারও কোনো কথা না বললে জায়েদ উঠে ও’র পাশে এসে দাঁড়ালে আতরের ঝাঁজালো গন্ধে ও’র গা গুলিয়ে ওঠে। জায়েদ ভাল করে জানে, অঞ্জলি কড়া গন্ধ সহ্য করতে পারেনা, তারপরও! তবে কি বিবাদ করার জন্য উজিয়ে আছে জায়েদ; প্রশ্নটি মনে আবার ঠোকর কাটে,কী নিয়ে? মনে হচ্ছে চাকরী না, অন্য কিছু; কী তা?
জায়েদ নিচুকণ্ঠে বলে, তোমার সাথে আমার কথা আছে। ওটা বন্ধ করো।
অঞ্জলি খুব বাধ্যগত হয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে জায়েদের মুখোমুখি হয়, ও শুনতে চায় জায়েদের কথা। ওকে নিয়ে জায়েদের বর্তমান প্রতিটি ভাবনা জানা ওর প্রয়োজন।
স্ত্রীর গত কয়েক দিনের তেড়িয়া রূপ সামনে বসা রেহানার মাঝে না দেখে জায়েদ মনে মনে একটু হোঁচট খায়। ও ভেবেছিল, রেহানা ফুঁসে উঠবে, কণ্ঠ দিয়ে কথার ঝাঁঝ বেরুবে। সে স্ত্রীর পছন্দ অপছন্দের ধার ধারেনা বুঝাতেই আজ আতর লাগিয়েছে শরীরে। এখন কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে সে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায়, তবে কি সব বিভ্রান্তি ভুলে ওর হাতে গড়া রেহানা আবার আগের রেহানা হয়ে উঠেছে? কিন্তু জায়েদ স্ত্রীর মধ্যে স্নিগ্ধতা আর প্রসন্নতার পাশাপাশি শাণিত এক দৃঢ়তাও দেখতে পায়, স্ত্রীর মুখায়াভাবে এই দৃঢ়তা ওর কাছে নতুন; আগে তো কখনও রেহানাকে এত তেজস্বী মনে হয়নি! নারী এত তেজস্বী হবে কেন? এটাই কি তবে অবাধ্য স্ত্রীর লক্ষণ? মুহূর্তে ওর কণ্ঠানালীতে তিতকুটে গরল ছড়িয়ে পড়ে, ও তা নীরবে গিলে নিয়ে নিজের প্রতিটি রক্ত বিন্দুতে ছড়িয়ে দিতে দিতে সিদ্ধান্তে আসে, রেহানা বিপদগামী হয়েছে। যেকোনো মূল্যে ওকে সঠিক পথে আনতে হবে।
রেহানা, আমি আবার সন্তান নিতে চাই।
মানে!
এত অবাক হচ্ছো কেনো? আরো সন্তান দরকার আমাদের পরিবারে। তাছাড়া টিনটিনও তো বেশ বড় হয়ে গিয়েছে।
তার জন্য এমন অশ্লীল ভাবে খোঁজ খবর নিচ্ছ? আমার সঙ্গে কথা না বলে বাচ্চা নেওয়ার ডিসিশন নিয়ে নিলে?
এখানে ডিসিশন নেওয়ারই বা কী আছে আর তোমার সঙ্গে কথা বলারই বা কী আছে? আমরা স্বামী-স্ত্রী, আমাদের বৈধ সম্পর্কর মাঝে যে আসতে চায় তাকে আসতে দেওয়াই উত্তম। না আসতে দেওয়াটা ধর্ম বিরোধীও। এই পৃথিবীতে আল্লাহ্ তালা আমাদের সংসার তৈরীর অনুমতি দিয়েছেন, সন্তান উৎপাদন করার জন্য। এতদিন আমরা ভুল করে আসছিলাম, এখন বুঝে-শুনে আর ভুল করা ঠিক হবে না।
অঞ্জলির শ্রুতির মধ্য দিয়ে তপ্ত শিসা যেন ওর মগজের কোষে কোষে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পরে, এমন নিম্ন রুচির একজন মানুষের সঙ্গে কী করে ও এতটা বছর পার করে দিলো? এই লোকটিকে কী করে ও ভালোবেসে বুকে জড়িয়েছে? প্রবল ভালোবাসায় দু’হাতে আগলে ধরেছিলো? সে সব স্মৃতি উপেক্ষা করে আজ নতুন ভাবে নিজের সম্পর্কে জায়েদের মনোভাব তীব্র কটাক্ষ হয়ে ওর আত্মসম্মানে আঘাত করে। নিজেকে যোনী স্বর্বস্ব বাচ্চা জন্মদানের পাত্র মনে হয়।
আমরা কি সন্তান উৎপাদনের কারখানা দিয়েছি নাকি চাইলে যখন ইচ্ছে তখন সন্তান উৎপাদন করবো!
কারখানায় হবে কেন? সন্তান কি কারখানায় জন্মায়? সন্তান জন্ম নিবে আমাদের ভালবাসায়। জায়েদের ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি দেখা যায়। সে হাসির দিকে তাকিয়ে অঞ্জলি স্বামীর চালাকি বুঝতে পারে।
আমি এখন আবার সন্তান চাইছি না।
কেনো না রেহানা? আদর করে অঞ্জলির গালে হাত রাখে জায়েদ। অঞ্জলি জায়েদের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি এই মুহূর্তে সন্তান নেওয়ার জন্য মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড না, তাই।
এতে আবার তোমার মেন্টাল প্রিপারেশনের কী আছে?
সন্তান জন্ম দেওয়া ছাড়াও আমার অন্য কাজ আছে। আমার সময় প্রয়োজন।
কী কাজ? নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে এবার জায়েদ গর্জে ওঠে, বালের মাস্টারী করার নামে সারা দিন টো টো করে ঘুরে  ড়ানো তোর কাজ? বিধর্মী চাচাকে দেখতে যাওয়া কাজ? নাকি নতুন প্রেমিক জুটিয়েছিস তার জন্য পেটে সন্তান রাখতে চাস    না?
ছি:!
আমি কিছু বললে ছি:! আমি ছুলে ছি:! কার সাথে সারা দিন ঘুরিস তুই? মনে করিস তোর কোনো খবর পাই না আমি? জানি তো নতুন লাঙ জুটাইছিস তুই। আস্তা একটা খানকি বনে গেছিস।
হিসহিসিয়ে ওঠে জায়েদ, প্রচণ্ড রাগে ওর মুখ-চোখ বিকৃত হয়ে উঠেছে। চোখে পশুর হিংস্রতা নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে সে। জায়েদের এই হিংস্র রূপ অঞ্জলি অনেক, অনেকবার দেখেছে, কিন্তু কখনও এমন তীব্র ঘৃনা আর তাচ্ছ্বিল্য বোধ করেনি, আজ যেমন বোধ করছে। জায়েদকে ওর এই মুহূর্তে সাপের মতো বিষাক্ত আর ঘিন ঘিনে যেমন মনে হচ্ছে তেমনি ওর নোংরা ভাষার প্রয়োগ দেখে এক প্রবল তাচ্ছ্বিল্য বোধও করছে।
মনের ক্লেদ মনে রাখো। মুখ দিয়ে এতো নোংরা না উগরালেও পারো।
আমার মনে ক্লেদ! আমি কথা বললে নোংরা উগরাই? তুই পরপুরুষের সঙ্গে সারা দিন চরে বেড়ালে কিছু হয়না! আমি কথা বললে নোংরামী হয়! আজ সারা দিন যে লাঙের সাথে ঘুরলি কে সে? গোপন লাঙরে এক্কেবারে মা’র বাড়ি নিয়ে তুললি! একটুও বিবেকে আটকায় নাই? সমাজের ভয় নাই? একটুও ধর্মের ভয় নাই? শরীর এতো বড় হয়ে গেল?
অঞ্জলি অবাক বিস্ময়ে জায়েদের মুখ দিয়ে ছিটকে বেরুতে থাকা পুঁতিগন্ধময় শব্দগুলো শুনতে শুনতে স্তব্ধ হয়ে যায়। একজন মানুষের ভেতরে কতটা অন্ধকার থাকলে হড়হড় করে এমন ক্লেদযুক্ত ভাষার প্রশ্রবন হতে পারে!
যেমন মেয়ে তেমনি তার মা! সকালে ফোন করলাম, কথার এমন স্বর যেন কিছুই জানে না সে। গোপনে গোপনে মেয়ের পরকিয়া প্রেমের সাপোর্টার হয়ে আছে। ছি!
আমিও বলছি, ছিঃ! জায়েদ! তুমি আমাকে যা বলার বলো। আমার মা’কে নিয়ে আর একটি বাজে কথা উচ্চারণ করবে না।
একশো বার করবো…
না। একটি বারও করবে না।
জায়েদ স্ত্রীর ধীর শান্ত ভাষার হুমকি অগ্রাহ্য করছে ভাব দেখালেও মা’কে নিয়ে আর কোন কথা না বলে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে শাসানি দেয়, আমি দেখে নিবো।
কী দেখে নেবে? আমার কোনো বন্ধু নিয়ে বেড়াতে যাওয়া দেখে নেবে?
মেয়েলোকের পুরুষ বন্ধু মানে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
সাদা চোখে দেখলে ঠিকঠাক রঙ দেখতে পাবে।
আমি তোর ছাত্র না, আমারে সবক দিতে আসবি না ।
জায়েদ লাল চোখে অঞ্জলির দিকে তাকায়, ওর মুখের সমস্ত পেশি থরথরিয়ে কাঁপছে, হা করে নি:শ্বাস নিচ্ছে; ওর সবটা অবয়ব জুড়ে নগ্ন পাশবিকতা। অঞ্জলির জায়েদের জন্য অনুকম্পা হয়, মানুষকে ক্রোধ কতটা উন্মাদ করে তুলে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য করে দেয় তার জ্বলন্ত প্রমান।
কে লোকটা যার সঙ্গে কফি খাওয়ার সাধ হয়? জায়েদ অঞ্জলির বাহু খামচে ধরে জানতে চায়।
আহ্। ছাড়ো…
ন্যাকামি?…তোর খদ্দর?
দিন দিন তোমার অধঃপতন হচ্ছে।
আর তোর উন্নতি? খদ্দর নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছ, উন্নতি বটে।
সুমন।
সুমন! সুমন, এমন ভাবে বলছো যেন আমি সব সুমনরে চিনে বসে আছি!
তোমার বন্ধু সুমন।
আমার বন্ধু সুমন!
অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জায়েদের মুখটা ম্লান হয়ে যায়।
সুমনকে কই পেলে তুমি? ও তো দেশে থাকে না।
দেশে এসেছে। চাচ্চুকে দেখতে আসছে…
তাই তো বলি শালা নাস্তিক দেশে কেন! বুঝছি এক নাস্তিক আর এক নাস্তিকের খোঁজে আসছে।
জায়েদের মুখ দেখে অঞ্জলির মনে হয় সুমনের দেশে ফেরাটা ওর পছন্দ হয়নি। সুমনের ফেরার খবরে জায়েদকে কিছুটা চিন্তিতও দেখায়। হঠাৎ কী মনে করে ও ইচ্ছে করে জায়েদকে বাজাতে চায়,
শুধু নাস্তিকের খোঁজ নেয় নাই, তোমার কথাও জানতে চাইলো।
আমার কথা? কী জানতে চাইলো আমার কথা?
অনেক কথা। তোমাদের স্টুডেন্ট লাইফের গল্প করলো অনেক।
স্টুডেন্ট লাইফের গল্প! কী বললো?
বললো আর কী।
রাগে ফুলে ঢোল হয়ে থাকা জায়েদ ফুটো গ্যাস বেলুনের মতো হঠাৎ চুপসে যায়, নীরবে রকিং চেয়ারে গিয়ে বসে মাথা নিচু করে কিছু ভাবতে থাকে। জায়েদের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে অঞ্জলির মনে হয়,ডাল মে কুচ কালা হ্যায় ক্যায়া?

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!